১১:১১ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
                       

শিক্ষা কী? শিক্ষার সংজ্ঞা, ধারণা এবং লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য

ব্যাপক অর্থে শিক্ষার যে ধারণা দিয়েছেন শিক্ষাবিজ্ঞানীরা তা ব্যক্তির ওপর পরিবেশের সার্বিক প্রভাব সম্পর্কিত। একজন ব্যক্তি যে পরিবেশের সদস্য ওই পরিবেশের উন্নতি, অবনতি বা যে-কোনো ধরনের পরিবর্তন বা অবস্থার সাথে মানিয়ে নিতে পারার সক্ষমতা অর্জন হলো শিক্ষা।
মু. মিজানুর রহমান মিজান
  • প্রকাশ: ০২:৩৮:৪৭ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৪ এপ্রিল ২০২১
  • / ১৩৮২৪৫ বার পড়া হয়েছে

শিক্ষা কী? শিক্ষার সংজ্ঞা, ধারণা, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য


Google News
বিশ্লেষণ-এর সর্বশেষ নিবন্ধ পড়তে গুগল নিউজে যোগ দিন

বিশেষ শর্তসাপেক্ষে এবং স্বল্পমূল্যে এই ওয়েবসাইটটি সামাজিক কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ কিংবা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের নিকট বিক্রি করা হবে।

শিক্ষা ব্যক্তিগত বিকাশ ও সামাজিক উন্নয়নের সবচেয়ে শক্তিশালী মাধ্যম। সাধারণভাবে বলা হয়, শিক্ষা হলো কোনো কিছু জানা বা বিশেষ কোনো কিছুর ওপর জ্ঞান অর্জন বা দক্ষতা অর্জন। তবে একে যখন ব্যাপকভাবে চিহ্নিত করা হয় তখন দেখা যায়, শিক্ষা হলো একটি পদ্ধতিগত ও জীবনব্যাপী প্রক্রিয়া। আবার আমরা যে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় অভ্যস্ত, সেটি হলো শিক্ষার সংকীর্ণ ধারণার রুপ। এ আর্টিকেলে আলোচনা করার চেষ্টা করা হয়েছে – শিক্ষা ও education শব্দদ্বয়ের উৎপত্তি, শিক্ষার সংজ্ঞা, শিক্ষার ধারণা এবং শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে।

শিক্ষা পরিচিতি: শিক্ষা কী, শিক্ষার সংজ্ঞা, ধারণা এবং লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য

শিক্ষা ও এডুকেশন শব্দের উৎপত্তি

শিক্ষা শব্দের উৎপত্তি

বাংলা ভাষার একটি শব্দ হলো শিক্ষা। এই শিক্ষা শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে সংস্কৃত ‘শাস্‌’ ধাতু থেকে। শাস্‌’র অর্থ শাসন করা, নিয়ন্ত্রণ করা, নির্দেশদান, উপদেশদান ইত্যাদি। শিক্ষা শব্দের পাশাপাশি আমাদের আরেকটি শব্দ এখানে খুবই গুরুত্বপূর্ণ, সে শব্দটি ‘বিদ্যা’। সংস্কৃত এ শব্দের উৎপত্তি হয়েছে ‘বিদ্‌’ থেকে, যার অর্থ- জানা। জানার অর্থ হলো কোনো কিছু সম্পর্কে জ্ঞানলাভ করা অর্থে শিক্ষালাভ করা।

এডুকেশন (Education) শব্দের উৎপত্তি

Education শব্দটির উৎপত্তি নিয়ে বেশ কিছু মত রয়েছে। নিচে এগুলো উল্লেখ করা হলো-

অনেক গবেষক ও শিক্ষাগবেষকই একমত হয়েছেন যে, শিক্ষার ইংরেজি প্রতিশব্দ education এর উৎপত্তি হয়েছে ল্যাটিন শব্দ educare অথবা educere থেকে। এখানে educare শব্দের অর্থ হলো – to train (প্রশিক্ষিত করা) এবং to accustom (অভ্যস্ত করা)। কেউ কেউ বলে থাকেন educare এর আরেকটি অর্থ – to bring up (লালন-পালন করা)।

অন্যদিকে educere শব্দের অর্থ হলো – to lead out বা বের করে আনা। এখানে ‘বের করে আনা’ মানে হলো সুপ্ত মানসিক শক্তির বিকাশ ঘটানো। education এর উৎপত্তি educere থেকে হয়েছে এটি খুব বেশি মানুষ বিশ্বাস না করলেও, কেউই আলোচনার টেবিলে একে বাদ দিয়ে কথা বলতে পারেন না।

আবার বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, education শব্দটি সরাসরি educare থেকে আসেনি। মাঝখানে পার হতে হয়েছে বেশ কয়েকটি ধাপ। ল্যাটিন educare থেকে আমরা বেশ কিছু শব্দের জন্ম সম্পর্কে জানতে পারি। এদের মধ্যে educat এবং educatio ল্যাটিন শব্দ, এখান থেকে একইসঙ্গে ইংরেজি শব্দের educate (কাউকে শেখানো) এর উৎপত্তি হয়। এভাবেই ষোড়শ শতাব্দিতে ইংরেজি শব্দ education উৎপত্তিলাভ করে।

কেউ কেউ বলে থাকেন ইংরেজি ভাষার শব্দ education এসেছি ল্যাটিন শব্দ educatum থেকে যার অর্থ the act of training বা প্রশিক্ষণের নিয়ম/রীতি। জোসেফ টোয়াডেল শিপলি নামক এক পণ্ডিত তাঁর লিখিত Dictionary of Word Origins’এ লিখেছেন যে, ইংরেজি education এর উৎপত্তি হয় ল্যাটিন edex এবং duccrduc শব্দদ্বয় থেকে। এখানে edex এর অর্থ ‘বের করা’ এবং duccrduc এর বাংলা করলে হয় ‘পথ প্রদর্শন করা’।

সাধারণ অর্থে শিক্ষা

মানুষ জন্ম থেকে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত অনেক কিছুই শেখে। কোনো ব্যক্তি যা কিছু শেখে তাকেই আমরা ‘শিক্ষা’ হিসেবে অভিহিত করতে পারি। এটি হলো শিক্ষার প্রাথমিক ধারণা। এ হিসেবে আমরা সমাজের প্রতিটি মানুষই শিক্ষিত কারণ শিক্ষার সাধারণ ধারণা অনুসারে প্রতিটি মানুষই কিছু না কিছু জানে বা পারে।

সাধারণ অর্থে শিক্ষার বৈশিষ্ট্য-

  • মানুষ যা শেখে বা জানে তার নামই শিক্ষা
  • কেউ অশিক্ষিত নয়
আধুনিক শিক্ষা হলো একটি শিক্ষার্থীকেন্দ্রীক প্রক্রিয়া; এই শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষার্থীকে শিখন-শিক্ষণ কার্যক্রমে স্বক্রিয় অংশগ্রহণমূলক হয়ে থাকে।

ব্যাপক অর্থে শিক্ষা

সাধারণ অর্থে শিক্ষার ধারণা এবং ব্যাপক শিক্ষার ধারণা মূলত একই। কারো যখন জন্ম হয় তখন থেকেই সে তার পরিবেশ থেকে শিক্ষা নিতে থাকে এবং শিক্ষা নেওয়ার ফলে আচরণগত পরিবর্তন হয়। শিক্ষা হলো মানবীয় প্রচেষ্টায় একটি সামাজিক প্রক্রিয়া যা কোনো না কোনো বাস্তব সমস্যার সমাধানকেন্দ্রিক হয়ে থাকে।

