০৬:৩৭ অপরাহ্ন, রবিবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
                       

উন্নয়নের ধারণা ও তত্ত্বসমূহ

অধ্যাপক আবু হামিদ লতিফ
  • প্রকাশ: ০২:৪৩:২৩ অপরাহ্ন, শনিবার, ২১ অগাস্ট ২০২১
  • / ৯৮৭১ বার পড়া হয়েছে

উন্নয়ন | ছবি: iStock


Google News
বিশ্লেষণ-এর সর্বশেষ নিবন্ধ পড়তে গুগল নিউজে যোগ দিন

বিশেষ শর্তসাপেক্ষে এবং স্বল্পমূল্যে এই ওয়েবসাইটটি সামাজিক কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ কিংবা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের নিকট বিক্রি করা হবে।

বর্তমান আলোচনায় দেশ ও জাতির উন্নয়নের ধ্যান-ধারণা ও তত্বসমূহের ক্রমবিকাশ উপস্থাপন করা হয়েছে। পঞ্চম শতাব্দীতে খ্রিস্টধর্ম রোমের রাষ্ট্রধর্ম হিসাবে স্বীকৃতি লাভ করে। এই সময় হিব্রু, গ্রিক ও খ্রিস্টিয় চিন্তাধারার সমন্বয় ও অগ্রগতি উন্নয়ন সম্পর্কিত ধারণার একটা মৌলিক পরিবর্তন নিয়ে আসে। খ্রিস্টীয় মতাদর্শকে স্পষ্টভাবে তুলে ধরার ব্যাপারে যিনি সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন তিনি ছিলেন সেন্ট অগাস্টিন (Saint Augustine)। তার চিস্তা ও মতাদর্শ প্রতিফলিত হয় তার প্রণীত The City of God পুস্তকে। এই পুস্তকে লিপিবদ্ধ ভাবাদর্শ দ্বাদশ শতাব্দী পর্যন্ত ইউরোপিয়ান চিন্তাধারাকে আচ্ছন্ন করে রাখে। খ্রিস্টান চিস্তাবিদগণ এরূপ মতামত পোষণ করতেন যে, আদম হাওয়ার সৃষ্টি থেকে মানবজাতির যে যাত্রা শুরু তা খ্রিস্টের আগমনে পরিপূর্ণতা লাভ করে। এই জাগতিক পৃথিবীর ধ্বংস ও মৃত্যুর সাথে তার পরিসমাপ্তি ঘটবে এবং এই মহাবিপর্ষয় অত্যাসন্ন। সুতরাং ইহলৌকিক জীবন সম্বন্ধে তাঁরা হতাশাগ্রস্ত ও নিরাশাবাদী ছিলেন। তাদের কাছে পারলৌকিক জীবনই ছিল আসল জীবন এবং তাঁরা এ ব্যাপারে উৎসাহী ও আশাবাদী ছিলেন। তাঁরা মনে করতেন পার্থিব জীবনের পরিবর্তনের প্রধান শক্তি হচ্ছে প্রভুর ‘প্রভুর ইচ্ছে’ ৷ মধ্যযুগ পর্যন্ত এই মনোভাবের কোনো পরিবর্তন হয় নি। স্মতর্ব্য ইউরোপে মধ্যযুগের অন্য নামই হলো অন্ধকার যুগ, পুরোটা না হলেও অধিকাংশ তো বটেই। 

ইউরোপে রেনেসাঁস ও মানবিকতাবাদ

ইউরোপে রেনেসাঁসের পদধ্বনি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রযাত্রা সত্ত্বেও সেন্ট অগাস্টিনের (Saint Augustine) প্রভাব অব্যাহত থাকে। এই প্রভাব কমে আসে যখন রেনেসাসের ফলে ইউরোপে আধুনিক যুগের উত্তরণ ঘটতে থাকে। রেনেসাঁস বা নবজাগরণের মূলকথা হচ্ছে ইহলোকে ও ইহকালে পরিপূর্ণ জীবন। পরলোক বা পরকালের চিন্তা ছেড়ে দিয়ে মানুষ বাস্তবতার সন্ধানে আত্মনিয়োগ করে। রেনেসাঁসের একটা বিশিষ্ট লক্ষণ হচ্ছে সর্ববিষয়ে কৌতূহল বা অনুসন্ধিৎসা। অন্যটি হচ্ছে মানব জীবনকে সর্বপ্রকারে পরিপূর্ণ বা বিকশিত করা। রেনেসাঁস একটা নতুন মনোভাবের জন্ম দেয় তার নাম মানবিকবাদ বা হিউমানিজম (humanisml; মানুষই সবকিছুর মাপকাঠি। এই যে নতুন শিক্ষা বা নিউলার্নিং এটাই মধ্যযুগকে অপসারণ করে ইউরোপে আধুনিক যুগের পত্তন করে। 

ইউরোপে রেনেসাঁস, রিফরমেশন ও এনলাইটেনমেন্টের (Renaissance, Reformation, Enlightenment) কালপর্ব প্রায় চারশত বৎসর (১৫০০-১৮০০)। এই সময়ে বহু বুদ্ধিজীবী, দার্শনিক ও সমাজবিজ্ঞানীর আবির্ভাব হয়েছে যাঁরা সমাজ পরিবর্তন ও উন্নয়ন সম্পর্কে নানা মতবাদ তুলে ধরেছেন। ফরাসী বুদ্ধিজীবী বের্নারর ল্য বোভিয়ে (Bernard Le Bovier: 1688), ফরাসি গণিতবিদ ও দার্শনিক রনে দেকার্ত (Rene Descartes) এবং জামনি দার্শনিক ইমানুয়েল কান্ট (Emanuel Kant)-এর ভাবাদর্শ উন্নয়নের ধারণার বিবর্তনে প্রত্যক্ষ প্রভাব ফেলে। ল্য বোভিয়ে যেমনটা বলেছিলেন: সভ্যতা অতীতে অগ্রগতি লাভ করেছে, বর্তমানে অগ্রগতি করে চলেছে এবং অনন্ত ভবিষ্যতে তা করেই চলবে। এই মতামতই আধুনিক চিন্তাধারা হিসাবে গণ্য হয়। মানবজাতির বা সভ্যতার অগ্রগতির প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস ছিল পাশ্চাত্যের তৎকালীন মতাদর্শের মূলকথা। 

বুদ্ধিবৃত্তিক ও জ্ঞানভিত্তিক ঐতিহ্য

এদিকে প্রাচ্যে প্রায় এক হাজার বৎসর পূর্বে চীন সভ্যতা একটা বুদ্ধিবৃত্তিক ঐতিহ্য গড়ে তুলেছিল যা সমাজের নিরন্তর পরিবর্তনের শক্তিকে স্বীকার করত এবং তারা জানত মানুষের সার্থক জীবনযাপনের মূলনীতি কি হওয়া উচিত। এই চিস্তাধারার হোতা ছিলেন কনফুসিয়াস (Confucius)। এদিকে ভারতবর্ষে একটা জ্ঞান ভিত্তিক ঐতিহ্য বিজ্ঞ শিক্ষা গুরুর মাধ্যমে যুগের পর যুগ জনগণের মধ্যে সঞ্চারিত হতে থাকে। আফ্রিকা মহাদেশেও জ্ঞানানুশীলনে নিয়োজিত রাখা হতো। মধ্যপ্রাচ্যের ইসলামি দেশসমূহেও সমাজ পরিবর্তন সম্পর্কে নিজস্ব চিন্তা-চেতনার উন্মেষ দেখা যায়। এই পৃথিবীর প্রথম সমাজ বিজ্ঞানী ইবনে খালদুন সুশৃঙ্খল সমাজ পরিবর্তনে বিশ্বাস করতেন। পৃথিবীর সব প্রধান সংস্কৃতি অধ্যুষিত অঞ্চলই শিশু-সন্তানদের শিক্ষার ব্যাপারে সজাগ ছিল। 

সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতাব্দীতে এনলাইটেনমেন্টের যুগে বেশ কয়েকটি বিশ্বাস ও মতাদর্শ দেখা দেয় যা উন্নয়নের ভাবধারাকে প্রভাবিত করে। বিশেষ করে মনে করা হতো যে ধর্মীয় ও শাস্ত্রীয় জ্ঞানের জায়গা দখল করে নিয়েছে শুদ্ধ জ্ঞান ও বিজ্ঞান। প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া ক্রমবর্ধমান ও যৌক্তিক এবং প্রবৃদ্ধির ব্যাপারে তা সীমিত নয়। রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রধান কাজ হচ্ছে প্রকৃতি ও মানবজাতির স্বাভাবিক অগ্রগতির পথের সমস্ত প্রতিবন্ধকতা দূর করা। মানবসমাজের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে এনলাইটেনমেন্টের আশাবাদে বিশ্বাসী ফরাসী চিন্তাবিদ রুশো (Jean Jacq Rousseu) মনে করতেন মানব সন্তানের অগ্রগতি নির্ভর করে সভ্যতা দ্বারা সংক্রমিত মা হওয়ার যোগ্যতার ওপর। সংক্রমিত না হয়ে, সভ্যতার অংশীদার হয়ে একজন নাগরিকের দায়িত্ব পালন করে যাওয়ার মধ্যেই তার কৃতিত্ব। এই আপাত বৈপরীত্যের সমাধানের জন্যই রুশো শিক্ষার ওপর এত গুরুত্ব দিয়েছিলেন। 

উনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীর বিবর্তনমূলক তত্বসমূহ (Evolutionary Theories of Nineteenth and Twentieth Centuries) 

উনিশ শতকের প্রারম্ভে সমাজ পরিবর্তনে ও উন্নয়নে এনলাইটেনমেন্টের যুগের আশাবাদ- সমাজ ও সভ্যতা নিরন্তর অগ্রগতি করেই চলবে- এই ধারণা প্রশ্নের সম্মুখীন হয়। নিরন্তর আশাবাদের স্থলে আরও সুসংবদ্ধ এবং কিছুটা জটিল সব মতবাদ বা তত্ত্ব তুলে ধরা হয়। এই তত্ত্বসমূহকে এক কথায় বিবর্তনমূলক তত্ত্ব বলা যেতে পারে। এসব তাত্ত্বিকের পূর্বসূরী হিসাবে জার্মান দার্শনিক হেগেলের (Georg Wilhelm Friedrich Hegel) নাম উল্লেখ করা প্রয়োজন।

উন্নয়ন সম্পর্কে হেগেলের চিন্তাধারা কোনো কোনো ক্ষেত্রে ধুপদী, গ্রিক ও রোমান চিন্তাধারার সমগ্রোত্রীয়। তিনিও ধ্রুপদী ধারণা ‘ফিসিস’ এর মতাবলম্বী ছিলেন৷ হেগেলের দ্বাম্বিকতার (dialectic) ধারণা পরবর্তীকালে কার্লমার্কস (Karl Marx) ও তার অনুসারীদের প্রভাবিত করে। মার্কস মনে করতেন সমাজ দু’টি শ্রেণিতে বিভক্তশোষক ও শোষিত শ্রেণি যারা সবসময় দ্বন্দ্বে বিজড়িত। বিবর্তনমূলক অন্যান্য তাত্ত্বিকের মতো মার্কস মনে করতেন সমাজ ধাপে ধাপে অগ্রসর হচ্ছে।

যেমন, আদিম কমিউনিস্ট অবস্থা থেকে দাসত্রে অবস্থা, সামন্তবাদের অবস্থা, ধনবাদের অবস্থা, সমাজতন্ত্রের অবস্থা এবং সর্বশেষ স্বাপ্নিক কমিউনিস্ট সমাজ ব্যবস্থা। মার্কস এও মনে করতেন যে এই ধাপে ধাপে অগ্রসর হওয়াটাও সমাজের অভ্যন্তরে দ্বন্দ্ব থাকার ফলে এবং উৎপাদনের পদ্ধতির পরিবর্তনের ফলে নাটকীয়ভাবে দ্রুত সম্পন্ন হবে।

হেগেলের সমকালীন ফরাসি দার্শনিক ওগুস্ত কোঁত (Auguste Comte) হচ্ছেন সেই ব্যক্তি যিনি বিবর্তনমূলক তত্ত্বকে সুসংবদ্ধ করেন। হেগেলের মত কোঁত বিবর্তনমূলক তত্ত্বের কেন্দ্রবিন্দুতে মহাপ্রভুকে না বসিয়ে অগ্রগতি ও উন্নয়নকে দেখেছেন মানুষের বৈজ্ঞানিক অর্জনসমূহের অনুষঙ্গ হিসাবে। উনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে ব্রিটিশ দার্শনিক হার্বাট স্পেন্সার (Herbert Spencer) বিবর্তনমূলক তত্ত্বকে কিছুটা ভিন্নরূপে তুলে ধরেন। ম্যালথাসের (Malthus) মতো স্পেনসারও “যোগ্যতম ব্যক্তির বেঁচে থাকার অধিকার’ (Survival of the fittest)-এর মতবাদে বিশ্বাস করতেন। উনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধ ও বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধ পর্যন্ত কোন কোনো ক্ষেত্রে সূক্ষভাবে বিবর্তনমূলক তত্ত্ব প্রচলিত ছিল।

বিবর্তনমূলক তত্ত্বের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে: যে কোনো প্রাণী সত্তার মতো সমাজ অগ্রসর হয় একটি সহজ সরল আদিম অবস্থা থেকে একটা জটিল আধুনিক অবস্থায়। সামজিক উন্নয়নে এই ব্যাখ্যার একটা বাস্তব উদাহরণ দিতে গিয়ে দরিদ্র ও অশিল্পায়িত একটি সমাজকে বিবর্তনের আদিম অবস্থা এবং ধনী ও শিল্পায়িত দেশকে জটিল ও আধুনিক অবস্থার সমতুল্য বলে ধরে নেওয়া হয়। তবে স্বীকার করা হয় যে দরিদ্র ও ধনী নির্বিশেষে সব সমাজই অগ্রগতির পথে বিবর্তিত হচ্ছে। এই তত্ত্বের বেড়াজালে ঔপনিবেশিক শাষকগোষ্ঠী এবং ধর্মীয় মিশনারিরা উপনিবেশগুলোতে তাদের কর্মকাণ্ড পরিচালনার যৌক্তিকতা প্রদান করে। অর্থাৎ তাঁরা বলতে থাকেন যে, আদিম, পশ্চাৎপদ ও অসভ্য সমাজ ব্যবস্থাকে উন্নতির পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য। 

বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধেই প্রশ্ন তোলা হয় সমাজ উন্নয়নে বিবর্তনমূলক তত্ত্বের যথার্থতা নিয়ে। মানবজাতির নিরবচ্ছিন্ন অগ্রগতির ধারণা যা বিবর্তনমূলক তত্বের প্রধান প্রতিপাদ্য বিষয় তা নিয়ে অনেক যুক্তি-তর্কের অবতারণা করা হয়। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে নিরবচ্ছিন্ন অগ্রগতির তত্ত্ব আর ধোপে টেকে না। এটা প্রমাণিত হয় যে, সমাজের উত্থান ও পতন দুইই সত্ত্ব, কোনো সমাজই এর আওতা মুক্ত নয়। 

উন্নয়নের তত্ত্ব (Theories of Development)

উন্নয়নের কয়েকটি নির্দিষ্ট তত্ত্ব নিম্নে উল্লেখ করা হলো-

  • আধুনিকায়ন তত্ত্ব (Modernization Theory)
  • মানব পুঁজি তত্ত্ব (Human Capital Theory)
  • মার্কসের উন্নয়ন তত্ত্ব (Marxist Theories of Development) 
  • নির্ভরশীলতার তত্ত্ব (Dependency Theory)

আধুনিকায়ন তত্ব (Modernization Theory) 

১৮৫০ -এর দশকে আধুনিকায়ন তত্ত্ব প্রচলিত হয়। এই তত্রের প্রবক্তারা প্রথম দিকে অগ্রসর ও শিল্পায়িত দেশসমূহের ব্যাপারে মনোযোগ দেননি। তাঁরা মনে করতেন যে এসব দেশ এমন এক পর্যায়ে পৌছেছে যে, আধুনিকায়নের পথে সেসব দেশ অগ্রসর হতেই থাকবে।

আধুনিকায়ন তত্ত্ব একটি ধারণার ওপর প্রতিষ্ঠিত। আধুনিকায়ন তত্ত্ব যে ধারণার ওপর প্রতিষ্ঠিত সেটি হলো যে পাঁচটি চলের (Variable) মধ্যে একটির সাথে অপরটির প্রত্যক্ষ কার্যকারণ সম্পর্ক রয়েছে। চলগুলো হচ্ছে:

১. আধুনিকীকরণ প্রতিষ্ঠান (Modernizing institution)

২) আধুনিক মূল্যবোধ (Modern values)

৩) আধুনিক ব্যবহার (Modern behaviour)

8) আধুনিক সমাজ (Modern society)

৫) অর্থনৈতিক উন্নয়ন (Economic development)

এসব চলের প্রথম দুইটির সম্পর্ক যেভাবে প্রতিষ্ঠিত করা যায় অন্যগুলোর বেলায় তেমন সহজে করা যায় না, যদিও সবগুলোর মধ্যে কার্যকারণ সম্পর্ক রয়েছে বলে বলা হয়ে থাকে। 

এই আধুনিকায়ন তত্ব আন্তঃশান্ত্রীয় বিশেষত সমাজতন্ত্রবিদ (Sociologist) ও মনোবিজ্ঞানীদের (Psychologist) কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়েছে।

আমেরিকান সমাজতত্ত্ববিদ আলেক্স ইনকেলস (Alex Inkeles) একগুচ্ছ দৃষ্টিভঙ্গি সংশ্লিষ্ট প্রশ্নমালা প্রণয়ন করেন যা পরবর্তীকালে আধুনিকতা মাপনী বা মানদণ্ড (moderenity scale) হিসাবে পরিচিত হয়। একটি সমাজের সদস্যবৃন্দ কতটা আধুনিক মূল্যবোধ ধারণ করেন সেটা যাচাইয়ের জন্য ১৯৬০ এর পরবর্তী সময়ে এই মানদণ্ড বহুল ব্যবহৃত হয়। ইনকেলস এবং তাঁর অনুগামীরা যুক্তি দেখাতেন যে আধুনিকায়ন মানেই উন্নতি এবং একটা সমাজ উন্নতি করতেই পারে না যতক্ষণ না সেই সমাজের অধিকাংশ, লোক আধুনিক মূল্যবোধ ধারণ করে। সমাজতত্ত্ববিদগণের চিন্তা ও গবেষণা যতদিন আধুনিকায়ন তত্বকে ঘিরে ঘুরপাক খাচ্ছিল ততদিনে অর্থনীতিবিদগণ উন্নয়ন সম্বদ্ধে তাদের নিজস্ব তত্ত্ব উদ্ভাবন করেন যা ‘মানব পুজি’ নামে খ্যাত। 

মানব পুঁজি তত্ত্ব (Human Capital Theory) 

সমাজ তত্ত্ববিদগণের নিকট আধুনিকায়ন তত্ত্ব একটি সামাজিক-মনোবৈজ্ঞানিক তত্ত্ব হিসাবে বিবেচিত হতো যা ব্যক্তি মানুষের দৃষ্টিতে মূল্যবোধের ওপর নির্ভরশীল ছিল।

অপরদিকে অর্থনীতিবিদগণ উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় মানব সমাজের জনশক্তির উৎপাদন ক্ষমতার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। এবং এভাবে উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় মানব সমাজের জনশক্তির ওপর গুরুত্ব প্রদান করতে গিয়ে মানুষের কর্মদক্ষতার উন্নতি বা গুণগত পরিবর্তনের সকল আয়োজনকে পুঁজি বিনিয়োগ হিসাবে গণ্য করেন। এই দৃষ্টিকোণ থেকে মানব পুঁজি তত্ব যুক্তি প্রদান করে যে, যে কোনো সমাজের উন্নয়নের চাবিকাঠি হচ্ছে সেই সমাজের জনসম্পদের উন্নয়ন অর্থাৎ মানব পূঁজি গঠন।

১৯৬০ সালে থিওডোর শুলজ (Theodore Schultz) আমেরিকার অর্থনীতিবদ সমিতির সভাপতি হিসাবে ‘মানব পুঁজির’ জন্য বিনিয়োগ শিরোনামে তার প্রবন্ধে সর্বপ্রথম এই তত্ত্বের সুসংবদ্ধ ব্যাখ্যা প্রদান করন। বহুল প্রচারিত এই ভাষণে শুলজ বলেন যে, শিক্ষা সম্বন্ধে চিরাচরিত দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাতে হবে। শিক্ষাকে শুধু ভোগের বস্তু হিসেবে না দেখে শিক্ষাকে দেখতে হবে উৎপাদনশীল বিনিয়োগ (productive investment) হিসেবে। তিনি যুক্তি দেখান যে, শিক্ষা কেবল ব্যক্তি বিশেষের উন্নতির সহায়ক নয়, শিক্ষা এমন একটা জনগোষ্ঠী তৈরি করে যা শিল্প সমৃদ্ধি ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য একান্ত প্রয়োজন। এই তত্বের ফলে উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশ নির্বিশেষে শিক্ষাক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগের যুক্তিগ্রাহ্য কারণ খুজে পাওয়া যায়। শিক্ষা ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক বিনিয়োগের লাভ ব্যক্তি ও সমষ্টি পর্ধায়ে পাওয়ার নিশ্চয়তা প্রদান করে বলে এই তত্ব সহসা গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে। কিন্তু সব তত্ত্বের মত মানব পুঁজি তত্ত্বও সমালোচনার সম্মুখীন হয়। অর্থনীতিবিদ জন ভেইজি (JohnVaizey) ও মার্ক ব্লগ (Mark Bloug) এই বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ মতামত প্রকাশ করেন। মানব পুঁজি তত্ত্বের একটা আবেদন আছে কিন্তু পদ্ধতিগত কিছু সমস্যাও আছে । বিশেষ করে শ্রমিকের গুণগত মান নির্ধারণে শিক্ষার অবদান নির্ণয়ের সমস্যা পদ্ধতিকে সম্পূর্ণভাবে গ্রহণ করতে বাধাগ্রস্ত করেছে।

