প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার নারী মুক্তির চেতনা ও অনুপ্রেরণার এক অমর নাম
- প্রকাশ: ০৪:৩৮:০৪ অপরাহ্ন, বুধবার, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২১
- / ২১৩৫ বার পড়া হয়েছে
সংগ্রামী, সৎ, সাহসী, নিষ্ঠাবান, দেশপ্রেমিক এক মহীয়সী নারী, বাঙালির ইতিহাসে প্রথম নারী শহীদ প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার (Pritilata Waddedar)। ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম বিপ্লবী নারী শহীদ প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের আত্নহুতি দিবস ২৩ সেপ্টেম্বর।
এক নজরে প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের সংক্ষিপ্ত জীবনী
প্রীতিলতার জন্ম
প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার ১৯১১ সালের ৫ মে জন্মগ্রহণ করে। তার ডাকনাম ছিল রাণী, ছদ্মনাম ফুলতার। ছোটো বেলা থেকেই প্রীতিলতা তার মায়ের সাথে রান্না বান্নায় অনেক পারদর্শী ছিলেন।
প্রীতিলতার শিক্ষাজীবন
প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার চট্টগ্রামের খাস্তগীর বালিকা বিদ্যালয় থেকে ১৯২৭ সালে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাশ করেন। এরপর তিনি ১৯২৯ সালে ঢাকা ইডেন মহিলা কলেজে ভর্তি হন, তিনি উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় ঢাকা বোর্ডে প্রথম স্থান অধিকার করেন। এর দুই বৎসর পর প্রীতিলতা কলকাতার বেথুন কলেজ থেকে দর্শনশাস্ত্রে ডিস্টিংশনসহ গ্রাজুয়েশন করেন। ইডেন কলেজের ছাত্রী থাকাকালে প্রীতিলতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ছাত্রী লীলা নাগের নেতৃত্বাধীন আসেন। কলকাতার বেথুন কলেজের ছাত্রী থাকাকালে কল্যাণী দাসের নেতৃত্বাধীন ছাত্রীসংঘের সদস্য হন। গ্রাজুয়েশন করার পর তিনি চট্টগ্রামের নন্দনকানন অপর্ণাচরণ নামক একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে প্রধান শিক্ষিকা হিসেবে যোগদান করেন।
প্রীতিলতার সংগ্রামী কর্মকাণ্ড
১৯৩০ সালে সমগ্র বাংলা জুড়ে অনেক বিপ্লবী দল সংগ্রামরত ছিল। ঐসব দলের সদস্যরা বিশ্বাস করত যে, কেবল সশস্ত্র বিপ্লবের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা অর্জিত হতে পারে। এক্ষেত্রে স্বাধীনতা সংগ্রামের গোপন দলিলপত্র পাঠ থেকে প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার বিপ্লবে উদ্বুদ্ধ হন। প্রীতিলতা সূর্যসেনের নেতৃত্বাধীন বিপ্লবী দলের প্রথম মহিলা সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি টেলিফোন ও টেলিগ্রাফ অফিস ধ্বংস এবং রিজার্ভ পুলিশ লাইন দখল অভিযানে যুক্ত ছিলেন। তিনি জালালাবাদ যুদ্ধেও অংশগ্রহণ করেন। ১৯৩০ সালে প্রীতিলতা কলকাতাস্থ আলীপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত রাজবন্দি রামকৃষ্ণের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়ে যথাসময়ে তা পালন করেন। ১৯৩২ সালের ১৩ জুন ধলঘাট সংঘর্ষে কয়েকজন বিপ্লবী প্রাণ হারান। মাস্টারদা ও প্রীতিলতা পালাতে সক্ষম হন।