ব্যাপক অর্থে শিক্ষার যে ধারণা দিয়েছেন শিক্ষাবিজ্ঞানীরা তা ব্যক্তির ওপর পরিবেশের সার্বিক প্রভাব সম্পর্কিত। একজন ব্যক্তি যে পরিবেশের সদস্য ওই পরিবেশের উন্নতি, অবনতি বা যে-কোনো ধরনের পরিবর্তন বা অবস্থার সাথে মানিয়ে নিতে পারার সক্ষমতা অর্জন হলো শিক্ষা।

ব্যাপক অর্থে শিক্ষার বৈশিষ্ট্য

  1. প্রত্যেকেই শিক্ষিত এবং অশিক্ষিত কেউ নেই।
  2. শিক্ষা আচরণগত পরিবর্তন আনে।
  3. শিক্ষা হলো একটি মানবীয় প্রচেষ্টার ফল।
  4. শিক্ষা একটি জীবনব্যাপী প্রক্রিয়া।
  5. শিক্ষা হলো নির্দেশনার সমষ্টি।
  6. শিক্ষা হয়ে থাকে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যনির্ভর।
  7. শিক্ষা একটি সামাজিক ও মনোসামাজিক প্রক্রিয়া।

বিশেষ অর্থে শিক্ষার ধারণা

বিশেষ অর্থে শিক্ষার ধারণাকে আমরা শিক্ষার সংকীর্ণ ধারণাও বলতে পারি। সত্যি কথা হলো – আমাদের আলোচনার টেবিলে যে শিক্ষা (education) নিয়ে সর্বদা আলোচনা হয় বা আমরা যে অর্থে শিক্ষা শব্দটিকে ব্যবহার করি তা বিশেষ বা সংকীর্ণ অর্থেই ব্যবহার করি। প্রচলিত প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাব্যবস্থাই হলো শিক্ষার বিশেষ বা সংকীর্ণ ধারণার রুপ। বিশেষ অর্থে শিক্ষা হলো স্বীকৃত কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নির্দিষ্ট কোনো বিষয় বা বিষয়সমূহে জ্ঞানার্জন করা। যারা বিদ্যালয় কিংবা পাঠশালা থেকে পড়া, লেখা ও গণিতের প্রাথমিক ধারণালাভ থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন পর্যায়ের ডিগ্রিপ্রাপ্ত হয়েছেন তাঁরাই শিক্ষার বিশেষ অর্থ অনুযায়ী শিক্ষিত। অন্যদিকে যারা কোনো সময়েই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যেতে পারেনি তাঁদের অশিক্ষিত বলা হয়।

বিশেষ বা সংকীর্ণ বা সীমিত অর্থে শিক্ষার কতগুলো বৈশিষ্ট্য-

  1. শিক্ষা হলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অর্জিত জ্ঞান ও দক্ষতা।
  2. শিক্ষা হলো একটি কাঠামো ও স্তর ভিত্তিক প্রক্রিয়া।
  3. শিক্ষা হলো সুপরিকল্পিত ও সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্যভিত্তিক প্রক্রিয়া।
  4. শিক্ষাব্যবস্থা পরিচালিত হয়ে থাকে দেশের সরকারি বা প্রশাসনিক দিকনির্দেশনা অনুযায়ী।
  5. শিক্ষার্থীদের শিক্ষাদানের জন্য শিক্ষক নিয়োজিত থাকেন।

বিশেষ অর্থে শিক্ষা বলতে সেই শিক্ষাকে বোঝায় যা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অর্জিত হয়। যে-কারণে অত্যন্ত দক্ষ একজন মিস্ত্রির যদি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকে তাহলে তাকে শিক্ষিত বলা হয় না। আবার একজন ডিগ্রিধারি প্রকৌশলী যদি নিজ কাজে খুব একটা দক্ষ না-ও হন তাহলেও তিনি শিক্ষিত বলে গণ্য হবেন।

শিক্ষা কাকে বলে বা শিক্ষার সংজ্ঞা কী?

শিক্ষা নিয়ে যারা কথা বলেছেন তাঁরা প্রত্যেকেই নিজের মতো করে ভেবে নিয়েছেন শিক্ষাকে, নিজের মতো করে সংজ্ঞা দিয়েছেন। শিক্ষাবীদ কিংবা মনিষী, যার সংজ্ঞাই দেখা হোক না কেন, খুব একটা সন্তুষ্ট হওয়া যায় না। তাই বলে যাদের হাত ধরে শিক্ষা ও শিক্ষাব্যবস্থা আজ পর্যন্ত এসেছে তাঁদের মতো শিক্ষাবিদ বা মনিষীদের বলে যাওয়া বা লিখে যাওয়া কথাগুলোকে এড়িয়ে চলাও সম্ভব নয়।

কয়েকজন শিক্ষাবিদের মতে শিক্ষার সংজ্ঞা

প্লেটো শিক্ষাকে সনাক্ত করেছেন ন্যায় বিচার অর্জনের উপায় হিসেবে। তিনি বলেছেন, “শিক্ষা হলো ব্যক্তিগত এবং সামাজিক ন্যায়বিচার উভয়ই অর্জনের উপায়”। শিক্ষা সামাজিক ন্যায়বিচারের উপায় হলেও সামাজিক সাফল্যের মাধ্যম নয় বরং এটি এমন একটি পথ যা সত্যের কাছে পৌঁছে দেয়”।

অ্যারিস্টটল বলেছেন, “সুস্থ দেহে সুস্থ মন তৈরির নামই শিক্ষা”।

জন ডিউই How We Think বইয়ে লিখেছেন, শিক্ষা হলো জীবনযাপনের প্রক্রিয়া তবে ভবিষ্যতে জীবনযাপনের প্রস্তুতি নয়।

মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র বলেন, শিক্ষা কোনো ব্যক্তিকে পরিবর্তন করে পরীক্ষানিরীক্ষা করে মিথ্যা থেকে সত্য, অবাস্তব থেকে বাস্তব, কল্পনা থেকে প্রকৃতকে আলাদা করতে সক্ষম করে তোলে।

এফ. জে. ব্রাউন শিক্ষা সম্পর্কে বলেন, “শিক্ষা এমন একটি প্রক্রিয়া যা কারো জন্ম থেকে শুরু হয়ে জীবনব্যাপী চলতে থাকে। শিক্ষাই জীবন, পুরোটা জীবনই শিক্ষা”।

বি. এফ. স্কিনার বলেছেন, “শিক্ষা মানে বৃদ্ধি আর বৃদ্ধি মানে হলো বহুমুখী বিকাশ”।

জোহান হেইনরিখ পেস্তালতজির মতে, “শিক্ষা হলো মানুষের অন্তর্নিহিত শক্তির স্বাভাবিক, সুষম ও প্রগতিশীল বিকাশ”।

জন ফ্রেডারিক হার্বার্ট বলেছেন, “মানুষের নৈতিক চরিত্রের বিকাশ সাধন হলো শিক্ষা”।

স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন, “শিক্ষা হলো মানুষের অন্তর্নিহিত মহত্বের বিকাশ”।

আধুনিক শিক্ষা কী?