মার্কসের উন্নয়ন তত্ত্ব (Marxist Theories of Development) 

ইউরোপিয়ান সমাজ বিশারদদের মধ্যে হেগেল সম্ভবত প্রথম ব্যক্তি যিনি সমাজ পরিবর্তনে দ্বন্দ্বকে প্রধান উপাদান হিসাবে বিবেচনায় আনেন। তার দ্বান্দ্বিক নীতিমালায় সকল পরিবর্তনকে একটি প্রক্রিয়ার থিসিস (thesis), অ্যান্টিথিসিস (antithesis) ও সিনথেসিস (synthesis) এব ফল হিসাবে দেখা হতো। এই মতবাদ মার্কসের সমাজ পরিবর্তনের মূলভিত্তি হিসাবে পরিগণিত হয় এবং পরবর্তীকালে উন্নয়ন তত্ত্বের একটি ধারা হিসাবে প্রসিদ্ধি লাভ করে।

মার্কসের মতে সমাজ পরিবর্তনের মুল ঘটক হচ্ছে অর্থনৈতিক কাঠামো।

শ্রেণিভিত্তিজ সমাজ বলতে বোঝায় ঐ সমাজ যেখানে উৎপাদনের উপায় ব্যক্তিমালিকানার নিয়ন্ত্রণে থাকে। আর শ্রেণিহীন সমাজ বলতে বোঝায় যেখানে উৎপাদনের উপায় সমষ্টির হস্তগত বা যৌথভাবে নিয়ন্ত্রিত। মার্কস প্রথম ধরনের সমাজকে বুর্জোয়া সমাজ (bourgeois class) এবং দ্বিতীয় ধরনের সমাজকে সর্বহারা সমাজ (proletariat class) বলে আখ্যায়িত করেন। তার মতে পুঁজিবাদ ব্যবস্থা মালিক কর্তৃক প্রলেতারিয়া বা শ্রমিক সম্প্রদায়ের শ্রমের উদ্বৃত্ত মুনাফা জোর করে আদায়ের ওপর নির্ভরশীল। শ্রমিক শ্রেণি এই শোষণ সম্পর্কে সচেতন নয়। মার্কস মনে করতেন শ্রমিক শ্রেণি এই শোষণ সম্বন্ধে যখন সচেতন হবে তখন শ্রেণি দ্বন্দ্ব শুরু হবে। ফলশ্রুতি হিসাবে বিপ্লবের মাধ্যমে সমাজের কাঠামোগত বিরাট পরিবর্তন হবে এবং শ্রেণিহীন সমাজ প্রতিষ্ঠিত হবে। এই সমাজ ব্যবস্থা সমাজতান্ত্রিক এবং কমিউনিষ্ট ব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত। মার্কস এই অবশ্যম্ভাবী ক্রান্তিকালকে উন্নয়ন ও অগ্রগতির একটা আবশ্যিক প্রক্রিয়ার অংশ হিসাবে দেখতেন। বলা হতো সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় পরিবর্তন একটু ভিন্নভাবে আসবে । মার্কস সমাজতন্ত্রকে পুঁজিবাদ ও কমিউনিস্ট ব্যবস্থার মধ্যবর্তী পর্যায় বলে মনে করতেন।

মার্কসের উন্নয়ন কার্যক্রমের দুইটি প্রধান কর্মসূচি হলো- গণশিক্ষা এবং ভাবাদর্শ সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি; যার মাধ্যমে প্রলেতারিয়া তার শোষণের অবস্থা সম্বন্ধে সজাগ হবে। সমাজ পরিবর্তন সম্পর্কে মার্কসের চিন্তাধারা উন্নয়ন সংশ্লিষ্ট মতবাদের ওপর বিরাট প্রভাব ফেলে। মার্কস ইতিহাসের যাত্রাপথকে একমুখী বিবর্তন প্রক্রিয়া বলে গণ্য করতেন। আদিম সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল হতে সামন্তবাদ ও পুঁজিবাদ হয়ে শেষাবধি সমাজতন্ত্র ও কমিউনিজমে উত্তরণ।

নির্ভরশীলতা তত্ব (Dependency Theory) 

এই তত্ত্ব একটি সমাজের সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কাঠামোর অভ্যন্তরীণ পারস্পরিক সম্পর্ক এবং এ সমাজের সাথে অন্য সমাজের উক্ত বিষয়াবলীর পারস্পরিক সম্পর্কের প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখে। কোনো সমাজের বা অঞ্চলের অনুন্নয়নকে অন্য একটি সমাজের বা অঞ্চলের উন্নয়নের প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত বলে মনে করা হয়। নির্ভরশীল অভিধাটি ব্যবহার করে এটা বুঝাবার চেষ্টা করা হয় যে অনুন্নত দেশসমূহ যার অধিকাংশই ঔপনিবেশিক শাসক গোষ্ঠীর কুক্ষিগত ছিল, তারা শাসক দেশের উন্নয়নের রসদ যুগিয়ে এসেছে। ফলে স্বাধীনতোত্তর উন্নয়ন কর্মসূচীর অর্থায়নের জন্য তারা এতিহাসিকভাবে পূর্বতন শাসক দেশের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। 

নির্ভরশীলতা তত্ত্ব অনুযায়ী সম্পদের পাচার হতে পারে নানাভাবে, একেবারে সরাসরি লুণ্ঠন, সাম্রাজ্যবাদের বিস্তারের মাধ্যমে অথবা বর্তমান কালের বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর মাধ্যমে। এই তত্ত্ব অনুসারে পৃথিবীকে দুইভাগে ভাগ করা যায়: একভাগে ধণী ও তথাকথিত উন্নত দেশসমূহ অন্যদিকে তথাকথিত অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশসমূহ। দ্বিতীয় শ্রেণীভুক্ত দেশসমূহ প্রথম শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত দেশসমূহের ওপর নানাভাবে নির্ভরশীল। সেজন্য ঔপনিবেশের যুগ শেষ হলেও অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশে পরোক্ষভাবে সাম্রাজ্যবাদ ও পুঁজিবাদের আধিপত্য ও শোষণ অব্যাহত রয়েছে। এই প্রক্রিয়া টিকিয়ে রাখার জন্য কোনো দেশকে বাস্তবে অধিকারে রাখার প্রয়োজন হয়না। দরিদ্র ও অনুন্নত দেশের নেতৃবৃন্দ ও অভিজনেরা ধনতন্ত্রবাদী বা ধনী দেশসমূহের দৃষ্টিভঙ্গি, মূল্যবোধ ও স্বার্থকেন্দ্রিক মনোভাব পোষণ করলেই হল। এদের নামকরণ করা হয়েছে লুম্পেন বুর্জোয়া (lumpen bourgeoisie) | এরাই প্রভুদের স্বার্থ রক্ষা করে। 

