একটি নিউরনের ‘স্নায়ু আবেগ’ সৃষ্টির গল্প
- প্রকাশ: ১২:৫৭:০৪ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২৫ মে ২০২২
- / ২০৫০ বার পড়া হয়েছে
বিশ্বরচনার প্রধান উপকরণ হচ্ছে যেমন পরমাণু, তেমনি সেই পরমাণু দিয়েই সংহত করেছে জীবকোষগুলিকে এক বিশেষ নিয়মে। দেহক্রিয়ার একটি কর্তব্যবিভাগ হচ্ছে স্নায়ুতন্ত্র। তারই এক বিষয় নিয়ে পর্যালোচনা করবো আমার এই প্রবন্ধে। জানিনা কী করে একটি স্নায়ুক্রিয়ার এমন কর্তব্য বংশ্ববলীক্রমে ক্লান্তিহীনভাবে যথাযথ পথে প্রবাহিত হয়ে চলেছে। এই প্রবাহের মধ্যে রয়েছে একটা বিরাট শৃঙ্খলা। জানিনা কোথা থেকেই বা সে এমন উদ্যম পায়।
অনেকে মনে করেন যে, বজ্রপাত এবং নিউরন-ক্ষরিত স্ফুলিঙ্গের ঘটনাটি একইরকম, কারণ উভয় প্রক্রিয়াতেই বৈদ্যুতিক চার্জ বা আধান উৎপন্ন হয়। তাই, স্নায়ু আবেগ থেকে যে স্ফুলিঙ্গের সৃষ্টি তা একটি বজ্র পতনের অনুরূপ। দুটো ক্ষেত্রেই আমরা দেখেছি বৈদ্যুতিক চার্জের তারতম্যের কারণে হয়ে থাকে— বজ্রপাত ঘটে থাকে মেঘ ও ভূপৃষ্ঠের মধ্যকার বা পাশাপাশি দুই মেঘের মধ্যকার বৈদ্যুতিক চার্জের পার্থক্যের কারণে, আর নিউরনের প্লাজমা মেমব্রেন বা কোষ ঝিল্লি জুড়ে বহিঃকোষীয় ও অন্তঃকোষীয় বৈদ্যুতিক চার্জের পার্থক্যের কারণে সৃষ্টি হয় বৈদ্যুতিক সিগন্যালে প্রবাহিত স্নায়ুকোষের এই আবেগ ও অগ্নি-প্রজ্বলন। উভয় ক্ষেত্রেই মূল ভূমিকায় রয়েছে কতিপয় আয়ন, বৈদ্যুতিক চার্জযুক্ত পরমাণু বা অণু।
স্নায়ুতত্ববিদগণ অংক কষে দেখিয়েছেন মানব স্নায়ুজগতে প্রায় ১০০০ কোটি নিউরন বা স্নায়ুকোষ রয়েছে। তারই মধ্য থেকে মডেল হিসেবে একটি নিউরনের স্নায়ুতাড়না নিয়ে আমার এই প্রবন্ধটি রচনা। আমার এই নিবন্ধটি লেখা হয়েছে মূলতঃ শিক্ষার্থীদের জন্য। আশাকরি শিক্ষার্থীগণ খুব সহজ বাংলায় লেখা এই বিষয়টি নিয়ে আমার বিশ্লেষণ পড়ে ও জেনে উপকৃত হবেন। এটি স্নায়ু বিজ্ঞান ও কোষ বিজ্ঞানের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
কোষ ঝিল্লি প্রধানত লিপিড ও প্রোটিনের সমন্বয়ে গঠিত। কোলেস্টেরলের সাথে মিলেমিশে ফোসফোলিপিড-এর অণুগুলি দুটি স্তরে সজ্জিত হয়ে ঝিল্লির কাঠামো গঠন করে এবং দ্বিস্তর লিপিড কাঠামোর মধ্যে প্রোটিন অণুগুলি অবস্থান করে। স্নায়ুকোষ ঝিল্লিও এই নিয়মে গড়া। অনেকগুলি কাজের মধ্যে কোষ ঝিল্লির একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো কোষ এবং কোষের অঙ্গাণুদের ভিতরে ও বাইরে পদার্থের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করা, যেখানে আয়ন এবং জৈব অণুদের প্রবেশাধিকার উম্মুক্ত নয়, অর্থাৎ নির্বাচনভিত্তিতে প্রবেশযোগ্য। কোষ ঝিল্লি এই কাজটি করে সাধারণত চারটি পরিবহন প্রক্রিয়া ও বাহনের মাধ্যমে, যথা—
