০৭:৫৭ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ৩ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
                       

অক্ষাংশ কাকে বলে? অক্ষরেখার বৈশিষ্ট্য, অক্ষাংশের কাজ ও অক্ষাংশ নির্ণয় পদ্ধতি কী?

ফারজানা হোসেন
  • প্রকাশ: ০১:২১:০৪ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৮ অক্টোবর ২০২১
  • / ৩২৫৬৪ বার পড়া হয়েছে

অক্ষাংশ কাকে বলে? অক্ষরেখার বৈশিষ্ট্য, অক্ষাংশের কাজ ও অক্ষাংশ নির্ণয় পদ্ধতি কী?


Google News
বিশ্লেষণ-এর সর্বশেষ নিবন্ধ পড়তে গুগল নিউজে যোগ দিন

বিশেষ শর্তসাপেক্ষে এবং স্বল্পমূল্যে এই ওয়েবসাইটটি সামাজিক কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ কিংবা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের নিকট বিক্রি করা হবে।

অক্ষাংশ এবং দ্রাঘিমার সাহায্যে পৃথিবীর কোনো স্থানের অবস্থান সুনির্দিষ্টভাবে নির্ণয় করা যায়। এই অক্ষাংশ ও দ্রাঘিমাংশ ব্যবহার করে কোনো স্থান যেমন সুনির্দিষ্ট ভাবে নির্ণয় করা সম্ভব, তেমনই আবহাওয়াগত বৈশিষ্ট্য সম্পর্কেও জানা সম্ভব হয়। এখানে অক্ষাংশ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো। অক্ষাংশ কী; অক্ষাংশের বৈশিষ্ট্য, কাজ; অক্ষাংশ নির্ণয় পদ্ধতি উল্লেখ করা হলো।

অক্ষাংশ কী (What is Latitude)?

অক্ষাংশ শব্দের ইংরেজি প্রতিশব্দ হলো latitude (ল্যাটিচুড)। সহজ কথায়, নিরক্ষরেখা হতে উত্তর বা দক্ষিণে কোনো স্থানের কৌণিক দূরত্বকে সে স্থানের অক্ষাংশ বলে। ভূপৃষ্ঠের কোনো স্থান থেকে পৃথিবীর কেন্দ্র পর্যন্ত যদি কোন সরলরেখা টানা হয় তাহলে এই রেখাটি নিরক্ষীয় তলের সাথে যে কোণ সৃষ্টি করবে তাপ হবে ঐ স্থানের অক্ষাংশ।

নিরক্ষরেখার অক্ষাংশকে ধরা হয় শূন্য ডিগ্রি (০°), এখান থেকে সুমেরু ও কুমেরু অক্ষাংশ যথাক্রমে ৯০° উত্তর ও ৯০° দক্ষিণ।

সমাক্ষরেখাগুলো নিরক্ষরেখার সমান্তরাল বলে একই সমাক্ষরেখায় অবস্থিত বিভিন্ন স্থানের অক্ষাংশ একই। অক্ষাংশকে ডিগ্রি, মিনিট ও সেকেন্ড একক দ্বারা প্রকাশ করা হয়। 

পৃথিবীর অভ্যন্তরভাগে ভূকেন্দ্রকে ছেদ করে উত্তর-দক্ষিণ বরাবর যে রেখা কল্পনা করা হয় তাকে মেরুরেখা বা অক্ষ বলে। মেরুরেখা বা অক্ষ ইংরেজি হলো axis।

অক্ষের উত্তর প্রান্তবিন্দুকে উত্তরমেরু বা সুমেরু (north pole) এবং দক্ষিণ প্রান্তবিন্দুকে দক্ষিণমেরু বা কুমেরু (south pole) বলে। মেরুদ্বয় হতে সমান দূরত্বে পৃথিবীকে পূর্ব-পশ্চিমে বেষ্টন করে একটি রেখা কল্পনা করা হয়েছে; এই রেখাকে বলা হয় নিরক্ষরেখা বা বিষুবরেখা (equator)। 

নিরক্ষরেখা উত্তর-দক্ষিণে পৃথিবীকে সমান দুটি ভাগে ভাগ করেছে। উত্তর ভাগের নাম উত্তর গোলার্ধ এবং দক্ষিণ ভাগের নাম দক্ষিণ গোলার্ধ।

