দেহের যেসব প্রাণপদার্থ মানুষকে সুখী রাখে
- প্রকাশ: ০৩:২৪:২৫ অপরাহ্ন, সোমবার, ১২ সেপ্টেম্বর ২০২২
- / ১০৭৬ বার পড়া হয়েছে
“সবাই তো সুখী হতে চায়, তবু কেউ সুখী হয়, কেউ হয়না।” কিংবদন্তি শিল্পী মান্না দে এই গানটি করেছেন এক সামাজিক প্রেক্ষাপট থেকে। তবে, স্নায়ুবিজ্ঞানের ভাষাতেও সবার কপালে সুখ স্থায়ী হয় না; যদিও, আমাদের জীবন আনন্দময় হোক সে লক্ষ্যেই সৃষ্টিকর্তা আমাদের মস্তিষ্ককে ডিজাইন করেছেন। আমাদের বেঁচে থাকার জন্য, প্রয়োজনীয় সবকিছুই ভালোভাবে অনুভব করার জন্য, মস্তিস্ক সেভাবেই তৈরি। মানুষের মতো জগতের সমস্ত প্রাণী আনন্দের সন্ধান খোঁজে, এড়িয়ে চলে ব্যথা ও অবসাদগ্রস্ততা। আমাদের মস্তিষ্কে স্ব-উৎপাদিত কিছু প্রাণপদার্থের মাধ্যমেই জীবনের সাধনা ও সংগ্রামকে আনন্দে পরিণত করে এবং যখন আমরা সেগুলি অর্জন করি তখনই আমরা আনন্দিত হই। সে সুখ খুঁজে পেতে কেউ বলেন বেশি করে আড্ডা দিতে, গভীরভাবে আলিঙ্গন করতে, খোলা মনে হাসতে- আবার কেউ বলেন অধিক পরিমানে পানি পান করতে, চুইংগাম চিবুতে বা দই খেতে। জানি, এসব কিছুর পেছনে যুক্তি আছে। তবে, মানসিক চাপ, দুশ্চিন্তা ও প্রাণপদার্থের ঘাটতিতে সেই সতেজ ও চাঙ্গা অনুভবকে দমিয়ে দিতে পারে। তাই অনেকের মতে, মনকে সতেজ রাখুন, উপরোক্ত প্রেসক্রিপশন ছাড়াও প্রতিদিন অন্তত ২/১টি গান শুনুন। আর গান যদি গাইতে পারেন, তাহলে তো সোনায় সোহাগা! গান মস্তিষ্কে ‘ডোপামিন’ নামক একটি প্রাণপদার্থ নিঃসরণ করে থাকে, যা আমাদের মুডকে উজ্জীবিত করে, মানসিক চাপ কমিয়ে দেয়, বাড়ে স্মৃতি ও মেধাশক্তি। তাছাড়া, আপনার প্রতিদিনের রুটিনে ব্যায়াম করার অভ্যাসও করুন।
স্নায়ুতন্ত্রের মৌল একক হচ্ছে নিউরোন (neuron) বা স্নায়ুকোষ। মানুষের মস্তিষ্ক প্রায় ৮৬ বিলিয়ন নিউরোন ও সমপরিমাণ গ্লিয়া কোষের সমন্বয়ে সৃষ্ট একটি জটিল অঙ্গ, যেখানে ২.৫ মিলিয়ন গিগাবাইট ডিজিটাল সমতুল্য মেমরি ও আবেগ ধরে রাখা সক্ষম। ১৩০০ গ্রামের এই মস্তিষ্কের বিভিন্ন অঞ্চল বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত, তম্মধ্যে সুখ-আবেগ-অবসাদ সম্পর্কিত নির্দিষ্ট কিছু অঞ্চলও এই নিবন্ধে ব্যাখ্যাত হয়েছে। আমরা যে উষ্ণতা বা আবেগ অনুভব করি তা সম্পূর্ণ রাসায়নিক সংবেদনের কারণেই ঘটে- তা কী আমরা কখনও ভেবেছি? যেসব রাসায়নিক পদার্থ আমাদের সেই সুখ, ঘনিষ্ঠতা ও আনন্দের অনুভূতি এনে দেয়, সেগুলো মস্তিষ্ক থেকে নিঃসৃত প্রোটিন, নিউরোট্রান্সমিটার ও তাদের পরিবেশগত মিথস্ক্রিয়ার ফলেই ঘটে থাকে। এসবের মিশলেই আমরা সুখ অনুভব করি। নিবন্ধে, সেরকম সাতটি প্রাথমিক রাসায়নিক পদার্থ বা প্রোটিন উল্লেখ করেছি, যা আমাদের ইতিবাচক আবেগ অনুভব করায়। এই প্রোটিনগুলো সংশ্লেষিত হয় ডিএনএ জিনোমের তাদের স্ব-স্ব জিনগুলো থেকে । সেই জিনগুলোর ত্রুটি বা মিউটেশনের ফলে জীবন হতে পারে ধূসরময়, সৃষ্টি হয় নানান স্নায়ুঅবক্ষয়জনিত অসুখ, ব্যথা-বেদনা ও বিস্বাদগ্রস্ততা।
আনন্দমাইড (Anandamide)— পরম আনন্দদায়ক একটি অণু
