১০:৫৯ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
                       

বই রিভিউ: লাল নীল দীপাবলি বা বাঙলা সাহিত্যের জীবনী

মু. মিজানুর রহমান মিজান
  • প্রকাশ: ০৪:২৭:৫৯ অপরাহ্ন, রবিবার, ৭ মার্চ ২০২১
  • / ৫৫৭৭ বার পড়া হয়েছে

"লাল নীল দীপাবলি বা বাঙলা সাহিত্যের জীবনী" | ছবি: ফাহমিদা নাজনীন


Google News
বিশ্লেষণ-এর সর্বশেষ নিবন্ধ পড়তে গুগল নিউজে যোগ দিন

বিশেষ শর্তসাপেক্ষে এবং স্বল্পমূল্যে এই ওয়েবসাইটটি সামাজিক কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ কিংবা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের নিকট বিক্রি করা হবে।

‘লাল নীল দীপাবলি’ হলো ১৯৭৬ সালে প্রকাশিত বাংলাদেশের প্রখ্যাত সাহিত্যিক হুমায়ুন আজাদের একটি অসামান্য বই। বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন যুগ অর্থাৎ ৯৫০ থেকে শুরু করে আধুনিককালের ১৯৫০ এর পূর্ব পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস সংক্ষেপে বলে গেছেন এ বইয়ে। এ দেশে সাহিত্যর যুগ শুরুর সময়টি উল্লেখের ক্ষেত্রে তিনি সুনীতিকুমারের মতকেই বেছে নেন। ছোট্ট এই বইটি তিনি লেখেন কিশোরদের বা কিশোর বয়সের আশেপাশে যারা রয়েছেন তাদেরকে মাথায় রেখে। যা কিছু আছে এখানে তা ‘লাল নীল দীপাবলি’ নামে ১৯৭৩ সালে ‘দৈনিক বাংলা’য় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ হয়। ১৯৯২ সালে এসে ‘লাল নীল দীপাবলি’র সাথে যুক্ত হয় ‘বাঙলা সাহিত্যের জীবনী’। এরপর থেকে বইটির নাম হয়ে যায় ‘লাল নীল দীপাবলি বা বাঙলা সাহিত্যের জীবনী’।

বই নিয়ে কথা বলতে গেলে বা বুক রিভিউ করতে গেলে বইটি বই যে বিষয়ের ওপর রচিত সে বিষয়ের ওপর গভীর চিন্তা করতে হয় এবং আশেপাশে খোঁজ নিয়ে সম্পর্কিত কিছু তথ্য জোগাড় করা জরুরি যেহেতু বিষয়বস্তু সম্পর্কে দুচারটে কথা লিখতে ও তুলনা করে দেখতে এটি প্রয়োজন। কিন্তু এই ‘লাল নীল দীপাবলি বা বাঙলা সাহিত্যের জীবনী’ বইটির সঠিকভাবে রিভিউ বা পর্যালোচনা করার জন্য প্রচুর পড়াশোনা করা প্রয়োজন যাকে আমি পিএইচডি করার সাথে তুলনা করতে পারি। সুতরাং, এই মুহুর্তে যারা আমার এই লেখাটি পড়ছেন তাঁদের বলে নিচ্ছি, এরকম একটি বই নিয়ে কথা বলার যোগ্যতা আমি রাখি না। তবে একজন সামান্য পাঠক হিসেবে বইটি নিয়ে আমার মধ্যে যে প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে তার কিছুটা প্রকাশ করছি মাত্র।

আমি হুমায়ুন আজাদের কোনো লেখা এর আগে পড়িনি তাই তাঁর সম্পর্কে কোনো ধারণা কোনো সময়েই ছিল না। যা ধারণা আছে তা অন্যের থেকে কুড়িয়ে পাওয়া। এই বইটি পড়ার পর আমি এই বিখ্যাত সাহিত্যিকের লেখার মোটামুটিভাবে একজন ভক্ত হয়ে গিয়েছি। প্রতিদিনের যোগাযোগে যেসব সহজ ও সরল শব্দ আমরা ব্যবহার করে থাকি সেসবের প্রয়োগে ছোটো ছোটো বাক্যে খুব সুন্দর করে তিনি বাংলা সাহিত্যের লাল নীল দীপাবলির খবর বলে গেছেন।

আমি যখন প্রথম বইটি হাতে নেই এবং বইয়ের প্রথম কয়েকটি লাইন পড়ি, তখনই বুঝতে পারি আমার মতো ধৈর্য্যহীন মানুষের জন্য উপযুক্ত একটি বই ‘লাল নীল দীপাবলি বা বাঙলা সাহিত্যের জীবনী’। আমি যখন একটি বাক্য পড়ছি ঠিক তখনই অন্য একটি লাইন পড়ার আগ্রহ জন্মেছে। এই আগ্রহের দুটি কারণ, ১. বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস জানার ইচ্ছে এবং ২. হুমায়ুন আজাদের লেখার শক্তি। তবে ইতিহাস বলে বইটি একটানা না পড়ে কিছুটা সময় নিয়ে পড়েছি।

