আলঝেইমার রোগ— গবেষণায় বিগত দুই দশকের অসামান্য অগ্রগতি
- প্রকাশ: ০৭:১৮:৫২ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৫ মে ২০২৩
- / ৬৭৫ বার পড়া হয়েছে
আলঝেইমার রোগটি শুরু হয় স্মৃতি হ্রাস বা ভুলে যাওয়া দিয়ে। ধীরে ধীরে রোগী সম্পূর্ণ স্মৃতিভ্রংশ হতে পারে। মস্তিষ্কে স্মৃতি সংরক্ষণের দায়িত্ব হলো মূলতঃ হিপোক্যাম্পাস (hippocampus) ও এন্টোরহিনাল কর্টেক্সের।
আলঝেইমার রোগ এক ধরনের স্নায়ুঅবক্ষয়জনিত রোগ যা ষাটোর্ধ বয়সী ব্যক্তিদের স্মৃতিভ্রংশের অন্যতম কারণ। ৬৫ বছরের বেশি বয়সী ১০ জনের মধ্যে একজন এবং অশীতিপর প্রবীণদের প্রায় এক তৃতীয়াংশ মানুষের এই রোগ দেখা যায়। ২০১৯-২০ সালে বাংলাদেশের আট বিভাগে পরিচালিত একটি জরিপ অনুযায়ী দেশে ১১ লাখ মানুষ ডিমেনশিয়া বা স্মৃতিভ্রংশে ভুগছেন (যুগান্তর, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২২)। সামগ্রিক বা আংশিক বুদ্ধি, স্মৃতি ও ব্যক্তিত্ব লোপ আলঝেইমার রোগের প্রধান লক্ষণীয় উপসর্গ। অনেকের বাল্যস্মৃতি ঠিক আছে, অথচ স্বল্পস্থায়ী স্মৃতিগুলির বিস্মরণ হয়। এটি বিজ্ঞানের ভাষায় ডিমেনশিয়া হিসেবেও পরিচিত। মানুষের মস্তিষ্ক খুব জটিল ও বিস্ময়কর একটি অঙ্গ, যেখানে নিউরোন ও স্নায়ুসহায়ক গ্লিয়া কোষ নিয়ে প্রায় ১০০ বিলিয়ন কোষ থাকে। প্রকৃতপক্ষে, গ্লিয়াল কোষ নিউরনের থেকে সংখ্যায় প্রায় ১০গুণ বেশি। এই কোষগুলি, যেমন মাইক্রোগ্লিয়া, অ্যাস্ট্রোসাইট এবং অলিগোডেনড্রোসাইট নিউরোনগুলিকে ঘিরে থাকে এবং তাদের কার্যকারিতা এবং স্বাস্থ্যকে পরিপোষণ করে। বিশেষকরে, মাইক্রোগ্লিয়া নিউরোনকে শারীরিক এবং রাসায়নিক ক্ষতি থেকে রক্ষা করে এবং মস্তিষ্ক থেকে ক্ষতিকারক পদার্থ এবং কোষীয় ধ্বংসাবশেষ অপসারণ করে। নিউরোন কোষগুলি বৈদ্যুতিক এবং রাসায়নিক সংকেতের বিস্তৃত নেটওয়ার্কের মাধ্যমে তথ্য সংবহন করে মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশের মধ্যে এবং মস্তিষ্ক থেকে শরীরের পেশি এবং অঙ্গগুলিতে। আলঝেইমার রোগ নিউরোনগুলির মধ্যে এই সেতুবন্ধনকে ব্যাহত করে, যার ফলে তাদের কার্যকারিতা নষ্ট হয় এবং কোষের মৃত্যু হয়। প্রসঙ্গতঃ, একজন জার্মান মনোচিকিৎসক অ্যালোইস আলঝেইমার (১৮৬৪-১৯১৫) সর্বপ্রথম এ রোগটির বর্ণনা দেন, তাই তাঁর নামানুসারেই এ রোগের নামকরণ। কিন্তু, নামকরণের শতবর্ষপূর্তি হলেও মাত্র দুই দশকের বিগতশ্রম আবিষ্কার করেছে এই রোগটির অন্তর্নিহিত জিনগত ও রাসায়নিক রহস্য, অসাধারণ সফলতা এসেছে চিকিৎসা ক্ষেত্রেও। সে আলোকেই, আমার এ প্রবন্ধে তুলে ধরেছি আলঝেইমার রোগ-সম্পর্কিত সাম্প্রতিক কিছু উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি।
