অকাস কী এং কেন গঠিত হয়? অকাস নিয়ে চীন ও ফ্রান্সের প্রতিক্রিয়া কী?
- প্রকাশ: ১২:৪৭:০৬ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২১
- / ৭১৫১ বার পড়া হয়েছে
২০২১ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর অকাস (AUKUS অথবা Aukus) নামে একটি নতুন জোট আবির্ভুত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন, যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন এবং অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসন এক ভার্চুয়াল সম্মেলনে যৌথ বিবৃতির মাধ্যমে এই জোটের ব্যাপারে বিশ্বকে জানান। এখানে Aukus এর পূর্ণরূপ হলো- Australia, the United Kingdom, and the United States। স্বাভাবিকভাবেই অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাজ্য এবং যুক্তরাষ্ট্র- এই তিনটি দেশ হলো অকাসের সদস্য।
অকাস কী?
অকাস হলো অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাজ্য এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে ত্রিমুখী প্রতিরক্ষার কৌশলগত জোট। অকাস গঠন করা হয় ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২১ তারিখ। প্রাথমিকভাবে এই জোটের মনোযোগ পরমাণু শক্তি চালিত সাবমেরিন নির্মাণের দিকে। এছাড়া ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলেও এই তিন দেশ একসাথে কাজ করবে এবং নিজেদের উপস্থিতি পূর্বের থেকেও বৃদ্ধির চেষ্টা করবে। বলা হচ্ছে ইন্দো প্যাসিফিক অঞ্চলে নিরাপত্তা ও উন্নতি নিশ্চিত করা ও মূল্যবোধ সুরক্ষার জন্য তিন দেশ: অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাজ্য এবং যুক্তরাষ্ট্র এই নতুন জোট অকাস (Aukus) গঠন করেছে।
অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাজ্য এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে এই ঐতিহাসিক নিরাপত্তা চুক্তির তীব্র সমালোচনা করেছে চীন। চীন এই ‘অকাস’ গঠনের চুক্তিকে ‘চরম দায়িত্বজ্ঞানহীন’ ও ‘সংকীর্ণ মানসিকতা’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। ফ্রান্স বলছে এই চুক্তি হলো ‘পেছন থেকে ছুড়িকাঘাত’।
অকাস কেন গঠন করা হলো?
আনুষ্ঠানিকভাবে অকাস (Aukus) গঠনের উদ্দেশ্য হলো ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে (Indo-Pacific region) সমন্বিত নিরাপত্তা ও উন্নতি নিশ্চিতের পাশাপাশি মূল্যবোধের সুরক্ষার কথা বলা হয়েছে।
অকাস চুক্তির আওতায় যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য অস্ট্রেলিয়াকে পরমাণু চালিত সাবমেরিন নির্মাণের প্রযুক্তি দিয়ে সহযোগিতা করবে।
এখানে একটি বিষয় নিশ্চিত বলেই দাবি করছেন বিশেষজ্ঞরা, আর সেটি হলো বিরোধপূর্ণ দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব ঠেকানোই প্রধান লক্ষ্য।
চীন ও অস্ট্রেলিয়ার মধ্যে উত্তেজনা
অকাস (Aukus) চুক্তির মাধ্যমে অস্ট্রেলিয়া কাগজে কলমে চীনের একটি প্রতিপক্ষে পরিণত হয়েছে। অতীত ঘটনা ঘেটে দেখলে বোঝা যাবে যে, অস্ট্রেলিয়া সর্বদা যুক্তরাষ্ট্রের কথায় কথা মিলিয়ে চীনের বিপক্ষে ছিল; আবার কোয়াড সংলাপের মাধ্যমে অস্ট্রেলিয়া চীনের প্রতিপক্ষ হিসেবে চিহ্নিত করা হলেও সেটি ছিল একটি অনানুষ্ঠানিক বিষয়। কিন্তু এবার অস্ট্রেলিয়াকে কাগজে কলমে চীনের বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু এই চীন অস্ট্রেলিয়ার অন্যতম বাণিজ্যিক ভরসা। চীন ও অস্ট্রেলিয়ার মধ্যে খুবই ভালো সম্পর্ক থাকলে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এই দুই দেশের মধ্যে বিবাদ ক্রমবর্ধমান।
