উন্নয়ন বলতে কী বোঝায় এবং উন্নয়ন কার?
- প্রকাশ: ০৮:১১:৫৭ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৭ অগাস্ট ২০২১
- / ৭৭৫৫ বার পড়া হয়েছে
মানুষ উন্নয়ন প্রত্যাশী। উন্নয়ন মূলত মানুষের প্রচেষ্টার ফল। এই প্রচেষ্টায় নিয়োজিত হবার পূর্বে মানুষ কি ভেবে তা করতে প্রয়াস পেয়েছে তার ইতিহাস কিছুটা জানা দরকার? উন্নয়ন সম্পর্কে গ্রিক ও রোমান দার্শনিকদের চিন্তা-ভাবনার মধ্য দিয়ে এর সূত্রপাত। গ্রিকদের ব্যবহৃত ‘ফিসিস’ (physis) শব্দটি উন্নয়ন সম্পর্কে তাঁদের ধারণা প্রকাশ করে। ‘ফিসিস’ শব্দের সমার্থ হচ্ছে বৃদ্ধি উন্মোচিত বা বিকশিত হওয়ার অর্থে। গ্রিকরা ‘ফিসিস’ অভিধাটি সবধরনের জীবন্ত জিনিস যেমন, গাছ, প্রাণী, মানুষ বা সমাজের বেলায় রূপক হিসাবে ব্যবহার করত। সেই থেকে আজ পর্যন্ত দার্শনিক, সমাজ বিজ্ঞানী ও অর্থনীতিবিদরা উন্নয়নের বনু, মতবাদ, তত্ব বা ব্যাখ্যা দিয়ে আসছেন। সেই জটিল ও দীর্ঘ আলোচনা সংক্ষিপ্ত আকারে উপস্থাপনের পূর্বে উন্নয়ন বলতে সাধারণভাবে কি বোঝায় প্রথমে তা জেনে নেওয়া দরকার।
উন্নয়ন বলতে কী বোঝায়?
সমাজ পরিবর্তন ও উন্নয়নের ধারণা, মতবাদ ও তত্ত্বের আলোচনায় উন্নয়ন অভিধাটি নানাভাবে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে । এটি আসলে একটি চলমান ধারণা যা সময় ও অবস্থার প্রেক্ষিতে নতুন রূপ পরিগ্রহ করে। তবে সহজভাবে সংজ্ঞায়িত করতে হলে বলতে হয়- উন্নয়ন হলো বিদ্যমান অবস্থার কাঙ্খিত পরিবর্তন যা বিভিন্ন মাত্রায় পরিব্যপ্ত (desirable change of existing situation encompassing different dimensions)।
মনে রাখা দরকার যে-কোনো পরিবর্তন উন্নয়ন নয়; কোনো পরিবর্তন ইতিবাচক বা কাঙ্খিত হলেই তাকে উন্নয়ন বলে গণ্য করা হয়। উন্নয়নের সমার্থক শব্দ হচ্ছে ‘উন্নতি’, ‘অগ্রগতি’। এছাড়া বৃদ্ধি, ইতাচক পরিবর্তন, বিবর্তন, আধুনিকায়ন ইত্যাদি শব্দ উন্নয়নের অর্থ বহন করে। উন্নয়ন বিভিন্ন মাত্রায় পরিব্যাপ্ত বলতে অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, ইত্যাদি নানা ক্ষেত্রে উন্নয়নের কথা বোঝানো হয়েছে। বর্তমানে বহুল ব্যবহৃত শব্দবন্ধ টেকসই উন্নয়ন (sustainable development) বলতে কি বোঝায় তা জানা দরকার।
১৯৮৭ সালে অনুষ্ঠিত World Commission on Environment and Development – এর রিপোর্ট ‘In our Common Future’-এ বলা হয়েছে: ‘Sustainable development was conceived as development that meets present needs without constraints on satisfying the needs of future generations; as development that is economically, socially and ecologically sustainable.’
