০২:০৩ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
                       

অর্থনীতি: বিভিন্ন ধরনের অর্থনৈতিক অবস্থা ও বৈশিষ্ট্য এবং বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থা

আহমেদ মিন্টো
  • প্রকাশ: ০৬:১৮:০০ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ৩ সেপ্টেম্বর ২০২১
  • / ১৭৬৬৮ বার পড়া হয়েছে

একেক দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা একেক রকম, কিন্তু কোনো দেশেই বিশুদ্ধ একক কোনো অর্থব্যবস্থা দেখা যায় না | ছবি: Photo by rupixen.com/unsplash


Google News
বিশ্লেষণ-এর সর্বশেষ নিবন্ধ পড়তে গুগল নিউজে যোগ দিন

বিশেষ শর্তসাপেক্ষে এবং স্বল্পমূল্যে এই ওয়েবসাইটটি সামাজিক কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ কিংবা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের নিকট বিক্রি করা হবে।

বলা হয়ে থাকে, ‘অর্থনৈতিক ব্যবস্থা মানুষের বেঁচে থাকার একটি কৌশল’। উৎপাদন এবং বণ্টন সংক্রান্ত কার্যক্রম পরিচালনার একটি উপায় বা অবলম্বন হলো অর্থনীতি। আধুনিক বিশ্বে একেক দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা একেক রকম। বিভিন্ন দেশে যত ধরনের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা বিদ্যমান, সেগুলোর প্রধান কয়েকটি শ্রেণি বা প্রকারভেদ রয়েছে। এ সকল অর্থনৈতিক ব্যবস্থা হলো হলো- ধনতান্ত্রিক অর্থনীতি, সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি, মিশ্র অর্থনীতি ও ইসলামি অর্থনীতি।

বিভিন্ন ধরনের অর্থনৈতিক অবস্থা ও বৈশিষ্ট্য এবং বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থা

ধনতান্ত্রিক অর্থনীতি 

ধনতান্ত্রিক অর্থনীতির অপর নাম বাজার অর্থনীতি। ধনতান্ত্রিক অর্থনীতি বা বাজার অর্থনীতি অবাধ উদ্যোগ বা অবাধনীতি অর্থনীতি বলা হয়।

ধনতান্ত্রিক অর্থনৈতিক অবস্থায় মৌলিক অর্থনৈতিক সমস্যাসমূহ বাজার শক্তির অবাধ ক্রিয়ার মাধ্যমে সমাধান করা হয়। এ ধরনের অর্থ ব্যবস্থায় অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে রাষ্ট্রের বিশেষ ভূমিকা নেই বললেই চলে। এটি অবশ্য সত্য যে, শতভাগ বা বিশুদ্ধ বাজার অর্থনীতি কখনো ছিল না। 

ধনতান্ত্রিক অর্থনীতি বা বাজার অর্থব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য 

ধনতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার প্রধান কয়েকটি প্রধান বৈশিষ্ট্য নিচে উল্লেখ করা হল:

১. ব্যক্তিগত সম্পত্তি 

ব্যক্তিগত সম্পত্তির মালিকানা ধনতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থার প্রধান বৈশিষ্ট্য। এ অর্থব্যবস্থায় প্রাকৃতিক ও মানুষ নির্মিত সম্পদের মালিকানার, নিয়ন্ত্রণ ও বিনিময় করার অধিকার ব্যক্তি বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের হাতে থাকে। 

২. উদ্যোগের স্বাধীনতা

উদ্যোগের স্বাধীনতা হলো, উদ্যোক্তার ইচ্ছেমতো প্রয়োজনীয় অর্থনৈতিক সম্পদ সংগঠিত করে পছন্দমত দ্রব্য ও সেবা উৎপাদন করা এবং উৎপাদিত দ্রব্য ও সেবা পছন্দমত বাজারে বিক্রয় করার ক্ষেত্রে পূর্ণ অধিকার। কোনো ধরনের শিল্পে প্রবেশ বা শিল্প থেকে প্রস্থানের ক্ষেত্রে কোনো উদ্যোক্তার জন্য কেউ কোনো কৃত্রিম বাধা বা প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে না। 

৩. পছন্দের স্বাধীনতা

ভূমি ও মূলধনের মালিকেরা যে-ভাবে উপযুক্ত মনে করে সে-ভাবে এসব সম্পদ ব্যবহার করতে পারে, শ্রমিকরা নিজেদের পছন্দ অনুযায়ী কাজ করতে পারে, কারবারি নিজের ইচ্ছে মতো নিজের কারবারি কাজকর্ম চালিয়ে যেতে পারে, ভোক্তা নিজের পছন্দ অনুযায়ী পণ্য বা সেবা গ্রহণ করতে পারে; এই উন্মুক্ত অবস্থার নাম হলো পছন্দের স্বাধীনতা।

৪. ভোক্তার স্বাধীনতা

ভোক্তার স্বাধীনতা অর্থনৈতিক স্বাধীনতার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হয়। ধনতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থায় ভোক্তাকে প্রভূ বিবেচনা করা হয়। কারণ ভোক্তা যে সব দ্রব্য ও সেবা ক্রয়ের জন্য ব্যয় করে সমাজের সম্পদ সেসব দ্রব্য ও সেবা উৎপাদনের জন্য ব্যবহৃত হয়।  অবশ্য ‘ভোক্তার স্বাধীনতা’ বৈশিষ্ট্যটি ‘পছন্দের স্বাধীনতা’র সাথে যুক্ত।

৫. স্বার্থের ভূমিকা 

ধনতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থা ব্যক্তিবাদী এবং এজন্য এরূপ অর্থনীতির মূল উদ্দেশ্য হলো প্রতিটি অর্থনৈতিক এককের (ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি) স্বার্থের উন্নতি সাধন।

৬. প্রতিযোগিতা 

অর্থনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা বা প্রতিযোগিতা ধনতান্ত্রিক অর্থনীতির একটি মৌলিক বৈশিষ্ট্য।  প্রতিযোগিতা বলতে এখানে মূল্য প্রতিযোগিতা বুঝায়। দ্রব্য বা উপকরণের বাজারে অসংখ্য ক্রেতা এবং বিক্রেতা থাকে। কোনো একজন ক্রেতা বা বিক্রেতা বাজারের তুচ্ছ অংশ অর্থাৎ মোট ক্রয় বা বিক্রয়ের তুলনায় তার ক্রয় বা বিক্রয়ের পরিমাণ খুব অল্প। সুতরাং সে এককভাবে বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। মোট চাহিদা ও যোগানের মিথস্ক্রীয়ার মাধ্যমে বাজারে মূল্য নির্ধারিত হয় এবং এই মূল্য প্রদত্ত ধরে ক্রেতা ও বিক্রেতা সিদ্ধান্ত নেয়। প্রতিযোগিতা হলো ধনতান্ত্রিক অর্থনীতির নিয়ন্ত্রণমূলক কৌশল। প্রতিযোগিতামূলক ধনতান্ত্রিক অর্থনীতি সম্পদের ব্যবহার বা বরাদ্দকরণে সর্বাপেক্ষা দক্ষ।

