০৬:৪৬ অপরাহ্ন, রবিবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
                       

বই রিভিউ: পাঁচমুড়োর পঞ্চাননমঙ্গল

রিয়াজুল ইসলাম জুলিয়ান
  • প্রকাশ: ০১:১৬:১৩ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৫ অগাস্ট ২০২১
  • / ১২৩০ বার পড়া হয়েছে

পাঁচমুড়োর পঞ্চাননমঙ্গল


Google News
বিশ্লেষণ-এর সর্বশেষ নিবন্ধ পড়তে গুগল নিউজে যোগ দিন

বিশেষ শর্তসাপেক্ষে এবং স্বল্পমূল্যে এই ওয়েবসাইটটি সামাজিক কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ কিংবা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের নিকট বিক্রি করা হবে।

‘পাঁচমুড়োর পঞ্চাননমঙ্গল’ হলো লেখক প্রীতম বসুর লেখা একটি ঐতিহাসিক রহস্য উপন্যাস। বইটি প্রথম প্রকাশিত হয় ২০১৫ সালের এপ্রিল মাসে। লেখক নিজেই এর প্রকাশক। ‘পাঁচমুড়োর পঞ্চাননমঙ্গল’ পড়ে প্রকাশিত হয় যুক্তরাষ্ট্র থেকে। 

কিছু প্রাসঙ্গিক কথা

বই পাঠের প্রতিক্রিয়ায় যাবার আগে রিভিউ এর প্রয়োজনেই বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস সম্মন্ধে কিছু কথা বলে নেয়া দরকার। যারা বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস নিয়ে একটু পড়াশোনা করেছেন কোনো কারণে পড়তে বাধ্য হয়েছেন তারা জেনে থাকবে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসকে তিনটি যুগে ভাগ করা হয়েছে। প্রাচীন-মধ্য-আধুনিক যুগ।

প্রাচীন যুগের সাহিত্যের আদি নিদর্শন হল চর্যাশ্চর্যবিনিশ্চয় বা চর্যাপদ, যা ছিল সহজিয়া বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের সাধন সঙ্গীত; যেটি মহামোহপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ১৯০৭ সালে নেপালের রাজদরবার থেকে আবিষ্কার করেন।

মধ্যযুগের (১২০০-১৮০০) প্রথম দিককার ১৫০ বছর, মতান্তরে ২৫০ বছর সময়কালকে বলা হয় ‘অন্ধকার যুগ’, কারণ এই সময়কালে বাংলা সাহিত্যের কোনো উল্লেখযোগ্য নিদর্শন খুঁজে পাওয়া যায় না। ব্যতিক্রম শুধু রামাই পন্ডিতের ‘শূন্য পূরাণ’ এবং হলায়ুধ মিশ্রের ‘সেক শুভোদয়া’। এই যুগের পরের সাহিত্যিক রত্নসম্ভার হল বড়ু চণ্ডীদাসের ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’, পরবর্তীতে বিভিন্ন মহৎ কবিদের (বিদ্যাপতি, জ্ঞানদাস, গোবিন্দদাস, চণ্ডীদাস, বলরাম দাস) দ্বারা রচিত ‘বৈষ্ণব পদাবলী’।