আজকাল ‘মানব উন্নয়ন’ (humandevelopment)-এর ধারণাটিও বহুল প্রচলিত। ইউএনডিপি (UNDP) রিপোর্টে “মানব উন্নয়ন’ ধারণা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলা হয়েছে যে এটি একটি প্রক্রিয়া যা মানুষকে তার পছন্দ অনুযায়ী জীবন বেছে নেবার প্রসারিত সুযোগ প্রদান করে (defined human development as a process of enlarging peoples choices) । এক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত হচ্ছে ঐ সব সিদ্ধান্ত যা সুস্থ ও দীর্ঘ জীবন লাভে, সুশিক্ষা অর্জনে ও যথোচিত জীবন যাপনের মান নিশ্চিতকরণে সহায়ক। এছাড়া যেসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে নিশ্চয়তা প্রদান মানব উন্নয়নের লক্ষ্য তা হলো: রাজনৈতিক স্বাধীনতা, মানবাধিকার এবং আত্মমর্ধাদা সুপ্রতিষ্ঠিতকরণ।
উন্নয়ন কার?
লক্ষ্য করা যায় যে উন্নয়ন সম্পর্কে যে-কোনো সাধারণ আলোচনায় সমাজ, দেশ ও জাতীয় উন্নয়নের বিষয়টি প্রাধান্য পায়। সমাজ, দেশ ও জাতীয় উন্নয়ন খুবই গুরুতৃপূর্ণ বিষয়। একটি গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় প্রত্যেক সচেতন নাগরিকের এই বিষয়ে গভীর আগ্রহ থাকা সুস্থ সমাজ-পরিবেশের লক্ষণ। কিন্তু সামষ্টিক উন্নয়নের চিন্তা-চেতনা ও আগ্রহের পাশাপাশি প্রত্যেক ব্যক্তির উন্নয়নের নিজন্ব ধ্যান-ধারণা ও কর্মপরিকল্পনা থাকা অপরিহার্য । জাতীয় উন্নয়নের সুফল ন্যায়ত প্রত্যেক নাগরিকের প্রাপ্য; কিন্তু কোনো দেশ বা জাতির উন্নতি হলেই সে দেশের প্রত্যেক ব্যক্তির আপনা আপনি উন্নতি হবে কিংবা তিনি উন্নত জীবনের অধিকারী হবেন এমনটা ভাবার অবকাশ নেই। সেজন্য প্রত্যেক ব্যক্তির উন্নয়নের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। অর্থাৎ আত্মউন্নয়ন উন্নয়নের সিঁড়ির প্রথম ধাপ।
প্রত্যেক মানব শিশুর জীবন অতিমূল্যবান। সে জন্ম নেয় অনেক সম্ভাবনা নিয়ে। সেই সন্তাবনার স্ফুরণ ও বিকাশ অনেকটাই নির্ভর করে শিশুর পরিবারের পরিবেশ, আর্থিক অবস্থা ও সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলের ওপর। অনুকূল সামাজিক অবস্থা ও বিদ্যালয়ের আনন্দঘন ও সহানুভূতিপূর্ণ পরিবেশ শিশুর বেড়ে ওঠা ও পরিপূর্ণ জীবনের লালন ক্ষেত্র হিসাবে বিবেচিত । শৈশব ও কৈশোরে এই গুরুত্বপূর্ণ সময়ে পিতা-মাতা, বিদ্যালয় ও সমাজকে সচেতন ও পরিকল্পিতভাবে শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের জীবন উন্নয়নের পরিবেশ ও ক্ষেত্র তৈরি করতে হয়। যে দেশ এই কাজ যত সুষ্ঠুভাবে করতে পারে তার ভবিষ্যৎ ততই সম্ভাবনাময় হয়ে ওঠে।