শেয়ার করুন

মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার তথ্য সংরক্ষিত রাখুন

বিশেষ শর্তসাপেক্ষে এই ওয়েবসাইটটি সামাজিক কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ কিংবা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের নিকট বিক্রি করা হবে।

উন্নয়নের ধারণা ও তত্ত্বসমূহ

প্রকাশ: ০২:৪৩:২৩ অপরাহ্ন, শনিবার, ২১ অগাস্ট ২০২১

বর্তমান আলোচনায় দেশ ও জাতির উন্নয়নের ধ্যান-ধারণা ও তত্বসমূহের ক্রমবিকাশ উপস্থাপন করা হয়েছে। পঞ্চম শতাব্দীতে খ্রিস্টধর্ম রোমের রাষ্ট্রধর্ম হিসাবে স্বীকৃতি লাভ করে। এই সময় হিব্রু, গ্রিক ও খ্রিস্টিয় চিন্তাধারার সমন্বয় ও অগ্রগতি উন্নয়ন সম্পর্কিত ধারণার একটা মৌলিক পরিবর্তন নিয়ে আসে। খ্রিস্টীয় মতাদর্শকে স্পষ্টভাবে তুলে ধরার ব্যাপারে যিনি সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন তিনি ছিলেন সেন্ট অগাস্টিন (Saint Augustine)। তার চিস্তা ও মতাদর্শ প্রতিফলিত হয় তার প্রণীত The City of God পুস্তকে। এই পুস্তকে লিপিবদ্ধ ভাবাদর্শ দ্বাদশ শতাব্দী পর্যন্ত ইউরোপিয়ান চিন্তাধারাকে আচ্ছন্ন করে রাখে। খ্রিস্টান চিস্তাবিদগণ এরূপ মতামত পোষণ করতেন যে, আদম হাওয়ার সৃষ্টি থেকে মানবজাতির যে যাত্রা শুরু তা খ্রিস্টের আগমনে পরিপূর্ণতা লাভ করে। এই জাগতিক পৃথিবীর ধ্বংস ও মৃত্যুর সাথে তার পরিসমাপ্তি ঘটবে এবং এই মহাবিপর্ষয় অত্যাসন্ন। সুতরাং ইহলৌকিক জীবন সম্বন্ধে তাঁরা হতাশাগ্রস্ত ও নিরাশাবাদী ছিলেন। তাদের কাছে পারলৌকিক জীবনই ছিল আসল জীবন এবং তাঁরা এ ব্যাপারে উৎসাহী ও আশাবাদী ছিলেন। তাঁরা মনে করতেন পার্থিব জীবনের পরিবর্তনের প্রধান শক্তি হচ্ছে প্রভুর ‘প্রভুর ইচ্ছে’ ৷ মধ্যযুগ পর্যন্ত এই মনোভাবের কোনো পরিবর্তন হয় নি। স্মতর্ব্য ইউরোপে মধ্যযুগের অন্য নামই হলো অন্ধকার যুগ, পুরোটা না হলেও অধিকাংশ তো বটেই। 

ইউরোপে রেনেসাঁস ও মানবিকতাবাদ

ইউরোপে রেনেসাঁসের পদধ্বনি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রযাত্রা সত্ত্বেও সেন্ট অগাস্টিনের (Saint Augustine) প্রভাব অব্যাহত থাকে। এই প্রভাব কমে আসে যখন রেনেসাসের ফলে ইউরোপে আধুনিক যুগের উত্তরণ ঘটতে থাকে। রেনেসাঁস বা নবজাগরণের মূলকথা হচ্ছে ইহলোকে ও ইহকালে পরিপূর্ণ জীবন। পরলোক বা পরকালের চিন্তা ছেড়ে দিয়ে মানুষ বাস্তবতার সন্ধানে আত্মনিয়োগ করে। রেনেসাঁসের একটা বিশিষ্ট লক্ষণ হচ্ছে সর্ববিষয়ে কৌতূহল বা অনুসন্ধিৎসা। অন্যটি হচ্ছে মানব জীবনকে সর্বপ্রকারে পরিপূর্ণ বা বিকশিত করা। রেনেসাঁস একটা নতুন মনোভাবের জন্ম দেয় তার নাম মানবিকবাদ বা হিউমানিজম (humanisml; মানুষই সবকিছুর মাপকাঠি। এই যে নতুন শিক্ষা বা নিউলার্নিং এটাই মধ্যযুগকে অপসারণ করে ইউরোপে আধুনিক যুগের পত্তন করে। 

ইউরোপে রেনেসাঁস, রিফরমেশন ও এনলাইটেনমেন্টের (Renaissance, Reformation, Enlightenment) কালপর্ব প্রায় চারশত বৎসর (১৫০০-১৮০০)। এই সময়ে বহু বুদ্ধিজীবী, দার্শনিক ও সমাজবিজ্ঞানীর আবির্ভাব হয়েছে যাঁরা সমাজ পরিবর্তন ও উন্নয়ন সম্পর্কে নানা মতবাদ তুলে ধরেছেন। ফরাসী বুদ্ধিজীবী বের্নারর ল্য বোভিয়ে (Bernard Le Bovier: 1688), ফরাসি গণিতবিদ ও দার্শনিক রনে দেকার্ত (Rene Descartes) এবং জামনি দার্শনিক ইমানুয়েল কান্ট (Emanuel Kant)-এর ভাবাদর্শ উন্নয়নের ধারণার বিবর্তনে প্রত্যক্ষ প্রভাব ফেলে। ল্য বোভিয়ে যেমনটা বলেছিলেন: সভ্যতা অতীতে অগ্রগতি লাভ করেছে, বর্তমানে অগ্রগতি করে চলেছে এবং অনন্ত ভবিষ্যতে তা করেই চলবে। এই মতামতই আধুনিক চিন্তাধারা হিসাবে গণ্য হয়। মানবজাতির বা সভ্যতার অগ্রগতির প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস ছিল পাশ্চাত্যের তৎকালীন মতাদর্শের মূলকথা। 

বুদ্ধিবৃত্তিক ও জ্ঞানভিত্তিক ঐতিহ্য

এদিকে প্রাচ্যে প্রায় এক হাজার বৎসর পূর্বে চীন সভ্যতা একটা বুদ্ধিবৃত্তিক ঐতিহ্য গড়ে তুলেছিল যা সমাজের নিরন্তর পরিবর্তনের শক্তিকে স্বীকার করত এবং তারা জানত মানুষের সার্থক জীবনযাপনের মূলনীতি কি হওয়া উচিত। এই চিস্তাধারার হোতা ছিলেন কনফুসিয়াস (Confucius)। এদিকে ভারতবর্ষে একটা জ্ঞান ভিত্তিক ঐতিহ্য বিজ্ঞ শিক্ষা গুরুর মাধ্যমে যুগের পর যুগ জনগণের মধ্যে সঞ্চারিত হতে থাকে। আফ্রিকা মহাদেশেও জ্ঞানানুশীলনে নিয়োজিত রাখা হতো। মধ্যপ্রাচ্যের ইসলামি দেশসমূহেও সমাজ পরিবর্তন সম্পর্কে নিজস্ব চিন্তা-চেতনার উন্মেষ দেখা যায়। এই পৃথিবীর প্রথম সমাজ বিজ্ঞানী ইবনে খালদুন সুশৃঙ্খল সমাজ পরিবর্তনে বিশ্বাস করতেন। পৃথিবীর সব প্রধান সংস্কৃতি অধ্যুষিত অঞ্চলই শিশু-সন্তানদের শিক্ষার ব্যাপারে সজাগ ছিল। 

সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতাব্দীতে এনলাইটেনমেন্টের যুগে বেশ কয়েকটি বিশ্বাস ও মতাদর্শ দেখা দেয় যা উন্নয়নের ভাবধারাকে প্রভাবিত করে। বিশেষ করে মনে করা হতো যে ধর্মীয় ও শাস্ত্রীয় জ্ঞানের জায়গা দখল করে নিয়েছে শুদ্ধ জ্ঞান ও বিজ্ঞান। প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া ক্রমবর্ধমান ও যৌক্তিক এবং প্রবৃদ্ধির ব্যাপারে তা সীমিত নয়। রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রধান কাজ হচ্ছে প্রকৃতি ও মানবজাতির স্বাভাবিক অগ্রগতির পথের সমস্ত প্রতিবন্ধকতা দূর করা। মানবসমাজের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে এনলাইটেনমেন্টের আশাবাদে বিশ্বাসী ফরাসী চিন্তাবিদ রুশো (Jean Jacq Rousseu) মনে করতেন মানব সন্তানের অগ্রগতি নির্ভর করে সভ্যতা দ্বারা সংক্রমিত মা হওয়ার যোগ্যতার ওপর। সংক্রমিত না হয়ে, সভ্যতার অংশীদার হয়ে একজন নাগরিকের দায়িত্ব পালন করে যাওয়ার মধ্যেই তার কৃতিত্ব। এই আপাত বৈপরীত্যের সমাধানের জন্যই রুশো শিক্ষার ওপর এত গুরুত্ব দিয়েছিলেন। 

উনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীর বিবর্তনমূলক তত্বসমূহ (Evolutionary Theories of Nineteenth and Twentieth Centuries) 

উনিশ শতকের প্রারম্ভে সমাজ পরিবর্তনে ও উন্নয়নে এনলাইটেনমেন্টের যুগের আশাবাদ- সমাজ ও সভ্যতা নিরন্তর অগ্রগতি করেই চলবে- এই ধারণা প্রশ্নের সম্মুখীন হয়। নিরন্তর আশাবাদের স্থলে আরও সুসংবদ্ধ এবং কিছুটা জটিল সব মতবাদ বা তত্ত্ব তুলে ধরা হয়। এই তত্ত্বসমূহকে এক কথায় বিবর্তনমূলক তত্ত্ব বলা যেতে পারে। এসব তাত্ত্বিকের পূর্বসূরী হিসাবে জার্মান দার্শনিক হেগেলের (Georg Wilhelm Friedrich Hegel) নাম উল্লেখ করা প্রয়োজন।

উন্নয়ন সম্পর্কে হেগেলের চিন্তাধারা কোনো কোনো ক্ষেত্রে ধুপদী, গ্রিক ও রোমান চিন্তাধারার সমগ্রোত্রীয়। তিনিও ধ্রুপদী ধারণা ‘ফিসিস’ এর মতাবলম্বী ছিলেন৷ হেগেলের দ্বাম্বিকতার (dialectic) ধারণা পরবর্তীকালে কার্লমার্কস (Karl Marx) ও তার অনুসারীদের প্রভাবিত করে। মার্কস মনে করতেন সমাজ দু’টি শ্রেণিতে বিভক্তশোষক ও শোষিত শ্রেণি যারা সবসময় দ্বন্দ্বে বিজড়িত। বিবর্তনমূলক অন্যান্য তাত্ত্বিকের মতো মার্কস মনে করতেন সমাজ ধাপে ধাপে অগ্রসর হচ্ছে।

যেমন, আদিম কমিউনিস্ট অবস্থা থেকে দাসত্রে অবস্থা, সামন্তবাদের অবস্থা, ধনবাদের অবস্থা, সমাজতন্ত্রের অবস্থা এবং সর্বশেষ স্বাপ্নিক কমিউনিস্ট সমাজ ব্যবস্থা। মার্কস এও মনে করতেন যে এই ধাপে ধাপে অগ্রসর হওয়াটাও সমাজের অভ্যন্তরে দ্বন্দ্ব থাকার ফলে এবং উৎপাদনের পদ্ধতির পরিবর্তনের ফলে নাটকীয়ভাবে দ্রুত সম্পন্ন হবে।

হেগেলের সমকালীন ফরাসি দার্শনিক ওগুস্ত কোঁত (Auguste Comte) হচ্ছেন সেই ব্যক্তি যিনি বিবর্তনমূলক তত্ত্বকে সুসংবদ্ধ করেন। হেগেলের মত কোঁত বিবর্তনমূলক তত্ত্বের কেন্দ্রবিন্দুতে মহাপ্রভুকে না বসিয়ে অগ্রগতি ও উন্নয়নকে দেখেছেন মানুষের বৈজ্ঞানিক অর্জনসমূহের অনুষঙ্গ হিসাবে। উনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে ব্রিটিশ দার্শনিক হার্বাট স্পেন্সার (Herbert Spencer) বিবর্তনমূলক তত্ত্বকে কিছুটা ভিন্নরূপে তুলে ধরেন। ম্যালথাসের (Malthus) মতো স্পেনসারও “যোগ্যতম ব্যক্তির বেঁচে থাকার অধিকার’ (Survival of the fittest)-এর মতবাদে বিশ্বাস করতেন। উনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধ ও বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধ পর্যন্ত কোন কোনো ক্ষেত্রে সূক্ষভাবে বিবর্তনমূলক তত্ত্ব প্রচলিত ছিল।

বিবর্তনমূলক তত্ত্বের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে: যে কোনো প্রাণী সত্তার মতো সমাজ অগ্রসর হয় একটি সহজ সরল আদিম অবস্থা থেকে একটা জটিল আধুনিক অবস্থায়। সামজিক উন্নয়নে এই ব্যাখ্যার একটা বাস্তব উদাহরণ দিতে গিয়ে দরিদ্র ও অশিল্পায়িত একটি সমাজকে বিবর্তনের আদিম অবস্থা এবং ধনী ও শিল্পায়িত দেশকে জটিল ও আধুনিক অবস্থার সমতুল্য বলে ধরে নেওয়া হয়। তবে স্বীকার করা হয় যে দরিদ্র ও ধনী নির্বিশেষে সব সমাজই অগ্রগতির পথে বিবর্তিত হচ্ছে। এই তত্ত্বের বেড়াজালে ঔপনিবেশিক শাষকগোষ্ঠী এবং ধর্মীয় মিশনারিরা উপনিবেশগুলোতে তাদের কর্মকাণ্ড পরিচালনার যৌক্তিকতা প্রদান করে। অর্থাৎ তাঁরা বলতে থাকেন যে, আদিম, পশ্চাৎপদ ও অসভ্য সমাজ ব্যবস্থাকে উন্নতির পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য। 

বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধেই প্রশ্ন তোলা হয় সমাজ উন্নয়নে বিবর্তনমূলক তত্ত্বের যথার্থতা নিয়ে। মানবজাতির নিরবচ্ছিন্ন অগ্রগতির ধারণা যা বিবর্তনমূলক তত্বের প্রধান প্রতিপাদ্য বিষয় তা নিয়ে অনেক যুক্তি-তর্কের অবতারণা করা হয়। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে নিরবচ্ছিন্ন অগ্রগতির তত্ত্ব আর ধোপে টেকে না। এটা প্রমাণিত হয় যে, সমাজের উত্থান ও পতন দুইই সত্ত্ব, কোনো সমাজই এর আওতা মুক্ত নয়। 

উন্নয়নের তত্ত্ব (Theories of Development)

উন্নয়নের কয়েকটি নির্দিষ্ট তত্ত্ব নিম্নে উল্লেখ করা হলো-

  • আধুনিকায়ন তত্ত্ব (Modernization Theory)
  • মানব পুঁজি তত্ত্ব (Human Capital Theory)
  • মার্কসের উন্নয়ন তত্ত্ব (Marxist Theories of Development) 
  • নির্ভরশীলতার তত্ত্ব (Dependency Theory)

আধুনিকায়ন তত্ব (Modernization Theory) 

১৮৫০ -এর দশকে আধুনিকায়ন তত্ত্ব প্রচলিত হয়। এই তত্রের প্রবক্তারা প্রথম দিকে অগ্রসর ও শিল্পায়িত দেশসমূহের ব্যাপারে মনোযোগ দেননি। তাঁরা মনে করতেন যে এসব দেশ এমন এক পর্যায়ে পৌছেছে যে, আধুনিকায়নের পথে সেসব দেশ অগ্রসর হতেই থাকবে।

আধুনিকায়ন তত্ত্ব একটি ধারণার ওপর প্রতিষ্ঠিত। আধুনিকায়ন তত্ত্ব যে ধারণার ওপর প্রতিষ্ঠিত সেটি হলো যে পাঁচটি চলের (Variable) মধ্যে একটির সাথে অপরটির প্রত্যক্ষ কার্যকারণ সম্পর্ক রয়েছে। চলগুলো হচ্ছে:

১. আধুনিকীকরণ প্রতিষ্ঠান (Modernizing institution)

২) আধুনিক মূল্যবোধ (Modern values)

৩) আধুনিক ব্যবহার (Modern behaviour)

8) আধুনিক সমাজ (Modern society)

৫) অর্থনৈতিক উন্নয়ন (Economic development)

এসব চলের প্রথম দুইটির সম্পর্ক যেভাবে প্রতিষ্ঠিত করা যায় অন্যগুলোর বেলায় তেমন সহজে করা যায় না, যদিও সবগুলোর মধ্যে কার্যকারণ সম্পর্ক রয়েছে বলে বলা হয়ে থাকে। 

এই আধুনিকায়ন তত্ব আন্তঃশান্ত্রীয় বিশেষত সমাজতন্ত্রবিদ (Sociologist) ও মনোবিজ্ঞানীদের (Psychologist) কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়েছে।

আমেরিকান সমাজতত্ত্ববিদ আলেক্স ইনকেলস (Alex Inkeles) একগুচ্ছ দৃষ্টিভঙ্গি সংশ্লিষ্ট প্রশ্নমালা প্রণয়ন করেন যা পরবর্তীকালে আধুনিকতা মাপনী বা মানদণ্ড (moderenity scale) হিসাবে পরিচিত হয়। একটি সমাজের সদস্যবৃন্দ কতটা আধুনিক মূল্যবোধ ধারণ করেন সেটা যাচাইয়ের জন্য ১৯৬০ এর পরবর্তী সময়ে এই মানদণ্ড বহুল ব্যবহৃত হয়। ইনকেলস এবং তাঁর অনুগামীরা যুক্তি দেখাতেন যে আধুনিকায়ন মানেই উন্নতি এবং একটা সমাজ উন্নতি করতেই পারে না যতক্ষণ না সেই সমাজের অধিকাংশ, লোক আধুনিক মূল্যবোধ ধারণ করে। সমাজতত্ত্ববিদগণের চিন্তা ও গবেষণা যতদিন আধুনিকায়ন তত্বকে ঘিরে ঘুরপাক খাচ্ছিল ততদিনে অর্থনীতিবিদগণ উন্নয়ন সম্বদ্ধে তাদের নিজস্ব তত্ত্ব উদ্ভাবন করেন যা ‘মানব পুজি’ নামে খ্যাত। 

মানব পুঁজি তত্ত্ব (Human Capital Theory) 

সমাজ তত্ত্ববিদগণের নিকট আধুনিকায়ন তত্ত্ব একটি সামাজিক-মনোবৈজ্ঞানিক তত্ত্ব হিসাবে বিবেচিত হতো যা ব্যক্তি মানুষের দৃষ্টিতে মূল্যবোধের ওপর নির্ভরশীল ছিল।

অপরদিকে অর্থনীতিবিদগণ উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় মানব সমাজের জনশক্তির উৎপাদন ক্ষমতার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। এবং এভাবে উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় মানব সমাজের জনশক্তির ওপর গুরুত্ব প্রদান করতে গিয়ে মানুষের কর্মদক্ষতার উন্নতি বা গুণগত পরিবর্তনের সকল আয়োজনকে পুঁজি বিনিয়োগ হিসাবে গণ্য করেন। এই দৃষ্টিকোণ থেকে মানব পুঁজি তত্ব যুক্তি প্রদান করে যে, যে কোনো সমাজের উন্নয়নের চাবিকাঠি হচ্ছে সেই সমাজের জনসম্পদের উন্নয়ন অর্থাৎ মানব পূঁজি গঠন।

১৯৬০ সালে থিওডোর শুলজ (Theodore Schultz) আমেরিকার অর্থনীতিবদ সমিতির সভাপতি হিসাবে ‘মানব পুঁজির’ জন্য বিনিয়োগ শিরোনামে তার প্রবন্ধে সর্বপ্রথম এই তত্ত্বের সুসংবদ্ধ ব্যাখ্যা প্রদান করন। বহুল প্রচারিত এই ভাষণে শুলজ বলেন যে, শিক্ষা সম্বন্ধে চিরাচরিত দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাতে হবে। শিক্ষাকে শুধু ভোগের বস্তু হিসেবে না দেখে শিক্ষাকে দেখতে হবে উৎপাদনশীল বিনিয়োগ (productive investment) হিসেবে। তিনি যুক্তি দেখান যে, শিক্ষা কেবল ব্যক্তি বিশেষের উন্নতির সহায়ক নয়, শিক্ষা এমন একটা জনগোষ্ঠী তৈরি করে যা শিল্প সমৃদ্ধি ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য একান্ত প্রয়োজন। এই তত্বের ফলে উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশ নির্বিশেষে শিক্ষাক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগের যুক্তিগ্রাহ্য কারণ খুজে পাওয়া যায়। শিক্ষা ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক বিনিয়োগের লাভ ব্যক্তি ও সমষ্টি পর্ধায়ে পাওয়ার নিশ্চয়তা প্রদান করে বলে এই তত্ব সহসা গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে। কিন্তু সব তত্ত্বের মত মানব পুঁজি তত্ত্বও সমালোচনার সম্মুখীন হয়। অর্থনীতিবিদ জন ভেইজি (JohnVaizey) ও মার্ক ব্লগ (Mark Bloug) এই বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ মতামত প্রকাশ করেন। মানব পুঁজি তত্ত্বের একটা আবেদন আছে কিন্তু পদ্ধতিগত কিছু সমস্যাও আছে । বিশেষ করে শ্রমিকের গুণগত মান নির্ধারণে শিক্ষার অবদান নির্ণয়ের সমস্যা পদ্ধতিকে সম্পূর্ণভাবে গ্রহণ করতে বাধাগ্রস্ত করেছে।