এরপর আসে ‘মঙ্গলকাব্য’। কবিকঙ্কন মুকুন্দরাম চক্রবর্তী এর ‘চণ্ডীমঙ্গল’, ভারতচন্দ্র রায়গুনাকর এর ‘অন্নদামঙ্গল’, কানাহরিদত্তের ‘মনসামঙ্গল’, ময়ূরভট্ট এর ‘ধর্মমঙ্গল’ সহ আরও অনেক কবির লেখা এ জাতীয় মঙ্গলকাব্য ছিল মধ্যযুগের আরেক শ্রেষ্ঠ সম্পদ। এই ধরনের কাব্যে কবিরা বিভিন্ন কাহিনিকে আশ্রয় করে নিজেদের কথা, সমাজের কথা, আচারের কথা বর্ননা করতেন। বলা যায় নিজের কথা অন্যের মুখ দিয়ে প্রকাশ করতেন, ধর্মকে আশ্রয় করে। (এখানে একটা আলাদা তথ্য দিয়ে রাখি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার বড়ো ভাইয়ের স্ত্রী, যিনি কিনা তার প্রায় সমবয়সী ছিলেন, তাকে কবিতা পড়ে শোনাতেন। তিনি ভালোবাসতেন বিহারীলাল চক্রবর্তী নামের এক কবির কবিতা। রবীন্দ্রনাথ লক্ষ্য করেন অন্য কবিরা যেখানে নিজের মনের কথা ধর্মের আবরণে প্রকাশ করেছে, সেখানে প্রথম এই বিহারীলাল নিজের মনের কথা নিজেই প্রকাশ করেছেন কবিতায়। যার ফলে তা হয়ে উঠেছে জনসাধারন এর মনের কথা। তিনি বেশ আকৃষ্ট হয়ে পড়েন সেই কবিতাগুচ্ছে। নিজে আগে থেকে কিছু লেখালেখি করলেও বিহারি লাল এর কবিতার মাধ্যমে তিনি আরও বেশি অনুপ্রাণিত হয়ে কাব্যচর্চা আরম্ভ করেন। বিহারীলাল চক্রবর্তী কে তিনি ‘ভোরের পাখি’ বলে উপাধি দেন। এখনো বাংলা সাহিত্যে তাকে ভোরের পাখি বলে ডাকা হয়।)

মঙ্গলকাব্যের পাঁচটি অংশ থাকে: বন্দনা, আত্মপরিচয়, দেবখন্ড, মর্ত্যখন্ড ও শ্রুতিফল।

‘পাঁচমুড়োর পঞ্চাননমঙ্গল’এ কী আছে?

চয়নবিলের তলা থেকে আবিষ্কৃত হলো পাথরে খোদাই করে ১৪০০ সালের কথ্য বাংলা ভাষায় ও লিপিতে লিখিত পঞ্চাননমঙ্গল কাব্য। কিন্তু সেখানে কেন পঞ্চানন ঠাকুরের পূজার মন্ত্রে আমাদের পূর্বপুরুষেরা লুকিয়ে রেখেছিল অজস্র আধুনিক অঙ্কের সুত্র?

ছয়শত বছর আগেরকার বাঙালির অজস্র অজানা পারদর্শীতার আলেখ্য দেখে গর্বে বুক ফুলে উঠবে, কিন্তু এক অশুভ বৈদেশিক শক্তি পঞ্চাননমঙ্গল ধ্বংস করার জন্য কেন উন্মত্তপ্রায়? বখতিয়ার খলজী নালন্দা ধ্বংস করে তিনমাস ধরে পুথি পুড়িয়ে আমাদের অতীত মুছে দিয়েছিল। তবে কি পঞ্চাননমঙ্গলের সাথে সাথে হারিয়ে যাবে প্রাচীন বাঙালির বিজ্ঞান, সাহিত্য, দর্শনের শেষ দলিল?

কাহিনির শুরুতেই দেখা যায় যে গৌড় থেকে এক সেনাপতি সুলতানের আদেশে এক মন্দির ধ্বংস করতে এসে সেটা না পেয়ে তারপর পাশের এক বৌদ্ধ বিহারের অজস্র পুথি আগুনে পুড়িয়ে ধ্বংস করে ফেলে।

এরপর কাহিনি একলাফে চলে আসে ১৯৯৬ সালে পাঁচমুড়ো এর পুরানো জমিদারবাড়িতে। সেখানে জমিদার উত্তরসূরি সদানন্দ ভটচাজের বাড়িতে প্রাচীন পুথি বিক্রির চেষ্টারত কালাচাঁদ চোর কে দেখা যায়। ড. অংশুমান ধাড়া নামক এক বিলাতি সাহেবের জন্য পুথি আসল না নকল সেটা পরীক্ষার কাজ করে সদানন্দ। এরপরে সেখানে খবর আসে চয়নবিলের তলা থেকে লিপিখোদাই করা এক পাথরের সাথে শিকলে বাধা কংকাল উদ্ধার করা হয়েছে।