আনন্দমাইড (N-arachidonoylethanolamine) একটি ফ্যাটি অ্যাসিড নিউরোট্রান্সমিটার। সংস্কৃত শব্দ ‘আনন্দ’ থেকে নামকরণ করা হয়েছে এই রাসায়নিক পদার্থটির। এটি এন্ডোকানাবিনয়েড (endocannabinoids) গ্রুপের একটি অণু, যা মস্তিষ্ক থেকে নিঃসৃত। রসায়নের ভাষায় এটি ওমেগা-৬ ফ্যাটি অ্যাসিড (আরাকিডোনিক অ্যাসিড/ arachidonic acid) এর একটি উপজাত। আনন্দমাইড CB1/CB2 ক্যানাবিনয়েড রিসেপ্টর (two G protein-coupled receptors)গুলির সাথে আবদ্ধ হয়ে দেহের এন্ডোক্যানাবিনয়েড সিস্টেমে অংশগ্রহণ করে। CB রিসেপ্টর প্রধানত মস্তিষ্ক এবং প্রান্তীয় স্নায়ুতন্ত্রে পাওয়া যায়। CB1/CB2 রিসেপ্টরের সাথে আনন্দমাইডের আবদ্ধতা ডোপামিন, সেরোটোনিন, GABA (গামা-অ্যামিনোব্যুটারিক অ্যাসিড) এবং গ্লুটামেট স্নায়ুসংকেত পরিবহনে ভূমিকা পালন করে বলে প্রমাণিত। এ সেই রিসেপ্টর যেখানে গাঁজা বা ম্যারিওয়ানা থেকে প্রাপ্ত সাইকোঅ্যাকটিভ যৌগ THC (Tetrahydrocannabinol) মস্তিষ্কে মাদকাসক্তি সৃষ্টি করে। গোলমরিচে বিদ্যমান একটি অ্যালকালয়েড ‘গিনিনসিন’ (Guineensine) আনন্দমাইডের প্রিসিনাপ্টিক স্নায়ুকোষীয় পুনঃগ্রহণ (re-uptake)কে বাধা দেয়। ফলে সিনাপ্স (দুটি পাশাপাশি নিউরোনের সংযোগস্থল)-এ আনন্দমাইডের প্রাপ্যতা বৃদ্ধি পায়। প্রসঙ্গতঃ সিন্যাপ্সের মাধ্যমেই স্নায়ুতাড়না এক স্নায়ুকোষ থেকে অন্য স্নায়ুকোষে পরিবাহিত হয়। আনন্দমাইড আশাবাদ সংকেতের মাধ্যমে অভিলষণীয় উদ্দীপকের ভূমিকা পালন করে। এছাড়াও, আনন্দমাইড মানসিক চাপ কমায়, ব্যথা হ্রাস করে, স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধি করে এবং সর্বোপরি এক ধরণের অভিনবত্ব সৃষ্টিতে বদ্ধপরিকর এই নিউরোট্রান্সমিটারটি। আনন্দমাইড উদ্ভিদে, তামাক-জর্দা ও চকলেটও পাওয়া যায়।
অক্সিটোসিন— আদর-সোহাগের অণু
অক্সিটোসিন (Oxytocin) এমনই একটি হরমোন যা মানুষের বন্ধন এবং আস্থা ও আনুগত্য বৃদ্ধির সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত। এটি একটি সম্পর্ক-সংযোগকারী অণু। কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, অক্সিটোসিনের উচ্চ মাত্রা ও রোমান্টিকতা একই সুতোই গাঁথা। যদি কোনো যুগল দীর্ঘ সময়ের জন্য আলাদা থাকে, শারীরিক যোগাযোগের অভাবে তাদের, বিশেষকরে নারীদের, অক্সিটোসিনের মাত্রা হ্রাস করে এবং সেই ব্যক্তির সাথে আবার বন্ধনের আকাঙ্ক্ষার অনুভূতিকে প্রবলভাবে জাগিয়ে তোলে। সম্ভবতঃ পুরুষদের মধ্যে এই কাজটি করে ভাসোপ্রেসিন (অক্সিটোসিনের ঘনিষ্ঠ কাজিন-প্রোটিন)। মানবজিনোমে অক্সিটোসিন ও ভ্যাসোপ্রেসিন (vasopressin) জিন-দুটি ২০ নং ক্রমেজোমে পাশাপাশি অবস্থিত, যাদের সংকেতে এই প্রোটিনগুলো তৈরি হয়। সম্ভবতঃ তাদের পূর্বপুরুষ জিনটির ডুপ্লিকেশনের (gene duplication) মাধ্যমেই প্রায় ৫০০ মিলিয়ন বছর আগে এই দুটি জিনের সৃষ্টি (Gimpl G, Fahrenholz F, Physiological Reviews. 81 (2): 629–683)।
সাধারণত মস্তিষ্কের হাইপোথ্যালামাস (hypothalamus)-এ উৎপাদিত এবং পিটুইটারি গ্রন্থির পশ্চাৎ অংশ (neurohypophysis) থেকে নির্গত অক্সিটোসিন (Oxt) হচ্ছে নয় অ্যামিনো অ্যাসিড-বিশিষ্ট একটি পেপটাইড হরমোন (নিউরোপেপটাইড), যা প্রজননে, বিশেষ করে সন্তান প্রসবের সময় এবং প্রসবের পরে, এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অক্সিটোসিন জরায়ুর সংকোচন ও সার্ভিক্স (cervix) প্রসারণকে উদ্দীপিত ক’রে প্রসবের