রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সমাজ ভাবনা
- প্রকাশ: ০৫:২৯:৪২ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৫ ডিসেম্বর ২০২২
- / ৩৯১৭ বার পড়া হয়েছে
বাঙালিরর সামগ্রিক জীবনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অপরিহার্যতা অনস্বীকার্য। বাংলা ও বাঙালীর সমাজ-সংস্কার থেকে শুরু করে প্রতিদিনের কর্মপ্রবাহের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চিন্তা-চেতনা এক অবিচ্ছিন্ন সুতায় গাঁথা। খণ্ডিত কিংবা বিচ্ছিন্ন রবীন্দ্রনাথ পুরো বাঙালির সত্যিকারের দিশারী হতে পারেন না।
আমাদের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক জীবনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গভীর চর্চা ও অনুশীলনের মাধ্যমে তাকে পরিপূর্ণভাবে নিজেদের জীবনাচরণে সম্পৃক্ত করা সম্ভব হবে। শুধু তাই নয়, জাতি হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো, সাহস আর উদ্দীপনায় নিজের অবস্থান বিশ্ব দরবারে সুনিশ্চিত করার শক্তি খুঁজে পাব।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আমাদের প্রতিদিনের কর্মে, অনুপ্রেরণায়, আদর্শে আবেদন জানাতে পারলে আমরা আপন মর্যাদায় নিজেকে তৈরি করতে সক্ষম হব। ঈশ্বর প্রেমিক রবীন্দ্রনাথ কখনও ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা কিংবা সঙ্কীর্ণতার নগ্ন বেড়াজালে আবদ্ধ ছিলেন না। তার কাছে মানুষই ছিল সব থেকে বড় সত্য। তাই মানুষ আর মনুষ্যত্বের অপমান তাকে বার বার মর্মাহত করেছে, ক্ষুব্ধ করেছে, তার চেতনাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। ভেঙ্গে দিতে উদ্যত হয়েছেন সে সব নিয়মশৃঙ্খল যা মানুষে মানুষে ব্যবধানের প্রাচীর তোলে, সহজ মিলনের পথে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে, মানুষ হিসেবে মানুষের মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হয়।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে যথার্থভাবে আলোচনা করতে গেলে তার এসব আদর্শিক মূল্যবোধকে বিবেচনায় আনতে হবে। তার মননশীলতার অনুষঙ্গ হিসেবে কবির সমাজভাবনা ও সেভাবে নির্ণীত হওয়া অত্যন্ত জরুরী। তার আদর্শ ও সচেতনতাকে গুরুত্ব দিয়ে সমাজ চিন্তামূলক আবেদন তুলে আনা বিশেষ দরকার।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সমাজচিন্তাকে আলোকপাত করতে তৎকালীন সমাজ ব্যবস্থার ওপর একটি পরিচ্ছন্ন ধারণা থাকা আবশ্যক। ১৮৬১ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম তখন অবিভক্ত বাংলায় ইতোমধ্যে শুরু হয়ে যায় নবজাগরণের সমৃদ্ধ জোয়ার। আর এই পরিবর্তিত কালের শ্রেষ্ঠ মনীষী রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সাহিত্যে, সমাজ সংস্কারে এক অনুপম দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করে বাংলা ও বাঙালীকে নতুন পথের সন্ধান দেন।
উনিশ শতকের প্রাণপরুষ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ব্রাহ্মণ বংশের সন্তান হয়েও ব্রাহ্মণ্যবাদের অমানবিক, নিষ্ঠুর আচার ব্যবস্থাকে ভাঙ্গার কাজে দৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়ে আসলেন। বিশেষ করে নারীদের অসহনীয় দুর্দশা থেকে বের করার বলিষ্ঠ প্রত্যয়ে বাল্যবিবাহ রোধ, বিধবা বিবাহ প্রচলন থেকে শুরু করে অন্যান্য সামাজিক অপসংস্কারের বিরুদ্ধে দৃঢ় প্রতিরোধে অনড় থাকেন। আর নারী শিক্ষা তো তার হাত ধরেই বঙ্গরমণীর আঙ্গিনায় প্রবেশ করে।