মস্তিষ্কের যেসব অঞ্চল সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত
মস্তিষ্কের টেম্পোরাল লোব, যা নিওকর্টেক্স নামেও পরিচিত, আমাদের মস্তিষ্কের সেরেব্রাল কর্টেক্সের প্রায় ২০% জুড়ে থাকে। এই লোবটি আমাদের আবেগ, আমাদের ইন্দ্রিয়গুলি থেকে তথ্য আহরণ ও প্রক্রিয়াকরণ, স্মৃতি সংরক্ষণ এবং পুনরুদ্ধার, এবং ভাষা বোঝার ক্ষেত্রে ভূমিকা পালন করে। টেম্পোরাল লোবে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য অংশ রয়েছে, যা আলঝেইমার রোগে ধীরে ধীরে অবক্ষয়প্রাপ্ত হয় (ছবি দেখুন):
১. এন্টোরহিনাল (entorhinal) কর্টেক্স: আলঝেইমার রোগটি শুরু হয় স্মৃতি হ্রাস বা ভুলে যাওয়া দিয়ে। ধীরে ধীরে রোগী সম্পূর্ণ স্মৃতিভ্রংশ হতে পারে। মস্তিষ্কে স্মৃতি সংরক্ষণের দায়িত্ব হলো মূলতঃ হিপোক্যাম্পাস (hippocampus) ও এন্টোরহিনাল কর্টেক্সের। হিপোক্যাম্পাস-সংলগ্ন এন্টোরহিনাল কর্টেক্স-টি মস্তিষ্কের মধ্য টেম্পোরাল লোবে অবস্থিত, যার কাজগুলির মধ্যে রয়েছে স্মৃতি প্রক্রিয়াকরণ, নেভিগেশন এবং সময়ের উপলব্ধির জন্য একটি বিস্তৃত নেটওয়ার্ক সৃষ্টি করা। হিপোক্যাম্পাসে তথ্য গ্রহণ করা ও মস্তিষ্কের বাকি অংশে তথ্য পাঠানো উভয় ঘটে থাকে এন্টোরহিনাল কর্টেক্সের মাধ্যমে। এটি হিপোক্যাম্পাস-সহ মস্তিষ্কের অন্যান্য অংশের সাথে একটি তথ্যকেন্দ্রিক কেন্দ্রস্থল হিসাবে কাজ করে। এটি প্রভাব বিস্তার করে ভাষা, যুক্তি এবং সামাজিক আচরণের জন্য দায়ী সেরিব্রাল কর্টেক্সের অঞ্চলগুলিতে। এন্টোরহিনাল কর্টেক্সে রয়েছে গ্রিড (Grid)কোষ নামক এক ধরণের বিশেষ নিউরোন, যা মানব মস্তিষ্কে ও অন্যান্য প্রাণিদের মস্তিষ্কেও “গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম” বা GPS হিসেবে কাজ করে। মস্তিষ্কের এটি-ই হলো প্রথম এলাকা যা আলঝেইমার রোগে আক্রান্ত হয়। তাই, এই এলাকাটি নিয়ে গবেষণাও হয়েছে ঢের, অর্জন হয়েছে বিজ্ঞানীদের নোবেল পুরস্কার।
২. হিপোক্যাম্পাস: এটি কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ। মস্তিস্কের এই অংশটিতে ছয় স্তরে নিউরোনগুলি বিস্তৃত, যার পরতে পরতে লুকিয়ে আছে বিজ্ঞান, লুকিয়ে আছে জীবনবোধ। মানুষসহ অন্যান্য স্তন্যপায়ী প্রাণিদের মস্তিষ্কের দুই পাশে একটি করে হিপোক্যাম্পাস রয়েছে। মস্তিষ্কের এই অংশটিকে বলা হয় “মেমরি লাইব্রেরি”। এখানে আমাদের সমস্ত স্মৃতি সৃষ্টি হয় ও সংরক্ষিত থাকে। একটি অনুঘটক হিসাবে হিপোক্যাম্পাস