প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত ও সহজতর করে। হরমোন এস্ট্রোজেন এর প্রভাবে অক্সিটোসিনের নিঃসরণ বৃদ্ধি পায়। মস্তিষ্ক ছাড়াও কর্পাস লুটিয়াম (ডিম্বাশয়), প্লাসেন্টা এবং মুষ্ক-তেও অক্সিটোসিন সংশ্লেষিত হয়। স্তনে দুগ্ধ উৎপাদন এবং শিশুর সাথে বন্ধন সৃষ্টিতেও এর ভূমিকা অনস্বীকার্য। অক্সিটোসিন এই কাজগুলি করে তার রিসেপ্টরের মাধ্যমে, যা ‘জি প্রোটিন’-যুক্ত (G protein-coupled) অক্সিটোসিন-রিসেপ্টর (OXTR) নামে অভিহিত। OXTR অবস্থান করে মস্তিষ্কে, স্তনে, জরায়ুর এন্ডোমেট্রিয়াম (endometrium) ও রেটিনায়। এই অণুটি আবিষ্কার করে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন মার্কিন বিজ্ঞানী ভিন্সেন্ট ডু ভিগনেউড (Vincent Du Vigneaud) ১৯৫৫ সনে।
এন্ডোরফিন— ব্যাথানাশক অণু
এই হরমোনটি অন্তৰ্জ (endogenous) মরফিন নামেও পরিচিত। এটি একটি অপিওয়েড নিউরোপেপটাইড ও পেপটাইড হরমোন। এন্ডোরফিন (endorphins)এর বেদনানাশক ক্ষমতা মরফিনের প্রায় ২০ গুণ বেশি। মানুষ ও অন্যান্য স্তন্যপায়ী প্রাণিদের মস্তিষ্কে, হাইপোথ্যালামাস ও পিটুইটারি গ্রন্থিতে এন্ডোরফিন সংশ্লেষিত হয় এবং সংরক্ষণ করা হয় পিটুইটারি গ্রন্থিতে। তাদের ফার্মাকোলজি-কার্যকলাপের উপর ভিত্তি করে এন্ডোরফিনকে তিনিটি শ্রেণীতে ভাগ করা হয়েছে: α-এন্ডোরফিন, β-এন্ডোরফিন এবং γ-এন্ডোরফিন। তিনটি এন্ডোরফিন-ই অগ্রাধিকারমূলকভাবে μ-অপিওয়েড রিসেপ্টর (μ-opioid receptors)গুলির সাথে আবদ্ধ হয়ে কাজ করে। এন্ডোরফিন তার বিভিন্ন রিসেপ্টরের মাধ্যমে মূলত দুটি নিউরোট্রান্সমিটারকে ব্লক করে, যেমন নিউরোট্রান্সমিটার P (neurotransmitter P) ও গামা-অ্যামিনোবুটারিক অ্যাসিড (GABA)। GABA-নিঃসরণ বাধাগ্রস্থ হওয়ায় বৃদ্বি পায় সুখের হরমোন ডোপামিন। এন্ডোরফিনের প্রধান কাজ হলো ব্যথা সংকেতের যোগাযোগকে বাধা দেওয়া, অর্থাৎ এটি একটি ব্যাথানাশক প্রোটিন। এ ছাড়াও, এন্ডোরফিন অন্যান্য অপিওয়েড ড্রাগের অনুরূপ আনন্দ, উত্তেজনা ও সুখের তীব্র অনুভূতিও তৈরি করতে পারে, যাকে বলা হয় ইউফোরিয়া (euphoria)।
GABA- দুশ্চিন্তা-রোধক অণু
গামা-অ্যামিনোব্যুটারিক অ্যাসিড (gamma-aminobutyric acid) হলো একটি অ্যামিনো অ্যাসিড যা মস্তিষ্ক ও মেরুরজ্জু (spinal cord)তে প্রতিরোধক নিউরোট্রান্সমিটার হিসেবে কাজ করে। এনজাইম গ্লুটামেট ডিকারবক্সিলেজ (glutamate decarboxylase)র মাধ্যমে পূর্বসূরী গ্লুটামেট থেকে প্রিসিন্যাপটিক নিউরনের সাইটোপ্লাজমে সংশ্লেষিত হয় GABA, কোফ্যাক্টর হিসেবে সহযোগিতা করে ভিটামিন বি৬ (পাইরিডক্সিন/pyridoxine)। দুটি প্রধান পোস্ট-সিনাপটিক রিসেপ্টর (GABA-A ও GABA-B)গুলির সাথে আবদ্ধ হয়ে GABA তার প্রতিরোধমূলক প্রভাব ফেলে। GABA-A রিসেপ্টর হলো একটি আয়োনোট্রপিক (Ionotropic) রিসেপ্টর (ligand-gated ion channel), যা GABA বন্ধনে পোস্টসিন্যাপটিক ক্লোরাইড (chloride) চ্যানেলের মাধ্যমে ক্লোরাইড আয়নের পরিবাহিতা বাড়ায় ও প্রতিহত করে অ্যাকশন পটেনশিয়াল বা স্নায়ু-উত্তেজনাকে। অপরপক্ষে, GABA-B রিসেপ্টর একটি মেটাবোট্রপিক ‘জি প্রোটিন’-যুক্ত (metabotropic G protein-coupled) রিসেপ্টর, যা পোস্টসিন্যাপটিক