কালাচাঁদ এরপর পাঁচমুড়ো থেকে উদ্ধার হওয়া এক পাথরের লিপি থেকে টোকা কাগজ নিয়ে আসে হরু ঠাকুর এর কাছে যে কিনা লিপির জাল করার ব্যাপারে সিদ্ধহস্ত এক লোক। সেখানেই দেখা মেলে হরু ঠাকুরের ভাগ্নে বদন এর, যে কম্পিউটার সায়েন্স নিয়ে পড়াশোনা করেছে। সে কালাচাঁদ এর আনা কাগজ থেকে লিপির কবিতা পড়ে বের করে যে কবিতার আড়ালে অংকের সুত্র বিবৃত আছে। সাথে সাথে কালাচাঁদ বুঝে যায় এক স্বর্ণখনি এর খোজ পাওয়া গেছে।

সদানন্দের বিশ্বাস এই পাথরগুলো হলো সেই লোকমুখে শুনে আসা রহস্যময় ‘পঞ্চাননমঙ্গলকাব্য’, যেটা অনেক আগে হারিয়ে গিয়েছিল কোন সুত্র না রেখেই। এখানেই গল্প জটিল হয়ে পড়ে।

এক বিদেশি ফ্যানাটিক এসে পড়ে কাব্যটা দখল করার জন্য। তার জালে ফেঁসে যায় কালাচাঁদ সহ বাকি দুইজন। এরপর কালাচাঁদ এর বিভিন্ন তৎপরতায় ও কূটচালে উপন্যাসটি সমাপ্তির দিকে এগোয়। সদানন্দ এর গভীর জ্ঞান আর মাঝে হরু ঠাকুরের সাথে ঘটা কিছু রহস্যময় ঘটনা পাঠককে অতীতের সাথে সংযোগ করিয়ে দেয়।

অন্ধকার যুগ কেন এসেছিল তার কিছু কারণ পাঠকের সামনে উপস্থাপিত হয়। সাথে পুরো কাহিনী জুড়েই মঙ্গলকাব্যের বলা যায় একপ্রকার ব্যবচ্ছেদ চলে।

আমার কাছে ‘পাঁচমুড়োর পঞ্চাননমঙ্গল’ যেমন

আমি পুরোই চমৎকৃত হয়েছি বইটা পড়ে। লেখক প্রাচীন বাংলা লিপি বিষয়ে বিশেষজ্ঞ এক স্কলার, তাই কাহিনীজুড়েই তার গভীর জ্ঞানের পরিচয় পেয়েছি। কাহিনী তে যে পঞ্চাননমঙ্গলকাব্য তৈরি করা হয় তা লেখকের নিজের লেখা। প্রাচীন কথ্য বাংলা আর লিপিভাষার মিশ্রনে তিনিই সেটা লিখেছেন, যা কিনা বেশ কঠিন একটা কাজ।

গল্প বলে যাওয়া আর বাক্যগঠনে লেখক দারুণ দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। আমি সবচেয়ে বেশি আকৃষ্ট হয়েছি লেখকের সুক্ষ্ম রসবোধের প্রতি। প্রায় প্রতি পাতাতেই গভীর সব তত্ত্বালাপের ভীড়ে এমন করে হিউমারকে মাখিয়েছেন যে তা নিউমার্কেট থেকে কেনা এবং কালাচাঁদ এর রান্না করা হরিনের মাংসের মত সুস্বাদু হয়ে উঠেছে। তত্ত্বের আর ইতিহাসের ভীড়ে বিন্দুমাত্র বোর হবার সুযোগ দেননি। কালাচাঁদ, হরু ঠাকুর আর সদানন্দ তিনজনেই সমানে তাদের কথার ভিতর দিয়ে ‘কমিক রিলিফ’ বা ‘ব্রিদিং স্পেস’ দিয়েছে।

