জীবনী: মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত
- প্রকাশ: ০৩:৩৫:০৫ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২২
- / ২৭৯৭৭ বার পড়া হয়েছে
মাইকেল মধুসূদন দত্ত (Michael Madhusudan Dutt) হলেন অন্যতম শ্রেষ্ঠ বাঙালি কবি এবং নাট্যকার ও প্রহসন রচয়িতা এবং বাংলার নবজাগরণ সাহিত্যের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব। মাইকেল মধুসূদন একজন মহাকবি, নাট্যকার, বাংলাভাষার সনেট প্রবর্তক এবং অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রবর্তক। ঐতিহ্যের অনুবর্তিতা অমান্য করে নব্যরীতি প্রবর্তনের কারণে মাইকেল মধুসূদন দত্তকে আধুনিক বাংলা সাহিত্যের প্রথম বিদ্রোহী কবি বলা হয়। তাকে ‘মধুকবি’ বলেও ডাকা হয়।
এখানে যা আছে
- জন্মপরিচয় ও শিক্ষাজীবন
- খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ ও ব্যক্তিজীবনে তার প্রভাব
- মাদ্রাজে মধুসূদন দত্ত: সাংবাদিকতা, সম্পাদনায় যুক্ত হওয়া, সাহিত্যচর্চা, বিয়ে ও বিভিন্ন ভাষায় দক্ষতা অর্জন
- সাহিত্যে মাইকেল মধুসূদন দত্ত
- বাংলায় লেখা শুরু যেভাবে
- বাংলায় উপযুক্ত নাটকের অভাববোধ
- পাশ্চাত্য রীতিতে ‘শর্মিষ্ঠা’ রচনা
- ১৮৫৯ সালে দুই প্রহসন: ‘একেই কি বলে সভ্যতা’ এবং ‘বুড়ো সালিকের ঘাড়ে রোঁ’
- প্রতবারেই নতুনত্ব এনেছেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত
- অমিত্রাক্ষর ছন্দ: পদ্মাবতী, তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য এবং পরে
- অমিত্রাক্ষর ছন্দেই মহাকাব্য ‘মেঘনাদবধ কাব্য’
- মধুসূদনের কাব্যে নারীবিদ্রোহ
- বাংলা থেকে ইংরেজি অনুবাদ
- বিলেত হয়ে ভার্সাই, ভার্সাই থেকে বাংলা সনেট
- বিলেত থেকে ফেরেন ব্যারিস্টার হয়ে, দেশে এসে হয়ে যান ঋণগ্রস্ত
- … তবু অব্যাহত থাকে সাহিত্যচর্চা
- যুগপ্রবর্ত কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত
- জীবনের অবসান
- এক নজরে মাইকেল মধুসূদন দত্তের সাহিত্যকর্ম
জন্মপরিচয় ও শিক্ষাজীবন
১৮২৪ সালের ২৫ জানুয়ারি ব্রিটিশ ভারতের (বর্তমান বাংলাদেশ) যশোর জেলার কপোতাক্ষ নদের তীরে সাগরদাঁড়ি গ্রামে, এক জমিদার বংশে মাইকেল মধুসূদন দত্ত জন্মগ্রহণ করেন। মধুসূদন দত্তের পিতার নাম রাজনারায়ণ দত্ত ছিলেন এবং মায়ের নাম জাহ্নবী দেবী। পিতা কলকাতার একজন প্রতিষ্ঠিত উকিল ছিলেন, আর তাই তাকে বেশির ভাগ সময়ই ব্যস্ত থাকতে হতো। পিতা ব্যস্ত থাকলেও মাতার তত্ত্বাবধানে মধুসূদনের শিক্ষারম্ভ হয়।
মধুসূদন দত্ত প্রথমে সাগরদাঁড়ির পাঠশালায় পড়াশোনা করেন। সাত বছর বয়সে মধুসূদন দত্ত কলকাতা যান এবং সেখানে খিদিরপুর স্কুলে দুই বছর পড়ার পর ১৮৩৩ সালে হিন্দু কলেজে ভর্তি হন।
