নতুন স্বাভাবিক সময়ে ব্লেন্ডেড লার্নিং: শিখন রবে সচল
- প্রকাশ: ১০:৪৫:৫০ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২২
- / ১০৮৭ বার পড়া হয়েছে
বর্তমানে শিখন শেখানোর পদ্ধতিতে ব্যাপক পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। আমাদের প্রচলিত ধারণার বাইরেও এমনভাবে এখন শিক্ষক শিক্ষার্থীকে তাদের ভূমিকায় পরিবর্তন হতে হচ্ছে যা আগে কখনো কল্পনাও করা হয়নি। ২০১৭ সালে সারা বিশ্বে যেখানে মাত্র ৬৬ মিলিয়ন শিক্ষার্থী দূর শিখনে অন্তর্ভুক্ত ছিল, কোভিড-১৯ পরবর্তিতে তা এখন 8০০ মিলিয়নে গৌঁছেছে।
খুব স্বাভাবিকভাবে বলা যায় দূর শিখন হলো প্রতিষ্ঠানের বাইরে দূর হতে স্ব উদ্যোগে বিভিন্ন উকরণ ব্যবহার করে শিক্ষার্থীর শিখন অর্জন। দূর শিখন বিভিন্ন পদ্ধতিতে সম্ভব, যেমন— মডিউল ভিত্তিক শিখন, ই-লার্নিং, ব্লেন্ডেড লার্নিং, অনলাইন লার্নিং ইত্যাদি। এক্ষেত্রে শিক্ষার্থীরা ক্লাসরুমের বাহিরে বাড়িতে বা যে-কোনো স্থান হতে শিখন গ্রহণ করে থাকে। এজন্য শিক্ষার্থীকে নির্দিষ্ট কোনো স্থানে গিয়ে শিখনে অংশগ্রহণ করতে হয় না। অনেক দুর শিখন শিক্ষার্থীর ইচ্ছে অনুযায়ী সময় ব্যাপ্তি নিয়ে শিখন অর্জন করে থাকে আবার অনেক সময় নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই শিখন সম্পন্ন করতে হয়। আবার দুর শিখনে খরচও অনেক কম। আমাদের দেশে অনেক আগে থেকেই উন্মুক্ত বিশবিদ্যালয়ের মাধ্যমে দূর শিখনে অনেক বিষয়ে ডিগ্রি নেয়ার ব্যবস্থা আছে। এক্ষেত্রে প্রযুক্তি ব্যবহার ছাড়াই মডিউলভিত্তিক বইয়ের মাধ্যমে শিখন অর্জন করে নির্দিষ্ট সময়ে অ্যাসাইনমেন্ট ও সামনাসামনি পরীক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থীকে মূল্যায়ন করে ডিগ্রি প্রদান করা হয়। দূর শিখনে বই বা মডিউল ছাড়াও রেডিয়ো, টেলিভিশন, মোবাইল, ইন্টারনেট ইত্যাদি মাধ্যম ব্যবহার করেও শিক্ষা অর্জন করা যায়। তবে করোনাকালে দূর শিখনে ইন্টারনেট একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হলেও টেলিভিশনেও শিক্ষক কর্তৃক পাঠ উপস্থাপন প্রচার করা করা হয়েছে।
ইদানিং শুধু একটি উপায়ে শিখন শেখানো কার্যকর নয়। সরাসরি মুখোমুখি ও দূর শিখন উভয় উপায়েই শিখন শেখানো চলছে। এই উপায়ই হলো ব্লেন্ডেড বা মিশ্র শিখন। ব্লেডেড লার্নিং-এর মাধ্যম হিসেবে প্রযুক্তির ব্যবিহার অপরিহার্য। এক্ষেত্রে ই-লার্নিং ও মুখোমুখি শিক্ষার সমন্বয়ই হলো ব্লেডেড লার্নিং।
ব্লেন্ডেড লার্নিং-এ প্রস্ততি
