সামাজিক বিজ্ঞান এবং সামাজিক বিজ্ঞান শিক্ষা
- প্রকাশ: ০৬:১৬:০১ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২১ ডিসেম্বর ২০২১
- / ১০৫৮৯ বার পড়া হয়েছে
সমাজ বলতে আসলে কী বোঝায় সেটা এক কথায় বলা সম্ভব নয়। সামাজিক বিজ্ঞানীগণ বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে সমাজের যে ধারণা ব্যাখ্য করেছেন তা থেকে সাধারণভাবে বলা যায়, বহু ব্যক্তি যখন একই উদ্দেশ্য সাধনের জন্য সংঘবদ্ধভাবে বসবাস করে তখন সেটাই সমাজ। এখানে দুটি বৈশিষ্ট্য বিরাজমান। প্রথমত, বহু লোকের সংঘবদ্ধভাবে বসবাস; দ্বিতীয়ত, সংঘবদ্ধতার পেছনে বিরাজমান বিশেষ উদ্দেশ্য। এ দুটি বৈশিষ্ট্যের অধিকারী যে কোনো জনসমষ্টিকে ‘সমাজ’ বলা যায়। অনেক সামাজিক বিজ্ঞানী মানুষের পারস্পরিক সম্পর্ককে সমাজের ভিত্তি হিসেবে গণ্য করেছেন।
জিসবার্ট তাঁর ‘ফান্ডামেন্টাল অব সোসিওলজি’ গ্রন্থে বলেছেন, “সাধারণভাবে সমাজ হলো সম্পর্কের জটিল জাল, যে সম্পর্ক দ্বারা প্রত্যেক মানুষ তার সঙ্গীর সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত।”
সামাজিক বিজ্ঞানী আর.এম. ম্যাকাইভার ‘সমাজ’ বোঝাতে ব্যক্তিবর্গের মানসিক অবস্থা বা মনস্তাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। তাঁর মতে, “সমাজ হলো সামাজিক সম্পর্কসমূহের ব্যবস্থা যার মাধ্যমে আমরা জীবনযাপন করছি। এ সম্পর্ক বহুমাত্রিক। কারণ এটি যেমন কতকগুলো মনস্তাত্ত্বিক বিষয়ের ওপর নির্ভরশীল তেমনই কতকগুলো বৈষয়িক চাহিদা দ্বারাও নিয়ন্ত্রিত। মোটকথা, এটি নানাবিধ চাহিদার ওপর নির্ভরশীল। পরিবর্তনশীলতাই এর প্রধান ধর্ম। এ পরিবর্তশীলতাই সামাজিক সম্পর্কের গতিশীলতা আনে। নিয়ত পরিবর্তনশীল এ ব্যবস্থাকে প্রাধান্য দিয়েই ম্যাকাইভার সমাজের সংজ্ঞা দিয়েছেন। তাই ব্যাপক অর্থে সমাজের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে তিনি বলেছেন, “সমাজ হলো আচার ও কার্যপ্রণালি, কর্তৃত্ব এবং পারস্পরিক সহযোগিতা, নানারকম দলবদ্ধতা ও বিভাজন মানুষের আচরণের নিয়ন্ত্রণ এবং স্বাধীনতা এসব কিছু দ্বারা গঠিত একটি ব্যবস্থা। এই নিয়ত পরিবর্তনশীল জটিল ব্যবস্থাকে আমরা সমাজ বলি।
এ হলো সামাজিক সম্পর্কের জাল এবং এটি সর্বদা পরিবর্তনশীল।”
এ থেকে স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে যে, সামাজিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে ‘মনস্তাত্বিক’ অনুভূতি, পারস্পরিক স্বীকৃতি, সাদৃশ্য ও নির্ভরশীলতা সমাজিক সম্পর্কের উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। সাদৃশ্য, নির্ভরশীলতা এবং সহযোগিতা সমাজের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলেও বৈচিত্র, স্বাতন্ত্র্য, মতবিরোধ, সংঘাত, প্রতিযোগিতা ইত্যাদিও সমাজে বিদ্যমান থাকে। আর তাই সমাজের ধারণা অনুধাবনে এ সব দিকও অবশ্যই বিবেচনায় আনতে হবে। কারণ সমাজ হলো যুদ্ধ বা ধ্বংসের বিভীষিকাময়
