বই রিভিউ: চিলেকোঠার সেপাই
- প্রকাশ: ০৭:১৮:২১ অপরাহ্ন, রবিবার, ১৬ মে ২০২১
- / ১৪৮১০ বার পড়া হয়েছে
বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক আখতারুজ্জামান ইলিয়াস রচিত ‘চিলেকোঠার সেপাই’ খুবই জনপ্রিয় একটি উপন্যাস। ‘চিলেকোঠার সেপাই’ ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান প্রেক্ষাপটে রচিত। এই উপন্যাসে লেখক আখতারুজ্জামান ইলিয়াস ফুটিয়ে তুলেছেন গণঅভ্যুত্থান চলাকালীন পূর্ববাংলা বা তৎকালীন পূর্বপাকিস্তান। দেখিয়েছেন রাজপথের মিছিল, নিয়ে গিয়েছেন আন্দোলনের ভিতর। ‘চিলেকোঠার সেপাই’ উপন্যাসটি প্রথমে ‘রোববার’ নামক একটি সাপ্তাহিক পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়, আশির দশকের শুরুতে। সমর মজুমদারের প্রচ্ছদে ১৯৮৬ সালে প্রথমবারের মতো পুস্তক আকারে এই উপন্যাসটি প্রকাশ করে ঢাকার দি ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড (ইউপিএল)।
পাঠ প্রতিক্রিয়ায় ‘চিলেকোঠার সেপাই’
‘চিলেকোঠার সেপাই’ উপন্যাসের গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র
উপন্যাসটির গুরুত্বপূর্ণ একটি চরিত্র ওসমান। গণঅভ্যুত্থানের অংশ ছিল ওসমান। একজন ব্যাচেলর চাকুরীজীবি। যার ঠিকানা একটি ভবনের চিলেকোঠার চার দেয়ালের মাঝে। তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু আনোয়ার। সে বামপন্থি দলের একজন সক্রিয় নেতা। আরও একজন মূল চরিত্র হলো হাড্ডি খিজির। যার সঙ্গে ওসামানের বেশ খাতির। পেশায় একজন রিক্সাচালক। পুরো উপন্যাস জুড়েই ছিল এই তিনজনের আন্দোলন কেন্দ্রিক বিভিন্ন ঘটনা।
অল্পকথায় ‘চিলেকোঠার সেপাই’ উপন্যাস
১৯৬৯ এ পূর্ববাংলার অবস্থা ছিল শোচনীয়। আন্দোলনে কেঁপে ওঠে ঢাকা। এর বাতাস পৌঁছে যায় দূরের গ্রাম অবধি। সেখানেও আন্দোলন দানা বাধে। চারদিক মুখরিত হতে থাকে এক সুর; ‘দিকে দিকে আগুন জ্বালো’ এবং ‘জেলের তালা ভাংবো শেখ মুজিবকে আনবো’।
উপন্যাসের শুরু হয় ওসমানের দুঃস্বপ্নের মাধ্যমে। ঘুম ভাঙতেই সংবাদ পায় তার নিচের ভাড়াটিয়ার বড়ো ছেলে মিছিলে গিয়ে শহিদ হয়েছে। ছেলে হারানো বাবার আর্তনাদ তার কানে বাজতে থাকে। ওদিকে হাড্ডি খিজিরের মাহাজন একজন পাকিস্তানপন্থি। তার মা রেহাই পায় না মহাজনের কালো নজর থেকে, এমনকি তার বৌয়ের দিকেও চোখ দেয় মহাজন। কিন্তু খিজির মহাজনের বিরুদ্ধে একা তেমন কিছুই করতে পারে না। খিজির মিছিল মিটিংয়ে সব সময় থাকতো। এ জন্যে মহাজন তাকে আর দেখতে পারতো না। এক সময় মহাজনের সাথে বিদ্রোহ করে বসে তার গ্যারেজের সকল রিক্সাচালক। সেখানে মহাজনের এক দালালের সাথে হাতাহাতি সংঘর্ষ হয় খিজিরের। তাই সে মহাজনের আশ্রয় ছেড়ে উঠে পড়ে ওসমানের চিলেকোঠার চার দেয়ালে। সেখানেই দুজনের বেশ খাতির হয়। একসাথে অনেক গুলো মিছিলে এর আগেও গিয়েছে খিজির আর ওসমান। কিন্তু ওসমানের চিলেকোঠায় ওঠার পর বন্ধনটা আরো দৃঢ হয়।
অপর দিকে ওসমানের বন্ধু আনোয়ার যায় নিজ গ্রামে। সেখানে গিয়ে চোখে পড়ে খয়বর গাজীর অত্যাচার। সাধারণ গ্রামবাসীর গরু চুরি আর সম্পদ আত্মসাৎ করাই যেন তার মূল লক্ষ্য। এই অন্যায় দেখে চুপ থাকে না আনোয়ার। গ্রামের বাসিন্দাদের সংঘবদ্ধ করে। রুখে দাঁড়ায় খয়বর গাজীর অত্যাচারের বিরুদ্ধে। গ্রামের জনগণের নেতায় পরিণত হয় আনোয়ার। গ্রামবাসী খয়বর গাজীকে পাকরাও করে আনোয়ারের নেতৃত্বে। কিন্তু স্বাস্তি হবার আগ মুহূর্তে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয় খয়বর গাজী।