মাইকেল মধুসূদন দত্ত হিন্দু কলেজে বাংলা, সংস্কৃত ও ফারসি ভাষা শেখেন। হিন্দু কলেজে অধ্যয়নকালেই মধুসূদনের প্রতিভার বিকাশ ঘটে।
১৮৩৪ সালে মধুসূদন দত্ত কলেজের পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে ইংরেজি ‘নাট্য-বিষয়ক প্রস্তাব’ আবৃত্তি করে উপস্থিত সকলের মনে জায়গা করে নেন।
হিন্দু কলেজে মধুসূদন দত্তের যে সকল সহপাঠী ছিলেন তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকজন— ভূদেব মুখোপাধ্যায়, রাজেন্দ্রলাল মিত্র, রাজনারায়ণ বসু, গৌরদাস বসাক প্রমুখ; এঁদের প্রত্যেকেই স্বস্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। এখানে উল্লেখকৃত প্রত্যেকেই নিজ নিজ জায়গা থেকে উজ্জ্বল ছিলেন, তবে মধুসূদন উজ্জ্বলতম জ্যোতিষ্ক হিসেবে পরিচিত ছিলেন। কলেজের পরীক্ষায় তিনি বরাবর বৃত্তি পেতেন। এ সময় ‘নারীশিক্ষা’ বিষয়ে প্রবন্ধ রচনা করে তিনি স্বর্ণপদক লাভ করেন।
১৮৪৪ সালে মাইকেল মধুসূদন দত্ত বিশপ্স কলেজে ভর্তি হন এবং ১৮৪৭ পর্যন্ত ওই কলেজে অধ্যয়ন করেন। বিশপ্স কলেজে মধুসূদন ইংরেজি ছাড়াও গ্রিক, ল্যাটিন ও সংস্কৃত ভাষা শেখার সুযোগ পান। পরবর্তীতে বিলেতে ব্যারিস্টারি সম্পন্ন করেন।
খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ ও ব্যক্তিজীবনে তার প্রভাব
মধুসূদন দত্ত ইংরেজি সাহিত্যের প্রতি টান থেকেই ফেব্রুয়ারি ৯, ১৮৪৩ সালে খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করেন এবং সেই থেকেই তাঁর নামের পূর্বে ‘মাইকেল’ শব্দটি যুক্ত হয়।
হিন্দু কলেজে খ্রিষ্টানদের অধ্যয়ন নিষিদ্ধ ছিল, আর তাই মধুসূদনকে কলেজ ত্যাগ করতে হয়। ১৮৪৪ সালে মাইকেল মধুসূদন দত্ত বিশপ্স কলেজে ভর্তি হন।
এ সময় ধর্মান্তরের কারণে মধুসূদন তাঁর আত্মীয়স্বজনদের নিকট থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। তাঁর পিতাও এক সময় অর্থ পাঠানো বন্ধ করে দেন। অগত্যা মধুসূদন ভাগ্যান্বেষণে ১৮৪৮ সালে মাদ্রাজ গমন করেন। সেখানে তিনি দীর্ঘদিন শিক্ষকতা করেন। প্রথমে মাদ্রাজ মেইল অরফ্যান অ্যাসাইলাম স্কুলে (১৮৪৮-১৮৫২) এবং পরে মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত হাইস্কুলে শিক্ষকতা (১৮৫২-১৮৫৬) করেন।
মাদ্রাজে মধুসূদন দত্ত: সাংবাদিকতা, সম্পাদনায় যুক্ত হওয়া, সাহিত্যচর্চা, বিয়ে ও বিভিন্ন ভাষায় দক্ষতা অর্জন
খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণের ফলে স্বজনরা মাইকেল মধুসূদন দত্তকে দূরে ঠেলে দেয়। আর তাই নিজের পাঠ্যপুস্তক বিক্রি করে সেই অর্থ দিয়ে ভাগ্যের সন্ধানে মধুসূদন মাদ্রাজ গেলে সেখানে মধুসূদনের জীবনে গুরুত্বপূর্ণ কিছু ঘটনা ঘটে। মাদ্রাজে বসবাসের সময় থেকেই মাইকেল মধুসূদন দত্ত সাংবাদিক ও কবি হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।
মাইকেল মধুসূদন দত্ত Eurasion (পরে Eastern Guardian), Madras Circulator and General Chronicle ও Hindu Chronicle পত্রিকা সম্পাদনা করেন এবং Madras Spectator-এর সহকারী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন (১৮৪৮-১৮৫৬)।
মাদ্রাজে অবস্থানকালে মাইকেল মধুসূদন দত্ত ‘Timothy Penpoem’ ছদ্মনামে তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘The Captive Ladie’ (১৮৪৮) এবং দ্বিতীয় গ্রন্থ ‘Visions of the Past’ লেখেন।
মাদ্রাজে অবস্থানকালেই মাইকেল মধুসূদন প্রথম ও দ্বিতীয় বিবাহ করেন। তাঁর প্রথম স্ত্রীর নাম রেবেকা ও দ্বিতীয় স্ত্রীর নাম হেনরিয়েটা।
মাদ্রাজে বসেই তিনি হিব্রু, ফরাসি, জার্মান, ইটালিয়ান, তামিল ও তেলেগু ভাষা শিক্ষা করেন।
পিতা ও মাতার মৃত্যুর পেয়ে ১৮৫৬ সালে মধুসূদন দত্ত দ্বিতীয় স্ত্রী হেনরিয়েটাকে নিয়ে কলকাতায় ফেরেন। কলকাতায় আসার পরে প্রথমে পুলিশ কোর্টের কেরানি এবং পরে দোভাষীর কাজ করেন। এ সময় বিভিন্ন পত্রিকায় প্রবন্ধ লিখেও তিনি প্রচুর অর্থোপার্জন করেন।
সাহিত্যে মাইকেল মধুসূদন দত্ত
হিন্দু কলেজে অধ্যয়নের সময়েই মধুসূদন কাব্যচর্চা শুরু করেন। তখন তাঁর কবিতা জ্ঞানান্বেষণ, Bengal Spectator, Literary Gleamer, Calcutta Library Gazette, Literary Blossom, Comet প্রভৃতি পত্রিকায় প্রকাশিত হতো।
মধুসূদন দত্ত মনে করতেন যে, বিলেতে গেলেই বড়ো মানের কবি হওয়া সম্ভব। আর তাই তিনি হিন্দু কলেজের ছাত্র থাকা সময় থেকেই স্বপ্ন দেখতেন বিলেত যাওয়ার। তিনি বিখ্যাত ইংরেজি কবি হতে চেয়েছিলেন, আর তাই শুরুর দিকে ইংরেজিতেই সাহিত্যচর্চা করতেন।
মধুসূদন দত্ত ইংরেজি সাহিত্যের প্রতি টান থেকে ফেব্রুয়ারি ৯, ১৮৪৩ সালে খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করেন। স্বজনরা তাঁকে দূরে ঠেলে দিলে ভাগ্যের সন্ধানে মাদ্রাজ যান। সেখানে গিয়ে তিনি সাংবাদিকতায় যোগ দেন এবং ইংরেজিতে কাব্যচর্চা করতে থাকেন। সেখানে বসে তিনি ‘Timothy Penpoem’ ছদ্মনামে তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘The Captive Ladie’ (১৮৪৮) এবং দ্বিতীয় গ্রন্থ ‘Visions of the Past’ লেখেন।
এগুলোর বাইরে মাইকেল মধুসূদন দত্ত কিছু ইংরেজি পত্রিকা সম্পাদনা করেন, পত্রিকাগুলোর নাম নিচে উল্লেখ করা হলো—
- Eurasion (পরে Eastern Guardian),
