রসায়ন শাস্ত্রে মুসলিম বিজ্ঞানীগণ
- প্রকাশ: ১২:৪৪:৫২ অপরাহ্ন, সোমবার, ৩ জুলাই ২০২৩
- / ৫৩৯ বার পড়া হয়েছে
ইসলাম প্রতিষ্ঠার আগে রসায়ন নামক কোনো বিদ্যার প্রচলন ছিল না। সর্বপ্রথম আরবীয়রাই রসায়নকে বিজ্ঞানের একটি আলাদা শাখা হিসেবে পরিচিতি দিয়েছেন। মিশরীয়রা প্রথম এর চর্চা শুরু করলেও ইসলাম প্রতিষ্ঠার পর বিজ্ঞ মুসলিম জাতি এর চর্চা, বিশ্লেষণ, পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার মাধ্যমে রসায়নের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে এবং রসায়নকে বিজ্ঞানের একটি নতুন অধ্যায় হিসেবে পরিচিতি দেয়। চিকিৎসা শাস্ত্র, ভূগোল শাস্ত্র, এবং গণিতের পর মুসলমানদের শ্রেষ্ঠ অবদান হলো রসায়ন শাস্ত্র। রসায়ন শাস্ত্রকে আরবরা আল কিমিয়া বলত, যা পরে আলকেমি এর রূপ নেয়। আর এই শব্দ থেকেই কেমিস্ট্রি (Chemistry) এর উদ্ভব। রসায়নশাস্ত্রে অবদান রাখা কয়েকজন মুসলিম মনীষার পরিচয় তুলে ধরা হলো।
আর হুমায়রী ও আাস সাদিক
আধুনিক রসায়নের জনক ইবনে হাইয়ানের শিক্ষক ছিলেন জাফর আস সাদিক ও হারবী আর হুরাইরী। যারা মিশরের রসায়ন নিয়ে অনেক জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন। আস সাদিক ৭০০ বা, ৭০২-৭৬৫ সালের লোক ছিলেন। হারবী আর-হুমায়রী সপ্তম শতকের মাঝামাঝি সময়ে ইয়ামনে জন্মগ্রহণ করেন। তাদের রাসায়নিক তত্ত্বগুলো নিয়ে শিষ্য ইবন হাইয়ান বিস্তারিত আলোচনা করেছেন।
ইবনে হাইয়ান
আধুনিক রসায়নের জনক হলেন জাবের ইবনে হাইয়ান (জন্ম : ৭২১ মৃত্যু : ৮১৫)। খলিফা হারুনুর রশিদের শাসনামলে তার রসায়ন চর্চা দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়লে রসায়ন বিজ্ঞান হিসেবে নতুন পরিচিতি পায়। এর আগে রসায়নের বিজ্ঞান হিসেবে কোনো পরিচয় ছিল না। রসায়ন শাস্ত্রে তার রচিত বিখ্যাত বই হলো- ১. উসলুল কিমিয়া ২. আসরারুল কিমিয়া এবং ৩. আর রাহমা ইত্যাদি। ইবনে হাইয়ান আলকেমিতে পরীক্ষামূলক গবেষণার গোড়াপত্তন করেছেন। এছাড়া ভারসাম্য তত্ত্ব, কৃত্রিম উৎপাদন তত্ত্ব, ধাতুর গন্ধক-পারদ তত্ত্ব, রসায়নের জৈব উপাদান প্রয়োগ তার অন্যতম আবিষ্কার। তিনি একাধারে রসায়ন শাস্ত্রবিদ, দার্শনিক, মহাকাশ বিজ্ঞানী, জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও চিকিৎসা বিজ্ঞানী ছিলেন।
ইবনে ওয়াহশিয়া, ইবনে সিনার মতো বিখ্যাত মুসলিম মনিষীরা তার শিষ্য ছিলেন। ইবনে হাইয়ানের তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে তারা রসায়নের শাখাকে আরো প্রশস্ত করেছেন।
আল রাজি
আবু বকর মোহাম্মদ ইবন যাকারিয়া আল রাজি (জন্ম : ৮৬৫, মৃত্যু : ৯২৫) পেশায় ছিলেন একজন দক্ষ পারসিক চিকিৎসক ও দার্শনিক। বিজ্ঞানী আল রাজি সর্বপ্রথম হাইড্রোজেন ও সালফেটের বিক্রিয়ার মাধ্যমে সালফিউরিক এসিড আবিষ্কার করেন। যা সার উৎপাদন, রং, বিস্ফোরক, কীটনাশক, ওষুধ ইত্যাদি তৈরিতে ব্যবহার হয়। এ ছাড়া তিনি জৈব ও অজৈব রসায়নে অবদান রেখেছেন। আল রাজি রসায়ন বিষয়ের ওপর ১২টি গ্রন্থ রচনা করেছেন। ইরানে প্রতিবছর ২৭ আগস্ট “রাজি দিবস” (ফার্মেসি দিবস) পালন করা হয়।
