০৯:৫৪ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
                       

কোয়াড কী? কোয়াড বিষয়ে বাংলাদেশ নিয়ে চীন কেন কূটনৈতিক শিষ্টাচারবিরুদ্ধ বক্তব্য দিয়েছে?

মু. মিজানুর রহমান মিজান
  • প্রকাশ: ১২:১৪:২৮ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৩ মে ২০২১
  • / ৫৭০৮ বার পড়া হয়েছে

বামে চীনের রাষ্ট্রদূত লি জিমিং এবং ডানে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ. কে. আবদুল মোমেন। তাঁদের বক্তব্য নিয়ে ফের আলোচনায় যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, জাপান ও ভারতের কোয়াড।


Google News
বিশ্লেষণ-এর সর্বশেষ নিবন্ধ পড়তে গুগল নিউজে যোগ দিন

বিশেষ শর্তসাপেক্ষে এবং স্বল্পমূল্যে এই ওয়েবসাইটটি সামাজিক কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ কিংবা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের নিকট বিক্রি করা হবে।

কোয়াড ইস্যুতে বাংলাদেশকে সতর্ক করে বক্তব্য দিয়েছেন বাংলাদেশে চীনের রাষ্ট্রদূত মিস্টার লি জিমিং। এই বক্তব্যকে কূটনৈতিক শিষ্টাচার বিরুদ্ধ বলে করা জবাব দিয়েছেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ. কে. আবদুল মোমেন, এম. পি.। তিনি বলে দিয়েছেন, বাংলাদেশ সবসময় নিজেদের পররাষ্ট্রনীতি মেনেই চলবে এবং এতে অন্য কেউ কথা বলার অধিকার রাখে না। কোয়াড ও বাংলাদেশ নিয়ে কী জানা জানা যাচ্ছে?

কোয়াড কী?

কোয়াড্রাল্যাটেরাল সিকিউিরিটি ডায়ালগ যা সংক্ষেপে কোয়াড বা কিউএসডি বলেও ডাকা হয়। এই কোয়াড হলো চারটি দেশ যথা যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও ভারতের মধ্যে এক ধরনের অনানুষ্ঠানিক কৌশলগত জোট যা ২০০৭ সালে গঠিত হয়। কোয়াড নামের অনানুষ্ঠানিক এই জোটের সদস্যরা প্রায়ই বিভিন্ন রকম সম্মেলনের আয়োজন করে থাকে এবং নিজেদের প্রয়োজনে নানান রকম তথ্য আদান প্রদান করে থাকে। এ জোটকে সামরিক জোট না বলা হলেও এর কাজকর্ম সামরিক জোটের মতোই ডালপালা মেলছে ধীরেধীরে।

ইংরেজিতে এই জোট The Quadrilateral Security Dialogue নামে পরিচিত। সংক্ষেপে QSD এবং Quad নামে পরিচিত। বাংলায় একে বলা হয় ‘চতুর্ভুজ সুরক্ষা সংলাপ’

কোয়াড কেন গঠিত বা প্রতিষ্ঠিত হলো কেন?