পৃথিবীর কৌণিক মাপ ৩৬০° এবং কিলোমিটার হিসেবে এর দৈর্ঘ্য প্রায় ৪০,০০০ কিলোমিটার। সুতরাং ১° অক্ষাংশ পরিমিত স্থান প্রায় ১১১.১ কিলোমিটার হয়। সাধারণভাবে অক্ষরেখাগুলো পরস্পরের সমান্তরাল বলে অক্ষরেখাগুলোর প্রত্যেকটি একে অপরের থেকে প্রায় ১১১.১ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত। তবে পৃথিবীর উত্তর ও দক্ষিণ মেরু প্রদেশে কিছুটা চাপা বলে সেখানে ১° অক্ষাংশের রৈখিক ব্যবধান ১১১ কিলোমিটার ধরা হয়। প্রতি ডিগ্রি অক্ষাংশকে ৬০ মিনিট এবং প্রতি মিনিট অক্ষাংশকে ৬০ সেকেন্ডে ভাগ করা হয়। প্রতি মিনিট অক্ষাংশ গড়ে ১,৮৫৩ মিটারের সমান এবং প্রতি সেকেন্ডে অক্ষাংশ গড়ে প্রায় ৩১ মিটারের সমান।

অক্ষরেখার বৈশিষ্ট্য (Characteristics of Latitude)

  • অক্ষরেখাগুলো পরস্পরের সমান্তরাল হওয়ায় যে কোন দুটো অক্ষরেখার মধ্যবর্তী দূরত্ব সব সময় সমান হয়।
  • প্রতিটি অক্ষরেখা নিরক্ষরেখার সমান্তরালভাবে অবস্থিত, এজন্য একই অক্ষরেখায় অবস্থিত যে কোন স্থান হতে নিরক্ষরেখার দূরত্ব সব সময় সমান।
  • অক্ষরেখাগুলোর পরিধি নিরক্ষরেখা হতে মেরুবিন্দুদ্বয়ের দিকে ক্রমশ ছোট হতে হতে শেষে বিন্দুতে পরিণত হয়। এ কারণে অক্ষরেখাগুলোর পরিধি সর্বত্র সমান নয়।
  • নিরক্ষরেখা নিজেও একটি অক্ষরেখা, পৃথিবীর ঠিক মধ্যস্থান ঘিরে আছে বলে নিরক্ষরেখার পরিধি সর্ববৃহৎ। অনুরূপভাবে মেরু অঞ্চলে পরিধি সর্বনিম্ন।
  • অক্ষরেখাগুলো পূর্ব-পশ্চিমে পৃথিবীকে বেষ্টন করে আছে। তাই অক্ষরেখাগুলোর সবখানে একই সময়ে সূর্যোদয়, মধ্যাহ্ন ও সূর্যাস্ত হয় না।
  • একই অক্ষরেখায় অবস্থিত বিভিন্ন স্থানের দিন-রাত্রির দৈর্ঘ্য এবং জলবায়ু প্রায় একই রকম হয়।

অক্ষাংশের কাজ (Functions of Latitude)

  • অক্ষাংশ ও দ্রাঘিমার সাহায্যে ভূপৃষ্ঠের কোন স্থানের অবস্থান সঠিকভাবে জানা যায়। একই অক্ষাংশ ও দ্রাঘিমা বিশিষ্ট স্থান ভূপৃষ্ঠে কেবল একটিই হতে পারে।
  • অক্ষাংশ দ্বারা তাপমাত্রার পরিমাপ জানা যায়। নিরক্ষরেখা হতে ক্রমশ উত্তর ও দক্ষিণে তাপ হ্রাস পায়। একই অক্ষরেখায় অবস্থিত বিভিন্ন স্থানের তাপমাত্রা সাধারণত একই হয়।
  • অকূল সমুদ্রে বিপদাপন্ন জাহাজ বেতারের সাহয্যে তার অবস্থানের অক্ষাংশ ও দ্রাঘিমা জানিয়ে দিলে সহজেই তার সাহায্যের ব্যবস্থা করা যায়।

