হিন্দু ধর্ম তথা সনাতন ধর্মের প্রবর্তক, গ্রন্থ ও বৈশিষ্ট্য
- প্রকাশ: ১২:৪৯:২২ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৫ অগাস্ট ২০২১
- / ৭০১০ বার পড়া হয়েছে
বৈদিক সভ্যতার যেমন লিখিত নিদর্শন আছে হরপ্সা ও মহেঞ্জোদারোতে সেই রকম কোনো নিদর্শন পাওয়া যায়নি। প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে বিশেষত বন্যা-জলোচ্ছাসের কারণে যদি এ সভ্যতা ধ্বংস হয়ে থাকে; তবে তা না পাওয়ারই কথা। তবে অনেক গবেষকই এ ব্যাপারের নিঃসন্দেহ হয়েছেন যে, সেই সময় মাতৃপূজার গুরুত্ব ছিল বেশি এবং আচার-আচরণের মাধ্যমে সেই দর্শন ও প্রথা জনসাধারণ বহনও করেছিল দীর্ঘদিন। পরবর্তীতে পুরুষদেবতা তথা প্রকৃতি দেবতার দিকে মনোযোগ বৃদ্ধি পেলেও কোথাও কোথাও মাতৃদেবীর পূজাও সম্পন্ন হয়েছে আড়ম্বরের সঙ্গেই। আরও পরবর্তীকালে উভয় দেব-দেবী ও তৎসম্পর্কিত আচার-আচরণের মিশ্রণে সৃষ্টি হয়েছে হিন্দু ধর্ম তথা হিন্দু সংস্কৃতি। হিন্দু ধর্মকে সাধারণত সনাতন ধর্ম নামেই অভিহিত করা হয়। এই নিবন্ধে হিন্দু ধর্ম তথা সনাতন ধর্মের প্রবর্তক, ধর্মগ্রন্থ ও এই ধর্মের বৈশিষ্ট্য নিয়ে আলোচনা করা হবে।
হিন্দু ধর্মের প্রবর্তক ও ধর্মগ্রন্থ
হিন্দু ধর্মের যেমন নির্দিষ্ট কোনো প্রবর্তক নেই; তেমনি এর কোনো নির্দিষ্ট ধর্মগ্রন্থও নেই। ভক্তগণ ভক্তিসহকারে এ জন্য বলেন যে, স্বয়ং ঈশ্বর এর স্রষ্টা, আর জ্ঞান ও বিবেক এর ধর্মগ্রন্থ। অন্যরা এটা মেনে না নিলেও তারা জানেন যে, এই ধর্মের মূলে রয়েছে গুরু ও শিষ্য। বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন গুরু ও অবতার যে বাণী প্রচার করেছেন, সেইগুলোর সমষ্টিই হিন্দু ধর্ম। গুরুর বাণী শিষ্য পরম্পরা প্রথমে মুখে মুখে মুখস্তের মাধ্যমে, তারপর লিপিবদ্ধ হয়ে বয়ে এসেছে বর্তমান পর্যন্ত। বৈদিক ঋষিগণ একে ঐশীবাণী বলে প্রচার করেছেন। তবে সকল বাণীই যেহেতু বেদ, উপনিষদকে ভিত্তি করে বর্ণিত; তাই এইগুলোই সেই হিসেবে মুল ধর্মগ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত।