যে প্রক্রিয়ায় ব্যক্তি বা শিক্ষার্থীর চাহিদা, আগ্রহ, প্রবণতা, প্রয়োজনীয়তা ইত্যাদিকে গুরুত্ব প্রদান করে অগ্রসরমান সমাজ ও বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে চলার উপযোগী করে গড়ে যোগ্য জনসম্পদরুপে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা হয় সে প্রক্রিয়াকে আধুনিক শিক্ষা বলা হয়। আধুনিক শিক্ষা হলো একটি শিক্ষার্থীকেন্দ্রীক প্রক্রিয়া; এই শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষার্থীকে শিখন-শিক্ষণ কার্যক্রমে স্বক্রিয় অংশগ্রহণমূলক হয়ে থাকে।

শিক্ষা হলো এমন একটি প্রক্রিয়া যা একজন মানুষের অন্তর্নিহিত ও বাহ্যিক গুনাবলি বিকাশে সহায়ক হিসেবে কাজ করে তাকে সমাজের উৎপাদনশীল সদস্য তথা জনসম্পদে রুপান্তর করে। শিক্ষা নামক এই প্রক্রিয়া হলো একটি বিজ্ঞানভিত্তিক পদ্ধতিগত প্রক্রিয়া। শিক্ষার মাধ্যমে মানুষের আচরণের পরিবর্তন হয়। তবে এ কথা সত্য যে, সারা বিশ্বে অতি পরিচিত এ প্রত্যয়টির সর্বজনগ্রাহ্য কোনো সংজ্ঞা কিংবা ধারণা এখনো তৈরি হয়নি।

তাই বলে সন কিছুকে শিক্ষা হিসেবে ধরা হয় না। মানুষ যা শেখা তা যদি শিক্ষা হিসেবে গণ্য করতে হয় তবে এর জন্য বেশ কয়েকটি শর্তের মধ্য দিয়ে আসতে হবে যা পূরণ না হলে ওই শিখনকে শিক্ষা বলা যাবে না। শিক্ষা প্রত্যয় হিসেবে গণ্য হবার আগে দেখতে হবে তা মানুষ ও সমাজের জন্য ইতিবাচক, কল্যাণকর ও ব্যক্তি ও সমাজের জন্য প্রত্যাশিত পরিবর্তন আনতে সহায়ক হবে কি না।

শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য কী?

শিক্ষার ধারণা যেমন নির্দিষ্ট কোনো রুপ লাভ করতে পারেনি তেমনই শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়েও রয়েছে নানান মত। যুগে যুগে শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের ধরন পাল্টেছে। দেশ, জনগোষ্ঠী, বিশ্বাস, রীতিনীতি কিংবা প্রয়োজনের দিক বিবেচনায়ও শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের পার্থ্যক্য দেখা যায়। এখানে শিক্ষার বেশ কিছু সাধারণ উদ্দেশ্য উল্লেখ করা হলো-

শিক্ষার জ্ঞানার্জনমূলক লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য

শিক্ষার অন্যতম প্রধান লক্ষ্য হলো জ্ঞানার্জন করা। জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমেই মানুষের বিভিন্ন দিকে দক্ষতা বৃদ্ধি পায়। মানুষের চিন্তাশক্তির বিকাশলাভ তখনই সম্ভন হয় যখন জ্ঞানার্জন করে। জ্ঞান অর্জন করলে যেমন ব্যক্তির মানসিক উন্নতি হয় তেমনই ব্যবহারিক দিকেও উন্নতি হয়। জ্ঞানকে শুধু জানার মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে ‘প্রকৃত জ্ঞান’ প্রত্যয়ের ওপর গুরুত্ব দেওয়া জরুরি। সক্রেটিস, ফ্র্যান্সিস বেকন, ফ্রয়েবল, বেঞ্জামিন ব্লুম কিংবা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সবাই জ্ঞানার্জনের প্রতি গুরুত্বারোপ করেছেন। যদি বলা হয় শিক্ষার প্রথম ও প্রধান লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হলো জ্ঞানার্জন করা তাহলেও কেউ ভুল বলে অ্যাখ্যায়িত করতে পারবেন বলে মনে হয় না।

শিক্ষার বৃত্তিমূলক লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য

আধুনিক বিশ্বের আধুনিক শিক্ষার অন্যতম প্রধান লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হলো মানবসম্পদ তৈরি ও মানবসম্পদ উন্নয়ন। শিল্পবিপ্লবের পর থেকেই বৃত্তিমূলক শিক্ষায় আলাদা করে গুরুত্বারোপ করা হচ্ছে। নিত্যনতুন প্রযুক্তির আগমন, কর্মসংস্থানের সৃষ্টি ও কর্মসংস্থানে প্রবেশের জন্য বৃত্তিমূলক শিক্ষার প্রয়োজন। বৃত্তিমূলকশিক্ষাই মানুষের মৌলিক চাহিদা মেটাতে, সমাজ ও দেশের উন্নয়নে সহায়ক ভূমিকা রাখে। বৃত্তিমূলক বা কর্মমূখী শিক্ষাকে ‘bread and butter aim of education’ বা ‘শিক্ষার রুজি লক্ষ্য’ বলে অভিহিত করে থাকেন। মানুষের শিক্ষার প্রধান লক্ষ্য-উদ্দেশ্য জ্ঞানার্জন হলেও তা যথাযথ বৃত্তিমূলক বা কর্মমুখী শিক্ষার ছাড়া প্রায় মূল্যহীন। বৃত্তিমূলক শিক্ষাই পারে ব্যক্তিকে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করতে যা সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রবেশগম্যতা বাড়ায়।

শিক্ষার সামাজিক লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য

শিক্ষার উদ্দেশ্য তা নয় যা ব্যক্তিকে নিজের মধ্যে বা গুটিকয়েক মানুষের মধ্যে আবদ্ধ করে ফেলে। আত্মকেন্দ্রিক মানুষ খুব সহজেই সমাজচ্যুত হয়ে যেতে পারে। মানুষ সামাজিক জীব আর শিক্ষার উদ্দেশ্য হলো মানুষকে সামাজিক দক্ষতায় দক্ষ করে গড়ে তুলে সমাজচ্যুত হয়ে যাওয়া ঠেকানো। প্রশ্ন জাগতে পারে যে, সামাজিক দক্ষতার কানে কী হতে পারে। সামাজিক দক্ষতা হলো – সমাজে সকলের সঙ্গে আনন্দের সাথে বসবাসের জন্য সমাজের সদস্যদের সাথে আন্তঃব্যক্তিক সম্পর্ক স্থাপন, নৈতিক ও আচরণগত জ্ঞান, সাংস্কৃতিক জ্ঞান, সমাজ সচেতনতা, অর্থনৈতিক সামর্থ্য অর্জনসহ যে অত্যাবশ্যকীয় সামর্থ্য ও যোগ্যতার প্রয়োজন সেসব কিছুর সমষ্টি। ব্যক্তির সামাজিক দক্ষতার উন্নয়ন আধুনিক শিক্ষার গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হিসেবে চিহ্নিত করেছেন শিক্ষাবিদ ও সমাজবিদগণ।

শিক্ষার সাংস্কৃতিক লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য

নির্দিষ্ট সমাজে বসবাসরত লোকজনের আচার-আচরণ, আদর্শ, জ্ঞান, কলাকৌশল, দক্ষতা, ধ্যান-ধারণা, বিশ্বাস, অভ্যেস ইত্যাদির সমষ্টিকে সংস্কৃতি বলে। সংস্কৃতি হলো সমাজবদ্ধ মানুষের পরিপূর্ণ জীবনচিত্র। এর আরেক হলো সামাজিক উত্তরাধিকার (social heritage)। সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যগুলো মানুষ পেয়ে থাকে তার পূর্বপুরুষদের নিকট থেকে উত্তরাধিকারস্বরুপ।