গুরুত্বপূর্ণ কিছু অক্ষরেখা

  • নিরক্ষরেখা বা বিষুবরেখা: ০° ধরা হয়;
  • কর্কটক্রান্তি রেখা: উত্তর গোলার্ধের ২৩.৫° উত্তর অক্ষরেখা;
  • মকরক্রান্তি রেখা: দক্ষিণ গোলার্ধের ২৩.৫° দক্ষিণ অক্ষরেখা;
  • সুমেরু বৃত্ত: উত্তর গোলার্ধের ৬৬.৫° উত্তর অক্ষরেখা;
  • কুমেরু বৃত্ত: দক্ষিণ গোলার্ধের ৬৬.৫° দক্ষিণ অক্ষরেখা।
নিরক্ষরেখা হতে উত্তর বা দক্ষিণে কোনো স্থানের কৌণিক দূরত্বকে সে স্থানের অক্ষাংশ বলে

অক্ষাংশ নির্ণয় পদ্ধতি

সাধারণত ৫ টি পদ্ধতিতে অক্ষাংশ নির্ণয় করা যায়। যথা-

  • ১. ধ্রুবতারার সাহায্যে
  • ২. হ্যাডলির অকট্যান্ট নক্ষত্রের সাহায্যে
  • ৩. সূর্যের উন্নতির সাহায্যে
  • ৪. সেক্সট্যান্ট যন্ত্রের সাহায্যে
  • ৫. খুঁটির সাহায্যে

১. ধ্রুবতারার সাহায্যে

উত্তর গোলার্ধের যে কোন স্থান হতে প্রতি রাতে উত্তর আকাশে একটি নির্দিষ্ট স্থানে ধ্রুবতারা দেখা যায়। 

তবে এ গোলার্ধের সব জায়গা হতে ধ্রুবতারা আকাশে দিগন্ত হতে সমান উচ্চতায় দেখা যায় না। স্থানভেদে এ উচ্চতার পার্থক্য হয়। বিষুবরেখা হতে ধ্রুবতারাটি ঠিক দিগন্তরেখায় অবস্থান করে। নিরক্ষরেখায় ধ্রুবতারার উন্নতি ০° ধরা হয়।

তবে নিরক্ষরেখা হতে সুমেরুর দিকে প্রতি ১° অগ্রসর হলে ধ্রুবতারার উন্নতিও ১° করে বেড়ে যায়। সুমেরুতে ধ্রুবতারাকে ঠিক মাথার ওপর দেখা যায়। তাই সুমেরুতে ধ্রুবতারার উন্নতি ৯০° ধরা হয়। অর্থাৎ নিরক্ষরেখা যতই উত্তরে যাওয়া যায় অক্ষাংশ ততই বৃদ্ধি পায়।

সুতরাং, উত্তর গোলার্ধের কোন স্থানের অক্ষাংশ ধ্রুবতারার উন্নতির সমান হয়। এ ক্ষেত্রে ধ্রুবতারার উন্নতি জানতে পারলে অতি সহজে অক্ষাংশ নিরূপণ করা যায়। তবে এ পদ্ধতি দিনের বেলা বা দক্ষিণ গোলার্ধের জন্য প্রযোজ্য নয়।

২. হ্যাডলির অকট্যান্ট নক্ষত্রের সাহয্যে

দক্ষিণ গোলার্ধ ধ্রুবতারা দেখা যায় না। তবে কুমেরুবিন্দু বরাবর দক্ষিণ গোলার্ধের আকাশে হ্যাডলির অকট্যান্ট নামে একটি নক্ষত্র দেখা যায়। দক্ষিণ গোলার্ধের কোন স্থানের অবস্থান নির্ণয় করার সময় এ নক্ষত্রের সাহায্য নেয়া হয়। তবে এ ক্ষেত্রেও একই পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়।

৩. সূর্যের উন্নতির সাহায্যে

উত্তর ও দক্ষিণ গোলার্ধে দিনের বেলায় সূর্যের উন্নতির সাহায্যে যে কোন স্থানের অক্ষাংশ নির্ণয় করা যায়। এ ক্ষেত্রে একটি সূত্র ব্যবহার করা হয়।

