চাণক্যের সাফল্য সূত্র
- প্রকাশ: ০৫:২১:২৮ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৬ এপ্রিল ২০২১
- / ১৩৩৫ বার পড়া হয়েছে
চাণক্য কে?
প্রাচীন ভারতীয় মহাপণ্ডিত, বিদ্যাগুরু, জ্ঞানতাপস চাণক্য মানব জীবনের গতি প্রকৃতি উত্থান-পতনের নানা দিক সম্পর্কে দীর্ঘ উপলব্ধির পর যে নীতিশাস্ত্রের অবতারণা করেছেন তার নাম চাণক্য-সূত্রম্। তাঁর রচিত সূত্রগুলো শ্লোক নামেই পরিচিত। ভারতীয় উপমহাদেশ তো বটেই সারা বিশ্বে যাঁকে অন্যতম প্রাচীন এবং বাস্তববাদী পণ্ডিত মনে করা হয় তিনি চাণক্য, শাস্ত্রজ্ঞ মহাপণ্ডিত হিসেবে যার আরেক নাম কৌটিল্য। খ্রিস্টপূর্ব ৩৭০ থেকে ২৮৩ অব্দ তিনি ছিলেন প্রাচীন ভারতের পণ্ডিত, দার্শনিক ও রাজ উপদেষ্টা। প্রকৃতপক্ষে তিনি প্রাচীন তক্ষশীলা বিহারের অর্থনীতি ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যক্ষ ছিলেন। ইতিহাসে যে কজন প্রাচীন পণ্ডিত অমর হয়ে আছেন, তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন চাণক্য।
চাণক্যের সাফল্য সূত্র
আচার্য চাণক্য কেবলমাত্র সমস্যারই ব্যাখ্যা করেননি, বরং এক ম্যানেজমেন্ট গুরুর মত সঠিক ব্যক্তি চিনে নেওয়ার উপায়ও জানিয়েছেন। যে কোন কাজের সফলতা সেটার সঠিক ব্যবস্থাপনার ওপরে নির্ভর করে। অন্য দিকে ব্যবস্থাপনার সফলতায় এই জিনিষটার গুরুত্বপূর্ণ অবদান থাকে যে, সঠিক ব্যক্তি চিনে নেওয়া হোক, আর তাকে তার যোগ্যতা অনুসারে কাজের দায়িত্ব দেওয়া হোক। মহামতি চাণক্যের সাফল্য সূত্র ও নীতি সূত্রগুলো সত্যিই অসাধারণ, আমরা একটু খেয়াল করলেই বুঝতে পারি, তিনি তাঁর শ্লোকগুলোয় কত গভীর জ্ঞানের কথা ও বোধশক্তির কথা বলেছেন :
- দুর্বলের বল রাজা, শিশুর বল কান্না, মূর্খের বল নীরবতা, চোরের মিথ্যাই বল।
- দুষ্ট স্ত্রী, প্রবঞ্চক বন্ধু, দুর্মুখ ভৃত্য এবং সসর্প-গৃহে বাস মৃত্যুর দ্বার, এ বিষয়ে সংশয় নেই।
- আকাশে উড়ন্ত পাখির গতিও জানা যায়, কিন্তু প্রচ্ছন্ন প্রকৃতি-কর্মীর গতিবিধি জানা সম্ভব নয়।
- অধমেরা ধন চায়, মধ্যমেরা ধন ও মান চায়, উত্তমেরা শুধু মান চায়। মানই মহতের ধন।
- অন্তঃসারশূন্যদের উপদেশ দিয়ে কিছু ফল হয় না, মলয় পর্বতের সংসর্গে বাঁশ চন্দনে পরিণত হয় না।
চাণক্য ব্যক্তি জীবনে সাফল্য ও সমৃদ্ধির অসাধারণ সব কৌশলের প্রবক্তা। তিনি মনে করেন, সাফল্য অর্জন যুদ্ধক্ষেত্রে বীরত্ব প্রদর্শনের ন্যায়। আর এ বীরত্ব প্রদর্শন বুদ্ধি, কৌশল ও যথাযথ প্রয়োগশৈলীর উপর নির্ভরশীল। শক্তিশালী রণনীতি ছাড়া সাফল্য ত্বরান্বিত হয় না। সাফল্য লাভের রণনীতি তৈরি করার মামলায় চাণক্যের মত আরেকটা উদাহরণ দেখতে পাওয়া যায় না। উনি কেবলমাত্র রণনীতিই তৈরি করতেন না বরং সেগুলো প্রয়োগ করার সম্পূর্ণ রূপরেখাও তৈরি করতেন। ওনার সঠিক রণনীতিরই পরিণাম এটা ছিল যে, উনি যা কিছু চেয়েছেন সেগুলোকে উনি সঠিক সময়ে এবং প্রভাবশালীভাবে পূরণও করেছেন তাঁর সাফল্য সূত্র ও নীতি সূত্রের যথাযথ প্রয়োগশৈলীতার দ্বারা।
আধুনিক প্রতিযোগিতার যুগে চাণক্যের সুত্র