আমি জানিনা হুমায়ুন আজাদের চেয়ে আরও সুন্দর করে সংক্ষেপে আরও কোনো লেখক বাংলা সাহিত্যের গল্প বলেছেন কি না অথবা তাঁর কাছাকাছি মানের কোনো বই আছে কি না। যদি থাকে তাহলে আমি তা পড়তে চাই।

লেখক বইটিতে যেমন বাংলার সাহিত্যের ইতিহাস তুলে ধরেছেন তেমনি কোন সময়ের সাহিত্য কেমন ছিল, কে কিভাবে লিখেছেন, যা লেখা হয়েছে তা কোন কোন বিষয় থেকে অনুপ্রাণিত, কার লেখার মান যুগ বিচারে কেমন ছিল সেসব তিনি অকপটে বলে গেছেন। তিনি যে এ বইটি লেখার জন্য প্রচুর গবেষণা করেছেন সে অস্বীকার কেউ করবে না।

এ বইয়ে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসতো রয়েছেই, পাশাপাশি বাঙালির পরিচয়ও অল্পের মধ্যে দারূণভাবে দিয়েছেন। বাঙালি দেখতে কেমন, এরা কেমন প্রকৃতির ইত্যাদি। লেখক লিখেছেন বাংলা ভাষার তিনস্তর যথা- প্রথম স্তর: ৯৫০ – ১২৫০, দ্বিতীয় স্তর: ১২৫০ – ১৩৫০ ও আধুনিক স্তর: ১৩৫০ – ১৮০০ সাল এবং বাংলা সাহিত্যের তিনযুগ, যথা- প্রাচীন: ৯৫০ – ১২০০, মধ্যযুগ: ১৩৫০ – ১৮০০ এবং আধুনিক যুগ: ১৮০০ থেকে চলমান নিয়ে।

লাল নীল দীপাবলি বা বাঙলা সাহিত্যের জীবনী প্রথম প্রচ্ছদ
হুমায়ুন আজাদ রচিত ১৯৯২ সালে প্রকাশিত লাল নীল দীপাবলি বা বাঙলা সাহিত্যের জীবনী গ্রন্থের প্রথম সংস্করণের প্রচ্ছদ

১২০০ থেকে ১৩৫০ পর্যন্ত আমরা যে সময়টিকে অন্ধকার যুগ বলি বাংলা সাহিত্যের জন্য, সে সময় নিয়ে অনেকেই বলেন হিন্দুদের হটিয়ে শাসন করার কর্তৃত্ব চলে যায় মুসলিমদের হাতে আর মুসলিম শাসকরা এই বাংলা ভাষা অপছন্দ করতেন। যারা এ ভাষায় সাহিত্য রচনা করতেন তাঁদের নির্যাতন করা হতো, মেরে ফেলা হতো। কিন্তু হুমায়ুন আজাদ সুন্দর করে বুঝিয়ে দিয়েছেন, মুসলমানরা এ দেশে এসেছে শাসন করার জন্য,  মানুষ মেরে ফেললে তাঁরা কাদের শাসন করবে। বরং মুসলিমরা বাংলার মানুষের কাছাকাছি আসার জন্য বা নিজেদের গ্রহনযোগ্যতা বাড়ানোর জন্য এদেশের মানুষদের বাংলায় সাহিত্য রচনায় উতসাহ দিতেন কিন্তু তখন সাহিত্য রচনা হতো মুখে মুখে, লিখে রাখার ব্যবস্থা ছিল না। তাই এই সময়ে যা কিছু রচিত হয়েছে তা কালের গহবরে হারিয়ে গেছে।

এরপরে লেখক যখন মধ্যযুগ নিয়ে লেখা শুরু করেন তখন স্বাভাবিকভাবেই বড়ু চণ্ডিদাসের ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ দিয়ে শুরু করেছেন। ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ মহাকাব্যের জন্য বড়ু চণ্ডীদাস বাংলা সাহিত্যের প্রথম মহাকবি বলে সবাই স্বীকার করেন, হুমায়ুন আজাদও তা বলেছেন। কিন্তু তিনি মধ্যযুগের এই মহাকবি বড়ু চণ্ডীদাসকে বলেছেন বাংলা সাহিত্যের প্রথম রবীন্দ্রনাথ। এটি আমার কাছে ভালো লাগেনি। একদিকে যেমন রবীন্দ্রনাথ মহাকবি নন আরেকদিকে চণ্ডিদাসের আগমন রবীন্দ্রনাথের বহু আগে, এ ব্যাপারে যুগ ও পরিবেশও তুলে আনা যায়।