পিতা-মাতা, বিদ্যালয় ও সমাজের সস্নেহ ও পরিকল্পিত নিয়ন্ত্রণে শৈশব ও কৈশোর শেষে যৌবনে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নের সময়ে প্রত্যেক যুবক-যুবতীকে নিজের জীবন নিজে গড়ে তোলার জন্য সচেষ্ট হতে হয়। এই সময় স্বপ্নের সময়, পরিকল্পিত জীবন-যাপনের সময়, কর্মজীবনে প্রবেশের প্রস্তুতির সময়, দুঃসাহসের সময়, প্রেম ও ভালবাসার সময় অর্থাৎ জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়। কিন্তু সবকিছুই নির্ভর করে ব্যক্তির জীবনবোধের ওপর ও ব্যক্তি পর্যায়ে উন্নয়নের ধারণা ও সচেতনভাবে তা বাস্তবায়নের ওপর। পরবর্তীকালে সংসার জীবনে, কর্মজীবনে ও নাগরিক জীবনে উন্নয়ন সম্পর্কে উপলব্ধি ও আগ্রহ ব্যক্তি জীবনে সাফল্যের সহায়ক হয়ে ওঠে। তবে মানব জীবন সবসময় সহজ সরল পথে চলে না। মানুষের সব স্বপ্ন সত্য হয় না, বাস্তবে রূপলাভ করে না। মানুষের চাওয়া-পাওয়ার হিসাব প্রায়শ মিটে না। তবুও বলতে হয় ব্যক্তি জীবনে সাফল্য অর্জন বা উন্নতির জন্য শ্রম, অনুশীলন ও পরিকল্পিত পথে অগ্রসর হওয়ার কোনো বিকল্প নেই। এ জন্য জীবনমানের উন্নয়নের স্বচ্ছ ধারণা একাস্ত আবশ্যক। আসলে আত্মউন্নয়ন একটি জীবনব্যাপী প্রক্রিয়া। আত্মউন্নয়ন প্রক্রিয়াই পারে একজন ব্যক্তির মনে আত্মপ্রত্যয়ের সেই দ্বীপশিখা জ্বেলে দিতে যার বলে বলীয়ান হয়ে সে তার জ্ঞান, মেধা ও কর্মদক্ষতাকে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যার্জনে নিয়োজিত করে। অর্থাৎ নিজের কাজটি নিজেই করতে হয়। অন্য কোনো বাক্তি বা প্রতিষ্ঠান শুধু সহায়কের ভূমিকা পালন করতে পারে।
ব্যাপকতর অর্থে উন্নয়নের যুদ্ধ হচ্ছে জীবনের গুণগত মানের অগ্রগতি নিশ্চিত করা। বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশে এর লক্ষ্য হচ্ছে অধিকতর আয়, উন্নতমানের শিক্ষা, স্থাস্থ্য ও পুষ্টির উচ্চমান, দারিদ্র্যের ক্রমাবনতি, দূষণমুক্ত পরিবেশ, সুযোগের সমতা, ব্যক্তির স্বাধীনতা এবং সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক জীবন। এ ধরনের উন্নয়ন কিভাবে সুনিশ্চিত করা যায় সে সম্পর্কে নানা চিন্তা-ভাবনা, মতামত ও কলা-কৌশল আলোচনায় এসেছে। উন্নয়ন অভিধাটি নানাভাবে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা যায় ও ব্যাখ্যা করা যায়। প্রত্যেক ক্ষেত্রে এর রূপ ও চারিত্র্য কিছুটা হলেও ভিন্ন আকার ধারণ করে। এ জন্য উন্নয়ন কর্মকান্ডের সাথে যারা জড়িত তাদের স্পষ্ট ধারণা থাকা বাঞ্ছনীয় যে, তারা কিসের উন্নয়ন চান, কি ধরনের উন্নয়ন চান এবং কিভাবে তা অর্জন করতে চান। তা নাহলে কাঙ্খিত পরিবর্তন নাও আসতে পারে।
এক সময় মনে করা হতো আবহাওয়া, সংস্কৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ অর্থনৈতিক উন্নতির মূল চাবিকাঠি দ্রুত শিল্পায়ন উন্নয়নের ইঞ্জিন হিসাবে গণ্য করা হয়েছে বেশ কিছুকাল। পরবর্তীকালে মনে করা হয় যে, যদি সঠিকভাবে মানবসম্পদের জন্য বিনিয়োগ করা হয় তাহলে টেকসই উন্নয়নের সুদৃঢ় বুনিয়াদ গড়ে তোলা হবে। মানবিক পুঁজির জন্য বিনিয়োগ ও অর্থনৈতিক পরিবেশের গুণাগুণের সাথে উৎপাদনশীলতার যোগাযোগের প্রত্যক্ষ প্রমান পাওয়া যায়।