৭. বাজার এবং দাম 

ধনতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থার সর্বাপেক্ষা মৌলিক বৈশিষ্ট্য হলো বিভিন্ন ব্যবহারের মধ্যে সম্পদ বরাদ্দকরণে মূল্য প্রক্রিয়ার ব্যবহার। বিভিন্ন দ্রব্য ও উপকরণের ক্রেতা ও বিক্রেতাদের সিদ্ধান্ত বাজার ব্যবস্থার মাধ্যমে কার্যকরি হয়। ক্রেতাদের সিদ্ধান্ত দ্বারা চাহিদা এবং বিক্রেতাদের 

সিদ্ধান্ত দ্বারা যোগান নির্ধারিত হয়। চাহিদা এবং যোগানের মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে বাজারে দাম নির্ধারিত হয়। এই দাম সম্পদের মালিক, উদ্যোক্তা এবং ভোক্তাদের জন্য পথনির্দেশক স্তম্ভ হিসেবে কাজ করে যার ভিত্তিতে তারা নিজেদের স্বার্থ বাস্তবা সিদ্ধান্ত নেয়। 

৮. সরকারের সীমিত ভূমিকা 

ধনতান্ত্রিক অর্থনৈতিক অবস্থায় অর্থনীতির কার্যপরিচালনার জন্য সরকারের বিশেষ ভূমিকা থাকে না। এক্ষেত্রে ব্যক্তিগত সম্পত্তির ব্যবহার এবং ব্যক্তির পছন্দের সীমারেখা টানার জন্য সরকার শুধু যথাযথ আইন কাঠামো দিতে পারে। যেমন, নিজস্ব সম্পদ ব্যবহার করে মাদক দ্রব্য উৎপদানের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে পারে।

সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি 

সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থা হলো এমন একটি সামাজিক-অর্থনৈতিক ব্যবস্থা যেখানে সম্পদ ও অর্থের মালিকানা সামাজিক বা রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণাধীন। সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থায় কোনো ব্যক্তিমালিকানা থাকে না এবং জনসাধারণের প্রয়োজন অনুসারে পণ্য উৎপাদন হয়। এই ব্যবস্থায় মৌলিক অর্থনৈতিক সমস্যাসমূহ কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষের নির্দেশে সমাধান করা হয়। 

সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির বৈশিষ্ট্য 

সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির বৈশিষ্ট্যসমূহ নিচে আলোচনা করা হলো:

১. সম্পদের রাষ্ট্রীয় মালিকানা

সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো কলকারখানা, জমি সম্পদ এবং উৎপাদনের অন্যান্য উপকরণ উৎপাদনের উপকরণের উপর রাষ্ট্রীয় মালিকানা স্বীকৃত থাকবে।

২. মুনাফা নিষিদ্ধ

সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় ব্যক্তিগত সম্পদ ও মুনাফা অর্জন নিষিদ্ধ।

৩. শ্রেণি বৈষম্য ও শ্রেণি শোষণমুক্ত

সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থায় সম্পদ ও উৎপাদনের উপকরণের উপর রাষ্ট্রীয় মালিকানা প্রতিষ্ঠিত করার মাধ্যমে সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিত করা হয়; এর ফলে সমাজে শ্রেণি বৈষম্য ও শ্রেণি শোষণ বিলুপ্ত হয়। সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় শ্রমিকদের শোষনের কোন সুযোগ থাকে না এবং প্রত্যেকেই সমান মর্যাদা ও সুবিধা ভোগ করে। সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষিত হয়।

৪. আয় ও সম্পদের সুষম বণ্টন

সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থায় জাতীয় আয় বণ্টনের মূলনীতি হলো প্রত্যেকে ব্যক্তি নিজের যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ করবে এবং কাজ অনুযায়ী পারিশ্রমিক পাবে; যা আয় ও সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে সামাজিক ন্যয়বিচার প্রতিষ্ঠা করে থাকে।

সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় রাষ্ট্রের উৎপাদন ও বণ্টন ব্যবস্থা দেশ বা সমাজের কল্যাণের দিকে লক্ষ্য রেখে করা হয়। বলা হয়, সামাজিক কল্যাণ সাধনই এই অর্থ ব্যবস্থার মুল উদ্দ্যেশ্য।

৫. পরিকল্পনা কর্তৃপক্ষ বিদ্যমান

সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় উৎপাদন, বণ্টন, বিনিয়োগ ইত্যাদি ব্যবস্থাপনার জন্য কেন্দ্রীয় (রাষ্ট্রীয়) পরিকল্পনা কর্তৃপক্ষ থাকে। সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থায় কৃষি, শিল্প, শিক্ষা, সাস্থ্য, যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রভৃতি খাতে পরিকল্পনা অনুযায়ী যথাযথ গুরুত্ব সহকারে উন্নয়ন করা হয়। সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থায় কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষের পরিকল্পনা অনুযায়ী সকল অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।

৬. মৌলিক চাহিদার নিশ্চয়তা

সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতিতে মানুষের সকল মৌলিক চাহিদা, যেমন- খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা, চিত্তবিনোদনের নিশ্চয়তা প্রদান করা হয়।

৭. বেকারত্ব ও মুদ্রাস্ফীতির সম্ভাবনাহীনতা

সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থায় ক্ষেত্রে সাধারণত বেকারত্ব ও মুদ্রাস্ফীতির সম্ভাবনা থাকে না।

৮. অতি উৎপাদন কিংবা সংকট নেই

সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় চাহিদা বা প্রয়োজন অনুযায়ী পরিকল্পিত উপায়ে উৎপাদন ও বণ্টন ব্যবস্থা পরিচালিত হওয়ার ফলে অতি উৎপাদন বা কম উৎপাদনজনিত ঘটনা ঘটতে দেখা দেয় না।

৯. কেন্দ্র থেকে মূল্য বা দাম নির্ধারিত হয়

সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা কতৃপক্ষ পণ্য বা দ্রব্যসামগ্রীর মূল্য নির্ধারন করে দেয়।

১০. রাজনৈতিক পরিবেশের উপাদান

সমাজতান্ত্রিক সমাজের রাজনৈতিক ব্যবস্থার মূল উপাদানসমূহ হলো রাষ্ট্র, সমাজের নেতৃজনিত ও চালিকা শক্তি মার্কসবাদী লেনিনবাদী পার্টি, নানা সামাজিক সংগঠন ও মেহনতি কর্মীদল।

মিশ্র অর্থনীতি 

বর্তমান সময়ে কোনো অর্থনৈতিক ব্যবস্থাই শতভাগ বিশুদ্ধ ধনতান্ত্রিক বা বিশুদ্ধ সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি নয়। বর্তমানে সকল অর্থনীতি মিশ্র অর্থনীতি।

যে অর্থব্যবস্থায় ব্যক্তিগত ও রাষ্ট্রীয় উভয় মালিকানাই স্বীকৃত এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড আংশিক ব্যক্তি উদ্যোগে বাজার প্রক্রিয়ায় এবং আংশিক রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে পরিকল্পনা কমিশনের নির্দেশে পরিচালিত হয়, তাকে মিশ্র অর্থব্যবস্থা বলে।

মিশ্র অর্থনীতির প্রধান বৈশিষ্ট্যসমূহ 

মিশ্র অর্থনীতিতে ধনতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক উভয় প্রকারই স্বীকৃত।

