বন্ধুত্ব সম্পর্কে ইসলামের নীতিমালা
- প্রকাশ: ১০:৩০:২১ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২১ নভেম্বর ২০২২
- / ১৯০০ বার পড়া হয়েছে
ইসলাম হচ্ছে একমাত্র পরিপূর্ণ জীবনবিধান। যেখানে একজন মানুষের সামগ্রিক জীবনযাপনের সবকিছুই সুস্পষ্টভাবে বিধিবদ্ধ রয়েছে। ঠিক তেমনই একটি বিষয় হলো “বন্ধু এবং বন্ধুত্ব।” মানুষের জীবনে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজনীয় এবং প্রভাবিত ব্যক্তি হলো বন্ধু। তাই একজন মুমিনকে কারো সাথে বন্ধু এবং বন্ধুত্ব করার জন্য ইসলাম কিছু নির্দেশনা দেয়। আসুন আমরা কুরআন এবং হাদিসের আলোকে ইসলামে বন্ধুত্বের নীতিমালা কী তা জানার চেষ্টা করি।
বন্ধু এবং বন্ধুত্ব কী
বন্ধু হলো এমন একটি বন্ধনের নাম, যা একাধিক মানুষের সাথে সম্পর্কিত। যে বন্ধনে স্নেহ, মায়া মমতা, মানবিকতা, সহানুভূতি, সহমর্মিতা, সততা, স্বার্থপরতা, পারস্পরিক বোঝাপড়া, সমবেদনা, একে অপরের সঙ্গ, আস্থা, নিজের যোগ্যতা, অনুভূতির প্রকাশ ইত্যাদির কমবেশি সংমিশ্রণ থাকে। সাধারণত প্রতিটি মানুষের পরিচিত চারপাশে অসংখ্য বন্ধু বিদ্যমান থাকে। যেখানে বয়সের নির্দিষ্ট কোনো সীমারেখা থাকে না। আমরা সমবয়সী সকল পরিচিতজনকেই বন্ধু বলে ডাকতে পছন্দ করি।
তবে বন্ধুত্বের সংজ্ঞা আরো গভীর। বন্ধুত্ব হলো একাধিক মানুষের গভীর সম্পর্কের নাম। যেখানে একজন মানুষ তার কাছের বন্ধুর সাথে নিজের মনের প্রকাশ্য, অপ্রকাশ্য সকল কথা অকপটে বলে আনন্দ পায়। যার সাথে ভালোমন্দ সবকিছু প্রকাশ করে। যে খুশির সংবাদে সমান খুশি হয়। একইসাথে বিপদে আপদে সর্বদা একজন সাহায্যকারী, উদ্ধারকর্তা, পরামর্শদাতা হিসাবে যে আমাদের পাশে থাকে তার সাথে সম্পর্কিত অবস্থাকেই বলা হয় বন্ধুত্ব। বন্ধু হলো সাধারণ একটি অবস্থার নাম। আর বন্ধুত্ব হলো দুজনের মধ্যে গভীর সম্পর্কের নাম। আমরা যাকে বেশি ভালোবাসি ও পছন্দ করি তার সাথেই বন্ধুত্ব করি। আর বন্ধুত্বের প্রকাশ হয় তখন, যখন একজন আরেকজনকে স্নেহ মায়া মমতা ইত্যাদি দিয়ে অনুসরণ অনুকরণ করে। একইসাথে দুজনের মধ্যে গভীর আত্মিক সম্পর্কের অপর নাম বন্ধুত্ব।
এই পৃথিবীতে আমরা সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত হই বন্ধুর দ্বারা। ভালো বন্ধুর পছন্দ-অপছন্দ তার চাল-চলন, তার সততা, মহানুভবতা, ইত্যাদি যেমন প্রভাব ফেলে। ঠিক তদ্রুপ একজন খারাপ বন্ধুর দূর্নীতি, অসততা, হিংস্রতা, অমানবিকতা ইত্যাদিও বন্ধুত্বের সম্পর্কে প্রভাব ফেলে। আর তাই প্রকৃত বন্ধু হলো সে, যে নিজে শুদ্ধ থাকে এবং অন্যকেও শুদ্ধ করে চলতে সাহায্য করে।
