০৫:৫২ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
                       

অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিক্ষার যুগে বাংলাদেশ

ড. রঞ্জিত পোদ্দার
  • প্রকাশ: ০৩:২৩:০০ অপরাহ্ন, সোমবার, ৬ মার্চ ২০২৩
  • / ২৮০৬ বার পড়া হয়েছে

বাংলাদেশের উত্তর কামারখোলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একটি শ্রেণিকক্ষ। ছবিটি প্রতীকী। | © Mott MacDonald


Google News
বিশ্লেষণ-এর সর্বশেষ নিবন্ধ পড়তে গুগল নিউজে যোগ দিন

বিশেষ শর্তসাপেক্ষে এবং স্বল্পমূল্যে এই ওয়েবসাইটটি সামাজিক কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ কিংবা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের নিকট বিক্রি করা হবে।

কর্মের মাধ্যমে শিখনকে অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিক্ষা বলা হয়। কর্ম ও অভিজ্ঞতার মাধ্যমে জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জন করলে তা দীর্ঘস্থায়ী হয়। শিক্ষার্থীরা বাস্তব অভিজ্ঞতা বা কর্মের মাধ্যমে না শিখলে, শিখন যথাযথ হয় না কারণ তারা তাদের অর্জিত জ্ঞানকে বহুলাংশেই দৈনন্দিন জীবনে প্রয়োগ করতে পারে না। যে শিক্ষা বাস্তব জীবনে কাজে লাগে না তাকে কখনো মানসম্মত  শিক্ষা বলা যায় না।

একজন আমেরিকান শিক্ষাবিদ ডেভিড কোলব দাবি করেছেন যে, যথাযথ জ্ঞান এবং দক্ষতা অর্জনের জন্য একজন শিক্ষার্থীকে অবশ্যই কাজের অভিজ্ঞতার মাধ্যদিয়ে যেতে হবে। 

যেহেতু তরুণ প্রজন্মকে আরো জ্ঞানী ও দক্ষ করে তোলার জন্য এই অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিক্ষাকে অধিক কার্যকর পদ্ধতি হিসেবে বিবেচনা করা হয়, সেহেতু বাংলাদেশ সরকার ২০২৩ শিক্ষাবর্ষ থেকে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে এ শিক্ষাব্যবস্থা চালু করতে যাচ্ছে। যদিও ২০২৩ সালে প্রাথমিকে প্রথম ও দ্বিতীয় এবং মাধ্যমিকের ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিক্ষাক্রম বাস্তবায়িত হতে যাচ্ছে, এটি ক্রমান্বয়ে অন্যান্য শ্রেণীতে বাস্তবায়ন করা হবে। আশা করা যায় যে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অভিজ্ঞতাভিত্তিক পাঠ্যক্রম বাস্তবায়িত হলে, শিক্ষার্থীরা সঠিক জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জন করবে এবং তারা সমাজে সচেতনভাবে সকলের সাথে মিলেমিশে কাজ করতে পারবে এবং কর্মক্ষেত্রে আরও ভালো কর্ম সম্পাদনে সক্ষম হবে। কারণ অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিক্ষায় বড় একটি সময় জুড়ে হযরত সদস্যদের সাথে কাজ করতে হয়। 

ডেভিড কোলব বিশ্বাস করতেন যে, জ্ঞান অর্জন ও পুনর্গঠন হয় অভিজ্ঞতার মাধ্যমে। তিনি জ্যাঁ পিয়াঁজে (১৮৯৬-১৯৮০), জন ডিউই (১৮৫৯-১৯৫২) এবং কার্ট লিউইন (১৮৯০-১৯৪৭)-এর শিক্ষা দর্শনের মাধ্যমে প্রভাবিত হয়ে তত্ত্বটি প্রদান করেছেন। পিয়াঁজের মতে, শিক্ষা হলো পরিবেশগত উদ্দীপনার সাথে অভিযোজনের একটি প্রক্রিয়া এবং এই প্রক্রিয়ায় শিক্ষার্থীরা নতুন পরিস্থিতিতে একটি নতুন সমস্যা সমাধানের জন্য বারবার পূর্ববর্তী জ্ঞান প্রয়োগ করে থাকে। জন ডিউই এর মতে, জ্ঞান সামাজিকভাবে নির্মিত এবং শিশুরা পাঠ্যক্রমের চেয়ে তাদের সে অভিজ্ঞতাকে বেশি গুরুত্ব দেয়। যে অভিজ্ঞতা তারা কর্ম সম্পাদন ও সামাজিক মিথষ্ক্রিয়ার মাধ্যমে অর্জন করে। আবার, কার্ট লিউইন দাবি করেছেন যে, অভিজ্ঞতা অর্জন শেখার একটি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা নতুন অন্তর্দৃষ্টি তৈরি করে এবং কখনো কখনো পুরনো চিন্তার সংস্কার করে। ডেবিড কোলব ১৯৮৪ সালে এখন বিষয়ে বলেন, কার্যকরী শিক্ষা তখনই ঘটে যখন একজন শিক্ষার্থী চারটি ধাপের মধ্য দিয়ে যায়, যথা: সুনির্দিষ্ট অভিজ্ঞতা অর্জন, অভিজ্ঞতার প্রতিফলন চর্চা, বিমূর্ত বা কাল্পনিক ধারণা নিয়ে ভাবনা এবং সক্রিয় বাস্তবায়ন; যেখানে শেখার প্রক্রিয়া চলাকালীন প্রতিটি পরিস্থিতিতে এই চক্রটি চলতে থাকে। অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিখন কৌশল থেকে শিক্ষার্থী, শিক্ষক এবং সমাজ ও রাষ্ট্র উপকৃত হয়। এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা বাস্তব সমস্যা সমাধানে শিক্ষাকে প্রয়োগ করার সুযোগ পায়। শিক্ষার্থীরা পুস্তকের জ্ঞানকে বাস্তবে কাজে লাগাতে উৎসাহিত হয় কারণ তারা বাস্তব পরিস্থিতিতে শেখার বিষয়ে বেশি উৎসাহী হয়। এই পদ্ধতিতে যেহেতু শিক্ষার্থীদের নিজেদেরকে বিভিন্নি কর্মের মধ্য দিয়ে যেতে হয়, সেহেতু তারা অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য একটি ভালো সুযোগ পায়। শিক্ষার্থীদের  দলগত মনোভাব উন্নত হয় কারণ অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিক্ষায় প্রায়শই  একটি দলের সদস্য হিসেবে তাদের কাজ করতে হয়। এ শিখন পদ্ধতিতে প্রকৃত, অর্থপূর্ণ বাস্তব অনুশীলনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের কর্মক্ষেত্রের জন্য প্রস্তুত করার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে এবং শিক্ষার্থীরা অভিজ্ঞ ব্যক্তি এবং সম্ভাব্য নিয়োগকারীদের সাথে মিথষ্ক্রিয়ার সুযোগ পায় কারণ খণ্ডকালীন বা ইন্টার্ন হিসেবে কাজ করাকে  অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিক্ষা উৎসাহিত করে। 

অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিক্ষা একটি ব্যাপক বিষয় যার মধ্যে সমবায়শিক্ষা, সেবাশিক্ষা, ক্লিনিক্যাল শিক্ষা, ছাত্রশিখণ অনুশীলন ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত। এ শিক্ষা ব্যবস্থায় খণ্ডকালীন কাজকে কোর্সের অংশ হিসেবে গণ্য করা হয়। সাধারণত, এই কাজ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে কর্মক্ষেত্রের সাথে শিক্ষার্থীদের সংযুক্ত করে। সাধারণ খন্ডকালীন কাজ শেষ হওয়ার পরে, শিক্ষার্থীরা কাজের উপর গঠনমূলক একটি প্রতিবেদন লিখে যা তাদের শিখনকে স্থায়ী করতে সহায়তা করে। সেবাশিক্ষা বা সার্ভিস লার্নিং (Service Learning) অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিক্ষার একটি ধারণা যা নাগরিক দায়িত্বের একটি অংশ। সেবাশিক্ষা সংক্রান্ত কোর্সে অংশ হিসেবে সমাজের প্রয়োজনের উপর ভিত্তি করে শিক্ষার্থীদের কিছু সামাজিক কর্ম সম্পাদন করতে হয়। এভাবে শিক্ষার্থীরা সমাজকে আরও  ভালোভাবে বোঝে এবং  সমাজের প্রতি তথা রাষ্ট্রের প্রতি দায়িত্বশীল হয় এবং শিক্ষার্থীরা সমাজে বসবাসরত মানুষের সুখ-দুঃখ ও সামগ্রিক আবেগের সাথে পরিচিত হয়; এভাবে শিক্ষার্থীরা সমাজের সদস্যদের প্রতি সহমর্মী হতে পারে। 

তারপর আসে ক্লিনিক্যাল শিক্ষা যার অপর নাম চিকিৎসা শিক্ষা। ইন্টার্নশিপ  হলো মেডিকেল শিক্ষার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ যেখানে শিক্ষার্থীরা শ্রেণিকক্ষে শেখা বিষয়গুলো অনুশীলন করে। শুধু চিকিৎসক নয়, নার্সদেরও ইন্টার্নশিপ করতে হয়। ইন্টার্নশিপের মাধ্যমে তারা যেমন দক্ষতা অর্জন করে তেমনি কাজের প্রতিও মানুষের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়। শিক্ষার্থীদের শিক্ষাদান অনুশীলন শিক্ষক প্রশিক্ষণ বা শিক্ষক-শিক্ষা-এর সাথে সম্পর্কিত। ছাত্র-শিখনের অপর নাম টিচিং প্র্যাকটিস (টিপি)। ব্যাচেলর অব এডুকেশন (বি.এড.) প্রোগ্রামের অংশ হিসেবে শিক্ষার্থীদের স্কুলে পাঠদানের অনুশীলন করতে হয়। তেমনিভাবে বিজ্ঞান শিক্ষায় প্রাকটিক্যাল অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিক্ষারই উৎকৃষ্ট উদাহরণ। বিজ্ঞানের মত ভাষা শিক্ষারও শোনা,বলা, পড়া এবং লেখার সক্রিয়  অংশগ্রহণের মাধ্যমে ভাষা ব্যবহারের অভিজ্ঞতা নিতে হয়। ভাষা ব্যবহার না করে কোন ভাষার দক্ষতা অর্জন করা কোনো ভাবে সম্ভব নয়। অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিক্ষা ব্যবস্থায় সকল শিক্ষাই কাজ করে অভিজ্ঞতার মাধ্যমে গ্রহণ করতে হয় যা বাস্তব জীবনে তা কাজে লাগে।

এখন প্রশ্ন হলো যে, অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিক্ষা কি বাংলাদেশ একেবারেই নতুন? বর্তমান পাঠ্যক্রমে (এনসিটিবি ২০১২) অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিক্ষার কোনো উপাদান আছে কি? সেগুলো কি সঠিক বাস্তবায়ন হচ্ছে? অথবা, যে বিষয়গুলো প্র্যাকটিক্যালি শেখার  দাবি রাখে সেগুলো কি সঠিক বাস্তবায়ন করা হচ্ছে? যদি না হয়, চ্যালেঞ্জগুলো কী?