পটাসিয়াম চ্যানেলের মাধ্যমে পটাসিয়ামের পরিবাহিতা বাড়ায় এবং প্রিসিন্যাপটিক ক্যালসিয়াম পরিবাহিতা হ্রাস করে- ফলস্বরূপ, পোস্টসিন্যাপটিক নিউরনে হাইপারপোলারাইজেশন (hyperpolarization) অবস্থার সৃষ্টি হয় ও অ্যাকশন পটেনশিয়াল সঞ্চালনকে রোধ করে। যে রিসেপ্টরের মাধমেই সংকেত বাহিত হোক না কেন, GABA স্নায়ুর উত্তেজনামূলক সঞ্চালনকে বাধা দেয়। স্বাভাবিকভাবে, GABA নিউরোনগুলির অতিরিক্ত উত্তেজনা কমিয়ে উদ্বেগ কমায়, মনোযোগ বৃদ্ধি করে, অনিদ্রা থেকে মুক্তি দেয়, রক্তচাপ কমায় এবং সর্বোপরি প্রশান্তির অনুভূতি এনে দেয়। দেখা গেছে, GABA সিগন্যালিং এর অস্বাভাবিকতা অনেক স্নায়বিক এবং মানসিক অবস্থার সৃষ্টি করে। বর্তমানে গবেষণায় প্রমাণিত যে, বার্ধক্যের সাথে সাথে GABA নিঃসরণও হ্রাস পায় যা মানুষের জ্ঞানীয় ক্ষমতা ও স্মৃতিশক্তির উপর আঘাত হানে। স্নায়ুতন্ত্রের পাশাপাশি, অগ্ন্যাশয়ের ইনসুলিন-উৎপাদনকারী β-কোষেও GABA অপেক্ষাকৃত উচ্চ মাত্রায় উৎপাদিত হয়। GABA অগ্নাশয়ের β-কোষকে উদ্দীপিত করে, কিন্তু আলফা-কোষের সংকেতকে বাধা দেয়। যোগাভ্যাস ও আত্মনিয়ন্ত্রণ অনুশীলনের মাধ্যমে প্রাকৃতিকভাবে GABA সংশ্লেষণের পরিমান বৃদ্ধি করা যায়।
এপিনেফ্রিন— মানসিকচাপ নিবারক ও কর্মশক্তির উদ্দীপক
মানসিক স্ট্রেস বা চাপ জীবনের সব থেকে বড়ো শত্রু। আপনি যদি উচ্চ-স্তরের মানসিক প্রতিক্রিয়াশীল ব্যক্তিদের মতো উদ্বেগপ্রবণ হন, তাহলে খুব সামান্য দুঃশ্চিন্তায় আপনার মানসিক চাপ বেড়ে যেতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, আপনি হয়তো পিএইচডি অভিসন্দর্ভ জমা দিয়েছেন, প্রতীক্ষায় আছেন ও ভাবছেন ডিগ্রি হবে কী হবে না, কিংবা চাকুরীস্থলে সামনে আপনার প্রমোশন ইন্টারভিউ আছে- পদমর্যাদা বৃদ্ধি পাবে কী পাবে না। এইসব ভেবেচিন্তে আপনার মানসিক উত্তেজনা বেড়ে গেছে। আপনার এই মানসিক চাপ এড়াতে বা মানসিক উত্তেজনার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে নিঃসৃত হবে এপিনেফ্রিন (epinephrine) বা অ্যাড্রিন্যালিন (adrenaline) হরমোন। বস্তুতঃ এই চাপকে অনুভব করার জন্যই এপিনেফ্রিন হরমোনের ক্ষরণ। সাধারণত অ্যাড্রিনাল (adrenal) গ্রন্থি ও কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের সুষুম্নাকাণ্ড (মেডুলা অবলংগাটা)র অল্প সংখ্যক নিউরোন থেকে এপিনেফ্রিন নিঃসৃত হয়। মানসিক চাপে উদ্দীপ্ত হয় দেহের ‘ফাইট-অর-ফ্লাইট’ (Fight-or-flight) রেসপন্স, যখন কোনো বাস্তব বা কাল্পনিক বিপদের আশঙ্কা আমাদের শারীরিক বা মানসিক নিরাপত্তাকে বিনষ্ট করে। এপিনেফ্রিন ছোটো-ছোটো রক্তনালীগুলিকে সংকুচিত ক’রে দেহের প্রধান পেশীগুলোতে রক্তপ্রবাহ বাড়িয়ে দেয়। পেশিগুলো থেকে বেরিয়ে আসে সঞ্চিত গ্লুকোজ, যোগায় মানসিক ও দৈহিক শক্তি; যদিও, সাময়িকভাবে বেড়ে যায় রক্তচাপ, হৃদস্পন্দন, শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি ও রক্তে শর্করার মাত্রা। এহেন অবস্থায় এপিনেফ্রিন উৎফুল্লতা বাড়িয়ে আমাদের দেয় মানসিক ও শারীরিক শক্তি। সাথে ক্ষরিত হয় নিউরোট্রান্সমিটার সেরোটোনিন ও ডোপামিন, যা মানসিক চাপের প্রতিক্রিয়াকে প্রশমিত করে। এপিনেফ্রিন তার এই প্রতিক্রিয়াগুলো