বন্ধুত্বে কুরআনের নির্দেশনা
ইসলামের দৃষ্টিকোণ থেকে বন্ধু এবং বন্ধুত্ব একটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আল্লাহ্ বন্ধু এবং বন্ধুত্ব করা সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে অসংখ্য আয়াত নাযিল করেছেন। একজন ইমানদারের প্রকৃত বন্ধু কে তা সূরা আল মায়িদাহর ৫৫ নং আয়াতে আল্লাহ্ বলেন, “তোমাদের বন্ধু তো আল্লাহ তাঁর রাসুল এবং মুমিনবৃন্দ-যারা নামায কায়েম করে, যাকাত দেয় এবং বিনম্র।” অর্থাৎ প্রতিটি মুসলমানের প্রকৃত বন্ধু হলেন, আল্লাহ্, তাঁর রাসুল সা. এবং সকল মুমিন, যারা পরিপূর্ণ ইসলাম মেনে চলে। অনুরূপভাবে সূরা আল জাসিয়ার ১৯ নং আয়াতে আল্লাহ্ বলেন, “তিনি পরহেযগারদের বন্ধু।” অর্থাৎ যারা সকল পাপ থেকে নিজেকে দূরে রাখে, তাদের তিনি বন্ধু।
একইসাথে সূরা ইউনুসের ৬২ নং আয়াতে আল্লাহ্ বলেন, “যারা আল্লাহর বন্ধু, তাদের না কোন ভয় ভীতি আছে, না তারা চিন্তান্বিত হবে।” অর্থাৎ যারা আল্লাহ্র বন্ধু হতে পেরেছে এবং বন্ধু হিসাবে আল্লাহ্কে পেয়েছে তারা কখনোই কোনো বিষয়ে চিন্তিত ভয় ভীতি ইত্যাদি পাবে না। হোক সেটা দুনিয়াবী কিংবা আখিরাতের।
একইসাথে আল্লাহ্ আরো বলেন, “ইমানদার পুরুষ ও ইমানদার নারী একে অন্যের সহায়ক। তারা ভালো কথার শিক্ষা দেয় এবং মন্দ থেকে বিরত রাখে। নামাজ প্রতিষ্ঠা করে, জাকাত দেয় এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের নির্দেশ অনুযায়ী জীবনযাপন করে। এদেরই ওপর আল্লাহ তায়ালা দয়া করবেন।’ (সুরা তাওবা : ৭১)
অর্থাৎ ইমানদার পুরুষ ও মহিলারা তারা তাদের বন্ধুদের দিন ইসলামের পরিপূর্ণ শিক্ষা দেয় এবং তদনুযায়ী জীবনযাপন করে। তই এইসব ভালো বন্ধুদেরই আল্লাহ্ দয়া করেন ও করবেন।
উপর্যুক্ত আয়াতের সারমর্ম থেকে আমরা বুঝতে পারলাম, একমাত্র আল্লাহ্ই হচ্ছেন মুমিনের প্রকৃত বন্ধু। সেইসাথে রাসুলুল্লাহ সা. এবং পরিপূর্ণ ইমানদার ব্যক্তিবর্গই হচ্ছে বন্ধু হিসাবে শ্রেষ্ঠ। যাদের সংস্পর্শে থাকাটা সৌভাগ্যের এবং কল্যাণকর।
বন্ধু সম্পর্কে রাসুলের নির্দেশনা
বন্ধুত্ব এবং বন্ধু নির্বাচনের ক্ষেত্রে রাসুলুল্লাহ সা. কিছু নির্দেশনা দিয়েছেন। যেমন: বন্ধুত্ব হতে হবে শুধুমাত্র আল্লাহ্র জন্য। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি কাউকে ভালোবাসলো, তো আল্লাহর জন্যই ভালোবাসলো, কাউকে ঘৃণা করলো তো আল্লাহর জন্যই ঘৃণা করলো, কাউকে কিছু দিলো তো আল্লাহর জন্যই দিল এবং কাউকে দেয়া বন্ধ করলো তো আল্লাহর জন্যই দেয়া বন্ধ করলো, তবে সে তার ইমানকে পূর্ণ করলো।’ (মিশকাত শরিফ)