- ব্যাপন (osmosis ও diffusion)
- আয়ন চ্যানেল ও পরিবাহী প্রোটিন
- এন্ডোসাইটোসিস (endocytosis)
- এক্সোসাইটোসিস (exocytosis)
আমার এই নিবন্ধে বিশ্লেষণ করা হয়েছে শুধুমাত্র কোষ ঝিল্লি জুড়ে আয়নের পারাপার নিয়ে এবং তার ফলশ্রুতিতে কোষের ঝিল্লিতে (ভিতরে ও বাইরে) বৈদ্যুতিক শক্তি বা ভোল্টেজের পার্থক্যে কীভাবে কোষের ভিতরে এক অচিন্তনীয় উদ্দীপনার সৃষ্টি হয় তা নিয়ে। দেহের সব ধরণের কোষেই ভোল্টেজের ভিতর-বাইর পার্থক্য থাকে, তবে যে-সব কোষ (excitatory cells) উত্তেজনা বা বৈদুতিকপ্রবাহ সৃষ্টি করে, যেমন স্নায়ুকোষ ও পেশিকোষ, সে-সব কোষগুলিতে কোষ ঝিল্লি জুড়ে ভোল্টেজের সূক্ষ্ম পরিবর্তনের ফলে দেহে বড়ো ধরণের বিপর্যয় দেখা দিতে পারে। কোষ ঝিল্লি জুড়ে বৈদ্যুতিক শক্তির এই অবস্থানকে বলা হয় মেমব্রেন পোটেনশিয়াল (membrane potential)।
একটি স্নায়ুকোষের বিশ্রামকালে তার ঝিল্লি বরাবর যে বৈদ্যুতিক বিভব থাকে, তাকে বলা হয় রেস্টিং মেমব্রেন পোটেনশিয়াল, (resting membrane potential, RMP) বা স্থিতিশীল পোটেনশিয়াল। কোষাভ্যন্তরে বাইরের তুলনায় সাধারণত RMP থাকে ঋণাত্মক আধানের অর্থাৎ নেতিবাচক, –৭০ মিলিভোল্ট (mV) বা তার আশপাশ। RMP কীভাবে –৭০mV এ পৌঁছয় তার তিনটি প্রক্রিয়া খুব সহজভাবে এখানে ব্যাখ্যা করা হলো। প্রথম বাহনটি হচ্ছে Na+/K+ATPase (সোডিয়াম-পটাসিয়াম এটিপি’য়েজ), এটি একটি ঝিল্লীবন্ধ এনজাইমধর্মী প্রোটিন। এখানে সংক্ষিপ্ত আকারে ATPaseকে বর্ণনা করা হলে পুরো বিষয়টি বোঝার জন্য সুবিধা হয়। ATPaseকে একটি ট্রান্সমেমব্রেন প্রোটিন বলা হয়, কারণ এর অবস্থান হচ্ছে কোষঝিল্লি জুড়ে, যা বিভিন্ন ধরণের দ্রবনকে তাদের ঘনত্ব গ্রেডিয়েন্টের বিপরীতে ঝিল্লি জুড়ে পারাপারের সুযোগ করে দেয়। কোষ ঝিল্লিতে অবস্থান করছে বেশ কয়েক ধরণের ATPase, যার মধ্যে Na+/K+ATPase দ্বারা মেমব্রেন পোটেনশিয়াল নিয়ন্ত্রণ অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ। এরা সোডিয়াম-পটাসিয়াম এক্সচেঞ্জার বা পাম্প হিসেবেও পরিচিত। এরা কোষের ভিতরে ও বাইরে সোডিয়াম ও