অবস্থার বিপরীত একটি অবস্থা। তবে পারস্পরিক নির্ভরশীলতা হচ্ছে সমাজের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। বলা যায়, এটিই সমাজ জীবনের ভিত্তি তথা সামাজিক সম্পর্কের কেন্দ্রবিন্দু।
তাই ম্যাকাইভার বলেন, “সমাজ অর্থ সহযোগিতা….। সমাজ হলো যুদ্ধের ঠিক বিপরীত অবস্থা। যুদ্ধ বলতে বোঝায় বিপরীত ধারার স্বার্থে জড়িত ব্যক্তিবর্গ বা গোষ্ঠিসমূহের পারস্পরিক সংঘাত, আর সমাজ বলতে বোঝায় একই প্রকার বা সাধারণ স্বার্থে উদ্দীপ্ত ব্যক্তিবর্গ বা গোষ্ঠিসমূহের পারস্পরিক সহযোগিতায় কিছু গঠন বা সৃষ্টি।”
সামাজিক বিজ্ঞানের উৎপত্তি
এখন স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে সমাজের উৎপত্তি কখন, কীভাবে হয়েছে? এসব প্রশ্নের উত্তরে বলা যায় যে, ঠিক কোনো একটি নির্দিষ্ট সময়ে বা তারিখে আনুষ্ঠানিকভাবে সমাজের উৎপত্তি হয়েছে, তা নয়। তবে একথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, আজকের সমাজের যে চিত্র আমরা দেখছি তা সময়ের ধারাবাহিকতায় গড়ে উঠেছে, হঠাৎ একদিনে গড়ে ওঠে নি। একটি ক্রমপরিবর্তনের মধ্য দিয়ে বিবর্তনের ধারায় সমাজ পেয়েছে তার আজকের এই অবস্থা বা চিত্র। সেজন্যেই প্রাচীন সমাজ আর আজকের সমাজের চিত্র ভিন্ন। হ্যাঁ, শিক্ষার্থী বন্ধুরা, এই সমাজ তথা সমাজিক বিষয়াদির বিজ্ঞানসম্মত আলোচনা ও ব্যাখ্যা বিচার-বিশ্লেষণ ও মূল্যায়ন শুরু হয়েছে যখন থেকে তখন থেকেই উৎপত্তি সামাজিক বিজ্ঞানের।
মানুষের সঙ্গে মানুষের মেলামেশা বা মিথস্ক্রিয়ার ফলে যে সম্পর্কের সৃষ্টি হয়, সেটিই সামাজিক সম্পর্ক। এ সম্পর্ক বিভিন্ন ধরনের হতে পারে। যেমন- সহযোগিতার, প্রতিযোগিতার, স্নেহ-ভালবাসার ইত্যাদি। সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয়, ঐতিহাসিক, ও ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য ও কারণসমূহই সামাজিক সম্পর্কের ভিত্তি। এমন সম্পর্কের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা সমাজবদ্ধ মানুষের জীবন সব সময় ছিল গতিশীল। আর এ গতিশীলতাই সমাজকে করেছে পরিবর্তনশীল।
আর সমাজকে নিয়ে অনুশীলন এবং পরিবর্তনশীল সমাজের পারিপার্শ্বিক অবস্থার সাথে সামঞ্জস্য বিধান সম্পর্কে জ্ঞান, দৃষ্টিভঙ্গি ও দক্ষতা অর্জনের জন্যেই সামাজিক বিজ্ঞানের উৎপত্তি ঘটেছে।
সামাজিক বিজ্ঞানের কাঠামো