কট্টর ব্রাহ্মণ্যবাদী সমাজের কঠিন শৃঙ্খল ভেদ করার যে সাহসী লড়াইয়ে বিদ্যাসাগর নেমেছিলেন তার প্রভাব পড়েছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চেতনায়, সৃষ্টিযজ্ঞে এবং সুবিশাল কর্মযোগেও। বিদ্যাসাগর ছিল তাঁর কাছে নমস্য, পরম পূজনীয়। রাজা রামমোহন রায়ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে ছিলেন যুগস্রষ্টা মহামানব।
রবীন্দ্রমননে রামমোহনের যে যুগান্তকারী ছাপ ছিল তাও স্পষ্টই লক্ষ্য করা যায়। তাঁকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দেখেছেন ঠিক এভাবে— ‘নবযুগের প্রথম প্রবর্তক রামমোহন রায়। তিনি যে পশ্চিমকে দেখতে পেয়েছিলেন সে তো শস্ত্রধারী পশ্চিম নয়, বাণিজ্যজীবী পশ্চিম নয়, সে হচ্ছে জ্ঞানে প্রাণে উদ্ভাসিত পশ্চিম।’ আর তাই জ্ঞান-বিজ্ঞান সমৃদ্ধ পাশ্চাত্যের মাঙ্গলিক ধারাই বার বার রবীন্দ্রমননকে উদ্দীপ্ত করেছে। ইংরেজদের অন্ধ অনুকরণে দেশীয় শিক্ষা, সংস্কৃতি,
ঐতিহ্যের ধারা থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার আশঙ্কায়ও তিনি তাড়িত হয়েছেন। অবিভক্ত বাংলার সামাজিক উত্থান-পতনের এক যুগ সন্ধিক্ষণে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম। এক ঐতিহ্যবাহী ঠাকুর বাড়ির সন্তান হিসেবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শৈশব-কৈশোর অতিক্রান্ত হয়েছে জ্ঞানচর্চার এক নির্মল পরিবেশের মধ্যে। পাশাপাশি নিজের বিরাট সৃষ্টিশীল ক্ষমতা তাঁকে এক যুগোত্তীর্ণ মহাপুরুষের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করে। অবিভক্ত বাংলার নবজাগরণের মধ্যাহ্নে রবি কিরণের উন্মেষ।
১৭৯৩ খ্রি লর্ড কর্নওয়ালিশ প্রবর্তিত চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বাংলার ভূমি ব্যবস্থার ওপর ব্যাপক রদবদল আনে। প্রাচীন ভারতে ভূমিতে ব্যক্তির যে স্বত্বহীনতা ছিল সেখানে তৈরি হয় এক জটিল মালিকানা ব্যবস্থা। ফলে সৃষ্টি হয় বাংলার নতুন জমিদার শ্রেণী। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন সেই জমিদার বংশের সন্তান। এক সময় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ওপর দায়িত্ব এসে পড়ে পিতার জমিদারি দেখার। সাধারণ মানুষের জীবনের সঙ্গে জীবন যোগ করার সুবর্ণ সুযোগ আসার মধ্য দিয়ে দরিদ্র, নিপীড়িত, প্রজাকুলের সঙ্গেও গড়ে ওঠে এক অকৃত্রিম সৌহার্দ্য আর হৃদ্যতা।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জমিদারের প্রতিনিধি নন। তিনি নিজেই তার নিজের তুলনা ফলে জমিদার হয়েও তিনি যে প্রজাহিতৈষীর ভূমিকা রেখেছিলেন তা আজও অতুলনীয়। প্রজাদের কল্যাণে তাঁর যে বাস্তব কর্মসূচী সেটা তাঁকে একজন সমাজ গবেষকের সম্মানেও ভূষিত করে। তাঁর সমাজ-চিন্তা-চেতনার সঙ্গে কবির সৃষ্টিযজ্ঞের কোন বিরোধ বা সংঘর্ষ ছিল না। বরং তা সম্পূরক ছিল। ঠাণ্ডা মাথায়, স্থিরচিত্তে, দৃঢ় প্রত্যয়ে যা ভেবেছেন সৃষ্টি দ্যেতনায় তাকেই সফলভাবে রূপায়ণ করেছেন। জমিদার সম্বন্ধে তাঁর ধারণা ছিল- ‘পিতৃপ্রতিম অভিভাবক।’ আর সেই কারণে তিনি জমিদার হিসেবে প্রজামঙ্গলে কখনও পিছপা হননি।
ক্ষয়িষ্ণু জমিদার আর উঠতি বণিক শ্রেণীর বিরোধ যখন তাঁকে ক্ষুব্ধ করেছে তখন নির্দ্বিধায় জমিদার শ্রেণীর পক্ষপাতিত্ব করেছেন। তাঁর উক্তি স্মরণ করলেই এর যথাযর্থতা উপলব্ধি করা যাবে—‘পূর্বকালের ক্ষত্রিয় নায়কের সঙ্গে মানুষের যে সম্বন্ধ ছিল সেটা মানব সম্বন্ধ। দুঃখ, কষ্ট, অত্যাচার যতই থাক তবু পরস্পরের মধ্যে হৃদয়ের আদান-প্রদানের পথ ছিল। এখন বৈশ্য মহাজনের সঙ্গে মানুষের সম্বন্ধ যান্ত্রিক।
