বাংলাদেশের আইনে মৃত ব্যক্তির ব্যাংকে রাখা টাকা কে পাবে, নমিনি নাকি ওয়ারিশ?
- প্রকাশ: ১০:১২:৪৮ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ৮ জুন ২০২২
- / ১৮৫৭ বার পড়া হয়েছে
কোনো ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করলে ব্যাংকে জমা রাখা তার অর্থ কে পাবে? নমিনি যাকে দেওয়া হয় তিনি টাকা পাবেন নাকি আইনগতভাবে বৈধ উত্তরাধিকার তারা পাবেন?— এর উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছেন বিবিসি বাংলা‘র সাংবাদিক রাকিব হাসনাত। জুন ৩, ২০২২ তারিখে প্রকাশিত রাকিব হাসনাতের লেখা ‘বাংলাদেশের আইনে মৃত ব্যক্তির ব্যাংকে রাখা টাকা কার, নমিনি নাকি ওয়ারিশদের’ শিরোনামের প্রতিবেদনটি কিছুটা সম্পাদনা করে বিশ্লেষণ’র পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো।
বাংলাদেশের আইনে মৃত ব্যক্তির ব্যাংকে রাখা টাকা নমিনি পাবে নাকি ওয়ারিশ বা উত্তরাধিকারী পাবে?
বাংলাদেশে কোনো ব্যক্তি মারা গেলে তার ব্যাংকের অ্যকাউন্টে গচ্ছিত টাকা বা সঞ্চয়পত্রের মতো বিষয়গুলো কে পাবে তা নিয়ে অনেকের মধ্যেই বিভ্রান্তি রয়েছে। বিশেষ করে ওই ব্যক্তি যদি উত্তরাধিকারীদের বাইরে কাউকে নমিনি হিসেবে মনোনীত করে যান তাহলে তা নিয়ে তৈরি হয় নানা জটিলতা।
বাংলাদেশের অনেকেই তাদের ব্যাংকে হিসাব খোলার সময় নমিনি নির্বাচনের বিষয়টিতে খুব একটা গুরুত্ব দেন না। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে, শুধু একটি নাম দেওয়া দরকার মনে করে ভালোমন্দ বিবেচনা না করেই অনেকে নমিনি হিসেবে পরিচিত কারও নাম দিয়ে দেন। এছাড়া অনেক সময় সন্তানরা খুব অল্প বয়সের থাকার কারণেও কেউ কেউ বন্ধু, আত্মীয় বা পরিচিত কারও নাম নমিনি হিসেবে দেন। ফলে অনেক সময় ওই ব্যক্তি মারা গেলে নমিনি সব অর্থ নিয়ে নিচ্ছেন এবং মৃত ব্যক্তির স্ত্রী, সন্তান অর্থাৎ ওয়ারিশদের বঞ্চিত হওয়ার ঘটনাও ঘটছে।
এখন প্রশ্ন উঠেছে যে ওই ব্যক্তি মারা গেলে ব্যাংক তার অ্যাকাউন্টে থাকা টাকা কাকে দেবে? নমিনি হিসেবে যার নাম তিনি দিয়েছিলেন তাকে নাকি ওয়ারিশ বা উত্তরাধিকারী যারা তাদের?
