০১:৫৩ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৯ ডিসেম্বর ২০২৪, ৪ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
                       

আবেগ: বাল্যকালে আবেগিক বিকাশ

বিশ্লেষণ সংকলন টিম
  • প্রকাশ: ০৩:২৮:১৪ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১৭ ডিসেম্বর ২০২১
  • / ২৬৯০ বার পড়া হয়েছে

শিশু যত বাইরের পরিবেশের সঙ্গে পরিচিত হয়। ততই তারা পিতামাতার শাসন ও নিয়ম বুঝতে পারে, সামাজিক নিয়মনীতি, ব্যবহার সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হয়।


Google News
বিশ্লেষণ-এর সর্বশেষ নিবন্ধ পড়তে গুগল নিউজে যোগ দিন

বিশেষ শর্তসাপেক্ষে এবং স্বল্পমূল্যে এই ওয়েবসাইটটি সামাজিক কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ কিংবা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের নিকট বিক্রি করা হবে।

সাধারণত কোনো মানুষের ৬ বছর থেকে ১০ বছর পর্যন্ত সময়কে বাল্যকাল বলে। জীবনের এই স্তরে আবেগিক বিকাশ বিশেষভাবে দেখা যায়। এই বয়সে ছেলেমেয়েরা স্কুলে যেতে শুরু করে। নতুন পরিবেশে তারা নিরাপত্তার অভাব বোধ করে। ফলে এই স্তরে প্রথম দিকে আবেগ নিয়ন্ত্রিত থাকে। কিন্তু কিছু সময় অতিবাহিত হওয়ার পর তাদের স্বাভাবিক আবেগিক প্রকাশ দেখা যায়। ভয় আশংকা ইত্যাদি আবেগ বিভিন্ন কারণে সৃষ্টি হয়। রাগের প্রকাশে পরিবর্তন আসে। 

আবেগিক দিক থেকে বাল্যকালের শেষ দিকটাকে অনেকে ভাবনাচিন্তা মুক্ত কাল হিসাবে বিবেচনা করেন। মনোবিজ্ঞানীদের ধারণা এই বয়সের ছেলেমেয়েদের আনন্দ ধরনের আবেগের প্রকাশ বেশি দেখা যায়। তবে মোটিমুটি ভাবে এ বয়সের ছেলেমেয়েরা চিন্তা ভাবনা মুক্ত হয় এবং তাদের মধ্যে আনন্দ উচ্ছাস, হাসি, খুশিভাব বেশি পরিমানে দেখা যায়। আশংকা, রাগ, ভয় ইত্যাদি আবেগও থাকে। 

শিশু সুলভ ভয়ের পরিবর্তে তাদের মধ্যে বাস্তব ঘটনার প্রেক্ষিতে ভয়ের ভাব দেখা যায়। এ বয়সে বাবা মার স্নেহ থেকে বঞ্চিত হওয়ার আশংকায় ছো ভাই বোনদের প্রতি ঈর্ষা সৃষ্টি হয়। বাবা মার প্রতি তাদের আবেগিক আচরণে বিশেষ পরিবর্তন হয়। বাবা মার শাসনের ফলে ভূল বোঝাবুঝি হয় এবং শিশুমনে বিরূপ আবেগ সৃষ্টি হতে দেখা যায়। বাল্যকালের ভয়,রাগ,হিংসা, আগ্রহ,অনুরাগ, আনন্দ- উচ্ছাস ইত্যাদি কয়েকটি প্রধান আবেগ নিয়ে আমরা এখন আলোচনা করব।

ভয় 

শৈশবেই ভয়ের বিকাশ হয। বাল্যকালেও ভয় বিভিন্ন ভাবে ছেলেমেয়েদের মধ্যে দেখা যায়। তিন বছর বয়সে এবং বাল্যের শেষের দিকে শিশুর ভয় তীব্র আকার ধারণ করে। ছেলেমেয়ের মধ্যেও ভয়ের পার্থক্য দেখা যায়। যেমন এই স্তরে মেয়েরা সাপ, বেজী,ব্যাঙ এসমস্ত ভয় পায়। আর ছেলেদের কাছে এই ভয় একান্তই ছেলেমি।

ভয় অনেকটা শিক্ষণ জনিত এবং সাপেক্ষীকরণের সাহায্যেও হয়ে থাকে। ভয় শিখনজাত বলে পরিবারের আর্থ-সামাজিক অবস্থানের উপর ভয়ের ধরন নির্ভর করে। নিম্নবিত্ত পরিবেশে পিতামাতার প্রহার, বকুনী এবং সামাজিক পরিবেশের সন্ত্রাসকে এবং উচ্চবিত্ত পরিবেশে গাড়ী দূর্ঘটনা, ঝড়, স্কুলে দুর্ঘটনা ইত্যাদিকে বেশি ভয় করে। নিম্নবিত্ত শিশুদের মনে শিক্ষক ও পড়াশুনা ভয় জাগায়। উচ্চবিত্ত শিশুরা পড়া শুনায় ভালো ফলাফল করা, স্কুল শেষ করা, কলেজে যাওয়া ইত্যাদি নিয়ে ভয়ে দুর্ভাবনায় থাকে।

বাল্যকালে শিশু জীবজন্তু, অচেনা পরিবেশ, বিভিন্ন ব্যক্তি যেমন ডাক্তার, পাগল ইত্যাদিকে ভয় করে। তবে প্রথম দিকের এই সব বস্তুতান্ত্রিক ভয় বয়স বাড়ার সাথে সাথে কমতে থাকে।