সূত্র: অক্ষাংশ = ৯০°- মধ্যাহ্নে সূর্যের উন্নতি ± বিষুবলম্ব।

সূর্যের বিষুবলম্ব বলতে সূর্য যে দিন যে অক্ষাংশের ওপর লম্বভাবে কিরণ দেয় তাকে বোঝায়। পৃথিবীর বার্ষিক গতি জন্য সূর্যের আপাত পরিক্রমণ পথ বিষুবরেখা হতে ২৩.৫° উত্তর অক্ষাংশ বা কর্কটক্রান্তি রেখা (tropic of cancer) ও ২৩.৫° দক্ষিণ অক্ষাংশ বা মকরক্রান্তি রেখা (tropic of capricorn)। এ কারণেই সূর্যের বিষুবলম্ব ২৩.৫° উত্তর অক্ষাংশ হতে ২৩.৫° দক্ষিণ অক্ষাংশ পর্যন্ত হয়। ২১ মার্চ হতে ২৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সূর্যের বিষুবলম্ব উত্তরে এবং ২৩ সেপ্টেম্বর হতে ২১ মার্চ পর্যন্ত সূর্যের বিষুবলম্ব দক্ষিণে হয়ে থাকে।

উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ২১ জুন তারিখে কর্কটক্রান্তির ওপর সূর্য লম্বভাবে কিরণ দেয়।

সুতরাং ২১ শে জুন তারিখে সূর্যের বিষুবলম্ব ২৩.৫° উত্তরে। এভাবে ২৩ সেপ্টেম্বর বিষুব লম্ব ০° এবং ২১ ডিসেম্বর তারিখের বিষুবলম্ব ২৩.৫° দক্ষিণ।

এক্ষেত্রে স্থানটি যদি উত্তর গোলার্ধে হয়, তবে উত্তরবাচক বিষুবলম্ব যোগ করতে হবে এবং দক্ষিণবাচক বিষুবলম্ব বিয়োগ করতে হবে। + চিহ্ন দ্বারা এটি বোঝান হয়েছে। এ সূত্র অনুসারে উত্তর গোলার্ধে কোনদিন মধ্যাহ্ন সূর্যের উন্নতি ৪০° থাকলে এবং সেদিনের বিষুবলম্ব ২০° উত্তর হলে সে স্থানের অক্ষাংশ ৯০°-৪০°+২০° = ৭০° উত্তর হবে। এভাবে দক্ষিণ গোলার্ধের কোন স্থানের অক্ষাংশও নিরূপণ করা হয়। তবে এ ক্ষেত্রে সূর্যের উন্নতির সাথে উত্তর বিষুবলম্ব বিয়োগ ও দক্ষিণ বিষুবলম্ব যোগ করতে 

হবে।

৪. সেক্সট্যান্ট যন্ত্রের সাহায্যে

সেক্সট্যান্ট যন্ত্রের সাহায্যে সূর্যের উন্নতি কোণ নির্ণয় করে অক্ষাংশ নির্ণয় করা যায়। যে যন্ত্রের সাহায্যে সূর্যের উন্নতি পরিমাপ করা হয়, তাকে সেক্সট্যান্ট যন্ত্র বলা হয়। সেক্সট্যান্ট যন্ত্রের সহায়তায় উত্তর গোলার্ধে মধ্যাহ্ন সূর্যের উন্নতির কোণ নির্ণয় করে অক্ষাংশ নির্ণয় করা যায়। এ ক্ষেত্রে একটি সূত্র ব্যবহার করা হয়।

সূত্র: অক্ষাংশ = ৯০°- মধ্যাহ্ন সূর্যের উন্নতি ± বিষুবলম্ব

এ যন্ত্রে একটি দূরবীক্ষণ লাগানো থাকে। যন্ত্রটিকে প্রথমে উত্তরমুখী করে ভূমিতলের সাথে আনুভূমিক করে এটিকে ধীর গতিতে ওপরমুখী তোলা হয়, যেন এ যন্ত্রের মধ্য দিয়ে ধ্রুবতারাকে দেখা যায়।

৫. খুঁটির সাহায্যে

উত্তর গোলার্ধের কোন সমতল স্থানের ওপর একটি খুঁটি পুঁতে সে স্থানের অক্ষাংশ নিরূপণ করা যায়।

যেমন: উত্তর গোলার্ধের একটি সমতল স্থানের ওপর খ ছ নামক একটি খুঁটি লম্বভাবে পোঁতা হলো। এবার তার বাম দিকে অল্প দূরত্বে আর একটি খুঁটি গ চ লম্বভাবে পোঁতা হলো। এ ক্ষেত্রে একটা মাপ থাকবে, যেন খুঁটিদ্বয়ের বাম পাশে দাঁড়িয়ে তাদের মাথা বরাবর একটি কল্পিত সরলরেখাকে উত্তর দিকে বাড়িয়ে দিলে তার শেষ প্রান্তে ধ্রুব নক্ষত্র দেখা যায়।