যথাযথ সাংস্কৃতিক জ্ঞান না থাকার কারণে যে কেউ পিছিয়ে থাকতে পারে। সাংস্কৃতিক জ্ঞানের অভাব দূর করতে পারে শিক্ষা। শিক্ষার সাংস্কৃতিক লক্ষ্য হলো ব্যক্তিকে সত্যের অনুসারী করে তাকে রুচিশীল করা। মানুষ যা তাঁদের পূর্বপুরুষদের নিকট থেকে যে সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যাবলী পেয়ে থাকে অনেক সময় তা ইতিবাচক ও কল্যাণকর না-ও হতে পারে। যে সকল সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য ইতিবাচক ও কল্যাণকর নয় তা পরিহার করতে সাহায্য করে শিক্ষা। আবার সংস্কৃতির যে সকল দিক সবার জন্য ইতিবাচক, কল্যাণকর ও প্রত্যাশিত যে সকল দিক বা বৈশিষ্ট্যকে আরও উন্নত করাও শিক্ষার উদ্দেশ্য।

শিক্ষার সাংস্কৃতিক লক্ষ্যের উদ্দেশ্যসমূহ

  1. সাংস্কৃতিক জ্ঞান অর্জন
  2. সাংস্কৃতিক কুসংস্কার দূরীকরণ
  3. ব্যক্তিকে মার্জিত ও রুচিশীল করা
  4. সাংস্কৃতিক রীতিনীতির বিকাশ
  5. সংস্কৃতির কল্যাণকর ও ইতিবাচক দিকগুলোকে ধারণ করা
  6. সংস্কৃতির অকল্যাণকর ও নেতিবাচক দিকগুলোকে বর্জন

নৈতিক চরিত্র গঠনমূলক লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য

অনেক শিক্ষাবিদের মতে, শিক্ষার প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিৎ শিক্ষার্থীর নৈতিক চরিত্র গঠন। যেমনটি বলেছেন জার্মান দার্শনিক ও শিক্ষাবিদ জোহান ফ্রেডারিক হার্বার্ট। হার্বার্ট বলেন, শিক্ষার্থীর চরিত্র গঠনই শিক্ষার প্রধান লক্ষ্য।

শিক্ষার নৈতিক চরিত্র গঠমূলক লক্ষ্যে পৌঁছানোর উদ্দেশ্য

  1. উচ্চতর মূলবোধ অর্জন ও চর্চা
  2. মনোবৃত্তি ও ইচ্ছাশক্তির বিকাশ
  3. সুশৃঙ্খল মনোভাব
  4. সার্বিক নৈতিক আচরণের উন্নতি

ব্যক্তিক বিকাশমূলক লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য

আধুনিক শিক্ষাদর্শনের অন্যতম মুলকথা হলো শিক্ষার্থীর ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবোধ জাগ্রত করে আত্মসত্তায় বিশ্বাসী করে গড়ে তোলা। ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের সাবেক প্রফেসর ব্রিটিশ শিক্ষাবিদ স্যার থমাস পার্সি নান বলেছে, “স্বতন্ত্রতা হলো জীবনের আদর্শ এবং ব্যক্তিগত কৃতিত্বে সর্বোচ্চ ডিগ্রি অর্জনেই শিক্ষাপদ্ধতি চূড়ান্ত মূল্যায়িত হয়”। শিক্ষার্থীর দৈহিক, আবেগিক এবং আত্মিক উন্নয়নে বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করেছেন শিক্ষাবিদগণ। তাঁরা মনে করেন, পরিপূর্ণ জীবন গড়ে ওঠার পেছনে সুস্থ্য দেহ এর সুষ্ঠু বিকাশ এবং সুস্থ দেহে সুস্থ্য মন থাকাটা জরুরি। অ্যারিস্টটল বলেছেন, “সুস্থ দেহে সুস্থ মন তৈরির নামই শিক্ষা”। আত্মোপলব্ধি ও আত্মপ্রকাশ, এই দুটি মানুষের গুরুত্বপূর্ণ মানবীয় গুণ, যার বিকাশ ঘটানোর জন্য শিক্ষা যথাযথ ভূমিকা পালন করে।

শিক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থীর ব্যক্তিক লক্ষ্যে পৌঁছানোর মধ্য দিয়ে যে সব উদ্দেশ্য অর্জন করা সম্ভব

  1. দেহের সুষ্ঠু বিকাশ ঘটানো
  2. সুস্থ দেহ ও সুস্থ দেহে সুস্থ্ মনের সৃষ্টি করা
  3. আত্মোপলব্ধি ও আত্মপ্রকাশের দক্ষতা বৃদ্ধি করা
  4. আত্মিক বিকাশ ঘটানো
  5. অন্তর্নিহিত ক্ষমতার বিকাশ ঘটানো
  6. উচ্চতর আদর্শ জাগ্রত করা
  7. নিজেকে জানার দক্ষতা বৃদ্ধি করা
  8. আত্মবিশ্বাসী করা
  9. চিন্তাশক্তি বৃদ্ধি করা
  10. ব্যক্তি ও বুদ্ধিবৃত্তিক স্বাধীন হিসেবে গড়া

জীবনধারামূলক লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য

শিক্ষার খুবই গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য হলো পূর্ণাঙ্গ জীবন যাপনের লক্ষ্য। সমাজবিজ্ঞানী ও শিক্ষাবিদ হারবার্ট স্পেন্সার শিক্ষার  লক্ষ্য নিয়ে কথা বলেছেন। তিনি মনে করেন, মানুষকে বহুমুখী গুণ বা দক্ষতার অধিকারি হতে হয়। শিক্ষা অর্জনের মাধ্যমে মাধ্যমে মানুষ সঠিকভাবে জীবনধারণ ও জীবনধারণের সঠিক পদ্ধতি খোঁজ পেতে সক্ষম হয়। শিক্ষা হলো জীবনযাপনেরপূর্ণাঙ্গ প্রস্তুতি। মানবসমাজে প্রতিনিয়ত যেমন পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে তেমনই বিকশিতও হচ্ছে। এর ফলে এ মানবসমাজ নানান  বৈশিষ্ট্য ধারণ করেছে এবং ভবিষ্যতেও অনেক বৈশিষ্ট্য ধারণ করবে। এ সব কিছুর সাথে ব্যক্তিকে মানিয়ে নিয়ে বা চলমান জীবনধারার উপযোগী করে তোলাও শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য।

শিক্ষার জীবনধারামূলক লক্ষ্যে পৌঁছানোর উদ্দেশ্য

  1. জীবনযাপনের সঠিক পদ্ধতি রপ্ত করা
  2. পরিবর্তনশীল ও বিকাশমান সমাজপদ্ধতির সাথে মানিয়ে নেওয়া
  3. সমাজের ইতিবাচক পরিবর্তনে ভূমিকা রাখা

শিক্ষা প্রসঙ্গে ইংরেজিতে পড়তে ক্লিক করুন

শেয়ার করুন

10 thoughts on “শিক্ষা কী? শিক্ষার সংজ্ঞা, ধারণা এবং লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য

  1. Nice but I say moral education is the important subject

  2. খুব ভালো লাগলো। তবে ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে একটু আলোচনা করলে পূর্ণাঙ্গ হতো বলে মনে করি।