বলা হয়ে থাকে যে, যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, অস্ট্রেলিয়া এবং ভারত গণতান্ত্রিক শান্তি তত্ত্ব ধারণ করে নিজেদের প্রতিরক্ষা সম্পর্ক ও ব্যবস্থাকে আরও মজবুত করার লক্ষ্যে ২০০৭ সালে অনানুষ্ঠানিকভাবে কোয়াড গঠন করে। শুরুতে এই চারদেশের মাথায় কোয়াড গঠনের পরিকল্পনা ছিল না। দেশগুলো চেয়েছিল মধ্য এশিয়ার বিভিন্ন দেশ, কোরিয়ান উপদ্বীপ এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলিকে নিয়ে একটি জোট প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা ছিল। এর নাম ঠিক করা হয়েছিল ‘এশিয়ান আর্ক অব ডেমোক্রেসি’। কোয়াডকে এশিয়ার ন্যাটো হিসেবে অনেক আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক তাঁদের বিশ্লেষণে উল্লেখ করেছেন। আর যারাই এই কোয়াড নিয়ে বিশ্লেষণ করেছেন তাঁরা প্রত্যেকেই দাবি করেছেন, এই জোট চীন বিরোধী।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, জাপান ও ভারত ভারত মহাসাগর ও প্রশান্ত মহাসাগরে নৌপথে অবাধ চলাচল বা স্বাধীন চলাচলে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য এই জোট গঠিত হয়। সদস্য চারটি দেশের কোনো দেশই এখনো প্রকাশ্যে স্বীকার করেনি যে, কোয়াড একটি সামরিক জোট। কিন্তু বিশ্লেষকগণ ও বিভিন্ন দেশের পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা দপ্তর একে সামরিক জোট হিসেবেই বিবেচনা করছে। বিশেষ করে চীন এবং চীনের বন্ধু দেশ বলে পরিচিত দেশগুলো এমনটাই বিশ্বাস করছে। কোয়াডকে চীনবিরোধী জোট হিসেবে অনেকেই চিহ্নিত করেছে। প্রশান্ত মহাসাগরে অবাধ চলাচলের পাশাপাশি ভারত মহাসাগরে চার দেশের আধিপত্য বিস্তারের লক্ষ্যকে বড়ো আকারে চোখে পড়ছে৷

২০০৭ সালেই কোয়াডের চারদেশ, যথা- যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, ভারত এবং অস্ট্রেলিয়া বঙ্গোপসাগরে যৌথ মহড়া চালনার মাধ্যমে নিজেদের কার্যক্রম উদ্বোধন করে।

কোয়াড ১০ বছর ঘুমিয়ে চোখ মেলে ২০১৭ সালে

২০০৭ সালে কোয়াড গঠিত হলে চারটি দেশ বঙ্গোপসাগরে যৌথ মহড়া চালনার মধ্য দিয়ে নিজেদের কার্যক্রম উদ্বোধন করলেও পরক্ষণে তা বন্ধ হয়ে যায়। কোয়াড থাকে ঘুমন্ত অবস্থায়। ২০১৭ সালের আগ পর্যন্ত কোয়াড সদস্যরা কোয়াড যা নিয়ে সুচনা লাভ করে তার ধারে কাছেও ছিল না। অনেক বিশ্লেষক এই সময়টাকে ‘হিমাগারে কোয়াড’ বলে আখ্যা দিয়েছেন।

২০২০ সালে টোকিয়োতে কোয়াড

বছর দশেক চুপ থাকার পর ২০১৭ সালে পুনরায় জাগ্রত হয় এবং যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও ভারত নিজেদের মধ্যে নানান কর্মসুচি গ্রহণ করে। এবং এ সময় বিভিন্ন তথ্যেরও আদান-প্রদান শুরু হতে থাকে। এরই ধারাবাহিকতা ২০২০ সালে ৬ অক্টোবর জাপানের টোকিয়োতে সংলাপে বসেছেন চার দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। এই সংলাপটি এমন এক সময় অনুষ্ঠিত হয় যখন চীনের সাথে ভারতের সীমান্ত নিয়ে পরিস্থিতি বিপজ্জনক উত্তেজনার অবস্থায় গিয়ে পৌঁছেছিল। চীন ও ভারতের মধ্যে এই যুদ্ধ চার/পাঁচ মাস স্থায়ী হয়েছিল। ওই সময়ে সংলাপ অনুষ্ঠিত হওয়ায় বিশ্বমিডিয়া ও বিশ্বনেতারা একে খুবই গুরুত্বের সাথে দেখেছিল। তবে চারটি দেশের যে নথিপত্র সংলাপের পর প্রকাশ করেছে তাতে ‘চীন’ শব্দেরও উল্লেখ ছিল না। প্রকাশ্যে চীন প্রসঙ্গে কিছু আলোচনায় না থাকলে বেশিরভাগই বিশ্বনাগরিক তখন ধরেই নিয়েছিলেন ওখানে ‘চীন-বিরোধী’ সিদ্ধান্ত আসতে পারে। চীনও তখন অনেকগুলো নৌ ও আকাশপথে মহড়া চালিয়েছিল।

কোয়াড ও বাংলাদেশকে জড়িয়ে হঠাৎ কেন সংবাদ শিরোনাম?