সৃষ্টি করে সমবেদী (sympathetic) স্নায়ুতন্ত্রের আলফা- ও বিটা-অ্যাড্রিনেরজিক (adrenergic)রিসেপ্টরের সাথে আবদ্ধ হয়ে। এক্ষেত্রে কোষাভ্যন্তরে মূল সংকেতবাহী অণু হচ্ছে সাইক্লিক এএমপি (cAMP)। তবে অতিরিক্ত মাত্রায় এপিনেফ্রিন-ক্ষরণ দেহের ক্ষতি করতে পারে। ১৮৯৫ সালে রুশ বংশোদ্ভুদ নেপোলিয়ন সাইবুলস্কি (Napoleon Cybulski) প্রথম এড্রেনালিন পৃথকীকরণ করেন। ওষুধ হিসেবে এপিনেফ্রিন অ্যালার্জিজনিত অ্যানাফাইল্যাক্সিস (anaphylaxis), কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট, এবং হাঁপানি অসুখে ব্যবহৃত হয়। কোভিড-১৯ চিকিৎসায় এপিনেফ্রিনের ব্যবহারেও ইতিবাচক সাড়া পাওয়া গিয়েছে।
সেরোটোনিন— সুখানুভূতির হরমোন
সেরোটোনিন (serotonin) সক্রিয়ভাবে মানুষের মেজাজ ও আচরণ নিয়ন্ত্রণে জড়িত। সেরোটোনিন একটি সংকেতবাহী রাসায়নিক (নিউরোট্রান্সমিটার), যার মাধ্যমে একটি নিউরোন অন্যান্য নিউরোনের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করে। এর রাসায়নিক নাম হচ্ছে ৫-হাইড্রক্সিট্রিপ্টামিন (5-hydroxytryptamine, 5-HT)। অ্যামিনো অ্যাসিড ট্রিপটোফ্যান থেকে তৈরি হয় সেরোটোনিন, দুইটি এনজাইম (Tryptophan hydroxylase ও 5-HTP decarboxylase)এর সাহায্যে। মস্তিষ্কে এটি একরকম কাজ করে, শরীরের অন্য জায়গায় আরেক কাজ করে। ৯০ শতাংশ সেরোটোনিন উৎপন্ন হয় অন্ত্রীয় স্নায়ুতন্ত্রে (enteric nervous system), যা মূলত পাকস্থলী ও অন্ত্রের সঞ্চালন (peristalsis)কে সাহায্য করে। অন্ত্রীয় স্নায়ুতন্ত্রে নিউরোনের সংখ্যা প্রায় ১০ কোটিরও বেশি যা প্রায় সমগ্র সুষুম্নাকাণ্ডের নিউরোন সংখ্যার চেয়েও বেশি। মস্তিষ্কের পেছনের একটি অংশ ‘মস্তিষ্ককাণ্ড’ (brainstem: raphe nuclei) থেকে নিঃসৃত হয় সেরোটোনিন। এছাড়া, মস্তিষ্কে পাইনিল (pineal) গ্রন্থি ও চোখের রেটিনাতেও উৎপন্ন হয় সেরোটোনিন। পাইনিল গ্রন্থি ও রেটিনায় সেরোটোনিন থেকে তৈরি হয় মেলাটোনিন (melatonin), রাতের হরমোন। মস্তিষ্ককাণ্ড শরীরের জীবনরক্ষাকারী বহু কার্যক্রমের নিয়ন্ত্রক, যার মধ্যে রয়েছে হৃৎস্পন্দন, রক্তনালী সংকোচন, শ্বাস-প্রশ্বাস, ঘুম, ক্ষুধা ইত্যাদি। এছাড়াও, সেরোটোনিন মুড, মেজাজ, স্মৃতি, মন ভালো থাকা ইত্যাদির ওপর প্রভাব বিস্তার করে। রক্তের প্লাটেলেট্স (platelets)গুলিতে সঞ্চিত সেরোটোনিন রক্ত জমাট বাঁধতেও সাহায্য করে। এমনকি গর্ভে একটি ভ্রূণের মধ্যে হৃৎপিণ্ডের প্রথম সংকোচন সেরোটোনিনের কারণে ঘটে। সূর্যের আলো, ব্যায়াম, ট্রিপটোফ্যান-সম্মৃদ্ধ খাবার, ইত্যাদি শরীরে সেরোটোনিনের নিঃসরণ বাড়ে। সেরোটোনিন হচ্ছে দিনের অণু, কিন্তু মেলাটোনিনের আধিক্য হলো রাত্রিতে; সে কারণেই মেলাটোনিন কে বলা হয় ঘুমের হরমোন।
সেরোটোনিন তার প্রভাব সৃষ্টি করে কেন্দ্রীয় ও প্রান্তীয় স্নায়ুতন্ত্র এবং দেহের অন্যান্য কোষের প্লাজমা-ঝিল্লিতে অবস্থিত সেরোটোনিন রিসেপ্টর (5-HT receptors)গুলির মাধ্যমে। এই রিসেপ্টর পরিবারে (5-HT1– 5-HT7) রয়েছে পাঁচটি উত্তেজক ও দুইটি নিরোধক রিসেপ্টর। 5-HT3 ছাড়া বাকি সবগুলো জি প্রোটিন-যুক্ত (G protein-coupled) রিসেপ্টর। 5-HT3 হচ্ছে লাইগ্যান্ড-গেটেড আয়ন চ্যানেল। সেরোটোনিন রিসেপ্টরগুলি গ্লুটামেট, GABA, ডোপামিন, এপিনেফ্রিন/নর-এপিনেফ্রিন ও অ্যাসিটাইলকোলিন (acetylcholine)-সহ অনেক নিউরোট্রান্সমিটারের মুক্তির সাথে সম্পৃক্ত।
