ভাষাবিজ্ঞান আলোচনা
- প্রকাশ: ০৮:৩৩:৩৬ অপরাহ্ন, শনিবার, ১১ জানুয়ারি ২০২৫
- / ৩৬ বার পড়া হয়েছে
আরও বিস্তারিত এককালিক তাত্ত্বিক ভাষাবিজ্ঞানের শাখাগুলির সম্পর্ক; সময়ের সাথে সাথে এগুলির প্রতিটিই পরিবর্তিত হয়।
ভাষাবিজ্ঞান বলতে একটি ভাষার প্রকৃতি, গঠন ও ঔপাদানিক একক ও এর যেকোনো ধরনের পরিবর্তন নিয়ে বৈজ্ঞানিক গবেষণাকে বোঝায়। যারা এ বিষয়ে গবেষণা করেন তাদেরকে ভাষাবিজ্ঞানী বলা হয়।
ভাষাবিজ্ঞানীরা নৈর্ব্যক্তিক বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে ভাষাকে বিশ্লেষণ ও বর্ণনা করেন; ভাষার সঠিক ব্যবহারের কঠোর বিধিবিধান প্রণয়ন তাদের উদ্দেশ্য নয়। তারা বিভিন্ন ভাষার মধ্যে তুলনা করে এদের সাধারণ উপাদান এবং অন্তর্নিহিত সূত্রগুলি নিরূপণের চেষ্টা করেন এবং এগুলিকে এমন একটি তাত্ত্বিক কাঠামোয় দাঁড় করাতে চেষ্টা করেন যে-কাঠামো সমস্ত ভাষার পরিচয় দিতে সক্ষম এবং ভাষাতে কোন ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা নেই, সে ব্যাপারেও ভবিষ্যদ্বাণী করতে সক্ষম।
ভাষাসমূহের বৈজ্ঞানিক বিবরণ ছাড়াও এগুলির উৎপত্তি কীভাবে হয় ও শিশুরা কীভাবে ভাষা অর্জন করে এবং প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তিরা কীভাবে মাতৃভাষা ব্যতীত অন্য নতুন ভাষা শেখে, সেগুলিও ভাষাবিজ্ঞানের আলোচ্য বিষয়। আবার ভাষাসমূহের নিজেদের মধ্যকার সম্পর্ক এবং সময়ের সাথে সাথে এগুলির পরিবর্তন নিয়েও এই শাস্ত্রে অধ্যয়ন করা হয়। কোনও কোনও ভাষাবিজ্ঞানী ভাষাকে একটি মানসিক প্রক্রিয়া হিসেবে বিবেচনা করেন এবং ভাষা উৎপাদন ও উপলব্ধি করার যে বিশ্বজনীন মানবিক ক্ষমতা,সেটির একটি তত্ত্ব দাঁড় করাতে চেষ্টা করেন। আবার অন্যান্য কিছু ভাষাবিজ্ঞানী সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে ভাষাকে দেখেন এবং মানুষের কথা বলার ভঙ্গি পর্যবেক্ষণ করে বোঝার চেষ্টা করেন মানুষ কীভাবে পরিবেশ ভেদে কর্মস্থলে, বন্ধুদের সাথে বা পরিবারের সদস্যদের সাথে যথাযথভাবে একই ভাষার বিভিন্ন রূপ প্রয়োগ করে।
ভাষা নিয়ে গবেষণা একটি অতি প্রাচীন শাস্ত্র হলেও কেবল উনিশ শতকে এসেই এটি বিজ্ঞানভিত্তিক “ভাষাবিজ্ঞান” নামীয় শাস্ত্রের রূপ নেয়। ভাষাবিজ্ঞানের তাত্ত্বিক দিক ও ব্যাবহারিক দিক দুই-ই বিদ্যমান। তাত্ত্বিক ভাষাবিজ্ঞানে ভাষার ধ্বনিসম্ভার (ধ্বনিতত্ত্ব ও ধ্বনিবিজ্ঞান), ব্যাকরণ (বাক্যতত্ত্ব ও রূপমূলতত্ত্ব) এবং শব্দার্থ (অর্থবিজ্ঞান) নিয়ে আলোচনা করা হয়। ব্যাবহারিক ভাষাবিজ্ঞানে অনুবাদ, ভাষা শিক্ষণ, বাক-রোগ নির্ণয় ও বাক-চিকিৎসা, ইত্যাদি আলোচিত হয়। এছাড়া ভাষাবিজ্ঞান জ্ঞানের অন্যান্য শাখার সাথে মিলে সমাজভাষাবিজ্ঞান, মনোভাষাবিজ্ঞান, গণনামূলক ভাষাবিজ্ঞান ইত্যাদির জন্ম দিয়েছে।