আল-কিন্দি
আবু ইউসুফ ইয়াকুব ইবনে ইসহাক আল কিন্দি (জন্ম : আনু ৮০১, মৃত্যু : আনু ৮৭৩) ছিলেন বহুবিদ্যাবিশারদ। তিনি ছিলেন দার্শনিক, গণিতবিদ, যুক্তিবিদ, রসায়ণবিদ, মনোবিজ্ঞানী, জ্যোতির্বিজ্ঞানী, সংগীতজ্ঞ। পাশ্চাত্য বিশ্বে তিনি আলকিন্দাস নামে পরিচিত। এরিস্টটল, প্লেটো, ইবনে হাইয়ানের ভাবশিষ্য ছিলেন তিনি।
আল বিরুনি
আবু রায়হান আল বিরুনি (জন্ম : ৯৭৩, মৃত্যু : ১০৫০) ছিলেন গণিত, রসায়ন, জ্যোতির্বিজ্ঞান, প্রাকৃতিক বিজ্ঞানে পারদর্শী। তিনি সর্বপ্রথম ভারতের জ্ঞান-বিজ্ঞানের ওপর মুসলিম মনিষীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। অধ্যাপক মাপা বলেছেন, আল বিরুনি শুধু মুসলিম বিশ্বের নয়, বরং তিনি ছিলেন সমগ্র বিশ্বের শ্রেষ্ঠ জ্ঞানীদের একজন। তার ওষুধ প্রস্তুত প্রণালি সম্পর্কিত বই, ‘কিতাব আল-সায়দালা ফি আল-তিব্ব।’ এছাড়া তিনি ধাতু ও মূল্যবান পাথরের ঘনত্ব ও বিশুদ্ধতা নির্ধারণ করতে হাইড্রোস্ট্যাটিক ব্যালেন্স ব্যবহার করেছেন। আবু হানিফা দিনাওয়ারী, আল বাত্তানীর মতো প্রখ্যাত ব্যক্তি দ্বারা তিনি প্রভাবিত হয়েছিলেন। ওমর খৈয়ামের ভাবগুরু ছিলেন আল বিরুনি।
আন নাবতি
আবু বকর আহমদ ইবনে আলি ইবনে কায়েস আন-নাবতি (জন্ম : ৯৩০) রসায়নের জগতে ইবনে ওয়াইশিয়া নামে অধিক পরিচিত। এই মুসলিম রসায়নবিদের শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ হলো ‘উসুলুল কাবির’।
ইবনে ফিরনাস
মুসলমান রসায়নবিদদের মধ্যে আরেকটি উল্লেখযোগ্য নাম হলো আব্বাস ইবনে ফিরনাস (জন্ম : ৮১০ মৃত্যু : ৮৮৭)। তিনি ছিলেন একাধারে আবিষ্কারক, প্রকৌশলী এবং উড্ডয়ন বিশারদ।
ইবনে সিনা
আল শাইখ আল বাইম আবু আলি আল হোসেইন ইবনে আবদুল্লাহ ইবন সিনা আল বুখারি (জন্ম : ৯৮০ মৃত্যু : ১০৩৭) ছিলেন মুসলিম চারজন শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানীর একজন। তার বিখ্যাত বইগুলোতে ইবনে সিনা ওষুধ প্রণালি সম্পর্কে বলেছেন। যেমন : সোডিয়াম হাইড্রোক্সাইড দ্রবণ, ক্যালসিয়াম পলিসালফাইড, কপার ও সোনার ভস্মীকরণ, সালফার ওষুধ, সাদা সালফারের প্রস্তুতি প্রভৃতি। ইবনে সিনার রসায়নবিষয়ক বই ‘ব্যবহারিক রসায়ন’। ইবনে সিনা আল রাজি, আল বিরুনি, এরিস্টটল, আল কিন্দি প্রমুখ ব্যক্তি দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন। বিশ্বের অনেক বিখ্যাত মনীষী তার থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছে।
এছাড়া আল-তাতিমি, আল-কাসি, আল-মাজরিতি, ইবনে ইয়াজিদ, আব্বাস শাফেঈ প্রমুখসহ আরও অনেক মুসলিম বিজ্ঞানীর অনন্ত অবদানেই আজকের এই আধুনিক রাসায়নিক বিজ্ঞান।