সুতরাং একজন মুসলিম যার সাথেই বন্ধুত্ব করুক না কেন তার মূল উদ্দেশ্য হতে হবে আল্লাহ্র সন্তুষ্টি। অর্থাৎ এমন কারো সাথে বন্ধুত্ব করতে হবে যে পরিপূর্ণ ইমানদার। কেননা একজন সত্যিকার ইমানদারের সংস্পর্শে থাকা মানেই আল্লাহ্র কাছাকাছি থাকা আর শয়তান থেকে দূরে থাকা।
অন্য একটি হাদিসে এসেছে, নবি (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, মানুষ তার বন্ধুর রীতিনীতির অনুসারী হয়। কাজেই তোমাদের প্রত্যেকেই যেন লক্ষ্য করে, সে কার সঙ্গে বন্ধুত্ব করছে। “(সুনানে আবু দাউদ, হাদিস নং ৪৮৩৩)
এই হাদিস থেকে আমরা বাস্তবতার চরম একটি দৃষ্টান্ত পাই। এই দুনিয়ায় একমাত্র মানুষই তার বন্ধুর দ্বারা সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত হয় যা সৃষ্টিগত একটি বৈশিষ্ট্য। যেকারণে রাসুলুল্লাহ সা. আমাদের নির্দেশ দিচ্ছেন, আমরা যেন ভালো মানুষের সাথেই বন্ধুত্ব করি। যাতে খারাপ মানুষের সংস্পর্শে এসে নিজেদের ইমান আমল নষ্ট করে না ফেলি। সুতরাং ভালো মানুষের সাথে বন্ধুত্ব করা খুবই জরুরি।
একইভাবে আরেকটি হাদিসে রাসুল (সা.) বলেছেন, “তুমি মুমিন ব্যক্তি ব্যতীত অন্য কারো সঙ্গী হবে না এবং তোমার খাদ্য যেন পরহেযগার লোকে খায়।” (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস নং ৪৮৩২)
এই হাদিস থেকে সরাসরি নির্দেশ এসেছে যে, আমরা যেন অবশ্যই মুমিন ইমানদার ছাড়া অন্য কারো সাথে বন্ধুত্বের অন্তরঙ্গ সম্পর্ক না করি। এবং আমরা যেন তাদেরকেই খাওয়াই যারা পরহেযগার অর্থাৎ ভালো মানুষ। সুতরাং ইসলামে বন্ধু এবং বন্ধুত্ব খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। যে বিষয়ে কুরআন এবং হাদিসে খুবই কঠোর নির্দেশনা এসেছে।
ভালো এবং খারাপ বন্ধু সম্পর্কে বুখারি হাদিস গ্রন্থে একটি হাদিস এসেছে, যার মূল বক্তব্য হলো, ভালো বন্ধু এবং খারাপ বন্ধুর উদাহরণ হলো, আতর বিক্রয়কারী এবং কামারের মতো। কেউ যদি আতর বিক্রয়কারীর সাথে থাকে, সে আতর না কিনলেও আতরের সুগন্ধ তার গায়ে লাগবে। একইভাবে কেউ যদি কামারের কাছে যায়, সে তার কাছে কোনো কাজ না করালেও কামারের চুলার ছাই কালি আগুনের শিখা ও ধোঁয়া ইত্যাদি তার গায়ে এসে লাগবে এবং তাকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।
