ফরায়েজি আন্দোলন, হাজী শরীয়তউল্লাহ এবং দুদু মিয়া
- প্রকাশ: ০১:৩৭:৫৬ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৫ ডিসেম্বর ২০২১
- / ৬০১০ বার পড়া হয়েছে
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ক্ষমতা দখলের ফলে বাংলার মুসলমান সম্প্রদায়ের অর্থনৈতিক অবস্থা, শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে বিপর্যয় নেমে আসে। শিক্ষার অভাবে মুসলমানদের ধর্মীয় ও সামাজিক জীবন নানা ধরনের অনাচার কুসংস্কারে ভরে যায়। এ অবস্থায় মুসলমানদের ধর্মীয় ও সামাজিক ভাবে সঠিক পথে পরিচালিত করার জন্য উনিশ শতকে বাংলায় যে সকল সংস্কার আন্দোলন হয় সে গুলোর মধ্যে ফরায়েজি আন্দোলন (The Faraizi Movement) অন্যতম। এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন হাজী শরীয়তউল্লাহ। হাজী শরীয়ত উল্লাহর মৃত্যুর পর দুদু মিয়া ফরায়েজি আন্দোলনের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন।
আন্দোলনের পটভূমি
ফরায়েজি আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা হাজী শরীয়তউল্লাহ বৃহত্তর ফরিদপুরের মাদারীপুর জেলায় ১৭৮২ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি দীর্ঘ বিশ বছর মক্কায় অবস্থান করেন। সেখানে তিনি ইসলাম ধর্মের উপর লেখাপড়া করে অগাধ পাণ্ডিত্য অর্জন করেন। দেশে ফিরে তিনি বুঝতে পারেন যে বাংলার মুসলমানরা ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা থেকে অনেক দূরে সরে গেছে। তাদের মধ্যে অনৈসলামিক রীতিনীতি, কুসংস্কার, অনাচার প্রবেশ করেছে। তিনি ইসলাম ধর্মকে এসব কুসংস্কার আর অনৈসলামিক অনাচার মুক্ত করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হন। এই প্রতিজ্ঞার বশবর্তী হয়ে তিনি উনিশ শতকের প্রথমার্ধে বাংলার মুসলমানদের মধ্যে এক ধর্মীয় সামাজিক সংস্কার আন্দোলনের সূত্রপাত করেন। হাজী শরীয়ত উল্লাহর এই সংস্কার আন্দোলনের নামই ফরায়েজি আন্দোলন।
ফরায়েজি মতবাদ কী?
ফরায়েজি শব্দটি আরবি ‘ফরজ’ (অবশ্য কর্তব্য) শব্দ থেকে এসেছে। যাঁরা ফরজ পালন করে তারা হলেন ফরায়েজি। আর বাংলায় যাঁরা হাজী শরীয়তউল্লাহর অনুসারী ছিলেন, ইতিহাসে শুধু তাদেরকেই ফরায়েজি বলা হয়ে থাকে। শরীয়ত উল্লাহ যে ফরজের উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন, তা ছিল পবিত্র কুরআনে বর্ণিত পাঁচটি অবশ্যপালনীয় (ফরজ) মৌলনীতি। এই মৌলনীতিগুলো হচ্ছে: ইমান বা আল্লাহর একত্ব ও রিসালাতে বিশ্বাস, নামাজ, রোজা, হজ এবং জাকাত। ইসলাম অননুমোদিত সব বিশ্বাস, আচার-আচরণ ও অনুষ্ঠান ত্যাগ করে ইসলাম ধর্মে যা অবশ্য করণীয়, তা পালন করার জন্য তিনি মুসলমান সমাজকে আহ্বান জানান।
হাজী শরীয়ত উল্লাহ বাংলা তথা ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসন মেনে নিতে পরেননি। শরীয়ত উল্লাহ ইংরেজ রাজত্বকে ঘৃণার চোখে দেখতেন। তিনি ভারতবর্ষকে ‘দারুল হারব’ বলে ঘোষণা করেন। ‘দারুল হারব’ অর্থ হলো ‘বিধর্মীর’।
হাজী শরীয়তউল্লাহ বিধর্মী বিজাতীয় শাসিত দেশে জুমা এবং দুই ইদের নামাজ বর্জনের জন্য মুসলমানদের নির্দেশ দিয়েছিলেন।
