০২:৫১ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ৭ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
                       

হাফিজিয়া মাদরাসা থেকে শিশু শিক্ষার্থীরা কেন পালিয়ে যায়?

মু. মিজানুর রহমান মিজান
  • প্রকাশ: ০৪:২২:০১ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ৯ এপ্রিল ২০২১
  • / ১৯৩৯ বার পড়া হয়েছে

হাফিজিয়া মাদপ্রাসায় শিশু শিক্ষার্থীরা। ছবিটি মাধবপুর হাফিজিয়া মাদরাসার। প্রতীকী ছবি।


Google News
বিশ্লেষণ-এর সর্বশেষ নিবন্ধ পড়তে গুগল নিউজে যোগ দিন

বিশেষ শর্তসাপেক্ষে এবং স্বল্পমূল্যে এই ওয়েবসাইটটি সামাজিক কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ কিংবা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের নিকট বিক্রি করা হবে।

ইদের ছুটিতে বাড়িতে গেলে অনেকের সাথেই দেখা হয়, ছোটোবেলা থেকে যাদের সাথে বেড়ে উঠেছি তাঁদের খবরাখবর নেওয়ার বা তাঁদের খুব কাছে যাওয়ার অন্যতম সময় ইদ। এ রীতি মেপেই দেখা হয় শৈশব-কৈশোর অধিকার করা ছেলেমেয়েদের সাথেও বেশ জমিয়ে আলাপ করা যায়, ওদের সাথে খেলা করা যায়, ওদের মনের কথাগুলোও এ সুযোগে জেনে নেওয়ার যায়। কিন্তু এমন কয়েকটা ছেলের সাথে দেখা হল যাদের সাথে দেখা হতে পারে বলে আমার ধারণা ছিলনা, বা অত তারাতারি দেখা হবে ভাবতে পারিনি। ওরা হাফিজিয়া মাদ্রাসায় পড়াশোনা করে, রমযানে ছুটি হয় ক্বদর রাতের পরে। আমি গিয়েছিলাম ২২শে রমযান। গল্পচ্ছলে এই ছেলেপুলেদের কাছে একে একে পড়াশোনার কথা জানতে চাই, ওরাও উত্তর দেয় কিন্তু খটকা লাগে ওই কয়েকটা ছেলের কথা শুনে; হাঁসতে হাঁসতে বলে, স্কুল ও মাদ্রাসায় একেকেকজন একেক ক্লাসে পড়ে। বিস্ময় নিয়ে জানতে চাই, তোমরা না হাফিজিয়া মাদরাসায় পড়তে? পাশ থেকে একজন উত্তর দেয়, “কষ্ট বোলে ব্যামালা, হেইলাইগগা টেকতে পারেনাই, পলাইয়া আইছে। হ্যারপর অগোরে স্কুলে ভর্তি কইররা দেছে।” আমি উৎসুক মনে ওদের কাছ কষ্টের কথাটি জানতে চাই কিন্তু ব্যর্থ হই। পরে অবশ্য মাদরাসা পালানো অন্য এক কিশোরের কাছ থেকে কিছু একটু জানতে পারি।

একটি বাস্তব ঘটনা

আমাদের আত্মীয়ের ভেতরেই একটি ছেলে, নাম মাহফুজ (ছদ্মনাম) এ বছর দাখিল ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে। বয়স ১৪-১৫ হবে। পড়াশোনার শুরু হয় ইবতেদাইয়ির মাধ্যমে কিন্তু মাঝখানে ওকে রাজধানী ঢাকার একটি হাফিজিয়া মাদরাসায় ভর্তি করিয়ে দেওয়া হয়। বাবা-মায়ের স্বপ্ন ছেলে হাফিজ হবে, দিনি কাজ করবে। সবকিছু ঠিকঠাকভাবেই চলছিল, পবিত্র ক্বুরআন শরীফের ছয় পারার বেশি মুখস্তও করে ফেলে। ছেলেটা হঠাৎ করে বাড়িতে চলে আসে, মাদরাসা থেকে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে অভিভাবককে জানানো হয়- তাঁদের ছেলে নিখোঁজ। আবার দিয়ে আসে। এরকম চলতে থাকে অনেক দিন। আরেকদিন পালিয়ে আসার সময় ধরা পড়ে যাওয়ায় পায়ে শিকল দিয়েও রাখা হয়েছে কয়েকদিন, শুধু ও একাই নয় সাথে আরো কয়েকজন ছিল। শিকলের কষ্ট সহ্য করতে না পেরে মুখে কিছু মুখস্ত গালির দ্বারা চেচাতে থাকে (মাহফুজের ভাষায়- কত্ত সময় গেছিজ্ঞা, হ্যারপরও দেহি কেও ছেওল ছুডাইয়া দেয়না। অ্যাহন কী করমু, ইচ্ছামতন গাইল্লাইছি, গাইলের চোডে খুইল্লা দেছে) । এক সময় বিরক্ত হয়ে ছেলেটাকে মাদরাসা থেকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় মাদরাসা কর্তৃপক্ষ।