পটাসিয়াম আয়নকে স্থানান্তর করে। প্রসঙ্গতঃ কোষের বাইরে Na+ এর ঘনত্ব কোষের ভিতরের তুলনায় প্রায় ১০ গুণ বেশি, আর কোষের ভিতরে K+ এর ঘনত্ব কোষের বাইরের তুলনায় প্রায় ২০ গুণ বেশি। আয়ন দেওয়া-নেওয়া ছাড়াও এদের আরো একটি বড়ো কাজ আছে, সেটি হলো এরা ATP (এডিনোসিন ট্রাইফসফেট)কে অনুঘটনের মাধ্যমে রূপান্তর করে এডিপি (এডিনোসিন ডাইফসফেট)তে ও মুক্ত করে একটি অজৈব ফসফেট আয়ন। ফলে এই কাজটি সম্পাদন করতে কোষ পেয়ে যায় কোষীয় শক্তি।
ধরা যাক, একটি কোষের ভোল্টেজ মাত্রা শূন্য (০) mV। সেই মাত্রাকে RMP (-৭০ mV)স্তরে নিয়ে যেতে হলে কোষাভ্যন্তরে অনেকটা ঋণাত্মক আবহ সৃষ্টির প্রয়োজন এবং এই দায়িত্বটি অর্পিত হয়েছে Na+/K+ATPase ও বিভিন্ন চ্যানেলের ওপর। আয়ন বিনিময় খেলায় Na+/K+ATPaseদের একটি নীতি আছে, অর্থাৎ এদের মধ্য দিয়ে ৩:২ অনুপাতে তিনটি সোডিয়াম (Na+) আয়ন কোষ থেকে বেরিয়ে যায় এবং ২টি পটাসিয়াম আয়ন (K+) কোষে প্রবেশ করে। এই দেয়া-নেয়ায় কোষাভ্যন্তরে ভোল্টেজের মাত্রা খুব একটা নিম্নগামী হয় না, তবুও ধরা যাক অভ্যন্তরে বৈদ্যুতিক চার্জ এসে দাঁড়ালো -৫ থেকে -১০ মিলিভোল্টের কাছাকাছি। কোষের RMP (-৭০ mV) অর্জনে এটি মোটেই যথেষ্ট নয়। ফলে কোষ থেকে আরও বেশি পটাসিয়াম আয়ন নির্গত হওয়া প্রয়োজন। এখন প্রশ্ন হলো, পটাসিয়াম তো ধনাত্মক আধানের, তাহলে তাকে কোষ থেকে বের করার পেছনে কোষের এত তড়িঘড়ি কেন! কারণ— কোষের ভিতর পটাসিয়াম যুক্ত থাকে ঋণাত্মক আধানযুক্ত বিভিন্ন অণুর সাথে, যেমন ফসফেট (একটি মুক্ত ফসফেট আয়নে ৩টি ঋণাত্মক চার্জ রয়েছে) বা প্রোটিন। অ্যামিনো অ্যাসিডের কারণে প্রোটিনগুলির একটি নেট নেতিবাচক/ঋণাত্মক চার্জ থাকে। ফলে, পটাসিয়াম আয়ন নির্গত হওয়ার সময় তার সহযোগী অণুদের (ফসফেট, প্রোটিন) কোষাভ্যন্তরে ছেড়েই যেতে হয়, কারণ তারা আকারে বড়ো, কোষঝিল্লি জুড়ে তাদের অবাধ চলাচল নেই। তাই, ঋণাত্মক আধানযুক্ত এইসব অণুগুলির উপস্থিতিতে দ্রুত কোষাভ্যন্তরে চার্জ গিয়ে পৌঁছয় -৯০ মিলিভোল্টে।
এই শেষোক্ত কাজটি করে ঝিল্লীবন্ধ লিকি পটাসিয়াম চ্যানেল (leaky potassium channel)। এই চ্যানেলগুলি কার্যত প্রায় সব ধরণের কোষেই পাওয়া যায়, যদিও স্নায়ুকোষ ও পেশিকোষে এই চ্যানেলগুলি পরিব্যাপ্ত এবং এদের গুরুত্ব অসীম। অর্থাৎ ছিদ্রপথে প্রবিষ্ট বা নির্গত আয়নগুলি চ্যানেলের কোনো গেট বা কপাট দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় না। এদের চলাচল অবারিত হলেও, কোনো এক অজানা শক্তির দ্বারা কোষের মেমব্রেন পোটেনশিয়াল (membrane potential)কে এরা স্থিতিশীল রাখে, অর্থ্যাৎ ঝিল্লির বাইরে ধনাত্মক আয়নদের ভিড়, আর ভিতরে ঋণাত্মক চার্জ। এইরকম লিকি পটাসিয়াম চ্যানেলের মত লিকি সোডিয়াম চ্যানেলও রয়েছে। যাহোক, –৯০mV একটু বেশি-ই নেতিবাচক হয়ে গেলো। তাই অবিলম্বে ছিদ্রময় সোডিয়াম চ্যানেলের মাধ্যমে কিছুটা সোডিয়াম আয়ন প্রবেশ করে ভিতরের চার্জকে –৭০ মিলিভোল্টে নিয়ে আসে, যা ওই নিউরনটির RMP। এই সমস্ত ঘটনা ঘটে মাত্র ২-৩ মিলিসেকেন্ড (millisecond)র মধ্যে। তাহলে, স্নায়ুকোষের ক্ষণকালীন উত্তেজনাহীন অবস্থায় (যাকে বলা হয়েছে বিশ্রামদশা) তার ভিতরের চার্জ থাকে —৭০ (নেগেটিভ ৭০) মিলিভোল্ট, যখন ঝিলিপারের আধান থাকে ধনাত্মক।
নিউরনের সক্রিয় অবস্থা থেকে এসে কিছুটা সময় উত্তেজনামুক্ত থাকলেও নতুন কোনো আবেগে আবারো সে সক্রিয় হয়ে ওঠার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। প্রোটিন আকারে নতুন এই আবেগটি আসে তার পূর্ববর্তী নিউরন থেকে। তার এই চঞ্চলতা আজীবনের, নইলে আমরা বঞ্চিত থাকতাম সকল ধরণের বোধ উপলব্ধি থেকে। যাহোক, সছিদ্র চ্যানেল (leaky channel) ছাড়াও কোষ ঝিল্লিতে রয়েছে আরও সব নানান ধরণের চ্যানেল। তবে, সে আয়ন চ্যানেলগুলি অবাধ নয়, এরা গেট দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। উদ্দীপকের উপর ভিত্তি করে, এই আয়ন-চ্যানেলগুলি তিনটি বড়ো পরিবারে বিভক্ত: ভোল্টেজ-গেটেড আয়ন চ্যানেল (voltage-gated ion channels, VGIC), লাইগ্যান্ড-গেটেড আয়ন চ্যানেল (ligand-gated ion channels, LGIC) এবং অন্যান্য সংবেদনশীল (mechano-sensitive) কিছু আয়ন চ্যানেল। এই চ্যানেলগুলি কঠোরভাবে আয়ন নির্দিষ্ট। অর্থাৎ, নির্দিষ্ট উদ্দীপকের সাড়া পেলেই শুধুমাত্র চ্যানেলগুলি খোলে, আবার বন্ধ হয়, ঠিক যেন স্লুস (sluice) গেটের মত। তাই, এই চ্যানেলগুলিকে যথার্থই ‘আয়নকপাট’ও বলা যেতে পারে, যার মধ্য দিয়ে নির্দিষ্ট অণুগুলি কোষের ঝিল্লি জুড়ে পরিবাহিত হয়। এই প্রবন্ধে কেবল VGIC ও LGIC নিয়ে সংক্ষেপে বর্ণনা দেয়া হলো, কারণ কোষাভ্যন্তরে বৈদ্যুতিক প্রবাহ সৃষ্টিতে এই দুটো চ্যানেলের ভূমিকা অসীম। তবে, অন্যান্য চ্যানেলের গুরুত্বকে আমি মোটেই খাটো করে দেখছিনে।