স্বল্পস্থায়ী স্মৃতির তথ্যসমূহকে একত্রিত করে দীর্ঘস্থায়ী স্মৃতিতে রূপান্তর করে এবং সেগুলি সেখানে ক্ষণকালীন সংরক্ষিত থাকলেও দীর্ঘমেয়াদী স্মৃতি সংরক্ষিত থাকে মস্তিষ্কের অন্য স্থানে, বিশেষকরে নিওকর্টেক্সে প্রিয়ন-সাদৃশ (prion-like) CPEB প্রোটিন ও অন্যান্য প্রোটিনের মাধ্যমে। বিশ্লেষণমূলক স্মৃতি ছাড়াও, হিপোক্যাম্পাস তার স্মৃতিতে ধরে রাখে স্থান সম্পর্কিত বা ভ্রমণ-সম্পর্কিত (ন্যাভিগেশনাল) স্মৃতি। হিপোক্যাম্পাস ও এন্টোরহিনাল কর্টেক্স হচ্ছে আমাদের পথসারথি বা অবস্থান-নির্ণয়কারী অঞ্চল, যা যথাক্রমে ধারণ করে বিশেষ ধরণের কিছু স্নায়ুকোষ- প্লেস (place) এবং গ্রিড (grid) কোষ। অঞ্চলদ্বয়ের বিশেষায়িত এই কোষগুলির নেটওয়ার্ক আমাদের পরিবেশের একটি অভ্যন্তরীণ ‘স্নায়বিক মানচিত্র’ তৈরি করে যা আমাদের এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় পথ খুঁজে পেতে সহায়ক হয়, যেন এই কোষগুলি সেল-ফোন বা গাড়িতে থাকা GPS-র সমতুল্য। প্রকৃতপক্ষেই প্রাণিদের ও আমাদের মস্তিষ্কে অবস্থান করে জৈবিক জিপিএস যার আবিষ্কার বিজ্ঞানী জন ও’কিফ, মে-ব্রিট মোসার এবং এডভার্ড মোসার-কে এনে দিয়েছে ফিজিওলজি ও মেডিসিন শাখায় (২০১৪ সালে) নোবেল পুরস্কার। পথ খোঁজার সাথে জড়িত মস্তিষ্কের অঞ্চলগুলি নতুন স্মৃতি গঠনের সাথেও ঘনিষ্ঠভাবে সংযুক্ত। যখন এই নার্ভিয় (neural)-নেটওয়ার্ক ক্ষতিগ্রস্ত বা অকার্যকর হয়ে যায়, তখন ওই কোষগুলো পথ খুঁজে পেতে তাদের সক্ষমতা হারায়, যেমনটি আলঝেইমার রোগে আক্রান্ত রোগীদের ক্ষেত্রে দেখা যায়।
৩. অ্যামিগডালা (Amygdala): মস্তিষ্কের এই অংশটি ভয়, উদ্বেগ এবং আবেগমুহূর্ত স্মৃতিগুলোকে পরিচালনা করে। সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতাও রয়েছে অ্যামিগডালা-য় সজ্জিত স্নায়ুকোষগুলির। আলঝেইমার রোগে, অ্যামিগডালা সাধারণত হিপোক্যাম্পাসের চেয়ে পরে প্রভাবিত হয়। তাই এই রোগে প্রাথমিকভাবে আক্রান্ত ব্যক্তি প্রায়শই তাদের অতীত আবেগমুহূর্ত ঘটনাগুলি স্মরণ করতে পারে, যদিও তারা স্বল্পমেয়াদী স্মৃতি মনে রাখতে পারে না। তবে অ্যামিগডালার কোষগুলি ক্ষতিগ্রস্ত হলে স্মৃতি প্রক্রিয়াকরণ, মানসিক প্রতিক্রিয়া এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হতে পারে।