সামাজিক বিজ্ঞানের মূল উপাদান মানুষ। আর মানুষের সাথে সম্পর্কিত যে বিষয়গুলো উল্লেখযোগ্য তা হলো তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক, নির্ভরশীলতা ও আচরণ প্রভৃতি। এসব বিষয়ে সামাজিক বিজ্ঞান ভিন্ন ভিন্নভাবে আলোচনা করে থাকে। একটি সমন্বিত বিষয় হিসেবে সামাজিক বিজ্ঞানে রয়েছে নানা বিষয়ের অন্তর্ভুক্তি। বিষয়গুলো হলো রাষ্ট্র বিজ্ঞান, অর্থনীতি, ইতিহাস, সমাজবিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান, ভূগোল ইত্যাদি। এ সবগুলো বিষয়ই সামাজিক বিজ্ঞানের আলোচ্য বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত। আর সে কারণেই সামাজিক বিজ্ঞানের একটি সুনির্দিষ্ট কাঠামো নির্ধারণের প্রয়াস এখনও বিদ্যমান রয়েছে। সমাজ বিজ্ঞানীগণ তাঁদের এ প্রয়াস অব্যাহত রাখাতেই সামাজিক বিজ্ঞানের কাঠামো সম্পর্কে একটি সুস্পষ্ট ধারণা করা যেতে পারে। সামাজিক বিজ্ঞানের পরিসর ও কাঠামোকে বিবেচনায় আনলে একে তিনটি শাখায় ভাগ করা যায়। যেমন- পরিপূর্ণ সামাজিক বিজ্ঞান, উপ-সামাজিক বিজ্ঞান ও সামাজিক বিষয় সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞানসমূহ।
সামাজিক বিজ্ঞান শিক্ষার ধারণা গঠন
সামাজিক বিজ্ঞান শিক্ষার মূল কাজ হচ্ছে- সামাজিক বিজ্ঞানের শিক্ষাক্রম, পাঠ্যসূচি, বিষয়বস্তু, শিখন অভিজ্ঞতা, শিখন-শেখানো পদ্ধতি, কৌশল ও দক্ষতা, শিখন সামগ্রি, শিক্ষার্থী মূল্যায়ন ইত্যাদির অনুশীলন, অনুসন্ধান, পর্যালোচনা ও গবেষণা করা।
সমাজিক বিজ্ঞানের বিষয়বস্তু ও কাঠামোগত যে ধারণা আমরা ইতিপূর্বে পেয়েছি তাতে দেখা যাচ্ছে যে, সমাজ ও মানুষ তথা সামাজিক ঘটনা ও কার্যাবলিই এর মূল আলোচ্য বিষয়। সেজন্য জ্ঞান-রাজ্যের অধিকাংশ শাখাই এর আওতায় পড়ে। তাই সামাজিক বিজ্ঞানের স্থান অত্যন্তগুরুত্বপূর্ণ। সমগ্র বিশ্বজুড়ে প্রায় সকল শ্রেণিতেই অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে সামাজিক বিজ্ঞানকে পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে এবং তা পঠন-পাঠনেরও ব্যবস্থা রয়েছে। সুতরাং সামাজিক বিজ্ঞান শিক্ষা হলো শিক্ষার্থীর সামাজিক বিজ্ঞান সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন, অনুভূতি বা দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন এবং এর মাধ্যমে দক্ষতার উৎকর্ষ সাধন। মূলত: সামাজিক বিজ্ঞান শিক্ষালাভের মাধ্যমে শিক্ষার্থীর সামাজিক বিজ্ঞানের অন্তর্ভুক্ত বিষয়বস্তু সংক্রান্ত জ্ঞান লাভ করা সহজতর হয়।
সামাজিক বিজ্ঞান শিক্ষার ধারণা গঠন
বিভিন্ন সমাজবিজ্ঞানী সামাজিক বিজ্ঞানের সংজ্ঞা যেভাবে দিয়েছেন তাতে দেখা যায় তারা এক একটি আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট্যের উপরে গুরুত্ব আরোপ করেছেন। যেমন:
- গিডিংস-এর মতে সামাজিক ঘটনাবলিই সামাজিক বিজ্ঞানের প্রধান বিষয়।
- ম্যাক্সওয়েবার এর মতে সামাজিক কার্যাবলিই এর প্রধান বৈশিষ্ট্য।
- জিসবার্স্ট এর মতে সম্পর্কের জটিল জাল হচ্ছে এর মূল বৈশিষ্ট্য।