আয়ন হলো নিট বৈদ্যুতিক আধানযুক্ত কণিকা, পরমাণু বা অণু। তাই VGIC চ্যানেলগুলি ভাগ হয়েছে তাদের নির্দিষ্ট আয়ন (Na+, K+, Ca2+এবং Cl–) নির্বাচনের মাধ্যমে- যেমন ভোল্টেজ-গেটেড সোডিয়াম চ্যানেল, ভোল্টেজ-গেটেড পটাসিয়াম চ্যানেল, ভোল্টেজ-গেটেড ক্যালসিয়াম চ্যানেল, বা ভোল্টেজ-গেটেড ক্লোরাইড চ্যানেল। VGIC প্রোটিনচ্যানেলগুলি সংশ্লেষিত হয় তাদের নির্দিষ্ট জিনগুলির সংকেত পেয়ে, অর্থাৎ ডিএনএ-তে প্রত্যেকটি চ্যানেলের জন্য নির্দিষ্ট জিন (gene) রয়েছে। যেমন, মানব সোডিয়াম চ্যানেলের জন্য দশটি জিন, ক্যালসিয়াম চ্যানেলের জন্য ষোলটি জিন এবং পটাসিয়াম চ্যানেলের জন্য প্রায় ৪০টি জিন শনাক্ত হয়েছে। বলা বাহুল্য, VGIC চ্যানেলগুলির মধ্যে পটাসিয়াম চ্যানেল খুব বড়ো একটি গোষ্ঠী।
অপরপক্ষে, ডেনড্রাইট ও কোষ বডির ঝিল্লিতে আবদ্ধ LGIC বা আয়োনোট্রপিক রিসেপ্টর (Ionotropic receptor) নামক এই প্রোটিনচ্যানেলগুলি একটি নির্দিষ্ট লাইগ্যান্ড যেমন, নিউরোট্রান্সমিটার: গ্লুটামেট (glutamate), GABA (gamma-aminobutyric acid) ইত্যাদি বাঁধনের প্রতিক্রিয়ায় Na+, K+, Ca2+ অথবা Cl–-এর মতো আয়নগুলি ঝিল্লির মধ্য দিয়ে যাবার অনুমতি পায়। LGIC পরিবারের বৃহত্তম গ্ৰুপটি হচ্ছে ‘Cys-Loop LGIC’, যার মধ্যে নিকোটিনিক অ্যাসিটিলকোলাইন রিসেপ্টর (nAChR), GABA রিসেপ্টর, হাইড্রোক্সিট্রিপটামিন (5HT3R) রিসেপ্টর এবং গ্লাইসিন রিসেপ্টর অন্তর্ভুক্ত। nAChR এবং 5HT3R হলো উত্তেজনা সঞ্চারী (excitatory) রিসেপ্টর, আর GABA ও গ্লাইসিন রিসেপ্টর হলো প্রতিরোধী (inhibitory) প্রকৃতির। উদাহরণস্বরূপ, উদ্দীপিত অবস্থায় একটি প্রিসিনাপ্টিক (presynaptic) স্নায়ুকোষ থেকে একটি নিউরোট্রান্সমিটার নিঃসৃত হয়ে পোস্টসিনাপ্টিক (postsynaptic) কোষঝিল্লিব্যাপৃত LGIC-তে সন্নিবদ্ধ হয়। ফলে, লাইগ্যান্ডের (যেমন,গ্লুটামেট) বাঁধনে কোষটির ভিতরে বৈদ্যুতিক চার্জ বিতরণে একটি পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যায়, যার ফলে কোষাভ্যন্তরে বাইরের তুলনায় কম ঋণাত্মক হয়, অর্থাৎ ধনাত্মক আধানের দিকে পরিবর্তিত হয়। ফলে ওই কোষটির আয়নজনিত মেরুকরণ (polarization)র পরিবর্তন হয়।