  3. আলহামদুলিল্লাহ। অনেক শিক্ষক শিক্ষার সংজ্ঞা না জানায় শিক্ষা দিতেই জানে না। ধন্যবাদ।

মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার তথ্য সংরক্ষিত রাখুন

লেখকতথ্য

মু. মিজানুর রহমান মিজান

মু. মিজানুর রহমান মিজান একজন স্বাধীন শিক্ষামূলক লেখক। তিনি শিক্ষা গবেষণায় বেশ আগ্রহী। যৌথভাবে কিছু গবেষণায়ও অংশ নিয়েছেন।

বিশেষ শর্তসাপেক্ষে এই ওয়েবসাইটটি সামাজিক কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ কিংবা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের নিকট বিক্রি করা হবে।

ব্যাপক অর্থে শিক্ষার যে ধারণা দিয়েছেন শিক্ষাবিজ্ঞানীরা তা ব্যক্তির ওপর পরিবেশের সার্বিক প্রভাব সম্পর্কিত। একজন ব্যক্তি যে পরিবেশের সদস্য ওই পরিবেশের উন্নতি, অবনতি বা যে-কোনো ধরনের পরিবর্তন বা অবস্থার সাথে মানিয়ে নিতে পারার সক্ষমতা অর্জন হলো শিক্ষা।

শিক্ষা কী? শিক্ষার সংজ্ঞা, ধারণা এবং লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য

প্রকাশ: ০২:৩৮:৪৭ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৪ এপ্রিল ২০২১

শিক্ষা ব্যক্তিগত বিকাশ ও সামাজিক উন্নয়নের সবচেয়ে শক্তিশালী মাধ্যম। সাধারণভাবে বলা হয়, শিক্ষা হলো কোনো কিছু জানা বা বিশেষ কোনো কিছুর ওপর জ্ঞান অর্জন বা দক্ষতা অর্জন। তবে একে যখন ব্যাপকভাবে চিহ্নিত করা হয় তখন দেখা যায়, শিক্ষা হলো একটি পদ্ধতিগত ও জীবনব্যাপী প্রক্রিয়া। আবার আমরা যে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় অভ্যস্ত, সেটি হলো শিক্ষার সংকীর্ণ ধারণার রুপ। এ আর্টিকেলে আলোচনা করার চেষ্টা করা হয়েছে – শিক্ষা ও education শব্দদ্বয়ের উৎপত্তি, শিক্ষার সংজ্ঞা, শিক্ষার ধারণা এবং শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে।

শিক্ষা পরিচিতি: শিক্ষা কী, শিক্ষার সংজ্ঞা, ধারণা এবং লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য

শিক্ষা ও এডুকেশন শব্দের উৎপত্তি

শিক্ষা শব্দের উৎপত্তি

বাংলা ভাষার একটি শব্দ হলো শিক্ষা। এই শিক্ষা শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে সংস্কৃত ‘শাস্‌’ ধাতু থেকে। শাস্‌’র অর্থ শাসন করা, নিয়ন্ত্রণ করা, নির্দেশদান, উপদেশদান ইত্যাদি। শিক্ষা শব্দের পাশাপাশি আমাদের আরেকটি শব্দ এখানে খুবই গুরুত্বপূর্ণ, সে শব্দটি ‘বিদ্যা’। সংস্কৃত এ শব্দের উৎপত্তি হয়েছে ‘বিদ্‌’ থেকে, যার অর্থ- জানা। জানার অর্থ হলো কোনো কিছু সম্পর্কে জ্ঞানলাভ করা অর্থে শিক্ষালাভ করা।

এডুকেশন (Education) শব্দের উৎপত্তি

Education শব্দটির উৎপত্তি নিয়ে বেশ কিছু মত রয়েছে। নিচে এগুলো উল্লেখ করা হলো-

অনেক গবেষক ও শিক্ষাগবেষকই একমত হয়েছেন যে, শিক্ষার ইংরেজি প্রতিশব্দ education এর উৎপত্তি হয়েছে ল্যাটিন শব্দ educare অথবা educere থেকে। এখানে educare শব্দের অর্থ হলো – to train (প্রশিক্ষিত করা) এবং to accustom (অভ্যস্ত করা)। কেউ কেউ বলে থাকেন educare এর আরেকটি অর্থ – to bring up (লালন-পালন করা)।

অন্যদিকে educere শব্দের অর্থ হলো – to lead out বা বের করে আনা। এখানে ‘বের করে আনা’ মানে হলো সুপ্ত মানসিক শক্তির বিকাশ ঘটানো। education এর উৎপত্তি educere থেকে হয়েছে এটি খুব বেশি মানুষ বিশ্বাস না করলেও, কেউই আলোচনার টেবিলে একে বাদ দিয়ে কথা বলতে পারেন না।

আবার বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, education শব্দটি সরাসরি educare থেকে আসেনি। মাঝখানে পার হতে হয়েছে বেশ কয়েকটি ধাপ। ল্যাটিন educare থেকে আমরা বেশ কিছু শব্দের জন্ম সম্পর্কে জানতে পারি। এদের মধ্যে educat এবং educatio ল্যাটিন শব্দ, এখান থেকে একইসঙ্গে ইংরেজি শব্দের educate (কাউকে শেখানো) এর উৎপত্তি হয়। এভাবেই ষোড়শ শতাব্দিতে ইংরেজি শব্দ education উৎপত্তিলাভ করে।

কেউ কেউ বলে থাকেন ইংরেজি ভাষার শব্দ education এসেছি ল্যাটিন শব্দ educatum থেকে যার অর্থ the act of training বা প্রশিক্ষণের নিয়ম/রীতি। জোসেফ টোয়াডেল শিপলি নামক এক পণ্ডিত তাঁর লিখিত Dictionary of Word Origins’এ লিখেছেন যে, ইংরেজি education এর উৎপত্তি হয় ল্যাটিন edex এবং duccrduc শব্দদ্বয় থেকে। এখানে edex এর অর্থ ‘বের করা’ এবং duccrduc এর বাংলা করলে হয় ‘পথ প্রদর্শন করা’।

সাধারণ অর্থে শিক্ষা

মানুষ জন্ম থেকে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত অনেক কিছুই শেখে। কোনো ব্যক্তি যা কিছু শেখে তাকেই আমরা ‘শিক্ষা’ হিসেবে অভিহিত করতে পারি। এটি হলো শিক্ষার প্রাথমিক ধারণা। এ হিসেবে আমরা সমাজের প্রতিটি মানুষই শিক্ষিত কারণ শিক্ষার সাধারণ ধারণা অনুসারে প্রতিটি মানুষই কিছু না কিছু জানে বা পারে।

সাধারণ অর্থে শিক্ষার বৈশিষ্ট্য-

  • মানুষ যা শেখে বা জানে তার নামই শিক্ষা
  • কেউ অশিক্ষিত নয়
আধুনিক শিক্ষা হলো একটি শিক্ষার্থীকেন্দ্রীক প্রক্রিয়া; এই শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষার্থীকে শিখন-শিক্ষণ কার্যক্রমে স্বক্রিয় অংশগ্রহণমূলক হয়ে থাকে।