- Madras Circulator and General Chronicle
- Hindu Chronicle
- Hindu Patriot (১৯৬২)
বাংলায় লেখা শুরু যেভাবে
ইংরেজি পত্রিকায় প্রবন্ধ লিখে মাইকেল মধুসূদন দত্ত প্রচুর অর্থ উপার্জন করলে পরবর্তীতে বাংলায় সাহিত্য চর্চা করে বিখ্যাত হয়েছেন। ইংরেজিতে তিনি প্রবন্ধ লিখতেন বেশ। কিন্তু তাঁর বন্ধুবান্ধবরা ওই সময় তাঁকে বাংলায় সাহিত্যচর্চা করতে অনুরোধ জানান এবং তিনি নিজেও ভেতর থেকে এরূপ একটি তাগিদ অনুভব করেন। এই তাগিদ থেকেই তিনি বাংলা ভাষায় সাহিত্য রচনা শুরু করেন
বাংলায় উপযুক্ত নাটকের অভাববোধ
মাইকেল মধুসূদন দত্ত তাঁর বন্ধুবান্ধব বা কাছের মানুষদের অনুরোধে বাংলা ভাষায় লেখার প্রতি আগ্রহী হন, এ কথা সত্য। আবার তিনি নিজেও বাংলায় লেখার প্রয়োজনীয়তা বুঝতে পারেন।
মাইকেল মধুসূদন দত্ত যখন রামনারায়ণ তর্করত্নের রত্নাবলী (১৮৫৮) নাটক ইংরেজিতে অনুবাদ করেন তখন তিনি বুঝতে পারেন যে, বাংলা নাট্যসাহিত্যে উপযুক্ত নাটকের অভাব রয়েছে; এখান থেকেই তাঁর মধ্যে বাংলায় নাটক রচনার সংকল্প জাগে।
পাশ্চাত্য রীতিতে ‘শর্মিষ্ঠা’ রচনা
বাংলা নাটক লেখার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলে মাইকেল মধুসূদন দত্ত কলকাতার পাইকপাড়ার রাজাদের বেলগাছিয়া থিয়েটারের সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়েন। এমন একটি পরিস্থিতিতে নাট্যকার হিসেবেই মধুসূদনের বাংলা সাহিত্যাঙ্গনে পদার্পণ ঘটে। ১৮৫৮ সালে মধুসূদন দত্ত মহাভারতের দেবযানী-যযাতি কাহিনী অবলম্বনে পাশ্চাত্য রীতিতে রচনা করেন ‘শর্মিষ্ঠা’ নাটক।
‘শর্মিষ্ঠা’ হলো প্রকৃত অর্থে বাংলা ভাষায় রচিত প্রথম মৌলিক নাটক এবং একই অর্থে মধুসূদনও বাংলা সাহিত্যের প্রথম নাট্যকার। অর্থাৎ, বাংলা ভাষায় রচিত প্রথম প্রকৃত মৌলিক নাটক ‘শর্মিষ্ঠা’ এবং বাংলা সাহিত্যের প্রথম প্রথম মৌলিক নাট্যকার মাইকেল মধুসূদন দত্ত।
১৮৫৯ সালে দুই প্রহসন: ‘একেই কি বলে সভ্যতা’ এবং ‘বুড়ো সালিকের ঘাড়ে রোঁ’
‘শর্মিষ্ঠা’ প্রকাশিত হওয়ার পরের বছর অর্থাৎ ১৮৫৯ সালে মধুসূদন রচনা করেন দুইটি প্রহসন— ‘একেই কি বলে সভ্যতা’ ও ‘বুড়ো সালিকের ঘাড়ে রোঁ’।
‘একেই কি বলে সভ্যতা’ নাটকে মাইকেল মধুসূদন দত্ত ইংরেজি শিক্ষিত ইয়ং-বেঙ্গলদের মাদকাসক্তি, উচ্ছৃঙ্খলতা ও অনাচারকে কটাক্ষ করেন এবং ‘বুড়ো সালিকের ঘাড়ে রোঁ’ নাটকে রক্ষণশীল হিন্দু সমাজের আচারসর্বস্ব ও নীতিভ্রষ্ট সমাজপতিদের গোপন লাম্পট্য তুলে ধরেন। এ ক্ষেত্রেও মধুসূদন পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেন।
অর্থাৎ, বাংলা সাহিত্যের প্রথম প্রহসন হলো মাইকেল মধুসূদন দত্ত রিচিত ‘একেই কি বলে সভ্যতা’ ও ‘বুড়ো সালিকের ঘাড়ে রোঁ’, এগুলো প্রকাশিত হয় ১৮৫৯ সালে।