নমিনি যদি উত্তরাধিকারীদের কেউ হন তাহলে তিনিই কি সব টাকা পাবেন নাকি মৃত ব্যক্তির আরও উত্তরাধিকারী যদি থাকে তারাও সেই টাকার অংশ পাবেন— এগুলো নিয়েও আছে বিতর্ক।
আইন বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন
ব্যাংক আইন বিশেষজ্ঞ ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী খান মোহাম্মদ শামীম আজিজ বলছেন, “আইন অনুযায়ী নমিনিই মৃত ব্যক্তির ব্যাংক হিসেবে থাকা টাকা পাবেন, তবে সে কারণে উত্তরাধিকারীরা সেই অর্থ থেকে যে বঞ্চিত হবেন সেটা না। কেউ মারা গেলে তার সঞ্চিত অর্থ বা তার অ্যাকাউন্টে থাকা অর্থ নমিনিকে দিয়ে এ সম্পর্কিত প্রক্রিয়া থেকে মুক্ত হবে ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান। এরপর বিষয়টি হলো নমিনি ও উত্তরাধিকারীদের। আইনে বলা আছে নমিনিকে দেয়া মানে উত্তরাধিকারীদের অধিকার ক্ষুণ্ণ হওয়া নয়। অর্থাৎ নমিনি যদি উত্তরাধিকারীদের সেই টাকা না দেন, তাহলে তারা আদালতে যেতে পারবেন।”
অর্থাৎ প্রচলিত আইন অনুযায়ী ব্যাংক তার দায়িত্ব পালন শেষ করবে নমিনির হাতে অর্থ তুলে দিয়ে। কিন্তু তিনি যদি সেই অর্থ উত্তরাধিকারীদের মধ্যে বিতরণ না করেন তাহলে তারা আদালতে যেতে পারবে।
এর মানে হলো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে টাকা পাওয়ার পর নমিনির কাজ হবে ওই ব্যক্তির আইনগত উত্তরাধিকারীদের সেটি বুঝিয়ে দেওয়া।
সুপ্রিম কোর্টের আরেকজন আইনজীবী নাজনীন নাহার বলছেন যে, নমিনি ওই ব্যাংক অ্যাকাউন্টের ট্রাস্টির ভূমিকা পালন করেন বা ওই হিসাবের ম্যানেজার মাত্র।
আইন অনুযায়ী ম্যানেজার হিসেবে তিনি ওই অর্থ মৃত ব্যক্তির উত্তরাধিকারীদের হাতে তুলে দেবেন। যদিও তা না করে অনেক ক্ষেত্রে নমিনি টাকা নিজে রেখে দিচ্ছেন বলে দেখা যাচ্ছে- যা আইনের লঙ্ঘন বলে তিনি বলছেন।
“নমিনি ওই অর্থ উত্তোলনের অধিকারী হবেন ও উত্তরাধিকার আইন অনুসারে মৃত ব্যক্তির সাকসেসরদের (উত্তরাধিকারী) মধ্যে তা বণ্টন করবেন। তা না হলে উত্তরাধিকারীরা আদালতে গেলে প্রতিকার পাবেন,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন নাজনীন নাহার।
আইনজীবী নাজনীন নাহার এ ধরনের একটি মামলায় এক পক্ষে আইনজীবী হিসেবে কাজ করেছেন। ২০১৪ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা তার দ্বিতীয় স্ত্রীকে নমিনি করে সঞ্চয়পত্র রেখেছিলেন।
পরে তিনি মারা গেলে তার দ্বিতীয় স্ত্রী ওই সঞ্চয়পত্রের বিপরীতে পুরো টাকা একাই ভোগ করতে চাইলে আইনের আশ্রয় নেন তার প্রথম পক্ষের সন্তানরা।
এ নিয়ে প্রথমে নিম্ন আদালত বলেছিল যে নমিনিই সেই টাকা পাবেন। কিন্তু পরে হাইকোর্টে যায় বিষয়টি। হাইকোর্ট তার রায়ে বলে যে ওই টাকা পাবেন মৃত ব্যক্তির উত্তরাধিকারীরাই। এরপর হাইকোর্টের এ রায় চেম্বার আদালতে স্থগিত হয়ে এখন আপিল বিভাগে পূর্ণাঙ্গ শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে।
বিষয়টি এখনো চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হয়নি বলে আগের রায়ই কার্যকর আছে বলে জানিয়েছেন নাজনীন নাহার। আর সে রায় অনুযায়ী নমিনির কাছেই হিসেবের টাকা হস্তান্তর করবে ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান।
ব্যাংকে জমা মৃত ব্যক্তির টাকা প্রসঙ্গে আইনে যা আছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক যা বলেছে
বাংলাদেশের বিদ্যমান আইনগুলো অনুযায়ী সাধারণত মৃত ব্যক্তির সব সম্পত্তি তার ওয়ারিশ বা উত্তরাধিকারীদের মধ্যে বণ্টন হয়ে থাকে। কিন্তু ব্যাংকের হিসেবে থাকা টাকা যায় নমিনির কাছে।
তবে কোনো বিষয়ে একাধিক আইন থাকলে বা আইনগত জটিলতা দেখা দিলে এ বিষয়ে সর্বশেষ যে আইন হয়েছে সেটাই অনুসরণ করা হয়। এ বিষয়ে ব্যাংক কোম্পানি আইন ১৯৯১ হলো সর্বশেষ আইন। অন্য আইনে যাই থাকুক এটিই আসলে এ বিষয়ে কার্যকর হবে বলে বিদ্যমান আইন বলছে। আর এ আইন অনুযায়ী ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান নমিনির কাছেই মৃত ব্যক্তির অ্যাকাউন্টে থাকা টাকা হস্তান্তর করবে।
এর ভিত্তিতে ২০১৭ সালের অগাস্টে বাংলাদেশ ব্যাংকও সব বাণিজ্যিক ব্যাংককে নির্দেশ দিয়েছিলো যে কেউ মারা গেলে তার ব্যাংকে রাখা টাকা নমিনিই পাবে। কিন্তু নমিনি যদি সেই টাকা উত্তরাধিকারীদের মধ্যে তুলে না দেন তাহলে তাকে জবাবদিহিতার আওতায় আনার একমাত্র উপায় হলো আদালতের দ্বারস্থ হওয়া।
শেষ কথা হলো এই— ব্যাংকে গচ্ছিত মৃতব্যক্তির টাকা উত্তোলন করবে নমিনি কিন্তু ওই টাকা পাবে ওয়ারিশ বা উত্তরাধিকারী।
পিতার মৃত্যুর পর ব্যাংকের নমিনি আমার মায়ের নামে, আমরা তিন ভাই এক বোন। আমি দ্বিতীয় ছেলে, আমাকে বঞ্চিত করতে বা ঠকাতে চায় এবং ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট নাম্বার আমাকে জানাতে চায়না এবং কোনো তথ্য দেয় না। এই জন্য আমি কী করতে পারি?