হাজী শরীয়ত উল্লাহ এবং ফরায়েজি আন্দোলন
হাজী শরীয়ত উল্লাহর আহ্বানে বাংলার শোষিত, নির্যাতিত দরিদ্র রায়ত, কৃষক, তাঁতী, তেলি সম্প্রদায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে এই আন্দোলনে যোগদান করে। শরীয়ত উল্লাহর উপর দরিদ্র জনগোষ্ঠির আস্থা, বিশ্বাস এবং তাঁর অসাধারণ সাফল্য নিম্নশ্রেণির জনগণের মধ্যে দৃঢ় ঐক্য গড়ে তোলে। মুসলমানদের ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান পালনে জমিদাররা বাধা প্রদান করতে থাকে এবং নানা ধরনের কর আরোপ করে।
হাজী শরীয়ত উল্লাহ প্রজাদের অবৈধ কর দেয়া থেকে বিরত থাকার উপদেশ দেন এবং জমিদারদের সব অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য প্রস্তুতি নেন। দেশ জুড়ে অভাব দেখা দিলে তিনি নুন-ভাতের দাবিও উত্থাপন করেন। জমিদার শ্রেণি নানা অজুহাতে ফরায়েজি প্রজাদের উপর অত্যাচার শুরু করলে শরীয়ত উল্লাহ প্রজাদের রক্ষার জন্য লাঠিয়াল বাহিনী গঠনের সিদ্ধান্ত নেন।
১৮৩৯ খ্রিস্টাব্দে হাজী শরীয়ত উল্লাহর উপর পুলিশি নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। ১৮৪০ খ্রিস্টাব্দে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
ফরায়েজি আন্দোলন ও দুদু মিয়া
হাজী শরীয়ত উল্লাহর মৃত্যুর পরে ফরায়েজি আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন তাঁর যোগ্যপুত্র মুহম্মদ মুহসিন উদ্দীন আহমদ। মুহম্মদ মুহসিন উদ্দীন আহমদের ডাকনাম ‘দুদু মিয়া’। দুদু মিয়া ১৮১৯ খ্রিস্টাব্দে জন্ম গ্রহণ করেন। দুদু মিয়া তাঁর হাজী শরীয়ত উল্লাহর মতো মতো পণ্ডিত না হলেও তাঁর সাংগঠনিক ক্ষমতা ছিল অসাধারণ।
দুদু মিয়ার নেতৃত্বে ফরায়েজি আন্দোলন একাধারে একটি ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলনের পাশাপাশি কৃষক শ্রেণির শোষণ মুক্তির সশস্ত্র সংগ্রামে পরিণত হয়। যার ফলে এই আন্দোলন শেষ পর্যন্ত শুধু ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলনের মধ্যে সীমাবদ্ধ রইল না। ইংরেজ শাসকদের চরম অর্থনৈতিক শোষণে বিপর্যস্ত বাংলার কৃষক এই আন্দোলনের মাধ্যমে শোষণবিরোধী প্রত্যক্ষ সংগ্রামে অবতীর্ণ হলো। হাজার হাজার কৃষক জমিদার, নীলকর সাহেবদের নির্যাতন থেকে বাঁচার জন্য ফরায়েজি আন্দোলনে যোগদান করে। দুদুমিয়া ছিলেন ফরায়েজিদের গুরু বা ওস্তাদ। পিতার মৃত্যুর পর তিনি শান্তিপ্রিয় নীতি বাদ দিয়ে সশস্ত্র সংগ্রামে লিপ্ত হন। ফরায়েজিদের প্রতিরোধ সংগ্রামকে দৃঢ় এবং শক্তিশালী করার লক্ষ্যে দুদু মিয়া নিজে লাঠি চালনা শিক্ষা নেন। দুদু মিয়া তাঁর পিতার আমলের লাঠিয়াল জালালউদ্দিন মোল্লাকে সেনাপতি নিয়োগ করে এক সুদক্ষ লাঠিয়াল বাহিনী গড়ে তোলেন।
এর উদ্দেশ্য ছিল জমিদারদের অবৈধ কর আরোপ এবং নীলকরদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের ব্যবস্থা করা। এখানে উল্লেখ্য ফরিদপুর, পাবনা, রাজশাহী, যশোর, মুর্শিদাবাদ, নদিয়া প্রবৃতি অঞ্চলগুলো নীল চাষের জন্য ছিল উৎকৃষ্ট।