আজকের এই যুগ কড়া প্রতিযোগিতার যুগ! এজন্য কেবলমাত্র কঠিন পরিশ্রম দ্বারা সফলতা প্রাপ্ত করাটা ততটা নিশ্চিত হয় না বরং আজকের যুগে সফলতা পাওয়ার জন্য এক সুনির্দিষ্ট রণনীতির অন্তর্গত সঠিক পথে এগিয়ে চলা আর সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করাটা অত্যন্ত জরুরি হয়। এই ব্যাপারে চিন্তা-ভাবনা করতে ইচ্ছুক ব্যক্তিদের জন্য আচার্য চাণক্যের সাফল্য সূত্র ও নীতি সূত্রগুলো অত্যন্ত সহায়ক প্রমাণিত হতে পারে। এই সব সূত্রে উনি এক উৎকৃষ্ট ম্যানেজমেন্ট গুরুর ন্যায় রণনীতিকে আর তার কৌশলকে বিকশিত করা আর সেগুলোকে প্রয়োগ করে সঠিক পরিণাম প্রাপ্ত করার ব্যাপারটাকে বড়ই সুন্দরভাবে ব্যক্ত করেছেন। রণনীতিক কৌশলের প্রয়োজন আজ জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই রয়েছে তা সেটা রাজনীতি হোক্ বা ব্যবসা হোক্ বা ব্যক্তিগত জীবন। সব মিলিয়ে এমনটা বলা যেতে পারে যে, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সফলতা প্রাপ্ত করার জন্য আজ রণনীতিক কৌশলের প্রয়োজন হয়ে পড়েছে।
শক্তিশালী ব্যক্তি দুর্বল ব্যক্তির ওপরে আক্রমণ করে এটাই স্বাভাবিক। একটু গভীর থেকে চিন্তা করলে বুঝতে পারবেন যে, এটা হচ্ছে এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সূত্র। এটাকে গভীরতার সাথে বোঝা উচিত। এখানে আচার্য চাণক্য এক উৎকৃষ্ট ম্যানেজমেন্ট গুরুর মত বলেছেন যে, নিজের ক্ষমতার অনুরূপই কাজ নির্ধারণ করা উচিত। ওনার এই বক্তব্যকে উদাহরণের মাধ্যমে বোঝা সহজ হবে। ধরে নিন যে, এক ছাত্রের ক্ষমতা সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় সফলতা প্রাপ্ত করার মত নয়। যে কোন কারণেই হোক্, তার শিক্ষা যদি সেই স্তরের না হতে পারে তাহলে তার নিরাশ না হয়ে অন্য রাস্তা খোঁজা উচিত। তার এমন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা জন্য প্রস্তুত হওয়া উচিত, যাতে সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার তুলনায় কম জ্ঞান থাকলেও চলবে। সর্বদা নিজের ক্ষমতার অনুরূপই লক্ষ্য নির্ধারণ করা উচিত।
এই সূত্রটিও ম্যানেজমেন্ট ক্ষেত্রের হিসেবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এমনটা ধরে নেওয়া হোক্ যে, আপনি কোনো কোম্পানির সিইও। আপনি যখন নিজের কোম্পানির বিস্তারের পরিকল্পনা তৈরি করবেন তখন আপনার এই ব্যাপারটা মাথায় রাখা উচিত যে, আপনি যেন সরাসরি নিজের ক্ষেত্রের অন্যান্য মজবুত কোম্পানিগুলোর উদ্দেশ্যে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে না দেন বরং সবার আগে আপনার সেই সব কোম্পানিগুলোর বাজার নিজের দখলে নিয়ে আসার চেষ্টা করা উচিত যেসব কোম্পানি আপনার কোম্পানির তুলনায় অপেক্ষাকৃত দুর্বল। আপনি যখন এই সব কোম্পানির বাজারকে নিজের সঙ্গে যুক্ত করে নেবেন, তখন স্বাভাবিকভাবে এই পুরো প্রক্রিয়ায় আপনার কোম্পানিও মজবুত হয়ে উঠবে। এমনটা হয়ে পড়লে আপনার কোম্পানির শক্তি বেড়ে উঠবে আর যেসব কোম্পানি এর আগে আপনার কোম্পানির থেকে মজবুত ছিল তাদের সঙ্গেও এখন আপনার কোম্পানি টক্কর দিতে পারবে। এই প্রকার সূত্র জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হয়।