আর ঢাকাতে ওসমান প্রেমে পড়ে তার প্রতিবেশির মেয়ে রানুর। রানুকে ঘিরে জেগে ওঠে তার কামনা। কিন্তু ক’দিন পরেই রানুর বিয়ের কথা ওঠে। তখন ভেঙ্গে যায় ওসমানের মন। কিন্তু তাতেও তার মিছিলে যাওয়া আটকায় না। বরং বাসা থেকে বেরুতে না পাড়লেই যেন দম বন্ধ লাগে ওসমানের। সব শুনে, দেখে, মিটিংয়ে যায়, আবার মিছিলেও শরিক হয়। কিন্তু তবুও যেন সব কিছুতে শরিক নয়। তাকে ঘিরে থাকে চিলে কোঠার চার দেয়াল।
আন্দোলনের শেষের দিকের এক মিছিলে মিলিটারির বুলেটে শহিদ হয় খিজির। আর হয়তো সেজন্যেই মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে ওসমান। খুন করতে উদ্দত হয় তারই সহনামী রানুর ভাই রঞ্জুকে। এসব পাগলামীর খবর পেয়ে গ্রাম থেকে ছুটে আসে বন্ধু আনোয়ার। আনোয়ার ওকে নিজের বাড়িতে নিয়ে যেতে চাইলেও আনোয়ারের পরিবার মানা করে দেয়। কোনো পাগলকে আশ্রয় দিতে পারবে না বলে জানিয়ে দেয়। তাই চিলেকোঠাই হয় ওসমান।
দিনে দিনে ওসমানের পাগলামী বাড়তে থাকে। সে নাকি খিজিরকে দেখতে পায়। ডাকে তাকে মুক্তির জন্যে। চিলে কোঠার চার দেয়ালের বাইরে যাবার জন্যে ডাকে। ডাকে আবার মিছিলে যাবার জন্যে। খিজিরের এই আহ্বান ওসমানকে আষ্টেপিষ্টে ধরে। পরিণত হয় বদ্ধ উন্মাদে। এক সময় আর সে কাউকেই এমন কি তার বন্ধু আনোয়ারকেও চিনতে পারে না। বাহিরে যাবার জন্যে জোড়াজুড়ি করার এক পর্যায়ে তার গায়ে হাত তুলেই শান্ত করে। হঠাৎ একদিন আনোয়ারের ঘুমন্ত থাকা অবস্থায় বেড়িয়ে যায় ওসমান। মুক্ত সে। হয়ত ওসমানকেই লেখক বাংলার রূপে দেখিয়েছেন।
‘চিলেকোঠার সেপাই’ উপন্যাসের লেখক আখতারুজ্জামান ইলিয়াস প্রসঙ্গে কিছু কথা
গাইবান্ধা জেলার গোটিয়া নামক একটি গ্রামে আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের মামাবাড়ি। এই মামাবাড়িতেই ১৯৪৩ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি তিনি জন্মগ্রহণ করেন। পূর্ণনাম আখতারুজ্জামান মুহম্মদ ইলিয়াস হলেও মঞ্জু ডাকনামেও তিনি পরিচিত। পৈতৃক বাড়ি ছিলো বগুড়ায়। বগুড়া জিলা স্কুল থেকে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষা দিয়েছিলেন। এরপর চলে আসেন ঢাকায়। ঢাকা কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দেয়ার পর ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে, যেখান থেকে তিনি স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন।
কর্মজীবনে অধ্যাপনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন আগাগোড়া। জগন্নাথ কলেজের প্রভাষক পদ থেকে শুরু করে মিউজিক কলেজের উপধ্যাক্ষ, প্রাইমারি শিক্ষাবোর্ডের উপ-পরিচালক পদেও নিয়োজিত ছিলেন। পরবর্তীতে ঢাকা কলেজের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক এবং বিভাগীয় প্রধান হয়েছিলেন।