উল্লেখিত প্রশ্নগুলোর উত্তরে বলা যেতে পারে যে, বর্তমান শিক্ষাক্রমেও বিভিন্ন বিষয়ে অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিক্ষার সুযোগ রয়েছে। যেমন: পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, জীববিজ্ঞান, ইংরেজি ইত্যাদি। আমি নিশ্চিত, পাঠক সবাই জানেন যে বিজ্ঞান বিষয়ে ব্যাবহারিক আছে। বিজ্ঞান বিষয়ে এই ব্যাবহারিক কাজগুলো অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিক্ষার একটি ভালো উদাহরণ। শিক্ষার্থীরা কি  পরীক্ষাগারে বা অন্য কোথাও পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে বিজ্ঞান শেখে? একইভাবে ১৯৯৫ এবং ২০১২ সালের ইংরেজি পাঠ্যক্রমে ইংরেজি ভাষার দক্ষতা অনুশীলনের বিধান রাখা হয়েছিল; পাঠ্যপুস্তকে  বলা (Speaking), শোনা (Listening), পড়া (Reading) এবং লেখার (Writing) বিভিন্ন সুযোগও রাখা আছে। যতদূর জানা যায়, বেশিরভাগ ইংরেজি শিক্ষক চারটি ভাষার দক্ষতা অনুশীলনে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ করার না। কেন শিক্ষার্থীরা ভাষা দক্ষতা অনুশীলন করছেন না? আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে, পাঠকগণ জানেন উল্লিখিত পাঠ্যপুস্তক বাস্তবায়নের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা কী ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছেন।

২০২৩ সাল থেকে আসন্ন অভিজ্ঞতাভিত্তিক পাঠ্যক্রম বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জগুলো কি বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে? উল্লিখিত প্রশ্নগুলির উপযুক্ত উত্তর খোঁজা গুরুত্বপূর্ণ। কারণ আমরা যদি চ্যালেঞ্জগুলি জানি, তাহলে আমরা সম্ভাব্য বাধাগুলো দূর করতে পারব।

এখানে আরেকটু বড়ো প্রশ্ন হলো, শিক্ষার্থীদের  সব বিষয়ে সরাসরি অভিজ্ঞতা নেওয়ার কি সম্ভব? উত্তর যদি না হয়, তাহলে এসব বিষয়ে শিক্ষার্থীরা কিভাবে শিখন অভিজ্ঞতা অর্জন করবে? বিজ্ঞান এবং গণিত বিষয়ে শিক্ষার্থীদের ক্লাস রুমের ভেতরে এবং বাইরে অভিজ্ঞতা অর্জনের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। বিজ্ঞান পরীক্ষাগুলি অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে বা শিক্ষার্থীদের প্রকৃতির কাছে নিয়ে যাওয়া যেতে পারে। গণিত ক্লাসে, শিক্ষার্থীর টেবিল, বেঞ্চ, বই, শ্রেণিকক্ষের পৃষ্ঠতল পরিমাপ করতে এবং সেগুলো ক্ষেত্রফল বের করতে পারে। যাইহোক, ইতিহাস রাষ্ট্রবিজ্ঞান ইত্যাদি বর্ণনামূলক বিষয়গুলির ক্ষেত্রে কিভাবে অভিজ্ঞতা প্রদান করা যায়? উত্তরে  বলা যায় এক্ষেত্রে অভিনয় কৌশল বা রোল প্লেইং ভালো কাজ করতে পারে বা অভিজ্ঞতা প্রদানের জন্য ভিডিয়ো ক্লিপ ব্যবহার করা যেতে পারে। এগুলোর কোনোটিই পাওয়া না গেলে অভিজ্ঞতা সম্পন্ন ব্যক্তিরা ঘটনা বর্ণনা করতে পারেন। যদিও এগুলি নিম্নস্তরের অভিজ্ঞতা। তবে সরাসরি অভিজ্ঞতার সুযোগুলোকে সর্বদা অগ্রাধিকার দিতে হবে। 