বইটিতে পর্যায়ক্রমে বর্ণনা করা হয়েছে মঙ্গলকাব্য, বৈষ্ণব পদাবলী, প্রথমদিকের বিভিন্ন অনুবাদ সাহিত্য এবং শেষে যোগ হওয়া মুসলমান কবিদের নিয়ে। লেখক শুধু ইতিহাস বলেই নিজের দায়িত্ব সারেন নি। মাঝে মাঝে পিছনে ফেলে আসা সেই সাহিত্যের অংশবিশেষও তুলে ধরেছেন পাঠকদের কথা চিন্তা করে।  এই যেমন, মঙ্গলকাব্যের কালকেতু-ফুল্লরা কিংবা ভারতচন্দ্র রায় গুণাকরের রচিত সেই দেবি অন্নদার ঈশ্বরী পাটনীর নৌকায় নদী পার হওয়ার গল্পের কাব্য নিজের মতো করে সংক্ষেপে বর্ণনা করেছেন। তিনি কথা বলেছেন দেবি অন্নদার কাছে পাটনীর সেই প্রার্থনা, ‘আমার সন্তান যেনো থাকে দুধেভাতে’ সংলাপ নিয়ে।

কয়েকটি ভাষা যেমন, হিন্দি, বাংলা ও প্রাকৃত ভাষার সমন্বয়ে নিজেদের বানানো ব্রজবুলি নামক একটি মধুর ভাষায় রচিত বিদ্যাপতির কিছু অবদান সম্পর্কেও জানানো হয়। কারণ এ ভাষাটি ছিল বাংলার খুব কাছাকাছি এবং বিদ্যাপতিকে বাংলার কবি হিসেবেই ধরা হয়।

‘চণ্ডীদাস-সমস্যা’ বলে বাংলা সাহিত্যে যে বিশেষ সমস্যা রয়েছে তা নিয়ে কথা বলা হয়েছে এই বইয়ে। অল্প করে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয় তিনজন চণ্ডীদাসকে। একজন বড়ু চণ্ডীদাস, আরেকজন, দীন চণ্ডীদাস, আর তৃতীয়জন হলেন দ্বীজ চণ্ডীদাস। তিন চণ্ডীদাসকে নিয়ে খোলাসা করতে এসে আবারও বড়ু চণ্ডীদাসকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে তুলনা করেন, যা একদমই ভালো লাগে নি। কেন ভালো লাগেনি সে কথা উপরের দিকে বলেছি।

ধীরেধীরে হুমায়ুন আজাদ মধ্যযুগ পেরিয়ে আধুনিক যুগে প্রবেশ করেন। বাংলা সাহিত্যের এ যুগ নিয়ে অনেক কথা বলেন তিনি। কেমন করে আধুনিক যুগে এসে বাংলা সাহিত্য উন্নত হয়, গদ্যের আবির্ভাব, রাজা রামমোহন রায়ের গদ্যের ভিত গড়ে দেয়া, মাইকেল মধুসূদন দত্তের বাংলা সাহিত্যকে অনেক দূর পর্যন্ত এগিয়ে দেয়া যাকে তিনি বলেছেন ৫০০ বছর এগিয়ে দেয়ার সমান, এই যুগে কাঁদের হাত ধরে আমাদের সাহিত্য উন্নতিলাভ করে, এতে কার অবদান কেমন ছিল তা উল্লেখ করেন; বাংলা সাহিত্যে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের অবদানের কথাও বলতে ভোলেন নি। তিনি নাটক ও উপন্যাসের আগমন বিস্তার নিয়ে সুন্দর কিছু তথ্য উপস্থাপন করেছেন লেখার গতি ও সৌন্দর্য ঠিক রেখে। উপন্যাসকে হুমায়ুন আজাদ উল্লেখ করেছেন মানুষের মহাকাব্য বলে। প্যারীচাঁদ মিত্র থেকে বঙ্কিমচন্দ্র-রবীন্দ্রনাথ, মাথাতোলা প্রত্যেক ঔপন্যাসিকের কথা তিনি অল্প হলেও বলেছেন।

লাল নীল দীপাবলি বা বাঙলা সাহিত্যের জীবনী প্রচ্ছদ
লাল নীল দীপাবলি বা বাঙলা সাহিত্যের জীবনী। অ্যামাজন।