ভাষাবিজ্ঞানের শাখা
ভাষাবিজ্ঞানীরা কোন নির্দিষ্ট কালের একটি নির্দিষ্ট ভাষার ওপর গবেষণা করতে পারেন; একে বলা হয় এককালিক, সমকালীন, বা কালকেন্দ্রিক ভাষাবিজ্ঞান। অথবা তারা কোন একটি ভাষার ঐতিহাসিক বিবর্তন নিয়ে গবেষণা করতে পারেন; একে বলা হয় কালানুক্রমিক, বিবর্তনমূলক, বা ঐতিহাসিক ভাষাবিজ্ঞান।
তাত্ত্বিক ভাষাবিজ্ঞানে কোন ভাষার অভ্যন্তরীণ কাঠামোর একটি তত্ত্ব প্রদানের চেষ্টা করা হয়। অন্যদিকে ব্যাবহারিক ভাষাবিজ্ঞানে ভাষিক ধারণাগুলো শেখা ও অন্যান্য কাজে লাগানো হয়। তাত্ত্বিক ভাষাবিজ্ঞানে যেহেতু ভাষার অভ্যন্তরীণ কাঠামো নিয়ে গবেষণা করা হয়, এ গবেষণার প্রকৃতি তাই মূলত এককালিক। তাত্ত্বিক ভাষাবিজ্ঞানে ভাষার অর্জন, প্রয়োগ, সামাজিক ও নৃতাত্ত্বিক অনুষঙ্গ ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা করা হয় না। এগুলো ব্যাবহারিক ভাষাবিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখা যেমন সমাজভাষাবিজ্ঞান, মনোভাষাবিজ্ঞান, নৃতাত্ত্বিক ভাষাবিজ্ঞান, ইত্যাদি বিশেষায়িত ক্ষেত্রে গবেষণা করা হয়।
ভাষার কাঠামোর বিভিন্ন স্তরের ওপর ভিত্তি করে ভাষাবিজ্ঞানকে নিচের শাখাগুলোতে ভাগ করা যায়:
- ধ্বনিবিজ্ঞান: উচ্চারিত কথার/ধ্বনির ভৌত (physical) প্রকৃতি। ধ্বনিসমূহের উচ্চারণে মানুষের কোন কোন অঙ্গ কাজে আসে এবং উৎপাদিত ধ্বনিতরঙ্গের বিশ্লেষণ।
- ধ্বনিতত্ত্ব: ভাষাতে ধ্বনির ব্যবহারবিন্যাস। ধ্বনিমূল, সহধ্বনি, যুগ্মধ্বনি, ইত্যাদির গবেষণা।
- রূপমূলতত্ত্ব বা রূপতত্ত্ব বা শব্দতত্ত্ব: শব্দের গঠন।
- বাক্যতত্ত্ব: কীভাবে শব্দ ও শব্দগুচ্ছের মত ছোট এককগুলি সংযুক্ত হয়ে বাক্য গঠন করে, তার আলোচনা।
- শব্দার্থতত্ত্ব বা অর্থবিজ্ঞান: শব্দার্থ ও বাক্য গঠনে শব্দার্থের ভূমিকা।
- প্রায়োগিক ভাষাতত্ত্ব/প্রয়োগতত্ত্ব: ভাষার প্রয়োগে পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতির প্রভাব।
ভাষা বিষয়ক গবেষণার প্রকৃতি ও স্থানকালিক বিস্তার অনুসারে ভাষাবিজ্ঞানকে নিচের শাখাগুলোতে ভাগ করা যায়:
- তাত্ত্বিক ভাষাবিজ্ঞান: বিভিন্ন ভাষা কী ভাবে কাজ করে।