ইংরেজদের বিরুদ্ধে সংগ্রামী আন্দোলন ও আত্নহত্যা
মাস্টারদা’র নির্দেশ পেয়ে কয়েকজন বিপ্লবীকে সঙ্গে নিয়ে ১৯৩২ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর প্রীতিলতা চট্টগ্রামের পাহাড়তলী ইউরোপিয়ান ক্লাবে ইংরেজদের ওপর আক্রমণ করেন। কারণ পাহাড়তলী ইউরোপিয়ান ক্লাবটিতে একটি সাইনবোর্ড লাগানো ছিলো যাতে লেখা ছিলো কুকুর এবং ভারতীয়দের প্রবেশ নিষেধ। তাদের কঠোর অবস্থানে ইংরেজরা দিশেহারা হয়ে যায়।
অভিযান শেষে ফেরার সময় তার গায়ে একটি গুলি লাগে। ইংরেজদের হাতে ধরা পড়ার আশঙ্কায় তিনি নিজের পকেটে থাকা পটাশিয়াম সায়ানাইড খেয়ে আত্মহনন করেন।
বাঙালি নারীর অনুপ্রেরণা
ইংরেজদের বিরুদ্ধে বিপ্লবী আন্দোলনের পাশাপাশি নারীদরে প্রতি বৈষম্য বিরুদ্ধেও সোচ্চার ছিলেন প্রীতিলতা। মৃত্যুকালে প্রীতিলতার শেষ বিবৃতিতে তিনি লিখেছিলেন- নারীরা আজ কঠোর সংকল্প নিয়েছে যে, আমার দেশের বোনেরা আজ নিজেকে দুর্বল মনে করবেন না। সশস্ত্র ভারতীয় নারী সহস্র বিপদ ও বাধাকে চূর্ণ করে এই বিদ্রোহ ও সশস্ত্র মুক্তি আন্দোলনে যোগদান করবেন- এই আশা নিয়ে আমি আজ আত্মদানে অগ্রসর হলাম।
ব্রিটিশের শোষণ থেকে দেশকে এবং দেশের মানুষকে মুক্ত করতে স্বাধীনতার জন্য প্রীতিলতা জীবন দিয়েছিলেন। নারীমুক্তির সংগ্রামে মূল চেতনা ও ধারক হিসেবে প্রেরণা ও উৎসাহের আরেক নাম প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার।বাঙালি নারীকে তিনি শিখিয়েছিলেন নারীরাও দেশের জন্য লড়াই করতে পারে জীবন বাজি রাখতে পারে, তিনি শিখিয়েছেন স্বাধীনতার জন্য কী করে হার না মেনে সামনের দিকে অগ্রসর হওয়া যায়,বার বার নয় এক বার জন্মগ্রহণ করেও কি করে মানুষের হৃদয়ের মণিকোঠায় স্থান পাওয়া যায়।
নারী মুক্তির অগ্রদূত
বাঙালি নারীকে চিরকাল কেবল অবলা হয়েই থাকা যাবেনা, সংগ্রামী প্রতিবাদীও হতে হবে। যে বাঙালি নারী আজীবন গৃহের কোণে পড়ে থাকে কেবলই সাংসারিক কাজকর্মে মনোযোগী হয়, সেই নারীকে তিনি চিনিয়েছেন দেশের জন্য, বিপ্লবের জন্য একটি জীবনকে কতোখানি মহিমান্বিত করা যায়। কী করে গর্জে ওঠা যায় শোষকের বিরুদ্ধে। তাই তো তিনি বাংলার অগ্নিকন্যা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার।