কর্মপ্রণালী নামক প্রকা- একটা জাঁতা মানুষের আর সমস্তই গুঁড়া করিয়া দিয়া কেবল মজুরটুকু মাত্র বাকি রাখিবার চেষ্টা করিতেছে।’ তার যোগাযোগ উপন্যাসে ক্ষষিষ্ণু জমিদার বিপ্রদাস এবং উঠতি ব্যবসায়ী মধুসূদনের যে চারিত্রিক বৈপরীত্য সেখান থেকেও অনুমেয় জমিদার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আজীবন এই শ্রেণীর প্রতি বিশেষ দুর্বলতা ছিল। ‘ঘরেবাইরে’ উপন্যাসে জমিদার নিখিলেশের চরিত্রও সেই সম্ভাবনার দিকনির্দেশক। এর পরেও বলা যায় তিনি প্রজাহিতৈষী, অসাম্প্রদায়িক উদার, মানবিক জমিদার। প্রজাদের সঙ্গে তার মানবিক সম্পর্ক, সফল মিলনের যে অভিনব সংযোগ সেখানে তিনি একজন সত্যিকারের প্রজা মঙ্গলের পিতৃপ্রতিম অভিভাবক।
পাশ্চাত্যে ধনবাদী সভ্যতার বিকাশ এবং সারাবিশ্বে এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া রবীন্দ্রনাথকে ব্যথিত করেছিল। এই ধনবাদী সমাজের অসাম্যই তাঁকে বিশেষভাবে আলোড়িত করে। এ সম্পর্কে তাঁর মতামত- ‘ধনের ধর্মই অসাম্য। জ্ঞান ধর্ম কলাসৌন্দর্য পাঁচজনের সঙ্গে ভাগ করিলে বাড়ে বৈ কমে না। কিন্তু ধন জিনিসটাকে পাঁচজনের কাছ হইতে শোষণ করিয়া লইয়া পাঁচজনের হাত হইতে তাহাকে রক্ষা না করিলে সে টেকে না। এই ধনকামী নিজের গরজে দারিদ্র্য সৃষ্টি করে, তাই ধনের বৈষম্য লইয়া যখন সমাজে পার্থক্য ঘটে তখন ধনীর দল সেই পার্থক্যকে সমূলে ঘুচাইতে ইচ্ছা করে না, অথচ সে পার্থক্যটা যখন বিপজ্জনক হইয়া ওঠে তখন বিপদটাকে কোনমতে ঠেকো দিয়া ঠেকাইয়া রাখিতে চায়।’ এ শুধু তার সুচিন্তিত অভিব্যক্তিই নয় সৃজনশীলতায়ও এর ব্যত্যয় ঘটেনি।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার বিখ্যাত ‘রক্তকরবী’ নাটকটি দর্শক-শ্রোতার কাছে সে বার্তাই পৌঁছে দেয়। এই পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থার আগ্রাসনে যখন তিনি মর্মাহত সেই সময় যান বিপ্লবোত্তর রাশিয়ায়। সমাজতান্ত্রিক রাশিয়া তাকে মুগ্ধ করে। রূপান্তরিত রাশিয়াকে স্বাগত জানিয়ে তিনি বলেন ‘যে পুরাতন ধর্মতন্ত্র এবং পুরাতন রাষ্ট্রতন্ত্র বহু শতাব্দী ধরে এদের বুদ্ধিকে অভিভূত ও প্রাণশক্তিকে নিঃশেষ প্রায় করে দিয়েছে, এই সোভিয়েত বিপ্লবীরা তাদের দুটোকেই নির্মূল করে; এত বড় বন্ধন জর্জর জাতিকে এত অল্প কালে এতবড় মুক্তি দিয়েছে দেখে মন আনন্দিত হয়।
রাশিয়ার পলিটিক্স মুনাফা লোলুপদের লোভের দ্বারা কলুষিত নয়। এখানকার বিপ্লবের বাণীও বিশ্ববাণী। আজ পৃথিবীতে অন্তত একটা দেশের লোক স্বজাতিক স্বার্থের ওপরেও সমস্ত মানুষের স্বার্থের কথা চিন্তা করেছে।’ সমাজ বিষয়ক চিন্তায় রবীন্দ্রনাথ এতটাই অগ্রগামী ছিলেন যে তাঁর সেই গভীর উপলব্ধি আজও সময়ের পরিবর্তনের ধারায় প্রাসঙ্গিক এবং অপরিহার্য।
সমাজ সম্পর্কে বাস্তবসম্মত চেতনার স্বচ্ছ দলিল যেমন তার মননশীলতায় একইভাবে ছোটগল্প, উপন্যাস, কবিতা, নাটক, গীতি ও নৃত্যনাট্যে স্পষ্ট হয়ে আছে। জমিদারি দেখার সুবাদে মাটি আর মানুষের যত কাছাকাছি হয়েছেন ততই তার সমাজ-সম্পর্কিত ভাবনা এবং অভিব্যক্তি স্পষ্ট হয়েছে, গভীরতা পেয়েছে আর এরই মধ্যে নিজেকেও সমৃদ্ধ করেছেন। তার পরেও আক্ষেপ থেকেছে বৃহত্তর সমাজের পুরো ব্যবস্থাকে যথার্থভাবে না জানার অপূর্ণতায়।