এ পর্যন্ত আমরা জেনেছি যে একটি নিউরনের বিশ্রামের সময় তার অভ্যন্তরে ভোল্টেজ থাকে – ৭০ mV। ধরা যাক সেটি প্রিসিনাপ্টিক নিউরন। নিউরনের একটি প্রধান দায়িত্ব হচ্ছে কোষপ্রান্তে অর্থাৎ সিনাপ্সে (synapse: দুইটি নিউরনের আন্তঃসংযোগস্থল) একাধিক নিউরোট্রান্সমিটার মুক্তি দেওয়া। এটাই তার জন্মের ও কর্তব্যবোধের সার্থকতা। তাই এই কাজটি সে ক্লান্তিহীনভাবে খুব নিপুণতার সাথেই করে। একটি নিউরোট্রান্সমিটার সিনাপ্সে মুক্তির প্রাক্কালে কোষটিকে RMP দশা থেকে বেরিয়ে পুরোমাত্রায় সক্রিয় হতে হবে। অর্থাৎ কোষটিকে অ্যাকশন পোটেনশিয়াল (action potential) অর্জন করতে হবে। তবে সেই দশায় পৌঁছবার পূর্বে কোষটিকে ক্রমানুসারিক বা গ্রেডেড মেমব্রেন পোটেনশিয়াল অর্জনের মধ্য দিয়ে যেতে হবে। অর্থাৎ বিশ্রামাধীন -৭০ mV থেকে উজানে গিয়ে -৫৫mV এ পৌঁছতে হবে (এই অবস্থানটি হচ্ছে নিউরনের থ্রেশহোল্ড মেমব্রেন পোটেনশিয়াল (threshold membrane potential, TMP)। অর্থাৎ, পূর্বের তুলনায় তাকে কম ঋণাত্মক আধানের আবহ সৃষ্টি করতে হবে। কোষাভ্যন্তরে পজিটিভ বা ধনাত্মক আয়ন (যেমন, Na+, Ca2+)র আগমনেই একটি স্নায়ুকোষ তার TMP পর্যায়ে পৌঁছতে পারে। আর, এই কাজটি করে দেয় কোষের VGIC চ্যানেল। কোষে TMP (–৫৫ mV) প্রাপ্তির ফলে কোষটির এই অবস্থানকে বলা হয় ডিপোলারাইজেশন (depolarization) বা EPSP (excitatory postsynaptic potentials)। -৭০ mV থেকে -৫৫ mV তে উত্তীর্ণ হবার এই বিভব প্রক্রিয়াকে বলে ক্রমানুসারিক পোটেনশিয়াল (graded potential)। RMP বা TMP উভয়ই অর্জিত হয় নিউরনের কোষদেহে (cell body)। মেমব্রেন পোটেনশিয়ালের শেষ ধাপটি হচ্ছে অ্যাকশন পোটেনশিয়াল (action potential), যা অর্জিত হয় নিউরনের দীর্ঘ সরু প্রক্ষেপণ স্নায়ুতন্তু বা অ্যাক্সন (Axon) অঞ্চলে। একটি স্নায়ুকোষে অ্যাকশন পটেনশিয়াল-ই হচ্ছে তার ‘স্নায়ু আবেগ’। হিসেবে দেখা গেছে একটি নিউরন প্রতি সেকেন্ডে তার প্রায় ১০০০ আবেগকে প্রেরণ করতে পারে।
এই থ্রেসহোল্ডের ভিতর দিয়ে যেতে প্রচন্ড বেগের জোর চাই। যে-সব নিউরন সে শক্তি (বৈদ্যুতিক চার্জ) অর্জন করতে পারে না, তারা অ্যাকশন পটেনশিয়াল অবস্থায় পৌঁছতে পারে না, ব্যর্থ হয়ে ফিরে যায় RMP দশায়। তাই একটি নিউরনের ভিতরে ঋণাত্মক আধানের চেয়ে ক্রমান্বয়ে ধনাত্মক আধানের আধিক্য প্রয়োজন। অর্থাৎ কোষাভ্যন্তরে আধানগত আবহ অধিকতর EPSP অর্জনে অতিশয় ডিপোলারাইজেশন অবস্থায় পৌঁছতে হবে। সহজ ভাষায়, যত বেশি ডিপ্লারাইজেশনের মাত্রা বা EPSP, তত বেশি অর্জন অ্যাকশন পটেনশিয়াল।