এই উদাহরণের মাধ্যমে রাসুল (সা.) বোঝাতে চেয়েছেন, ভালো বন্ধু এমনই যে সে সরাসরি কোনো উপকার না করলেও; প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে তার সৎ গুণাবলী দ্বারা অপরজনকে সৎ হওয়ার এবং সৎ পথে চলতে সাহায্য করে। একইভাবে খারাপ বন্ধু সরাসরি খারাপ কাজ করতে না বললেও তার অসৎ কুকর্ম আমাদের খারাপ পথে যেতে উৎসাহিত করে এবং ধীরে ধীরে অসৎ মানুষে রূপান্তরিত করে। একইসাথে তার সাথে থাকার কারণে তার কুকর্মেরও ভাগিদার হতে হয়। সুতরাং একজন ইমানদারের কখনোই কোনো খারাপ মানুষের সাথে বন্ধুত্ব করা উচিত নয়।
বন্ধুত্ব সম্পর্কে কুরআনের নিষেধাজ্ঞা
পবিত্র কুরআনে আল্লাহ্ মুসলমানদের রাসুল এবং মুমিনদের সাথে যেমন বন্ধুত্ব করতে নির্দেশ দিয়েছেন। ঠিক তেমনি কার কার সাথে বন্ধুত্ব করা যাবে না তারও নির্দেশ দিয়েছেন সুস্পষ্টভাবে। আল্লাহ্ বলেন, “মুমিনগন যেন অন্য মুমিনকে ছেড়ে কোনো কাফেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ না করে। যারা এরূপ করবে আল্লাহর সাথে তাদের কেন সম্পর্ক থাকবে না। (সুরা: আল ইমরান, আয়াত: ২৮) অনুরূপভাবে সূরা নিসার ১৪৪ নং আয়াতে আল্লাহ্ বলেন, হে ইমানদারগণ! তোমরা কাফেরদেরকে বন্ধু বানিও না মুসলমানদের বাদ দিয়ে। এছাড়াও সূরা মায়িদার ৫১ নং আয়াতে আল্লাহ্ বলেন, “হে মুমিণগণ! তোমরা ইহুদি ও খ্রিষ্টানদেরকে বন্ধু হিসাবে গ্রহণ করো না। তারা একে অপরের বন্ধু। তোমাদের মধ্যে যে তাদের সাথে বন্ধুত্ব করবে, সে তাদেরই অন্তর্ভুক্ত।”
আল্লাহ্ আরো বলেন, “মুমিনগণ, আল্লাহ যে জাতির প্রতি রুষ্ট, তোমরা তাদের সাথে বন্ধুত্ব করো না। (সুরা: আল মুমতাহিনা, আয়াত: ১৩)
উপর্যুক্ত আয়াত ছাড়াও আল্লাহ্ আরো অসংখ্য আয়াতে কাফের মুশরিক বিধর্মীদের সাথে মুমিন মুসলমানদের বন্ধুত্ব না করার কঠোর নির্দেশ দিয়েছেন। শুধু তাইনয় যারাই তাদের সাথে বন্ধুত্ব করবে, এইসব নামধারী মুসলমানের সাথে আল্লাহ্র কোনো সম্পর্কে থাকবে না বলেও হুশিয়ারি দিয়েছেন। সুতরাং কাফের মুশরিকসহ সকল বিধর্মীদের সাথে কখনোই অন্তরঙ্গ বন্ধু্ত্ব করা যাবে না।
বিধর্মীদের ব্যাপারে রাসুলের নিষেধাজ্ঞা
বিধর্মীদের ব্যাপারে রাসুলুল্লাহ সা. এর কঠোর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। বিশেষকরে অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের অনুসরণ অনুকরণ করা। পবিত্র হাদিসে এসেছে, “যে ব্যক্তি কোনো জাতির অনুকরণ, অনুসরণ ও সামঞ্জস্য বিধান করবে, সে তাদেরই অন্তর্ভুক্ত বলে গণ্য হবে”। (ইমাম আহমাদ, আল-মুসনাদ: ২/৫০; আবু দাউদ রহ. বর্ণনা করেছে উৎকৃষ্ট সনদে, হাদিস নং- ৪০৩১; আর আলবানী হাদিসটিকে সহীহ বলেছেন, ‘সহীহ আল-জামে আস-সাগির’, হাদিস নং- ৬০২৫।)