মার্কসের উন্নয়ন তত্ত্ব (Marxist Theories of Development) 

ইউরোপিয়ান সমাজ বিশারদদের মধ্যে হেগেল সম্ভবত প্রথম ব্যক্তি যিনি সমাজ পরিবর্তনে দ্বন্দ্বকে প্রধান উপাদান হিসাবে বিবেচনায় আনেন। তার দ্বান্দ্বিক নীতিমালায় সকল পরিবর্তনকে একটি প্রক্রিয়ার থিসিস (thesis), অ্যান্টিথিসিস (antithesis) ও সিনথেসিস (synthesis) এব ফল হিসাবে দেখা হতো। এই মতবাদ মার্কসের সমাজ পরিবর্তনের মূলভিত্তি হিসাবে পরিগণিত হয় এবং পরবর্তীকালে উন্নয়ন তত্ত্বের একটি ধারা হিসাবে প্রসিদ্ধি লাভ করে।

মার্কসের মতে সমাজ পরিবর্তনের মুল ঘটক হচ্ছে অর্থনৈতিক কাঠামো।

শ্রেণিভিত্তিজ সমাজ বলতে বোঝায় ঐ সমাজ যেখানে উৎপাদনের উপায় ব্যক্তিমালিকানার নিয়ন্ত্রণে থাকে। আর শ্রেণিহীন সমাজ বলতে বোঝায় যেখানে উৎপাদনের উপায় সমষ্টির হস্তগত বা যৌথভাবে নিয়ন্ত্রিত। মার্কস প্রথম ধরনের সমাজকে বুর্জোয়া সমাজ (bourgeois class) এবং দ্বিতীয় ধরনের সমাজকে সর্বহারা সমাজ (proletariat class) বলে আখ্যায়িত করেন। তার মতে পুঁজিবাদ ব্যবস্থা মালিক কর্তৃক প্রলেতারিয়া বা শ্রমিক সম্প্রদায়ের শ্রমের উদ্বৃত্ত মুনাফা জোর করে আদায়ের ওপর নির্ভরশীল। শ্রমিক শ্রেণি এই শোষণ সম্পর্কে সচেতন নয়। মার্কস মনে করতেন শ্রমিক শ্রেণি এই শোষণ সম্বন্ধে যখন সচেতন হবে তখন শ্রেণি দ্বন্দ্ব শুরু হবে। ফলশ্রুতি হিসাবে বিপ্লবের মাধ্যমে সমাজের কাঠামোগত বিরাট পরিবর্তন হবে এবং শ্রেণিহীন সমাজ প্রতিষ্ঠিত হবে। এই সমাজ ব্যবস্থা সমাজতান্ত্রিক এবং কমিউনিষ্ট ব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত। মার্কস এই অবশ্যম্ভাবী ক্রান্তিকালকে উন্নয়ন ও অগ্রগতির একটা আবশ্যিক প্রক্রিয়ার অংশ হিসাবে দেখতেন। বলা হতো সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় পরিবর্তন একটু ভিন্নভাবে আসবে । মার্কস সমাজতন্ত্রকে পুঁজিবাদ ও কমিউনিস্ট ব্যবস্থার মধ্যবর্তী পর্যায় বলে মনে করতেন।

মার্কসের উন্নয়ন কার্যক্রমের দুইটি প্রধান কর্মসূচি হলো- গণশিক্ষা এবং ভাবাদর্শ সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি; যার মাধ্যমে প্রলেতারিয়া তার শোষণের অবস্থা সম্বন্ধে সজাগ হবে। সমাজ পরিবর্তন সম্পর্কে মার্কসের চিন্তাধারা উন্নয়ন সংশ্লিষ্ট মতবাদের ওপর বিরাট প্রভাব ফেলে। মার্কস ইতিহাসের যাত্রাপথকে একমুখী বিবর্তন প্রক্রিয়া বলে গণ্য করতেন। আদিম সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল হতে সামন্তবাদ ও পুঁজিবাদ হয়ে শেষাবধি সমাজতন্ত্র ও কমিউনিজমে উত্তরণ।

নির্ভরশীলতা তত্ব (Dependency Theory) 

এই তত্ত্ব একটি সমাজের সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কাঠামোর অভ্যন্তরীণ পারস্পরিক সম্পর্ক এবং এ সমাজের সাথে অন্য সমাজের উক্ত বিষয়াবলীর পারস্পরিক সম্পর্কের প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখে। কোনো সমাজের বা অঞ্চলের অনুন্নয়নকে অন্য একটি সমাজের বা অঞ্চলের উন্নয়নের প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত বলে মনে করা হয়। নির্ভরশীল অভিধাটি ব্যবহার করে এটা বুঝাবার চেষ্টা করা হয় যে অনুন্নত দেশসমূহ যার অধিকাংশই ঔপনিবেশিক শাসক গোষ্ঠীর কুক্ষিগত ছিল, তারা শাসক দেশের উন্নয়নের রসদ যুগিয়ে এসেছে। ফলে স্বাধীনতোত্তর উন্নয়ন কর্মসূচীর অর্থায়নের জন্য তারা এতিহাসিকভাবে পূর্বতন শাসক দেশের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। 

নির্ভরশীলতা তত্ত্ব অনুযায়ী সম্পদের পাচার হতে পারে নানাভাবে, একেবারে সরাসরি লুণ্ঠন, সাম্রাজ্যবাদের বিস্তারের মাধ্যমে অথবা বর্তমান কালের বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর মাধ্যমে। এই তত্ত্ব অনুসারে পৃথিবীকে দুইভাগে ভাগ করা যায়: একভাগে ধণী ও তথাকথিত উন্নত দেশসমূহ অন্যদিকে তথাকথিত অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশসমূহ। দ্বিতীয় শ্রেণীভুক্ত দেশসমূহ প্রথম শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত দেশসমূহের ওপর নানাভাবে নির্ভরশীল। সেজন্য ঔপনিবেশের যুগ শেষ হলেও অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশে পরোক্ষভাবে সাম্রাজ্যবাদ ও পুঁজিবাদের আধিপত্য ও শোষণ অব্যাহত রয়েছে। এই প্রক্রিয়া টিকিয়ে রাখার জন্য কোনো দেশকে বাস্তবে অধিকারে রাখার প্রয়োজন হয়না। দরিদ্র ও অনুন্নত দেশের নেতৃবৃন্দ ও অভিজনেরা ধনতন্ত্রবাদী বা ধনী দেশসমূহের দৃষ্টিভঙ্গি, মূল্যবোধ ও স্বার্থকেন্দ্রিক মনোভাব পোষণ করলেই হল। এদের নামকরণ করা হয়েছে লুম্পেন বুর্জোয়া (lumpen bourgeoisie) | এরাই প্রভুদের স্বার্থ রক্ষা করে।