‘ব্লেন্ডেড লার্নিং’ মডেলের কিছু গুরুত্বপূর্ণ অংশ রয়েছে। শিক্ষক প্রচলিত ক্লাসের মতোই এখানে ক্লাস নেবেন, ইনস্ট্রাকশন দেবেন। একে বলা হচ্ছে ‘ফেইস টু ফেইস’ ড্রাইভার। তবে গতানুগতিক লেখাপড়ার সাথে এর পার্থক্য হচ্ছে— ক্লাস শুরু হবার আগেই শিক্ষক লেসন প্ল্যান, উপকরণ সামগ্রী, অনলাইন রেফারেন্স, প্রয়োজনীয় সফটওয়্যার, অডিয়ো ও ভিডিয়ো ফাইল ইত্যাদি প্রস্তুত করে রাখবেন। অর্থাৎ, ক্লাস নেওয়ার জন্য যত ধরণের ভার্চুয়াল সহায়তা নেওয়া যায় শিক্ষককে তার সব কিছুই জানতে হয়।
ব্লেন্ডেড লার্নিং মডেল
ব্লেন্ডেড লার্নিং অলসভাবে বসে বসে ক্লাস করার কোনো সুযোগ নেই। ক্লাসে প্রত্যেকের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে, ঘুরে ঘুরে সবাইকে প্রশ্ন করতে হয়, বলা হয় বিভিন্ন স্টেশন ঘুরে লেসন প্র্যাকটিস করতে হয়। প্রয়োজনে বিভিন্ন ওয়েব টুল ব্যবহার করে শিক্ষার্থীদের সক্রিয় করতে হবে৷ এখন তো অনলাইনেও দলীয় কাজ (Group Work) দেওয়া যায়।
একবিংশ শতকের শিক্ষার্থীদের প্রযুক্তি ও ভার্চুয়াল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহারে পারদর্শী হতে হবে। তাই অনলাইন কোর্স কমপ্লিট করাতেও দৃষ্টি দিতে হবে। তবে তা একজন শিক্ষকের নিয়ন্ত্রণে থাকবে।
মোট কথা হচ্ছে যে, যে যেভাবে শিখতে চাইছে, পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে চাইছে, অ্যাসাইনমেন্ট করতে চাইছে— সব কিছুরই সুযোগ থাকবে এখানে।
ব্লেন্ডেড লার্নিং-এ প্রথমেই কোনো একটা প্ল্যাটফর্ম বাছাই করতে হবে। অনেক মুক্ত প্ল্যাটফর্ম রয়েছে (যেমন— মাইক্রোসফট টিম, গুগল মিট ইত্যাদি) যেগুলো ব্যবহার করে শিখন শেখানোর সব কাজই করা যায়। ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে শিক্ষকের সাথে শিক্ষার্থীর যোগাযোগ থাকতে হবে। শিক্ষক চাইলে ক্লাসের আগে বিভিন্ন ধরনের সহায়ক উপকরণ শিক্ষার্থীদের শেয়ার করতে পারেন, পরবর্তীতে ক্লাসে তা নিয়ে আলোচনা করলে শিখন দীর্ঘস্থায়ী হবে— এই অনলাইন প্ল্যাটফর্মকে বলা হয় ফ্লেক্স।
ব্লেন্ডেড লার্নিং বা মিশ্র শিখন-এর সুবিধা
এখনকার সময়ে দূর শিখনের একটা জনপ্রিয় পদ্ধতি হলো মিশ্র শিখন বা ব্লেন্ডেড লার্নিং। আগেত আলোচনা থেকে বুঝতে পারা যায় যে, মিশ্র শিখনের (ব্লেন্ডেড লার্নিং) নানা রকম সুবিধার কারণে সময়ের সাথে সাথে এখন তা অত্যন্ত জনপ্রিয়।
শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের ব্লেন্ডেড লার্নিং-এ অংশগ্রহণ করতে প্রযুক্তির ব্যবহার করতে বিধায় তাদের এ বিষয়ে যথেষ্ট পারদর্শিতা অর্জন করতে হয়। বিভিন্ন ওয়েব টুলের (Web tools) সমন্বয়ে একটি বিষয়কে উপস্থাপন করতে হয়, বাড়ির কাজ বা অ্যাসাইনমেন্ট দেওয়া হয়, মূল্যায়ন করতে হয়। ফলে শিক্ষক ও শিক্ষার্থী উভয়েরই একবিংশ শতকের দক্ষতা অর্জন হয়।