এবং অবাস্তব ও কাল্পনিক বিষয়ের ভয়, এমনকি বিদ্যুৎ চমকালেও তারা ভয় পায়। কল্পিত বিপদের আশংকা থেকে এই ভয় জাগে। স্নেহ মায়া মমতায় ভরা উষ্ণ পরিবারে না থাকলে স্নেহের অভাব বোধ থেকেও ভয় দেখা দেয়। বিভিন্ন ধরনের আশংকাও ছেলেমেয়ের মধ্যে দেখা যায়। ভয়ের প্রকাশের মধ্যে অনেক পরিবর্তন ঘটে। ছেলেমেয়েরা অনেকে ভয়কে চেপে রাখতেও চেষ্টা করে। কারণ অনেক সময় তা সামাজিক ভাবে অগ্রহণযোগ্য এবং বন্ধুদের কাছে হাসির ব্যপার হয়ে দাঁড়ায়।

উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা

শিশুদের লজ্জা, উদ্বেগ (worry) উৎকন্ঠা (anxiety) এগুলোও একধরনের ভয়েরই বহিঃপ্রকাশ। বাল্যকালেই এ সব ভয়ের সূত্রপাত হয়। কাল্পনিক ভয় থেকে উদ্বেগের সৃষ্টি। মানসিক বিকাশের সাথে সাথে শিশু মনে উদ্বেগের সৃষ্টি হয়। বই, সিনেমা, কমিক, রেডিও টেলিভিশন ইত্যাদি ও অনেক কাল্পনিক পরিস্থিতি থেকে শিশু মনে উদ্বেগের সৃষ্টি হয়। পরীক্ষার 

ফলাফল উদ্বেগের একটি সাধারণ কারণ। স্কুলের কোনো সমস্যা নিয়ে অথবা পরিবারের কোনো পরিস্থিতি নিয়েও শিশুমনে উদ্বেগ সৃষ্টি হয়। উদ্বেগের বিভিন্ন বহিঃপ্রকাশ দেখা যায়। 

পালায়নপরতা, ঘটনাকে এড়িয়ে চলা, মুখমন্ডল বিবর্ন হওয়া, ক্ষুধা নষ্ট হয়ে যাওয়া ইত্যাদি দেখা যায়। 

উদ্বেগ যখন অনেক বেশি এবং তীব্র হতে থাকে তখন সেটা উৎকন্ঠায় রূপ নেয়। মানসিক ভয় বা মনের বেদনাদায়ক দুশ্চিন্তা থেকেও উৎকন্ঠার সৃষ্টি হয়। সমবয়সীরা যে সব শিশুদের গ্রহন করে না, এ রকম প্রত্যাখ্যাত শিশুদের মধ্যে উৎকন্ঠা বেশি দেখা যায়। 

শিশু যত বাইরের পরিবেশের সঙ্গে পরিচিত হয়। ততই তারা পিতামাতার শাসন ও নিয়ম বুঝতে পারে, সামাজিক নিয়মনীতি, ব্যবহার সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হয়।

ছেলেদের চেয়ে মেয়েরা উৎকন্ঠায় বেশি ভোগে। দিবাস্বপ্ন, দুঃস্বপ্ন, অসুস্থতা, অতি-আক্রমনাত্বক ব্যবহার বিদ্রোহী ব্যবহার ইত্যাদির মাধ্যমে উৎকন্ঠার বহিঃপ্রকাশ ঘটে। 

লাজুকতা-সামাজিক ভয় থেকে সৃষ্টি হয়। এ সময় শিশুরা চুপ করে থাকে। হাতে কিছু নিয়ে নাড়াচাড়া করে বা দাঁত নিয়ে নখ কাটে।

রাগের বিকাশ 

রাগ বাল্যকালের অতি পরিচিত আবেগিক আচরণ। বয়স বাড়ার সাথে সাথে রাগের প্রকাশ বাড়তে থাকে। ব হওয়ার সঙ্গে চাহিদার বৃদ্ধি ঘটে। আর চাহিদা প রন না হলেই রাগের সৃষ্টি হয়। বাল্যে সাধারণত যে সব কারণে শিশুর রাগ হয় তার মধ্যে প্রধান হচ্ছে চাহিদার নিবৃত্তি না হওয়া, কাজে বাধাদান করা, অনবরত দোষ খোজাঁ বা সমালোচনা করা, উপদেশ দেওয়া, অন্য শিশুর সাথে তুলনা করা, অপছন্দনীয় কোনো দোষ আরোপ করা ইত্যাদি। আবার শিশু নিজে কোনো ভুল করলে, কোনো কাজে নিজের অপারগতার জন্য, অন্যায়ভাবে সে অথবা তার বন্ধুরা বকুনী খেলে, শান্তি পেলে, অন্য শিশুরা তাকে অবহেলা করলে, উপহাস করলে শিশুরা রাগ দেখায়। বয়স বাড়ার সাথে সাথে রাগের প্রকাশে পরিবর্তন আসে। রাগের তীব্র প্রকাশ বা temper tantrums (মেজাজ মর্জি) ছোটদের মধ্যে বেশি দেখা যায়। অনেক শিশু আক্রমনাত্বক হয়ে উঠে-হাত পা ছুঁড়ে চিৎকার করে আঘাত করে। জিনিসপত্র ভেঙ্গে ফেলে, গালাগালি দেয়। সাধারণত ২ থেকে ৪ বছরের শিশুদের মধ্যে temper tantrums দেখা দেয়।

বাল্যের শেষ দিকে শিশুরা রাগ হলে আগের মত আক্রমনাত্বক আচরণ করে না। নিজেরের রাগকে নিয়ন্ত্রণ করে অন্যভাবে রাগকে প্রকাশ করে। বড়োদের সমর্থন বা অসমর্থন তাদের আবেগিক ব্যবহার অনেকাংশে নিয়ন্ত্রন করে। বয়স বাড়ার সাথে তারা কথা না বলা, অভিমান করা, ঝগড়া ও হৈ, চৈ করা ইত্যাদি আচরণের দ্বারা রাগ প্রকাশ করে আবার কেউ কেউ সব বয়সেই আক্রমনান্তক আচরণ, ভাঙ্গাচোরা ,অপরকে আঘাত করা ইত্যাদি উপায়ে রাগ প্রকাশ করে। খাওয়া দাওয়া, কাজকর্ম ছেড়ে দিয়ে চুপচাপ ঘরে বসে থেকে রাগ প্রকাশ করে অনেকে। 

