গবেষণা: শিক্ষা গবেষণা কী এবং একজন শিক্ষকের গবেষক হওয়ার প্রয়োজনীয়তা
- প্রকাশ: ০৪:৪৩:৪৮ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১ জুন ২০২১
- / ১৮৬০২ বার পড়া হয়েছে
শিক্ষা গবেষণা কী এবং একজন শিক্ষকের গবেষক হওয়ার প্রয়োজনীয়তা | Photo by Taylor Wilcox on Unsplash
শিক্ষা গবেষণা
গবেষণা কী?
মানুষের মন সর্বদা কৌতূহলী। কৌতূহল থেকে মানুষের মনে নানা রকম প্রশ্ন জেগে ওঠে। কৌতূহল থেকে জেগে ওঠা প্রশ্নসমূহের উত্তর খোঁজার প্রক্রিয়াকে আমরা গবেষণা (research) বলতে পারি। গবেষণা হলো মানুষের বুদ্ধিবৃত্তিক অনুসন্ধান প্রক্রিয়া যা সত্য অনুসন্ধানের জন্য বিজ্ঞানভিত্তিক পদ্ধতি অনুসরণ করে পরিচালিত হয়। গবেষণাকে সত্য অনুসন্ধানের বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া বলা হয়।
পরীক্ষিত বিশেষ যুক্তিপূর্ণ নীতিমালার মাধ্যমে শিক্ষা গবেষণা পরিচালিত হয়। শিক্ষা গবেষণার মূল লক্ষ্য হলো বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর খোঁজা। শিক্ষা গবেষণার সংজ্ঞা এভাবে দেওয়া যায়, যথা- ‘সুপরিকল্পিত ও সুসংঘবদ্ধ পদ্ধতিতে ধারবাহিকভাবে তথ্য সংগ্রহ করে সেই তথ্যকে সঠিকভাবে বিশ্লেষণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে শিক্ষা ক্ষেত্রের নির্দিষ্ট কোনো সমস্যার নির্ভরযোগ্য ও গ্রহণযোগ্য সমাধান অনুসন্ধানের সাথে সংশ্লিষ্ট সকল কর্মকাণ্ডকে গবেষণা বলা হয়’।
শিক্ষা গবেষণার সংজ্ঞা ও ধারণা
শিক্ষাক্ষেত্রে নানা রকমের সমস্যা সমাধানের জন্য বিজ্ঞানভিত্তিক পদ্ধতি অনুসরণ করে যে অনুসন্ধান কার্যক্রম পরিচালনা করা হয় তাকে শিক্ষা গবেষণা বলে। একে ইংরেজিতে ‘educational research’ বলা হয়। ট্রেভার্স (Travers) শিক্ষা গবেষণা সম্পর্কে বলেছেন, “শিক্ষা গবেষণা হলো এমন কার্যক্রম যা শিক্ষামূলক পরিস্থিতির আচরণগত বিজ্ঞানের উন্নতিতে পরিচালিত হয়। এ বিজ্ঞানের চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো জ্ঞান সরবরাহ করা যা শিক্ষককে তাঁর সর্বোচ্চ কার্যকর উপায়ে লক্ষ্যে পৌঁছাতে সাহায্য করে।”
জ্ঞান-বিজ্ঞানের উন্নয়নের সাথে সাথে বভিন্ন ক্ষেত্রের পাশাপাশি শিক্ষাক্ষেত্রেও নতুন জ্ঞান সৃষ্টির জন্য গবেষণা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দিনে দিনে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও অঞ্চলে শিক্ষাবিজ্ঞানী, শিক্ষাবিদ ও মনোবিজ্ঞানীরা শিক্ষার বিভিন্ন দিক নিয়ে গবেষণামূলক কর্মকাণ্ড অব্যাহত রেখেছেন। শিক্ষা গবেষণার মাধ্যমেই শিক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত যে-কোনো সমস্যার সমাধান খুঁজে পাওয়া এবং নতুন নতুন জ্ঞান ও জ্ঞানক্ষেত্র সৃষ্টির লক্ষ্যে শিক্ষা গবেষণার আবির্ভাব।