এই উত্তরণের কাজটি সম্পাদন করে নিউরনের কোষদেহ (cell body) ও অ্যাক্সনের মধ্যবর্তী স্থানের একটি অঞ্চল যা অ্যাক্সন হিলক (axon hillock) নামে অভিহিত। এই অঞ্চলটিতে VGIC’র মধ্য দিয়ে, বিশেষ করে সোডিয়াম-গেটেড চ্যানেলের আধিক্যে, প্রচুর পরিমান সোডিয়াম (Na+) আয়ন কোষের ভিতর আসে, যা নিউরনের থ্রেশহোল্ড পোটেনশিয়ালকে প্রবাহিত করে অ্যাকশন পোটেনশিয়ালে। বৈদুৎধর্মের চাঞ্চল্য (অ্যাকশন পোটেনশিয়াল) এনে দেয় আবেগ। বিপুল এর উদ্যম, সমস্ত অ্যাক্সন জুড়ে এর সঞ্চরণ। এক মিলিসেকেন্ডে একটি VGICর মধ্য দিয়ে কোষাভ্যন্তরে প্রবেশ করে প্রায় 7000 Na+। কাজেই, কী পরিমান আবেগ সে সৃষ্টি করে তা সহজেই অনুমেয়।
অ্যাক্সন আবৃত থাকে মাইয়েলিন প্রোটিন ও নিউরোগ্লিয় কোষ দ্বারা, যে কারণে অ্যাক্সনঝিল্লির নামকরণ হয়েছে অ্যাক্সোলেমা (axolemma)। নিউরনের আরেক ধরণের প্রক্ষেপন হলো ডেনড্রাইট (dendrite)। একটি প্রিসিনাপ্টিক নিউরন পরবর্তী নিউরোন অর্থাৎ পোস্টসিনাপ্টিক কোষের সাথে সিন্যাপ্স (synapse) গঠন করে বৈদ্যুতিক উদ্দীপনা (electrical impulses) প্রেরণ করে।
অ্যাকশন পোটেনশিয়ালে উত্তীর্ণ হওয়ার ফলে অ্যাক্সোলেমায় অবস্থিত শতাধিক সোডিয়াম-গেটেড আয়ন চ্যানেল একের পর এক সক্রিয় হতে থাকে। ফলে, আক্সন জুড়ে, অ্যাক্সন হিলক থেকে প্রান্তীয় অ্যাক্সন পর্যন্ত, ক্রমান্বয়ে অধিকতর EPSP পরিবেশ তৈরি হতে থাকে। অ্যাক্সন জুড়ে ভোল্টেজ-গেটেড সোডিয়াম চ্যানেলগুলি পুঞ্জীভূত থাকে অ্যাক্সনের সে-সব অঞ্চলে যাকে বলা হয় রেনভিয়ার নোড (Ranvier node) । যার তাদের মাধ্যমে বিপুল পরিমানে সোডিয়াম আয়ন কোষাভ্যন্তরে প্রবেশ করায় ভোল্টেজের মাত্রা -৫৫ mV থেকে দ্রুত পরিবর্তিত হয়ে +৩০ mV (পজিটিভ)-এ গিয়ে পৌঁছয় এবং অ্যাক্সন জুড়ে এক ধনাত্মক আয়নের ঢেউ সৃষ্টি হয়।
পরবর্তীতে অ্যাক্সন প্রান্তিকে অবস্থিত ঝিল্লিবন্ধ ক্যালসিয়াম-গেটেড আয়ন চ্যানেল উদ্দীপিত হওয়ায় অনেক পজিটিভ চার্জযুক্ত ক্যালসিয়াম আয়ন (Ca2+) অভ্যন্তরীণ হয়। SNARE জাতীয় প্রোটিনের সাহায্যে সিনাপ্টিক ভেসিকল (vesicle)গুলি প্রান্তিক ঝিল্লির সাথে একীভূত হয়ে অন্তর্নিহিত নিউরোট্রান্সমিটারগুলিকে এক্সোসাইটোসিস প্রক্রিয়ায় সিনাপ্সে মুক্তি দেয়, ফলে বজ্রপাতের ন্যায় তেজময় স্ফুলিঙ্গের সৃষ্টি হয়, যাকে বজ্রপাতের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। একটি নিউরোট্রান্সমিটার সিনাপ্সে মুক্তি পেতে পারে প্রিসিনাপ্টিক ভেসিকল বা/এবং নিউরোট্রান্সমিটার ট্রান্সপোর্টার প্রোটিনের