গত ১০ মে, ২০২১ তারিখ ডিপ্লোমেটিক করেসপনডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশের (ডিক্যাব) এর সাথে একটি ভার্চুয়াল মত বিনিময়ের সময় বাংলাদেশে চীনের রাষ্ট্রদূত মিস্টার লি জিমিং কোয়াডে বাংলাদেশের অংশগ্রহণের বিষয়ে সতর্ক করেন। এ সময় চীনের রাষ্ট্রদূত বলেন, এ রকমের ছোটো গোষ্ঠী বা ক্লাবে যুক্ত হওয়া ভালো নয় এবং বাংলাদেশ যদি এতে যুক্ত হয় তাহলে চীন ও বাংলাদেশের মধ্যে সম্পর্ক যথেষ্ট খারাপ করবে। চীনের রাষ্ট্রদূতের এমন বক্তব্যের পর সেটা লুফে নেয় গণমাধ্যম। শোনা যাচ্ছে বাংলাদেশের প্রতি চীনের এই সতর্কতা যুক্তরাষ্ট্র আমলে নিয়েছে।

বাংলাদেশ কী কোয়াডে যোগ দিচ্ছে?

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জনাব এ. কে. আবদুল মোমেন পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিয়েছেন বাংলাদেশ এই মুহুর্তে কোয়াডে যোগ দেওয়ার কথা ভাবছে না এমন কি কোয়াডের অন্য সদস্যদের থেকে সেখানে যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ বা প্রস্তাবও পাননি। বাংলাদেশ যে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র সেটি বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিশ্বনেতাদের মনে করিয়ে দিয়ে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, প্রয়োজনে যে-কোনো সিদ্ধান্ত বাংলাদেশ নিতে পারে এবং এতে অন্য কোনো দেশ কিছু বলার বা বাধা দেওয়ার অধিকার রাখে না।

আবদুল মোমেনের অনেকটা এমনই বলেছেন, বাংলাদেশ কী করবে বা না করবে সেটা একান্তই বাংলাদেশের ব্যাপার। আপাতত বাংলাদেশের ততফ থেকে কোনো আগ্রহ নেই কোয়াড নামের সংলাপে যোগ দেওয়ার। কিন্তু বাংলাদেশের কোনো স্বাধীন সিদ্ধান্তে যে, অন্য কোনো দেশের নাক গলানোর অধিকার নেই সেটি ভালো করেই ফুটে উঠেছে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যে।

চীণের রাষ্ট্রদূতের এমন আগ বাড়িয়ে কথা বলা কূটনৈতিক শিষ্টাচার বহির্ভুত বলেই মনে করে বাংলাদেশ। এটি নিয়ে বাংলাদেশের অনেক নাগরিক সমাজমাধ্যমে দাবি করেন, এতে ওই রাষ্ট্রদুতের ক্ষমা চাওয়া উচিৎ।

কোয়াড, বাংলাদেশে ও চীনের রাষ্ট্রদুত বিষয়ে গণমাধ্যম

চীনের রাষ্ট্রদূত মিস্টার লি জিমিং যে বক্তব্য দিয়েছেন তা নিয়ে বিশ্বমিডিয়া গুরুত্বের সাথে প্রতিবেদন করেছে। আবার চীনের রাষ্ট্রদূতের বক্তব্যের প্রতিবাদ করে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী যে বক্তব্য প্রদান করেছেন তাও গুরত্বের সাথে প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম।

