০৭:২১ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
                       

বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনতম নিদর্শন চর্যাপদ প্রসঙ্গে

মাসুদা আক্তার
  • প্রকাশ: ১১:১৪:১২ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ৪ নভেম্বর ২০২২
  • / ২০৯১ বার পড়া হয়েছে

চর্যাপদের অনুলিপি


Google News
বিশ্লেষণ-এর সর্বশেষ নিবন্ধ পড়তে গুগল নিউজে যোগ দিন

বিশেষ শর্তসাপেক্ষে এবং স্বল্পমূল্যে এই ওয়েবসাইটটি সামাজিক কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ কিংবা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের নিকট বিক্রি করা হবে।

বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস বহু প্রাচীন। সেই আদি থেকে বর্তমান পর্যন্ত বিবিধ সাহিত্য রূপ সৃষ্টি হয়েছে বাংলায়। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসকালকে মূলত তিন ভাগে ভাগ করা হয়—

  • প্রাচীন যুগ (ড. মুহম্মদ শহিদুল্লাহর মতে আনুমানিক ৬৫০-১২০০ খ্রিস্টাব্দ এবং ড. সুনীতি কুমার চট্টপাধ্যায়সহ অন্যদের মতে ৯৫০-১২০০ খ্রিস্টাব্দ)
  • মধ্যযুগ (১২০১-১৮০০ খ্রিস্টাব্দ ) এবং 
  • আধুনিক যুগ (১৮০১ থেকে বর্তমান)।

এই যুগ বিভাগগুলো করা হয়েছে কিছু সাহিত্যিক নিদর্শনের মাধ্যমে। আজ বাংলা সাহিত্যের একমাত্র প্রাচীন নিদর্শন চর্যাপদের  বিষয়ে আলোকপাত করব।

বাংলা সাহিত্যের অমূল্য, ঐতিহাসিক প্রাচীনতম নিদর্শন হলো চর্যাপদ। এর পূর্বের আর কোনো সাহিত্যিক নিদর্শন আজ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।

মাৎসান্যায় পরবর্তীতে বাংলায় প্রায় চারশত বছর ধরে পাল বংশ সাম্রাজ্য শাসন করেছে। এই সাম্রাজ্যের সময়ই বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যরা চর্যাপদ রচনা শুরু করেন বলে মনে করা হয়। এ অঞ্চলে মুসলিম শাসন শুরু হওয়ার পূর্বেই ব্রাহ্মণ্যবাদী সেন শাসনের অত্যাচারের অতিষ্ঠ এসব বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যরা তাঁদের পুঁথি-পত্র নিয়ে পার্শ্ববর্তী দেশ নেপাল, ভুটান, তিব্বতে চলে গিয়েছিলেন। এসব দেশে থাকা পুঁথির দিকে সর্বপ্রথম নজর পড়ে বিদেশিদের। Brian Hodgson নামক জনৈক ইংরেজ নেপাল থেকে তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্মের অনেকগুলো পুঁথি আবিষ্কার করেন। এরপর থেকে তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্মের ইতিহাস রচনা ও শাস্ত্রগগ্রন্থ সম্পাদনায় গবেষকরা সচেতন হওয়া শুরু করেন। 