মিশ্র অর্থনীতির প্রধান বৈশিষ্ট্যসমূহ নিচে আলোচনা করা হলো:

১. ব্যক্তিগত ও সরকারি খাতের সহাবস্থান

মিশ্র অর্থনীতির প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো এতে ব্যক্তিগত ও সরকারি খাত একত্রে পাশাপাশি অবস্থান করে। অর্থনীতির বিভিন্ন খাতে ব্যক্তিগত ও সরকারী খাতের ভূমিকা নির্দিষ্ট করা হয়।

২. সম্পদের মালিকানা

মিশ্র অর্থব্যবস্থায় সম্পদের মালিকানা সরকারি ও বেসরকারি উভয়ই হয়ে থাকে।

৪. উৎপাদনের স্বাধীনতা এবং রাষ্ট্রীয় নিষেধাজ্ঞা

মিশ্র অর্থব্যবস্থায় ব্যক্তির উৎপাদনের স্বাধীনতা স্বীকৃত। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে কতিপয় পণ্যের উৎপাদনে রাষ্ট্র কর্তৃক নিষেধাজ্ঞা বজায় থাকে।

২. দাম ব্যবস্থা ও সরকারি নির্দেশের ভূমিকা

মিশ্র অর্থনীতির আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো এটি দাম ব্যবস্থা ও সরকারী নির্দেশ উভয়ের দ্বারা পরিচালিত হয়। সরকারি খাতের উৎপাদন, দাম ও বিনিয়োগ সম্পর্কিত সিদ্ধান্ত সরকার গ্রহণ করে। অপরদিকে, ব্যক্তিগত খাতের উৎপাদন, দাম ও বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত মুনাফা সর্বোচ্চকরণের উদ্দেশ্যে পরিচালিত হয়। 

৩. সরকারী নিয়ন্ত্রণ ও আইন

ব্যক্তিগত খাতে যে শুধু ব্যক্তির স্বার্থে পরিচালিত না হয় এর জন্য মিশ্র অর্থনীতিতে ব্যক্তিগত খাতের কার্যকলাপ সরকারী আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়।

৪. স্বয়ংক্রিয় দাম ব্যবস্থা

মিশ্র অর্থব্যবস্থায় স্বয়ংক্রিয় দাম ব্যবস্থা বিদ্যমান। বাজারে চাহিদা ও যোগানের ঘাত-প্রতিঘাতে দ্রব্যের দাম নির্ধারিত হয়ে থাকে। তবে বিশেষ বিশেষ পরিস্থিতিতে সরকার বাজার ব্যবস্থায় হস্তক্ষেপ করে থাকে।

৪. মুনাফা অর্জন স্বীকৃত

মিশ্র অর্থব্যবস্থায় ব্যক্তি খাতের উপস্থিতি থাকায় মুনাফা অর্জন স্বীকৃত।

৫. অর্থনৈতিক পরিকল্পনা

মিশ্র অর্থব্যবস্থায় সরকারি পরিকল্পনা অনুসারে বেসরকারি খাত নিয়ন্ত্রিত ও সরকারি খাত পরিচালিত হয়। এর জন্য প্রতিটি দেশেই একটি জাতীয় পরিকল্পনা কমিশন এ সংক্রান্ত প্রতিষ্ঠান বা পরিষদ থাকে।

৬. সামাজিক নিরাপত্তা

মিশ্র অর্থব্যবস্থায় সামাজিক রোগ, শোক, দুর্ঘটনা, বেকারত্ব, অক্ষমতা ইত্যাদির হাত থেকে জনগণকে রক্ষা করার জন্য নানা ধরনের রাষ্ট্রীয়ভাবে এবং ব্যক্তিগতভাবে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।

৭. সরকারের জবাবদিহিতা

মিশ্র অর্থব্যবস্থায় সরকারের জবাবদিহিতাকে বেশ গুরুত্বের সাথে দেখা হয়।

৮. আয় বৈষম্য

মিশ্র অর্থব্যবস্থায় যেহেতু সম্পদের উপর ব্যক্তি মালিকানা স্বীকৃত, তাই সেখানে স্বাভাবিকভাবেই আয় বৈষম্য লক্ষ্যণীয়।

৯. মুদ্রাস্ফীতির উপস্থিতি

মিশ্র অর্থনীতিতে যেহেতু ব্যক্তি উদ্যোগ স্বীকৃত এবং মুনাফাভিত্তিক উৎপাদন কার্যক্রম পরিচালিত হয়, সেহেতু এই অর্থনৈতিক অবস্থায় অনেক সময় অতি উৎপাদন বা কম উৎপাদন হতে পারে যার কারণে মুদ্রাস্ফীতিও দেখা দিতে পারে।

৪. ভোক্তার স্বাধীনতা

মিশ্র অর্থনীতিতে ভোক্তার স্বাধীনতা রক্ষিত হয়। ভোক্তা বাজারে নির্ধারিত দামে তার পছন্দসই পণ্য বাজার থেকে ক্রয় করতে পারে। উৎপাদক ভোক্তার পছন্দসই পণ্য বাজারে যোগান দেয়। অবশ্য কখনও কখনও সরকার ভোক্তার স্বার্থে দ্রব্যের দাম নিয়ন্ত্রণ করে বা সীমিত যোগান বিশিষ্ট দ্রব্য রেশনিং এর মাধ্যমে বণ্টন করে।

ইসলামি অর্থনীতি 

কুরআন ও সুন্নাহ মোতাবেক অর্থনৈতিক লেনদেন ব্যবস্থা হলো ইসলামি অর্থনীতি ব্যবস্থা। ইসলামি সংস্কৃতি ও তামাদ্দুন সমৃদ্ধ যে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে তা হলো ইসলামি অর্থনীতি।

ইসলামি অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ৭ টি মূলনীতি

বইভিন্ন মুসলিম পণ্ডিতের মত অনুযায়ী, ৭ টি (সাতটি) প্রধান মূলনীতিকে ইসলামি অর্থনীতির মৌলিক ভিত্তি হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করা হয়। এই ৭ মূলনীতির মাধ্যমে অর্থনীতির সকল কর্মকৌশল, কর্মপদ্ধতি ও কর্মদ্যোগ নির্ধারিত ও পরিচালিত হয়ে থাকে।

ইসলামি অর্থব্যাবস্থার ৭ টি মূলনীতি নিচে উল্লেখ করা হলো:

১. সকল ক্ষেত্রে আমর বিল মারুফ এবং নেহি আনিল মুনকার-এর বাস্তবায়নের মাধ্যমে তাযকিয়া (আত্মশুদ্ধি) ও তাকওয়া (আল্লাহভীরুতা) অর্জন

২. সকল কর্মকাণ্ডেই শরীয়াহর বিধান মান্য করা

৩. কল্যাণের জন্য শ্রমভিত্তিক বিনিময় ও বিনিময়ভিত্তিক শ্রম ন্যায়বিচার প্রয়োগ

৪. ব্যক্তির সম্পদে সমাজের অধিকার প্রতিষ্ঠা

৫. ভারসাম্যপূর্ন জীবন যাপনের প্রয়াস

৬. মৌলিক মানবিক প্রয়োজন পূরন নিশ্চত করা

৭. যুগপৎ দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণ অর্জন

ইসলামি অর্থনৈতিক অবস্থার বৈশিষ্ট্য

এই অর্থনৈতিক ব্যবহার কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এর মধ্যে তিনটি প্রধান বৈশিষ্ট্য নিচে আলোচনা করা হলো:

১. সুদ হারাম

ইসলামি অর্থনীতিতে সুদকে হারাম করা হয়েছে। ইসলামি অর্থ ব্যবস্থায় ঋণদাতা ঋণগ্রহীতার ব্যবসায় লাভজনক হলে যেমন মুনাফার অংশ পাবে, ব্যবসায় ক্ষতিগ্রস্ত হলে তেমনি তারা ক্ষতির ভাগ বহন করবে। অর্থাৎ ঋণদানকারী মুনাফা ও ঝুঁকি উভয়েরই অংশ বহন করবে।

২. ইসলামি পুর্নবণ্টন

ইসলামি অর্থনীতির দ্বিতীয় প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো ইসলামি পুর্নবণ্টন ব্যবস্থা। ইসলামি অর্থনীতিতে পুর্নবণ্টনের উদ্দেশ্যে যে সকল হাতিয়ার ব্যবহৃত হয় তার মধ্যে রয়েছে যাকাত (নিসাব স্তরের অতিরিক্ত সম্পদের উপর শতকরা ২.৫ হারে আরোপিত কর), সদকা (স্বেচ্ছামূলক দান), গনিমত (যুদ্ধে লুন্ঠিত মাল), খারাজ (যুদ্ধে বিজিত ভূমির উপর আরোপিত কর), উশর (শস্যের উপর যাকাত) ইত্যাদি। মনে করা হয় যে, যাকাত আয় পুর্নবণ্টনের একটি শক্তিশালী হাতিয়ার। 

৩. ইসলামি অর্থনৈতিক নিয়ম

ইসলামি অর্থনীতিতে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান ইসলামি নিয়মের নির্দেশ অনুযায়ী কাজ পরিচালনা করে। এ সকল নিয়ম ভালো কাজে উৎসাহ দান করে এবং মন্দ কাজ নিরুৎসাহিত করে। এসব নিয়ম অপচয়, অমিতব্যয় ও আড়ম্বর পরিহার করতে উৎসাহ দেয়। ক্ষতিকর বাহ্যিকতা সৃষ্টি করে এরূপ কাজকে নিরুৎসাহিত করে। এরা ঔদার্য উৎসাহিত করে। তারা ব্যক্তিকে কঠোর পরিশ্রম করতে, ন্যায্য মূল্য চাইতে এবং  অন্যান্যদেরকে তাদের ন্যায্য পাওনা পরিশোধ করতে উদ্ধুদ্ধ করে। এভাবে ইসলামি অর্থনীতি ধনতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক উভয় প্রকার অর্থনীতি থেকে পৃথক। এছাড়া আরও একটি বিষয় হলো ইসলামে হারাম (অবৈধ) বলা হয়েছে এমন কাজকর্ম, পণ্যদ্রব্য এবং পরিষেবা থেকে বিরত থাকতে হবে।

ইসলামি দৃষ্টিকোণ থেকে ধনতান্ত্রিক অর্থনীতিতে অর্থনৈতিক স্বাধীনতার পরিমাণ মাত্রাতিরিক্ত, আবার সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতিতে তা খুবই সংকীর্ণ। ইসলামি অর্থনীতি একটি তত্ত্বীয় পন্থা যা অর্থনৈতিক স্বাধীনতাকে কাম্য স্তরে সীমিত করে।

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা কোন ধরনের? 

বাংলাদেশের অর্থনীতি মিশ্র অর্থনীতি। অর্থনীতির সকল খাতে ব্যক্তিগত উদ্যোগ ও ব্যক্তিগত প্রচেষ্টার প্রাধান্য স্বীকার করা হয়েছে। কিন্তু বেসরকারি খাতকে তার যথাযোগ্য ভূমিকা পালনের সুযোগ সৃষ্টির জন্য সরকারি খাতের ভূমিকার গুরুত্ব অনস্বীকার্য। বর্তমান বাজার অর্থনীতির প্রেক্ষাপটে বেসরকারি খাতের ভূমিকাই প্রধান। তবে কিছু ক্ষেত্রে সরকারি খাতের সীমিত কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য নিচে উল্লেখ করা হলো:

১. সম্পত্তির ব্যক্তিগত মালিকানার অধিকার স্বীকার করা হয়েছে। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে, যেমন কৃষি জমির ক্ষেত্রে, সম্পত্তির মালিকানার সর্বোচ্চ সীমা নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে। 

২. ব্যক্তিগত উদ্যোগ, ব্যবসায়-বানিজ্য ও পেশা নির্বাচনের স্বাধীনতা স্বীকৃত হয়েছে। কিন্তু শিল্প স্থাপন, ব্যবসা বানিজ্য পরিচালনা ইত্যাদি সরকারি নীতিমালার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হয়। 

৩. বাজার ব্যবস্থার মাধ্যমে অধিকাংশ সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।

৪. কিছু পণ্যের বাজার ক্ষেত্রে সরকারি হস্তক্ষেপ এবং নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। যেমন, ধান কাটার মৌসুমে ধান-চাল সংগ্রহ, বেশি দামের সময় খোলা বাজারে ন্যায্যমূল্যে চাল বিক্রয়, ঘাটতির সময় চাল আমদানি ইত্যাদির মাধ্যমে সরকার চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ করে। 

৫. ব্যক্তিগত উদ্যোগে সকল কাজ পরিচালিত হলেও শিল্পখাত, আর্থিক খাত, যোগাযোগ ও পরিবহন খাত, খনিজ ও জ্বালানী খাত ইত্যাদি ক্ষেত্রে রাষ্ট্রায়ত্ত খাত রয়েছে। শিল্প আইনের মাধ্যমে শুধু নির্দিষ্ট ৬টি ক্ষেত্র ছাড়া অন্যান্য সকল শিল্প ব্যক্তিগত খাতে বিনিয়োগের জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছে। 

৬. অর্থনৈতিক পরিকল্পনার মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ব্যক্তিগত ও সরকারি উভয় খাত গুরুত্বপূর্ণ ও পরিপূরক ভূমিকা পালন করে।

৭. যে সকল ব্যক্তি বাজারে অংশগ্রহণ করতে পারে না বা অংশগ্রহণের সুযোগ পায় না, বাজার অর্থনীতিতে তাদের কল্যাণ হয় না; এমন বিশেষ ক্ষেত্রে সরকার বিভিন্ন কর্মসুচি গ্রহণ করে তাদের কল্যাণ নিশ্চিত করে।

৮. কোনো দুর্যোগ বা সঙ্কট দেখা দিলে সরকার তা মোকাবিলার জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করে। কোনো বাজারে যোগানের স্বল্পতার জন্য বা কৃত্রিম কারণে স্থিতিশীলতা দেখা দিলে বাজারকে স্থিতিশীল করার। 

(এটি লেখার জন্য বাংলাদেশে প্রচলিত বেশ কিছু পাঠ্যবই ও শিক্ষক প্রশিক্ষণ মডিউলের সহায়তা নেওয়া হয়েছে; এ সম্পর্কে আরও জানার জন্য অন্যান্য অ্যাভেইলেবল সোর্স দেখার জন্য বলা হলো)