- ঐতিহাসিক ভাষাবিজ্ঞান: ভাষাগুলো কী ভাবে ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে উদ্ভূত হল।
- উপভাষাতত্ত্ব: একই ভাষার ভৌগোলিক বৈচিত্র্য বিষয়ক গবেষণা।
- ভাষাতাত্ত্বিক শ্রেণীকরণবিদ্যা: বিভিন্ন ভাষাকে তাদের বহিঃস্থ গাঠনিক বৈশিষ্ট্যের ওপর ভিত্তি করে শ্রেণীকরণ।
আবার ভাষাবিজ্ঞান জ্ঞানের অন্যান্য কিছু শাখার সাথে একত্রে মিলে জ্ঞানের কিছু আন্তঃশাস্ত্রীয় শাখা গঠন করেছে:
- সমাজভাষাবিজ্ঞান: ভাষা ও সমাজ কাঠামোর পারস্পরিক সম্পর্কের গবেষণা।
- মনোভাষাবিজ্ঞান: মস্তিষ্কের বা মনের ভেতর ভাষা কীভাবে রূপলাভ করে, সে সম্পর্কিত আলোচনা।
- ফলিত ভাষাবিজ্ঞান: শিক্ষণ, অনুবাদ, ইত্যাদি ব্যাবহারিক বিষয়ে ভাষাবিজ্ঞানের অবদান।
- গাণিতিক ও গণনামূলক ভাষাবিজ্ঞান: ভাষার গাণিতিক ও পরিসাংখ্যিক প্রকৃতি, কম্পিউটারে মানুষের ভাষার প্রক্রিয়াকরণ, ইত্যাদি।
- শৈলীবিজ্ঞান: সাহিত্যে ভাষাবিজ্ঞানের প্রয়োগ।
- নৃতাত্ত্বিক ভাষাবিজ্ঞান: সাংস্কৃতিক পরিবেশভেদে ভাষার গবেষণা।
- ভাষার দর্শন: ভাষা ও যৌক্তিক চিন্তাধারার সম্পর্ক।
- চিকিৎসা ভাষাবিজ্ঞান: বাক-রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসায় ভাষাবিজ্ঞানের প্রয়োগ।
এছাড়া কিছু ভাষাবিজ্ঞানী প্রতীকী ভাষা, অব্যক্ত যোগাযোগ, প্রাণীদের মধ্যে যোগাযোগ ও অন্যান্য বিষয় (যেগুলো মুখের ভাষার সাথে সম্পর্কিত নয়) নিয়ে গবেষণা করেন।
কীভাবে সঠিকভাবে লিখতে বা পড়তে হয়, ভাষাবিজ্ঞানে তা নিয়ে গবেষণা করা হয় না। ভাষাবিজ্ঞান বিধানমূলক নয়, বরং বর্ণনামূলক। ভাষাবিজ্ঞানীরা অনেক সময় বিভিন্ন তথ্য উপস্থাপন করেন যা মানুষকে ভাষাবিষয়ক কোন সিদ্ধান্ত বা মূল্যায়নে সহায়তা করে, কিন্তু এই সিদ্ধান্ত বা মূল্যায়নগুলো ভাষিক বিজ্ঞানের অংশ নয়।
ভাষাবিজ্ঞানের উৎস
পাশ্চাত্যে খ্রিস্টপূর্ব ৫ম শতাব্দীর গ্রিক দার্শনিকরা প্রথম ভাষার তত্ত্বের ব্যাপারে আগ্রহী হন। ভাষার উৎস ও গ্রিক ভাষার ব্যাকরণগত কাঠামো ছিল তাদের মূল বিতর্কের বিষয়। প্লেটো ও এরিস্টটল ভাষার অধ্যয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। ধারণা করা হয় প্লাতো-ই প্রথম বিশেষ্য ও ক্রিয়ার মধ্যে পার্থক্য করেন। খ্রিস্টপূর্ব ১ম শতাব্দীতে দিয়োনিসিয়ুস থ্রাক্স প্রথম পূর্ণাঙ্গ গ্রিক ব্যাকরণ রচনা করেন। এই প্রভাবশালী ব্যাকরণটিকে পরবর্তীকালে রোমীয় বা লাতিন ব্যাকরণবিদরা মডেল হিসেবে গ্রহণ করেন এবং অনুরূপে তাদের কাজও পরবর্তীকালে মধ্যযুগ ও রেনেসাঁসের সময় লেখা সব ব্যাকরণকে