কোনো কিছু শত শত বৎসর যাবৎ মুখস্ত রাখা যেমন কঠিনতর কর্ম; তেমনি অবিকৃতভাবে লিপিবদ্ধ করে রাখাও কষ্টসাধ্য। বৈদিক খষি থেকে শুরু করে পরবর্তীকালের শাস্ত্রকারগণ তারপরও সেই কর্ম বেশ সফলভাবে করেছিলেন সম্পাদন। সফল নাই বা হবেন কেন? শিষ্যগণ তো গুরুর উপদেশ ও বাণী কেবল মুখস্তই করতেন না; অবিকৃতভাবে উচ্চারণের জন্য করতেন কঠোর পরিশ্রম। উচ্চারণের ব্যাকরণও তাদের ঠোটস্থ রাখতে হতো সব সময়। যখন লেখার প্রচলন শুরু হলো তখন বিশুদ্ধতাবে লেখার জন্য ব্যাকরণ, ছন্দ, অলংকারের ওপর নির্ভরশীল হতে হলো ঠিকই; কিন্তু সেগুলোও সঠিকভাবে আবৃত্তি করার জন্য সুর, স্বর, উচ্চারণের দিকে মনোযোগ রাখতে হতো। এ সম্পর্কে সুকুমার সেন (Sukumar Sen) বলেছেন, “একটানা প্রায় দেড়-দুই হাজার বৎসর ধরিয়া খগ্বেদের মতো গ্রন্থ মুখে মুখেই পুরুষানুক্রমে কালবাহিত হইয়া পরিশুদ্ধভাবে আসিয়াছে। মৌখিক পরিবহনে যাহাতে ভ্রমপ্রমাদের প্রবেশ না ঘটে সেজন্য সেকালের বেদজ্ঞেরা অত্যন্ত সর্তক ছিলেন। খগ্বেদের সূক্ত অভ্রান্তভাবে মনে রাখিবার ও বিশুদ্ধভাবে আবৃত্তি করিবার উদ্দেশ্যে অনেক উপায় অবলম্বিত হইয়াছিল। …মুখে মুখে খগ্বেদ রেকর্ড করার বিভিন্ন উপায়গুলিকে ‘পাঠ’ বলা হয়। সাধারণ পরিচিত হইতেছে ‘পদপাঠ’ ৷ পদপাঠ প্রণালীতে প্রত্যেক পদ সন্ধি ভাঙ্গিয়া এবং সমাস পদ হইলে সমাস ভাঙ্গিয়া একটি একটি করিয়া পড়া হইত।”
এসবের ফাঁকেও যে লিপিকার বা আবৃত্তিকারের নিজস্ব মতামত এর মধ্যে প্রবেশ করেনি, তা জোর দিয়ে বলা যায় না। তবে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন গুরুর উপদেশ ও ব্যাখ্যা কিন্তু পূর্ববর্তী মতকে (মূলত বেদ) কেন্দ্র করেই তৈরি হয়েছিল। ভারতবর্ষের বিভিন্ন সময়ের বিভিন্ন শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিত, সাধক, অবতার বা গুরুর বাণী বা তাদের কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা কাহিনি সমুহই তাই পরবর্তীকালে ধর্মশান্ত্রের মর্যাদা লাভ করে ছিল। তবে বেদই হিন্দুদের মূল ধর্মগ্রন্থ; উপনিষদ এর দার্শনিক রূপ; আর পুরাণ গল্পকারে উপস্থাপিত এদের কিছু উদাহরণ বা ব্যাখ্যা বিবৃতি। ক্ষিতিমোহন সেন (Kshitimohan Sen) এ সম্পর্কে বলেন, “খ্রিস্টান, ইসলাম বা বৌদ্ধ- বিশ্বের এইসব ধর্মের যেমন একজন প্রবর্তক আছেন, হিন্দু ধর্মের তেমন কোনও প্রবর্তক নেই। প্রায় পাঁচ হাজার বছর ধরে ভারতের সমস্ত ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনকে সাঙ্গীকরণ ও স্বীকরণের মধ্য দিয়ে ক্রমশ গড়ে উঠেছে এই ধর্ম। …বেদ, উপনিষদ, গীতা, রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণ, তথাকথিত ষড়দর্শন বিষয়ক গ্রন্থাবলি ভক্তিধর্মান্দোলনের পদাবলি সাহিত্য, মরমীয়া সাধকের গান এ সমস্তই প্রামাণ্য আকর, কিন্তু কোনওটিই একক ভাবে নয়।”
আচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় (Bhashacharya Acharya Suniti Kumar Chatterji) বলেন, “হিন্দু ধর্মের প্রথম বৈশিষ্ট্য, ইহা অন্য কতকগুলি ধর্মের মতো কোনও ব্যক্তি বিশেষের জীবন-কাহিনী অথবা জীবন-চরিত এবং তাঁহার প্রচারিত মতবাদের সঙ্গে অচ্ছেদ্যভাবে জড়িত নহে। যেমন যিশু খ্রিস্টকে বাদ দিয়া খ্রিস্টান ধর্মের অস্তিত্বের কল্পনাই করা যায় না, জরথুস্ট্রিয় (Zoroastrianism) ও বুদ্ধদেব ছাড়া জরথুস্ট্রশাস্ত্রীয় ও বৌদ্ধ ধর্ম যেমন হয় না, মোহম্মদের জীবনী ও শিক্ষা যেমন ইসলাম বা মোহম্মদিয় ধর্মের অন্যতর প্রধান প্রতিষ্ঠা, হিন্দু ধর্মে সেরূপ কোনও একজনমাত্র অবতার বা তত্ত্বজ্ঞ বা ধর্মগুরুর সর্বগ্রাহিতা নাই। পৃথিবীর ইতিহাসে বিশেষ দেশে এবং বিশেষ কালে বিদ্যমান কোনো একজন মহাপুরুষকে আশ্রয় করিয়া এই অন্য ধর্মগুলি নিজ শাশ্বতত্ত্ব প্রচার করিতেছে। দেশ-কাল পাত্র-নিবন্ধ মনুষ্য-চরিত্রের সীমার মধ্যে হিন্দু ধর্ম তাহার স্বীকৃত তত্বগুলিকে সীমাবদ্ধ করিতে চাহে নাই। হিন্দু ধর্মকে প্রাচীন মিসর, অ্যাসিরিয়, ব্যাবিলনিয়, প্রাচীন গ্রিস, চীন, জাপান প্রভৃতি দেশের ধর্মের মতো একটি Natural Religion বা স্বভাবজাত ধর্ম বলা যাইতে পারে; কারণ মানুষের অভিব্যক্তির সঙ্গে তাল রাখিয়া এইরূপ ধর্মের বিকাশ হয়, এবং জীবনের নানামুখিতার মতোই এইরূপ স্বভাবজাত ধর্ম নানামুখ। এই সমস্ত স্বভাবজাত ধর্মকে, যেগুলি কোনো বিশেষ আচার্য্যের শিক্ষাময় শাস্ত্রের মধ্যে নিবদ্ধ নহে, যেগুলি কেতাবি ধর্ম নহে, যাহা বিশ্ব-প্রপঞ্চের ও মানব-জীবনের পরিচালনাকারী কতকগুলি বিধি মানে, সেই ধর্মগুলিকে প্রাচীন কালে ইউরোপে খ্রিস্টানরা Pagan অথবা ‘জানপদ’ ধর্ম বলিত। হিন্দু ধর্মও এইরূপ Pagan ধর্ম; ইহা-ই ইহার প্রধান গৌরবের কথা, ইহার সার্থকতা এখানেই।”
ড. অতুল সুর বলেন, “হিন্দু ধর্ম বলতে আমরা সেই ধর্মকে বুঝি যে ধর্মের অনুগামীদের জীবনচর্যা একটা বিশেষখাতে প্রবাহিত হয় এবং যারা বেদ-পুরাণ-তন্ত্র ও ধর্মশাস্ত্রগুলিকে তাদের ধর্মের ভিত্তি বলে মনে করে। কিন্তু হিন্দুর জীবনচর্যার কোন একটা বিশেষ ও বিশিষ্ট রূপ নেই। …কালের আবর্তনের সঙ্গে তার বিবর্তন ঘটেছে এবং সেই সঙ্গে তার জীবন চর্যারও পরিবর্তন ঘটেছে। তার মানে, হিন্দু সমাজ Static বা অনড় নয়, এটা dynamic বা সচল”।