ব্রিটিশ ব্রডকাস্টিং করপোরেশন (বিবিসি) বলছে, চীনের উইঘুরদের (Uyghur) বিষয়ে অস্ট্রেলিয়ার অবস্থান, টেলিকম কোম্পানি হুয়াওয়ের (Huawei) কিছু প্রযুক্তি নিষিদ্ধ করা এবং করোনাভাইরাস মহামারী তদন্তে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি সমর্থন দেওয়া নিয়ে তাদের (অস্ট্রেলিয়া ও চীন) রাজনৈতিক সম্পর্কে ভাঙ্গন ধরেছে। বিবিসির প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীনের অবকাঠামো বিনিয়োগ ব্যাপক বাড়ানো নিয়েও পশ্চিমারা উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছিল। তারা চীনের কিছু ব্যবসায়িক সিদ্ধান্ত নিয়েও ক্ষুব্ধ ছিল। যেমন গত বছরই চীন অস্ট্রেলিয়ার ওয়াইনের ওপর কর বাড়িয়েছিল ২০০ ভাগ পর্যন্ত। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেন বলেছেন, চীনের বিরুদ্ধে অস্ট্রেলিয়ার নিজেকে সুরক্ষার পক্ষে দাঁড়িয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
অকাস প্রসঙ্গে ক্ষুব্ধ ফ্রান্স
ফ্রান্সের সাথে অস্ট্রেলিয়ার ১২ টি ডিজেল বৈদ্যুতিক শক্তি চালিত সাবমেরিন বানানোর চুক্তি ছিল, যার পরিমাণ ছিল ৫০ বিলিয়ন ডলার। এখন যেহেতু অকাস (Aukus) চুক্তির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র অস্ট্রেলিয়াকে পারমাণবিক শক্তি চালিত সাবমেরিন দিবে সেহেতু ফ্রান্সের সাথে অস্ট্রেলিয়ার এই ৫০ বিলিয়ন ডলারের চুক্তি বাতিল করেছে অস্ট্রেলিয়া। এতে স্বাভাবিকভাবেই ফ্রান্সের ক্ষুব্ধ হবার কথা।
১৬, সেপ্টেম্বর ২০২১ তারিখে আল-জাজিরার এক প্রতিবেদনে দেখা যায় যে, ফ্রান্সের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জ্যাঁ-ইভেস ল্য দ্রিয়াঁ (Jean-Yves Le Drian) অকাস প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘এটি সত্যিকার অর্থেই পেছন থেকে ছুড়িকাঘাত’।
ফ্রান্স নিশ্চিতভাবেই অস্ট্রেলিয়ার সাথে একটি আস্থার সম্পর্ক তৈরি করেছিল কিন্তু অকাস চুক্তির মাধ্যমে সেই আস্থার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে অকাস; এরকমই মন্তব্য করেছেন ফ্রান্সের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। ফ্রান্সের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যের যৌক্তিকতা রয়েছে বলে স্বীকার করেছে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন (European Union)। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে যে, ফ্রান্সের ক্ষোভের কারণ ইউনিয়ন বুঝতে পারছে কিন্তু চুক্তির (অকাস) আগে তাদের সাথে কোনো আলোচনা হয়নি।
অকাসের সাথে আনজুস ট্রিটির (ANZUS) পার্থক্য কোথায়?
১৯৫১ সালে প্রতিষ্ঠিত The Australia, New Zealand and United States Security Treaty (ANZUS or ANZUS Treaty) একটি সমন্বিত নিরাপত্তার নন-বাইন্ডিং চুক্তি, যাতে ইন্দো-প্যাসিফিক বা প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে সহযোগিতার কথা বলা আছে। তবে এতে কোনো পরমাণু শক্তির ব্যবহারের বিষয়ে কিছু নেই। অপরদিকে অকাস প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে সহযোগিতা বৃদ্ধি করলে এর শুরুই হয়েছে পরমাণু শক্তি বৃদ্ধির প্রত্যয় নিয়ে। এই পরমাণু শক্তিই অকাস ও আনজুসের মধ্য প্রধান পার্থক্য গড়ে দেয়। নিউজিল্যান্ড যেহেতু সামরিক ক্ষেত্রে পরমাণু শক্তি নিষিদ্ধ করেছে সেহেতু নতুন জোট থেকে দেশটিকে বাইরে রাখা হয়েছে বলে মনে হয়, তবে অফিশিয়াল কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি এ বিষয়ে।