শেয়ার করুন

মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার তথ্য সংরক্ষিত রাখুন

লেখকতথ্য

আহমেদ মিন্টো

মিন্টো একজন ফ্রিল্যান্স লেখক এবং বিশ্লেষণ'র কন্ট্রিবিউটর।

বিশেষ শর্তসাপেক্ষে এই ওয়েবসাইটটি সামাজিক কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ কিংবা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের নিকট বিক্রি করা হবে।

অর্থনীতি: বিভিন্ন ধরনের অর্থনৈতিক অবস্থা ও বৈশিষ্ট্য এবং বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থা

প্রকাশ: ০৬:১৮:০০ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ৩ সেপ্টেম্বর ২০২১

বলা হয়ে থাকে, ‘অর্থনৈতিক ব্যবস্থা মানুষের বেঁচে থাকার একটি কৌশল’। উৎপাদন এবং বণ্টন সংক্রান্ত কার্যক্রম পরিচালনার একটি উপায় বা অবলম্বন হলো অর্থনীতি। আধুনিক বিশ্বে একেক দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা একেক রকম। বিভিন্ন দেশে যত ধরনের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা বিদ্যমান, সেগুলোর প্রধান কয়েকটি শ্রেণি বা প্রকারভেদ রয়েছে। এ সকল অর্থনৈতিক ব্যবস্থা হলো হলো- ধনতান্ত্রিক অর্থনীতি, সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি, মিশ্র অর্থনীতি ও ইসলামি অর্থনীতি।

বিভিন্ন ধরনের অর্থনৈতিক অবস্থা ও বৈশিষ্ট্য এবং বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থা

ধনতান্ত্রিক অর্থনীতি 

ধনতান্ত্রিক অর্থনীতির অপর নাম বাজার অর্থনীতি। ধনতান্ত্রিক অর্থনীতি বা বাজার অর্থনীতি অবাধ উদ্যোগ বা অবাধনীতি অর্থনীতি বলা হয়।

ধনতান্ত্রিক অর্থনৈতিক অবস্থায় মৌলিক অর্থনৈতিক সমস্যাসমূহ বাজার শক্তির অবাধ ক্রিয়ার মাধ্যমে সমাধান করা হয়। এ ধরনের অর্থ ব্যবস্থায় অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে রাষ্ট্রের বিশেষ ভূমিকা নেই বললেই চলে। এটি অবশ্য সত্য যে, শতভাগ বা বিশুদ্ধ বাজার অর্থনীতি কখনো ছিল না। 

ধনতান্ত্রিক অর্থনীতি বা বাজার অর্থব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য 

ধনতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার প্রধান কয়েকটি প্রধান বৈশিষ্ট্য নিচে উল্লেখ করা হল:

১. ব্যক্তিগত সম্পত্তি 

ব্যক্তিগত সম্পত্তির মালিকানা ধনতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থার প্রধান বৈশিষ্ট্য। এ অর্থব্যবস্থায় প্রাকৃতিক ও মানুষ নির্মিত সম্পদের মালিকানার, নিয়ন্ত্রণ ও বিনিময় করার অধিকার ব্যক্তি বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের হাতে থাকে। 

২. উদ্যোগের স্বাধীনতা

উদ্যোগের স্বাধীনতা হলো, উদ্যোক্তার ইচ্ছেমতো প্রয়োজনীয় অর্থনৈতিক সম্পদ সংগঠিত করে পছন্দমত দ্রব্য ও সেবা উৎপাদন করা এবং উৎপাদিত দ্রব্য ও সেবা পছন্দমত বাজারে বিক্রয় করার ক্ষেত্রে পূর্ণ অধিকার। কোনো ধরনের শিল্পে প্রবেশ বা শিল্প থেকে প্রস্থানের ক্ষেত্রে কোনো উদ্যোক্তার জন্য কেউ কোনো কৃত্রিম বাধা বা প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে না। 

৩. পছন্দের স্বাধীনতা

ভূমি ও মূলধনের মালিকেরা যে-ভাবে উপযুক্ত মনে করে সে-ভাবে এসব সম্পদ ব্যবহার করতে পারে, শ্রমিকরা নিজেদের পছন্দ অনুযায়ী কাজ করতে পারে, কারবারি নিজের ইচ্ছে মতো নিজের কারবারি কাজকর্ম চালিয়ে যেতে পারে, ভোক্তা নিজের পছন্দ অনুযায়ী পণ্য বা সেবা গ্রহণ করতে পারে; এই উন্মুক্ত অবস্থার নাম হলো পছন্দের স্বাধীনতা।

৪. ভোক্তার স্বাধীনতা

ভোক্তার স্বাধীনতা অর্থনৈতিক স্বাধীনতার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হয়। ধনতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থায় ভোক্তাকে প্রভূ বিবেচনা করা হয়। কারণ ভোক্তা যে সব দ্রব্য ও সেবা ক্রয়ের জন্য ব্যয় করে সমাজের সম্পদ সেসব দ্রব্য ও সেবা উৎপাদনের জন্য ব্যবহৃত হয়।  অবশ্য ‘ভোক্তার স্বাধীনতা’ বৈশিষ্ট্যটি ‘পছন্দের স্বাধীনতা’র সাথে যুক্ত।

৫. স্বার্থের ভূমিকা 

ধনতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থা ব্যক্তিবাদী এবং এজন্য এরূপ অর্থনীতির মূল উদ্দেশ্য হলো প্রতিটি অর্থনৈতিক এককের (ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি) স্বার্থের উন্নতি সাধন।

৬. প্রতিযোগিতা 

অর্থনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা বা প্রতিযোগিতা ধনতান্ত্রিক অর্থনীতির একটি মৌলিক বৈশিষ্ট্য।  প্রতিযোগিতা বলতে এখানে মূল্য প্রতিযোগিতা বুঝায়। দ্রব্য বা উপকরণের বাজারে অসংখ্য ক্রেতা এবং বিক্রেতা থাকে। কোনো একজন ক্রেতা বা বিক্রেতা বাজারের তুচ্ছ অংশ অর্থাৎ মোট ক্রয় বা বিক্রয়ের তুলনায় তার ক্রয় বা বিক্রয়ের পরিমাণ খুব অল্প। সুতরাং সে এককভাবে বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। মোট চাহিদা ও যোগানের মিথস্ক্রীয়ার মাধ্যমে বাজারে মূল্য নির্ধারিত হয় এবং এই মূল্য প্রদত্ত ধরে ক্রেতা ও বিক্রেতা সিদ্ধান্ত নেয়। প্রতিযোগিতা হলো ধনতান্ত্রিক অর্থনীতির নিয়ন্ত্রণমূলক কৌশল। প্রতিযোগিতামূলক ধনতান্ত্রিক অর্থনীতি সম্পদের ব্যবহার বা বরাদ্দকরণে সর্বাপেক্ষা দক্ষ।