বাংলা ভাষায় বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান সংবাদ প্রচার প্রতিষ্ঠান প্রথম আলো, ব্রিটিশ গণমাধ্যম ব্রিটিশ ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশন (বিবিস), জার্মানির ডয়চে ভেলে, ভারতের আজকাল পত্রিকার প্রতিবেদন উল্লেখযোগ্য।

সবগুলো সংবাদমাধ্যমই দাবি করছে, বাংলাদেশ যে কোয়াডে যুক্ত হবে সে রকম কোনো আনুষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া এখনো স্পষ্ট নয়। অর্থাৎ গণমাধ্যমের কাছে ‘কোয়াড-বাংলাদেশ’ বিষয়ে কোনো তথ্য নেই।

চীন কেন চাইছে না বাংলাদেশ কোয়াডে যোগ দিক?

কোয়াড যখন এর সূচনা লাভ করে তখন থেকেই এ চার দেশের অনানুষ্ঠানিক জোটটিকে ‘চীন-বিরোধী’ জোট হিসেবেই দেখছে চীন ও অন্যান্যরা। চীনের সাথে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, জাপান ও ভারত; কারো সাথেই সম্পর্ক ভালো নয়। যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের সাথে চীনের সম্পর্ক কততা তিক্ত সে কথা আর বিশ্বনাগরিকের কাছে বিশেষভাবে বলার অপেক্ষা রাখে না। জাপান ও অস্ট্রেলিয়ার সাথে চিনের সম্পর্ক বাকি দুই দেশের মতো অতটা খারাপ সম্পর্ক না থাকলেও, দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক যে অবস্থায় আছে তা ভালো কিছুর ইঙ্গিত বহন করে না।

বিগত বছরগুলোতে খেয়াল করলে দেখা যাবে, বাংলাদেশের সাথে চীনের সম্পর্ক বেশ চমৎকার একটা জায়গায় পৌঁছেছে। এই সম্পর্কের জন্য বাংলাদেশের তরফ থেকে নিশ্চয়ই আগ্রহ লক্ষ্য করা যায়, কিন্তু বাংলাদেশের সাথে একটি ভালো সম্পর্ক বজায় রেখে চলাটা যেন চীনেরই চাওয়া। বাংলাদেশের সাথে ভারতের খুবই বন্ধুত্বপূর্ন সম্পর্ক। বাংলাদেশের স্বাধীনতা এসে ছিল ভারতের হাত ধরেই। বাণিজ্যিক দিক থেকে বাংলাদেশ ভারত ও চীনের ওপর অনেকাংশেই নির্ভরশীল। যে কারণে বাংলাদেশ কখনোই চাইবে না এই দুই দেশের সাথে সম্পর্ক খারাপ হোক। আবার চীনও চাইবে না বাংলাদেশের অর্থনীতি ও প্রতিরক্ষায় তাঁদের চেয়ে ভারত, আমেরিকা কিংবা জাপানের মতো দেশ ভালো একটা অবদান রাখুক। এতে চীনের বড়াই অনেকটাই হ্রাস পাবে আর বাংলাদেশ চীনকে বাদ রেখে অন্যদের সাথে হাত মেলাবে।

বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ. কে. আবদুল মোমেনের বেশ কিছু বক্তব্য ও পদক্ষেপে ইতোমধ্যেই বোঝা গেছে, ‘ভারত-বাংলাদেশ’ সম্পর্ক নিয়ে ভারত ছেলেখেলা করার সুযোগ পাবে না। এতে চীন ধরে নিয়েছে, বাংলাদেশ চীনের ওপর নির্ভর হয়ে পড়ছে। আর এই অতি-আত্মবিশ্বাসই চীনের পক্ষ থেকে এমন বক্তব্য ও দাবীর কারণ। কিন্তু আবদুল মোমেন এবার চীনকে ছেড়ে কথা বলছেন না, বরং তাঁদের মনে করিয়ে দিলেন, ‘বাংলাদেশ নিজের পররাষ্ট্রনীতি মেনেই চলবে’।

