মাথাপিছু আয় বাড়লেই তবে কি জীবনযাত্রার মান বাড়ে?— এ বিষয়ে অর্থনীতি কী বলে?
- প্রকাশ: ০৬:০৩:১৪ অপরাহ্ন, শনিবার, ২ জুলাই ২০২২
- / ১৭৪৭ বার পড়া হয়েছে
আমরা অনেকেই ভাবি যে, মাথাপিছু আয় বাড়লেই কোনো দেশের জীবনযাত্রার মান বাড়ে— এ বিষয়টি নিয়েই লেখা হয়েছে এ নিবন্ধে। দেখা যাক— এ প্রসঙ্গে অর্থনীতি কী বলে।
এখানে যা আছে
মাথাপিছু আয় কী?
মাথাপিছু আয় বলতে একটা দেশের মোট আয়ের পরিমাণ কে ঐ দেশের জনসংখ্যা দ্বারা ভাগ করলে যে আয় পাওয়া যায় তাকে মাথাপিছু বা জনপ্রতি আয় বলা যায়। আর মাথাপিছু আয় সাধারণত একটা নির্দিষ্ট সময়ে একটা নির্দিষ্ট ভৌগোলিক এলাকার মধ্যে পরিমাপ করা হয়ে থাকে।
সূত্র: মাথাপিছু আয় = কোনো নির্দিষ্ট বছরের মোট জাতীয় আয় / ঐ বছরের মোট জনসংখ্যা
মাথাপিছু আয় বাড়লে কোনো একটা দেশের মোট আয় বাড়ে, আবার মোট আয় বাড়লে এবং জনসংখ্যা সে অনুযায়ী কম হারে বাড়লে মাথাপিছু আয় বেড়ে যায়। কোনো দেশের মোট জাতীয় আয় বাড়লো এবং জনসংখ্যাও একই হারে বাড়লে সেক্ষেত্রে মাথাপিছু আয় বাড়বে না, জনসংখ্যা বৃদ্ধির তুলনায় জাতীয় আয়ের বৃদ্ধি বেশি হলে জনপ্রতি আয় বাড়বে এটা সাধারণভাবেও বোঝা যায়। অর্থাৎ মাথাপিছু আয় দুটি বিষয়ের উপর নির্ভর করছে— মোট জাতীয় আয় এবং মোট জনসংখ্যা।
মোট জাতীয় আয় বলতে কী বোঝায়?
মোট জাতীয় আয় বলতে, কোনো একটা নির্দিষ্ট অর্থবছরে কোনো দেশের জনগণের অর্থনৈতিক কার্যক্রমের ফলে মোট যে পরিমাণ বস্তুগত ও অবস্তুগত দ্রব্যসামগ্রী এবং সেবাকর্ম উৎপাদিত হয়, তার আর্থিক মূল্যকে জাতীয় আয় বলে। অর্থাৎ, উৎপাদিত দ্রব্য ও সেবার দাম মুদ্রায় হিসাব করার পরে যে আয় পাওয়া যাবে তাই জাতীয় আয়।
মোট জনসংখ্যা বলতে কী বোঝায়?
কোনো একটা নির্দিষ্ট সময়ে কোনো ভৌগোলিক সীমারেখার মধ্যে যে পরিমাণ জনসংখ্যা বসবাস করে তাই মোট জনসংখ্যা। এক্ষেত্রে, বাংলাদেশের সীমারেখার মধ্যে যতজন মানুষ বসবাস করে তা বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যা।
মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি পেলে কী জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধি পায়?
একটা দেশের মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি পেলে জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধি পাবে বা মানুষের দ্রব্যসামগ্রী ক্রয় করার ক্ষমতা বাড়বে এমন নয়। এক্ষেত্রে ঐ দেশের মুদ্রাস্ফীতি এবং আয় বৈষম্য পরিমাপের সূচক যাকে বলা হয়ে থাকে “Gini Coefficient” বা গিনি সূচকের মানের উপর নির্ভর করে। মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি মানে সবার আয় একইভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে এমন নয় আবার সবার হাতে একই পরিমাণ অর্থ রয়েছে তাও নয়। কারণ এখানে মোট আয় কে মোট জনসংখ্যা দিয়ে ভাগ করে জনপ্রতি আয় হিসাব করা হয়, সবার সমান আয়ের কোনো বিষয় এখানে নেই। কোনো ব্যক্তির আয় হতে পারে ৫ লক্ষ টাকা বাৎসরিক, আবার কারও আয় হতে পারে বাৎসরিক ৬০ হাজার টাকা। এখন যদি ঐ দেশের মোট জনসংখ্যাই হয় দুই জন সেক্ষেত্রে একটা হিসাব করা যাক—
দুই জনের মোট আয় (৫০০০০০ + ৬০০০০) = ৫,৬০,০০০ টাকা, মোট জনসংখ্যা ২ জন।
তাহলে, মাথাপিছু আয় = মোট জাতীয় আয় / মোট জনসংখ্যা
= ৫৬০০০০/২
= ২,৮০,০০০ টাকা
এখানে, মাথাপিছু আয় পাওয়া গেলো ২ লক্ষ ৮০ হাজার টাকা। কিন্তু একজনের আয় ছিল বাৎসরিক ৫ লক্ষ টাকা এবং অন্যজনের আয় ছিল ৬০ হাজার টাকা। আর মাথাপিছু আয়ের হিসেবে সেও ২ লক্ষ ৮০ হাজার টাকার জনপ্রতি হিসেবের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। এখন বুঝাই যাচ্ছে যে মাথাপিছু আয় বাড়লেও কিছু মানুষের হাতে অধিক পরিমাণে অর্থ জমা হলে এবং কিছু মানুষের আয় খুব কম হলেও তা মাথাপিছু আয় দিয়ে সবার জীবনযাত্রার মান একই হারে পরিমাপ করা যায় না। এখানে আয়বণ্টনের অসমতা বা আয়বৈষম্য বিষয়টি উপস্থিত।
আয় বৈষম্য কীভাবে পরিমাপ করা হয়?