প্রীতিলতার অমর জীবন হতে এই দেশের মেয়েদের তার অবিচল আদর্শ নিষ্ঠার শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে। ভাইদের পাশে দাঁড়াতে বোনদের সংগ্রাম করার যে দাবি তিনি উথাপন করেছিলেন, সংগ্রাম ও ইতিহাসের পরিবর্তিত রূপে এবং বিশ্বের বহু বৈজ্ঞানিক ও রাজনৈতিক অগ্রগতির পরও আমাদের দেশে প্রীতিলতার সেই দাবি আজও বাস্তবে রূপায়িত হয়নি। প্রীতিলতার শৌর্য ও সাহস ও আদর্শ নিষ্ঠা এ দেশের মেয়েদের কাছে এক অমূল্য উত্তরাধিকার যা নারীদের জন্য আলোকবর্তিকার নতুন রূপ।তৎকালীন বিপ্লব যুগের প্রথম নারী শহীদ প্রীতিলতা। সে সময়কার চট্টগ্রামের একটি তরুণী নিজের মাতৃভূমিকে সাম্রাজ্যবাদের কবলমুক্ত করার জন্য যে মরণ স্বপ্ন দেখেছিল তার কর্মপন্থা যুগের সঙ্গে সঙ্গে পরিত্যক্ত হয়েছে। এভাবে আজ আমাদের মধ্যে প্রয়োজন কোটি প্রীতিলতার। যারা হাজার বছরব্যাপী আমাদের প্রেরণাদায়িনী হয়ে আলোর পথ দেখাবে।যারা শোষণ উৎপীড়নের বিরুদ্ধে সোচ্চার হবে।নিজেকে রক্ষার দায়িত্ব নিবে।যারা যুগে যুগে অসুর ধ্বংসের হাতিয়ার হয়ে সামনে দাঁড়াবে।
১৯৩২ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর হয়তো তিনি শারীরিকভাবে চলে গিয়েছেন কিন্তু আজো তিনি রয়ে গেছেন কোটি প্রাণের হৃদয়ের স্পন্দনে, গহীন গহ্বরে। আজো যখন বাঙালি নারীর অসীম সাহসিকতার পরিচয় দেয়া হয়, দেশপ্রেম, আদর্শ আর বিপ্লবের কথা লেখা হয় সবার আগে আসে প্রীতিলতার নাম। প্রীতিলতা এক রংধনুর নাম। যার সাতটি রঙ সাতটি আদর্শকে বহন করে। মাত্র ২১ বছরের প্রীতিলতার দেশপ্রেম, আদর্শ, স্বাধীনতার জন্য অসীম ত্যাগ বৃথা যায় নাই। আজকের প্রতিটি নারীর উচিত প্রীতিলতাকে কে অনুসরণ করে,তার নির্ভিকতাকে অনুসরণ করে অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো। মেয়েরা যখন অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে শিখবে ঠিক তখনি দেশ থেকে জেন্ডার বৈষম্য, নারী নির্যাতনের কালো হাত দুমড়ে মুচড়ে মাটিতে নিপাতিত হবে, দেশটা আবার সোনার বাংলায় পরিণত হবে।
প্রীতিলতার জীবন নিয়ে চলচ্চিত্র
বর্তমানে ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতাসংগ্রামে আত্মাহুতি দানকারী প্রথম নারী শহীদ বীরকন্যা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের জীবনী নিয়ে তৈরি হচ্ছে একটি চলচ্চিত্র ‘ভালোবাসা প্রীতিলতা’। কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেনের উপন্যাস ‘ভালোবাসা প্রীতিলতা’ অবলম্বনে এটি পরিচালনা করছেন প্রদীপ ঘোষ।
প্রীতিলতা সাংস্কৃতিক ভবন
এছাড়াও ২০১৭ সালের ২০ অক্টোবর বীরকন্যা প্রীতিলতা সাংস্কৃতিক ভবন উদ্বোধন করেন সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। ২০০৫ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের অধ্যাপক প্রণব মিত্র চৌধুরীর তৈরি করা প্রীতিলতার আবক্ষ ভাস্কর্য উন্মোচন করেন বিপ্লবী বিনোদ বিহারী চৌধুরী। তিনি ট্রাস্ট ভবনেরও ভিত্তি স্থাপন করেন। এ ছাড়া বীরকন্যা স্মৃতি কমপ্লেক্সের ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন ডা. দীপু মনি।