শেয়ার করুন

মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার তথ্য সংরক্ষিত রাখুন

লেখকতথ্য

মু. মিজানুর রহমান মিজান

মু. মিজানুর রহমান মিজান একজন স্বাধীন শিক্ষামূলক লেখক। তিনি শিক্ষা গবেষণায় বেশ আগ্রহী। যৌথভাবে কিছু গবেষণায়ও অংশ নিয়েছেন।

বিশেষ শর্তসাপেক্ষে এই ওয়েবসাইটটি সামাজিক কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ কিংবা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের নিকট বিক্রি করা হবে।

কোয়াড কী? কোয়াড বিষয়ে বাংলাদেশ নিয়ে চীন কেন কূটনৈতিক শিষ্টাচারবিরুদ্ধ বক্তব্য দিয়েছে?

প্রকাশ: ১২:১৪:২৮ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৩ মে ২০২১

কোয়াড ইস্যুতে বাংলাদেশকে সতর্ক করে বক্তব্য দিয়েছেন বাংলাদেশে চীনের রাষ্ট্রদূত মিস্টার লি জিমিং। এই বক্তব্যকে কূটনৈতিক শিষ্টাচার বিরুদ্ধ বলে করা জবাব দিয়েছেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ. কে. আবদুল মোমেন, এম. পি.। তিনি বলে দিয়েছেন, বাংলাদেশ সবসময় নিজেদের পররাষ্ট্রনীতি মেনেই চলবে এবং এতে অন্য কেউ কথা বলার অধিকার রাখে না। কোয়াড ও বাংলাদেশ নিয়ে কী জানা জানা যাচ্ছে?

কোয়াড কী?

কোয়াড্রাল্যাটেরাল সিকিউিরিটি ডায়ালগ যা সংক্ষেপে কোয়াড বা কিউএসডি বলেও ডাকা হয়। এই কোয়াড হলো চারটি দেশ যথা যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও ভারতের মধ্যে এক ধরনের অনানুষ্ঠানিক কৌশলগত জোট যা ২০০৭ সালে গঠিত হয়। কোয়াড নামের অনানুষ্ঠানিক এই জোটের সদস্যরা প্রায়ই বিভিন্ন রকম সম্মেলনের আয়োজন করে থাকে এবং নিজেদের প্রয়োজনে নানান রকম তথ্য আদান প্রদান করে থাকে। এ জোটকে সামরিক জোট না বলা হলেও এর কাজকর্ম সামরিক জোটের মতোই ডালপালা মেলছে ধীরেধীরে।

ইংরেজিতে এই জোট The Quadrilateral Security Dialogue নামে পরিচিত। সংক্ষেপে QSD এবং Quad নামে পরিচিত। বাংলায় একে বলা হয় ‘চতুর্ভুজ সুরক্ষা সংলাপ’

কোয়াড কেন গঠিত বা প্রতিষ্ঠিত হলো কেন?