শেয়ার করুন

মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার তথ্য সংরক্ষিত রাখুন

বিশেষ শর্তসাপেক্ষে এই ওয়েবসাইটটি সামাজিক কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ কিংবা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের নিকট বিক্রি করা হবে।

অক্ষাংশ কাকে বলে? অক্ষরেখার বৈশিষ্ট্য, অক্ষাংশের কাজ ও অক্ষাংশ নির্ণয় পদ্ধতি কী?

প্রকাশ: ০১:২১:০৪ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৮ অক্টোবর ২০২১

অক্ষাংশ এবং দ্রাঘিমার সাহায্যে পৃথিবীর কোনো স্থানের অবস্থান সুনির্দিষ্টভাবে নির্ণয় করা যায়। এই অক্ষাংশ ও দ্রাঘিমাংশ ব্যবহার করে কোনো স্থান যেমন সুনির্দিষ্ট ভাবে নির্ণয় করা সম্ভব, তেমনই আবহাওয়াগত বৈশিষ্ট্য সম্পর্কেও জানা সম্ভব হয়। এখানে অক্ষাংশ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো। অক্ষাংশ কী; অক্ষাংশের বৈশিষ্ট্য, কাজ; অক্ষাংশ নির্ণয় পদ্ধতি উল্লেখ করা হলো।

অক্ষাংশ কী (What is Latitude)?

অক্ষাংশ শব্দের ইংরেজি প্রতিশব্দ হলো latitude (ল্যাটিচুড)। সহজ কথায়, নিরক্ষরেখা হতে উত্তর বা দক্ষিণে কোনো স্থানের কৌণিক দূরত্বকে সে স্থানের অক্ষাংশ বলে। ভূপৃষ্ঠের কোনো স্থান থেকে পৃথিবীর কেন্দ্র পর্যন্ত যদি কোন সরলরেখা টানা হয় তাহলে এই রেখাটি নিরক্ষীয় তলের সাথে যে কোণ সৃষ্টি করবে তাপ হবে ঐ স্থানের অক্ষাংশ।

নিরক্ষরেখার অক্ষাংশকে ধরা হয় শূন্য ডিগ্রি (০°), এখান থেকে সুমেরু ও কুমেরু অক্ষাংশ যথাক্রমে ৯০° উত্তর ও ৯০° দক্ষিণ।

সমাক্ষরেখাগুলো নিরক্ষরেখার সমান্তরাল বলে একই সমাক্ষরেখায় অবস্থিত বিভিন্ন স্থানের অক্ষাংশ একই। অক্ষাংশকে ডিগ্রি, মিনিট ও সেকেন্ড একক দ্বারা প্রকাশ করা হয়। 

পৃথিবীর অভ্যন্তরভাগে ভূকেন্দ্রকে ছেদ করে উত্তর-দক্ষিণ বরাবর যে রেখা কল্পনা করা হয় তাকে মেরুরেখা বা অক্ষ বলে। মেরুরেখা বা অক্ষ ইংরেজি হলো axis।

অক্ষের উত্তর প্রান্তবিন্দুকে উত্তরমেরু বা সুমেরু (north pole) এবং দক্ষিণ প্রান্তবিন্দুকে দক্ষিণমেরু বা কুমেরু (south pole) বলে। মেরুদ্বয় হতে সমান দূরত্বে পৃথিবীকে পূর্ব-পশ্চিমে বেষ্টন করে একটি রেখা কল্পনা করা হয়েছে; এই রেখাকে বলা হয় নিরক্ষরেখা বা বিষুবরেখা (equator)। 

নিরক্ষরেখা উত্তর-দক্ষিণে পৃথিবীকে সমান দুটি ভাগে ভাগ করেছে। উত্তর ভাগের নাম উত্তর গোলার্ধ এবং দক্ষিণ ভাগের নাম দক্ষিণ গোলার্ধ।