বাংলা সাহিত্যে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে বলা হয় গদ্যের জনক কিন্তু তিনি গদ্যের সূচনা করেন নি। যিনি বা যারা বাংলায় গদ্যের সূচনা করেছেন তাদের গদ্য নাকি খুবই নিম্নমানের ছিল তাই তাদের নাম উল্লেখ করা হয় না। উনিশ শতকের  দ্বিতীয় দশকে রামমোহন রায় বেশ কিছু গদ্যের বই লেখেন। অনেকেই তার গদ্যের প্রশংসা করেছেন, যারা প্রশংসা করেছেন তাদের মধ্যে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরও রয়েছেন। জন্ম না দিয়েও কারও পিতা হয়ে যাওয়ার বিষয়টি বড়োই অদ্ভুত আমার কাছে। প্রথম দিকে যারা গদ্য লেখার চেষ্টা চালিয়েছেন তাদের গদ্য মান সম্পন্ন না হওয়ায় তাদের কথা এখানে আসেনা। কিন্তু রামমোহন রায়ের ‘গদ্যের জনক’ খেতাব না পাওয়ায় কোন জিনিসটি ভূমিকা রাখতে পারে তা খুঁজে বের করা দরকার। আমার কাছে বিদ্যাসাগরকে গদ্যের জনক হিসেবে মেনে নিতে কষ্ট হয়। হুমায়ুন আজাদও এ নিয়ে তেমন কিছু বলেন নি, যা বলেছেনতা সবার মুখে মুখে রয়েছে।

রামমোহনের গদ্য খুবই জটিল, বোঝা যায় না অল্পতে, দাড়ি-কমার অভাব রয়েছে ইত্যাদি যুক্তি দিয়ে গদ্যের জনক হওয়ার মুকুট কেড়ে নেয়া ঠিক হয় নি সাহিত্যের মানুষদের। বিষয়টি এমনই যে, পিতা তার সন্তানকে জন্ম দিলেন কিন্তু পরে সেই সন্তানকে কেউ একটু বেশি আদর-যত্নের সাথে লালন পালন করে পিতার আসনে বসে গেলেন বির্যপাত ছাড়াই। যাইহোক এ নিয়ে আমার কিছু বলার নেই, ভাবেছিলাম হুমায়ুন আজাদের এই বইতে একটি ভালো আলোচনা বা সমালোচনা পাবো এ বিষয়ে, পূরণ হলো না আশা।

আধুনিক যুগের সাহিত্য নিয়ে কথা বলতে গিয়ে সব থেকে বেশি সময় নিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে। আজাদ রবি ঠাকুরকে তুলনা করেছেন প্রতিদিনের সূর্যের সাথে। সূর্য ছাড়া যেমন আমাদের চলে না তেমনি রবীন্দ্রনাথকেও ছাড়া বাংকা সাহিত্য চলে না, এমনই বলেছেন। রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে তিনি যা কিছু বলেছেন তা নিশ্চয়ই বলা দরকার। তবে মনে হয়েছে তাঁর কিছু কিছু কথা এরকম ছোট্ট একটি বইয়ে আনার অর্থ হলো দশ-পনেরো বা তারও বেশি লাইন বাড়ানো অথবা অতিভক্তি। পাশাপাশি রবীন্দ্রনাথ শেষ জীবনে স্রষ্টার প্রতি বিশ্বাস হারিয়ে ফেলে ছিলেন কি না এ বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন কবির জীবনের শেষ কবিতার ওপর করা মন্তব্যে। আন্দাজের ওপর ভর করে এমন একটি মন্তব্য করা কতটুকু যৌক্তিক বা জরুরি ছিল?- এই প্রশ্নটি আমি তাকে করতাম যদি তিনি আজ বেঁচে থাকতেন।

হুমায়ুন আজাদ তাঁর এই ‘লাল নীল দীপাবলি’তে কাজী নজরুল ইসলামকে আশ্রয় না দিতে পারলেই বরং খুশি হতেন, এ আমার বিশ্বাস। মাত্র ছয় লাইনে ৮ বাক্যে নজরুলবর্ণনা শেষ! তবে তাকে একজন মহাপদ্যকার বলতে কার্পণ্য করেন নি।

লাল নীল দীপাবলি প্রচ্ছদের পেছনের দিক
প্রচ্ছদের পেছনের দিক। অ্যামাজন

প্রাচীনযুগ থেকে শুরু করে আধুনিক যুগের বিশ শতকের প্রথম অর্ধেক পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন দিক খুব সুন্দর করে সাজিয়ে বর্ণনা করা হয়েছে। হুমায়ুন আজাদ বলেছেন এই বইটি তিনি কিশোরদের জন্য বা সদ্য কৈশোর পার করেছেন এরকম বয়সের মানুষের কথা ভেবে লিখেছেন যারা বাংলা সাহিত্যকে জানতে চায়। কিন্তু আমি মনে করি এ বইটি শুধু কিশোর বা কিশোরদের আশেপাশের বয়সের মানুষদের জন্যই নয়, এ বইটি প্রত্যেকেই পড়তে পারেন। যারা বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস জানতে চান বা এ নিয়ে পড়াশোনা করতে চান, তাঁদের শুরু হোক এই ‘লাল নীল দীপাবলি বা বাঙলা সাহিত্যের জীবনী’ বইটি পড়ার মাধ্যমে। আবার যারা বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের ব্যাপারে অনেক কিছুই জেনে নিয়েছেন তাঁরাও চোখ বুলিয়ে নিতে পারেন এটা দেখার জন্য যে, লাল নীল দীপাবলি কেমন আলো ছড়াচ্ছে।