হিন্দু দর্শনে সকল অধ্যাত্মবাদ
বিশ্বে প্রচলিত সব অধ্যাত্ম মতবাদই হিন্দু দর্শনে পাওয়া যায়। ঈশ্বরের নিরাকার, সাকার উভয় রূপই এই মতে স্বীকার করে নেয়া হয়েছে। উদ্ভিদ সহ সকল প্রাণিতে ঈশ্বরের অবস্থান স্বীকৃত হওয়ার পাশাপাশি জড় বন্তুতেও তীর ঠাই হয়েছে সম্মানের সঙ্গে। ঋগ্বেদেই তাই তিনি হয়েছেন ‘একমেবাদ্ধিতীয়ম্’।
সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় এ সম্পর্কে বলেন, “প্রায় সব ধর্মের মতন হিন্দু এক শাশ্বত সত্তাকে মানে। সংক্ষেপে এই শাশ্বত সত্তার স্বরূপ নিরূপণ করা অসম্ভব। উহার প্রকাশ নানা ভাবে হয়। এই প্রকাশকে ধরিবার জন্য হিন্দু দুইটি মুখ্য পথকে স্বীকার করে- এক, জ্ঞানের পথ; আর দুই, ভক্তির পথ; (যুক্তি ও তর্ক বা বিচারের পথ, অনুভব বা অনুভূতির পথ)। হিন্দুদের মধ্যে কোনো কোনো মতে একটির দিকে বেশি করিয়া ঝৌক দেওয়া হয়; যেমন শৈব টাহেন জ্ঞানের দ্বারা ঈশ্বরকে, শাশ্বত সত্তাকে বুঝিতে; বৈষ্ণব চাহেন, ভক্তির দ্বারা ইহাকে আস্বাদন করিতে। সাধারণ হিন্দু আদর্শে দুটিকেই রাখা হয়-_জ্ঞান-মিশ্র ভক্তি, বা ভক্তি-মিশ্র জ্ঞান। এই দুই পথ পৃথক্ কিন্তু পরস্পরের পরিপূরক”।
সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় আরো বলেন, “কতকগুলি ধর্ম, এক-একটি বিশেষ প্রকারের সাধনাকে, এক-একটি বিশেষ প্রকারের আধ্যাত্মিক অনুভূতি বা উপলব্ধিকে, মোক্ষ-সাধনের একমাত্র অদ্বিতীয় মার্গ বা উপায় বলিয়া মনে করে; এই শ্রেণীর ধর্ম অন্য সকল প্রকারের অনুষ্ঠান ও মতবাদকে ভ্রান্ত বা মিথ্যা বলিয়া, মানব-সমাজে সেগুলির উদ্ভবকে শয়তানের কারসাজী বলিয়া মনে করে, এবং নানা উপায়ে নিজ ধর্ম কর্তৃক অননুমোদিত এই সকল সাধন-পথকে বিনষ্ট বা দূরীভূত করিবার চেষ্টায় থাকে। “আমার সাধন-মার্গই একমাত্র সাধন-মার্গ”, অথবা “আমার ধর্মসংস্থাপক গুরু বা মহাত্মার নিদিষ্ট সাধন, মার্গই একমাত্র পারমার্থিক পথ”- এইরূপ ধারণার অবকাশই হিন্দুর মনে হইতে পারে না, কারণ হিন্দু ধর্মের মধ্যে, অর্থাৎ হিন্দুজাতির মধ্যে উদ্ভূত মতবাদগুলির মধ্যে সাধারণ এবং ব্যাপকভাবে, কোনও একটি বিশেষ মতকে প্রাধান্য দেওয়া হয় নাই।”