শিক্ষকতার পাশাপাশি আখতারুজ্জামান ইলিয়াস ছোটগল্প, প্রবন্ধ এবং উপন্যাস লেখালেখিতে সক্রিয় ছিলেন। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের প্রথম উপন্যাস ‘চিলেকোঠার সেপাই’ এবং এই উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৮৬ সালে।
যেমন উপন্যাস ‘চিলেকোঠার সেপাই’
লোকে বলে, একজন লেখক সারাজীবনে স্রেফ একটি সেরা উপন্যাস লিখতে পারে। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের চিলেকোঠার সেপাই হয়ত সেই উপন্যাস। তিনি উপন্যাসে ফুটিয়ে তুলেছেন গণঅভ্যুত্থান সময়কালীন গ্রাম-বাংলা ও নগর বাস্তবতা। এবং সেটি করেছেন বেশ সার্থকতার সাথেই। পাঠকে নিয়ে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন একদম ৫০ বছর আগের একখন্ড বাংলাদেশে। ১৯৬৯ সালের পূর্ব বাঙলা। কী এক জীবনস্পর্দহী মন্ত্রের মুখে বিস্ফোরিত চারদিক। যেখানে শোষণ চলেছে, চলেছে নির্মম হত্যাকান্ড। হচ্ছে মিছিল মিটিং, জ্বালাও পোড়াও। এর মাঝেই তিনজন ব্যাক্তির জীবন। যারা আন্দোলনের সাথে জড়িয়ে আছে ওতপ্রত ভাবে। যাদের হৃদয়ে জেগে ওঠে মুক্তির স্বাদ—মুক্তি।
মুক্তি? তার আসার পথও যে এরকম নয়। কেউ দাঁড়ায় এই সাড়িতে, কেউ দাঁড়ায় ঐ সাড়িতে। মুক্তির স্বাদ পেতে চায় সকলে।
এবার আসা যাক পাঠ পতিক্রিয়ায়। ‘চিলেকোঠার সেপাই’ নিঃসন্দেহে বাংলা সাহিত্যের মাইল ফলক স্পর্শি এক কিংবন্তি। আর এমন একটি কিংবদন্তি রচনা স্রেফ আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের দ্বারাই সম্ভব।
উপন্যাসের শুরুর দিকটা ধীর গতির। এটি লেখকের বৈশিষ্ট্য বলা চলে। তবে গল্পের মধ্যে প্রবেশ করার পরপরই বোঝা যায়, শুরুর দিকের ধীর গতির কারণ। একটা রাজনৈতিক উপন্যাস লিখতে বেশ কিছু ব্যাপারে খেয়াল রাখতে হয়। গল্প যদি বাস্তবধর্মী না হয় তাহলে সেটা স্রেফ একটা উপন্যাস হয়ে থেকে যায়। মানুষের হৃদয় স্পর্শ করতে পারে না। এক্ষেত্রে চিলেকোঠার সেপাই সফল। একদম বাস্তবাদী। মনেই হয়নি লেখকের সৃষ্টি এক জগতে আছে। মনে হবে পরিচিত বাস্তব জগতে বিচরণ করছে চরিত্রগুলো।
কোথাও কোনো রাখঢাক নেই। যেটা উপন্যাসের বেশ ভালো একটা দিক। যেখানে যেটুকু দরকার লেখক সেটুকুই ব্যবহার করেছেন। কোথাও বাড়িয়ে বলেন নি। অতিরঞ্জনের ছাপ ছিল না মোটেও। লেখক যেমন সফল ভাবে তৎকআলীন নগর জীবনকে ফুটিয়ে তুলেছেন, তেমনি সফল ভাবে একেছেন গ্রাম-বাংলার চিত্র। গ্রামের সংস্কৃতি, অপসংস্কৃতি দুটোই তুলে ধরেছেন।
সাহিত্যবিচারে বইয়ের কোনো খারাপ দিক বের করা সম্ভব হবে কি না সেটি আপেক্ষিক। আমার চোখে এই বইয়ে কোনো খারাপ দিক নেই। তবে ছাপাটা আরেকটু বড় ফন্টে হলে পাঠকদের সুবিধা হত। বানানের কোথাও কোন ভুল চোখে পড়ে না। প্রথম দিকে ধীর হলেও পরবর্তিতে লেখক বেশ দ্রুত গতিতেই একেরপর এক ঘটনা সাজিয়েছেন। লিখেছেন তিনটে টাইমলাইনে। একটি ওসমান, একটি খিজির আরেকটি আনোয়ারের। যেটিকে শেষে এসে মিলিয়ে দিয়েছেন দারুণভাবে। বইটি সকলের জন্যে অবশ্যপাঠ্য। নিজেদের স্বাধীনতা পূর্ব পূর্ববাংলা বা বর্তমান বাংলাদেশ এর থেকে সুন্দর করে উপস্থাপন করা সম্ভব না।
অসাধারণ , আমি তিতুমীর কলেজের বাংলা বিভাগের ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের ছাত্র । সামসুদ্দিন আহমেদের ভাইয়ের অসাধারণ অনুবাদ যজ্ঞে খুবই উপকৃত হলাম । ধন্যবাদ