বিষয়:

শেয়ার করুন

মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার তথ্য সংরক্ষিত রাখুন

লেখকতথ্য

মু. মিজানুর রহমান মিজান

মু. মিজানুর রহমান মিজান একজন স্বাধীন শিক্ষামূলক লেখক। তিনি শিক্ষা গবেষণায় বেশ আগ্রহী। যৌথভাবে কিছু গবেষণায়ও অংশ নিয়েছেন।

বিশেষ শর্তসাপেক্ষে এই ওয়েবসাইটটি সামাজিক কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ কিংবা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের নিকট বিক্রি করা হবে।

বই রিভিউ: লাল নীল দীপাবলি বা বাঙলা সাহিত্যের জীবনী

প্রকাশ: ০৪:২৭:৫৯ অপরাহ্ন, রবিবার, ৭ মার্চ ২০২১

‘লাল নীল দীপাবলি’ হলো ১৯৭৬ সালে প্রকাশিত বাংলাদেশের প্রখ্যাত সাহিত্যিক হুমায়ুন আজাদের একটি অসামান্য বই। বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন যুগ অর্থাৎ ৯৫০ থেকে শুরু করে আধুনিককালের ১৯৫০ এর পূর্ব পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস সংক্ষেপে বলে গেছেন এ বইয়ে। এ দেশে সাহিত্যর যুগ শুরুর সময়টি উল্লেখের ক্ষেত্রে তিনি সুনীতিকুমারের মতকেই বেছে নেন। ছোট্ট এই বইটি তিনি লেখেন কিশোরদের বা কিশোর বয়সের আশেপাশে যারা রয়েছেন তাদেরকে মাথায় রেখে। যা কিছু আছে এখানে তা ‘লাল নীল দীপাবলি’ নামে ১৯৭৩ সালে ‘দৈনিক বাংলা’য় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ হয়। ১৯৯২ সালে এসে ‘লাল নীল দীপাবলি’র সাথে যুক্ত হয় ‘বাঙলা সাহিত্যের জীবনী’। এরপর থেকে বইটির নাম হয়ে যায় ‘লাল নীল দীপাবলি বা বাঙলা সাহিত্যের জীবনী’।

বই নিয়ে কথা বলতে গেলে বা বুক রিভিউ করতে গেলে বইটি বই যে বিষয়ের ওপর রচিত সে বিষয়ের ওপর গভীর চিন্তা করতে হয় এবং আশেপাশে খোঁজ নিয়ে সম্পর্কিত কিছু তথ্য জোগাড় করা জরুরি যেহেতু বিষয়বস্তু সম্পর্কে দুচারটে কথা লিখতে ও তুলনা করে দেখতে এটি প্রয়োজন। কিন্তু এই ‘লাল নীল দীপাবলি বা বাঙলা সাহিত্যের জীবনী’ বইটির সঠিকভাবে রিভিউ বা পর্যালোচনা করার জন্য প্রচুর পড়াশোনা করা প্রয়োজন যাকে আমি পিএইচডি করার সাথে তুলনা করতে পারি। সুতরাং, এই মুহুর্তে যারা আমার এই লেখাটি পড়ছেন তাঁদের বলে নিচ্ছি, এরকম একটি বই নিয়ে কথা বলার যোগ্যতা আমি রাখি না। তবে একজন সামান্য পাঠক হিসেবে বইটি নিয়ে আমার মধ্যে যে প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে তার কিছুটা প্রকাশ করছি মাত্র।

আমি হুমায়ুন আজাদের কোনো লেখা এর আগে পড়িনি তাই তাঁর সম্পর্কে কোনো ধারণা কোনো সময়েই ছিল না। যা ধারণা আছে তা অন্যের থেকে কুড়িয়ে পাওয়া। এই বইটি পড়ার পর আমি এই বিখ্যাত সাহিত্যিকের লেখার মোটামুটিভাবে একজন ভক্ত হয়ে গিয়েছি। প্রতিদিনের যোগাযোগে যেসব সহজ ও সরল শব্দ আমরা ব্যবহার করে থাকি সেসবের প্রয়োগে ছোটো ছোটো বাক্যে খুব সুন্দর করে তিনি বাংলা সাহিত্যের লাল নীল দীপাবলির খবর বলে গেছেন।

আমি যখন প্রথম বইটি হাতে নেই এবং বইয়ের প্রথম কয়েকটি লাইন পড়ি, তখনই বুঝতে পারি আমার মতো ধৈর্য্যহীন মানুষের জন্য উপযুক্ত একটি বই ‘লাল নীল দীপাবলি বা বাঙলা সাহিত্যের জীবনী’। আমি যখন একটি বাক্য পড়ছি ঠিক তখনই অন্য একটি লাইন পড়ার আগ্রহ জন্মেছে। এই আগ্রহের দুটি কারণ, ১. বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস জানার ইচ্ছে এবং ২. হুমায়ুন আজাদের লেখার শক্তি। তবে ইতিহাস বলে বইটি একটানা না পড়ে কিছুটা সময় নিয়ে পড়েছি।