আয়বৈষম্য পরিমাপকের সূচক হলো— গিনি কোইফিশিয়েন্ট যা অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ সূচক। ইতালীয় একজন পরিসংখ্যানবিদ ১৯১২ সালে এই সহগ উদ্ভাবন করেন। আর কোনো দেশের আয় বা সম্পদের বণ্টনের অসমতা বোঝানোর জন্য এটি ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এটি ভগ্নাংশ বা অনুপাত হিসেবে প্রকাশ করা হয় এবং এর মান ০-১ এর মধ্যে হয়ে থাকে। গিনি সহগকে ১০০ দিয়ে গুণ করে শতকরা হারে প্রকাশ করলে তাকে গিনি সূচক বলা হয়। গিনি সূচকের মান শূন্য (০) এর যত নিকটবর্তী হবে ঐ দেশের আয় বণ্টনের অসমতা তত কম হবে অর্থাৎ আয়ের সুষম বণ্টন বা সবার আয় কাছাকাছি এমন বিষয় নির্দেশ করে থাকে। আর যদি এর মান এক (১) এর কাছাকাছি হয় তাহলে তা অসম বণ্টন কে নির্দেশ করে থাকে। গিনি সূচকের মান এক (১) এর যত নিকটবর্তী হবে ঐ দেশের অসম বণ্টন তত বেশি বা সবার আয়ের মধ্যে বড় ধরনের ব্যবধান কে নির্দেশ করে থাকে। অর্থাৎ শূন্য (০) চরম সমতা এবং এক (১) চরম অসমতা নির্দেশ করে।
আয়ের বণ্টনও সুষম হলো এবং মাথাপিছু আয়ও বাড়লো তবে মুদ্রাস্ফীতি হলো, এক্ষেত্রে কি জীবনযাত্রার মান বাড়বে?
কোনো দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় বাড়লো এবং আয়ের সুষম বণ্টনও হলো অর্থাৎ সবার আয় কাছাকাছি। আয় বৃদ্ধি এবং বণ্টনের পরেও জীবনযাত্রার মান বাড়বে কিনা তা ঐ দেশের দ্রব্যসামগ্রীর দামের উপর নির্ভর করে। যদি আয় বাড়ে এবং দ্রব্য ও সেবার দামের পরিবর্তন না হয় বা কমে সেক্ষেত্রে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। অর্থাৎ আগের তুলনায় সে বেশি পরিমাণে ক্রয় করতে পারে, আগে যেসব দ্রব্যের চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হতো না তাও সম্ভব হবে। কিন্তু আয় বাড়ার সাথে সাথে দ্রব্যের দামস্তরের বৃদ্ধি অর্থাৎ মুদ্রাস্ফীতি বা ইনফ্লেশন হলে মানুষের জীবনযাত্রার মান বাড়ে না এবং আয় বৃদ্ধির হার এবং মুদ্রাস্ফীতির হার যদি একই হয় তবে জীবনমান অপরিবর্তিত থাকবে। আর আয়বৈষম্য এবং তার সাথে মুদ্রাস্ফীতি বৃদ্ধি পেলে জীবনযাত্রার মানের বড় তারতম্য দেখা যাবে উচ্চ এবং নিম্ন আয়ের মানুষের মধ্যে। তাই মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির সাথে সাথে আয়ের সুষম বণ্টন এবং মুদ্রাস্ফীতির বিষয় বিবেচনা করে তবেই মানুষের জীবনযাত্রার মান বাড়ছে নাকি কমছে তা পরিমাপ করা যায়। কোনো দেশের আয় বৈষম্য যত বেশি হবে এবং মুদ্রাস্ফীতি হবে সে দেশের জনগণের জীবনযাত্রার মানের বড় পার্থক্য দেখা যাবে আর যদি আয়ের সুষম বণ্টন এবং মুদ্রাস্ফীতি কম হয় তাহলে জীবনযাত্রার মান বাড়বে।
কেন মুদ্রাস্ফীতি জীবনযাত্রার মানের সাথে সম্পর্কিত?