উল্লেখিত বিষয়গুলো ছাড়াও শিক্ষার্থীদের অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ সৃষ্টি করা যেতে পারে। প্রতিটি শিক্ষার্থীর জন্য   ইন্টার্নশিপের সুযোগ সৃষ্টি করা যেতে পারে। এটি এক বা দুই মাসের জন্য হতে পারে। তাদের অবশ্যই তাদের পিতামাতার সাথে বা অন্য কোথাও কাজ করতে হবে যাতে সেই কাজগুলি কতটা কঠিন বা সহজ তা বুঝতে পারে। এটা করা গেলে তারা সকল কাজকেই সম্মান করবে। অভিজ্ঞতাভিত্তিক  শিক্ষার আরও ভালো বাস্তবায়নের জন্য, ক্লাসের রুটিন নমনীয় হওয়া প্রয়োজন। যদি একজন শিক্ষক  একটি নির্দিষ্ট বিষয় বোঝাতে শিক্ষার্থীদের পরিস্থিতিতে  নিয়ে শ্রেণিকক্ষের  বাইরে যান, তাহলে চল্লিশ বা পঞ্চাশ মিনিটের ক্লাস যথেষ্ট নাও হতে পারে। শিক্ষাকার্যক্রমে তত্ত্ব (Theory) এবং অনুশীলন (Practice) একসাথে যেতে হবে; এবং শিক্ষার্থীদের ব্যাবহারিক কার্যক্রমকে অগ্রাধিকারের সাথে মূল্যায়ন করতে হবে কারণ অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিক্ষায় জানার চেয়ে করা বা করতে পারা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এই পদ্ধতি বাস্তবায়নের জন্য, শিক্ষকদের অবশ্যই প্রশিক্ষিত, উদ্যোগী এবং সক্রিয় হতে হবে। অধিকন্তু শিক্ষার্থীদের প্রয়োজনীয় অভিজ্ঞতা দেওয়ার জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো কম্পিউটার, মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর এবং সিমুলেটরের মতো ইকুইপমেন্ট এর ব্যবস্থা থাকতে হবে যাতে শিক্ষার্থীদের প্রয়োজনীয় অভিজ্ঞতা প্রদান করা যায়।

শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও অভিভাকদের কাছে ধারণাটি নতুন। তাই কারিকুলাম কীভাবে বাস্তবায়িত হবে, সে বিষয়ে একটি পরিকল্পনা  থাকতে হবে; কে কোন কাজ করবে; কোন উপকরণের প্রয়োজন হবে এবং শিক্ষকগণ কোথা থেকে উপকরণগুলো পাবেন তা স্পষ্ট করতে হবে। আসন্ন পরিবর্তনের জন্য ছাত্র, শিক্ষক এবং অভিভাবক এবং অন্যান্য অংশীজনদের প্রস্তুত করার জন্য পরিকল্পনাটি  প্রচার করা প্রয়োজন। কর্তৃপক্ষ ইলেকট্রনিক এবং প্রিন্ট মিডিয়া ব্যবহার করে অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিক্ষার ধারণা ও মূল্যায়ন কিভাবে হবে তা প্রচার করতে  এবং শিক্ষার সম্ভাব্য পরিবর্তন সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট সকলকে সচেতন করতে পারেন। নতুন পাঠ্যক্রমের সফল বাস্তবায়নের জন্য মানসিক প্রস্তুতির জন্য তা অপরিহার্য।

যেহেতু অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিক্ষা একটি নতুন ধারণা, তাই বাস্তবায়নের জন্য এমন একটি কমিটি থাকা উচিত যারা ধারাবাহিকভাবে পর্যবেক্ষণ করবে পাঠ্যক্রমটি সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হচ্ছে কি না। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো শিক্ষার্থীদের কার্যক্রম রেকর্ড করার জন্য কোন পদ্ধতি অবলম্বন করবে তাও স্পষ্ট করতে  হবে। কারণ মূল্যায়নের ন্যায্যতা প্রমাণের জন্য অভিজ্ঞতার রেকর্ড সংরক্ষণের প্রয়োজন হবে।

একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে জানা যায়, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) ইতিমধ্যে শিক্ষক বাতায়ন-এর মাধ্যমে অনলাইনে শিক্ষক প্রশিক্ষণ শুরু করেছেন। শিগগিরই দেশব্যাপী শিক্ষকদের নিয়ে ফেস টু ফেস প্রশিক্ষণ কার্যক্রম শুরু করতে যাচ্ছে। শিক্ষকদের সাথে প্রশিক্ষণে, শিক্ষক সমিতির নেতৃবর্গ, বিভিন্ন স্তরের কিছু অভিভাবক,কিছু মিডিয়া কর্মীকে প্রশিক্ষণে অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। কারণ এই লোকসমষ্টি নতুন পাঠ্যক্রমের যথাযথ বাস্তবায়নের সাথে প্রদান করতে পারবেন। শিক্ষকগণ যখন নতুন পাঠ্যক্রম বাস্তবায়ন শুরু করবেন, তখন বাস্তবায়নে তত্ত্বাবধান এবং মেন্টরিং-এর জন্য একটি দল থাকবে প্রয়োজনে তারা শিক্ষকদের অনলাইনে অন্য কোনো উপায়ে সহায়তা প্রদান করবে। ব্লেন্ডেড (অনলাইন ও অন-ক্যাম্পাস) মোডে সকলকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার পরও অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিক্ষা নিয়ে শিক্ষক, শিক্ষার্থীরাও অভিভাবকদের  যেসকল প্রশ্ন থাকতে পারে সেগুলোর জবাবও একই সাথে দেওয়ার ব্যবস্থা থাকতে হবে।

একটি উন্নত বাংলাদেশ গড়ার জন্য আমাদের সকলের উচিত অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিক্ষাক্রম যথাযথ বাস্তবায়নের জন্য আন্তরিকভাবে কাজ করা। আমরা আশাবাদী যে, এ কারিকুলাম যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করা গেলে, সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গঠন ত্বরান্বিত হবে। 