একেবারেই যে প্রাধান্য দেয়া হয়নি, একথা অবশ্য সর্বাংশে সত্য নয়। হিন্দু ধর্মের কোনো কোনো শাখা, কোনো কোনো সময় নিজেদেরে শ্রেষ্ঠ কিংবা তাদের মতটিই একমাত্র সত্য, এমন মন্তব্য উত্থাপন করেছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কালের ইতিহাসে তারা টিকে থাকতে পারেনি। শাক্ত, বৈষ্ণব, শৈব সম্প্রদায় তো বটেই, দ্বৈত, অদ্বৈতবাদীরাও নিজ নিজ মতকে শ্রেষ্ঠ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে শেষ পর্যন্ত সমন্বয়ের নিকট আত্মসমর্পণ করেছেন। গৌতম বুদ্ধ নিজে কোনো পৃথক ধর্ম সৃষ্টি না করলেও তার মৃত্যুর পর অনুসারীরা স্বতন্ত্র বৌদ্ধ মত প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে ভারতবর্ষ থেকে উৎখাত হয়েছে। আধুনিক যুগের শুরুতে দেবেন্দ্র, রবীন্দ্র, রামমোহনের মতো অসামান্য শক্তিশালী ও সুউচ্চ শিক্ষিত সুশীল সমাজও নিরাকার অদ্বৈতবাদ পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন। কাজেই ভারতবর্ষ যে-নির্দিষ্ট একটি মত ও পথের দেশ নয়, এটা বারবার প্রমাণিত হয়েছে। এখানে সবকিছু এসে মিলিত হয়; আবার এখান থেকেই নতুন করে শুরু হয় পথ পরিক্রমণ।
মাতৃপূজা, পুরুষপূজা, শক্তিপূজা
মাতৃপূজা হরপ্পা-মহেঞ্জোদারো যুগে ব্যাপকভাবে প্রচলিত থাকলেও বৈদিক যুগে ম্রিয়মান হয়ে পড়েছিল। মধ্যযুগে বাংলায় পুরুষ পূজার (শিব, বুদ্ধ, বিষ্ণু) আধিক্য দেখা গেলেও অন্তমধ্যযুগে এসে আবার শক্তিপূজার অভ্যু্থান ঘটে। তবে দেবতা ও দেবীর কেহই কোনো কালে সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষিত থাকেননি। সাধারণ হিন্দুর কাছে সকলেরই গ্রহণযোগ্যতা সর্বকালে ছিল সুপ্রতিষ্ঠিত।
উল্লেখ্য, বেদে পুরুষ দেবতার পাশাপাশি কয়েকজন স্ত্রী দেবতার উল্লেখ বর্তমান; আবার সিন্ধু সভ্যতায় নারী দেবতার সঙ্গে পুরুষ দেবতার অস্তিত দৃশ্যমান। মধ্যযুগে একসময় হরগৌরী এবং রাধা-কৃষ্ণের যুগল উপসনার চিত্রও হয়েছে প্রত্যক্ষ।
বস্তুত “বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের ভিতরে এশ্বরিক সত্তা বা শক্তি বিদ্যমান “খেলতি অপ্ডে, খেলতি পিণ্ডে,”- ঐশী শক্তি ব্রহ্মাণ্ডে বা বিশ্ব প্রকৃতিতে লীলা করিতেছেন, মানবদেহে মানব-প্রকৃতিতেও লীলা করিতেছেন; শক্তি-রূপে, কাম-রূপে, দুঃখ-রূপে মানুষের জীবনে এই শক্তি অদৃশ্যভাবে বিরাজমান, আবার জড় জগতের গতি ও অবস্থা-বিপর্যয়ের মধ্যেও এই শক্তি ক্রিয়মাণ৷ যেমন যজুর্বেদের (Yajurveda) শতরুদ্রিয়তে বলা হয়েছে, “হে রুদ্র-শিব, তুমি পাতায় আছো, তোমাকে নমস্কার; তুমি পাতার ঝরাতেও আছো, তোমাকে নমস্কার।”