সেরোটোনিন মানুষের মনে যেমন চঞ্চলতা আনে, তেমনি এর ঘাটতিতে সৃষ্টি হয় বিষণ্ণতা। সেরোটোনিনের একটি অনাকাঙ্খিত বৈশিষ্ট্য হলো যে সিনাপ্সে (synapse: দুইটি নিউরনের সংযোগস্থল) তার মুক্তির সাথে সাথে এটি আবারো প্রত্যাবর্তন করে তার উৎসে, অর্থাৎ প্রিসিনাপ্টিক নিউরনে। এই পুনঃগ্রহনের প্রক্রিয়াটিকে বলা হয় রি-আপটেক (reuptake)। সেরোটোনিনের প্রত্যাবর্তনকে প্রতিহত করে এক ধরণের ওষুধ, SSRI (সিলেক্টিভ সেরোটোনিন রিআপটেক ইনহিবিটর), যা অবসাদ নিয়ন্ত্রণে অন্যতম ওষুধ হিসেবে বিবেচিত, যদিও সবার ক্ষেত্রে এই অ্যান্টিডিপ্রেসেন্টগুলি একই ফলাফল দেখায় না- ফলে বিতর্কের ঝড় উঠেছে এই ওষুধগুলির সার্বিক সুফল নিয়ে (Gregory A, Little evidence that chemical imbalance causes depression, www.theguardian.com/society/2022/)। অবসাদ একটি জটিল অবস্থা যার একাধিক কারণ রয়েছে ৷ শুধুই যে মস্তিষ্কে কম সেরোটোনিনের মাত্রা অবসাদের কারণ তা বর্তমানে গবেষকরা মনে করেন না। মস্তিষ্কের অ্যামিগডালা (amygdala) এবং প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স (prefrontal cortex)র মতো অঞ্চলগুলির সাথে সম্পর্ক রয়েছে বিষণ্ণতা ও দ্বিপ্রান্তিক মানসিক ব্যাধি (bipolar disorder) ৷ শেষোক্ত দুটি অঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করে স্মৃতিশক্তি, জ্ঞানীয় কর্মক্ষমতা, সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং দুশ্চিন্তা-সহ নানান মানসিক প্রতিক্রিয়া। অবসাদে আক্রান্ত ব্যক্তিদের অ্যামিগডালা অঞ্চলে নিউরোনের পরিমাণ কমেছে, সাথে অ্যামিগডালা ও কর্টেক্সের মধ্যে সংযোগও কমেছে, বিজ্ঞানীরা বর্তমানে তারই প্রমাণ পেয়েছেন ৷
ডোপামিন— ভালোবাসার অণু
মস্তিষ্কের তিনটি অঞ্চল (নিউক্লিয়াস অ্যাকাম্বেন্স [nucleus accumbens], অ্যামিগডালা [amygdala]এবং মধ্যবর্তী প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স) নিয়ে গঠিত একটি অভ্যন্তরীণ নেটওয়ার্ক সৃষ্টি করে সামাজিক বন্ধন। সেই বন্ধনের মূল চাবিকাঠি হচ্ছে ডোপামিন। গবেষণায় দেখা যায়, শিশু ও মায়ের মধ্যে বন্ধন সৃষ্টি হয় ডোপামিনের মাধ্যমে। মা-শিশুর যোগাযোগে মা ও শিশু উভয়ই ডোপামিন নিঃসরণ করে, যা ক্রমশঃ তাদের বন্ধনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। (Atzil S , Touroutoglou A , Rudy T et al. Dopamine in the medial amygdala network mediates human bonding. Proc Natl Acad Sci USA. 2017, 28,114: 2361-2366)। ডোপামিনের সাহায্যে, আমরা প্রাথমিক জিনিসগুলি উপভোগ করি: ফুলের ঘ্রাণ থেকে শুরু করে মনোরম স্পর্শকাতর সংবেদনগুলি। ভাল ঘুম, সহজেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ, গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে মনোনিবেশ করা-সহ তৃপ্তিভরে খাবার গ্রহণ, অন্তরঙ্গ সম্পর্ক, সানন্দে কেনাকাটা ইত্যাদি উপভোগ করি ডোপামিনের মহানুভবতায়।