ব্যাপক অর্থে শিক্ষা

সাধারণ অর্থে শিক্ষার ধারণা এবং ব্যাপক শিক্ষার ধারণা মূলত একই। কারো যখন জন্ম হয় তখন থেকেই সে তার পরিবেশ থেকে শিক্ষা নিতে থাকে এবং শিক্ষা নেওয়ার ফলে আচরণগত পরিবর্তন হয়। শিক্ষা হলো মানবীয় প্রচেষ্টায় একটি সামাজিক প্রক্রিয়া যা কোনো না কোনো বাস্তব সমস্যার সমাধানকেন্দ্রিক হয়ে থাকে।

ব্যাপক অর্থে শিক্ষার যে ধারণা দিয়েছেন শিক্ষাবিজ্ঞানীরা তা ব্যক্তির ওপর পরিবেশের সার্বিক প্রভাব সম্পর্কিত। একজন ব্যক্তি যে পরিবেশের সদস্য ওই পরিবেশের উন্নতি, অবনতি বা যে-কোনো ধরনের পরিবর্তন বা অবস্থার সাথে মানিয়ে নিতে পারার সক্ষমতা অর্জন হলো শিক্ষা।

ব্যাপক অর্থে শিক্ষার বৈশিষ্ট্য

  1. প্রত্যেকেই শিক্ষিত এবং অশিক্ষিত কেউ নেই।
  2. শিক্ষা আচরণগত পরিবর্তন আনে।
  3. শিক্ষা হলো একটি মানবীয় প্রচেষ্টার ফল।
  4. শিক্ষা একটি জীবনব্যাপী প্রক্রিয়া।
  5. শিক্ষা হলো নির্দেশনার সমষ্টি।
  6. শিক্ষা হয়ে থাকে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যনির্ভর।
  7. শিক্ষা একটি সামাজিক ও মনোসামাজিক প্রক্রিয়া।

বিশেষ অর্থে শিক্ষার ধারণা

বিশেষ অর্থে শিক্ষার ধারণাকে আমরা শিক্ষার সংকীর্ণ ধারণাও বলতে পারি। সত্যি কথা হলো – আমাদের আলোচনার টেবিলে যে শিক্ষা (education) নিয়ে সর্বদা আলোচনা হয় বা আমরা যে অর্থে শিক্ষা শব্দটিকে ব্যবহার করি তা বিশেষ বা সংকীর্ণ অর্থেই ব্যবহার করি। প্রচলিত প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাব্যবস্থাই হলো শিক্ষার বিশেষ বা সংকীর্ণ ধারণার রুপ। বিশেষ অর্থে শিক্ষা হলো স্বীকৃত কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নির্দিষ্ট কোনো বিষয় বা বিষয়সমূহে জ্ঞানার্জন করা। যারা বিদ্যালয় কিংবা পাঠশালা থেকে পড়া, লেখা ও গণিতের প্রাথমিক ধারণালাভ থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন পর্যায়ের ডিগ্রিপ্রাপ্ত হয়েছেন তাঁরাই শিক্ষার বিশেষ অর্থ অনুযায়ী শিক্ষিত। অন্যদিকে যারা কোনো সময়েই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যেতে পারেনি তাঁদের অশিক্ষিত বলা হয়।

বিশেষ বা সংকীর্ণ বা সীমিত অর্থে শিক্ষার কতগুলো বৈশিষ্ট্য-

  1. শিক্ষা হলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অর্জিত জ্ঞান ও দক্ষতা।
  2. শিক্ষা হলো একটি কাঠামো ও স্তর ভিত্তিক প্রক্রিয়া।
  3. শিক্ষা হলো সুপরিকল্পিত ও সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্যভিত্তিক প্রক্রিয়া।
  4. শিক্ষাব্যবস্থা পরিচালিত হয়ে থাকে দেশের সরকারি বা প্রশাসনিক দিকনির্দেশনা অনুযায়ী।
  5. শিক্ষার্থীদের শিক্ষাদানের জন্য শিক্ষক নিয়োজিত থাকেন।

বিশেষ অর্থে শিক্ষা বলতে সেই শিক্ষাকে বোঝায় যা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অর্জিত হয়। যে-কারণে অত্যন্ত দক্ষ একজন মিস্ত্রির যদি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকে তাহলে তাকে শিক্ষিত বলা হয় না। আবার একজন ডিগ্রিধারি প্রকৌশলী যদি নিজ কাজে খুব একটা দক্ষ না-ও হন তাহলেও তিনি শিক্ষিত বলে গণ্য হবেন।

শিক্ষা কাকে বলে বা শিক্ষার সংজ্ঞা কী?

শিক্ষা নিয়ে যারা কথা বলেছেন তাঁরা প্রত্যেকেই নিজের মতো করে ভেবে নিয়েছেন শিক্ষাকে, নিজের মতো করে সংজ্ঞা দিয়েছেন। শিক্ষাবীদ কিংবা মনিষী, যার সংজ্ঞাই দেখা হোক না কেন, খুব একটা সন্তুষ্ট হওয়া যায় না। তাই বলে যাদের হাত ধরে শিক্ষা ও শিক্ষাব্যবস্থা আজ পর্যন্ত এসেছে তাঁদের মতো শিক্ষাবিদ বা মনিষীদের বলে যাওয়া বা লিখে যাওয়া কথাগুলোকে এড়িয়ে চলাও সম্ভব নয়।

কয়েকজন শিক্ষাবিদের মতে শিক্ষার সংজ্ঞা

প্লেটো শিক্ষাকে সনাক্ত করেছেন ন্যায় বিচার অর্জনের উপায় হিসেবে। তিনি বলেছেন, “শিক্ষা হলো ব্যক্তিগত এবং সামাজিক ন্যায়বিচার উভয়ই অর্জনের উপায়”। শিক্ষা সামাজিক ন্যায়বিচারের উপায় হলেও সামাজিক সাফল্যের মাধ্যম নয় বরং এটি এমন একটি পথ যা সত্যের কাছে পৌঁছে দেয়”।

অ্যারিস্টটল বলেছেন, “সুস্থ দেহে সুস্থ মন তৈরির নামই শিক্ষা”।

জন ডিউই How We Think বইয়ে লিখেছেন, শিক্ষা হলো জীবনযাপনের প্রক্রিয়া তবে ভবিষ্যতে জীবনযাপনের প্রস্তুতি নয়।

মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র বলেন, শিক্ষা কোনো ব্যক্তিকে পরিবর্তন করে পরীক্ষানিরীক্ষা করে মিথ্যা থেকে সত্য, অবাস্তব থেকে বাস্তব, কল্পনা থেকে প্রকৃতকে আলাদা করতে সক্ষম করে তোলে।

এফ. জে. ব্রাউন শিক্ষা সম্পর্কে বলেন, “শিক্ষা এমন একটি প্রক্রিয়া যা কারো জন্ম থেকে শুরু হয়ে জীবনব্যাপী চলতে থাকে। শিক্ষাই জীবন, পুরোটা জীবনই শিক্ষা”।

বি. এফ. স্কিনার বলেছেন, “শিক্ষা মানে বৃদ্ধি আর বৃদ্ধি মানে হলো বহুমুখী বিকাশ”।

জোহান হেইনরিখ পেস্তালতজির মতে, “শিক্ষা হলো মানুষের অন্তর্নিহিত শক্তির স্বাভাবিক, সুষম ও প্রগতিশীল বিকাশ”।

জন ফ্রেডারিক হার্বার্ট বলেছেন, “মানুষের নৈতিক চরিত্রের বিকাশ সাধন হলো শিক্ষা”।

স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন, “শিক্ষা হলো মানুষের অন্তর্নিহিত মহত্বের বিকাশ”।

আধুনিক শিক্ষা কী?