ক্ষিতিমোহন সেন এ সম্পর্কে বলেন, “বেদে ঘোষণা করা হল- “তিনি এক এবং অদ্বিতীয় যদিও প্রাজ্ঞেরা তাকে নানা নামে ডাকেন (ঋগবেদ, ২১, ১৬৪, ৪৬)। মহাভারতে বলা হল, সব বেদই এক ও অভিন্ন। সত্য এক। আমাদের অজ্ঞানতাই একে বহুধা বিভক্ত করে। যিনি পরম এক তিনি শুধু একজন স্থপতি নন, তিনি স্রষ্টাও। এবং তিনি সৃষ্টি করেন নিজেরই ভেতর থেকে। এ-বিশ্বের জন্ম তার আনন্দ থেকে। অসীম নিজেকে প্রকাশ করছেন বহু নামে, বহু রূপে। এই তত্ব প্রথম উল্লেখ পাই সংহিতায়। পরে তা বিশদভাবে উপস্থিত হয়েছে উপনিষদে।
সেই পরম এক তার নিজের সৃষ্টিতে বাধা পড়েন না, কেননা স্বভাবে তিনি মুক্ত। এই বিশ্ব তার লীলার অভিব্যক্তি, তার আনন্দের প্রকাশ, আমরা তারই অংশ। আত্মা আর ব্রহ্মার এই একাত্মতার কথা আছে উপনিষদে, বিশ্বের সকল মানুষের উদ্দেশ্য এই মহাবাণী ‘তৎ ত্বম অসি’, ‘তুমিই তিনি’। এই মত অনুযায়ী মানব জীবনের উদ্দেশ্য সেই মহা উৎসের সঙ্গে যোগ। উপনিষদে এ তত্ত্বের বিশদ বিকাশ হলেও এর প্রথম সাক্ষাৎ পাই বৈদিক সংহিতায়। শতাব্দীর ধারায় দৃষ্টি স্থাপন করলে দেখা যাবে হিন্দুধর্মের যা-কিছু মহার্য তার উৎসরূপে দঁড়িয়ে আছে বেদ।”
মধ্যযুগের দেব-দেবী
বাংলার বিভিন্ন স্থান থেকে মধ্যযুগে যেসব মূর্তি উৎকলিত হয়েছে তা থেকে উপলব্ধি করা যায় যে, সেই সময় বিষ্ণু, শিব এবং গৌতম বুদ্ধের উপাসনা হতো ব্যাপকভাবে ৷ তবে চৈতন্য পরবর্তী যুগে রাধা-কৃষ্ণের যুগল অথবা বিচ্ছিন্ন উপাসনার সঙ্গে সঙ্গে অন্নদা, চণ্ডী এদেরও প্রভাব বৃদ্ধি পেতে থাকে। শিবোপাসক কর্তৃক মনসাকে মেনে নেয়ার চিত্র যেমন মনসামঙ্গল কাব্যে প্রত্যক্ষ হয়; তেমনি শন্বিত, সন্তোষী ব্রত, কার্তিক ব্রত ও সূর্য ব্রতৈর মতো অনুষ্ঠানগুলোর ব্যাপ্তি পেতে দেখা যায় ব্রতকাহিনি সমুহে। গ্রাম বাংলার বিভিন্ন স্তরের নারী সমাজে এসব পূজা দারুণভাবে তখন জনপ্রিয়তা লাভ করে। সীমিত ক্ষেত্রে গঙ্গাপূজার প্রচলনও যে তখন ছিল; তার প্রমাণ পাওয়া যায় বিভিন্ন স্থানে গঙ্গা পূজার সংবাদ থেকে। রাজশাহী বিভাগের নাটোর শহরের রাণী ভবানী রাজমন্দিরে গঙ্গাদেবীর একটি পূর্ণাঙ্গ যূর্তি এখনো কয়েকশত বৎসর পূর্বের গঙ্গা পূজার চিহ্ন বহন করছে। তবে যে যে-দেবীকেই আরাধনা করুক না কেন; হিন্দু দর্শনের মূল ভিত্তি বেদ। সংহিতা, উপনিষদ প্রভৃতি গ্রন্থসমূহ এর দার্শনিক রূপকে ধারণ করেছে। এই দর্শনকে ভিত্তি করেও পরবতীঁকালে অনেক দেবমূর্তি এবং তৎসংশ্লিষ্ট কাহিনির করা হয়েছে কল্পনা।