সুতরাং এই অঞ্চলগুলোতে নীলকরদের অত্যাচারের মাত্রাও ছিল দুঃসহ ফলে কৃষকরাও হয়ে উঠেছিল বিদ্রোহী। দুদুমিয়া তাঁর নেতৃত্বে গ্রামাঞ্চলে স্বাধীন সরকার গঠন করেছিলেন। কৃষক প্রজাসাধারণকে নিয়ে স্বাধীন সরকারের একটি সেনাবাহিনীও (লাঠিয়াল বাহিনী) তিনি গঠন করেন। ফরায়েজিদের সরকার ব্যবস্থায় পূর্ব বাংলাকে কতগুলো হলকা বা এলাকায় বিভক্ত করা হয়। দুদু মিয়া তাঁর অনুসারীদের নিয়ে দীর্ঘকালব্যাপী জমিদার, নীলকর এবং ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে এই সংগ্রাম চালিয়ে যান। দেশীয় জমিদাররা বিদেশি ইংরেজ শাসক ও নীলকর সাহেবদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে তাঁর বিরুদ্ধে একের পর এক ফৌজদারি মামলা দায়ের করতে থাকে। কিন্তু দুদু মিয়ার বিরুদ্ধে সাক্ষী না পেয়ে তাকে বার বার মুক্তি দিতে হয়। শেষ পর্যন্ত ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে ভারতে প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধের আগুন জ্বলে উঠলে ইংরেজ সরকার ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে উঠে। ভীত ইংরেজ সরকার দুদু মিয়াকে রাজনৈতিক বন্দি হিসেবে কলকাতার কারাগারে আটকে রাখেন। ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে তিনি মুক্তি পান এবং ১৮৬২ খ্রিস্টাব্দে এই দেশ প্রেমিক দুঃসাহসী বিপ্লবীর মৃত্যু ঘটে। তাঁর মৃত্যুর পর যোগ্য নেতৃত্বের অভাবে ফরায়েজি আন্দোলন দুর্বল হয়ে পড়ে।
ব্রিটিশ ভারতে বাঙালি মুসলমানদের নৈতিক চেতনা আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে দেয়ার ক্ষেত্রে ফরায়েজি আন্দোলন এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়। পরবর্তী সময়ে সবধরনের শোষণ নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হওয়ার প্রেরণা যুগিয়েছে এই আন্দোলন। সুতরাং নিসন্দেহে পরাধীন ভারতে বাঙালি মুসলমানের জন্য এই আন্দোলনের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম।
ফরায়েজি আন্দোলনের নেতা
- হাজী শরীয়তুল্লাহ তালুকদার (১৮১৮ থেকে ১৮৪০)
- মুহম্মদ মুহসিনউদ্দীন আহমদ দুদু মিয়া (১৮৪০ থেকে ১৮৬২)
- আব্দুল গফূর নয়া মিয়া (১৮৬২ থেকে ১৮৮৪)
- খাঁন বাহাদুর সৈয়দউদ্দীন আহমদ (১৮৮৪ থেকে ১৯০৬)
- রশীদউদ্দীন আহমদ বাদশাহ মিয়া (১৯০৬ থেকে ১৯৪৭)
সারসংক্ষেপ
ইংরেজ শাসন আমলে বাঙালি মুসলমানের রাজনৈতিক অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের সঙ্গে সঙ্গে নৈতিক অধঃপতনও ঘটে। ধর্মীয় ও সামাজিক জীবনে নানা ধরনের কুসংস্কার অনাচার প্রবেশ করে। এসব থেকে বাঙালি মুসলমানকে উদ্ধার এবং ইসলামের বিধান মতো তাদের পরিচালনার জন্যই হাজী শরীয়ত উল্লাহ ফরায়েজি আন্দোলন শুরু করেন। তাঁর মৃত্যু পর দুদু মিয়ার নেতৃত্বে এই আন্দোলন ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। তাঁর সময়ে এটি কৃষক আন্দোলনে রূপ নেয় এবং বিক্ষুব্ধ প্রতিরোধ আন্দোলন হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। কিন্তু তার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে যোগ্য নেতৃত্বের অভাবে আন্দোলনের পরিসমাপ্তি ঘটে।