শিশু যত বাইরের পরিবেশের সঙ্গে পরিচিত হয়। ততই তারা পিতামাতার শাসন ও নিয়ম বুঝতে পারে, সামাজিক নিয়মনীতি, ব্যবহার সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হয়। শিক্ষার প্রভাবে তার আবেগিক আচরণ মার্জিত, সংযত ও সমাজ সম্মত হয়। মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য রাগের বহিঃপ্রকাশ হওয়া ভালো। শিশুর রাগকালীন প্রতিবাদের ভেতর দিয়ে তার আবেগ মুক্ত হয়। 

বিভিন্ন গঠনমূলক কাজের ভেতর দিয়ে রাগের অভিব্যক্তি সুন্দর ব্যক্তিত্ব গঠনে সাহায্য করে। জোর করে রাগ দমন করা বাঞ্জনীয় নয়। শিশু যদি রাগের প্রকাশকে চেপে যায়, আবেগকে অবদমিত করে সেটা মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।

হিংসা 

স্নেহ ভালোবাসা হারাবার অনিশ্চয়তায় শিশুর মনের হিংসার সৃষ্টি হয়। আপন ভাই বোনের প্রতি হিংসা বোধ শৈশবের বৈশিষ্ট্য। এটাকে বলা হয় অগ্রানুজ হিংসা (Sibling Rivalry)। বাল্য কালে শিশুর মধ্যে এই হিংসার প্রকাশ দেখা যায়। হিংসার পরিস্থিতি সব সময়ই সামাজিক। শিশু যাদেরকে ভালোবাসে তাদের সঙ্গে সম্পৃক্ত এই আবেগ। মা বাবা বা অন্যরা যারা শিশুর সেবা যত্ন করেন, ভালোবাসেন তাদের সম্পর্কে শিশুর মনে যখন স্নেহ ভালোবাসা হারাবার আশাংকা জাগে তখনই তার মধ্যে হিংসাবোধ জাগে। হিংসাবোধ জাগে সাধারণত তখন যখন অন্য একটি শিশু মাবাবার স্নেহ-ভালোবাসা ও মনোযোগ আকর্ষণ করে। তাকে বাদ দিয়ে অন্যের প্রতি বেশি আগ্রহ, বেশি মনোযোগ যখনই দেখে তখনই সেই ভাইবোনের প্রতি তার রাগ ও হিংসা তীব্র হয়ে উঠে। নিজেকে সে অবহেলিত মনে করে এবং মা ও নতুন শিশু উভয়ের বিরুদ্ধেই তার মনে ক্ষোভ জাগে।

বাড়িতে যে সব ছেলে মেয়েরা এই ধরনের হিংসা দেখায় স্কুলে গিয়েও বন্ধুদের ব্যাপারে একই হিংসা দেখায় তারা। যে সব ছেলেমেয়েরা শিক্ষকের কাছ থেকে প্রশংসা পায় বা বিভিন্ন কাজে খুব ভালো করে তাদের ব্যাপারে ঐ শিশুরা বেশি হিংসা পোষণ করে। পরিবারে কোনো সন্তানের প্রতি পক্ষপাতিত্ব করলে অন্য সন্তানেরা হিংসান্বিত হয়। স্কুলে শিক্ষকের পক্ষপাতিত্ব অন্য শিশুদের মধ্যে হিংসার উদ্রেক করে। 

হিংসামূলক আচরণ মৃদুবিরক্তি এবং উৎকন্ঠা থেকে আঘাত করার প্রবণতা পর্যন্ত হতে পারে। বাল্যকালের হিংসাত্বক আচরণ শৈশবের চেয়ে অনেক ভিন্ন। হিংসাত্বক আচরণ বিভিন্ন ধরনের ও পরোক্ষ প্রকৃতির। আক্রমনাত্বক আচরণ বাড়ীতে না হয়ে সাধারনত স্কুলে ও খেলার মাঠে হয়ে থাকে। বাল্যকালের প্রথম দিকের হিংসাত্বক আচরণের চেয়ে বাল্যকালের শেষ দিকের 

হিংসাত্বক আচরণ অনেক মার্জিত হয়ে আসে। কথা না বলা, টিটকারী দেওয়া, কৌতুক করা, কথা শোনানো, ঝগড়া এবং কখনও মারামারি করা ইত্যাদি ধরনের হিংসাত্বক আচরণ দেখা যায়। হিংসার আবেগিক বিকাশ ছেলে ও মেয়ে উভয়ের মধ্যে সমান ভাবে দেখা যায়।

আগ্রহ 

বাল্যে শিশুর পরিবেশ বিস্তৃত হওয়ার ফলে তার আগ্রহও বাড়তে থাকে বাড়ীতে ও আশেপাশে ছোবেলার তাকে যা ধরতে বা দেখতে দেওয়া হয়নি এখন সেগুলো সম্পর্কে তার সীমাহীন আগ্রহ দেখা যায়। ছুরি, কাঁচি, যন্ত্রপাতি সম্বন্ধে তার আগ্রহ অনেক। কিভাবে দিয়াশলাইর কাঠি, গ্যাসবার্ণার জ্বলে, স্টোর রুমে কী কী জিনিস সঞ্চিত আছে সব কিছু দেখা, সব কিছু নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা করার আগ্রহ বাল্যকালের বৈশিষ্ট্য। হারলক বলেন মায়ের চুলের নতুন বিন্যাস, বাড়ীতে নিয়ে আসা নতুন জিনিস সবই সমান ভাবে তার আগ্রহ আকর্ষণ করে। তার দৈহিক পরিবর্তন সম্পর্কেও তার অফুরন্ত আগ্রহ। স্থায়ী দাঁত যখন উঠতে থাকে ঘন্টার পর ঘন্টা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে শিশু তার বাড়ন দেখতে চায়। বাল্যের শেষাংশে যৌনাগমের পরিবর্তন তাকে কৌতুহলী ও আগ্রাহান্বিত করে তোলে। 