সবচেয়ে বেশি ভালো লেগেছে কালাচাঁদ চোরের ক্যারেক্টার, গল্পের মেইন প্রোটাগনিস্ট সে। রসিক, ক্ষেত্রবিশেষে চাটুকার, সুযোগ সন্ধানী, ঝুঁকি নেবার মানসিকতাওয়ালা, পরোপকারী- এইসব গুন তাকে ভালো-খারাপের মাঝামাঝি ‘গ্রে ক্যারেক্টার’ এ পরিণত করেছে।

লেখকের কি বাংলার মুসলিম শাসকদের প্রতি ক্ষোভ আছে?

সম্ভবত লেখকের বাংলার মুসলিম শাসকদের প্রতি ক্ষোভ আছে। অন্ধকার যুগ বাংলা সাহিত্যে কেন এসেছিল তা একটা তর্কসাপেক্ষ ব্যাপার। এই নিয়ে একাডেমিক মহলে তর্কবিতর্ক হয়েছে। এই বইতে লেখক মুসলিম শাসকদের দায়ী করেছেন। জাতিগত শ্রেষ্ঠত্বের আকাঙ্ক্ষাকে গল্পের যূপকাষ্ঠে ফেলে ইতিহাসের আলোকে দাঁড় করিয়েছেন।

শেষকথা

যদি জিজ্ঞাসা করেন বইটা পড়ে আমি কতটুকু সন্তুষ্ট, আমি বলব ৯৮.৫ পারসেন্ট। ১.৫ হাতে রেখে দিলাম এই কারনে যে, পৃথিবীতে কোন কিছুই পারফেক্ট না।

শেয়ার করুন

মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার তথ্য সংরক্ষিত রাখুন

লেখকতথ্য

রিয়াজুল ইসলাম জুলিয়ান

জুলিয়ান খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্রাজুয়েশন সম্পন্ন করেছেন। লেখালেখির জগতে বিচরণ করতে পছন্দ করেন। ২০১৯ সালে তার প্রথম মৌলিক বই 'নিঃশব্দ শিকারি' প্রকাশিত হয়েছে। এখন কাজ করছেন দ্বিতীয় বই 'আশিয়ানী' নিয়ে।

বিশেষ শর্তসাপেক্ষে এই ওয়েবসাইটটি সামাজিক কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ কিংবা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের নিকট বিক্রি করা হবে।

বই রিভিউ: পাঁচমুড়োর পঞ্চাননমঙ্গল

প্রকাশ: ০১:১৬:১৩ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৫ অগাস্ট ২০২১

‘পাঁচমুড়োর পঞ্চাননমঙ্গল’ হলো লেখক প্রীতম বসুর লেখা একটি ঐতিহাসিক রহস্য উপন্যাস। বইটি প্রথম প্রকাশিত হয় ২০১৫ সালের এপ্রিল মাসে। লেখক নিজেই এর প্রকাশক। ‘পাঁচমুড়োর পঞ্চাননমঙ্গল’ পড়ে প্রকাশিত হয় যুক্তরাষ্ট্র থেকে। 

কিছু প্রাসঙ্গিক কথা

বই পাঠের প্রতিক্রিয়ায় যাবার আগে রিভিউ এর প্রয়োজনেই বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস সম্মন্ধে কিছু কথা বলে নেয়া দরকার। যারা বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস নিয়ে একটু পড়াশোনা করেছেন কোনো কারণে পড়তে বাধ্য হয়েছেন তারা জেনে থাকবে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসকে তিনটি যুগে ভাগ করা হয়েছে। প্রাচীন-মধ্য-আধুনিক যুগ।