আমি জানিনা হুমায়ুন আজাদের চেয়ে আরও সুন্দর করে সংক্ষেপে আরও কোনো লেখক বাংলা সাহিত্যের গল্প বলেছেন কি না অথবা তাঁর কাছাকাছি মানের কোনো বই আছে কি না। যদি থাকে তাহলে আমি তা পড়তে চাই।

লেখক বইটিতে যেমন বাংলার সাহিত্যের ইতিহাস তুলে ধরেছেন তেমনি কোন সময়ের সাহিত্য কেমন ছিল, কে কিভাবে লিখেছেন, যা লেখা হয়েছে তা কোন কোন বিষয় থেকে অনুপ্রাণিত, কার লেখার মান যুগ বিচারে কেমন ছিল সেসব তিনি অকপটে বলে গেছেন। তিনি যে এ বইটি লেখার জন্য প্রচুর গবেষণা করেছেন সে অস্বীকার কেউ করবে না।

এ বইয়ে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসতো রয়েছেই, পাশাপাশি বাঙালির পরিচয়ও অল্পের মধ্যে দারূণভাবে দিয়েছেন। বাঙালি দেখতে কেমন, এরা কেমন প্রকৃতির ইত্যাদি। লেখক লিখেছেন বাংলা ভাষার তিনস্তর যথা- প্রথম স্তর: ৯৫০ – ১২৫০, দ্বিতীয় স্তর: ১২৫০ – ১৩৫০ ও আধুনিক স্তর: ১৩৫০ – ১৮০০ সাল এবং বাংলা সাহিত্যের তিনযুগ, যথা- প্রাচীন: ৯৫০ – ১২০০, মধ্যযুগ: ১৩৫০ – ১৮০০ এবং আধুনিক যুগ: ১৮০০ থেকে চলমান নিয়ে।

লাল নীল দীপাবলি বা বাঙলা সাহিত্যের জীবনী প্রথম প্রচ্ছদ
হুমায়ুন আজাদ রচিত ১৯৯২ সালে প্রকাশিত লাল নীল দীপাবলি বা বাঙলা সাহিত্যের জীবনী গ্রন্থের প্রথম সংস্করণের প্রচ্ছদ

১২০০ থেকে ১৩৫০ পর্যন্ত আমরা যে সময়টিকে অন্ধকার যুগ বলি বাংলা সাহিত্যের জন্য, সে সময় নিয়ে অনেকেই বলেন হিন্দুদের হটিয়ে শাসন করার কর্তৃত্ব চলে যায় মুসলিমদের হাতে আর মুসলিম শাসকরা এই বাংলা ভাষা অপছন্দ করতেন। যারা এ ভাষায় সাহিত্য রচনা করতেন তাঁদের নির্যাতন করা হতো, মেরে ফেলা হতো। কিন্তু হুমায়ুন আজাদ সুন্দর করে বুঝিয়ে দিয়েছেন, মুসলমানরা এ দেশে এসেছে শাসন করার জন্য,  মানুষ মেরে ফেললে তাঁরা কাদের শাসন করবে। বরং মুসলিমরা বাংলার মানুষের কাছাকাছি আসার জন্য বা নিজেদের গ্রহনযোগ্যতা বাড়ানোর জন্য এদেশের মানুষদের বাংলায় সাহিত্য রচনায় উতসাহ দিতেন কিন্তু তখন সাহিত্য রচনা হতো মুখে মুখে, লিখে রাখার ব্যবস্থা ছিল না। তাই এই সময়ে যা কিছু রচিত হয়েছে তা কালের গহবরে হারিয়ে গেছে।

এরপরে লেখক যখন মধ্যযুগ নিয়ে লেখা শুরু করেন তখন স্বাভাবিকভাবেই বড়ু চণ্ডিদাসের ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ দিয়ে শুরু করেছেন। ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ মহাকাব্যের জন্য বড়ু চণ্ডীদাস বাংলা সাহিত্যের প্রথম মহাকবি বলে সবাই স্বীকার করেন, হুমায়ুন আজাদও তা বলেছেন। কিন্তু তিনি মধ্যযুগের এই মহাকবি বড়ু চণ্ডীদাসকে বলেছেন বাংলা সাহিত্যের প্রথম রবীন্দ্রনাথ। এটি আমার কাছে ভালো লাগেনি। একদিকে যেমন রবীন্দ্রনাথ মহাকবি নন আরেকদিকে চণ্ডিদাসের আগমন রবীন্দ্রনাথের বহু আগে, এ ব্যাপারে যুগ ও পরিবেশও তুলে আনা যায়।