শেয়ার করুন

মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার তথ্য সংরক্ষিত রাখুন

লেখকতথ্য

ড. রঞ্জিত পোদ্দার

সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ, ঢাকায় সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত আছেন। তিনি একাধারে শিক্ষক, শিক্ষক প্রশিক্ষক, শিক্ষা গবেষক এবং ইংরেজি দৈনিক পত্রিকার নিয়মিত প্রাবন্ধিক।

বিশেষ শর্তসাপেক্ষে এই ওয়েবসাইটটি সামাজিক কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ কিংবা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের নিকট বিক্রি করা হবে।

অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিক্ষার যুগে বাংলাদেশ

প্রকাশ: ০৩:২৩:০০ অপরাহ্ন, সোমবার, ৬ মার্চ ২০২৩

কর্মের মাধ্যমে শিখনকে অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিক্ষা বলা হয়। কর্ম ও অভিজ্ঞতার মাধ্যমে জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জন করলে তা দীর্ঘস্থায়ী হয়। শিক্ষার্থীরা বাস্তব অভিজ্ঞতা বা কর্মের মাধ্যমে না শিখলে, শিখন যথাযথ হয় না কারণ তারা তাদের অর্জিত জ্ঞানকে বহুলাংশেই দৈনন্দিন জীবনে প্রয়োগ করতে পারে না। যে শিক্ষা বাস্তব জীবনে কাজে লাগে না তাকে কখনো মানসম্মত  শিক্ষা বলা যায় না।

একজন আমেরিকান শিক্ষাবিদ ডেভিড কোলব দাবি করেছেন যে, যথাযথ জ্ঞান এবং দক্ষতা অর্জনের জন্য একজন শিক্ষার্থীকে অবশ্যই কাজের অভিজ্ঞতার মাধ্যদিয়ে যেতে হবে। 

যেহেতু তরুণ প্রজন্মকে আরো জ্ঞানী ও দক্ষ করে তোলার জন্য এই অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিক্ষাকে অধিক কার্যকর পদ্ধতি হিসেবে বিবেচনা করা হয়, সেহেতু বাংলাদেশ সরকার ২০২৩ শিক্ষাবর্ষ থেকে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে এ শিক্ষাব্যবস্থা চালু করতে যাচ্ছে। যদিও ২০২৩ সালে প্রাথমিকে প্রথম ও দ্বিতীয় এবং মাধ্যমিকের ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিক্ষাক্রম বাস্তবায়িত হতে যাচ্ছে, এটি ক্রমান্বয়ে অন্যান্য শ্রেণীতে বাস্তবায়ন করা হবে। আশা করা যায় যে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অভিজ্ঞতাভিত্তিক পাঠ্যক্রম বাস্তবায়িত হলে, শিক্ষার্থীরা সঠিক জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জন করবে এবং তারা সমাজে সচেতনভাবে সকলের সাথে মিলেমিশে কাজ করতে পারবে এবং কর্মক্ষেত্রে আরও ভালো কর্ম সম্পাদনে সক্ষম হবে। কারণ অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিক্ষায় বড় একটি সময় জুড়ে হযরত সদস্যদের সাথে কাজ করতে হয়। 

ডেভিড কোলব বিশ্বাস করতেন যে, জ্ঞান অর্জন ও পুনর্গঠন হয় অভিজ্ঞতার মাধ্যমে। তিনি জ্যাঁ পিয়াঁজে (১৮৯৬-১৯৮০), জন ডিউই (১৮৫৯-১৯৫২) এবং কার্ট লিউইন (১৮৯০-১৯৪৭)-এর শিক্ষা দর্শনের মাধ্যমে প্রভাবিত হয়ে তত্ত্বটি প্রদান করেছেন। পিয়াঁজের মতে, শিক্ষা হলো পরিবেশগত উদ্দীপনার সাথে অভিযোজনের একটি প্রক্রিয়া এবং এই প্রক্রিয়ায় শিক্ষার্থীরা নতুন পরিস্থিতিতে একটি নতুন সমস্যা সমাধানের জন্য বারবার পূর্ববর্তী জ্ঞান প্রয়োগ করে থাকে। জন ডিউই এর মতে, জ্ঞান সামাজিকভাবে নির্মিত এবং শিশুরা পাঠ্যক্রমের চেয়ে তাদের সে অভিজ্ঞতাকে বেশি গুরুত্ব দেয়। যে অভিজ্ঞতা তারা কর্ম সম্পাদন ও সামাজিক মিথষ্ক্রিয়ার মাধ্যমে অর্জন করে। আবার, কার্ট লিউইন দাবি করেছেন যে, অভিজ্ঞতা অর্জন শেখার একটি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা নতুন অন্তর্দৃষ্টি তৈরি করে এবং কখনো কখনো পুরনো চিন্তার সংস্কার করে। ডেবিড কোলব ১৯৮৪ সালে এখন বিষয়ে বলেন, কার্যকরী শিক্ষা তখনই ঘটে যখন একজন শিক্ষার্থী চারটি ধাপের মধ্য দিয়ে যায়, যথা: সুনির্দিষ্ট অভিজ্ঞতা অর্জন, অভিজ্ঞতার প্রতিফলন চর্চা, বিমূর্ত বা কাল্পনিক ধারণা নিয়ে ভাবনা এবং সক্রিয় বাস্তবায়ন; যেখানে শেখার প্রক্রিয়া চলাকালীন প্রতিটি পরিস্থিতিতে এই চক্রটি চলতে থাকে। অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিখন কৌশল থেকে শিক্ষার্থী, শিক্ষক এবং সমাজ ও রাষ্ট্র উপকৃত হয়। এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা বাস্তব সমস্যা সমাধানে শিক্ষাকে প্রয়োগ করার সুযোগ পায়। শিক্ষার্থীরা পুস্তকের জ্ঞানকে বাস্তবে কাজে লাগাতে উৎসাহিত হয় কারণ তারা বাস্তব পরিস্থিতিতে শেখার বিষয়ে বেশি উৎসাহী হয়। এই পদ্ধতিতে যেহেতু শিক্ষার্থীদের নিজেদেরকে বিভিন্নি কর্মের মধ্য দিয়ে যেতে হয়, সেহেতু তারা অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য একটি ভালো সুযোগ পায়। শিক্ষার্থীদের  দলগত মনোভাব উন্নত হয় কারণ অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিক্ষায় প্রায়শই  একটি দলের সদস্য হিসেবে তাদের কাজ করতে হয়। এ শিখন পদ্ধতিতে প্রকৃত, অর্থপূর্ণ বাস্তব অনুশীলনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের কর্মক্ষেত্রের জন্য প্রস্তুত করার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে এবং শিক্ষার্থীরা অভিজ্ঞ ব্যক্তি এবং সম্ভাব্য নিয়োগকারীদের সাথে মিথষ্ক্রিয়ার সুযোগ পায় কারণ খণ্ডকালীন বা ইন্টার্ন হিসেবে কাজ করাকে  অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিক্ষা উৎসাহিত করে। 

অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিক্ষা একটি ব্যাপক বিষয় যার মধ্যে সমবায়শিক্ষা, সেবাশিক্ষা, ক্লিনিক্যাল শিক্ষা, ছাত্রশিখণ অনুশীলন ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত। এ শিক্ষা ব্যবস্থায় খণ্ডকালীন কাজকে কোর্সের অংশ হিসেবে গণ্য করা হয়। সাধারণত, এই কাজ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে কর্মক্ষেত্রের সাথে শিক্ষার্থীদের সংযুক্ত করে। সাধারণ খন্ডকালীন কাজ শেষ হওয়ার পরে, শিক্ষার্থীরা কাজের উপর গঠনমূলক একটি প্রতিবেদন লিখে যা তাদের শিখনকে স্থায়ী করতে সহায়তা করে। সেবাশিক্ষা বা সার্ভিস লার্নিং (Service Learning) অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিক্ষার একটি ধারণা যা নাগরিক দায়িত্বের একটি অংশ। সেবাশিক্ষা সংক্রান্ত কোর্সে অংশ হিসেবে সমাজের প্রয়োজনের উপর ভিত্তি করে শিক্ষার্থীদের কিছু সামাজিক কর্ম সম্পাদন করতে হয়। এভাবে শিক্ষার্থীরা সমাজকে আরও  ভালোভাবে বোঝে এবং  সমাজের প্রতি তথা রাষ্ট্রের প্রতি দায়িত্বশীল হয় এবং শিক্ষার্থীরা সমাজে বসবাসরত মানুষের সুখ-দুঃখ ও সামগ্রিক আবেগের সাথে পরিচিত হয়; এভাবে শিক্ষার্থীরা সমাজের সদস্যদের প্রতি সহমর্মী হতে পারে। 

তারপর আসে ক্লিনিক্যাল শিক্ষা যার অপর নাম চিকিৎসা শিক্ষা। ইন্টার্নশিপ  হলো মেডিকেল শিক্ষার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ যেখানে শিক্ষার্থীরা শ্রেণিকক্ষে শেখা বিষয়গুলো অনুশীলন করে। শুধু চিকিৎসক নয়, নার্সদেরও ইন্টার্নশিপ করতে হয়। ইন্টার্নশিপের মাধ্যমে তারা যেমন দক্ষতা অর্জন করে তেমনি কাজের প্রতিও মানুষের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়। শিক্ষার্থীদের শিক্ষাদান অনুশীলন শিক্ষক প্রশিক্ষণ বা শিক্ষক-শিক্ষা-এর সাথে সম্পর্কিত। ছাত্র-শিখনের অপর নাম টিচিং প্র্যাকটিস (টিপি)। ব্যাচেলর অব এডুকেশন (বি.এড.) প্রোগ্রামের অংশ হিসেবে শিক্ষার্থীদের স্কুলে পাঠদানের অনুশীলন করতে হয়। তেমনিভাবে বিজ্ঞান শিক্ষায় প্রাকটিক্যাল অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিক্ষারই উৎকৃষ্ট উদাহরণ। বিজ্ঞানের মত ভাষা শিক্ষারও শোনা,বলা, পড়া এবং লেখার সক্রিয়  অংশগ্রহণের মাধ্যমে ভাষা ব্যবহারের অভিজ্ঞতা নিতে হয়। ভাষা ব্যবহার না করে কোন ভাষার দক্ষতা অর্জন করা কোনো ভাবে সম্ভব নয়। অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিক্ষা ব্যবস্থায় সকল শিক্ষাই কাজ করে অভিজ্ঞতার মাধ্যমে গ্রহণ করতে হয় যা বাস্তব জীবনে তা কাজে লাগে।

এখন প্রশ্ন হলো যে, অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিক্ষা কি বাংলাদেশ একেবারেই নতুন? বর্তমান পাঠ্যক্রমে (এনসিটিবি ২০১২) অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিক্ষার কোনো উপাদান আছে কি? সেগুলো কি সঠিক বাস্তবায়ন হচ্ছে? অথবা, যে বিষয়গুলো প্র্যাকটিক্যালি শেখার  দাবি রাখে সেগুলো কি সঠিক বাস্তবায়ন করা হচ্ছে? যদি না হয়, চ্যালেঞ্জগুলো কী?