মধুসূদন দত্তের লেখা প্রহসন দুইটি কাহিনী, সংলাপ ও চরিত্রসৃষ্টির দিক থেকে আজও অতুলনীয়।
প্রতবারেই নতুনত্ব এনেছেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত
মাইকেল মধুসূদন দত্তের কৃতিত্ব শুধু প্রথম সার্থক নাটক কিংবা প্রহসন রচনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। তিনি যা কিছু রচনা করেছেন তাতেই নতুনত্ব এনেছেন। মধুসূদন দত্ত বাংলা সাহিত্যে প্রথম পাশ্চাত্য সাহিত্যের আদর্শ সার্থকভাবে প্রয়োগ করেন। তখনকার বাংলা সাহিত্যে রচনার শৈলীগত এবং বিষয়ভাবনাগত যে আড়ষ্টতা ছিল, মধুসূদন তা অসাধারণ প্রতিভা ও দক্ষতাগুণে দূরীভূত করেন।
অমিত্রাক্ষর ছন্দ: পদ্মাবতী, তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য এবং পরে
১৮৬০ সালে মাইকেল মধুসূদন দত্ত গ্রিক পুরাণ থেকে কাহিনী নিয়ে রচনা করেন ‘পদ্মাবতী’ নাটক। এ ‘পদ্মাবতী’ নাটকেই মধুসূদন দত্ত প্রথম ও পরীক্ষামূলকভাবে ইংরেজি কাব্যের অনুকরণে অমিত্রাক্ষর ছন্দ ব্যবহার বরেন।
বাংলা কাব্যে অমিত্রাক্ষর ছন্দের ব্যবহার এটাই প্রথম এবং এর ফলে তিনি বাংলা কাব্যকে ছন্দের বন্ধন থেকে মুক্তি দেন। বাংলা কাব্যে অমিত্রাক্ষর ছন্দের ব্যবহারে এই সফলতা তাঁকে ভীষণভাবে উৎসাহিত করে। ১৮৬০ সালেই অমিত্রাক্ষর ছন্দে মাইকেল মধুসূদন দত্ত পুনরায় রচনা করেন ‘তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য’।
অমিত্রাক্ষর ছন্দেই মহাকাব্য ‘মেঘনাদবধ কাব্য’
অমিত্রাক্ষর ছন্দে কাব্য রচনা করে বিভিন্ন মহলে প্রশংসা পেয়ে ১৮৬১ সালে আরেক মহাকাব্য ‘রামায়ণ‘ অবলম্বনে একই ছন্দে মাইকেল মধুসূদন দত্ত রচনা করেন তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তি মহাকাব্য ‘মেঘনাদবধ কাব্য’।
‘মেঘনাদবধ কাব্য’ হলো বাংলা ভাষায় রচিত প্রথম মৌলিক মহাকাব্য এবং মাইকেল মধুসূদন দত্ত বাংলা সাহিত্যের প্রথম মহাকবি।
মধুসূদন দত্ত যদি জীবনে আর কোনো রচনা না লিখতেন তাহলেও তিনি ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ মহাকব্যের জন্য অমর হয়ে থাকতে পারতেন।
‘মেঘনাদবধ কাব্য’ রচনার মাধ্যমেই মাইকেল মধুসূদন দত্ত মহাকবির মর্যাদা লাভ করেন এবং তাঁর নব আবিষ্কৃত অমিত্রাক্ষর ছন্দও বাংলা সাহিত্যে প্রতিষ্ঠা লাভ করে।
রামায়ণে বর্ণিত অধর্মাচারী, অত্যাচারী ও পাপী রাবণকে একজন দেশপ্রেমিক, বীর যোদ্ধা ও বিশাল শক্তির আধাররূপে চিত্রিত করে মধুসূদন উনিশ শতকের বাঙালির নবজাগরণের শ্রেষ্ঠ কবির মর্যাদা লাভ করেন। এক্ষেত্রে তিনি ভারতবাসীর চিরাচরিত বিশ্বাসের মূলে আঘাত হেনে প্রকৃত সত্য সন্ধান ও দেশপ্রেমের যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন, বাংলা সাহিত্যে তা তুলনাহীন।