৪. টেম্পোরাল লোবের আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল হচ্ছে ফিউজিফর্ম জাইরাস (fusiform gyrus)। বিশেষভাবে, এই অঞ্চলটি মুখোবয়ব শনাক্তের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। এটি মস্তিষ্কের দৃষ্টির সঙ্গে সংযুক্ত অক্সিপিটাল (occipital) লোবের ভিজ্যুয়াল প্রসেসিং সেন্টারের সাথে টেম্পোরাল লোবের মেমরি স্টোরেজের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ যোগাযোগ স্থাপন করে। অর্থাৎ আমরা যা প্রতিনিয়ত দেখি তার দ্রুত বিশ্লেষণ এবং সঞ্চিত স্মৃতির সাথে তা তুলনা করা হচ্ছে এই অঞ্চলের প্রধান কাজ। হিপোক্যাম্পাস ও এন্টোরহিনাল কর্টেক্স অঞ্চলগুলির অবক্ষয়ের ন্যায় ফিউজিফর্ম জাইরাসের কোষগুলিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর কারণ হিসেবে কোষগুলির কিছু এপিজেনেটিক জিনের অস্বাভাবিক প্রকাশকে দায়ী করা হয়েছে।
আলঝেইমার রোগে রাসায়নিক-বার্তাবাহকের ভূমিকা
মস্তিষ্কের মধ্যে আমাদের সংবেদ উদ্দীপনা বয়ে নিয়ে যায় “রাসায়নিক বার্তাবাহক” বা নিউরোট্রান্সমিটার, যারা এক স্নায়ুকোষ থেকে অন্য স্নায়ুকোষে উদ্দীপনা পৌঁছে দেয়। তাদের কাজ হল আমাদের মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষগুলির মধ্যে বার্তা পাঠানো। স্মৃতিও একইভাবে এই স্নায়ুকোষের সরণি বেয়ে পৌঁছে যায় স্মৃতির আধার হিপোক্যাম্পাসে। স্মৃতিপ্রোটিন নামে খ্যাত অ্যাসিটিলকোলিন (acetylcholine, Ach)-সহ গ্লুটামেট, গামা-অ্যামিনো-বুটারিক অ্যাসিড (GABA), এবং ক্যাটেকোলামাইন (ডোপামিন, নর-এপিনেফ্রিন) নিউরোট্রান্সমিটারগুলি স্মৃতি-প্রক্রমের মূল খেলোয়াড়। কোষপৃষ্ঠের বিভিন্ন রিসেপ্টর প্রোটিনের সাথে বন্ধনের মাধ্যমে, গ্লুটামেট (glutamate) সফলভাবে এবং দ্রুততার সাথে স্নায়ুকোষের মধ্যে স্মৃতিজড়িত বার্তাগুলি সংবহন করে। দেখা গিয়েছে, হিপোক্যাম্পাস অঞ্চলটি সেরোটোনিন, নর-এপিনেফ্রিন, ডোপামিন এবং গ্লুটামিন-নিউরন ধারণ করে। এছাড়াও, হিপোক্যাম্পাস নিউরোনগুলিতে প্রচুর পরিমাণে অ্যাসিটিলকোলিনের মাসকারিনিক (muscarinic) ও নিকোটিনিক (nicotinic) রিসেপ্টর ছড়িয়ে আছে। যদি মস্তিষ্ক নির্দিষ্ট কোনো নিউরোট্রান্সমিটার খুব বেশি বা খুব কম সংশ্লেষ করে, তবে স্মৃতিশক্তি-দৌর্বল্য, বিভ্রান্তি বা বিষণ্নতার মতো সমস্যা দেখা দিতে পারে। স্নায়ু-সিন্যাপ্সে অতিরিক্ত গ্লুটামেট-ক্ষরণ স্নায়ু কোষগুলিকে অতিরিক্ত উত্তেজিত ও বিষাযুক্ত করে তোলে। ফলে, হিপোক্যাম্পাস নিউরোনগুলি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, এমনকি কোষগুলির মৃত্যুর কারণও হতে পারে। বিপরীতে, অন্যতম স্মৃতিধারক অ্যাসিটিলকোলিনের কম নিঃসরণ ও জৈবিক ছন্দপতন আলঝেইমার রোগের প্রধান একটি কারণ। প্রসঙ্গতঃ অ্যাসিটিলকোলিনের অষ্টপ্রহর নিঃসরণ সমপরিমাণ নয়। জৈবিক ঘড়ি (circadian clock) দ্বারা নিয়ন্ত্রিত এর অতিমাত্রায় নিঃসরণ দেখা যায় রাত্রির শেষ প্রহরে, যা উল্লেখযোগ্যভাবে কমে আসে দিনের আলোয়। সে কারণে, স্মৃতির প্রখরতা থাকে খুব সকালে।