প্রাচীন যুগের সাহিত্যের আদি নিদর্শন হল চর্যাশ্চর্যবিনিশ্চয় বা চর্যাপদ, যা ছিল সহজিয়া বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের সাধন সঙ্গীত; যেটি মহামোহপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ১৯০৭ সালে নেপালের রাজদরবার থেকে আবিষ্কার করেন।

মধ্যযুগের (১২০০-১৮০০) প্রথম দিককার ১৫০ বছর, মতান্তরে ২৫০ বছর সময়কালকে বলা হয় ‘অন্ধকার যুগ’, কারণ এই সময়কালে বাংলা সাহিত্যের কোনো উল্লেখযোগ্য নিদর্শন খুঁজে পাওয়া যায় না। ব্যতিক্রম শুধু রামাই পন্ডিতের ‘শূন্য পূরাণ’ এবং হলায়ুধ মিশ্রের ‘সেক শুভোদয়া’। এই যুগের পরের সাহিত্যিক রত্নসম্ভার হল বড়ু চণ্ডীদাসের ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’, পরবর্তীতে বিভিন্ন মহৎ কবিদের (বিদ্যাপতি, জ্ঞানদাস, গোবিন্দদাস, চণ্ডীদাস, বলরাম দাস) দ্বারা রচিত ‘বৈষ্ণব পদাবলী’।

এরপর আসে ‘মঙ্গলকাব্য’। কবিকঙ্কন মুকুন্দরাম চক্রবর্তী এর ‘চণ্ডীমঙ্গল’, ভারতচন্দ্র রায়গুনাকর এর ‘অন্নদামঙ্গল’, কানাহরিদত্তের ‘মনসামঙ্গল’, ময়ূরভট্ট এর ‘ধর্মমঙ্গল’ সহ আরও অনেক কবির লেখা এ জাতীয় মঙ্গলকাব্য ছিল মধ্যযুগের আরেক শ্রেষ্ঠ সম্পদ। এই ধরনের কাব্যে কবিরা বিভিন্ন কাহিনিকে আশ্রয় করে নিজেদের কথা, সমাজের কথা, আচারের কথা বর্ননা করতেন। বলা যায় নিজের কথা অন্যের মুখ দিয়ে প্রকাশ করতেন, ধর্মকে আশ্রয় করে। (এখানে একটা আলাদা তথ্য দিয়ে রাখি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার বড়ো ভাইয়ের স্ত্রী, যিনি কিনা তার প্রায় সমবয়সী ছিলেন, তাকে কবিতা পড়ে শোনাতেন। তিনি ভালোবাসতেন বিহারীলাল চক্রবর্তী নামের এক কবির কবিতা। রবীন্দ্রনাথ লক্ষ্য করেন অন্য কবিরা যেখানে নিজের মনের কথা ধর্মের আবরণে প্রকাশ করেছে, সেখানে প্রথম এই বিহারীলাল নিজের মনের কথা নিজেই প্রকাশ করেছেন কবিতায়। যার ফলে তা হয়ে উঠেছে জনসাধারন এর মনের কথা। তিনি বেশ আকৃষ্ট হয়ে পড়েন সেই কবিতাগুচ্ছে। নিজে আগে থেকে কিছু লেখালেখি করলেও বিহারি লাল এর কবিতার মাধ্যমে তিনি আরও বেশি অনুপ্রাণিত হয়ে কাব্যচর্চা আরম্ভ করেন। বিহারীলাল চক্রবর্তী কে তিনি ‘ভোরের পাখি’ বলে উপাধি দেন। এখনো বাংলা সাহিত্যে তাকে ভোরের পাখি বলে ডাকা হয়।)

মঙ্গলকাব্যের পাঁচটি অংশ থাকে: বন্দনা, আত্মপরিচয়, দেবখন্ড, মর্ত্যখন্ড ও শ্রুতিফল।

‘পাঁচমুড়োর পঞ্চাননমঙ্গল’এ কী আছে?