- আর এম ম্যাকাইভার সমাজস্থ মানুষের মানসিক অবস্থা বা মনস্তাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যের উপর গুরুত্ব দেন।
সামাজিক বিজ্ঞান আসলে একটি সমন্বিত বিষয়। আর তাই এর অন্তর্ভুক্ত রয়েছে এর সাথে সম্পৃক্ত অন্য সকল বিষয়সমূহও। যেমন- রাষ্ট্রবিজ্ঞান, ইতিহাস, সমাজ বিজ্ঞান, ভূগোল ইত্যাদি। তবে এর একটি সুনির্দিষ্ট কাঠামোও রয়েছে।
সামাজিক বিজ্ঞানের সংজ্ঞা
সামাজিক বিজ্ঞানের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বিভিন্ন জন ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্যের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। যেগুলো আমাদের বর্তমান প্রসঙ্গে জানা প্রয়োজন। নিচে কিছু গুরুত্বপূর্ণ সংজ্ঞা তুলে ধরা হলো
- গিডিংস-এর মতে, “সামাজিক বিজ্ঞান হলো সামাজিক ঘটনাবলি বা প্রপঞ্চের বিজ্ঞান।”
- ম্যাক্স ওয়েবারের মতে, “সামাজিক কার্যাবলির বিজ্ঞান হচ্ছে সামাজিক বিজ্ঞান।”
- এস.কে.কোচার বলেছেন, “সামাজিক বিজ্ঞান হচ্ছে জ্ঞানের এমন এক শাখা যা একক বা দলগতভাবে মানুষের অভৌত বৈশিষ্ট্যাবলির বিজ্ঞানভিত্তিক অনুশীলন করে।”
- এনসাইক্লোপেডিয়া ব্রিটেনিকায় বলা হয়েছে “সামাজিক বিজ্ঞান মানব আচরণের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইত্যাদি যাবতীয় বিষয়াদি নিয়ে আলোচনা করে।”
- ক্রেইগ কিসক বলেছেন, “সামাজিক বিজ্ঞান পঠন-পাঠনের এমন কার্যক্রম, যার মাধ্যমে সমাজ শিক্ষার্থীর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন সামাজিক সম্পর্কভিত্তিক জ্ঞান, দক্ষতা, দৃষ্টিভঙ্গি এবং কর্মের সঞ্চার ঘটায়।”
সামাজিক বিজ্ঞানের মূল উপাদান হলো মানুষ। আর মানুষের সাথে সম্পর্কিত যে বিষয়গুলো উল্লেখযোগ্য তা হলো তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক, নির্ভরশীলতা ও আচরণ। আর এ সব বিষয়ে সামাজিক বিজ্ঞান ভিন্ন ভিন্নভাবে অধ্যয়ন করে থাকে। অর্থাৎ একটি সমন্বিত বিষয় হিসেবে এতে রয়েছে নানা বিষয়ের অন্তর্ভুক্তি। যেমন রাষ্ট্রবিজ্ঞান, অর্থনীতি, ইতিহাস, সমাজবিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান, ভূগোল ইত্যাদি। এ সবগুলো বিষয়ই সামাজিক বিজ্ঞানের আলোচ্য বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত। আর সে কারণেই সামাজিক বিজ্ঞানের একটি সুনির্দিষ্ট কাঠামো নির্ধারণের প্রয়াস এখনও বিদ্যমান রয়েছে। সমাজবিজ্ঞানীগণ তাঁদের এ প্রয়াস অব্যহত রাখাতেই সামাজিক বিজ্ঞানের কাঠামো সম্পর্কে একটি সুস্পষ্ট ধারণা করা যেতে পারে।
অধ্যাপক এম. হালাইয়া পরিসর ও কাঠামোর দিক থেকে সামাজিক বিজ্ঞানকে তিনটি শ্রেণিতে বিভক্ত করেছেন। যা নিম্নরূপ-