প্রভাবিত করে। এ সময় ইউরোপে প্রচলিত বেশির ভাগ ভাষার ব্যাকরণবিদরা গ্রিক ও লাতিন ব্যাকরণকে মান ও “শুদ্ধ” ব্যাকরণ গণ্য করে তাদের নিজ নিজ ভাষার জন্য বিধানমূলক ব্যাকরণ রচনা করেন। রেনেসাঁসের পরে পাশ্চাত্যের চিন্তাবিদেরা বিশ্বের অন্যান্য ভাষার ব্যাকরণের ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে ওঠেন।
পাশ্চাত্যের বাইরে ভারতীয় উপমহাদেশে ভাষাবিষয়ক গবেষণার একটি স্বতন্ত্র ধারা অতি প্রাচীনকাল থেকেই বিদ্যমান ছিল। সংস্কৃত ব্যাকরণবিদেরা উদ্দেশ্য ও বিধেয়ের মধ্যে পার্থক্য করেন, এবং গ্রিক ব্যাকরণবিদদের মত বিশেষ্য ও ক্রিয়াপদ ছাড়াও অনুসর্গ ও অব্যয় নামের দুটি পদ আবিষ্কার করেন। ভারতীয় ব্যাকরণবিদদের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হলেন পাণিনি (খ্রিস্টপূর্ব ৪র্থ শতাব্দী)। তবে তার বেশ কয়েক শতাব্দী আগে থেকেই ভারতে ব্যাকরণচর্চা শুরু হয়েছিল। পাণিনি-পূর্ব ব্যাকরণবিদদের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হলেন যাস্ক (আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৮ম শতাব্দী)। যাস্ক তার ব্যাকরণে বিশেষ্য, ক্রিয়া, উপসর্গ ও নিপাতের (অব্যয়) উল্লেখ করেছিলেন। তবে পাণিনির ব্যাকরণেই তার পূর্ববর্তী সমস্ত ভাষাতাত্ত্বিক চিন্তাধারা পূর্ণতা পায় এবং এটি ভবিষ্যতের সমস্ত ভারতীয় ব্যাকরণকে প্রভাবিত করে। তার ব্যাকরণের ওপর ভিত্তি করে কমপক্ষে ১২টি ভিন্ন ব্যাকরণ-তত্ত্বের ধারা ও হাজার খানেক ব্যাকরণ রচিত হয়। ভারতীয় ভাষা গবেষণার কাজ ধ্বনিতাত্ত্বিক ও শব্দের অন্তর্সংগঠন – উভয় দিক থেকেই পাশ্চাত্যের ব্যাকরণের চেয়ে উন্নত বলে গণ্য করা হয়। পাণিনীয় সংস্কৃত ব্যাকরণ সম্বন্ধে বলা হয়ে থাকে যে আজও পৃথিবীর ইতিহাসের আর কোন ভাষার ব্যাকরণে এরকম পুঙ্খানুপুঙ্খতা, অভ্যন্তরীণ সঙ্গতি ও ধারণার সাশ্রয় পরিলক্ষিত হয়নি। ব্লুমফিল্ডের মতে পাণিনির অষ্ট্যাধ্যায়ী “one of the greatest monuments of human intelligence” অর্থাৎ “মনুষ্য বুদ্ধিমত্তার সর্বশ্রেষ্ঠ নিদর্শনের একটি”। এই ব্যাকরণের মূল অংশে প্রায় চার হাজার সূত্র প্রদান করা হয়েছে। কেবল ১৮শ শতকের শেষার্ধে এসেই পাশ্চাত্যের ভাষাতাত্ত্বিকেরা ভারতীয় ব্যাকরণের এই ধারার সাথে প্রথম পরিচয় লাভ করেন।
১৯শ শতক ও তুলনামূলক ঐতিহাসিক ভাষাবিজ্ঞান