বাঙালি গবেষকদের মধ্যে রাজেন্দ্রলাল মিত্র ১৮৮২ সালে “Sanskrit Buddhist Literature in Nepal” নামে একটি পুঁথির তালিকা প্রকাশ করেছিলেন। রাজেন্দ্রলালের মৃত্যুর পর সরকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (তখনও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়নি) বাংলা বিভাগের প্রয়াত শিক্ষক মহামহোপাধ্যায় হরপপ্রসাদ শাস্ত্রীর উপর বাংলা-বিহার -আসাম-উড়িষ্যার পুঁথি সন্ধান ও সংগ্রহের দায়িত্ব অর্পণ করে। রাজেন্দ্রলাল মিত্রের তালিকা এবং আরো আবিষ্কৃত বিভিন্ন পুঁথির ভিত্তিতে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী অনুমান করেন নেপালের নানা জায়গায় হয়তো আরো পুঁথি রয়েছে। এই ধারণার বশবর্তী হয়ে তিনি মোট চারবার নেপাল গিয়েছিলেন। তৃতীয়বার ১৯০৭ সালে “চর্যাশ্চর্যবিনিশ্চয়” নামক একটি পুঁথি নেপাল রাজদরবারের অভিলিপিশালা থেকে আবিষ্কার করেন। এটি সহ আরো কিছু পুঁথি ১৯১৬ সালে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ থেকে “হাজার বছরের পুরাণ বাঙ্গালা ভাষার বৌদ্ধ গান ও দোহা” নামে ভূমিকাসহ গ্রন্থাকারে প্রকাশ করেন হরপ্রসাদ শাস্ত্রী। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী চর্যাপদের ৪৬ টি পূর্ণ এবং একটি খন্ড পদ পেয়েছিলেন। পুঁথিটির কিছু পাতা ছেঁড়া থাকায় বাকি পদগুলো পাননি। চর্যাপদের যে তিব্বতি অনুবাদ রয়েছে তাতে আরো চারটি পদসহ ওই খন্ড পদের অনুবাদও পাওয়া গেছে। তাই মনে করা হয় চর্যার পদসংখ্যা মোট ৫১টি।

চর্যাপদ আবিষ্কৃত হওয়ার পর এর রচনাকাল, ভাষা, পদকর্তা প্রভৃতি বিভিন্ন বিষয় নিয়ে গবেষকদের মধ্যে মতবিরোধ শুরু হয়। ভাষা নিয়ে গবেষকগণ একেকজন একেক মতবাদ দিয়েছেন, অনেকে আবার সেটা মেনেও নিয়েছেন। চর্যাপদের আবিষ্কর্তা মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর মতে, চর্যাপদের রচনা ১০ম শতাব্দীর আগে হতে পারে না। এর কারণস্বরূপ তিনি বলেছেন ১০৩০ খ্রিস্টাব্দে অতীস দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান তীব্বত যাওয়ার পূর্বে চর্যার আদি কবি লুইপা’কে “অভিসমবিহঙ্গ” গ্রন্থটি রচনায় সাহায্য করেছিলেন। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লহ্, রাহুল সাংকৃত্যায়নের মতে চর্যাপদের রচনাকাল ৮ম থেকে ১২শ শতাব্দী। 

তবে ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, ড.সুকুমার সেন, অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, ক্ষেত্রগুপ্ত, প্রবোধচন্দ্র বাগচী, হুমায়ূন আজাদের মতে, চর্যার রচনাকাল ১০ম থেকে ১২শ শতাব্দী।

চর্যাপদ যে বাংলা সাহিত্যের সম্পদ এর প্রমাণ দেয় ভাষাতাত্ত্বিক বিচারে এর ভাষা বাঙলা। হুমায়ুন আজাদের মতে, ভাষার জন্য চর্যাপদ মাণিক্যের চেয়েও মূল্যবান। চর্যাপদের আবিষ্কার এটি নিয়ে বিবিধ গবেষণার দ্বার উন্মোচন করে। চর্যার ভাষা নিয়ে গবেষক মহলে বিভিন্ন আলোচনা সমালোচনার সৃষ্ট হয়। ড.সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় তাঁর ODBL(Origin and Development of Bengali Language) গ্রন্থে বলেছেন, “The language of the carcyas is the genuine vernacular of Bengal at its basis.” সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় ভাষাতাত্ত্বিক গবেষণার মাধ্যমে তার মতকে জোরালোভাবে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ চর্যাপদের ভাষা নিয়ে আলোচনা করে অবশেষে এই সিদ্ধােেন্ত উপনিত হন যে চর্যার ভাষাকে প্রাচীন বঙ্গ-কামরূপি বলাই সঙ্গত। চর্যাপদের শব্দরাশির অনেক শব্দই বর্তমানে ব্যবহার হয় না। প্রায় সকল শব্দের রূপই ক্রমশ বদলেছে এতোদিনে। তবুও প্রাচীন বাংলা ভাষা এবং বর্তমান বাংলা ভাষার রক্তের সম্পর্ক নষ্ট হয়নি। চর্যাপদের ব্যাকরণ আলোচনা করলেই এদের মধ্যকার সম্পর্কটা স্পষ্ট ধরা পড়ে।