আলঝেইমার রোগের কারণ ও রিস্ক ফ্যাক্টর
আক্রান্ত রোগীদের মস্তিষ্কে, বিশেষকরে অ্যামিগডালা, হিপোক্যাম্পাস ও এন্টোরহিনাল কর্টেক্সে, মূলত অ্যামাইলয়েড-বেটা (amyloid-β) নামক একটি প্রোটিন পুঞ্জীভূত হওয়ায় প্লাক বা ফলকের (plaques) সৃষ্টি এবং “টাউ” প্রোটিন (tau protein)-এর অতিমাত্রায় ফসফোরিলেশন ও স্নায়ুকোষের অ্যাক্সন (axon) অংশে সূক্ষ্মতন্তুগুলির জটবাধন হওয়ার কারণেই এই রোগের সূত্রপাত। একটি অ্যামাইলয়েড পূর্বসূরি প্রোটিন (APP) থেকে সেক্রিটেজ (প্রোটিয়েজ) এনজাইম দ্বারা বিভাজনের মাধ্যমে তৈরি হয় অ্যামাইলয়েডের তিনটি ধরণ- আল্ফ়া, বিটা ও গামা। প্রধানতঃ প্রোটিনের বিটা ধরণটি আলঝেইমার রোগের জন্য দায়ী। অ্যামাইলয়েড-বেটা প্রোটিনের উৎপাদন এবং নিকাশকরণের হারের মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী ভারসাম্যহীনতা অ্যামাইলয়েড প্রোটিনের মাত্রা বৃদ্ধি করে। ফলে, স্নায়ুকোষের সাইটোস্কেলটন বা অবকাঠামো নড়বড়ে হয়ে যায় যা নিউরনের সংবহনপ্রবাহকে বাধা দেয়। এছাড়া, FAM222A নামক একটি জিন থেকে সংকেতপ্ৰাপ্ত আরও একটি প্রোটিন, অ্যাগ্রেগেটিন (aggregatin), শনাক্ত হয়েছে যা অ্যামাইলয়েড-বেটা’র সঙ্গে যুক্ত হয়ে প্লাক সৃষ্টি করে। গবেষণায় দেখা গিয়েছে, KIBRA (Kidney/BRAin) নামক একটি প্রোটিন অ্যামাইলয়েড-বিটা প্রোটিনের বিপাকের সাথে জড়িত। তাই, পোস্টসিনাপ্টিক স্নায়ুকোষে এই প্রোটিনটির সংশ্লেষেণ ও উপস্থিতি কমে গেলে ডিমেনশিয়া রোগের বর্ধিত কারণ হিসেবে দেখা দেয়। এছাড়াও, স্নায়ুকোষে অ্যাসিটিলকোলিনের সংশ্লেষণ ও কার্যকারিতা হ্রাস পাওয়া স্মৃতিবিভ্রমের আরও একটি কারণ বলে জানা গিয়েছে। পরিণতিতে, আক্রান্ত রোগীদের উত্তরোত্তর স্মৃতিহানি ঘটে, চিন্তা করার বা আবেগমুহূর্ত অতীতকালের স্মৃতিচারণ করার ক্ষমতা হ্রাস পায়, তাদের ব্যক্তিত্ব ও মেজাজে পরিবর্তন আসে।
আলঝেইমার রোগে বয়স এবং জিনের প্রভাবটা অস্বীকার করা যায় না। বয়স যত বাড়ে, এই রোগের জটিলতাও তত বৃদ্ধি প্রায়। আলঝেইমার রোগের উপরিল্লিখিত বৈশিষ্ট্যগুলি বিকাশের কারণ হিসেবে কিছু প্রোটিন ও জিনের অস্বাভাবিকতাকে চিহ্নিত করা হয়েছে। আলঝেইমার এর প্রধান রিস্ক ফ্যাক্টর হিসেবে APOE (Apolipoprotein E) জিনের তিনটি পলিমরফিক অ্যালিলের মধ্যে APOE4-কে দায়ী করা হয়েছে, যা অ্যামাইলয়েড-বেটাকে ভেঙে টুকরো-টুকরো করে