অনুরাগ 

বাল্যকালে প্রকাশ্যে একে অন্যের প্রতি অনুরাগ প্রকাশ করতে ছেলেমেয়েরা পছন্দ করে না। শৈশবে বড়োদের আদর ও চুমু শিশুদের খুব আকাংক্ষার বস্তু । কিন্তু বাল্যকালে প্রকাশ্য আদরে তাদের খুব অনীহা। অনুরাগের প্রকাশ ভিন্ন ভাবে হয়। কাছে কাছে থাকা, সাহায্য করা, কাজ করে দেওয়া ইত্যাদি উপায়ে তাদের অনুরাগ প্রকাশ পায়। 

আনন্দ উচ্ছাস 

আনন্দ-উচ্ছাস শিশুদের জীবনের এক স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য। এই বয়সে শিশু অন্যান্য ছেলেমেয়ের সঙ্গ পাওয়াতে বেশি আনন্দ পায়। অন্যান্যদের সঙ্গে খেলা ধূলা করা তার কাছে খুব আনন্দের ব্যাপার। এই সময় থেকে শিশু কমিক, কার্টুন বা হাসির ছবি দেখে আনন্দ পায়। 

অন্যকে বিরক্ত করে বা অপ্রতিভ করে বা অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে ফেলে সে আনন্দ পায়।আরও একটু বড়ো হয়ে সে অদ্ভুত কিছু দেখলে বা শুনলে হাসে এবং নিজেও রসিকতা করে। নিজের সাফল্যে সে আনন্দ পায়। যে সব কাজ নিষিদ্ধ সেই সব কাজ করতে বা সে গুলো নিয়ে আলোচনা করতে সে আনন্দ পায়।

বাল্যকালে শিশুর উচ্চ বা মৃদু হাসি হল আনন্দের সাধারণ প্রকাশ। আনন্দের সময় সমস্তশরীরের মধ্যে একটা শিথিল ভাব অনুভূত হয়। 

বাল্যকালে সব আবেগের প্রকাশই শৈশবের তুলনায় অনেক সংযত ও নিয়ন্ত্রিত লক্ষ্য করি। মেজাজ দেখানো রাগ করা, উদাসীনতা ইত্যাদি আবেগিক আচরণ যে বন্ধুদের ও বড়োদের অপছন্দের সেটা এই বয়সের শিশু বুঝতে শিখে। ভয় পেয়ে পালানো হল কাপুরুষতা, ঈর্ষার বশে কারো মনে আঘাত দেওয়া মোটেই খেলোয়াড় সুলভ মনের পরিচায়ক নয়। চিৎকার, হৈ চৈ করে রাগ প্রকাশ নেহায়েতই ছেলেমানুষী (Childish) এগুলো বুঝার ফলে আবেগিক আচরণ অনেক মার্জিত ও সংযত হয়ে যায়। বালক বালিকারা বাল্যের শেষে নিজেদের আবেগ 

অন্যের সামনে যাতে প্রকাশ না পায়,সে ব্যাপারেও সচেষ্ট হয়। 

যৌন আবেগের বিকাশ 

যৌন চেতনা এ স্তরে সুপ্ত থাকে। কোনো বহিঃপ্রকাশ থাকে না। ফ্রয়েড একে সুপ্ত কাম অবস্থা বা ল্যাটেন্সি পিরিয়ড (Latency Period) বলেছেন। এ বয়সে ছেলেমেয়েদের মধ্যে কোনো মানসিক বা আবেগিক অপসঙ্গতি থাকে না। এ জন্য আর্নেষ্ট জোনস বয়ঃপ্রাপ্তিকে বাল্যকালের পুনরাবৃত্তি বলে বর্ণনা করেছেন। বাল্যকালে যৌনতার কোনো বহিঃপ্রকাশ না থাকলেও যৌনতার বিকাশ চলতে থাকে। অন্তর্নিহিত অবস্থায় পূর্ণতার দিকে এগিয়ে চলে। যৌনতা অপ্রকাশিত থাকে বলে এই স্তরে আবেগিক চাঞ্চল্য দেখা যায় না ও সঙ্গতি বিধানে কোনো সমস্যা হয় না।

সারাংশ

বাল্যে নিরাপত্তার অভাব এবং অহেতুক ভয় লক্ষ্য করা যায়। আবেগিক আচরণ বদের মনোভাব দ্বারা অনেকখানি নিয়ন্ত্রিত হয়। আনন্দ এবং সুখের অনুভূতির আধিক্য দেখা যায়। ভাই বোনদের প্রতি ঈর্ষা দেখা যায়। বাল্যে ভয়ের বিকাশ বেশ গুরুত্বপূর্ণ। বাল্যের শেষে ভয় তীব্র হয়। শিখন, সাপেক্ষীকরণ ও আর্থ-সামাজিক অবস্থানের প্রভাবে বিভিন্ন ভাবে ভয়ের বিকাশ হয়। বস্তুতান্তিক ভয় চেপে রাখার চেষ্টাও দেখা যায়। লজ্জা, উদ্বেগ, উৎকন্ঠা ধীরে ধীরে বেশি করে প্রকাশ পেতে থাকে। চাহিদা বৃদ্ধির সাথে রাগ বাড়তে থাকে। রাগের প্রকাশে পরিবর্তন আসে। প্রকাশ মার্জিত সংযত ও সমাজসম্মত হতে থাকে। হিংসা, আগ্রহ, অনুরাগ,আনন্দ উচ্ছাস বাল্যের ছেলেমেয়েদের মধ্যে দেখা যায়। যৌন বিকাশ সুপ্ত অবস্থায় থাকে।