চর্যারপদের কবিদের পদকর্তা বলা হয়। চর্যাপদের কবিরা সিদ্ধাচার্য নামে পরিচিত। তিব্বতি ঐতিহ্য অনুসারে ৮৪ জন সিদ্ধাচার্যের নাম পাওয়া যায়। চর্যা শব্দের অর্থ আচরণ; বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যরা চর্যাপদে নির্দেশ করেছেন সাধনার বিভিন্ন গৃহীত আচরণ ও পরিহৃত আচরণ। প্রত্যেক চর্যার শেষ শ্লোকে ভণিতায় পদকর্তাদের নাম পাওয়া যায়। চর্যায় মোট ২৩ জন মতান্তরে ২৪ জন পদকর্তার পরিচয় পাওয়া যায়। এই ২৪ জন হলেন— লুইপা (চর্যার আদি কবি। প্রথম পদটি তাঁর রচনা। ১ ও ২৯ নং পদ তাঁর রচিত), কাহ্নপা (চর্যার সর্বোচ্চ ১৩টি পদের রচয়িতা তিনি) শবরপা (পেশায় শিকারী ও বাঙালি ছিলো), সরহপা, ভুসুকু পা (তাঁকে বাঙালি মনে করা হয়), বিরুআ পা , কুক্কুরী পা, ঢেন্ঢন পা, শান্তি পা, ভদ্র পা, তাড়ক পা, দাড়িক পা, বজ্র পা, গুন্ডুরী পা, বীণাপা, ডোম্বী পা, জয়নন্দী পা, মহীধর পা, আর্যদেব পা, তন্ত্রী পা, ধাম পা, চাটীল পা, কঙ্কণ পা, কম্বলাম্বর পা।

চর্যাপদের অনুলিপি
চর্যাপদের অনুলিপি

লুইপা চর্যাপদের আদি কবি। ১ ও ২৯ নং পদ তাঁর রচিত।

কালে কালে বিবিধ জিজ্ঞাসার সৃষ্টি হয় সাহিত্যের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসও কালান্তরে সম্মুখীন হয়েছে বিভিন্ন প্রশ্নের। চর্যাপদও বাংলা সাহিত্েেযর প্রাচীন নিদর্শন হিসেবে সম্মুখীন হয়েছে নানা প্রশ্নের। অবশেষে সাহিত্যিকরা ভাষাতাত্ত্বিক গবেষণার মাধ্যমে প্রমাণ করেছেন এটি বাংলা সাহিত্যেরই নিজস্ব সম্পদ। 

অন্য ভাষার গবেষকরা যদিও নিজেদের বলে দাবি করেছেন চর্যাকে। কিন্তু ব্যাকরণগত বৈশিষ্ট্য এবং অন্যান্য সকল দিক দিয়েই এটি আমাদের সাহিত্যের নিজস্ব সম্পদ। পরবর্তীতে গবেষকরা এর রচনাকাল, পদকর্তা প্রভৃতি বিষয় নিয়েও গবেষণা করেছেন। এই গবেষণার রূপ সময়ে সময়ে পরিবর্তিত হচ্ছে আর উদ্ভব হচ্ছে নতুন নতুন তথ্যের।

চর্যাপদ থেকে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন ও তার উত্তর

  • চর্যাপদের তিব্বতীয় নাম কী? — তানজুর
  • চর্যাপদের তিব্বতীয় অনুবাদক ও ব্যাখ্যাকারক কে? — কীর্তিচন্দ্র
  • চর্যাপদের তিব্বতীয় আবিস্কারক কে? — ড. প্রবোধচন্দ্র
    • চর্যাপদের আদি কবি কে? — লুইপা
      • চর্যাপদের কবিরা কী নামে পরিচিত? — চর্যাপদের কবিরা সিদ্ধাচার্য নামে পরিচিত
      • চর্যাপদ রচিত হয় কোন শাসনামলে? — পাল