মাধ্যমে। ট্রান্সপোর্টারগুলি আবদ্ধ থাকে প্রান্তীয় অ্যাক্সনের ঝিল্লিতে। নিউরোট্রান্সমিটার মুক্তি দিয়ে তার সক্রিয় অবস্থান থেকে সে ফিরে যেতে চায় বিশ্রাম দশায়। তাই. অ্যাক্সন অঞ্চলে স্বীয় চ্যানেলের মাধ্যমে ঋণাত্মক চার্জযুক্ত ক্লোরাইড আয়ন (Cl−)র আগমনে ও পটাসিয়াম (K+) আয়নের বহির্গমনে অ্যাকশন পোটেনশিয়াল অবস্থা থেকে সে প্রত্যাবর্তন করে তার পূর্বেকার RMP (-৭০ mV) অবস্থায় (ধনাত্মক পটাসিয়াম আয়ন নির্গত হলে কী কারণে কোষাভ্যন্তরে ঋণাত্মক আবহ সৃষ্টি হয় তা পূর্বেই উল্লেখ করেছি)। প্রত্যাবর্তিত এই পর্যায়কে বলা হয় রিপোলারাইজেশন (repolarization)। ঋণাত্মকতা যদি অধিকতর নেতিবাচক (-৯০mV) হয়, তাহলে সে দশাকে বলা হয় হাইপারপোলারাইজেশন (hyperpolarization)। শেষোক্ত এই দুটি প্রক্রিয়াকে বলা হয় IPSP (Inhibitory postsynaptic potential)।
বিস্ফুরিত নিউরোট্রান্সমিটারগুলি পোস্টসিনাপ্টিক স্নায়ুকোষের ডেনড্রাইটে অবস্থিত LGICগুলির সাথে আবদ্ধ হয়ে সেখানে বৈদ্যুতিক সংকেতের মেরুকরণ আবারো শুরু করে। এই ছিল একটি নিউরোনের বৈদ্যুতিক প্রবাহের ভ্রমণ। নিউরন ফিরে গেল তার ক্ষণকালীন বিশ্রাম দশায়। RMP দশা থেকে নিউরোট্রান্সমিটার মুক্তি পর্যন্ত একটি নিউরোনের সময় লাগে ৫-৬ মিলিসেকেন্ড, অর্থাৎ ০.০০৫ – ০.০০৬ সেকেন্ড। আর পোস্টসিনাপ্টিক স্নায়ুকোষ হয়ে গেল প্রিসিনাপ্টিক। কিন্তু রেখে গেলো আমার মনে এক বিস্ময়। সূর্য তার বৃহত্তর পরিবার (গ্রহ, গ্রহাণু, ধূমকেতু, অ্যাস্টেরয়েড ইত্যাদি)কে নিয়ে মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির কেন্দ্রকে প্রদক্ষিণ করে চলেছে। পৃথিবী সূর্যেরই দেহজাত। ধারণা করা হয়, মানব স্নায়ুজগতে যতগুলি স্নায়ুকোষ রয়েছে তার সমপরিমানে রয়েছে ছায়াপথের নক্ষত্র, অর্থাৎ প্রায় ১,০০০ কোটি (কিছু কম, কিছু বেশি)। নক্ষত্রে-নক্ষত্রে টান, নক্ষত্রে-গ্রহে টান সবই আয়নসমূহের গরিমায়। আর, নিউরনসহ দেহের কোষগুলোতেও প্রভুত্ব চলে নানান ধরণের আয়নের। আয়নের এই টান কী আমরা নক্ষত্র থেকে জন্মগতসূত্রে অর্জন করেছি? সে উত্তর এখন জানা নেই। মৌলিক পদার্থের এই খেলায়, সে স্নায়ুকোষেই হোক বা হৃৎপিণ্ডের পেসমেকার (SA Node) কোষে হোক, হাল ধরেছে কোষের কেন্দ্রবিন্দু অর্থাৎ নিউক্লিয়াস, যেখানে রয়েছে বিস্ময়কর অণু -ডিএনএ ও আরএন এ। হয়তো আমার প্রশ্নের উত্তর লুকিয়ে আছে কোষের এই কেন্ত্রবিন্দুতে।