মুদ্রাস্ফীতি একটা দেশের জীবনযাত্রার মানের উপর নির্ভর করে কেননা মুদ্রাস্ফীতি হলে ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পায়। যদি মুদ্রাস্ফীতি হয় এবং আয় সে হারে না বাড়ে তবে জীবনযাপন মান কমে যাবে। মুদ্রাস্ফীতি দ্রব্য ও সেবার ক্রয়ক্ষমতা কমিয়ে দেয়। অর্থাৎ, বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে মুদ্রা আগের তুলনায় কম দ্রব্য বিনিময় বা ক্রয় করতে পারে। পূর্বে যদি ১০০ টাকা দিয়ে ১ কেজি পরিমাণ কোনো দ্রব্য ক্রয় করা যেত এবং এখন ঐ সমপরিমাণ ক্রয় করতে ১১০ টাকা লাগে বা ৯০০ গ্রাম কিনতে হয় তবে মুদ্রা তার ক্রয়ক্ষমতা আগের তুলনায় হারিয়েছে। জীবনযাত্রার মান তখনই বাড়বে যখন ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে। তাই আয় বৃদ্ধি হওয়ার সাথে সাথে দাম নিয়ন্ত্রণে থাকা জরুরি।
যদি আয় ঠিক থেকে মুদ্রাস্ফীতি হয় তবে জীবনযাত্রার মান হ্রাস পাবে। এক্ষেত্রে, মানুষের ভোগ ব্যয় বাড়বে এবং আগের সমপরিমাণ আয় দিয়ে চলতে হলে তাকে অবশ্যই ব্যয়ের অভ্যাস বা “Spending Habit” পরিবর্তন করতে হবে। আগে যদি দুইটা রুটি খেতো তবে এখন একটা খেতে হবে যদি দাম বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে যায়। আর আয় বৃদ্ধি না পেয়ে মুদ্রাস্ফীতি হলে সেক্ষেত্রে MPS (Marginal Propensity to Save) বা প্রান্তিক সঞ্চয় প্রবনতাও কমে যাবে।
জীবনযাত্রার মান বলতে আসলে কি বোঝায়?
জীবনযাত্রার মান বলতে সাধারণত বোঝায়- একজন ব্যক্তি কিভাবে জীবনযাপন করছেন বা তার জীবনযাপনের প্রকৃতি কেমন। সে কি বিলাসবহুল জীবনযাপন করে নাকি সাধারণ বা নিম্ন মানের জীবনযাপন করেন।
কোনো এলাকায় সাধারণত দেশের সম্পদের পরিমাণ, মানুষের আয়, চাহিদা, আর্থ-সামাজিক অবস্থা অবস্থার উপর ভিত্তি করে জীবনযাত্রার মান যাচাই করা যায়। জীবনযাত্রার মানের উপর অনেক বিষয় সম্পর্কিত যেমন— শ্রেণি-বৈষম্য, মুদ্রাস্ফীতি, চাকরির বাজারের পরিস্থিতি, ক্রয়ক্ষমতা, দ্রব্য-সেবার ব্যয়, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ইত্যাদি।
জীবনযাত্রার মান মানে হলো— একজনের জীবনযাপনের সাথে অন্যজনের পার্থক্য। কেউ ভালো খেতে পারে এবং ভালো পোশাক পরিধান করতে পারে কিন্তু অন্য একজন ভালো খেতে পারে না বা ভালো পোশাক পরিধানও করতে পারে না। এক্ষেত্রে দ্বিতীয় ব্যক্তির জীবনযাত্রার মান প্রথম ব্যক্তির তুলনায় নিম্ন এবং তাদের জীবনযাত্রার মান ভিন্ন।
মাথাপিছু আয় ও জীবনযাত্রার মান প্রসঙ্গে অর্থনীতির বক্তব্য কী?
মানুষের মাথাপিছু আয় বাড়লে তবে জীবনযাত্রার মান বাড়ে। কিন্তু আয় বণ্টনের সমতা এবং আয় বৃদ্ধির সাথে সাথে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে থাকা অত্যাবশক। অর্থাৎ, মাথাপিছু আয় বাড়লো কিন্তু একজনের আয়ের সাথে অন্য একজনের আয়ের ব্যবধান পরিলক্ষিত হলো সেকেক্ষে সবার জীবনযাত্রার মান বাড়লো না। আবার মুদ্রাস্ফীতি হলো সেক্ষেত্রে জীবনযাত্রার মান বাড়বে না তাতে যদি মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি পেয়েও থাকে।