শেয়ার করুন

মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার তথ্য সংরক্ষিত রাখুন

বিশেষ শর্তসাপেক্ষে এই ওয়েবসাইটটি সামাজিক কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ কিংবা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের নিকট বিক্রি করা হবে।

বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনতম নিদর্শন চর্যাপদ প্রসঙ্গে

প্রকাশ: ১১:১৪:১২ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ৪ নভেম্বর ২০২২

বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস বহু প্রাচীন। সেই আদি থেকে বর্তমান পর্যন্ত বিবিধ সাহিত্য রূপ সৃষ্টি হয়েছে বাংলায়। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসকালকে মূলত তিন ভাগে ভাগ করা হয়—

  • প্রাচীন যুগ (ড. মুহম্মদ শহিদুল্লাহর মতে আনুমানিক ৬৫০-১২০০ খ্রিস্টাব্দ এবং ড. সুনীতি কুমার চট্টপাধ্যায়সহ অন্যদের মতে ৯৫০-১২০০ খ্রিস্টাব্দ)
  • মধ্যযুগ (১২০১-১৮০০ খ্রিস্টাব্দ ) এবং 
  • আধুনিক যুগ (১৮০১ থেকে বর্তমান)।

এই যুগ বিভাগগুলো করা হয়েছে কিছু সাহিত্যিক নিদর্শনের মাধ্যমে। আজ বাংলা সাহিত্যের একমাত্র প্রাচীন নিদর্শন চর্যাপদের  বিষয়ে আলোকপাত করব।

বাংলা সাহিত্যের অমূল্য, ঐতিহাসিক প্রাচীনতম নিদর্শন হলো চর্যাপদ। এর পূর্বের আর কোনো সাহিত্যিক নিদর্শন আজ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।

মাৎসান্যায় পরবর্তীতে বাংলায় প্রায় চারশত বছর ধরে পাল বংশ সাম্রাজ্য শাসন করেছে। এই সাম্রাজ্যের সময়ই বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যরা চর্যাপদ রচনা শুরু করেন বলে মনে করা হয়। এ অঞ্চলে মুসলিম শাসন শুরু হওয়ার পূর্বেই ব্রাহ্মণ্যবাদী সেন শাসনের অত্যাচারের অতিষ্ঠ এসব বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যরা তাঁদের পুঁথি-পত্র নিয়ে পার্শ্ববর্তী দেশ নেপাল, ভুটান, তিব্বতে চলে গিয়েছিলেন। এসব দেশে থাকা পুঁথির দিকে সর্বপ্রথম নজর পড়ে বিদেশিদের। Brian Hodgson নামক জনৈক ইংরেজ নেপাল থেকে তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্মের অনেকগুলো পুঁথি আবিষ্কার করেন। এরপর থেকে তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্মের ইতিহাস রচনা ও শাস্ত্রগগ্রন্থ সম্পাদনায় গবেষকরা সচেতন হওয়া শুরু করেন। 