চয়নবিলের তলা থেকে আবিষ্কৃত হলো পাথরে খোদাই করে ১৪০০ সালের কথ্য বাংলা ভাষায় ও লিপিতে লিখিত পঞ্চাননমঙ্গল কাব্য। কিন্তু সেখানে কেন পঞ্চানন ঠাকুরের পূজার মন্ত্রে আমাদের পূর্বপুরুষেরা লুকিয়ে রেখেছিল অজস্র আধুনিক অঙ্কের সুত্র?

ছয়শত বছর আগেরকার বাঙালির অজস্র অজানা পারদর্শীতার আলেখ্য দেখে গর্বে বুক ফুলে উঠবে, কিন্তু এক অশুভ বৈদেশিক শক্তি পঞ্চাননমঙ্গল ধ্বংস করার জন্য কেন উন্মত্তপ্রায়? বখতিয়ার খলজী নালন্দা ধ্বংস করে তিনমাস ধরে পুথি পুড়িয়ে আমাদের অতীত মুছে দিয়েছিল। তবে কি পঞ্চাননমঙ্গলের সাথে সাথে হারিয়ে যাবে প্রাচীন বাঙালির বিজ্ঞান, সাহিত্য, দর্শনের শেষ দলিল?

কাহিনির শুরুতেই দেখা যায় যে গৌড় থেকে এক সেনাপতি সুলতানের আদেশে এক মন্দির ধ্বংস করতে এসে সেটা না পেয়ে তারপর পাশের এক বৌদ্ধ বিহারের অজস্র পুথি আগুনে পুড়িয়ে ধ্বংস করে ফেলে।

এরপর কাহিনি একলাফে চলে আসে ১৯৯৬ সালে পাঁচমুড়ো এর পুরানো জমিদারবাড়িতে। সেখানে জমিদার উত্তরসূরি সদানন্দ ভটচাজের বাড়িতে প্রাচীন পুথি বিক্রির চেষ্টারত কালাচাঁদ চোর কে দেখা যায়। ড. অংশুমান ধাড়া নামক এক বিলাতি সাহেবের জন্য পুথি আসল না নকল সেটা পরীক্ষার কাজ করে সদানন্দ। এরপরে সেখানে খবর আসে চয়নবিলের তলা থেকে লিপিখোদাই করা এক পাথরের সাথে শিকলে বাধা কংকাল উদ্ধার করা হয়েছে।

কালাচাঁদ এরপর পাঁচমুড়ো থেকে উদ্ধার হওয়া এক পাথরের লিপি থেকে টোকা কাগজ নিয়ে আসে হরু ঠাকুর এর কাছে যে কিনা লিপির জাল করার ব্যাপারে সিদ্ধহস্ত এক লোক। সেখানেই দেখা মেলে হরু ঠাকুরের ভাগ্নে বদন এর, যে কম্পিউটার সায়েন্স নিয়ে পড়াশোনা করেছে। সে কালাচাঁদ এর আনা কাগজ থেকে লিপির কবিতা পড়ে বের করে যে কবিতার আড়ালে অংকের সুত্র বিবৃত আছে। সাথে সাথে কালাচাঁদ বুঝে যায় এক স্বর্ণখনি এর খোজ পাওয়া গেছে।

সদানন্দের বিশ্বাস এই পাথরগুলো হলো সেই লোকমুখে শুনে আসা রহস্যময় ‘পঞ্চাননমঙ্গলকাব্য’, যেটা অনেক আগে হারিয়ে গিয়েছিল কোন সুত্র না রেখেই। এখানেই গল্প জটিল হয়ে পড়ে।

এক বিদেশি ফ্যানাটিক এসে পড়ে কাব্যটা দখল করার জন্য। তার জালে ফেঁসে যায় কালাচাঁদ সহ বাকি দুইজন। এরপর কালাচাঁদ এর বিভিন্ন তৎপরতায় ও কূটচালে উপন্যাসটি সমাপ্তির দিকে এগোয়। সদানন্দ এর গভীর জ্ঞান আর মাঝে হরু ঠাকুরের সাথে ঘটা কিছু রহস্যময় ঘটনা পাঠককে অতীতের সাথে সংযোগ করিয়ে দেয়।