© হক, মু. না., হোসেন, দি., আক্তার, শা. (১৯৯৭). শিশু ও শিক্ষা মনোবিজ্ঞান. বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়

শেয়ার করুন

মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার তথ্য সংরক্ষিত রাখুন

বিশেষ শর্তসাপেক্ষে এই ওয়েবসাইটটি সামাজিক কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ কিংবা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের নিকট বিক্রি করা হবে।

আবেগ: বাল্যকালে আবেগিক বিকাশ

প্রকাশ: ০৩:২৮:১৪ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১৭ ডিসেম্বর ২০২১

সাধারণত কোনো মানুষের ৬ বছর থেকে ১০ বছর পর্যন্ত সময়কে বাল্যকাল বলে। জীবনের এই স্তরে আবেগিক বিকাশ বিশেষভাবে দেখা যায়। এই বয়সে ছেলেমেয়েরা স্কুলে যেতে শুরু করে। নতুন পরিবেশে তারা নিরাপত্তার অভাব বোধ করে। ফলে এই স্তরে প্রথম দিকে আবেগ নিয়ন্ত্রিত থাকে। কিন্তু কিছু সময় অতিবাহিত হওয়ার পর তাদের স্বাভাবিক আবেগিক প্রকাশ দেখা যায়। ভয় আশংকা ইত্যাদি আবেগ বিভিন্ন কারণে সৃষ্টি হয়। রাগের প্রকাশে পরিবর্তন আসে। 

আবেগিক দিক থেকে বাল্যকালের শেষ দিকটাকে অনেকে ভাবনাচিন্তা মুক্ত কাল হিসাবে বিবেচনা করেন। মনোবিজ্ঞানীদের ধারণা এই বয়সের ছেলেমেয়েদের আনন্দ ধরনের আবেগের প্রকাশ বেশি দেখা যায়। তবে মোটিমুটি ভাবে এ বয়সের ছেলেমেয়েরা চিন্তা ভাবনা মুক্ত হয় এবং তাদের মধ্যে আনন্দ উচ্ছাস, হাসি, খুশিভাব বেশি পরিমানে দেখা যায়। আশংকা, রাগ, ভয় ইত্যাদি আবেগও থাকে। 

শিশু সুলভ ভয়ের পরিবর্তে তাদের মধ্যে বাস্তব ঘটনার প্রেক্ষিতে ভয়ের ভাব দেখা যায়। এ বয়সে বাবা মার স্নেহ থেকে বঞ্চিত হওয়ার আশংকায় ছো ভাই বোনদের প্রতি ঈর্ষা সৃষ্টি হয়। বাবা মার প্রতি তাদের আবেগিক আচরণে বিশেষ পরিবর্তন হয়। বাবা মার শাসনের ফলে ভূল বোঝাবুঝি হয় এবং শিশুমনে বিরূপ আবেগ সৃষ্টি হতে দেখা যায়। বাল্যকালের ভয়,রাগ,হিংসা, আগ্রহ,অনুরাগ, আনন্দ- উচ্ছাস ইত্যাদি কয়েকটি প্রধান আবেগ নিয়ে আমরা এখন আলোচনা করব।

ভয় 

শৈশবেই ভয়ের বিকাশ হয। বাল্যকালেও ভয় বিভিন্ন ভাবে ছেলেমেয়েদের মধ্যে দেখা যায়। তিন বছর বয়সে এবং বাল্যের শেষের দিকে শিশুর ভয় তীব্র আকার ধারণ করে। ছেলেমেয়ের মধ্যেও ভয়ের পার্থক্য দেখা যায়। যেমন এই স্তরে মেয়েরা সাপ, বেজী,ব্যাঙ এসমস্ত ভয় পায়। আর ছেলেদের কাছে এই ভয় একান্তই ছেলেমি।

ভয় অনেকটা শিক্ষণ জনিত এবং সাপেক্ষীকরণের সাহায্যেও হয়ে থাকে। ভয় শিখনজাত বলে পরিবারের আর্থ-সামাজিক অবস্থানের উপর ভয়ের ধরন নির্ভর করে। নিম্নবিত্ত পরিবেশে পিতামাতার প্রহার, বকুনী এবং সামাজিক পরিবেশের সন্ত্রাসকে এবং উচ্চবিত্ত পরিবেশে গাড়ী দূর্ঘটনা, ঝড়, স্কুলে দুর্ঘটনা ইত্যাদিকে বেশি ভয় করে। নিম্নবিত্ত শিশুদের মনে শিক্ষক ও পড়াশুনা ভয় জাগায়। উচ্চবিত্ত শিশুরা পড়া শুনায় ভালো ফলাফল করা, স্কুল শেষ করা, কলেজে যাওয়া ইত্যাদি নিয়ে ভয়ে দুর্ভাবনায় থাকে।

বাল্যকালে শিশু জীবজন্তু, অচেনা পরিবেশ, বিভিন্ন ব্যক্তি যেমন ডাক্তার, পাগল ইত্যাদিকে ভয় করে। তবে প্রথম দিকের এই সব বস্তুতান্ত্রিক ভয় বয়স বাড়ার সাথে সাথে কমতে থাকে।

এবং অবাস্তব ও কাল্পনিক বিষয়ের ভয়, এমনকি বিদ্যুৎ চমকালেও তারা ভয় পায়। কল্পিত বিপদের আশংকা থেকে এই ভয় জাগে। স্নেহ মায়া মমতায় ভরা উষ্ণ পরিবারে না থাকলে স্নেহের অভাব বোধ থেকেও ভয় দেখা দেয়। বিভিন্ন ধরনের আশংকাও ছেলেমেয়ের মধ্যে দেখা যায়। ভয়ের প্রকাশের মধ্যে অনেক পরিবর্তন ঘটে। ছেলেমেয়েরা অনেকে ভয়কে চেপে রাখতেও চেষ্টা করে। কারণ অনেক সময় তা সামাজিক ভাবে অগ্রহণযোগ্য এবং বন্ধুদের কাছে হাসির ব্যপার হয়ে দাঁড়ায়।

উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা

শিশুদের লজ্জা, উদ্বেগ (worry) উৎকন্ঠা (anxiety) এগুলোও একধরনের ভয়েরই বহিঃপ্রকাশ। বাল্যকালেই এ সব ভয়ের সূত্রপাত হয়। কাল্পনিক ভয় থেকে উদ্বেগের সৃষ্টি। মানসিক বিকাশের সাথে সাথে শিশু মনে উদ্বেগের সৃষ্টি হয়। বই, সিনেমা, কমিক, রেডিও টেলিভিশন ইত্যাদি ও অনেক কাল্পনিক পরিস্থিতি থেকে শিশু মনে উদ্বেগের সৃষ্টি হয়। পরীক্ষার 

ফলাফল উদ্বেগের একটি সাধারণ কারণ। স্কুলের কোনো সমস্যা নিয়ে অথবা পরিবারের কোনো পরিস্থিতি নিয়েও শিশুমনে উদ্বেগ সৃষ্টি হয়। উদ্বেগের বিভিন্ন বহিঃপ্রকাশ দেখা যায়। 

পালায়নপরতা, ঘটনাকে এড়িয়ে চলা, মুখমন্ডল বিবর্ন হওয়া, ক্ষুধা নষ্ট হয়ে যাওয়া ইত্যাদি দেখা যায়। 

উদ্বেগ যখন অনেক বেশি এবং তীব্র হতে থাকে তখন সেটা উৎকন্ঠায় রূপ নেয়। মানসিক ভয় বা মনের বেদনাদায়ক দুশ্চিন্তা থেকেও উৎকন্ঠার সৃষ্টি হয়। সমবয়সীরা যে সব শিশুদের গ্রহন করে না, এ রকম প্রত্যাখ্যাত শিশুদের মধ্যে উৎকন্ঠা বেশি দেখা যায়। 

শিশু যত বাইরের পরিবেশের সঙ্গে পরিচিত হয়। ততই তারা পিতামাতার শাসন ও নিয়ম বুঝতে পারে, সামাজিক নিয়মনীতি, ব্যবহার সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হয়।

ছেলেদের চেয়ে মেয়েরা উৎকন্ঠায় বেশি ভোগে। দিবাস্বপ্ন, দুঃস্বপ্ন, অসুস্থতা, অতি-আক্রমনাত্বক ব্যবহার বিদ্রোহী ব্যবহার ইত্যাদির মাধ্যমে উৎকন্ঠার বহিঃপ্রকাশ ঘটে। 

লাজুকতা-সামাজিক ভয় থেকে সৃষ্টি হয়। এ সময় শিশুরা চুপ করে থাকে। হাতে কিছু নিয়ে নাড়াচাড়া করে বা দাঁত নিয়ে নখ কাটে।

রাগের বিকাশ 

রাগ বাল্যকালের অতি পরিচিত আবেগিক আচরণ। বয়স বাড়ার সাথে সাথে রাগের প্রকাশ বাড়তে থাকে। ব হওয়ার সঙ্গে চাহিদার বৃদ্ধি ঘটে। আর চাহিদা প রন না হলেই রাগের সৃষ্টি হয়। বাল্যে সাধারণত যে সব কারণে শিশুর রাগ হয় তার মধ্যে প্রধান হচ্ছে চাহিদার নিবৃত্তি না হওয়া, কাজে বাধাদান করা, অনবরত দোষ খোজাঁ বা সমালোচনা করা, উপদেশ দেওয়া, অন্য শিশুর সাথে তুলনা করা, অপছন্দনীয় কোনো দোষ আরোপ করা ইত্যাদি। আবার শিশু নিজে কোনো ভুল করলে, কোনো কাজে নিজের অপারগতার জন্য, অন্যায়ভাবে সে অথবা তার বন্ধুরা বকুনী খেলে, শান্তি পেলে, অন্য শিশুরা তাকে অবহেলা করলে, উপহাস করলে শিশুরা রাগ দেখায়। বয়স বাড়ার সাথে সাথে রাগের প্রকাশে পরিবর্তন আসে। রাগের তীব্র প্রকাশ বা temper tantrums (মেজাজ মর্জি) ছোটদের মধ্যে বেশি দেখা যায়। অনেক শিশু আক্রমনাত্বক হয়ে উঠে-হাত পা ছুঁড়ে চিৎকার করে আঘাত করে। জিনিসপত্র ভেঙ্গে ফেলে, গালাগালি দেয়। সাধারণত ২ থেকে ৪ বছরের শিশুদের মধ্যে temper tantrums দেখা দেয়।

বাল্যের শেষ দিকে শিশুরা রাগ হলে আগের মত আক্রমনাত্বক আচরণ করে না। নিজেরের রাগকে নিয়ন্ত্রণ করে অন্যভাবে রাগকে প্রকাশ করে। বড়োদের সমর্থন বা অসমর্থন তাদের আবেগিক ব্যবহার অনেকাংশে নিয়ন্ত্রন করে। বয়স বাড়ার সাথে তারা কথা না বলা, অভিমান করা, ঝগড়া ও হৈ, চৈ করা ইত্যাদি আচরণের দ্বারা রাগ প্রকাশ করে আবার কেউ কেউ সব বয়সেই আক্রমনান্তক আচরণ, ভাঙ্গাচোরা ,অপরকে আঘাত করা ইত্যাদি উপায়ে রাগ প্রকাশ করে। খাওয়া দাওয়া, কাজকর্ম ছেড়ে দিয়ে চুপচাপ ঘরে বসে থেকে রাগ প্রকাশ করে অনেকে। 