শক্তিশালীর সাথে যুদ্ধ করা হাতীর সেনার বিরুদ্ধে পায়ে হেঁটে লড়াই কারার সমান হয়।
ম্যানেজমেন্টের কলায় কুশল লোকেরা এটা জানেন যে, এই ক্ষেত্রে প্রতিটি মুহূর্তে তাঁদের মস্তিষ্কে এক প্রকারের মানসিক যুদ্ধ চলতে থাকে। এটাকেও যদি এক উদাহরণের মাধ্যমে বোঝার চেষ্টা করা হয়, তাহলে সুবিধা হবে। ধরে নিন, আপনি নিজের এক ব্যবসা শুরু করেছেন আর হয়তো সেই একই ক্ষেত্রে দেশের এক অত্যন্ত বড় কোম্পানি অনেক আগে থেকেই কাজ করছে। এমন পরিস্থিতিতে আপনার পক্ষে সরাসরি সেই কোম্পানির মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। আপনি সেই কোম্পানির সঙ্গে মোকাবিলা করার চেষ্টা করলে আপনাকে কুচলে দেওয়া হবে। এজন্য এই ক্ষেত্রে সঠিক রণনীতি এটাই হচ্ছে যে, নিজের থেকে শক্তিশালীর সঙ্গে টক্কর দেওয়ার মত ক্ষমতা প্রাপ্ত না করে তার উদ্দেশ্যে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেওয়া মোটেই উচিত নয়। এই সূত্রকে নিজেদের জীবনে গ্রহণ করা ব্যক্তিদের সমগ্র বিকাশ স্বাভাবিক রূপে হয়।
কাঁচা পাত্র কাঁচা পাত্রের সঙ্গে ধাক্কা লেগে ভেঙে যায় আর সেটার বিনাশ হয়ে পড়ে।
ম্যানেজমেন্ট ক্ষেত্রের জন্য এই সূত্র অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ! এর মাধ্যমে ম্যানেজমেন্ট গুরু চাণক্য এটা জানোনোর চেষ্টা করেছেন যে, সমান শক্তিসম্পন্ন দুই ব্যক্তি বা দুই সংগঠনের পরস্পরের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা উচিত নয়। এমনটা করলে দু’পক্ষেরই ক্ষতি হয়। এমন পরিস্থিতিতে দু পক্ষের লাভ এতেই রয়েছে যে, দু পক্ষ পরস্পরের সঙ্গে মৈত্রী স্থাপন করে নিক। সমান শক্তিসম্পন্ন দুটি পক্ষ যদি পরস্পরের সঙ্গে মিলেমিশে কাজ করে, তাহলে তাতে দু পক্ষেরই লাভ হয়। এজন্য সমান শক্তিসম্পন্ন লোকদের বা সংগঠনদের পারস্পরিক সংঘর্ষ এড়িয়ে চলাই উচিত। এই জিনিষটা জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সমান রূপে প্রযোজ্য হয়। আপনি ব্যবসায়ী হোন্, রাজনৈতিক নেতা হোন্, চাকুরীজীবি হোন্ বা ছাত্র, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সমান শক্তিসম্পন্ন লোকেরা যদি পরস্পরের সঙ্গে মিলেমিশে কাজ করেন, তাহলে তাঁদের সফল হওয়াটা তো নিশ্চিত হয়-ই… তার সাথে-সাথে তাঁরা যে কোন কাজ দ্রুত আর উৎকৃষ্টভাবে শেষ করতেও স্বাভাবিক রূপে সফল হয়ে ওঠেন।
চাণক্য-সূত্রমের ১০০ শ্লোকের সাফল্য সূত্র ও ১৫ টি নীতি সূত্রের বাস্তব শিক্ষাকে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে নিজের মতামতের সাথে সম্পৃক্ত মানব জীবনের নানা দিক একটি বই লিখেছি যার মাধ্যমে পাঠক-ভক্তগণ নিজের জীবনের প্রতি সঠিক দৃষ্টিভঙ্গির সাহায্যে উন্নতির শীর্ষে আরোহণ করতে সক্ষম হন।
বইয়ের নাম | প্রাচীন মহাপণ্ডিত চাণক্যের সাফল্য সূত্র: জীবনের সর্বক্ষেত্রে সাফল্যের টনিক |
লেখক | মোস্তাক আহ্মাদ |
প্রকাশক | ক্যারিয়ার পাবলিকেশন, ৬ বাংলাবাজার, বিচিত্রা বই মার্কেট (২য় তলা), ঢাকা-১১০০ |
পরিবেশক | ক্যারিয়ার পাবলিকেশন, রমকমারি ডট কম, বইবাজার ডট কম |