অনেকেই ১৭৮৬ সালকে ভাষাবিজ্ঞানের জন্মবছর হিসেবে গণ্য করেন। ঐ বছরের ২৭ সেপ্টেম্বর তারিখে ভারতে কর্মরত ব্রিটিশ প্রাচ্যবিদ স্যার উইলিয়াম জোন্স কলকাতার রয়াল এশিয়াটিক সোসাইটির এক সভায় একটি গবেষণাপত্র পাঠ করেন, যাতে তিনি উল্লেখ করেন যে সংস্কৃত, গ্রিক, লাতিন, কেল্টীয় ও জার্মানীয় ভাষাগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য রকমের গাঠনিক সাদৃশ্য রয়েছে এবং প্রস্তাব করেন যে এগুলো সবই একই ভাষা থেকে উদ্ভূত। জোন্সের এই আবিষ্কারের ওপর ভিত্তি করে সমগ্র ১৯শ শতক জুড়ে ঐতিহাসিক ভাষাবিজ্ঞানীরা তুলনামূলক কালানুক্রমিক পদ্ধতি অনুসরণ করে বিভিন্ন ভাষার ব্যাকরণ, শব্দভাণ্ডার ও ধ্বনিসম্ভারের মধ্যে তুলনা করার চেষ্টা করেন এবং ফলশ্রুতিতে আবিষ্কার করেন যে প্রকৃতপক্ষেই লাতিন, গ্রিক ও সংস্কৃত ভাষাগুলো পরস্পর সম্পর্কিত, ইউরোপের বেশির ভাগ ভাষার মধ্যে বংশগত সম্পর্ক বিদ্যমান এবং এগুলো সবই একটি আদি ভাষা প্রত্ন-ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা থেকে উদ্ভূত। রাস্মুস রাস্ক, ফ্রান্ৎস বপ, ইয়াকপ গ্রিম, প্রমুখ ইউরোপীয় ভাষাবিজ্ঞানী তাদের গবেষণা প্রকাশ করা শুরু করেন। ১৯শ শতকের শেষ চতুর্থাংশে লাইপ্ৎসিশ-ভিত্তিক “নব্যব্যাকরণবিদেরা” (Jung-grammatiker; কার্ল ব্রুগ্মান, হের্মান অস্ট্হফ, হের্মান পাউল, প্রমুখ) দেখান যে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে আদি ভাষাগুলোর উচ্চারণের সুশৃঙ্খল, নিয়মাবদ্ধ পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে নতুন ভাষাগুলোর উদ্ভব হয়েছে।
একই সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ভাষাবিজ্ঞানের আরেকটি ধারা স্বাধীনভাবে কাজ করে যাচ্ছিল। মার্কিন নৃতাত্ত্বিক ভাষাবিজ্ঞানীরা আমেরিকান ইন্ডিয়ান ভাষাসমূহের ওপর কাজ করতে শুরু করেন। এগুলোর অধিকাংশই ছিল বিলুপ্তির পথে, এবং এগুলোর কোন লিখিত দলিলও ছিল না। ফলে ঐতিহাসিক রচনাসমূহের তুলনা করে নয়, মার্কিন ভাষাবিজ্ঞানীরা মাঠে গিয়ে উপাত্ত সংগ্রহ করে ভাষা বিশ্লেষণ করতেন।
২০শ শতক, সোস্যুর, এককালিক ভাষাবিজ্ঞান ও সংগঠনবাদ
১৯শ শতকের শেষে সুইস ভাষাবিজ্ঞানী ফের্দিনঁ দ্য সোস্যুর ভাষা গবেষণার গতিধারায় পরিবর্তন আনেন। সোস্যুর-ই প্রথম এককালিক ও কালানুক্রমিক ভাষাবিজ্ঞানের মধ্যে পার্থক্য করেন। ফলে ভাষাবিজ্ঞানীরা বিভিন্ন ভাষার তুলনামূলক ঐতিহাসিক বিচারের পরিবর্তে যেকোন একটি ভাষার একটি নির্দিষ্ট কালের বিবরণের ব্যাপারে দৃষ্টিনিক্ষেপ করেন। সোস্যুর আরও প্রস্তাব করেন যে, ভাষা (langue, লংগ্) ও উক্তি (parole, পারোল) দুটি ভিন্ন সত্তা। তার মতে ভাষা হল অদৃশ্য অভ্যন্তরীণ কাঠামো, আর উক্তি হল তার বাস্তব বহিঃপ্রকাশ। সোস্যুর মত দেন যে ভাষা বিভিন্ন আন্তঃসম্পর্কিত, পরস্পরনির্ভর উপাদানে তৈরি একটি সুশৃঙ্খল কাঠামো বা সংগঠন। তার এই মতের ওপর ভিত্তি করে বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে সাংগঠনিক ভাষাবিজ্ঞানের সূত্রপাত ঘটে। বিখ্যাত মার্কিন ভাষাবিজ্ঞানী এডওয়ার্ড স্যাপির ও লিওনার্ড ব্লুমফিল্ড ছিলেন ভাষাবৈজ্ঞানিক সংগঠনবাদের পুরোধা। তারা ভাষার গবেষণায় উপাত্তভিত্তিক সাক্ষ্যপ্রমাণের ওপর জোর দেন এবং বলেন যে ভাষাবিজ্ঞানের কাজ ভাষা কী ভাবে কাজ করে তা নৈর্ব্যক্তিক বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে পর্যবেক্ষণ করা; ভাষা কী রকম হওয়া উচিত, তা নিয়ে গবেষণা করা ভাষাবিজ্ঞানের কাজ নয়। ১৯৩০ ও ১৯৪০-এর দশককে বলা হয় ভাষাবিজ্ঞানের “ব্লুমফিল্ডীয় যুগ”; এ সময় ব্লুমফিল্ড-প্রদত্ত কঠোর নিয়মতান্ত্রিক বিশ্লেষণী পদ্ধতি অনুসরণ করে বহু ভাষার বিবরণমূলক ব্যাকরণ রচিত হয়। এ সময় ভাষাবিজ্ঞানীরা কোন ভাষার মাতৃভাষী ব্যক্তির বিভিন্ন উক্তি সংগ্রহ করতেন ও পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিভিন্ন নিয়মতান্ত্রিক বিশ্লেষণ প্রয়োগ করে সেগুলোর ভেতরের ধ্বনিতাত্ত্বিক ও বাক্যতাত্ত্বিক সূত্র ও বিন্যাসগুলো আবিষ্কারের চেষ্টা করতেন।
চম্স্কি ও আধুনিক ভাষাবিজ্ঞান
১৯৫০-এর দশকেই কিছু কিছু ভাষাবিজ্ঞানী সংগঠনবাদের দুর্বলতা আবিষ্কার করেন। তারা বলেন, সংগঠনবাদীরা কেবল ভাষার বাহ্যিক রূপ ও দৃশ্যমান উপাত্ত নিয়েই আগ্রহী এবং ভাষাবিজ্ঞানকে অহেতুক উপাত্ত-সংগ্রহ ও বিশ্লেষণের ক্ষুদ্র সীমায় আবদ্ধ করে ফেলেছেন। এর ফলে ভাষার অদৃশ্য অভ্যন্তরীণ সংগঠন ও বিভিন্ন ভাষার বিশ্বজনীন ধর্মগুলো উপেক্ষিত হয়েছে। মার্কিন ভাষাবিজ্ঞানী নোম চম্স্কি সংগঠনবাদের বিরুদ্ধে লেখেন এবং ভাষা যে একটি মানসিক প্রক্রিয়া ও পৃথিবীর সব ভাষাই যে কিছু সার্বজনীন বিন্যাস অনুসরণ করে, সে ব্যাপারে জোর দেন। চম্স্কির এই লেখার ফলে ভাষাবিজ্ঞানের গতি আরেকবার পরিবর্তিত হয়। চম্স্কি বিশ্বাস করেন যে কোন ব্যক্তির অচেতন, অব্যক্ত ভাষাবোধ এবং তার ভাষাপ্রয়োগ দুটি ভিন্ন বস্তু। তার মতে ভাষাবিজ্ঞানীর কাজ হল মানুষের ভাষাবোধ যেসব অন্তর্নিহিত মানসিক সূত্র দিয়ে গঠিত সেগুলো আবিষ্কার করা। এ প্রস্তাবের সমর্থনে ১৯৫৭ সালে Syntactic Structures নামের গ্রন্থে