সুতরাং যেকেউ ইসলাম ব্যতিত অন্যান্য জাতি ধর্মের অনুসরণ অনুকরণ করবে, তাকে সেই জাতিরই দলভুক্ত করা হবে। আর মানুষ তাকেই অনুসরণ অনুকরণ করে যার প্রতি মায়া, ভালোবাসা এবং বন্ধুত্ব থাকে। অতএব অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের সাদৃশ্যপূর্ণ কোনো কিছুই করা যাবে না।
শুধু তাইনয়, তিনি জানতেন যে আমাদের অবস্থা এমনই হবে যে, আমরা কাফির মুশরিকদের অনুসরণ অনুকরণসহ তাদের সাথে বন্ধুত্ব ও হৃদ্যতা পোষণে পিছপা হবো না। তাই তিনি আগেই উল্লেখ করে গেছেন যা বুখারী মুসলিমসহ অসংখ্য হাদিস গ্রন্থে উল্লেখ রয়েছে। আর তা হলো “তোমরা অবশ্যই তোমাদের পূর্ববর্তীদের (অর্থাৎ ইহুদি খ্রিস্টানদের) রীতিনীতি পুরোপুরি অনুসরণ করবে, প্রতি বিঘতে বিঘতে এবং প্রতি গজে গজে। এমনকি তারা যদি ষাণ্ডার গর্তেও প্রবেশ করে থাকে, তবে তোমরাও তাতে প্রবেশ করবে।
সুতরাং কখনোই কোনো অবস্থাতেই বিধর্মীদের সাথে হৃদ্যতাপূর্ণ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক করা যাবে না এবং তাদের অনুকরণ অনুসরণও করা যাবে না।
বিধর্মীদের সাথে বন্ধুত্ব প্রসঙ্গে ইসলামি বিধান
আল্লাহ্ বিধর্মীদের সাথে শুধু বন্ধুত্ব বর্জন নয়, বরং যারাই তাদের সাথে বন্ধুত্ব করবে; তাদেরকে তিনি আযাবে নিপতিত করবেন বলে হুশিয়ারি দিয়েছেন। আল্লাহ্ বলেন, “আপনি তাদের অনেককে দেখবেন, কাফেরদের সাথে বন্ধুত্ব করে। তারা নিজেদের জন্য যা পাঠিয়েছে তা অবশ্যই মন্দ। তা এই যে, তাদের প্রতি আল্লাহ ক্রোধান্বিত হয়েছেন এবং তারা চিরকাল আযাবে থাকবে।” (সুরা: আল মায়িদাহ, আয়াত: ৮০) একইসাথে অন্য আয়াতে আল্লাহ্ আরো বলেন, “তোমরা কি মনে কর যে, তোমাদের ছেড়ে দেয়া হবে এমনি, যতক্ষণ না আল্লাহ জেনে নেবেন তোমাদের কে যুদ্ধ করেছে এবং কে আল্লাহ, তাঁর রাসুল ও মুসলমানদের ব্যতীত অন্য কাউকে অন্তরঙ্গ বন্ধুরূপে গ্রহণ করা থেকে বিরত রয়েছে। (সুরা: আত তাওবাহ, আয়াত: ১৬)
উপর্যুক্ত আয়াতগুলো দ্বারা আল্লাহ্ সকল মুসলমানদের সাবধান করে দিয়েছেন যে, যারাই অন্যান্যদের সাথে বন্ধু্ত্ব করবে তাদেরকে তিনি কখনোই ছেড়ে দিবেন না। একইসাথে যেসব মুনাফিক নামধারী মুসলমান বিধর্মীদের সাথে আতাত করে চলবে তাদেরকেও তিনি কঠিন শাস্তির মুখোমুখি করবেন।
বন্ধুত্বের জন্য আফসোস
পৃথিবীর অধিকাংশ কাফের মুশরিক মুনাফিক কিয়ামতের ময়দানে আফসোস করতে থাকবে আর বলতে থাকব, “হায় আমার দূর্ভাগ্য, আমি যদি অমুককে বন্ধুরূপে গ্রহণ না করতাম।” (সুরা: আল-ফুরকান, আয়াত: ২৮)
অর্থাৎ যদি তারা ভালো বন্ধুর সাথে সম্পর্ক রাখতো তাহলে তাদের এই করুন পরিনতি হতো না। এইভাবে আল্লাহ্ আরো বলেন, “বন্ধুবর্গ সেদিন একে অপরের শত্রু হবে, তবে খোদাভীরুরা নয়।” (সুরা: যুখরুফ, আয়াত: ৬৭)