উল্লেখিত প্রশ্নগুলোর উত্তরে বলা যেতে পারে যে, বর্তমান শিক্ষাক্রমেও বিভিন্ন বিষয়ে অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিক্ষার সুযোগ রয়েছে। যেমন: পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, জীববিজ্ঞান, ইংরেজি ইত্যাদি। আমি নিশ্চিত, পাঠক সবাই জানেন যে বিজ্ঞান বিষয়ে ব্যাবহারিক আছে। বিজ্ঞান বিষয়ে এই ব্যাবহারিক কাজগুলো অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিক্ষার একটি ভালো উদাহরণ। শিক্ষার্থীরা কি  পরীক্ষাগারে বা অন্য কোথাও পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে বিজ্ঞান শেখে? একইভাবে ১৯৯৫ এবং ২০১২ সালের ইংরেজি পাঠ্যক্রমে ইংরেজি ভাষার দক্ষতা অনুশীলনের বিধান রাখা হয়েছিল; পাঠ্যপুস্তকে  বলা (Speaking), শোনা (Listening), পড়া (Reading) এবং লেখার (Writing) বিভিন্ন সুযোগও রাখা আছে। যতদূর জানা যায়, বেশিরভাগ ইংরেজি শিক্ষক চারটি ভাষার দক্ষতা অনুশীলনে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ করার না। কেন শিক্ষার্থীরা ভাষা দক্ষতা অনুশীলন করছেন না? আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে, পাঠকগণ জানেন উল্লিখিত পাঠ্যপুস্তক বাস্তবায়নের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা কী ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছেন।

২০২৩ সাল থেকে আসন্ন অভিজ্ঞতাভিত্তিক পাঠ্যক্রম বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জগুলো কি বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে? উল্লিখিত প্রশ্নগুলির উপযুক্ত উত্তর খোঁজা গুরুত্বপূর্ণ। কারণ আমরা যদি চ্যালেঞ্জগুলি জানি, তাহলে আমরা সম্ভাব্য বাধাগুলো দূর করতে পারব।

এখানে আরেকটু বড়ো প্রশ্ন হলো, শিক্ষার্থীদের  সব বিষয়ে সরাসরি অভিজ্ঞতা নেওয়ার কি সম্ভব? উত্তর যদি না হয়, তাহলে এসব বিষয়ে শিক্ষার্থীরা কিভাবে শিখন অভিজ্ঞতা অর্জন করবে? বিজ্ঞান এবং গণিত বিষয়ে শিক্ষার্থীদের ক্লাস রুমের ভেতরে এবং বাইরে অভিজ্ঞতা অর্জনের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। বিজ্ঞান পরীক্ষাগুলি অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে বা শিক্ষার্থীদের প্রকৃতির কাছে নিয়ে যাওয়া যেতে পারে। গণিত ক্লাসে, শিক্ষার্থীর টেবিল, বেঞ্চ, বই, শ্রেণিকক্ষের পৃষ্ঠতল পরিমাপ করতে এবং সেগুলো ক্ষেত্রফল বের করতে পারে। যাইহোক, ইতিহাস রাষ্ট্রবিজ্ঞান ইত্যাদি বর্ণনামূলক বিষয়গুলির ক্ষেত্রে কিভাবে অভিজ্ঞতা প্রদান করা যায়? উত্তরে  বলা যায় এক্ষেত্রে অভিনয় কৌশল বা রোল প্লেইং ভালো কাজ করতে পারে বা অভিজ্ঞতা প্রদানের জন্য ভিডিয়ো ক্লিপ ব্যবহার করা যেতে পারে। এগুলোর কোনোটিই পাওয়া না গেলে অভিজ্ঞতা সম্পন্ন ব্যক্তিরা ঘটনা বর্ণনা করতে পারেন। যদিও এগুলি নিম্নস্তরের অভিজ্ঞতা। তবে সরাসরি অভিজ্ঞতার সুযোগুলোকে সর্বদা অগ্রাধিকার দিতে হবে। 