বলা হয়ে থাকে যে, যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, অস্ট্রেলিয়া এবং ভারত গণতান্ত্রিক শান্তি তত্ত্ব ধারণ করে নিজেদের প্রতিরক্ষা সম্পর্ক ও ব্যবস্থাকে আরও মজবুত করার লক্ষ্যে ২০০৭ সালে অনানুষ্ঠানিকভাবে কোয়াড গঠন করে। শুরুতে এই চারদেশের মাথায় কোয়াড গঠনের পরিকল্পনা ছিল না। দেশগুলো চেয়েছিল মধ্য এশিয়ার বিভিন্ন দেশ, কোরিয়ান উপদ্বীপ এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলিকে নিয়ে একটি জোট প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা ছিল। এর নাম ঠিক করা হয়েছিল ‘এশিয়ান আর্ক অব ডেমোক্রেসি’। কোয়াডকে এশিয়ার ন্যাটো হিসেবে অনেক আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক তাঁদের বিশ্লেষণে উল্লেখ করেছেন। আর যারাই এই কোয়াড নিয়ে বিশ্লেষণ করেছেন তাঁরা প্রত্যেকেই দাবি করেছেন, এই জোট চীন বিরোধী।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, জাপান ও ভারত ভারত মহাসাগর ও প্রশান্ত মহাসাগরে নৌপথে অবাধ চলাচল বা স্বাধীন চলাচলে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য এই জোট গঠিত হয়। সদস্য চারটি দেশের কোনো দেশই এখনো প্রকাশ্যে স্বীকার করেনি যে, কোয়াড একটি সামরিক জোট। কিন্তু বিশ্লেষকগণ ও বিভিন্ন দেশের পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা দপ্তর একে সামরিক জোট হিসেবেই বিবেচনা করছে। বিশেষ করে চীন এবং চীনের বন্ধু দেশ বলে পরিচিত দেশগুলো এমনটাই বিশ্বাস করছে। কোয়াডকে চীনবিরোধী জোট হিসেবে অনেকেই চিহ্নিত করেছে। প্রশান্ত মহাসাগরে অবাধ চলাচলের পাশাপাশি ভারত মহাসাগরে চার দেশের আধিপত্য বিস্তারের লক্ষ্যকে বড়ো আকারে চোখে পড়ছে৷

২০০৭ সালেই কোয়াডের চারদেশ, যথা- যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, ভারত এবং অস্ট্রেলিয়া বঙ্গোপসাগরে যৌথ মহড়া চালনার মাধ্যমে নিজেদের কার্যক্রম উদ্বোধন করে।

কোয়াড ১০ বছর ঘুমিয়ে চোখ মেলে ২০১৭ সালে

২০০৭ সালে কোয়াড গঠিত হলে চারটি দেশ বঙ্গোপসাগরে যৌথ মহড়া চালনার মধ্য দিয়ে নিজেদের কার্যক্রম উদ্বোধন করলেও পরক্ষণে তা বন্ধ হয়ে যায়। কোয়াড থাকে ঘুমন্ত অবস্থায়। ২০১৭ সালের আগ পর্যন্ত কোয়াড সদস্যরা কোয়াড যা নিয়ে সুচনা লাভ করে তার ধারে কাছেও ছিল না। অনেক বিশ্লেষক এই সময়টাকে ‘হিমাগারে কোয়াড’ বলে আখ্যা দিয়েছেন।

২০২০ সালে টোকিয়োতে কোয়াড

বছর দশেক চুপ থাকার পর ২০১৭ সালে পুনরায় জাগ্রত হয় এবং যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও ভারত নিজেদের মধ্যে নানান কর্মসুচি গ্রহণ করে। এবং এ সময় বিভিন্ন তথ্যেরও আদান-প্রদান শুরু হতে থাকে। এরই ধারাবাহিকতা ২০২০ সালে ৬ অক্টোবর জাপানের টোকিয়োতে সংলাপে বসেছেন চার দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। এই সংলাপটি এমন এক সময় অনুষ্ঠিত হয় যখন চীনের সাথে ভারতের সীমান্ত নিয়ে পরিস্থিতি বিপজ্জনক উত্তেজনার অবস্থায় গিয়ে পৌঁছেছিল। চীন ও ভারতের মধ্যে এই যুদ্ধ চার/পাঁচ মাস স্থায়ী হয়েছিল। ওই সময়ে সংলাপ অনুষ্ঠিত হওয়ায় বিশ্বমিডিয়া ও বিশ্বনেতারা একে খুবই গুরুত্বের সাথে দেখেছিল। তবে চারটি দেশের যে নথিপত্র সংলাপের পর প্রকাশ করেছে তাতে ‘চীন’ শব্দেরও উল্লেখ ছিল না। প্রকাশ্যে চীন প্রসঙ্গে কিছু আলোচনায় না থাকলে বেশিরভাগই বিশ্বনাগরিক তখন ধরেই নিয়েছিলেন ওখানে ‘চীন-বিরোধী’ সিদ্ধান্ত আসতে পারে। চীনও তখন অনেকগুলো নৌ ও আকাশপথে মহড়া চালিয়েছিল।

কোয়াড ও বাংলাদেশকে জড়িয়ে হঠাৎ কেন সংবাদ শিরোনাম?