শিশু যত বাইরের পরিবেশের সঙ্গে পরিচিত হয়। ততই তারা পিতামাতার শাসন ও নিয়ম বুঝতে পারে, সামাজিক নিয়মনীতি, ব্যবহার সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হয়। শিক্ষার প্রভাবে তার আবেগিক আচরণ মার্জিত, সংযত ও সমাজ সম্মত হয়। মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য রাগের বহিঃপ্রকাশ হওয়া ভালো। শিশুর রাগকালীন প্রতিবাদের ভেতর দিয়ে তার আবেগ মুক্ত হয়। 

বিভিন্ন গঠনমূলক কাজের ভেতর দিয়ে রাগের অভিব্যক্তি সুন্দর ব্যক্তিত্ব গঠনে সাহায্য করে। জোর করে রাগ দমন করা বাঞ্জনীয় নয়। শিশু যদি রাগের প্রকাশকে চেপে যায়, আবেগকে অবদমিত করে সেটা মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।

হিংসা 

স্নেহ ভালোবাসা হারাবার অনিশ্চয়তায় শিশুর মনের হিংসার সৃষ্টি হয়। আপন ভাই বোনের প্রতি হিংসা বোধ শৈশবের বৈশিষ্ট্য। এটাকে বলা হয় অগ্রানুজ হিংসা (Sibling Rivalry)। বাল্য কালে শিশুর মধ্যে এই হিংসার প্রকাশ দেখা যায়। হিংসার পরিস্থিতি সব সময়ই সামাজিক। শিশু যাদেরকে ভালোবাসে তাদের সঙ্গে সম্পৃক্ত এই আবেগ। মা বাবা বা অন্যরা যারা শিশুর সেবা যত্ন করেন, ভালোবাসেন তাদের সম্পর্কে শিশুর মনে যখন স্নেহ ভালোবাসা হারাবার আশাংকা জাগে তখনই তার মধ্যে হিংসাবোধ জাগে। হিংসাবোধ জাগে সাধারণত তখন যখন অন্য একটি শিশু মাবাবার স্নেহ-ভালোবাসা ও মনোযোগ আকর্ষণ করে। তাকে বাদ দিয়ে অন্যের প্রতি বেশি আগ্রহ, বেশি মনোযোগ যখনই দেখে তখনই সেই ভাইবোনের প্রতি তার রাগ ও হিংসা তীব্র হয়ে উঠে। নিজেকে সে অবহেলিত মনে করে এবং মা ও নতুন শিশু উভয়ের বিরুদ্ধেই তার মনে ক্ষোভ জাগে।

বাড়িতে যে সব ছেলে মেয়েরা এই ধরনের হিংসা দেখায় স্কুলে গিয়েও বন্ধুদের ব্যাপারে একই হিংসা দেখায় তারা। যে সব ছেলেমেয়েরা শিক্ষকের কাছ থেকে প্রশংসা পায় বা বিভিন্ন কাজে খুব ভালো করে তাদের ব্যাপারে ঐ শিশুরা বেশি হিংসা পোষণ করে। পরিবারে কোনো সন্তানের প্রতি পক্ষপাতিত্ব করলে অন্য সন্তানেরা হিংসান্বিত হয়। স্কুলে শিক্ষকের পক্ষপাতিত্ব অন্য শিশুদের মধ্যে হিংসার উদ্রেক করে। 

হিংসামূলক আচরণ মৃদুবিরক্তি এবং উৎকন্ঠা থেকে আঘাত করার প্রবণতা পর্যন্ত হতে পারে। বাল্যকালের হিংসাত্বক আচরণ শৈশবের চেয়ে অনেক ভিন্ন। হিংসাত্বক আচরণ বিভিন্ন ধরনের ও পরোক্ষ প্রকৃতির। আক্রমনাত্বক আচরণ বাড়ীতে না হয়ে সাধারনত স্কুলে ও খেলার মাঠে হয়ে থাকে। বাল্যকালের প্রথম দিকের হিংসাত্বক আচরণের চেয়ে বাল্যকালের শেষ দিকের 

হিংসাত্বক আচরণ অনেক মার্জিত হয়ে আসে। কথা না বলা, টিটকারী দেওয়া, কৌতুক করা, কথা শোনানো, ঝগড়া এবং কখনও মারামারি করা ইত্যাদি ধরনের হিংসাত্বক আচরণ দেখা যায়। হিংসার আবেগিক বিকাশ ছেলে ও মেয়ে উভয়ের মধ্যে সমান ভাবে দেখা যায়।

আগ্রহ 

বাল্যে শিশুর পরিবেশ বিস্তৃত হওয়ার ফলে তার আগ্রহও বাড়তে থাকে বাড়ীতে ও আশেপাশে ছোবেলার তাকে যা ধরতে বা দেখতে দেওয়া হয়নি এখন সেগুলো সম্পর্কে তার সীমাহীন আগ্রহ দেখা যায়। ছুরি, কাঁচি, যন্ত্রপাতি সম্বন্ধে তার আগ্রহ অনেক। কিভাবে দিয়াশলাইর কাঠি, গ্যাসবার্ণার জ্বলে, স্টোর রুমে কী কী জিনিস সঞ্চিত আছে সব কিছু দেখা, সব কিছু নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা করার আগ্রহ বাল্যকালের বৈশিষ্ট্য। হারলক বলেন মায়ের চুলের নতুন বিন্যাস, বাড়ীতে নিয়ে আসা নতুন জিনিস সবই সমান ভাবে তার আগ্রহ আকর্ষণ করে। তার দৈহিক পরিবর্তন সম্পর্কেও তার অফুরন্ত আগ্রহ। স্থায়ী দাঁত যখন উঠতে থাকে ঘন্টার পর ঘন্টা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে শিশু তার বাড়ন দেখতে চায়। বাল্যের শেষাংশে যৌনাগমের পরিবর্তন তাকে কৌতুহলী ও আগ্রাহান্বিত করে তোলে। 