১. পরিপূর্ণ সামাজিক বিজ্ঞানসমূহ: জ্ঞানের যেসব শাখা সরাসরি সমাজ বিষয়ে আলোচনা ও বিচার-বিশ্লেষণ করে সেগুলোকে পরিপূর্ণ সামাজিক বিজ্ঞান হিসেবে গণ্য করা হয়। এ শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত সামাজিক বিজ্ঞানসমূহ হচ্ছে-
- রাষ্ট্রবিজ্ঞান
- অর্থনীতি
- ইতিহাস
- আইনবিজ্ঞান
- নৃবিজ্ঞান
- দণ্ডবিজ্ঞান
- সমাজবিজ্ঞান
এখানে উল্লেখ্য যে, সামাজিক বিজ্ঞানের এসব শাখার উৎপত্তি ও বিকাশের কালক্রমিক ধারা অনুযায়ী তালিকাটি প্রণয়ন করা হয়েছে।
২. উপ-সামাজিক বিজ্ঞানসমূহ: জ্ঞানের যে সব শাখা আংশিকভাবে সামাজিক সম্পর্ক ও ঘটনা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের সাথে সংশ্লিষ্ট সেগুলোকে উপ-সামাজিক বিজ্ঞান হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এ শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত বিষয়সমূহ হচ্ছে:
- নীতিবিজ্ঞান
- শিক্ষাবিজ্ঞান
- দর্শন
- মনোবিজ্ঞান
এগুলোর আলোচ্য ক্ষেত্রের মূল ধারাটি সামাজিক বিষয়াবলিকে কেন্দ্র করে গঠিত।
৩. সামাজিক বিষয় সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞানসমূহ: জ্ঞানের কিছু কিছু শাখা রয়েছে যেগুলোর সাথে সামাজিক বিষয়াবলির সংশ্লিষ্টতা পরোক্ষ হলেও গুরুত্বপূর্ণ। একারণে এগুলোকে সামাজিক বিষয়সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞান হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে:
- জীববিজ্ঞান
- ভূগোল
- চিকিৎসাবিজ্ঞান
- ভাষাতত্ত্ব
- শিল্পকলা ইত্যাদি।
এস. কে. কোচার সামাজিক বিজ্ঞানের পরিসর ও কাঠামো বিষয়ে শিক্ষাক্রমভিত্তিক পঠন-পাঠনের ক্ষেত্রে ইতিহাস, ভূগোল, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, অর্থনীতি, নৃবিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞান অনিবার্যভাবে সামাজিক বিজ্ঞানের অন্তর্ভুক্ত বলে মত প্রকাশ করেছেন। তিনি সাংস্কৃতিক ভূগোল ও মনোবিজ্ঞানকেও সামাজিক বিজ্ঞানের অন্তর্ভুক্ত বলে গণ্য করেছেন। কোনো কোনো দিক থেকে বিশেষ বিবেচনায় তিনি সামাজিক জীববিজ্ঞান, নীতিশাস্ত্র, দর্শন, আইনবিজ্ঞান, পরিসংখ্যান, ভাষাতত্ত্ব ও শিক্ষাকে সামাজিক বিজ্ঞান হিসেবে অভিহিত করেছেন। জেমস হাই মনোবিজ্ঞান, নৃবিজ্ঞান, ভূগোল, অর্থনীতি, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান এবং ইতিহাসকে সামাজিক বিজ্ঞান হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।
‘ইন্টারন্যাশনাল এনসাইক্লোপিডিয়া অব দি সোশ্যাল সায়েন্স’-এ ডেভিড এল. সিলস সামাজিক আচরণ ও সামাজিক প্রতিষ্ঠান অনুশীলনের বা পঠন-পাঠনের দিক থেকে নৃবিজ্ঞান, আচরণিক বিজ্ঞান, অর্থনীতি, ভূগোল, ইতিহাস, আইনশাস্ত্র, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, মনোরোগবিদ্যা, মনোবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান এবং পরিসংখ্যানকে সামাজিক বিজ্ঞানের অন্তর্ভুক্ত করেছেন।