বাঙালি গবেষকদের মধ্যে রাজেন্দ্রলাল মিত্র ১৮৮২ সালে “Sanskrit Buddhist Literature in Nepal” নামে একটি পুঁথির তালিকা প্রকাশ করেছিলেন। রাজেন্দ্রলালের মৃত্যুর পর সরকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (তখনও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়নি) বাংলা বিভাগের প্রয়াত শিক্ষক মহামহোপাধ্যায় হরপপ্রসাদ শাস্ত্রীর উপর বাংলা-বিহার -আসাম-উড়িষ্যার পুঁথি সন্ধান ও সংগ্রহের দায়িত্ব অর্পণ করে। রাজেন্দ্রলাল মিত্রের তালিকা এবং আরো আবিষ্কৃত বিভিন্ন পুঁথির ভিত্তিতে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী অনুমান করেন নেপালের নানা জায়গায় হয়তো আরো পুঁথি রয়েছে। এই ধারণার বশবর্তী হয়ে তিনি মোট চারবার নেপাল গিয়েছিলেন। তৃতীয়বার ১৯০৭ সালে “চর্যাশ্চর্যবিনিশ্চয়” নামক একটি পুঁথি নেপাল রাজদরবারের অভিলিপিশালা থেকে আবিষ্কার করেন। এটি সহ আরো কিছু পুঁথি ১৯১৬ সালে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ থেকে “হাজার বছরের পুরাণ বাঙ্গালা ভাষার বৌদ্ধ গান ও দোহা” নামে ভূমিকাসহ গ্রন্থাকারে প্রকাশ করেন হরপ্রসাদ শাস্ত্রী। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী চর্যাপদের ৪৬ টি পূর্ণ এবং একটি খন্ড পদ পেয়েছিলেন। পুঁথিটির কিছু পাতা ছেঁড়া থাকায় বাকি পদগুলো পাননি। চর্যাপদের যে তিব্বতি অনুবাদ রয়েছে তাতে আরো চারটি পদসহ ওই খন্ড পদের অনুবাদও পাওয়া গেছে। তাই মনে করা হয় চর্যার পদসংখ্যা মোট ৫১টি।

চর্যাপদ আবিষ্কৃত হওয়ার পর এর রচনাকাল, ভাষা, পদকর্তা প্রভৃতি বিভিন্ন বিষয় নিয়ে গবেষকদের মধ্যে মতবিরোধ শুরু হয়। ভাষা নিয়ে গবেষকগণ একেকজন একেক মতবাদ দিয়েছেন, অনেকে আবার সেটা মেনেও নিয়েছেন। চর্যাপদের আবিষ্কর্তা মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর মতে, চর্যাপদের রচনা ১০ম শতাব্দীর আগে হতে পারে না। এর কারণস্বরূপ তিনি বলেছেন ১০৩০ খ্রিস্টাব্দে অতীস দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান তীব্বত যাওয়ার পূর্বে চর্যার আদি কবি লুইপা’কে “অভিসমবিহঙ্গ” গ্রন্থটি রচনায় সাহায্য করেছিলেন। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লহ্, রাহুল সাংকৃত্যায়নের মতে চর্যাপদের রচনাকাল ৮ম থেকে ১২শ শতাব্দী। 

তবে ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, ড.সুকুমার সেন, অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, ক্ষেত্রগুপ্ত, প্রবোধচন্দ্র বাগচী, হুমায়ূন আজাদের মতে, চর্যার রচনাকাল ১০ম থেকে ১২শ শতাব্দী।

চর্যাপদ যে বাংলা সাহিত্যের সম্পদ এর প্রমাণ দেয় ভাষাতাত্ত্বিক বিচারে এর ভাষা বাঙলা। হুমায়ুন আজাদের মতে, ভাষার জন্য চর্যাপদ মাণিক্যের চেয়েও মূল্যবান। চর্যাপদের আবিষ্কার এটি নিয়ে বিবিধ গবেষণার দ্বার উন্মোচন করে। চর্যার ভাষা নিয়ে গবেষক মহলে বিভিন্ন আলোচনা সমালোচনার সৃষ্ট হয়। ড.সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় তাঁর ODBL(Origin and Development of Bengali Language) গ্রন্থে বলেছেন, “The language of the carcyas is the genuine vernacular of Bengal at its basis.” সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় ভাষাতাত্ত্বিক গবেষণার মাধ্যমে তার মতকে জোরালোভাবে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ চর্যাপদের ভাষা নিয়ে আলোচনা করে অবশেষে এই সিদ্ধােেন্ত উপনিত হন যে চর্যার ভাষাকে প্রাচীন বঙ্গ-কামরূপি বলাই সঙ্গত। চর্যাপদের শব্দরাশির অনেক শব্দই বর্তমানে ব্যবহার হয় না। প্রায় সকল শব্দের রূপই ক্রমশ বদলেছে এতোদিনে। তবুও প্রাচীন বাংলা ভাষা এবং বর্তমান বাংলা ভাষার রক্তের সম্পর্ক নষ্ট হয়নি। চর্যাপদের ব্যাকরণ আলোচনা করলেই এদের মধ্যকার সম্পর্কটা স্পষ্ট ধরা পড়ে।