অনুরাগ 

বাল্যকালে প্রকাশ্যে একে অন্যের প্রতি অনুরাগ প্রকাশ করতে ছেলেমেয়েরা পছন্দ করে না। শৈশবে বড়োদের আদর ও চুমু শিশুদের খুব আকাংক্ষার বস্তু । কিন্তু বাল্যকালে প্রকাশ্য আদরে তাদের খুব অনীহা। অনুরাগের প্রকাশ ভিন্ন ভাবে হয়। কাছে কাছে থাকা, সাহায্য করা, কাজ করে দেওয়া ইত্যাদি উপায়ে তাদের অনুরাগ প্রকাশ পায়। 

আনন্দ উচ্ছাস 

আনন্দ-উচ্ছাস শিশুদের জীবনের এক স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য। এই বয়সে শিশু অন্যান্য ছেলেমেয়ের সঙ্গ পাওয়াতে বেশি আনন্দ পায়। অন্যান্যদের সঙ্গে খেলা ধূলা করা তার কাছে খুব আনন্দের ব্যাপার। এই সময় থেকে শিশু কমিক, কার্টুন বা হাসির ছবি দেখে আনন্দ পায়। 

অন্যকে বিরক্ত করে বা অপ্রতিভ করে বা অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে ফেলে সে আনন্দ পায়।আরও একটু বড়ো হয়ে সে অদ্ভুত কিছু দেখলে বা শুনলে হাসে এবং নিজেও রসিকতা করে। নিজের সাফল্যে সে আনন্দ পায়। যে সব কাজ নিষিদ্ধ সেই সব কাজ করতে বা সে গুলো নিয়ে আলোচনা করতে সে আনন্দ পায়।

বাল্যকালে শিশুর উচ্চ বা মৃদু হাসি হল আনন্দের সাধারণ প্রকাশ। আনন্দের সময় সমস্তশরীরের মধ্যে একটা শিথিল ভাব অনুভূত হয়। 

বাল্যকালে সব আবেগের প্রকাশই শৈশবের তুলনায় অনেক সংযত ও নিয়ন্ত্রিত লক্ষ্য করি। মেজাজ দেখানো রাগ করা, উদাসীনতা ইত্যাদি আবেগিক আচরণ যে বন্ধুদের ও বড়োদের অপছন্দের সেটা এই বয়সের শিশু বুঝতে শিখে। ভয় পেয়ে পালানো হল কাপুরুষতা, ঈর্ষার বশে কারো মনে আঘাত দেওয়া মোটেই খেলোয়াড় সুলভ মনের পরিচায়ক নয়। চিৎকার, হৈ চৈ করে রাগ প্রকাশ নেহায়েতই ছেলেমানুষী (Childish) এগুলো বুঝার ফলে আবেগিক আচরণ অনেক মার্জিত ও সংযত হয়ে যায়। বালক বালিকারা বাল্যের শেষে নিজেদের আবেগ 

অন্যের সামনে যাতে প্রকাশ না পায়,সে ব্যাপারেও সচেষ্ট হয়। 

যৌন আবেগের বিকাশ 

যৌন চেতনা এ স্তরে সুপ্ত থাকে। কোনো বহিঃপ্রকাশ থাকে না। ফ্রয়েড একে সুপ্ত কাম অবস্থা বা ল্যাটেন্সি পিরিয়ড (Latency Period) বলেছেন। এ বয়সে ছেলেমেয়েদের মধ্যে কোনো মানসিক বা আবেগিক অপসঙ্গতি থাকে না। এ জন্য আর্নেষ্ট জোনস বয়ঃপ্রাপ্তিকে বাল্যকালের পুনরাবৃত্তি বলে বর্ণনা করেছেন। বাল্যকালে যৌনতার কোনো বহিঃপ্রকাশ না থাকলেও যৌনতার বিকাশ চলতে থাকে। অন্তর্নিহিত অবস্থায় পূর্ণতার দিকে এগিয়ে চলে। যৌনতা অপ্রকাশিত থাকে বলে এই স্তরে আবেগিক চাঞ্চল্য দেখা যায় না ও সঙ্গতি বিধানে কোনো সমস্যা হয় না।

সারাংশ

বাল্যে নিরাপত্তার অভাব এবং অহেতুক ভয় লক্ষ্য করা যায়। আবেগিক আচরণ বদের মনোভাব দ্বারা অনেকখানি নিয়ন্ত্রিত হয়। আনন্দ এবং সুখের অনুভূতির আধিক্য দেখা যায়। ভাই বোনদের প্রতি ঈর্ষা দেখা যায়। বাল্যে ভয়ের বিকাশ বেশ গুরুত্বপূর্ণ। বাল্যের শেষে ভয় তীব্র হয়। শিখন, সাপেক্ষীকরণ ও আর্থ-সামাজিক অবস্থানের প্রভাবে বিভিন্ন ভাবে ভয়ের বিকাশ হয়। বস্তুতান্তিক ভয় চেপে রাখার চেষ্টাও দেখা যায়। লজ্জা, উদ্বেগ, উৎকন্ঠা ধীরে ধীরে বেশি করে প্রকাশ পেতে থাকে। চাহিদা বৃদ্ধির সাথে রাগ বাড়তে থাকে। রাগের প্রকাশে পরিবর্তন আসে। প্রকাশ মার্জিত সংযত ও সমাজসম্মত হতে থাকে। হিংসা, আগ্রহ, অনুরাগ,আনন্দ উচ্ছাস বাল্যের ছেলেমেয়েদের মধ্যে দেখা যায়। যৌন বিকাশ সুপ্ত অবস্থায় থাকে।

© হক, মু. না., হোসেন, দি., আক্তার, শা. (১৯৯৭). শিশু ও শিক্ষা মনোবিজ্ঞান. বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়