পৃথিবীর কৌণিক মাপ ৩৬০° এবং কিলোমিটার হিসেবে এর দৈর্ঘ্য প্রায় ৪০,০০০ কিলোমিটার। সুতরাং ১° অক্ষাংশ পরিমিত স্থান প্রায় ১১১.১ কিলোমিটার হয়। সাধারণভাবে অক্ষরেখাগুলো পরস্পরের সমান্তরাল বলে অক্ষরেখাগুলোর প্রত্যেকটি একে অপরের থেকে প্রায় ১১১.১ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত। তবে পৃথিবীর উত্তর ও দক্ষিণ মেরু প্রদেশে কিছুটা চাপা বলে সেখানে ১° অক্ষাংশের রৈখিক ব্যবধান ১১১ কিলোমিটার ধরা হয়। প্রতি ডিগ্রি অক্ষাংশকে ৬০ মিনিট এবং প্রতি মিনিট অক্ষাংশকে ৬০ সেকেন্ডে ভাগ করা হয়। প্রতি মিনিট অক্ষাংশ গড়ে ১,৮৫৩ মিটারের সমান এবং প্রতি সেকেন্ডে অক্ষাংশ গড়ে প্রায় ৩১ মিটারের সমান।

অক্ষরেখার বৈশিষ্ট্য (Characteristics of Latitude)

  • অক্ষরেখাগুলো পরস্পরের সমান্তরাল হওয়ায় যে কোন দুটো অক্ষরেখার মধ্যবর্তী দূরত্ব সব সময় সমান হয়।
  • প্রতিটি অক্ষরেখা নিরক্ষরেখার সমান্তরালভাবে অবস্থিত, এজন্য একই অক্ষরেখায় অবস্থিত যে কোন স্থান হতে নিরক্ষরেখার দূরত্ব সব সময় সমান।
  • অক্ষরেখাগুলোর পরিধি নিরক্ষরেখা হতে মেরুবিন্দুদ্বয়ের দিকে ক্রমশ ছোট হতে হতে শেষে বিন্দুতে পরিণত হয়। এ কারণে অক্ষরেখাগুলোর পরিধি সর্বত্র সমান নয়।
  • নিরক্ষরেখা নিজেও একটি অক্ষরেখা, পৃথিবীর ঠিক মধ্যস্থান ঘিরে আছে বলে নিরক্ষরেখার পরিধি সর্ববৃহৎ। অনুরূপভাবে মেরু অঞ্চলে পরিধি সর্বনিম্ন।
  • অক্ষরেখাগুলো পূর্ব-পশ্চিমে পৃথিবীকে বেষ্টন করে আছে। তাই অক্ষরেখাগুলোর সবখানে একই সময়ে সূর্যোদয়, মধ্যাহ্ন ও সূর্যাস্ত হয় না।
  • একই অক্ষরেখায় অবস্থিত বিভিন্ন স্থানের দিন-রাত্রির দৈর্ঘ্য এবং জলবায়ু প্রায় একই রকম হয়।

অক্ষাংশের কাজ (Functions of Latitude)

  • অক্ষাংশ ও দ্রাঘিমার সাহায্যে ভূপৃষ্ঠের কোন স্থানের অবস্থান সঠিকভাবে জানা যায়। একই অক্ষাংশ ও দ্রাঘিমা বিশিষ্ট স্থান ভূপৃষ্ঠে কেবল একটিই হতে পারে।
  • অক্ষাংশ দ্বারা তাপমাত্রার পরিমাপ জানা যায়। নিরক্ষরেখা হতে ক্রমশ উত্তর ও দক্ষিণে তাপ হ্রাস পায়। একই অক্ষরেখায় অবস্থিত বিভিন্ন স্থানের তাপমাত্রা সাধারণত একই হয়।
  • অকূল সমুদ্রে বিপদাপন্ন জাহাজ বেতারের সাহয্যে তার অবস্থানের অক্ষাংশ ও দ্রাঘিমা জানিয়ে দিলে সহজেই তার সাহায্যের ব্যবস্থা করা যায়।

গুরুত্বপূর্ণ কিছু অক্ষরেখা

  • নিরক্ষরেখা বা বিষুবরেখা: ০° ধরা হয়;
  • কর্কটক্রান্তি রেখা: উত্তর গোলার্ধের ২৩.৫° উত্তর অক্ষরেখা;
  • মকরক্রান্তি রেখা: দক্ষিণ গোলার্ধের ২৩.৫° দক্ষিণ অক্ষরেখা;
  • সুমেরু বৃত্ত: উত্তর গোলার্ধের ৬৬.৫° উত্তর অক্ষরেখা;
  • কুমেরু বৃত্ত: দক্ষিণ গোলার্ধের ৬৬.৫° দক্ষিণ অক্ষরেখা।
নিরক্ষরেখা হতে উত্তর বা দক্ষিণে কোনো স্থানের কৌণিক দূরত্বকে সে স্থানের অক্ষাংশ বলে