অর্থাৎ যেসব মানুষ তার বন্ধুর দ্বারা প্রভাবিত হয়ে আজ জাহান্নামী হয়েছে, তারা সেখানে একে অপরের শত্রুতে পরিনত হবে। অতএব এমন কারো সাথে আমাদের বন্ধুত্ব করা উচিত নয়, যারা আল্লাহ্ বিরোধী। যাদের উপর আল্লাহ্ নারাজ, যাদের সাথে শয়তানের বন্ধুত্ব তাদের সাথে কখনোই কোন মুমিনের অন্তরঙ্গ বন্ধুত্ব হতে পারে না। হোক সে নামধারী মুসলিম কিংবা বিধর্মী।
বিধর্মীরা ভালো হলেও অন্তরঙ্গতা নয়
আল্লাহ্ যেখানে সরাসরি বিধর্মীদের সাথে বন্ধুত্ব করতে নিষেধ করে দিয়েছেন। সেখানে কিছু মুসলিম মনে করে থাকেন, যেসব বিধর্মীরা ভালো তাদের সাথে নিশ্চয়ই (দাওআতের ইচ্ছা ছাড়া) বন্ধুত্ব করা যাবে। মুমিনদের জেনে রাখা উচিত, দুনিয়াবী প্রয়োজনে আল্লাহ্ সকল মানুষের সাথেই সুসম্পর্ক রাখতে জোর তাগিদ দেয়। শুধু সুসম্পর্কই নয়, বরং যেকোনো সময় সকল বিধর্মীদের নিরাপত্তা দান করাই একজন মুমিনের প্রকৃত কাজ। কেননা একজন মুমিনের উত্তম আখলাক অন্যান্য বিদর্মীদের ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট করবে।
তাই বিধর্মীদের দুনিয়াবী প্রয়োজনে এবং আখিরাতের (দাওয়াতের ইচ্ছায়) নিয়তে বন্ধু বানানো যাবে। তবে তা কখনোই অন্তরঙ্গতার বন্ধুত্ব নয়। কেননা আল্লাহ্ কখনোই বিধর্মীদের ভালো কাজের কোনো প্রতিদান দিবেন না। আল্লাহ্ বলেন, “আর আমরা তাদের কৃতকর্মের প্রতি অগ্রসর হয়ে সেগুলোকে বিক্ষিপ্ত ধূলিকণায় পরিণত করব”। [সূরা আল-ফুরকান, আয়াত: ২৩]
অর্থাৎ বিধর্মীরা (মান আনা ছাড়া) যতোই ভালো কাজ করুক না কেন, তার কোনো প্রতিদান আল্লাহ্র কাছে নেই। তাই কিয়ামতের ময়দানে এইসব ভালো কাজের কোনো মূল্য নেই। এছাড়াও বিধর্মীরা কখনোই ইসলাম এবং মুসলিমের কল্যাণ কামনা করে না। আল্লাহ্ বলেন,
“আর যারা কাফের তারা পারস্পরিক সহযোগী, বন্ধু। (সুরা: আল-আনফাল, আয়াত: ৭৩) অর্থাৎ যারা বিধর্মী তারা ইসলামের বিরুদ্ধে একে অপরের বন্ধু এবং সহযোগী। সুতরাং তাদের সাথে কখনোই কোনো মুমিনের অন্তরঙ্গ বন্ধুত্ব যা একজন মুসলিমের সাথে হয়, তা হতে পারে না। এছাড়াও আল্লাহ্ বলেন, “আপনি সব মানুষের চাইতে মুসলমানদের অধিক শত্রু ইহুদি ও মুশরেকদেরকে পাবেন।” (সুরা: আল মায়িদাহ, আয়াত: ৮২)