উল্লেখ্য, ভ্রূণ অবস্থায় চোখের উন্নয়ন ও বৃদ্ধিতে ডোপামিনের ভূমিকা অনস্বীকার্য। এমনকি, একটি সদ্যজাত শিশুর দৃষ্টি ও চোখে আলোর প্রতিসরণ (refraction)স্বাভাবিক হতেও তার সময় লেগে যায় বেশ কয়েক মাস। জন্মায় হাইপারোপিক (hyperopia/farsightedness) দৃষ্টি নিয়ে, অর্থাৎ কাছের বস্তু দেখে খুব অস্পষ্ট, তবে দূরের জিনিস দেখে কিছুটা স্পষ্ট। ধীরে ধীরে তার এই প্রতিসরণ ত্রুটি ঠিক হয় ডোপামিনের ভূমিকায়।
ক্যাটেকোলামাইন (catecholamine)
যে গ্রুপে এপিনেফ্রিন ও নর-এপিনেফ্রিন হরমোনও অন্তর্ভুক্ত) পরিবারের একটি হরমোন ও নিউরোট্রান্সমিটার হচ্ছে ডোপামিন। ডোপামিন প্রধানত মস্তিষ্কে সংশ্লেষিত হয়, তবে অ্যাড্রিনাল গ্রন্থির মেডুলা এবং রেটিনার অ্যামাক্রাইন (amacrine) কোষগুলিও ডোপামিন তৈরি করতে সক্ষম৷ চোখের রেটিনায় ডোপামিন একটি নিউরোমডুলেটর যা দিনের আলোয় চোখের দৃষ্টিসহ কোষীয় বিভিন্ন কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করে (Nir I, Haque R, et al., Diurnal metabolism of dopamine in the mouse retina. Brain Res. 2000, 870(1-2):118-25)। প্লাসেন্টা থেকেও সংশ্লেষিত হয় এই হরমোন। মানুষের মস্তিষ্কে ডোপামিনার্জিক (dopaminergic) নিউরোন (যেসব স্নায়ুকোষ ডোপামিন সংশ্লেষ করে) সংখ্যায় তুলনামূলকভাবে অনেক কম (প্রায় চার লক্ষ নিউরোন) এবং সেগুলো মূলতঃ মস্তিষ্কের সাবস্ট্যানশিয়া নাইগ্রা (substantia nigra) ও ভেন্ট্রাল টেগমেন্টাল অঞ্চল (ventral tegmental area)জুড়ে অবস্থিত (ছবি দেখুন)। এছাড়াও, অন্যান্য অঞ্চল থেকেও স্বল্পপরিমানে ডোপামিন নিঃসৃত হয়। ডোপামিনের পূর্বসূরী এল-ডোপা (L-dopa/levodopa), অ্যামিনো অ্যাসিড ফেনিল্যালানিন (phenylalanine) বা টাইরোসিন (tyrosine) থেকে সংশ্লেষিত হতে পারে। প্রথমটি আমাদের দেহে তৈরি হয় না, খাবার থেকে সংগ্রহ করতে হয়। যদিও এই অ্যামিনো অ্যাসিডগুলি প্রায় প্রতিটি প্রোটিনে বা খাবারে সহজেই পাওয়া যায়, কিস্তু এগুলি রক্ত-মস্তিষ্কের প্রতিবন্ধকতা (blood-brain barrier) অতিক্রম করতে সক্ষম নয়। ফলে নিউরোনের কার্যকলাপ সঞ্চালনের জন্য মস্তিষ্কের ভিতরেই ডোপামিনের সংশ্লেষণ হওয়া বাঞ্চনীয়। টাইরোসিন হাইড্রোক্সিলেজ (tyrosine hydroxylase) এনজাইম দ্বারা টাইরোসিন রূপান্তরিত হয় এল-ডোপা (L-DOPA)-তে। এল-ডোপা এনজাইম ডোপা ডিকারবক্সিলেজ (DOPA decarboxylase) দ্বারা ডোপামিনে রূপান্তরিত হয়। ডোপামিন স্বয়ং রূপান্তরিত হতে পারে নর-এপিনেফ্রিন ও এপিনেফ্রিন নিউরোট্রান্সমিটারে। চোখের রেটিনায় ডোপামিন নিঃসরণকারী নিউরোন হচ্ছে অ্যাক্সন-বিহীন অ্যামাক্রাইন (amacrine) কোষ। অ্যাক্সন না থাকায় ডোপামিন নিঃসৃত হয় কোষের বাইরে ৷ ডোপামিনকে বলা হয় দিনের হরমোন ৷ রেটিনায় নিঃসৃত এই ডোপামিন চোখের ‘রড’ (rod cells)কোষগুলির কার্যাবলীকে দমন করার সময় রেটিনার ‘কোণ’ (cone cells) কোষগুলির কার্যকলাপকে সমুন্নত রাখে। এছাড়া, দিনের বেলায় রাতের হরমোন ‘মেলাটোনিন’ নিঃসরণকেও দমিয়ে রাখে। এরা একে অপরের নিয়ন্ত্রক। ডোপামিন ও মেলাটোনিন উভয়ের নিঃসরণ জৈবিক ঘড়ি (biological clock) দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। শুধু সেরোটিনের অভাবেই নয়, ডোপামিনের স্বল্পতাও বিষণ্ণতা ডেকে আনে। এছাড়া, মস্তিষ্কে ডোপামিনের অভাব পার্কিনসন’স রোগ (Parkinson’s disease)র মূল কারণ।