আমি অবাক চোখে তাকিয়ে আছি মাহফুজের দিকে আর জানার চেষ্টা করছি। একটা মুহুর্তে জানতে চাই ও কেন পালিয়ে এসেছিল বারেবার। এ প্রশ্নের উত্তরে শুধুই গোমরা মুখে নিচের দিকে তাকিয়ে ছিল। আমিও প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে অন্য কথা তুলে এনে সুযোগ বুঝেই জানতে চাইলাম, ওখানের পড়াশোনা আর খাওয়ার বিষয় সম্পর্কে। আমাকে জানায়, ঘুম থেকে উঠতে হয় রাত ৩ টায়, এরপর ওজু করে পড়া শুরু করে ফজরের আযানের সময় একটু বিশ্রাম অর্থাৎ নামায আর যিকিরের জন্য এ বিরতি। এরপর আবার পড়া শুরু, সকাল একটু ভারী হলে নাস্তা দেওয়া হয়। নাস্তার পর আবার পড়তে হয় যোহরের আযান পর্যন্ত। দুপুরে গোসল, নামায ও খাবারের পর ঘুমোতে হয় এবং আসরের নামাযের পর সন্ধ্যা পর্যন্ত ছুটি। ছুটির সময়টা ছেলেরা সাধারণত খেলা করেই কাটায়। মাগরিবের পরে খাওয়ার সময় সহ ১০ টা পর্যন্ত পড়তে হবেই, এরপর ঘুম এবং যথারীতি ৩ টায় উঠতে হয়। পড়া না পারলে শাস্তি কি রকম, জানতে চাইলে শুধু বলে- না…, পড়া না পারলে বেশী মারেনা, তয় কেউ দুষ্টামি করলে পিডায়।

মোটামুটিভাবে আর বোঝার বাকী থাকলোনা, কেন হাফিজিয়া মাদরাসায় ছেলেরা টিকতে পারেনা। যুগেযুগে এমনই হয়ে আসছে কিন্তু হাফিজিয়া মাদরাসা থমকে নেই, থাকবেওনা। কারণ এখানে পবিত্র কুরআনের হফিজ বানানো হয়। কিন্তু শিশু কিশোর যারা এখানে পড়তে আসে তাঁদের জন্য ঠিকই কষ্টসাধ্য হয়ে থাকে এখানের দৈনন্দিন রুটিন। কেননা, কোন বাচ্চা ছেলেই কিন্তু প্রতিদিন ১০ টায় ঘুমিয়ে আবার রাত ৩ টায় ঊথতে চাইবেনা। আবার সারাদিনের যে বাঁধাধরা নিয়ম তাতে শিশু কিশোররা মানিয়ে নিতে পারেনা। এসবের পরেও হাফিজ হচ্ছে, কিন্তু যারা হচ্ছে তাঁদের অনেকেই কিন্তু এরকম পালাতে পালাতে একসময় মাদরাসায় শেকড় গাড়ে এবং সফলতার সাথে বের হয়ে যায়।

কিন্তু এমন রুটিন থাকা উচিৎ নয় যা বাচ্চাদের মনের সাথে না মেলে, তাঁরা সহজে মেনে নিতে পারে না। হাফিজিয়া মাদরাসায় অনেক বাচ্চারা পড়ে যাদের অভিভাবক থেকেও থাকেনা, ইয়াতিম এঁরা কিন্তু চাইলেও চার দেওয়াল ছেড়ে বেরুতে পারেনা, আস্বাভাবিক মানসিক কষ্ট নিয়েই শৈশব ও কৈশোর পার করে। একটা সময় শক্ত হয়ে যায়। তবে সবাই পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে নিতে পারেনা বলে অনেক সময় মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। আর বলা হয়, – ছেলেটা পড়তে পড়তে পাগল হয়ে গেছে। এভাবেও অপবাদ দেওয়া হয়ে থাকে যে, ক্বুরআনকে ঠিক মত ইজ্জত করতে পারেনি বলে পাগল হয়ে গেছে। পড়তে পড়তে এভাবে পাগল হয়ে যাওয়ার ঘটনা শুধু মাদরাসা কেন, সাধারণ পরিবেশেও ঘটে। কখনও পরিবারের অতিরিক্ত রেস্ট্রিকশনের কারণে, কখনও নিজের খামখেয়ালিতে।