বইটিতে পর্যায়ক্রমে বর্ণনা করা হয়েছে মঙ্গলকাব্য, বৈষ্ণব পদাবলী, প্রথমদিকের বিভিন্ন অনুবাদ সাহিত্য এবং শেষে যোগ হওয়া মুসলমান কবিদের নিয়ে। লেখক শুধু ইতিহাস বলেই নিজের দায়িত্ব সারেন নি। মাঝে মাঝে পিছনে ফেলে আসা সেই সাহিত্যের অংশবিশেষও তুলে ধরেছেন পাঠকদের কথা চিন্তা করে।  এই যেমন, মঙ্গলকাব্যের কালকেতু-ফুল্লরা কিংবা ভারতচন্দ্র রায় গুণাকরের রচিত সেই দেবি অন্নদার ঈশ্বরী পাটনীর নৌকায় নদী পার হওয়ার গল্পের কাব্য নিজের মতো করে সংক্ষেপে বর্ণনা করেছেন। তিনি কথা বলেছেন দেবি অন্নদার কাছে পাটনীর সেই প্রার্থনা, ‘আমার সন্তান যেনো থাকে দুধেভাতে’ সংলাপ নিয়ে।

কয়েকটি ভাষা যেমন, হিন্দি, বাংলা ও প্রাকৃত ভাষার সমন্বয়ে নিজেদের বানানো ব্রজবুলি নামক একটি মধুর ভাষায় রচিত বিদ্যাপতির কিছু অবদান সম্পর্কেও জানানো হয়। কারণ এ ভাষাটি ছিল বাংলার খুব কাছাকাছি এবং বিদ্যাপতিকে বাংলার কবি হিসেবেই ধরা হয়।

‘চণ্ডীদাস-সমস্যা’ বলে বাংলা সাহিত্যে যে বিশেষ সমস্যা রয়েছে তা নিয়ে কথা বলা হয়েছে এই বইয়ে। অল্প করে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয় তিনজন চণ্ডীদাসকে। একজন বড়ু চণ্ডীদাস, আরেকজন, দীন চণ্ডীদাস, আর তৃতীয়জন হলেন দ্বীজ চণ্ডীদাস। তিন চণ্ডীদাসকে নিয়ে খোলাসা করতে এসে আবারও বড়ু চণ্ডীদাসকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে তুলনা করেন, যা একদমই ভালো লাগে নি। কেন ভালো লাগেনি সে কথা উপরের দিকে বলেছি।

ধীরেধীরে হুমায়ুন আজাদ মধ্যযুগ পেরিয়ে আধুনিক যুগে প্রবেশ করেন। বাংলা সাহিত্যের এ যুগ নিয়ে অনেক কথা বলেন তিনি। কেমন করে আধুনিক যুগে এসে বাংলা সাহিত্য উন্নত হয়, গদ্যের আবির্ভাব, রাজা রামমোহন রায়ের গদ্যের ভিত গড়ে দেয়া, মাইকেল মধুসূদন দত্তের বাংলা সাহিত্যকে অনেক দূর পর্যন্ত এগিয়ে দেয়া যাকে তিনি বলেছেন ৫০০ বছর এগিয়ে দেয়ার সমান, এই যুগে কাঁদের হাত ধরে আমাদের সাহিত্য উন্নতিলাভ করে, এতে কার অবদান কেমন ছিল তা উল্লেখ করেন; বাংলা সাহিত্যে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের অবদানের কথাও বলতে ভোলেন নি। তিনি নাটক ও উপন্যাসের আগমন বিস্তার নিয়ে সুন্দর কিছু তথ্য উপস্থাপন করেছেন লেখার গতি ও সৌন্দর্য ঠিক রেখে। উপন্যাসকে হুমায়ুন আজাদ উল্লেখ করেছেন মানুষের মহাকাব্য বলে। প্যারীচাঁদ মিত্র থেকে বঙ্কিমচন্দ্র-রবীন্দ্রনাথ, মাথাতোলা প্রত্যেক ঔপন্যাসিকের কথা তিনি অল্প হলেও বলেছেন।

লাল নীল দীপাবলি বা বাঙলা সাহিত্যের জীবনী প্রচ্ছদ
লাল নীল দীপাবলি বা বাঙলা সাহিত্যের জীবনী। অ্যামাজন।