যে প্রক্রিয়ায় ব্যক্তি বা শিক্ষার্থীর চাহিদা, আগ্রহ, প্রবণতা, প্রয়োজনীয়তা ইত্যাদিকে গুরুত্ব প্রদান করে অগ্রসরমান সমাজ ও বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে চলার উপযোগী করে গড়ে যোগ্য জনসম্পদরুপে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা হয় সে প্রক্রিয়াকে আধুনিক শিক্ষা বলা হয়। আধুনিক শিক্ষা হলো একটি শিক্ষার্থীকেন্দ্রীক প্রক্রিয়া; এই শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষার্থীকে শিখন-শিক্ষণ কার্যক্রমে স্বক্রিয় অংশগ্রহণমূলক হয়ে থাকে।

শিক্ষা হলো এমন একটি প্রক্রিয়া যা একজন মানুষের অন্তর্নিহিত ও বাহ্যিক গুনাবলি বিকাশে সহায়ক হিসেবে কাজ করে তাকে সমাজের উৎপাদনশীল সদস্য তথা জনসম্পদে রুপান্তর করে। শিক্ষা নামক এই প্রক্রিয়া হলো একটি বিজ্ঞানভিত্তিক পদ্ধতিগত প্রক্রিয়া। শিক্ষার মাধ্যমে মানুষের আচরণের পরিবর্তন হয়। তবে এ কথা সত্য যে, সারা বিশ্বে অতি পরিচিত এ প্রত্যয়টির সর্বজনগ্রাহ্য কোনো সংজ্ঞা কিংবা ধারণা এখনো তৈরি হয়নি।

তাই বলে সন কিছুকে শিক্ষা হিসেবে ধরা হয় না। মানুষ যা শেখা তা যদি শিক্ষা হিসেবে গণ্য করতে হয় তবে এর জন্য বেশ কয়েকটি শর্তের মধ্য দিয়ে আসতে হবে যা পূরণ না হলে ওই শিখনকে শিক্ষা বলা যাবে না। শিক্ষা প্রত্যয় হিসেবে গণ্য হবার আগে দেখতে হবে তা মানুষ ও সমাজের জন্য ইতিবাচক, কল্যাণকর ও ব্যক্তি ও সমাজের জন্য প্রত্যাশিত পরিবর্তন আনতে সহায়ক হবে কি না।

শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য কী?

শিক্ষার ধারণা যেমন নির্দিষ্ট কোনো রুপ লাভ করতে পারেনি তেমনই শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়েও রয়েছে নানান মত। যুগে যুগে শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের ধরন পাল্টেছে। দেশ, জনগোষ্ঠী, বিশ্বাস, রীতিনীতি কিংবা প্রয়োজনের দিক বিবেচনায়ও শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের পার্থ্যক্য দেখা যায়। এখানে শিক্ষার বেশ কিছু সাধারণ উদ্দেশ্য উল্লেখ করা হলো-

শিক্ষার জ্ঞানার্জনমূলক লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য

শিক্ষার অন্যতম প্রধান লক্ষ্য হলো জ্ঞানার্জন করা। জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমেই মানুষের বিভিন্ন দিকে দক্ষতা বৃদ্ধি পায়। মানুষের চিন্তাশক্তির বিকাশলাভ তখনই সম্ভন হয় যখন জ্ঞানার্জন করে। জ্ঞান অর্জন করলে যেমন ব্যক্তির মানসিক উন্নতি হয় তেমনই ব্যবহারিক দিকেও উন্নতি হয়। জ্ঞানকে শুধু জানার মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে ‘প্রকৃত জ্ঞান’ প্রত্যয়ের ওপর গুরুত্ব দেওয়া জরুরি। সক্রেটিস, ফ্র্যান্সিস বেকন, ফ্রয়েবল, বেঞ্জামিন ব্লুম কিংবা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সবাই জ্ঞানার্জনের প্রতি গুরুত্বারোপ করেছেন। যদি বলা হয় শিক্ষার প্রথম ও প্রধান লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হলো জ্ঞানার্জন করা তাহলেও কেউ ভুল বলে অ্যাখ্যায়িত করতে পারবেন বলে মনে হয় না।

শিক্ষার বৃত্তিমূলক লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য

আধুনিক বিশ্বের আধুনিক শিক্ষার অন্যতম প্রধান লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হলো মানবসম্পদ তৈরি ও মানবসম্পদ উন্নয়ন। শিল্পবিপ্লবের পর থেকেই বৃত্তিমূলক শিক্ষায় আলাদা করে গুরুত্বারোপ করা হচ্ছে। নিত্যনতুন প্রযুক্তির আগমন, কর্মসংস্থানের সৃষ্টি ও কর্মসংস্থানে প্রবেশের জন্য বৃত্তিমূলক শিক্ষার প্রয়োজন। বৃত্তিমূলকশিক্ষাই মানুষের মৌলিক চাহিদা মেটাতে, সমাজ ও দেশের উন্নয়নে সহায়ক ভূমিকা রাখে। বৃত্তিমূলক বা কর্মমূখী শিক্ষাকে ‘bread and butter aim of education’ বা ‘শিক্ষার রুজি লক্ষ্য’ বলে অভিহিত করে থাকেন। মানুষের শিক্ষার প্রধান লক্ষ্য-উদ্দেশ্য জ্ঞানার্জন হলেও তা যথাযথ বৃত্তিমূলক বা কর্মমুখী শিক্ষার ছাড়া প্রায় মূল্যহীন। বৃত্তিমূলক শিক্ষাই পারে ব্যক্তিকে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করতে যা সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রবেশগম্যতা বাড়ায়।

শিক্ষার সামাজিক লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য

শিক্ষার উদ্দেশ্য তা নয় যা ব্যক্তিকে নিজের মধ্যে বা গুটিকয়েক মানুষের মধ্যে আবদ্ধ করে ফেলে। আত্মকেন্দ্রিক মানুষ খুব সহজেই সমাজচ্যুত হয়ে যেতে পারে। মানুষ সামাজিক জীব আর শিক্ষার উদ্দেশ্য হলো মানুষকে সামাজিক দক্ষতায় দক্ষ করে গড়ে তুলে সমাজচ্যুত হয়ে যাওয়া ঠেকানো। প্রশ্ন জাগতে পারে যে, সামাজিক দক্ষতার কানে কী হতে পারে। সামাজিক দক্ষতা হলো – সমাজে সকলের সঙ্গে আনন্দের সাথে বসবাসের জন্য সমাজের সদস্যদের সাথে আন্তঃব্যক্তিক সম্পর্ক স্থাপন, নৈতিক ও আচরণগত জ্ঞান, সাংস্কৃতিক জ্ঞান, সমাজ সচেতনতা, অর্থনৈতিক সামর্থ্য অর্জনসহ যে অত্যাবশ্যকীয় সামর্থ্য ও যোগ্যতার প্রয়োজন সেসব কিছুর সমষ্টি। ব্যক্তির সামাজিক দক্ষতার উন্নয়ন আধুনিক শিক্ষার গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হিসেবে চিহ্নিত করেছেন শিক্ষাবিদ ও সমাজবিদগণ।