সাধারণত কোন সুস্থ্য মানুষ কখনই চায়না দুনিয়াটা অন্যের মত করে দেখতে, হোক তাঁর বয়স ৫ বছর কি ৫০, ৬০, ৭০ বা এর থেকেও বেশি। যখনই এর উল্টোটা হয়ে পড়ে তখনই কোন না কোন অপ্রত্যাশিত কিছু ঘটবে। আজকের যে নাবালক ছেলে কিবা মেয়েটা সেই একদিন পরিবার, সমাজ কিংবা দেশের জন্য কাজ করবে। তাইতো তাকে একটি সুস্থ্য পরিবেশে, সুস্থ্যভাবে বেড়ে ওঠা একান্তই প্রয়োজন।

যদিও বিষয়টিকে এখানে হাফিজিয়া মাদরাসার ওপর ভর করে দেখানো হয়েছে, এর মানে এ নয় যে, ইঙ্গিত মাদরাসার দিকেই। ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ প্রত্যেকেই শিশুদের জন্য একটি সুস্থ্য পরিবেশের অন্তরায় হয়ে আছে, এমনকি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও। শোধরাতে হবে সবাইকে, আমাদের সবারই বোঝার চেষ্টা করা উচিৎ বাচ্চারা কি চায়। আর হাফিজিয়া বা অন্যসব ধর্মীয় ও সাধারণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষের কাছে অনুরোধ, তাঁরা যেন অন্তত স্বল্পবয়স্ক শিক্ষার্থীদের নুন্যতম স্বাধীনতা দেন।

(২০১৭ সালের ইদের ছুটিতে লিখিত)

শেয়ার করুন

মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার তথ্য সংরক্ষিত রাখুন

লেখকতথ্য

মু. মিজানুর রহমান মিজান

মু. মিজানুর রহমান মিজান একজন স্বাধীন শিক্ষামূলক লেখক। তিনি শিক্ষা গবেষণায় বেশ আগ্রহী। যৌথভাবে কিছু গবেষণায়ও অংশ নিয়েছেন।

বিশেষ শর্তসাপেক্ষে এই ওয়েবসাইটটি সামাজিক কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ কিংবা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের নিকট বিক্রি করা হবে।

হাফিজিয়া মাদরাসা থেকে শিশু শিক্ষার্থীরা কেন পালিয়ে যায়?

প্রকাশ: ০৪:২২:০১ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ৯ এপ্রিল ২০২১

ইদের ছুটিতে বাড়িতে গেলে অনেকের সাথেই দেখা হয়, ছোটোবেলা থেকে যাদের সাথে বেড়ে উঠেছি তাঁদের খবরাখবর নেওয়ার বা তাঁদের খুব কাছে যাওয়ার অন্যতম সময় ইদ। এ রীতি মেপেই দেখা হয় শৈশব-কৈশোর অধিকার করা ছেলেমেয়েদের সাথেও বেশ জমিয়ে আলাপ করা যায়, ওদের সাথে খেলা করা যায়, ওদের মনের কথাগুলোও এ সুযোগে জেনে নেওয়ার যায়। কিন্তু এমন কয়েকটা ছেলের সাথে দেখা হল যাদের সাথে দেখা হতে পারে বলে আমার ধারণা ছিলনা, বা অত তারাতারি দেখা হবে ভাবতে পারিনি। ওরা হাফিজিয়া মাদ্রাসায় পড়াশোনা করে, রমযানে ছুটি হয় ক্বদর রাতের পরে। আমি গিয়েছিলাম ২২শে রমযান। গল্পচ্ছলে এই ছেলেপুলেদের কাছে একে একে পড়াশোনার কথা জানতে চাই, ওরাও উত্তর দেয় কিন্তু খটকা লাগে ওই কয়েকটা ছেলের কথা শুনে; হাঁসতে হাঁসতে বলে, স্কুল ও মাদ্রাসায় একেকেকজন একেক ক্লাসে পড়ে। বিস্ময় নিয়ে জানতে চাই, তোমরা না হাফিজিয়া মাদরাসায় পড়তে? পাশ থেকে একজন উত্তর দেয়, “কষ্ট বোলে ব্যামালা, হেইলাইগগা টেকতে পারেনাই, পলাইয়া আইছে। হ্যারপর অগোরে স্কুলে ভর্তি কইররা দেছে।” আমি উৎসুক মনে ওদের কাছ কষ্টের কথাটি জানতে চাই কিন্তু ব্যর্থ হই। পরে অবশ্য মাদরাসা পালানো অন্য এক কিশোরের কাছ থেকে কিছু একটু জানতে পারি।