দলা বানাতে সাহায্য করে। এছাড়াও রয়েছে আরো দুটি জিন: অ্যামাইলয়েড পূর্বসূরি জিন (যার নির্দেশে সংশ্লেষ হয় APP) এবং প্রেসেনিলিন (Presenilin: PSEN1 ও PSEN2), যাদের মিউটেশন অ্যামাইলয়েড-বেটা সংশ্লেষণের মাত্রা ত্বরান্বিত করে। উপরন্তু, TREM2 (Triggering receptor expressed on myeloid cells 2) জিনের অ্যালিলগুলিও এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ায়। এছাড়াও রয়েছে হান্টিংটন (Htt) জিনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। এর বাইরেও, আরও বেশ কিছু জিন/প্রোটিন রোগ বিকাশে অবদান রাখে, যেমন এফ্রিন টাইপ-এ রিসেপ্টর (EPHA1), কাইনেজ অ্যাঙ্কোর প্রোটিন (AKAP9), এবং কোলস্টেরিন (CLU)। অধিকন্তু,, মাথার আঘাত, মানসিক চাপ, ডায়াবেটিস, কোলেস্টরল এবং উচ্চ রক্তচাপের প্রভাব তো রয়েছেই।
রোগের চিকিৎসা
প্রচলিত চিকিৎসায় ব্যবহৃত অ্যাসিটিলকোলিনস্টেরেজ (acetylcholinesterase) প্রতিরোধক (যেমন, রিভারস্টিগমাইন), গ্লুটামেট (NMDA) রিসেপ্টর অ্যান্টাগোনিস্ট (যেমন, মেমেন্টিন) ও অ্যান্টিডিপ্রেসেন্ট জাতীয় ওষুধগুলি রোগীদের স্মৃতিঅবক্ষয় থেকে বেশ কিছুটা নিরোধ করে বটে, কিস্তু এগুলি সরাসরি অ্যামাইলয়েড বা “টাউ” প্রোটিনকে আঘাত করে না। সম্প্রতি, হাইব্রিডোমা প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে আলঝেইমার রোগের চিকিৎসায় এক নজিরবিহীন অগ্রগতি হয়েছে। আলঝেইমার রোগ প্রতিরোধে যুক্তরাষ্ট্রের এফডিএ (ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন) কর্তৃক প্রথম অনুমোদিত (২০২১) ওষুধ হচ্ছে একটি মনোক্লোনাল অ্যান্টিবডি, অ্যাডুকানুম্যাব (aducanumab), যা অ্যামাইলয়েড বিটা ফলক-কে সরাসরি ভাঙতে সাহায্য করে। এছাড়া, একই কৌশলে আরও একটি মনোক্লোনাল অ্যান্টিবডি, লেকানেম্যাব (lecanemab), অ্যামাইলয়েড প্রোটিনগুলির সাথে সরাসরি যুক্ত হয়ে অ্যামাইলয়েড-জটগুলিকে ভেঙে ফেলতে সক্ষম হয়েছে এবং আলঝেইমার আক্রান্ত রোগীদের স্মৃতিশক্তির অবক্ষয় উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। এছাড়াও, অ্যামাইলয়েড রোগবিদ্যায় আরও একটি নতুন ওষুধ সংযোজন হতে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের এলি লিলি কোম্পানির ‘ডোনানেমাব (donanemab)’ নামে একটি মনোক্লোনাল অ্যান্টিবডি, যা রোগের গতি প্রায় এক তৃতীয়াংশ কমিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে। এটি অ্যামাইলয়েড-সহ Tau-প্রোটিনকেও উল্লেখ্যনীয় হারে কমিয়ে আনে। এই ওষুধটি এখন এফডিএ-কর্তৃক অনুমোদনের