চম্স্কি উপস্থাপন করেন তার উদ্ভাবিত “রূপান্তরমূলক সৃষ্টিশীল ব্যাকরণ” নামের একটি ধারণা, যে ব্যাকরণের সূত্রগুলো দিয়ে কোন একটি ভাষার সমস্ত “বৈধ” বাক্যের গঠন ব্যাখ্যা করা সম্ভব। চম্স্কি আরও বলেন যে সব ভাষার মানুষই ভাষা বিষয়ক কিছু সার্বজনীন ধারণা নিয়ে জন্মগ্রহণ করে, যাদের সমষ্টিগত নাম তিনি দেন “বিশ্বজনীন ব্যাকরণ”। এই ব্যাকরণের সীমা উদ্ঘাটন করাও ভাষাবিজ্ঞানীর অন্যতম কাজ। উল্লেখ্য, চম্স্কীয় ধারায় “ব্যাকরণ” বলতে ভাষাবিষয়ক প্রথাগত কিছু আনুশাসনিক নিয়মের সমষ্টিকে বোঝানো হয় না, বরং মানবমনের বিমূর্ত ভাষাবোধ, যা মানুষকে কথা বলতে, বুঝতে কিংবা নতুন ভাষা শিখতে সাহায্য করে, সেটিকে নির্দেশকারী ও ব্যাখাকারী ভাষাবৈজ্ঞানিক সূত্রসমষ্টিকে বোঝায়।
বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধের আধুনিক ভাষাবিজ্ঞান মূলত চম্স্কি প্রস্তাবিত রূপান্তরমূলক ব্যাকরণের ওপর ভিত্তি করে প্রস্তাবিত বিভিন্ন ধরনের ব্যাকরণিক কাঠামোর গবেষণা। চম্স্কি বাক্যতত্ত্বকে ভাষাবিজ্ঞানের মূল ধারা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। ৫০ ও ৬০-এর দশকের প্রাথমিক প্রকাশের পর চম্স্কির নিজস্ব তত্ত্বের বিবর্তন ঘটেছে বেশ কয়েকবার: “মান তত্ত্ব” থেকে শুরু করে “সম্প্রসারিত মান তত্ত্ব”, “শাসন ও বন্ধন তত্ত্ব”, “নীতি ও প্রচল”, এবং সর্বশেষ “ন্যূনতমবাদী প্রকল্প”। এছাড়া চম্স্কীয় তত্ত্বের অনুসরণে কিছু তত্ত্ব গড়ে উঠেছে, যেগুলি ভাষাবিজ্ঞানের লক্ষ্য-সংক্রান্ত চম্স্কীয় মতবাদ ও স্বতঃসিদ্ধগুলো অনেকাংশেই মেনে নিয়ে অগ্রসর হয়েছে। এদের মধ্যে “কারক ব্যাকরণ”, “সাধারণীকৃত পদ সংগঠন ব্যাকরণ”, “সৃষ্টিশীল অর্থবিজ্ঞান”, “মস্তক-চালিত পদ সংগঠন ব্যাকরণ”, “আভিধানিক কার্যমূলক ব্যাকরণ”, “সম্পর্কমূলক ব্যাকরণ” ও “কাম্যতমতা তত্ত্ব” অন্যতম। চম্স্কীয় মূলধারার বাইরে আধুনিক ভাষাবিজ্ঞানে শ্রেণীকরণবাদী একটি ধারা আছে, যে ধারার অনুসারী ভাষাবিজ্ঞানীরা বিভিন্ন ভাষাকে তাদের সাদৃশ্য-বৈসাদৃশ্যের ভিত্তিতে শ্রেণীকরণ করার চেষ্টা করেন।
একবিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে এসে মানবমনের বিভিন্ন প্রক্রিয়া সংক্রান্ত সংজ্ঞানাত্মক বিজ্ঞানের একটি অন্যতম শাখা হিসেবে ভাষাবিজ্ঞান নিজের স্থান করে নিয়েছে। ভাষাবিজ্ঞানের গবেষণায় কম্পিউটার ও কম্পিউটার বিজ্ঞানের তত্ত্বের প্রয়োগও বহুলাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে।
|