একটি বাস্তব ঘটনা

আমাদের আত্মীয়ের ভেতরেই একটি ছেলে, নাম মাহফুজ (ছদ্মনাম) এ বছর দাখিল ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে। বয়স ১৪-১৫ হবে। পড়াশোনার শুরু হয় ইবতেদাইয়ির মাধ্যমে কিন্তু মাঝখানে ওকে রাজধানী ঢাকার একটি হাফিজিয়া মাদরাসায় ভর্তি করিয়ে দেওয়া হয়। বাবা-মায়ের স্বপ্ন ছেলে হাফিজ হবে, দিনি কাজ করবে। সবকিছু ঠিকঠাকভাবেই চলছিল, পবিত্র ক্বুরআন শরীফের ছয় পারার বেশি মুখস্তও করে ফেলে। ছেলেটা হঠাৎ করে বাড়িতে চলে আসে, মাদরাসা থেকে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে অভিভাবককে জানানো হয়- তাঁদের ছেলে নিখোঁজ। আবার দিয়ে আসে। এরকম চলতে থাকে অনেক দিন। আরেকদিন পালিয়ে আসার সময় ধরা পড়ে যাওয়ায় পায়ে শিকল দিয়েও রাখা হয়েছে কয়েকদিন, শুধু ও একাই নয় সাথে আরো কয়েকজন ছিল। শিকলের কষ্ট সহ্য করতে না পেরে মুখে কিছু মুখস্ত গালির দ্বারা চেচাতে থাকে (মাহফুজের ভাষায়- কত্ত সময় গেছিজ্ঞা, হ্যারপরও দেহি কেও ছেওল ছুডাইয়া দেয়না। অ্যাহন কী করমু, ইচ্ছামতন গাইল্লাইছি, গাইলের চোডে খুইল্লা দেছে) । এক সময় বিরক্ত হয়ে ছেলেটাকে মাদরাসা থেকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় মাদরাসা কর্তৃপক্ষ।

আমি অবাক চোখে তাকিয়ে আছি মাহফুজের দিকে আর জানার চেষ্টা করছি। একটা মুহুর্তে জানতে চাই ও কেন পালিয়ে এসেছিল বারেবার। এ প্রশ্নের উত্তরে শুধুই গোমরা মুখে নিচের দিকে তাকিয়ে ছিল। আমিও প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে অন্য কথা তুলে এনে সুযোগ বুঝেই জানতে চাইলাম, ওখানের পড়াশোনা আর খাওয়ার বিষয় সম্পর্কে। আমাকে জানায়, ঘুম থেকে উঠতে হয় রাত ৩ টায়, এরপর ওজু করে পড়া শুরু করে ফজরের আযানের সময় একটু বিশ্রাম অর্থাৎ নামায আর যিকিরের জন্য এ বিরতি। এরপর আবার পড়া শুরু, সকাল একটু ভারী হলে নাস্তা দেওয়া হয়। নাস্তার পর আবার পড়তে হয় যোহরের আযান পর্যন্ত। দুপুরে গোসল, নামায ও খাবারের পর ঘুমোতে হয় এবং আসরের নামাযের পর সন্ধ্যা পর্যন্ত ছুটি। ছুটির সময়টা ছেলেরা সাধারণত খেলা করেই কাটায়। মাগরিবের পরে খাওয়ার সময় সহ ১০ টা পর্যন্ত পড়তে হবেই, এরপর ঘুম এবং যথারীতি ৩ টায় উঠতে হয়। পড়া না পারলে শাস্তি কি রকম, জানতে চাইলে শুধু বলে- না…, পড়া না পারলে বেশী মারেনা, তয় কেউ দুষ্টামি করলে পিডায়।