ব্লেন্ডেড লার্নিং-এ প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষার্থী উভয়ের ব্যয় সংকোচন করে। আনুষঙ্গিক অনেক ব্যয় কমে যাচ্ছে। ইউটিলিটি, যাতায়াত বা বেতনাদির খরচ কমার সাথে সাথে সময়ের খরচও অনেক কম হয়। যে-কোনো স্থান হতে ক্লাসে অংশগ্রহণ করা যায়। অনেকক্ষেত্রে সময়ের বাধ্যবাধকতাও থাকে না। অনেক ব্লেন্ডেড লার্নিং-এ শিক্ষার্থী নিজস্ব সময় মতো ক্লাসে অংশগ্রহণ করে থাকে। এই পদ্ধতিকে বলা হয় ‘সেলফ পেসড’ (Self paced) লার্নিং।
অনলাইনভিত্তিক ব্লেন্ডেড লার্নিং-এ শিক্ষার্থীদের জন্য আনন্দদায়কও বটে। কেননা ডিজিটাল মাধ্যমে অডিয়ো, ভিডিয়ো বা প্রেজেন্টেশন শিক্ষার্থীদের জন্য খুবই আকর্ষণীয়। এখননকার শিক্ষার্থীরা এসবে বেশি অভ্যস্ত। এমনকি পরীক্ষাভীতিও এক্ষেত্রে কাজ করে না। অনলাইনে কাহুট (Kahoot!)-এর মতো প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে খেলার মাধ্যমেই শিক্ষার্থীর শিখনের গঠনমূলক মূল্যায়ন করা যায়।
ব্লেন্ডেড লার্নিং-এর জন্য যেহেতু অনেক মুক্ত প্ল্যাটফর্ম রয়েছে, তাই শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের জন্য সহজেই ক্লাসে অংশগ্রহণ, পরীক্ষা নেওয়া, অ্যাসাইনমেন্ট, দেওয়া, উপকরণ বিতরণ বা ফলাফল/গ্রেড প্রদান করা যাচ্ছে। এমন কি কমেন্ট ও ফিডব্যাকের মাধ্যমে উভমুখী যোগাযোগও সম্ভব হচ্ছে।
ব্লেন্ডেড লার্নিং-এর কিছু অসুবিধা
- ব্লেন্ডেড লার্নিং যেহেতু পুরোপুরি অনলাইন ভিত্তিক, তাই যেখানে ইন্টারনেট অপ্রতুল বা খরচ বেশি সেখানে এটি সফল ভাবে কাজ করে না। প্রত্যেকের জন্য ডিভাইসও প্রয়োজন হয়, যা অনেক ক্ষেত্রেই জোগাড় করা সম্ভব হয় না।
- শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার করা জানতে হবে। এ বিষয়টি এখনও আমাদের দেশে গড়ে উঠেনি। কারো যদি টেকনোলজিকে চ্যালেঞ্জ মনে হয়, তা লেখাপড়ার পুরো প্রক্রিয়াটাই ভেস্তে যাবে।
- যেহেতু এই পদ্ধতিতে অনেক রিসোর্স জোগাড় করতে হয়, তাই টিচারদের কাজ অনেক বেড়ে যাবে। তাই কম বেতনে কোনো টিচারই এই মেথড অনুসরণ করতে চাইবেন না।
- অনেক বেশি কন্টেন্ট ও এডুকেশনাল জন্য স্টুডেন্টের উপরও মানসিক চাপ বেড়ে যাবে। বেশি সময় ধরে ডিভাইস ব্যবহারের ঝুঁকি তো রয়েছেই।
ব্রেন্ডেড শিখনের ধরন: সিনক্রোনাস ও এসিনক্রোনাস
সরাসরি শ্রেণিকক্ষে বা অনলাইন শিক্ষায় লাইভ ভিডিও স্ট্রিমিং, ভিডিয়ো কনফারেন্সিং বা রেকর্ডেড ক্লাসের মাধ্যমে শিখন শেখানো চলমান। যখন সরাসরি শ্রেণিকক্ষে, লাইভ ভিডিয়ো স্ট্রিমিং, সরাসরি ভিডিয়ো কল বা কনফারেন্সিং হয় শিক্ষক শিক্ষার্থী ভিন্ন অবস্থানে থাকলেও একই সময়ে যোগাযোগ সম্পন্ন করতে পারছে, আবার যখন রেকর্ডেড ক্লাস চলে তখন যোগাযোগটা অনেকটা একমুখী হয়। এই দুটি পদ্ধতির প্রথমটি হলো সিনক্রোনাস (Synchronous) আর দ্বিতীয়টি এসিনক্রোনাস (Asynchronous) শিখন।