ডোপামিন তার অনুভূতি প্রকাশ করে ডোপামিন-রিসেপ্টরের সংস্পর্শে। পাঁচ ধরণের ডোপামিন রিসেপ্টর (D1-D5) রয়েছে। এই রিসেপ্টরগুলি পোস্টসিন্যাপটিক (postsynaptic) নিউরনের ডেনড্রাইডে অবস্থিত । পাঁচটি রিসেপ্টর দুইটি গ্রুপে বিভক্ত- D1-এর মতো (D1-like: D1 ও D5) এবং D2-এর মতো (D2-like: D2, D3 ও D4) রিসেপ্টর। এই রিসেপ্টরগুলি মেটাবোট্রপিক, জি প্রোটিন-কাপল্ড রিসেপ্টর হিসেবে কাজ করে, যার অর্থ তারা একটি জটিল সংকেত-সংবহনের মাধ্যমে তাদের প্রভাব প্রয়োগ করে। D1 ও D5 রিসেপ্টরগুলি সোডিয়াম চ্যানেল (sodium channel) খোলার মাধ্যমে নিউরনে উত্তেজনামূলক প্রভাব আনতে পারে, অথবা পটাসিয়াম চ্যানেল (potassium channel) খোলার মাধ্যমে তারা প্রতিরোধমূলক প্রভাব ফেলতে পারে। অপরপক্ষে, D2-এর মতো রিসেপ্টরগুলি (D2, D3 এবং D4) শুধুমাত্র প্রতিরোধমূলক প্রভাব সৃষ্টি করতে পারে। সে কারণে ডোপামিনকে শুধুমাত্র উত্তেজক বা প্রতিরোধক হরমোন হিসেবে বর্ণনা করা ভুল হবে। ডোপামিন রিসেপ্টরগুলি মস্তিষ্কের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে আছে, তবে মস্তিষ্কের স্ট্রায়াটাম (striatum) অঞ্চলে অবস্থিত ডোপামিন রিসেপ্টরের উপস্থিতি দেহের মোটর মুভমেন্ট (motor movement)কে নিয়ন্ত্রণ করে। ডোপামিনের ঘাটতিতে মোটর মুভমেন্ট বা দেহের পেশি নিয়ন্ত্রণ চরমভাবে ব্যাহত হয়।
উপসংহৃতি
স্নায়ুবিজ্ঞান হলো বৈদ্যুতিক (মস্তিষ্কের তরঙ্গ), স্থাপত্য (মস্তিষ্কের কাঠামো) এবং রাসায়নিক (নিউরোকেমিক্যাল) উপাদানগুলির একটি ত্রয়ী, যা মনের অবস্থা তৈরি করতে সমন্বিতভাবে কাজ করে। এই নিবন্ধে শুধু রাসায়নিক উপাদানগুলির উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করা হয়েছে। সহস্রাব্দ ধরে বিকশিত বিভিন্ন নিউরোকেমিক্যালের ভারসাম্য আমাদের আধুনিক জীবন দ্বারা প্রতিনিয়তই ব্যাহত হচ্ছে, যা আমাদের বিষণ্ণতা, উদ্বেগ এবং অসন্তুষ্টির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এছাড়া, সামাজিক ও পরিবেশগত কলুষ আমাদের অশান্তির অন্যতম কারণও বটে। এই স্নায়বিক ভারসাম্যহীনতাকে সহজ করার লক্ষ্যে ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলো ওষুধও বানিয়ে চলেছে। অথচ, আমরা সহজ জীবনযাত্রার ও আচরণের মাধ্যমে আমাদের মস্তিষ্কের রসায়নকে উন্নত করতে পারি, আমরা আরও ভাল বোধ করতে পারি। যে-কোনো সৃজনশীল কাজে দিনের কিছুটা সময় হলেও আমাদের ব্যয় করা প্রয়োজন। ভবিষ্যতে ভালো কিছু হবে সর্বদা মনের মধ্যে সে আশাবাদ রাখাকে বলে ‘মিনিংফুল অপটিমিজম’। নতুন কিছু করুন। নতুন কিছু করা, নতুন কিছু শেখার মধ্য দিয়ে মস্তিষ্ককে আরও সক্রিয় করে তোলা যায়। যে কাজ করে আপনি বেশি আনন্দিত হন, সেটাই বেশি করে প্র্যাকটিস করুন। ব্যায়াম, যোগাভ্যাস, মেডিটেশন, এসব কিছুই মনকে প্রফুল্ল রাখে। আপনার প্রিয় বন্ধু বা মানুষটির সঙ্গে এক কাপ কফি বা চা পান করুন, প্রিয় মানুষটির সঙ্গে সময় কাটান, মনের কথা বলে মনকে হালকা করুন ও দুজনে মিলে প্রচুর হাসুন। জীবনকে উপভোগ করতে ও সুখী হতে বেশি উপাদানের প্রয়োজন হয় না।
অনেক নতুন তথ্য জানলাম। খুব ভালো লেগেছে।