অর্থাৎ ইহুদিরা ইসলাম প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই কিয়ামত পর্যন্ত মুসলিমের শত্রু হিসাবে চিহ্নিত। একইসাথে মুশরিকরাও। সুতরাং কোনো অবস্থাতাতেই বিধর্মীদের সাথে বন্ধুত্ব নয়। শুধু তাইনয়, আল্লাহ্ সরাসরি তাঁর রাসুল (সা.) কে নির্দেশ করে বলেন, “ইহুদি ও খ্রিষ্টানরা কখনই আপনার প্রতি সন্তুষ্ট হবে না, যে পর্যন্ত না আপনি তাদের ধর্মের অনুসরণ করেন। বলে দিন, যে পথ আল্লাহ প্রদর্শন করেন, তাই হল সরল পথ। যদি আপনি তাদের আকাঙ্খাসমূহের অনুসরণ করেন, ঐ জ্ঞান লাভের পর, যা আপনার কাছে পৌঁছেছে, তবে কেউ আল্লাহর কবল থেকে আপনার উদ্ধারকারী ও সাহায্যকারী নেই। (সুরা: আল বাকারা, আয়াত: ১২০)
উপর্যুক্ত আয়াতে আল্লাহ্ সরাসরি তাঁর রাসুলকে দিয়েই বান্দাদের শিক্ষা দিচ্ছেন যে, বিধর্মীরা ততক্ষণ পর্যন্ত সন্তুষ্ট নয়, যতক্ষণ না আমরা তাদের অনুসরণ করছি। অর্থাৎ তাদের মূল উদ্দেশ্যই হলো মুমিনদের আল্লাহ্র পথ থেকে সরিয়ে দেওয়া। সুতরাং আমরা যদি তাদের লৌকিক ভালো কাজগুলো দেখে তাদের প্রতি আকৃষ্ট হই, তাহলে তারা আমাদের দিনের পথ থেকে সরিয়ে দিবে।
আমরা যদি কোনো বিধর্মীদের সাথে অন্তরঙ্গ বন্ধুত্ব করি। তাহলে তার সকল কাজে আমাদের উপস্থিতি থাকটা স্বাভাবিক। এখন তাদের ধর্মীয় কাজেও যদি আমরা উপস্থিত থাকি, তাহলে আমাদের ইমান আর অবশিষ্ট থাকবে না। আর এভাবেই আমরা ইমান ও আকিদা নষ্ট করে মুনাফিকে পরিনত হয়ে যাবো। তাই আল্লাহ্ আগে থেকেই বিধর্মীদের সাথে অন্তরঙ্গ বন্ধুত্ব করতে নিষেধ করে দিয়েছেন।
বন্ধুত্বই সবার শেষ গন্তব্য
আমরা কুরআন হাদিসের আলোকে বুঝতে পারলাম ইসলাম বন্ধুত্বের সম্পর্ককে খুবই গুরুত্ব দেয়। আর এর গুরুত্ব এতোটাই বেশি যে, রাসুলুল্লাহ সা. একটি হাদিসে বলেন, যার সাথে যার মুহাব্বত, ভালোবাসা কিংবা বন্ধুত্ব, তার সাথেই তার কিয়ামত হবে। এবং তার সাথেই সে থাকবে। (সহীহ বুখারী,অধ্যায়: সাহাবীদের ফাযায়েল ৩/১৩৪৯ হা: ৩৪৮৫, সহীহ মুসলিম, অধ্যায়: আদব ৪/২০৩২ হা: ২৬৩৯, সুনানে তিরমিজি,অধ্যায়: যুহুদ ৪/৫৯৫ হা: ২৩৮৫)
অর্থাৎ দুনিয়ায় যে ব্যক্তি যাকে ভালোবাসবে, যার অনুসরণ অনুকরণের মাধ্যমে তার সাথে হৃদ্যতা প্রকাশ করবে। ঐ ব্যক্তির সাথেই তার কিয়ামত অনুষ্ঠিত হবে। সুতরাং কেউ যদি প্রকৃত ইমানদার মুমিন মুসলিমের সাথে ভালোবাসার সহিত চলাফেরা কিংবা তার অনুকরণ অনুসরণের মাধ্যমে তার প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করে। তাহলে সে আখিরাতে তার সেই বন্ধুর সাথেই থাকবে।
এখন আমরা যদি মুমিন মুসলিমের সাথে বন্ধুত্ব না করে কাফের, মুশরিক, মুনাফিক, ফাসেক ইত্যাদি ব্যক্তিবর্গের সাথে বন্ধুত্ব করি। তাহলে আমাদের আখিরাতও তাদের সাথেই হবে। এবং আমরা নিশ্চিতরূপেই জাহান্নামের দিকে পতিত হবো।
সর্বোত্তম বন্ধু হলেন রাসুলুল্লাহ (সা.)