চর্যারপদের কবিদের পদকর্তা বলা হয়। চর্যাপদের কবিরা সিদ্ধাচার্য নামে পরিচিত। তিব্বতি ঐতিহ্য অনুসারে ৮৪ জন সিদ্ধাচার্যের নাম পাওয়া যায়। চর্যা শব্দের অর্থ আচরণ; বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যরা চর্যাপদে নির্দেশ করেছেন সাধনার বিভিন্ন গৃহীত আচরণ ও পরিহৃত আচরণ। প্রত্যেক চর্যার শেষ শ্লোকে ভণিতায় পদকর্তাদের নাম পাওয়া যায়। চর্যায় মোট ২৩ জন মতান্তরে ২৪ জন পদকর্তার পরিচয় পাওয়া যায়। এই ২৪ জন হলেন— লুইপা (চর্যার আদি কবি। প্রথম পদটি তাঁর রচনা। ১ ও ২৯ নং পদ তাঁর রচিত), কাহ্নপা (চর্যার সর্বোচ্চ ১৩টি পদের রচয়িতা তিনি) শবরপা (পেশায় শিকারী ও বাঙালি ছিলো), সরহপা, ভুসুকু পা (তাঁকে বাঙালি মনে করা হয়), বিরুআ পা , কুক্কুরী পা, ঢেন্ঢন পা, শান্তি পা, ভদ্র পা, তাড়ক পা, দাড়িক পা, বজ্র পা, গুন্ডুরী পা, বীণাপা, ডোম্বী পা, জয়নন্দী পা, মহীধর পা, আর্যদেব পা, তন্ত্রী পা, ধাম পা, চাটীল পা, কঙ্কণ পা, কম্বলাম্বর পা।

চর্যাপদের অনুলিপি
চর্যাপদের অনুলিপি

লুইপা চর্যাপদের আদি কবি। ১ ও ২৯ নং পদ তাঁর রচিত।

কালে কালে বিবিধ জিজ্ঞাসার সৃষ্টি হয় সাহিত্যের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসও কালান্তরে সম্মুখীন হয়েছে বিভিন্ন প্রশ্নের। চর্যাপদও বাংলা সাহিত্েেযর প্রাচীন নিদর্শন হিসেবে সম্মুখীন হয়েছে নানা প্রশ্নের। অবশেষে সাহিত্যিকরা ভাষাতাত্ত্বিক গবেষণার মাধ্যমে প্রমাণ করেছেন এটি বাংলা সাহিত্যেরই নিজস্ব সম্পদ। 

অন্য ভাষার গবেষকরা যদিও নিজেদের বলে দাবি করেছেন চর্যাকে। কিন্তু ব্যাকরণগত বৈশিষ্ট্য এবং অন্যান্য সকল দিক দিয়েই এটি আমাদের সাহিত্যের নিজস্ব সম্পদ। পরবর্তীতে গবেষকরা এর রচনাকাল, পদকর্তা প্রভৃতি বিষয় নিয়েও গবেষণা করেছেন। এই গবেষণার রূপ সময়ে সময়ে পরিবর্তিত হচ্ছে আর উদ্ভব হচ্ছে নতুন নতুন তথ্যের।

চর্যাপদ থেকে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন ও তার উত্তর

  • চর্যাপদের তিব্বতীয় নাম কী? — তানজুর
  • চর্যাপদের তিব্বতীয় অনুবাদক ও ব্যাখ্যাকারক কে? — কীর্তিচন্দ্র
  • চর্যাপদের তিব্বতীয় আবিস্কারক কে? — ড. প্রবোধচন্দ্র
    • চর্যাপদের আদি কবি কে? — লুইপা
      • চর্যাপদের কবিরা কী নামে পরিচিত? — চর্যাপদের কবিরা সিদ্ধাচার্য নামে পরিচিত
      • চর্যাপদ রচিত হয় কোন শাসনামলে? — পাল