আমার মায়ের ব্যাংক একাউন্টের নমিনি কে আমি জানিনা, সম্ভবত মামা হতে পারেন। আম্মু মারা গিয়েছেন। এখন উত্তরাধিকার কি শুধু আমিই? নাকি আমার আব্বুও। যতদূর জানি ইউনিয়ন থেকে উত্তরাধিকার সার্টিফিকেট নিতে হয়৷ তখন সেখানে কি শুধু আমিই থাকবো, নাকি আমার বাবাও?
শুধু টাকা উত্তোলন করবেন আপনার মামা। উত্তোলনের পর ওই টাকা ওয়ারিশদের মধ্যে ভাগ করে দেবেন। আপনি যেই ধর্মের, সেই ধর্ম অনুসারে নির্দিষ্ট আইন আছে— সে অনুসারে টাকা বণ্টন করতে হবে। ‘উত্তরাধিকার’ নামে একটি অ্যাপ আছে প্লে স্টোরে, ওখান থেকে সহজেই জেনে নিতে পারবেন কে কতটাকা পাবেন।
যদি এই তিনজনই ওয়ারিশ হয়ে থাকেন তাহলে— আপনি পাবেন না ৫০%, আপনার বাবা ২৫% এবং আপনার মামা ২৫%।
এ বিষয়ে আরও প্রশ্ন থাকলে তা করতে পারেন।
আমরা চার বোন আম্মু নমিনী থাকা স্বত্তেও ও তারা টাকা দাবি করছে, কিন্তু আমাদের সবকিছু আলাদা এখন তারা কি টাকা টা পাবে?
আপনার মা ব্যাংক থেকে টাকা উত্তোলন করবেন। উত্তোলনের পরে সকল ওয়ারিশের মধ্যে ভাগ করে দেবেন।
আমার বাবা মারা গেছেন, আম্মু নমিনী। এখন টাকাটা কে পাবে?
নমিনি হিসেবে আপনার মা আপনার বাবার ব্যাংকের টাকা উত্তোলন করবেন। এর পরে ওই টাকা আপনার মা একা রাখতে পারবেন না বা আপনাদেরকেও দান করতে পারবেন না; ওয়ারিশ হিসাব করে যে যতটুকু অংশ পাওয়ার কথা সে ততটুকু অংশ পাবে।
কিন্তু ব্যাংক থেকে নোটিশ দিয়েছিল চেয়ারম্যান এর স্বাক্ষর আনার জন্য এফডিআর এর নমিনী আম্মু এবং আমরা চার বোন আর আম্মুর ওয়ারিশ হিসাবে স্বাক্ষর নিয়েছে আর আমার কাকা মামা তাদের সাক্ষী হিসাবে স্বাক্ষর নিয়েছে এটা কীসের জন্য নিইয়েছে? আর তারা নিজেরাই আমাদের ওয়ারিশ সনদ বানিয়ে দিয়েছে। এখন কোন হিসাবে তারা টাকা দাবি করে?
একজন মানুষের ওয়ারিশ শুধু ছেলেমেয়ে বা তাঁর স্ত্রী নয়। আরও অনেকেই আছে। ‘উত্তরাধিকার’ নামে একটি সরকারি অ্যাপ আছে, প্লে স্টোর থেকে মোবাইলে ইনস্টল করলে সেখান থেকে সহজেই বুঝে নিতে পারবেন।