অনলাইন লার্নিং সিনক্রোনাস হয় যা রিয়েলটাইমে ঘটে, আর এসিনক্রোনাস লার্নিং রিয়েলটাইম ইন্টারঅ্যাকশন ছাড়াই অনলাইন চ্যানেলের মাধ্যমে ঘটে। ব্লেন্ডেড লার্নিং ডিজাইনে সিনক্রোনাস ও এসিনক্রোনাস শিখন পদ্ধতির মিশ্রণ থাকতে পারে।
সিনক্রোনাস শিখন পরিবেশটা কিছুটা পদ্ধতিগত। শিক্ষক বিভিন্ন মাধ্যম বা টুল ব্যবহার করে শিক্ষার্থীকে সক্রিয় রাখেন এবং একই সময়ে শিক্ষার্থীর কাছ থেকে ফিডব্যাক প্রত্যাশা করেন। এক্ষেত্রে শিক্ষার্থীর উপস্থিতি বাধ্যতামূলক। একই সময়ে শিক্ষক হয়তো শিক্ষার্থীর শিখন যাচাইও করতে পারেন। প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা আলোচনায় অংশগ্রহণ করে। অর্থাৎ একই সময়ে একই প্লাটফর্মে শিক্ষক শিক্ষার্থী উপস্থিত থাকে। সিনক্রোনাস অনলাইন লার্নিং পদ্ধতিগুলির মধ্যে রয়েছে ভিডিও কনফারেন্সিং, টেলিকনফারেন্সিং, লাইভ চ্যাট এবং লাইভ স্ট্রিমিং।
সিনক্রোনাস শিখনে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মাঝে যোগাযোগ নিবিড় হয়। শিক্ষার্থীরা তাৎক্ষণিক ফিডব্যাক পায়। দলগত কাজ বা অন্যান্য উপায়ে শিক্ষার্থীরা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করতে পারে। সামাজিক মাধ্যম বা শিখন প্রাটফর্ম ব্যবহার করে শিক্ষক সহায়তা দিতে পারেন। কোন শিক্ষার্থীর প্রয়োজনে সরাসরি শিক্ষকের সাথে যোগাযোগ করতে পারে। সিনক্রোনাস শিখনে অংশগ্রহণের আগে ও পরে শিক্ষার্থী এসিনক্রোনাস শিখনে অংশ নিতে পারে। অর্থাৎ সরাসরি অংশগ্রহণের আগে শিক্ষার্থী নিজের সময় ও সুবিধা মতো শিখন উপকরণ দেখে নিয়ে সিনক্রোনাস শিখনে অংশ নিতে পারে।
এসিনক্রোনাস শিখন শিক্ষার্থীর স্বাধীন অংশগ্রহণে হয়ে থাকে। শিক্ষার্থী তার নিজের সুবিধামত সময়, স্থান ও পছন্দের বিষয়ে অধ্যয়নের সুযোগ পায়। এসিনক্রোনাস শিখন পদ্ধতিগুলির মধ্যে রয়েছে স্ব-নির্দেশিত পাঠ বা মডিউল, স্ট্রিমিং ভিডিয়ো সামগ্রী, ভার্চুয়াল লাইব্রেরি, বক্তৃতা নোট পোস্ট করা এবং আলোচনা বোর্ড বা সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটটফর্মের মাধ্যমে শিখন।
এসিনক্রোনাস শিখনে শিক্ষার্থীর পর্যাপ্ত সময় থাকায় পাঠ উপকরণ ব্যবহার করে নোট নিতে পারে। সময় নিয়ে বার বার একই ভিডিও বা অডিও ব্যবহার করে পাঠকে আয়ত্ব করার সুযোগ পায়। একটি পাঠের উপর একাধিক উপকরণ ব্যবহার করতে পারে। অনলাইন আলোচনায় অংশগ্রহণ করতে পারে। কোনো বিষয়ে বেশি বেশি অনুশীলনের চেষ্টা করতে পারে। এসিনক্রোনাস শিখন পদ্ধতি নমনীয় বিধায়
শিক্ষার্থীরা নিজস্ব গতিতে (self-pace) কোর্স বা বিষয় আয়ত্ব করতে পারে। বর্তমান সময়ে শিক্ষার্থীদের নিকট এসিনক্রনাস পদ্ধতির শিখন অনেক জনপ্রিয়।