৭. বাজার এবং দাম 

ধনতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থার সর্বাপেক্ষা মৌলিক বৈশিষ্ট্য হলো বিভিন্ন ব্যবহারের মধ্যে সম্পদ বরাদ্দকরণে মূল্য প্রক্রিয়ার ব্যবহার। বিভিন্ন দ্রব্য ও উপকরণের ক্রেতা ও বিক্রেতাদের সিদ্ধান্ত বাজার ব্যবস্থার মাধ্যমে কার্যকরি হয়। ক্রেতাদের সিদ্ধান্ত দ্বারা চাহিদা এবং বিক্রেতাদের 

সিদ্ধান্ত দ্বারা যোগান নির্ধারিত হয়। চাহিদা এবং যোগানের মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে বাজারে দাম নির্ধারিত হয়। এই দাম সম্পদের মালিক, উদ্যোক্তা এবং ভোক্তাদের জন্য পথনির্দেশক স্তম্ভ হিসেবে কাজ করে যার ভিত্তিতে তারা নিজেদের স্বার্থ বাস্তবা সিদ্ধান্ত নেয়। 

৮. সরকারের সীমিত ভূমিকা 

ধনতান্ত্রিক অর্থনৈতিক অবস্থায় অর্থনীতির কার্যপরিচালনার জন্য সরকারের বিশেষ ভূমিকা থাকে না। এক্ষেত্রে ব্যক্তিগত সম্পত্তির ব্যবহার এবং ব্যক্তির পছন্দের সীমারেখা টানার জন্য সরকার শুধু যথাযথ আইন কাঠামো দিতে পারে। যেমন, নিজস্ব সম্পদ ব্যবহার করে মাদক দ্রব্য উৎপদানের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে পারে।

সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি 

সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থা হলো এমন একটি সামাজিক-অর্থনৈতিক ব্যবস্থা যেখানে সম্পদ ও অর্থের মালিকানা সামাজিক বা রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণাধীন। সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থায় কোনো ব্যক্তিমালিকানা থাকে না এবং জনসাধারণের প্রয়োজন অনুসারে পণ্য উৎপাদন হয়। এই ব্যবস্থায় মৌলিক অর্থনৈতিক সমস্যাসমূহ কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষের নির্দেশে সমাধান করা হয়। 

সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির বৈশিষ্ট্য 

সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির বৈশিষ্ট্যসমূহ নিচে আলোচনা করা হলো:

১. সম্পদের রাষ্ট্রীয় মালিকানা

সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো কলকারখানা, জমি সম্পদ এবং উৎপাদনের অন্যান্য উপকরণ উৎপাদনের উপকরণের উপর রাষ্ট্রীয় মালিকানা স্বীকৃত থাকবে।

২. মুনাফা নিষিদ্ধ

সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় ব্যক্তিগত সম্পদ ও মুনাফা অর্জন নিষিদ্ধ।

৩. শ্রেণি বৈষম্য ও শ্রেণি শোষণমুক্ত

সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থায় সম্পদ ও উৎপাদনের উপকরণের উপর রাষ্ট্রীয় মালিকানা প্রতিষ্ঠিত করার মাধ্যমে সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিত করা হয়; এর ফলে সমাজে শ্রেণি বৈষম্য ও শ্রেণি শোষণ বিলুপ্ত হয়। সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় শ্রমিকদের শোষনের কোন সুযোগ থাকে না এবং প্রত্যেকেই সমান মর্যাদা ও সুবিধা ভোগ করে। সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষিত হয়।

৪. আয় ও সম্পদের সুষম বণ্টন

সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থায় জাতীয় আয় বণ্টনের মূলনীতি হলো প্রত্যেকে ব্যক্তি নিজের যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ করবে এবং কাজ অনুযায়ী পারিশ্রমিক পাবে; যা আয় ও সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে সামাজিক ন্যয়বিচার প্রতিষ্ঠা করে থাকে।

সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় রাষ্ট্রের উৎপাদন ও বণ্টন ব্যবস্থা দেশ বা সমাজের কল্যাণের দিকে লক্ষ্য রেখে করা হয়। বলা হয়, সামাজিক কল্যাণ সাধনই এই অর্থ ব্যবস্থার মুল উদ্দ্যেশ্য।

৫. পরিকল্পনা কর্তৃপক্ষ বিদ্যমান

সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় উৎপাদন, বণ্টন, বিনিয়োগ ইত্যাদি ব্যবস্থাপনার জন্য কেন্দ্রীয় (রাষ্ট্রীয়) পরিকল্পনা কর্তৃপক্ষ থাকে। সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থায় কৃষি, শিল্প, শিক্ষা, সাস্থ্য, যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রভৃতি খাতে পরিকল্পনা অনুযায়ী যথাযথ গুরুত্ব সহকারে উন্নয়ন করা হয়। সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থায় কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষের পরিকল্পনা অনুযায়ী সকল অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।

৬. মৌলিক চাহিদার নিশ্চয়তা

সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতিতে মানুষের সকল মৌলিক চাহিদা, যেমন- খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা, চিত্তবিনোদনের নিশ্চয়তা প্রদান করা হয়।

৭. বেকারত্ব ও মুদ্রাস্ফীতির সম্ভাবনাহীনতা

সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থায় ক্ষেত্রে সাধারণত বেকারত্ব ও মুদ্রাস্ফীতির সম্ভাবনা থাকে না।

৮. অতি উৎপাদন কিংবা সংকট নেই

সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় চাহিদা বা প্রয়োজন অনুযায়ী পরিকল্পিত উপায়ে উৎপাদন ও বণ্টন ব্যবস্থা পরিচালিত হওয়ার ফলে অতি উৎপাদন বা কম উৎপাদনজনিত ঘটনা ঘটতে দেখা দেয় না।

৯. কেন্দ্র থেকে মূল্য বা দাম নির্ধারিত হয়

সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা কতৃপক্ষ পণ্য বা দ্রব্যসামগ্রীর মূল্য নির্ধারন করে দেয়।

১০. রাজনৈতিক পরিবেশের উপাদান

সমাজতান্ত্রিক সমাজের রাজনৈতিক ব্যবস্থার মূল উপাদানসমূহ হলো রাষ্ট্র, সমাজের নেতৃজনিত ও চালিকা শক্তি মার্কসবাদী লেনিনবাদী পার্টি, নানা সামাজিক সংগঠন ও মেহনতি কর্মীদল।

মিশ্র অর্থনীতি 

বর্তমান সময়ে কোনো অর্থনৈতিক ব্যবস্থাই শতভাগ বিশুদ্ধ ধনতান্ত্রিক বা বিশুদ্ধ সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি নয়। বর্তমানে সকল অর্থনীতি মিশ্র অর্থনীতি।

যে অর্থব্যবস্থায় ব্যক্তিগত ও রাষ্ট্রীয় উভয় মালিকানাই স্বীকৃত এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড আংশিক ব্যক্তি উদ্যোগে বাজার প্রক্রিয়ায় এবং আংশিক রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে পরিকল্পনা কমিশনের নির্দেশে পরিচালিত হয়, তাকে মিশ্র অর্থব্যবস্থা বলে।

মিশ্র অর্থনীতির প্রধান বৈশিষ্ট্যসমূহ 

মিশ্র অর্থনীতিতে ধনতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক উভয় প্রকারই স্বীকৃত।

মিশ্র অর্থনীতির প্রধান বৈশিষ্ট্যসমূহ নিচে আলোচনা করা হলো:

১. ব্যক্তিগত ও সরকারি খাতের সহাবস্থান

মিশ্র অর্থনীতির প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো এতে ব্যক্তিগত ও সরকারি খাত একত্রে পাশাপাশি অবস্থান করে। অর্থনীতির বিভিন্ন খাতে ব্যক্তিগত ও সরকারী খাতের ভূমিকা নির্দিষ্ট করা হয়।

২. সম্পদের মালিকানা

মিশ্র অর্থব্যবস্থায় সম্পদের মালিকানা সরকারি ও বেসরকারি উভয়ই হয়ে থাকে।

৪. উৎপাদনের স্বাধীনতা এবং রাষ্ট্রীয় নিষেধাজ্ঞা

মিশ্র অর্থব্যবস্থায় ব্যক্তির উৎপাদনের স্বাধীনতা স্বীকৃত। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে কতিপয় পণ্যের উৎপাদনে রাষ্ট্র কর্তৃক নিষেধাজ্ঞা বজায় থাকে।

২. দাম ব্যবস্থা ও সরকারি নির্দেশের ভূমিকা

মিশ্র অর্থনীতির আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো এটি দাম ব্যবস্থা ও সরকারী নির্দেশ উভয়ের দ্বারা পরিচালিত হয়। সরকারি খাতের উৎপাদন, দাম ও বিনিয়োগ সম্পর্কিত সিদ্ধান্ত সরকার গ্রহণ করে। অপরদিকে, ব্যক্তিগত খাতের উৎপাদন, দাম ও বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত মুনাফা সর্বোচ্চকরণের উদ্দেশ্যে পরিচালিত হয়। 

৩. সরকারী নিয়ন্ত্রণ ও আইন

ব্যক্তিগত খাতে যে শুধু ব্যক্তির স্বার্থে পরিচালিত না হয় এর জন্য মিশ্র অর্থনীতিতে ব্যক্তিগত খাতের কার্যকলাপ সরকারী আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়।

৪. স্বয়ংক্রিয় দাম ব্যবস্থা

মিশ্র অর্থব্যবস্থায় স্বয়ংক্রিয় দাম ব্যবস্থা বিদ্যমান। বাজারে চাহিদা ও যোগানের ঘাত-প্রতিঘাতে দ্রব্যের দাম নির্ধারিত হয়ে থাকে। তবে বিশেষ বিশেষ পরিস্থিতিতে সরকার বাজার ব্যবস্থায় হস্তক্ষেপ করে থাকে।

৪. মুনাফা অর্জন স্বীকৃত

মিশ্র অর্থব্যবস্থায় ব্যক্তি খাতের উপস্থিতি থাকায় মুনাফা অর্জন স্বীকৃত।

৫. অর্থনৈতিক পরিকল্পনা

মিশ্র অর্থব্যবস্থায় সরকারি পরিকল্পনা অনুসারে বেসরকারি খাত নিয়ন্ত্রিত ও সরকারি খাত পরিচালিত হয়। এর জন্য প্রতিটি দেশেই একটি জাতীয় পরিকল্পনা কমিশন এ সংক্রান্ত প্রতিষ্ঠান বা পরিষদ থাকে।

৬. সামাজিক নিরাপত্তা

মিশ্র অর্থব্যবস্থায় সামাজিক রোগ, শোক, দুর্ঘটনা, বেকারত্ব, অক্ষমতা ইত্যাদির হাত থেকে জনগণকে রক্ষা করার জন্য নানা ধরনের রাষ্ট্রীয়ভাবে এবং ব্যক্তিগতভাবে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।

৭. সরকারের জবাবদিহিতা

মিশ্র অর্থব্যবস্থায় সরকারের জবাবদিহিতাকে বেশ গুরুত্বের সাথে দেখা হয়।

৮. আয় বৈষম্য

মিশ্র অর্থব্যবস্থায় যেহেতু সম্পদের উপর ব্যক্তি মালিকানা স্বীকৃত, তাই সেখানে স্বাভাবিকভাবেই আয় বৈষম্য লক্ষ্যণীয়।

৯. মুদ্রাস্ফীতির উপস্থিতি

মিশ্র অর্থনীতিতে যেহেতু ব্যক্তি উদ্যোগ স্বীকৃত এবং মুনাফাভিত্তিক উৎপাদন কার্যক্রম পরিচালিত হয়, সেহেতু এই অর্থনৈতিক অবস্থায় অনেক সময় অতি উৎপাদন বা কম উৎপাদন হতে পারে যার কারণে মুদ্রাস্ফীতিও দেখা দিতে পারে।

৪. ভোক্তার স্বাধীনতা

মিশ্র অর্থনীতিতে ভোক্তার স্বাধীনতা রক্ষিত হয়। ভোক্তা বাজারে নির্ধারিত দামে তার পছন্দসই পণ্য বাজার থেকে ক্রয় করতে পারে। উৎপাদক ভোক্তার পছন্দসই পণ্য বাজারে যোগান দেয়। অবশ্য কখনও কখনও সরকার ভোক্তার স্বার্থে দ্রব্যের দাম নিয়ন্ত্রণ করে বা সীমিত যোগান বিশিষ্ট দ্রব্য রেশনিং এর মাধ্যমে বণ্টন করে।

ইসলামি অর্থনীতি 

কুরআন ও সুন্নাহ মোতাবেক অর্থনৈতিক লেনদেন ব্যবস্থা হলো ইসলামি অর্থনীতি ব্যবস্থা। ইসলামি সংস্কৃতি ও তামাদ্দুন সমৃদ্ধ যে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে তা হলো ইসলামি অর্থনীতি।

ইসলামি অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ৭ টি মূলনীতি

বইভিন্ন মুসলিম পণ্ডিতের মত অনুযায়ী, ৭ টি (সাতটি) প্রধান মূলনীতিকে ইসলামি অর্থনীতির মৌলিক ভিত্তি হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করা হয়। এই ৭ মূলনীতির মাধ্যমে অর্থনীতির সকল কর্মকৌশল, কর্মপদ্ধতি ও কর্মদ্যোগ নির্ধারিত ও পরিচালিত হয়ে থাকে।

ইসলামি অর্থব্যাবস্থার ৭ টি মূলনীতি নিচে উল্লেখ করা হলো:

১. সকল ক্ষেত্রে আমর বিল মারুফ এবং নেহি আনিল মুনকার-এর বাস্তবায়নের মাধ্যমে তাযকিয়া (আত্মশুদ্ধি) ও তাকওয়া (আল্লাহভীরুতা) অর্জন

২. সকল কর্মকাণ্ডেই শরীয়াহর বিধান মান্য করা

৩. কল্যাণের জন্য শ্রমভিত্তিক বিনিময় ও বিনিময়ভিত্তিক শ্রম ন্যায়বিচার প্রয়োগ

৪. ব্যক্তির সম্পদে সমাজের অধিকার প্রতিষ্ঠা

৫. ভারসাম্যপূর্ন জীবন যাপনের প্রয়াস

৬. মৌলিক মানবিক প্রয়োজন পূরন নিশ্চত করা

৭. যুগপৎ দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণ অর্জন

ইসলামি অর্থনৈতিক অবস্থার বৈশিষ্ট্য

এই অর্থনৈতিক ব্যবহার কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এর মধ্যে তিনটি প্রধান বৈশিষ্ট্য নিচে আলোচনা করা হলো:

১. সুদ হারাম

ইসলামি অর্থনীতিতে সুদকে হারাম করা হয়েছে। ইসলামি অর্থ ব্যবস্থায় ঋণদাতা ঋণগ্রহীতার ব্যবসায় লাভজনক হলে যেমন মুনাফার অংশ পাবে, ব্যবসায় ক্ষতিগ্রস্ত হলে তেমনি তারা ক্ষতির ভাগ বহন করবে। অর্থাৎ ঋণদানকারী মুনাফা ও ঝুঁকি উভয়েরই অংশ বহন করবে।

২. ইসলামি পুর্নবণ্টন

ইসলামি অর্থনীতির দ্বিতীয় প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো ইসলামি পুর্নবণ্টন ব্যবস্থা। ইসলামি অর্থনীতিতে পুর্নবণ্টনের উদ্দেশ্যে যে সকল হাতিয়ার ব্যবহৃত হয় তার মধ্যে রয়েছে যাকাত (নিসাব স্তরের অতিরিক্ত সম্পদের উপর শতকরা ২.৫ হারে আরোপিত কর), সদকা (স্বেচ্ছামূলক দান), গনিমত (যুদ্ধে লুন্ঠিত মাল), খারাজ (যুদ্ধে বিজিত ভূমির উপর আরোপিত কর), উশর (শস্যের উপর যাকাত) ইত্যাদি। মনে করা হয় যে, যাকাত আয় পুর্নবণ্টনের একটি শক্তিশালী হাতিয়ার। 

৩. ইসলামি অর্থনৈতিক নিয়ম

ইসলামি অর্থনীতিতে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান ইসলামি নিয়মের নির্দেশ অনুযায়ী কাজ পরিচালনা করে। এ সকল নিয়ম ভালো কাজে উৎসাহ দান করে এবং মন্দ কাজ নিরুৎসাহিত করে। এসব নিয়ম অপচয়, অমিতব্যয় ও আড়ম্বর পরিহার করতে উৎসাহ দেয়। ক্ষতিকর বাহ্যিকতা সৃষ্টি করে এরূপ কাজকে নিরুৎসাহিত করে। এরা ঔদার্য উৎসাহিত করে। তারা ব্যক্তিকে কঠোর পরিশ্রম করতে, ন্যায্য মূল্য চাইতে এবং  অন্যান্যদেরকে তাদের ন্যায্য পাওনা পরিশোধ করতে উদ্ধুদ্ধ করে। এভাবে ইসলামি অর্থনীতি ধনতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক উভয় প্রকার অর্থনীতি থেকে পৃথক। এছাড়া আরও একটি বিষয় হলো ইসলামে হারাম (অবৈধ) বলা হয়েছে এমন কাজকর্ম, পণ্যদ্রব্য এবং পরিষেবা থেকে বিরত থাকতে হবে।

ইসলামি দৃষ্টিকোণ থেকে ধনতান্ত্রিক অর্থনীতিতে অর্থনৈতিক স্বাধীনতার পরিমাণ মাত্রাতিরিক্ত, আবার সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতিতে তা খুবই সংকীর্ণ। ইসলামি অর্থনীতি একটি তত্ত্বীয় পন্থা যা অর্থনৈতিক স্বাধীনতাকে কাম্য স্তরে সীমিত করে।

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা কোন ধরনের? 

বাংলাদেশের অর্থনীতি মিশ্র অর্থনীতি। অর্থনীতির সকল খাতে ব্যক্তিগত উদ্যোগ ও ব্যক্তিগত প্রচেষ্টার প্রাধান্য স্বীকার করা হয়েছে। কিন্তু বেসরকারি খাতকে তার যথাযোগ্য ভূমিকা পালনের সুযোগ সৃষ্টির জন্য সরকারি খাতের ভূমিকার গুরুত্ব অনস্বীকার্য। বর্তমান বাজার অর্থনীতির প্রেক্ষাপটে বেসরকারি খাতের ভূমিকাই প্রধান। তবে কিছু ক্ষেত্রে সরকারি খাতের সীমিত কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য নিচে উল্লেখ করা হলো:

১. সম্পত্তির ব্যক্তিগত মালিকানার অধিকার স্বীকার করা হয়েছে। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে, যেমন কৃষি জমির ক্ষেত্রে, সম্পত্তির মালিকানার সর্বোচ্চ সীমা নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে। 

২. ব্যক্তিগত উদ্যোগ, ব্যবসায়-বানিজ্য ও পেশা নির্বাচনের স্বাধীনতা স্বীকৃত হয়েছে। কিন্তু শিল্প স্থাপন, ব্যবসা বানিজ্য পরিচালনা ইত্যাদি সরকারি নীতিমালার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হয়। 

৩. বাজার ব্যবস্থার মাধ্যমে অধিকাংশ সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।

৪. কিছু পণ্যের বাজার ক্ষেত্রে সরকারি হস্তক্ষেপ এবং নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। যেমন, ধান কাটার মৌসুমে ধান-চাল সংগ্রহ, বেশি দামের সময় খোলা বাজারে ন্যায্যমূল্যে চাল বিক্রয়, ঘাটতির সময় চাল আমদানি ইত্যাদির মাধ্যমে সরকার চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ করে। 

৫. ব্যক্তিগত উদ্যোগে সকল কাজ পরিচালিত হলেও শিল্পখাত, আর্থিক খাত, যোগাযোগ ও পরিবহন খাত, খনিজ ও জ্বালানী খাত ইত্যাদি ক্ষেত্রে রাষ্ট্রায়ত্ত খাত রয়েছে। শিল্প আইনের মাধ্যমে শুধু নির্দিষ্ট ৬টি ক্ষেত্র ছাড়া অন্যান্য সকল শিল্প ব্যক্তিগত খাতে বিনিয়োগের জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছে। 

৬. অর্থনৈতিক পরিকল্পনার মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ব্যক্তিগত ও সরকারি উভয় খাত গুরুত্বপূর্ণ ও পরিপূরক ভূমিকা পালন করে।

৭. যে সকল ব্যক্তি বাজারে অংশগ্রহণ করতে পারে না বা অংশগ্রহণের সুযোগ পায় না, বাজার অর্থনীতিতে তাদের কল্যাণ হয় না; এমন বিশেষ ক্ষেত্রে সরকার বিভিন্ন কর্মসুচি গ্রহণ করে তাদের কল্যাণ নিশ্চিত করে।

৮. কোনো দুর্যোগ বা সঙ্কট দেখা দিলে সরকার তা মোকাবিলার জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করে। কোনো বাজারে যোগানের স্বল্পতার জন্য বা কৃত্রিম কারণে স্থিতিশীলতা দেখা দিলে বাজারকে স্থিতিশীল করার। 

(এটি লেখার জন্য বাংলাদেশে প্রচলিত বেশ কিছু পাঠ্যবই ও শিক্ষক প্রশিক্ষণ মডিউলের সহায়তা নেওয়া হয়েছে; এ সম্পর্কে আরও জানার জন্য অন্যান্য অ্যাভেইলেবল সোর্স দেখার জন্য বলা হলো)