অপেক্ষায়। গ্লাইকোজেন সিন্থেজ কাইনেজ ৩ (GSK3) এবং সাইক্লিন ডিপেন্ডেন্ট কাইনেজ ৫ (CDK5) এনজাইম-দুটিকে বাধাগ্রস্ত করে Tau-প্রোটিনের অতিরিক্ত ফসফেট সংযোজনকে প্রতিহত করার কৌশলটিও সফলতার দ্বারপ্রান্তে। আলঝেইমার রোগের চিকিৎসায় এই ওষুধগুলি হলো যুগান্তকারী সংযোজন এবং একটি নির্দিষ্ট থেরাপিউটিক পদ্ধতির অর্জন। তদুপরি, দ্বি-নির্দিষ্ট (bi-specific) মনোক্লোনাল অ্যান্টিবডি ব্যবহারের মধ্য দিয়ে অ্যামাইলয়েড ও টাউ প্রোটিনকে একিসাথে (একটি কোষে বা দুটি ভিন্ন কোষে) দমন করা হলে সেটি হবে আরও একটি বড় অর্জন। এছাড়া, জিন প্রযুক্তি ও ক্রিসপর (CRISPR) জিন-সম্পাদনা কৌশলগুলির প্রয়োগ এই রোগটির নিরাময়ে অপার সম্ভাবনা রয়েছে। বলা বাহুল্য, প্রাপ্তবয়স্কদের মস্তিষ্কে নতুন কোষ সৃষ্টিতে যে সব বিষয় ও সম্পূরক খাবার গুরুত্বপূর্ণ, তার মধ্যে রয়েছে ব্যায়াম, ক্যালোরি সীমাবদ্ধতা, ক্যাফেইন, ফ্ল্যাভোনয়েড-সমৃদ্ধ ফল ও শাকসবজি, ওমেগা ৩-ফ্যাটি অ্যাসিড, দস্তা, লিথিয়াম এবং ফলিক এসিড। এই সম্পূরকগুলি স্মৃতিশক্তি উন্নত করে, মনোযোগ ও সতর্কতা বাড়ায়, সৃজনশীলতা বাড়ায় এবং চাপ কমায়।
উপসংহার
গত দুই দশকের গবেষণায় মানুষের মস্তিষ্ক সম্পর্কে একটি মৌলিক ধারণার পরিবর্তন এসেছে। পূর্বে, এটি বিশ্বাস করা হতো যে প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে গেলে মস্তিষ্কের কোষ আর নতুনভাবে সৃষ্টি হয় না। সাম্প্রতিক আবিষ্কারগুলি থেকে প্রমাণ মিলেছে যে মস্তিষ্কের বেশ কিছু অঞ্চলে সমগ্র জীবন জুড়েই নতুন কোষের জন্ম হয়। ঠিক সেই রকমটা দেখা গিয়েছে এমনকি অশীতিপর-মস্তিষ্কের হিপোক্যাম্পাস, অ্যামিগডালা, হাইপোথ্যালামাস ও সেরেব্রাল কর্টেক্সে। দেখা গেছে, প্রাপ্তবয়স্কদের নিউরোনকোষগুলির এ ধরণের নিউরোনম্যতার (plasticity) পেছনে রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ দুটি রাসায়নিক পদার্থ- মস্তিষ্ক থেকে প্রাপ্ত নিউরোট্রফিক ফ্যাক্টর (BDNF) এবং স্নায়ু বৃদ্ধির ফ্যাক্টর (NGF)। এসব অভাবনীয় আবিষ্কার আলঝেইমার-সহ অন্যান্য স্নায়ুঅবক্ষজনিত রোগগুলির নিরাময়ে এক নতুন দিগন্ত উম্মোচন করবে। এটা বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে, জ্ঞানবিস্তারের সাথে সাথে যেন এই রোগটিও আমাদের সমাজে দ্রুত হারে ছড়িয়ে পড়ছে, হতে পারে দেশের মানুষের আয়ুষ্কাল এখন অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। তাই প্রয়োজন আলঝেইমার রোগ-সম্পর্কিত গণসচেতনতা বৃদ্ধি। এ ব্যাপারে আলঝেইমার সোসাইটি অব বাংলাদেশের উদ্যোগ প্রশংসনীয়।