‘মেঘনাদবধ কাব্য’ মাইকেল মধুসূদন দত্তের শ্রেষ্ঠ সাহিত্যকর্ম। মাইকেল মধুসূদন দত্ত বাংলা মহাকাব্যের জনক।
মধুসূদনের কাব্যে নারীবিদ্রোহ
মাইকেল মধুসূদন দত্তের কাব্যে এক ধরনের নারীবিদ্রোহের সুর লক্ষ করা যায়। মধুসূদন দত্তের কাব্যের নায়িকাদের মধ্য দিয়ে যেন যুগ যুগ ধরে বঞ্চিত, অবহেলিত, আত্ম সুখ-দুঃখ প্রকাশে অনভ্যস্ত ও ভীত ভারতীয় নারীরা হঠাৎ আত্মসচেতন হয়ে জেগে ওঠে।
মধুকবির নায়িকারা পুরুষের নিকট নিজেদের ভালো-মন্দ, সুখ-দুঃখ এবং কামনা-বাসনা প্রকাশে হয়ে ওঠে প্রতিবাদী। মধুসুদন দত্তের লেখা ‘বীরাঙ্গনা’ কাব্যের নায়িকাদের দিকে তাকালে এ কথার সত্যতা উপলব্ধি করা যাবে।
‘বীরাঙ্গনা’ কাব্যের জনা, কৈকেয়ী, তারা প্রমুখ পৌরাণিক নারী তাদের স্বামী বা প্রেমিকদের নিকট নিজেদের কামনা-বাসনা ও চাওয়া-পাওয়ার কথা নির্ভীকচিত্তে প্রকাশ করে।
উল্লেখ্য, ‘বীরাঙ্গনা’ হলো মাইকেল মধুসূদন দত্তের লেখা একটি পত্রকাব্য, এটি প্রকাশিত হয় ১৮৬২ সালে।
নারীচরিত্রে এরূপ বিদ্রোহের প্রকাশ বাংলা সাহিত্যে মধুসূদনের আগে আর কারও রচনায় প্রত্যক্ষ করা যায় না। মাইকেল মধুসূদন দত্তের এ সময়কার অপর দুটি রচনা হলো ‘কৃষ্ণকুমারী’ ও ‘ব্রজাঙ্গনা’।
‘কৃষ্ণকুমারী’ ১৮৬১ সালে প্রকাশিত রাজপুত উপাখ্যান অবলম্বনে রচিত একটি বিয়োগান্তক নাটক, এবং ‘ব্রজাঙ্গনা’ হলো রাধাকৃষ্ণ বিষয়ক গীতিকাব্য, এটিও ১৮৬১ সালে প্রকাশিত হয়।
বাংলা থেকে ইংরেজি অনুবাদ
মাইকেল মধুসূদন দত্ত যখন রামনারায়ণ তর্করত্নের রত্নাবলী নাটক এবং দীনবন্ধু মিত্রের ‘নীলদর্পণ’ নাটক ইংরেজিতে অনুবাদ করেন।
বিলেত হয়ে ভার্সাই, ভার্সাই থেকে বাংলা সনেট
১৮৬২ সালের ৯ জুন মাইকেল মধুসূদন দত্ত ব্যারিস্টারি পড়ার উদ্দেশ্যে বিলেত যান এবং গ্রেজ-ইন-এ যোগদান করেন।
সেখান থেকে ১৮৬৩ সালে মধুসূদন প্যারিস হয়ে ভার্সাই নগরীতে যান এবং সেখানে প্রায় দুবছর অবস্থান করেন। মধুকবির ভার্সাই নগরিতে অবস্থানকালে তাঁর জীবনে দুটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে— ১. মাতৃভূমি ও মাতৃভাষার গুরুত্ব ও টান বুঝতে পারেন, ভার্সাই থেকেই তিনি যেন মাতৃভূমি ও মাতৃভাষাকে নতুনভাবে এবং একান্ত আপনভাবে দেখতে ও বুঝতে পারেন; ২. ইতালিয় কবি পেত্রার্কের পেত্রার্কের অনুকরণে বাংলায় সনেট লিখতে শুরু করেন।
ফ্রান্সের ভার্সাই নগরিতে বসে রচনা করেন বাংলা সাহিত্যের প্রথম সনেট ‘বঙ্গভাষা’। এছাড়া তিনি ‘কপোতাক্ষ নদ’ ও আরও কিছু সনেট লেখেন এই সময়ে। মাইকেল মধুসূদন দত্তের সনেটগুলি ১৮৬৬ সালে ‘চতুর্দশপদী কবিতাবলী’ নামে প্রকাশিত হয়।