উল্লেখিত বিষয়গুলো ছাড়াও শিক্ষার্থীদের অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ সৃষ্টি করা যেতে পারে। প্রতিটি শিক্ষার্থীর জন্য   ইন্টার্নশিপের সুযোগ সৃষ্টি করা যেতে পারে। এটি এক বা দুই মাসের জন্য হতে পারে। তাদের অবশ্যই তাদের পিতামাতার সাথে বা অন্য কোথাও কাজ করতে হবে যাতে সেই কাজগুলি কতটা কঠিন বা সহজ তা বুঝতে পারে। এটা করা গেলে তারা সকল কাজকেই সম্মান করবে। অভিজ্ঞতাভিত্তিক  শিক্ষার আরও ভালো বাস্তবায়নের জন্য, ক্লাসের রুটিন নমনীয় হওয়া প্রয়োজন। যদি একজন শিক্ষক  একটি নির্দিষ্ট বিষয় বোঝাতে শিক্ষার্থীদের পরিস্থিতিতে  নিয়ে শ্রেণিকক্ষের  বাইরে যান, তাহলে চল্লিশ বা পঞ্চাশ মিনিটের ক্লাস যথেষ্ট নাও হতে পারে। শিক্ষাকার্যক্রমে তত্ত্ব (Theory) এবং অনুশীলন (Practice) একসাথে যেতে হবে; এবং শিক্ষার্থীদের ব্যাবহারিক কার্যক্রমকে অগ্রাধিকারের সাথে মূল্যায়ন করতে হবে কারণ অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিক্ষায় জানার চেয়ে করা বা করতে পারা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এই পদ্ধতি বাস্তবায়নের জন্য, শিক্ষকদের অবশ্যই প্রশিক্ষিত, উদ্যোগী এবং সক্রিয় হতে হবে। অধিকন্তু শিক্ষার্থীদের প্রয়োজনীয় অভিজ্ঞতা দেওয়ার জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো কম্পিউটার, মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর এবং সিমুলেটরের মতো ইকুইপমেন্ট এর ব্যবস্থা থাকতে হবে যাতে শিক্ষার্থীদের প্রয়োজনীয় অভিজ্ঞতা প্রদান করা যায়।

শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও অভিভাকদের কাছে ধারণাটি নতুন। তাই কারিকুলাম কীভাবে বাস্তবায়িত হবে, সে বিষয়ে একটি পরিকল্পনা  থাকতে হবে; কে কোন কাজ করবে; কোন উপকরণের প্রয়োজন হবে এবং শিক্ষকগণ কোথা থেকে উপকরণগুলো পাবেন তা স্পষ্ট করতে হবে। আসন্ন পরিবর্তনের জন্য ছাত্র, শিক্ষক এবং অভিভাবক এবং অন্যান্য অংশীজনদের প্রস্তুত করার জন্য পরিকল্পনাটি  প্রচার করা প্রয়োজন। কর্তৃপক্ষ ইলেকট্রনিক এবং প্রিন্ট মিডিয়া ব্যবহার করে অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিক্ষার ধারণা ও মূল্যায়ন কিভাবে হবে তা প্রচার করতে  এবং শিক্ষার সম্ভাব্য পরিবর্তন সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট সকলকে সচেতন করতে পারেন। নতুন পাঠ্যক্রমের সফল বাস্তবায়নের জন্য মানসিক প্রস্তুতির জন্য তা অপরিহার্য।

যেহেতু অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিক্ষা একটি নতুন ধারণা, তাই বাস্তবায়নের জন্য এমন একটি কমিটি থাকা উচিত যারা ধারাবাহিকভাবে পর্যবেক্ষণ করবে পাঠ্যক্রমটি সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হচ্ছে কি না। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো শিক্ষার্থীদের কার্যক্রম রেকর্ড করার জন্য কোন পদ্ধতি অবলম্বন করবে তাও স্পষ্ট করতে  হবে। কারণ মূল্যায়নের ন্যায্যতা প্রমাণের জন্য অভিজ্ঞতার রেকর্ড সংরক্ষণের প্রয়োজন হবে।

একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে জানা যায়, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) ইতিমধ্যে শিক্ষক বাতায়ন-এর মাধ্যমে অনলাইনে শিক্ষক প্রশিক্ষণ শুরু করেছেন। শিগগিরই দেশব্যাপী শিক্ষকদের নিয়ে ফেস টু ফেস প্রশিক্ষণ কার্যক্রম শুরু করতে যাচ্ছে। শিক্ষকদের সাথে প্রশিক্ষণে, শিক্ষক সমিতির নেতৃবর্গ, বিভিন্ন স্তরের কিছু অভিভাবক,কিছু মিডিয়া কর্মীকে প্রশিক্ষণে অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। কারণ এই লোকসমষ্টি নতুন পাঠ্যক্রমের যথাযথ বাস্তবায়নের সাথে প্রদান করতে পারবেন। শিক্ষকগণ যখন নতুন পাঠ্যক্রম বাস্তবায়ন শুরু করবেন, তখন বাস্তবায়নে তত্ত্বাবধান এবং মেন্টরিং-এর জন্য একটি দল থাকবে প্রয়োজনে তারা শিক্ষকদের অনলাইনে অন্য কোনো উপায়ে সহায়তা প্রদান করবে। ব্লেন্ডেড (অনলাইন ও অন-ক্যাম্পাস) মোডে সকলকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার পরও অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিক্ষা নিয়ে শিক্ষক, শিক্ষার্থীরাও অভিভাবকদের  যেসকল প্রশ্ন থাকতে পারে সেগুলোর জবাবও একই সাথে দেওয়ার ব্যবস্থা থাকতে হবে।

একটি উন্নত বাংলাদেশ গড়ার জন্য আমাদের সকলের উচিত অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিক্ষাক্রম যথাযথ বাস্তবায়নের জন্য আন্তরিকভাবে কাজ করা। আমরা আশাবাদী যে, এ কারিকুলাম যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করা গেলে, সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গঠন ত্বরান্বিত হবে।