‘দ্য নিউ এনসাইক্লোপেডিয়া ব্রিটেনিকা’তে অর্থনীতি, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞান, সামাজিক মনোবিজ্ঞান, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ভূগোল, শিক্ষাবিজ্ঞান এবং ইতিহাসকে সামাজিক বিজ্ঞানের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। বাংলাদেশে নিম্ন মাধ্যমিক ও মাধ্যমিক স্তরে সমাজবিজ্ঞান, ইতিহাস, পৌরনীতি, ভূগোল, অর্থনীতি, জনসংখ্যা শিক্ষা ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনাকে সামাজিক বিজ্ঞানের বিষয় হিসেবে পাঠদান করা হচ্ছে। সামাজিক বিজ্ঞান শিক্ষার মূল কাজ হচ্ছে সামাজিক বিজ্ঞানের শিক্ষাক্রম, পাঠ্যসূচি, বিষয়বস্তু, শিখন অভিজ্ঞতা, শিখন-শেখানো পদ্ধতি, কৌশল ও দক্ষতা, শিখন সামগ্রী, শিক্ষার্থী মূল্যায়ন ইত্যাদির অনুশীলন, অনুসন্ধান, পর্যালোচনা ও গবেষণা করা।
সমাজিক বিজ্ঞানের বিষয়বস্তু ও কাঠামোগত যে ধারণা আমরা ইতপূর্বে পেয়েছি তাতে দেখা যাচ্ছে যে, সমাজ ও মানুষ তথা সামাজিক ঘটনা ও কার্যাবলিই এর মূল আলোচ্য বিষয়। সেজন্য জ্ঞান রাজ্যের অধিকাংশ শাখাই এর আওতায় পড়ে। তাই সামাজিক বিজ্ঞানের স্থান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সমগ্র বিশ্ব জুড়ে প্রায় সকল শ্রেণিতেই অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে সামাজিক বিজ্ঞানকে
পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে এবং তা পঠন-পাঠনেরও ব্যবস্থা রয়েছে।
সুতরাং, সামাজিক বিজ্ঞান শিক্ষা হলো শিক্ষার্থীর সামাজিক বিজ্ঞানসম্পর্কে জ্ঞান অর্জন, অনুভূতি বা দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন এবং এর মাধ্যমে দক্ষতার উৎকর্ষ সাধন। মূলত সামাজিক বিজ্ঞান শিক্ষালাভের মাধ্যমে শিক্ষার্থীর সামাজিক বিজ্ঞানের অন্তর্ভুক্ত বিষয়বস্তু সংক্রান্ত জ্ঞান লাভ করা সহজতর হয়।
তাছাড়াও জ্ঞান অর্জন, নতুন জ্ঞান আবিষ্কার এবং নতুন নতুন কলা-কৌশল উদ্ভাবন, ব্যবহার ও রপ্ত করে তা প্রয়োগের মাধ্যমে মানুষ অতি দ্রুত পৃথিবীর পরিবর্তন ঘটাচ্ছে। পরিবর্তিত পৃথিবীর সাথে তাল মেলাতে নতুন জ্ঞান ও কলাকৌশল মানুষের আয়ত্বে আনার ব্যবস্থা বা সুযোগ করে দেয় শিক্ষা। শিক্ষা শিক্ষার্থীর জ্ঞান ভাণ্ডারকে করে সমৃদ্ধ, দৃষ্টিভঙ্গি বা অনুভূতির পরিবর্তন ঘটায় এবং দক্ষতাকে করে সমৃদ্ধ। সে জ্ঞান তার অনুভূতিতে সাড়া জাগায় ফলে, দৃষ্টিভঙ্গি প্রসারিত হয় এবং সহযোগিতামূলক শিখন এবং সামাজিক দক্ষতার উন্মেষ ঘটে।
এক কথায় বলা যায় সামাজিক বিজ্ঞান শিক্ষা সমাজ সম্পর্কে শিক্ষার্থীর জ্ঞানগত, অনুভূতিমূলক ও মনোপেশীজ ক্ষেত্রের বিকাশ ঘটাতে ভূমিকা পালন করে।