গত ১০ মে, ২০২১ তারিখ ডিপ্লোমেটিক করেসপনডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশের (ডিক্যাব) এর সাথে একটি ভার্চুয়াল মত বিনিময়ের সময় বাংলাদেশে চীনের রাষ্ট্রদূত মিস্টার লি জিমিং কোয়াডে বাংলাদেশের অংশগ্রহণের বিষয়ে সতর্ক করেন। এ সময় চীনের রাষ্ট্রদূত বলেন, এ রকমের ছোটো গোষ্ঠী বা ক্লাবে যুক্ত হওয়া ভালো নয় এবং বাংলাদেশ যদি এতে যুক্ত হয় তাহলে চীন ও বাংলাদেশের মধ্যে সম্পর্ক যথেষ্ট খারাপ করবে। চীনের রাষ্ট্রদূতের এমন বক্তব্যের পর সেটা লুফে নেয় গণমাধ্যম। শোনা যাচ্ছে বাংলাদেশের প্রতি চীনের এই সতর্কতা যুক্তরাষ্ট্র আমলে নিয়েছে।

বাংলাদেশ কী কোয়াডে যোগ দিচ্ছে?

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জনাব এ. কে. আবদুল মোমেন পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিয়েছেন বাংলাদেশ এই মুহুর্তে কোয়াডে যোগ দেওয়ার কথা ভাবছে না এমন কি কোয়াডের অন্য সদস্যদের থেকে সেখানে যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ বা প্রস্তাবও পাননি। বাংলাদেশ যে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র সেটি বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিশ্বনেতাদের মনে করিয়ে দিয়ে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, প্রয়োজনে যে-কোনো সিদ্ধান্ত বাংলাদেশ নিতে পারে এবং এতে অন্য কোনো দেশ কিছু বলার বা বাধা দেওয়ার অধিকার রাখে না।

আবদুল মোমেনের অনেকটা এমনই বলেছেন, বাংলাদেশ কী করবে বা না করবে সেটা একান্তই বাংলাদেশের ব্যাপার। আপাতত বাংলাদেশের ততফ থেকে কোনো আগ্রহ নেই কোয়াড নামের সংলাপে যোগ দেওয়ার। কিন্তু বাংলাদেশের কোনো স্বাধীন সিদ্ধান্তে যে, অন্য কোনো দেশের নাক গলানোর অধিকার নেই সেটি ভালো করেই ফুটে উঠেছে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যে।

চীণের রাষ্ট্রদূতের এমন আগ বাড়িয়ে কথা বলা কূটনৈতিক শিষ্টাচার বহির্ভুত বলেই মনে করে বাংলাদেশ। এটি নিয়ে বাংলাদেশের অনেক নাগরিক সমাজমাধ্যমে দাবি করেন, এতে ওই রাষ্ট্রদুতের ক্ষমা চাওয়া উচিৎ।

কোয়াড, বাংলাদেশে ও চীনের রাষ্ট্রদুত বিষয়ে গণমাধ্যম

চীনের রাষ্ট্রদূত মিস্টার লি জিমিং যে বক্তব্য দিয়েছেন তা নিয়ে বিশ্বমিডিয়া গুরুত্বের সাথে প্রতিবেদন করেছে। আবার চীনের রাষ্ট্রদূতের বক্তব্যের প্রতিবাদ করে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী যে বক্তব্য প্রদান করেছেন তাও গুরত্বের সাথে প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম।