অক্ষাংশ নির্ণয় পদ্ধতি

সাধারণত ৫ টি পদ্ধতিতে অক্ষাংশ নির্ণয় করা যায়। যথা-

  • ১. ধ্রুবতারার সাহায্যে
  • ২. হ্যাডলির অকট্যান্ট নক্ষত্রের সাহায্যে
  • ৩. সূর্যের উন্নতির সাহায্যে
  • ৪. সেক্সট্যান্ট যন্ত্রের সাহায্যে
  • ৫. খুঁটির সাহায্যে

১. ধ্রুবতারার সাহায্যে

উত্তর গোলার্ধের যে কোন স্থান হতে প্রতি রাতে উত্তর আকাশে একটি নির্দিষ্ট স্থানে ধ্রুবতারা দেখা যায়। 

তবে এ গোলার্ধের সব জায়গা হতে ধ্রুবতারা আকাশে দিগন্ত হতে সমান উচ্চতায় দেখা যায় না। স্থানভেদে এ উচ্চতার পার্থক্য হয়। বিষুবরেখা হতে ধ্রুবতারাটি ঠিক দিগন্তরেখায় অবস্থান করে। নিরক্ষরেখায় ধ্রুবতারার উন্নতি ০° ধরা হয়।

তবে নিরক্ষরেখা হতে সুমেরুর দিকে প্রতি ১° অগ্রসর হলে ধ্রুবতারার উন্নতিও ১° করে বেড়ে যায়। সুমেরুতে ধ্রুবতারাকে ঠিক মাথার ওপর দেখা যায়। তাই সুমেরুতে ধ্রুবতারার উন্নতি ৯০° ধরা হয়। অর্থাৎ নিরক্ষরেখা যতই উত্তরে যাওয়া যায় অক্ষাংশ ততই বৃদ্ধি পায়।

সুতরাং, উত্তর গোলার্ধের কোন স্থানের অক্ষাংশ ধ্রুবতারার উন্নতির সমান হয়। এ ক্ষেত্রে ধ্রুবতারার উন্নতি জানতে পারলে অতি সহজে অক্ষাংশ নিরূপণ করা যায়। তবে এ পদ্ধতি দিনের বেলা বা দক্ষিণ গোলার্ধের জন্য প্রযোজ্য নয়।

২. হ্যাডলির অকট্যান্ট নক্ষত্রের সাহয্যে

দক্ষিণ গোলার্ধ ধ্রুবতারা দেখা যায় না। তবে কুমেরুবিন্দু বরাবর দক্ষিণ গোলার্ধের আকাশে হ্যাডলির অকট্যান্ট নামে একটি নক্ষত্র দেখা যায়। দক্ষিণ গোলার্ধের কোন স্থানের অবস্থান নির্ণয় করার সময় এ নক্ষত্রের সাহায্য নেয়া হয়। তবে এ ক্ষেত্রেও একই পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়।

৩. সূর্যের উন্নতির সাহায্যে

উত্তর ও দক্ষিণ গোলার্ধে দিনের বেলায় সূর্যের উন্নতির সাহায্যে যে কোন স্থানের অক্ষাংশ নির্ণয় করা যায়। এ ক্ষেত্রে একটি সূত্র ব্যবহার করা হয়।

সূত্র: অক্ষাংশ = ৯০°- মধ্যাহ্নে সূর্যের উন্নতি ± বিষুবলম্ব।

সূর্যের বিষুবলম্ব বলতে সূর্য যে দিন যে অক্ষাংশের ওপর লম্বভাবে কিরণ দেয় তাকে বোঝায়। পৃথিবীর বার্ষিক গতি জন্য সূর্যের আপাত পরিক্রমণ পথ বিষুবরেখা হতে ২৩.৫° উত্তর অক্ষাংশ বা কর্কটক্রান্তি রেখা (tropic of cancer) ও ২৩.৫° দক্ষিণ অক্ষাংশ বা মকরক্রান্তি রেখা (tropic of capricorn)। এ কারণেই সূর্যের বিষুবলম্ব ২৩.৫° উত্তর অক্ষাংশ হতে ২৩.৫° দক্ষিণ অক্ষাংশ পর্যন্ত হয়। ২১ মার্চ হতে ২৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সূর্যের বিষুবলম্ব উত্তরে এবং ২৩ সেপ্টেম্বর হতে ২১ মার্চ পর্যন্ত সূর্যের বিষুবলম্ব দক্ষিণে হয়ে থাকে।

উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ২১ জুন তারিখে কর্কটক্রান্তির ওপর সূর্য লম্বভাবে কিরণ দেয়।

সুতরাং ২১ শে জুন তারিখে সূর্যের বিষুবলম্ব ২৩.৫° উত্তরে। এভাবে ২৩ সেপ্টেম্বর বিষুব লম্ব ০° এবং ২১ ডিসেম্বর তারিখের বিষুবলম্ব ২৩.৫° দক্ষিণ।

এক্ষেত্রে স্থানটি যদি উত্তর গোলার্ধে হয়, তবে উত্তরবাচক বিষুবলম্ব যোগ করতে হবে এবং দক্ষিণবাচক বিষুবলম্ব বিয়োগ করতে হবে। + চিহ্ন দ্বারা এটি বোঝান হয়েছে। এ সূত্র অনুসারে উত্তর গোলার্ধে কোনদিন মধ্যাহ্ন সূর্যের উন্নতি ৪০° থাকলে এবং সেদিনের বিষুবলম্ব ২০° উত্তর হলে সে স্থানের অক্ষাংশ ৯০°-৪০°+২০° = ৭০° উত্তর হবে। এভাবে দক্ষিণ গোলার্ধের কোন স্থানের অক্ষাংশও নিরূপণ করা হয়। তবে এ ক্ষেত্রে সূর্যের উন্নতির সাথে উত্তর বিষুবলম্ব বিয়োগ ও দক্ষিণ বিষুবলম্ব যোগ করতে 

হবে।

৪. সেক্সট্যান্ট যন্ত্রের সাহায্যে

সেক্সট্যান্ট যন্ত্রের সাহায্যে সূর্যের উন্নতি কোণ নির্ণয় করে অক্ষাংশ নির্ণয় করা যায়। যে যন্ত্রের সাহায্যে সূর্যের উন্নতি পরিমাপ করা হয়, তাকে সেক্সট্যান্ট যন্ত্র বলা হয়। সেক্সট্যান্ট যন্ত্রের সহায়তায় উত্তর গোলার্ধে মধ্যাহ্ন সূর্যের উন্নতির কোণ নির্ণয় করে অক্ষাংশ নির্ণয় করা যায়। এ ক্ষেত্রে একটি সূত্র ব্যবহার করা হয়।

সূত্র: অক্ষাংশ = ৯০°- মধ্যাহ্ন সূর্যের উন্নতি ± বিষুবলম্ব

এ যন্ত্রে একটি দূরবীক্ষণ লাগানো থাকে। যন্ত্রটিকে প্রথমে উত্তরমুখী করে ভূমিতলের সাথে আনুভূমিক করে এটিকে ধীর গতিতে ওপরমুখী তোলা হয়, যেন এ যন্ত্রের মধ্য দিয়ে ধ্রুবতারাকে দেখা যায়।

৫. খুঁটির সাহায্যে

উত্তর গোলার্ধের কোন সমতল স্থানের ওপর একটি খুঁটি পুঁতে সে স্থানের অক্ষাংশ নিরূপণ করা যায়।

যেমন: উত্তর গোলার্ধের একটি সমতল স্থানের ওপর খ ছ নামক একটি খুঁটি লম্বভাবে পোঁতা হলো। এবার তার বাম দিকে অল্প দূরত্বে আর একটি খুঁটি গ চ লম্বভাবে পোঁতা হলো। এ ক্ষেত্রে একটা মাপ থাকবে, যেন খুঁটিদ্বয়ের বাম পাশে দাঁড়িয়ে তাদের মাথা বরাবর একটি কল্পিত সরলরেখাকে উত্তর দিকে বাড়িয়ে দিলে তার শেষ প্রান্তে ধ্রুব নক্ষত্র দেখা যায়।