মাইকেল মধুসূদন দত্ত বাংলা ভাষায় প্রথম সনেট রচনা করেন, তাই তাকে বাংলা সনেটের জনক বলা হয়। সনেট রচনায় মধুসূদন ইতালির পেত্রার্ককে অনুসরণ করেন।
বিলেত থেকে ফেরেন ব্যারিস্টার হয়ে, দেশে এসে হয়ে যান ঋণগ্রস্ত
১৮৬২ সালের ৯ জুন মাইকেল মধুসূদন দত্ত ব্যারিস্টারি পড়ার উদ্দেশ্যে বিলেত যান এবং গ্রেজ-ইন-এ যোগদান করেন। সেখান থেকে প্যারিস হয়ে চলে যান ভার্সাই নগরীতে। ভার্সাই নগরিতে দুই বছর থাকার পর মধুসূদন ১৮৬৫ সালে পুনরায় ইংল্যান্ড যান এবং ১৮৬৬ সালে গ্রেজ-ইন থেকে ব্যারিস্টারি পাস করেন।
১৮৬৭ সালের ৫ জানুয়ারি দেশে ফিরে তিনি কলকাতা হাইকোর্টে আইন ব্যবসায় যোগ দেন। কিন্তু ওকালতিতে খুব একটা সুবিধে করতে পারেননি, আর তাই ১৮৭০ সালের জুন মাসে মাসিক এক হাজার টাকা বেতনে হাইকোর্টের অনুবাদ বিভাগে যোগদান করেন।
হাইকোর্টের অনুবাদ বিভাগে যোগদানের দুই বছরের মাথায় এ চাকরি ছেড়ে তিনি পুনরায় আইন ব্যবসা শুরু করেন এবং সফল হন। কিন্তু অমিতব্যয়িতার কারণে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েন। অমিতব্যয়িতার ব্যাপারটি ছিল তাঁর স্বভাবগত।
স্বভাবগত অমিতব্যয়ীতার কারণে মাইকেল মধুসূদন দত্ত বিদেশে অবস্থানকালেও একবার বিপদগ্রস্ত হয়েছিলেন এবং ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের আনুকূল্যে সেবার উদ্ধার পান। বিপদে এগিয়ে আসার কারণে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে মাইকেল মধুসূদন দত্ত ‘করুণাসাগর’ নামে অ্যাখ্যা দিয়েছেন। এ নিয়ে ‘মাইকেল-বিদ্যাসাগর সংবাদ’ শিরোনামে গান রচনা করেছেন ভারতের অনুপম রায়।
১৮৭২ সালে মধুসূদন কিছুদিন পঞ্চকোটের রাজা নীলমণি সিংহ দেও-এর ম্যানেজার ছিলেন।
বাংলার এই মহান কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত শেষজীবন অত্যন্ত দুঃখ-দারিদ্রের মধ্যে কেটেছে। ঋণের দায়, অর্থাভাব, অসুস্থতা, চিকিৎসাহীনতা ইত্যাদি কারণে তাঁর জীবন হয়ে উঠেছিল দুর্বিষহ। শেষজীবনে তিনি উত্তরপাড়ার জমিদারদের লাইব্রেরি ঘরে বসবাস করতেন।
… তবু অব্যাহত থাকে সাহিত্যচর্চা
জীবনের এই টানাপোড়েনের মধ্য দিয়েও মধুসূদন কাব্যচর্চা অব্যাহত রাখেন। হোমারের ‘ইলিয়াড’ অবলম্বনে ১৮৭১ সালে মাইকেল মধুসূদন দত্ত রচনা করেন ‘হেক্টরবধ’।
মাইকেল মধুসূদন দত্তের শেষ রচনা ‘মায়াকানন’। ‘মায়াকানন’ একটি নাটক, যা প্রকাশিত হয় ১৮৭৩ সালে।
বাংলা ভাষায় প্রকাশিত মাইকেল মধুসূদন দত্তের মৌলিক গ্রন্থ ১২ টি এবং ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত মৌলিক গ্রন্থ ৫টি, এছাড়া অন্যান্য গ্রন্থ রয়েছে।