বাংলা সাহিত্যে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে বলা হয় গদ্যের জনক কিন্তু তিনি গদ্যের সূচনা করেন নি। যিনি বা যারা বাংলায় গদ্যের সূচনা করেছেন তাদের গদ্য নাকি খুবই নিম্নমানের ছিল তাই তাদের নাম উল্লেখ করা হয় না। উনিশ শতকের  দ্বিতীয় দশকে রামমোহন রায় বেশ কিছু গদ্যের বই লেখেন। অনেকেই তার গদ্যের প্রশংসা করেছেন, যারা প্রশংসা করেছেন তাদের মধ্যে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরও রয়েছেন। জন্ম না দিয়েও কারও পিতা হয়ে যাওয়ার বিষয়টি বড়োই অদ্ভুত আমার কাছে। প্রথম দিকে যারা গদ্য লেখার চেষ্টা চালিয়েছেন তাদের গদ্য মান সম্পন্ন না হওয়ায় তাদের কথা এখানে আসেনা। কিন্তু রামমোহন রায়ের ‘গদ্যের জনক’ খেতাব না পাওয়ায় কোন জিনিসটি ভূমিকা রাখতে পারে তা খুঁজে বের করা দরকার। আমার কাছে বিদ্যাসাগরকে গদ্যের জনক হিসেবে মেনে নিতে কষ্ট হয়। হুমায়ুন আজাদও এ নিয়ে তেমন কিছু বলেন নি, যা বলেছেনতা সবার মুখে মুখে রয়েছে।

রামমোহনের গদ্য খুবই জটিল, বোঝা যায় না অল্পতে, দাড়ি-কমার অভাব রয়েছে ইত্যাদি যুক্তি দিয়ে গদ্যের জনক হওয়ার মুকুট কেড়ে নেয়া ঠিক হয় নি সাহিত্যের মানুষদের। বিষয়টি এমনই যে, পিতা তার সন্তানকে জন্ম দিলেন কিন্তু পরে সেই সন্তানকে কেউ একটু বেশি আদর-যত্নের সাথে লালন পালন করে পিতার আসনে বসে গেলেন বির্যপাত ছাড়াই। যাইহোক এ নিয়ে আমার কিছু বলার নেই, ভাবেছিলাম হুমায়ুন আজাদের এই বইতে একটি ভালো আলোচনা বা সমালোচনা পাবো এ বিষয়ে, পূরণ হলো না আশা।

আধুনিক যুগের সাহিত্য নিয়ে কথা বলতে গিয়ে সব থেকে বেশি সময় নিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে। আজাদ রবি ঠাকুরকে তুলনা করেছেন প্রতিদিনের সূর্যের সাথে। সূর্য ছাড়া যেমন আমাদের চলে না তেমনি রবীন্দ্রনাথকেও ছাড়া বাংকা সাহিত্য চলে না, এমনই বলেছেন। রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে তিনি যা কিছু বলেছেন তা নিশ্চয়ই বলা দরকার। তবে মনে হয়েছে তাঁর কিছু কিছু কথা এরকম ছোট্ট একটি বইয়ে আনার অর্থ হলো দশ-পনেরো বা তারও বেশি লাইন বাড়ানো অথবা অতিভক্তি। পাশাপাশি রবীন্দ্রনাথ শেষ জীবনে স্রষ্টার প্রতি বিশ্বাস হারিয়ে ফেলে ছিলেন কি না এ বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন কবির জীবনের শেষ কবিতার ওপর করা মন্তব্যে। আন্দাজের ওপর ভর করে এমন একটি মন্তব্য করা কতটুকু যৌক্তিক বা জরুরি ছিল?- এই প্রশ্নটি আমি তাকে করতাম যদি তিনি আজ বেঁচে থাকতেন।

হুমায়ুন আজাদ তাঁর এই ‘লাল নীল দীপাবলি’তে কাজী নজরুল ইসলামকে আশ্রয় না দিতে পারলেই বরং খুশি হতেন, এ আমার বিশ্বাস। মাত্র ছয় লাইনে ৮ বাক্যে নজরুলবর্ণনা শেষ! তবে তাকে একজন মহাপদ্যকার বলতে কার্পণ্য করেন নি।

লাল নীল দীপাবলি প্রচ্ছদের পেছনের দিক
প্রচ্ছদের পেছনের দিক। অ্যামাজন

প্রাচীনযুগ থেকে শুরু করে আধুনিক যুগের বিশ শতকের প্রথম অর্ধেক পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন দিক খুব সুন্দর করে সাজিয়ে বর্ণনা করা হয়েছে। হুমায়ুন আজাদ বলেছেন এই বইটি তিনি কিশোরদের জন্য বা সদ্য কৈশোর পার করেছেন এরকম বয়সের মানুষের কথা ভেবে লিখেছেন যারা বাংলা সাহিত্যকে জানতে চায়। কিন্তু আমি মনে করি এ বইটি শুধু কিশোর বা কিশোরদের আশেপাশের বয়সের মানুষদের জন্যই নয়, এ বইটি প্রত্যেকেই পড়তে পারেন। যারা বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস জানতে চান বা এ নিয়ে পড়াশোনা করতে চান, তাঁদের শুরু হোক এই ‘লাল নীল দীপাবলি বা বাঙলা সাহিত্যের জীবনী’ বইটি পড়ার মাধ্যমে। আবার যারা বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের ব্যাপারে অনেক কিছুই জেনে নিয়েছেন তাঁরাও চোখ বুলিয়ে নিতে পারেন এটা দেখার জন্য যে, লাল নীল দীপাবলি কেমন আলো ছড়াচ্ছে।