বাংলা ভাষায় বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান সংবাদ প্রচার প্রতিষ্ঠান প্রথম আলো, ব্রিটিশ গণমাধ্যম ব্রিটিশ ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশন (বিবিস), জার্মানির ডয়চে ভেলে, ভারতের আজকাল পত্রিকার প্রতিবেদন উল্লেখযোগ্য।

সবগুলো সংবাদমাধ্যমই দাবি করছে, বাংলাদেশ যে কোয়াডে যুক্ত হবে সে রকম কোনো আনুষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া এখনো স্পষ্ট নয়। অর্থাৎ গণমাধ্যমের কাছে ‘কোয়াড-বাংলাদেশ’ বিষয়ে কোনো তথ্য নেই।

চীন কেন চাইছে না বাংলাদেশ কোয়াডে যোগ দিক?

কোয়াড যখন এর সূচনা লাভ করে তখন থেকেই এ চার দেশের অনানুষ্ঠানিক জোটটিকে ‘চীন-বিরোধী’ জোট হিসেবেই দেখছে চীন ও অন্যান্যরা। চীনের সাথে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, জাপান ও ভারত; কারো সাথেই সম্পর্ক ভালো নয়। যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের সাথে চীনের সম্পর্ক কততা তিক্ত সে কথা আর বিশ্বনাগরিকের কাছে বিশেষভাবে বলার অপেক্ষা রাখে না। জাপান ও অস্ট্রেলিয়ার সাথে চিনের সম্পর্ক বাকি দুই দেশের মতো অতটা খারাপ সম্পর্ক না থাকলেও, দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক যে অবস্থায় আছে তা ভালো কিছুর ইঙ্গিত বহন করে না।

বিগত বছরগুলোতে খেয়াল করলে দেখা যাবে, বাংলাদেশের সাথে চীনের সম্পর্ক বেশ চমৎকার একটা জায়গায় পৌঁছেছে। এই সম্পর্কের জন্য বাংলাদেশের তরফ থেকে নিশ্চয়ই আগ্রহ লক্ষ্য করা যায়, কিন্তু বাংলাদেশের সাথে একটি ভালো সম্পর্ক বজায় রেখে চলাটা যেন চীনেরই চাওয়া। বাংলাদেশের সাথে ভারতের খুবই বন্ধুত্বপূর্ন সম্পর্ক। বাংলাদেশের স্বাধীনতা এসে ছিল ভারতের হাত ধরেই। বাণিজ্যিক দিক থেকে বাংলাদেশ ভারত ও চীনের ওপর অনেকাংশেই নির্ভরশীল। যে কারণে বাংলাদেশ কখনোই চাইবে না এই দুই দেশের সাথে সম্পর্ক খারাপ হোক। আবার চীনও চাইবে না বাংলাদেশের অর্থনীতি ও প্রতিরক্ষায় তাঁদের চেয়ে ভারত, আমেরিকা কিংবা জাপানের মতো দেশ ভালো একটা অবদান রাখুক। এতে চীনের বড়াই অনেকটাই হ্রাস পাবে আর বাংলাদেশ চীনকে বাদ রেখে অন্যদের সাথে হাত মেলাবে।

বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ. কে. আবদুল মোমেনের বেশ কিছু বক্তব্য ও পদক্ষেপে ইতোমধ্যেই বোঝা গেছে, ‘ভারত-বাংলাদেশ’ সম্পর্ক নিয়ে ভারত ছেলেখেলা করার সুযোগ পাবে না। এতে চীন ধরে নিয়েছে, বাংলাদেশ চীনের ওপর নির্ভর হয়ে পড়ছে। আর এই অতি-আত্মবিশ্বাসই চীনের পক্ষ থেকে এমন বক্তব্য ও দাবীর কারণ। কিন্তু আবদুল মোমেন এবার চীনকে ছেড়ে কথা বলছেন না, বরং তাঁদের মনে করিয়ে দিলেন, ‘বাংলাদেশ নিজের পররাষ্ট্রনীতি মেনেই চলবে’।