অন্ধকার যুগ কেন এসেছিল তার কিছু কারণ পাঠকের সামনে উপস্থাপিত হয়। সাথে পুরো কাহিনী জুড়েই মঙ্গলকাব্যের বলা যায় একপ্রকার ব্যবচ্ছেদ চলে।

আমার কাছে ‘পাঁচমুড়োর পঞ্চাননমঙ্গল’ যেমন

আমি পুরোই চমৎকৃত হয়েছি বইটা পড়ে। লেখক প্রাচীন বাংলা লিপি বিষয়ে বিশেষজ্ঞ এক স্কলার, তাই কাহিনীজুড়েই তার গভীর জ্ঞানের পরিচয় পেয়েছি। কাহিনী তে যে পঞ্চাননমঙ্গলকাব্য তৈরি করা হয় তা লেখকের নিজের লেখা। প্রাচীন কথ্য বাংলা আর লিপিভাষার মিশ্রনে তিনিই সেটা লিখেছেন, যা কিনা বেশ কঠিন একটা কাজ।

গল্প বলে যাওয়া আর বাক্যগঠনে লেখক দারুণ দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। আমি সবচেয়ে বেশি আকৃষ্ট হয়েছি লেখকের সুক্ষ্ম রসবোধের প্রতি। প্রায় প্রতি পাতাতেই গভীর সব তত্ত্বালাপের ভীড়ে এমন করে হিউমারকে মাখিয়েছেন যে তা নিউমার্কেট থেকে কেনা এবং কালাচাঁদ এর রান্না করা হরিনের মাংসের মত সুস্বাদু হয়ে উঠেছে। তত্ত্বের আর ইতিহাসের ভীড়ে বিন্দুমাত্র বোর হবার সুযোগ দেননি। কালাচাঁদ, হরু ঠাকুর আর সদানন্দ তিনজনেই সমানে তাদের কথার ভিতর দিয়ে ‘কমিক রিলিফ’ বা ‘ব্রিদিং স্পেস’ দিয়েছে।

সবচেয়ে বেশি ভালো লেগেছে কালাচাঁদ চোরের ক্যারেক্টার, গল্পের মেইন প্রোটাগনিস্ট সে। রসিক, ক্ষেত্রবিশেষে চাটুকার, সুযোগ সন্ধানী, ঝুঁকি নেবার মানসিকতাওয়ালা, পরোপকারী- এইসব গুন তাকে ভালো-খারাপের মাঝামাঝি ‘গ্রে ক্যারেক্টার’ এ পরিণত করেছে।

লেখকের কি বাংলার মুসলিম শাসকদের প্রতি ক্ষোভ আছে?

সম্ভবত লেখকের বাংলার মুসলিম শাসকদের প্রতি ক্ষোভ আছে। অন্ধকার যুগ বাংলা সাহিত্যে কেন এসেছিল তা একটা তর্কসাপেক্ষ ব্যাপার। এই নিয়ে একাডেমিক মহলে তর্কবিতর্ক হয়েছে। এই বইতে লেখক মুসলিম শাসকদের দায়ী করেছেন। জাতিগত শ্রেষ্ঠত্বের আকাঙ্ক্ষাকে গল্পের যূপকাষ্ঠে ফেলে ইতিহাসের আলোকে দাঁড় করিয়েছেন।

শেষকথা

যদি জিজ্ঞাসা করেন বইটা পড়ে আমি কতটুকু সন্তুষ্ট, আমি বলব ৯৮.৫ পারসেন্ট। ১.৫ হাতে রেখে দিলাম এই কারনে যে, পৃথিবীতে কোন কিছুই পারফেক্ট না।