এই দুনিয়ায় কিয়ামতের আগ পর্যন্ত প্রতিটি মুসলমানের জন্য সর্বোত্তম আদর্শের এবং সর্বশ্রেষ্ঠ অনুকরণীয় অনুসরণীয় বন্ধু হলেন রাসুলুল্লাহ (সা.)। এই বন্ধুত্বের গুরুত্বের কথা হাদিসে এসেছে, যে কেউ রাসুল সা. কে ভালোবেসে তাঁর আদর্শকে বুকে ধারণ করে জীবনযাপন করবে, সে অবশ্যই রাসুলুল্লাহ সা. সাথেই কিয়ামতে থাকবে।
রাসুলুল্লাহ সা. এর স্বীকৃতি সম্পর্কে আল্লাহ্ বলেন, “নিশ্চয়ই রাসুলুল্লাহর জীবনের মধ্যে রয়েছে তোমাদের জন্য সর্বোত্তম আদর্শ।” (সুরা আহযাব : আয়াত ২১) শুধু তাইনয় আল্লাহ্ আরো বলেন, “(হে রাসুল! আপনি) বলুন, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালোবাসতে চাও, তবে আমার অনুসরণ কর; তাহলেই আল্লাহ তোমাদের ভালোবাসবেন এবং তোমাদের গোনাহসমূহ ক্ষমা করে দেবেন।” (সুরা আল-ইমরান : আয়াত ৩১)
অর্থাৎ আল্লাহ্র ভালোবাসা এবং ক্ষমা পেতে হলে অবশ্যই তাকে রাসুলুল্লাহ সা. কে ভালোবেসে তাঁর আদর্শের অনুসরণ অনুকরণ করতে হবে। সুতরাং দুনিয়া এবং আখিরাতের জন্য সর্বোত্তম আদর্শিক বন্ধু হলেন রাসুল (সা.)। প্রতিটি মুসলমানেরই উচিত তাঁর আদর্শকে বুকে ধারণ করে তাঁকে ভালোবাসা। যাতে কিয়ামতের ময়দানে তাঁর সাহচর্য পাওয়া যায়।
কুরআন হাদিসের আলোকে উপর্যুক্ত আলোচনা থেকে আমরা এটাই জানতে পারলাম যে, পৃথিবীতে প্রতিটি মুসলিমেরই প্রকৃত বন্ধু হলেন আল্লাহ্ তাঁর রাসুল এবং মুমিনবৃন্দ। একইসাথে যারা নিজেদের ইমানদার দাবি করবে, তারা কখনোই মুমিন ব্যতিত বিধর্মীদের সাথে বন্ধুত্ব করতে পারবে না। যদি কেউ এমন করে তাহলে সে কিয়ামতে লাঞ্চিত হয়ে জাহান্নামীদের অন্তর্ভূক্ত হবে। তাই প্রতিটি মুসলমানেরই উচিত প্রকৃত ইসলাম সম্পর্কে জেনেবুঝে তা সঠিকভাবে পালন করা।
(মতামত লেখকের নিজস্ব)