মোটামুটিভাবে আর বোঝার বাকী থাকলোনা, কেন হাফিজিয়া মাদরাসায় ছেলেরা টিকতে পারেনা। যুগেযুগে এমনই হয়ে আসছে কিন্তু হাফিজিয়া মাদরাসা থমকে নেই, থাকবেওনা। কারণ এখানে পবিত্র কুরআনের হফিজ বানানো হয়। কিন্তু শিশু কিশোর যারা এখানে পড়তে আসে তাঁদের জন্য ঠিকই কষ্টসাধ্য হয়ে থাকে এখানের দৈনন্দিন রুটিন। কেননা, কোন বাচ্চা ছেলেই কিন্তু প্রতিদিন ১০ টায় ঘুমিয়ে আবার রাত ৩ টায় ঊথতে চাইবেনা। আবার সারাদিনের যে বাঁধাধরা নিয়ম তাতে শিশু কিশোররা মানিয়ে নিতে পারেনা। এসবের পরেও হাফিজ হচ্ছে, কিন্তু যারা হচ্ছে তাঁদের অনেকেই কিন্তু এরকম পালাতে পালাতে একসময় মাদরাসায় শেকড় গাড়ে এবং সফলতার সাথে বের হয়ে যায়।

কিন্তু এমন রুটিন থাকা উচিৎ নয় যা বাচ্চাদের মনের সাথে না মেলে, তাঁরা সহজে মেনে নিতে পারে না। হাফিজিয়া মাদরাসায় অনেক বাচ্চারা পড়ে যাদের অভিভাবক থেকেও থাকেনা, ইয়াতিম এঁরা কিন্তু চাইলেও চার দেওয়াল ছেড়ে বেরুতে পারেনা, আস্বাভাবিক মানসিক কষ্ট নিয়েই শৈশব ও কৈশোর পার করে। একটা সময় শক্ত হয়ে যায়। তবে সবাই পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে নিতে পারেনা বলে অনেক সময় মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। আর বলা হয়, – ছেলেটা পড়তে পড়তে পাগল হয়ে গেছে। এভাবেও অপবাদ দেওয়া হয়ে থাকে যে, ক্বুরআনকে ঠিক মত ইজ্জত করতে পারেনি বলে পাগল হয়ে গেছে। পড়তে পড়তে এভাবে পাগল হয়ে যাওয়ার ঘটনা শুধু মাদরাসা কেন, সাধারণ পরিবেশেও ঘটে। কখনও পরিবারের অতিরিক্ত রেস্ট্রিকশনের কারণে, কখনও নিজের খামখেয়ালিতে।

সাধারণত কোন সুস্থ্য মানুষ কখনই চায়না দুনিয়াটা অন্যের মত করে দেখতে, হোক তাঁর বয়স ৫ বছর কি ৫০, ৬০, ৭০ বা এর থেকেও বেশি। যখনই এর উল্টোটা হয়ে পড়ে তখনই কোন না কোন অপ্রত্যাশিত কিছু ঘটবে। আজকের যে নাবালক ছেলে কিবা মেয়েটা সেই একদিন পরিবার, সমাজ কিংবা দেশের জন্য কাজ করবে। তাইতো তাকে একটি সুস্থ্য পরিবেশে, সুস্থ্যভাবে বেড়ে ওঠা একান্তই প্রয়োজন।

যদিও বিষয়টিকে এখানে হাফিজিয়া মাদরাসার ওপর ভর করে দেখানো হয়েছে, এর মানে এ নয় যে, ইঙ্গিত মাদরাসার দিকেই। ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ প্রত্যেকেই শিশুদের জন্য একটি সুস্থ্য পরিবেশের অন্তরায় হয়ে আছে, এমনকি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও। শোধরাতে হবে সবাইকে, আমাদের সবারই বোঝার চেষ্টা করা উচিৎ বাচ্চারা কি চায়। আর হাফিজিয়া বা অন্যসব ধর্মীয় ও সাধারণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষের কাছে অনুরোধ, তাঁরা যেন অন্তত স্বল্পবয়স্ক শিক্ষার্থীদের নুন্যতম স্বাধীনতা দেন।

(২০১৭ সালের ইদের ছুটিতে লিখিত)