শিক্ষার সাংস্কৃতিক লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য

নির্দিষ্ট সমাজে বসবাসরত লোকজনের আচার-আচরণ, আদর্শ, জ্ঞান, কলাকৌশল, দক্ষতা, ধ্যান-ধারণা, বিশ্বাস, অভ্যেস ইত্যাদির সমষ্টিকে সংস্কৃতি বলে। সংস্কৃতি হলো সমাজবদ্ধ মানুষের পরিপূর্ণ জীবনচিত্র। এর আরেক হলো সামাজিক উত্তরাধিকার (social heritage)। সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যগুলো মানুষ পেয়ে থাকে তার পূর্বপুরুষদের নিকট থেকে উত্তরাধিকারস্বরুপ।

যথাযথ সাংস্কৃতিক জ্ঞান না থাকার কারণে যে কেউ পিছিয়ে থাকতে পারে। সাংস্কৃতিক জ্ঞানের অভাব দূর করতে পারে শিক্ষা। শিক্ষার সাংস্কৃতিক লক্ষ্য হলো ব্যক্তিকে সত্যের অনুসারী করে তাকে রুচিশীল করা। মানুষ যা তাঁদের পূর্বপুরুষদের নিকট থেকে যে সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যাবলী পেয়ে থাকে অনেক সময় তা ইতিবাচক ও কল্যাণকর না-ও হতে পারে। যে সকল সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য ইতিবাচক ও কল্যাণকর নয় তা পরিহার করতে সাহায্য করে শিক্ষা। আবার সংস্কৃতির যে সকল দিক সবার জন্য ইতিবাচক, কল্যাণকর ও প্রত্যাশিত যে সকল দিক বা বৈশিষ্ট্যকে আরও উন্নত করাও শিক্ষার উদ্দেশ্য।

শিক্ষার সাংস্কৃতিক লক্ষ্যের উদ্দেশ্যসমূহ

  1. সাংস্কৃতিক জ্ঞান অর্জন
  2. সাংস্কৃতিক কুসংস্কার দূরীকরণ
  3. ব্যক্তিকে মার্জিত ও রুচিশীল করা
  4. সাংস্কৃতিক রীতিনীতির বিকাশ
  5. সংস্কৃতির কল্যাণকর ও ইতিবাচক দিকগুলোকে ধারণ করা
  6. সংস্কৃতির অকল্যাণকর ও নেতিবাচক দিকগুলোকে বর্জন

নৈতিক চরিত্র গঠনমূলক লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য

অনেক শিক্ষাবিদের মতে, শিক্ষার প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিৎ শিক্ষার্থীর নৈতিক চরিত্র গঠন। যেমনটি বলেছেন জার্মান দার্শনিক ও শিক্ষাবিদ জোহান ফ্রেডারিক হার্বার্ট। হার্বার্ট বলেন, শিক্ষার্থীর চরিত্র গঠনই শিক্ষার প্রধান লক্ষ্য।

শিক্ষার নৈতিক চরিত্র গঠমূলক লক্ষ্যে পৌঁছানোর উদ্দেশ্য

  1. উচ্চতর মূলবোধ অর্জন ও চর্চা
  2. মনোবৃত্তি ও ইচ্ছাশক্তির বিকাশ
  3. সুশৃঙ্খল মনোভাব
  4. সার্বিক নৈতিক আচরণের উন্নতি

ব্যক্তিক বিকাশমূলক লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য

আধুনিক শিক্ষাদর্শনের অন্যতম মুলকথা হলো শিক্ষার্থীর ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবোধ জাগ্রত করে আত্মসত্তায় বিশ্বাসী করে গড়ে তোলা। ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের সাবেক প্রফেসর ব্রিটিশ শিক্ষাবিদ স্যার থমাস পার্সি নান বলেছে, “স্বতন্ত্রতা হলো জীবনের আদর্শ এবং ব্যক্তিগত কৃতিত্বে সর্বোচ্চ ডিগ্রি অর্জনেই শিক্ষাপদ্ধতি চূড়ান্ত মূল্যায়িত হয়”। শিক্ষার্থীর দৈহিক, আবেগিক এবং আত্মিক উন্নয়নে বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করেছেন শিক্ষাবিদগণ। তাঁরা মনে করেন, পরিপূর্ণ জীবন গড়ে ওঠার পেছনে সুস্থ্য দেহ এর সুষ্ঠু বিকাশ এবং সুস্থ দেহে সুস্থ্য মন থাকাটা জরুরি। অ্যারিস্টটল বলেছেন, “সুস্থ দেহে সুস্থ মন তৈরির নামই শিক্ষা”। আত্মোপলব্ধি ও আত্মপ্রকাশ, এই দুটি মানুষের গুরুত্বপূর্ণ মানবীয় গুণ, যার বিকাশ ঘটানোর জন্য শিক্ষা যথাযথ ভূমিকা পালন করে।

শিক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থীর ব্যক্তিক লক্ষ্যে পৌঁছানোর মধ্য দিয়ে যে সব উদ্দেশ্য অর্জন করা সম্ভব

  1. দেহের সুষ্ঠু বিকাশ ঘটানো
  2. সুস্থ দেহ ও সুস্থ দেহে সুস্থ্ মনের সৃষ্টি করা
  3. আত্মোপলব্ধি ও আত্মপ্রকাশের দক্ষতা বৃদ্ধি করা
  4. আত্মিক বিকাশ ঘটানো
  5. অন্তর্নিহিত ক্ষমতার বিকাশ ঘটানো
  6. উচ্চতর আদর্শ জাগ্রত করা
  7. নিজেকে জানার দক্ষতা বৃদ্ধি করা
  8. আত্মবিশ্বাসী করা
  9. চিন্তাশক্তি বৃদ্ধি করা
  10. ব্যক্তি ও বুদ্ধিবৃত্তিক স্বাধীন হিসেবে গড়া

জীবনধারামূলক লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য

শিক্ষার খুবই গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য হলো পূর্ণাঙ্গ জীবন যাপনের লক্ষ্য। সমাজবিজ্ঞানী ও শিক্ষাবিদ হারবার্ট স্পেন্সার শিক্ষার  লক্ষ্য নিয়ে কথা বলেছেন। তিনি মনে করেন, মানুষকে বহুমুখী গুণ বা দক্ষতার অধিকারি হতে হয়। শিক্ষা অর্জনের মাধ্যমে মাধ্যমে মানুষ সঠিকভাবে জীবনধারণ ও জীবনধারণের সঠিক পদ্ধতি খোঁজ পেতে সক্ষম হয়। শিক্ষা হলো জীবনযাপনেরপূর্ণাঙ্গ প্রস্তুতি। মানবসমাজে প্রতিনিয়ত যেমন পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে তেমনই বিকশিতও হচ্ছে। এর ফলে এ মানবসমাজ নানান  বৈশিষ্ট্য ধারণ করেছে এবং ভবিষ্যতেও অনেক বৈশিষ্ট্য ধারণ করবে। এ সব কিছুর সাথে ব্যক্তিকে মানিয়ে নিয়ে বা চলমান জীবনধারার উপযোগী করে তোলাও শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য।

শিক্ষার জীবনধারামূলক লক্ষ্যে পৌঁছানোর উদ্দেশ্য

  1. জীবনযাপনের সঠিক পদ্ধতি রপ্ত করা
  2. পরিবর্তনশীল ও বিকাশমান সমাজপদ্ধতির সাথে মানিয়ে নেওয়া
  3. সমাজের ইতিবাচক পরিবর্তনে ভূমিকা রাখা

শিক্ষা প্রসঙ্গে ইংরেজিতে পড়তে ক্লিক করুন