যুগপ্রবর্ত কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত
মধুসূদন ছিলেন বাংলা সাহিত্যের যুগপ্রবর্তক কবি। তিনি তাঁর কাব্যের বিষয় সংগ্রহ করেছিলেন প্রধানত সংস্কৃত কাব্য থেকে, কিন্তু পাশ্চাত্য সাহিত্যের আদর্শ অনুযায়ী সমকালীন ইংরেজি শিক্ষিত বাঙালির জীবনদর্শন ও রুচির উপযোগী করে তিনি তা কাব্যে রূপায়িত করেন এবং তার মধ্য দিয়েই বাংলা সাহিত্যে এক নবযুগের সূচনা হয়। উনিশ শতকের বাঙালি নবজাগরণের অন্যতম পথিকৃৎ মধুসূদন তাঁর অনন্যসাধারণ প্রতিভার দ্বারা বাংলা ভাষার অন্তর্নিহিত শক্তি আবিষ্কার করে এই ভাষা ও সাহিত্যের যে উৎকর্ষ সাধন করেন, এরফলেই তিনি বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন। বাংলা সাহিত্যে তিনি ‘মধুকবি’ নামে পরিচিত।
জীবনের অবসান
বাংলা সাহিত্যের মহান কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের শেষজীবন সুখের ছিল না। অত্যন্ত দুঃখ-দারিদ্রের মাঝে কেটেছে শেষ কয়েকটা বছর। থাকার যায়গা ছিল না, ঘুমোতেন অন্যের লাইব্রেরি ঘরে।
স্ত্রী হেনরিয়েটার মৃত্যুর তিনদিন পরে ১৮৭৩ সালের ২৯ জুন বাংলার প্রথম মহাকবি কপর্দকহীন অবস্থায় জেনারেল হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন; শেষ হয় একটি মহাকব্যিক অধ্যায়ের।
এক নজরে মাইকেল মধুসূদন দত্তের সাহিত্যকর্ম
- বাংলা রচনা
- নাটক ও প্রহসন
- শর্মিষ্ঠা নাটক (১৮৫৯)
- একেই কি বলে সভ্যতা? (১৮৬০)
- বুড়ো সালিকের ঘাড়ে রোঁ (১৮৬০)
- পদ্মাবতী নাটক (১৮৬০)
- কৃষ্ণকুমারী নাটক (১৮৬১)
- মায়া-কানন (১৮৭৪)
- নাটক ও প্রহসন
- কাব্য
- তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য (১৮৬০)
- ব্রজাঙ্গনা কাব্য (১৮৬১)
- বীরাঙ্গনা কাব্য (১৮৬২)
- চতুর্দশপদী কবিতাবলী (১৮৬৫)
- মহাকাব্য
- মেঘনাদবধ কাব্য (১৮৬১)
- ইংরেজি থেকে বাংলায় অনুবাদ গ্রন্থ
- হেক্টর-বধ (১৮৭১)
- ইংরেজি রচনা
- কাব্য
- কালেক্টেড পোয়েমস (Collected Poems)
- দি অপ্সরি: আ স্টোরি ফ্রম হিন্দু মিথোলজি (The Apsari: A Story from Hindu Mythology)
- দ্য ক্যাপটিভ লেডি, ১৮৪৯ (The Captive Ladie, 1849)
- ভিশনস অব দ্য পাস্ট, ১৮৪৯ (Visions of the Past, published in 1849)
- কাব্যনাট্য
- রিজিয়া: ইমপ্রেস অফ ইন্ডে
- কাব্য
- ইংরেজিতে অনুবাদ নাটক
- রামনারায়ণ তর্করত্নের ‘রত্নাবলী’
- ‘ দি ইন্ডিগো প্ল্যান্টিং মিরর’মধুসূদন (দীনবন্ধু মিত্রের ‘নীলদর্পণ’-এর অনুবাদ)
- প্রবন্ধ সাহিত্য
- দি অ্যাংলো-স্যাক্সন অ্যান্ড দ্য হিন্দু
- অন পোয়েট্রি এটসেট্রা
- অ্যান এসে
- অন্যান্য রচনা
- আ সাইনপসিস অফ দ্য রুক্মিণী হরণ নাটক