শিক্ষা গবেষণা কঠোর ও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি মেনে পরিচালনা করা উচিৎ, এটি নিয়ে সকলেই একমত হলেও এর প্রমিতমান ও নির্দেশক কিংবা পদ্ধতি নিয়ে নানা মত রয়েছে। শিক্ষা গবেষণায় নানান মত প্রচলিত থাকলেও, এ ধরনের গবেষণায় সমাজবিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান, নৃ-বিজ্ঞান, দর্শন ইত্যাদি অন্তর্ভুকত হতে পারে।
শিক্ষা গবেষণার বৈশিষ্ট্য
যে-কোনো গবেষণা কর্মকাণ্ডেরই কতগুলো সর্বজনীন বিশেষত্ব সনাক্ত করা যায় যেগুলোকে ওই নির্দিষ্ট গবেষণার বৈশিষ্ট্য বা প্রকৃতি বলে উল্লেখ করা যায়। শিক্ষা গবেষণার বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য নিচে উল্লেখ করা হলো-
- শিক্ষা গবেষণা সুনির্দিষ্ট পদ্ধতির মাধ্যমে পরিচালিত হয়।
- শিক্ষা গবেষণায় বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়।
- ভুলত্রুটি এড়িয়ে সুনিপুন, ধারাবাহিক ও সঠিক অনুসন্ধানের মাধ্যমে শিক্ষা গবেষণা পরিচালনা করা হয়।
- শিক্ষা গবেষণা শিক্ষা সংক্রান্ত যাবতীয় সমস্যার সমাধানের নির্দেশনা পাওয়া যায়।
- শিক্ষা সংক্রান্ত নতুন জ্ঞানের যোগান দিয়ে থাকে শিক্ষা গবেষণা। এ ধরনের গবেষণার মাধ্যমে সাধারণ সূত্র ও তত্ত্বের আবিষ্কার হয়ে থাকে।
- শিক্ষা গবেষণার মাধ্যমে প্রাপ্ত নতুন জ্ঞান পুরাতন জ্ঞানের সাথে সংযোজন, বিয়োজন বা নির্দিষ্ট পার্থক্য গড়ে দিতে পারে। প্রাপ্ত নতুন তত্ত্ব, তথ্য বা জ্ঞানের সাথে পুর্বের তত্ত্ব, তথ্য বা জ্ঞানের সমন্বয় সাধনও শিক্ষা গবেষণার বৈশিষ্ট্য।
- শিক্ষা গবেষণা বাস্তব ও অভিজ্ঞতা ও তথ্যের ওপর নির্ভরশীল। সমস্যাগুলোও কঠোর যুক্তি প্রয়োগ করে বিশ্লেষন করা হয়।
- শিক্ষা গবেষণা পুনরায় অনুসন্ধান ও পুনরায় যাচাইযোগ্য হয়ে থাকে।
- শিক্ষা গবেষণা শিক্ষাগত অবস্থা সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করার লক্ষ্যে শিক্ষানীতি ও শিক্ষাতত্ত্বের সাধারণীকরণে বিশ্বাসী।
- শিক্ষা গবেষণা শিক্ষাসংক্রান্ত সঠিক তত্ত্ব গঠন ও ভ্রান্ত তত্ত্ব বা তথ্য অপসারণে নিবেদিত।
- শিক্ষা গবেষণার প্রতিবেদনে গবেষণার প্রতিটি সচেতনভাবে ও যত্নসহকারে লেখা হয়।
- কোনো শিক্ষা বিষয়ক প্রপঞ্চকে বোঝা, বিশ্লেষণ ও ব্যাখ্যা করার প্রচেষ্টার মধ্যেই শিক্ষা গবেষণার চেতনা নিহিত।
- শিক্ষাগবেষনা দুই বা ততোধিক চলকের মধ্যে সম্পর্ক নির্ধারণ করে কোনো সমস্যার সমাধান করে থাকে। এই চলকগুলোর মধ্যে ধনাত্মক বা ঋনাত্মক সম্পর্ক নির্ণয় করাই গবেষণার একটি বড়ো দায়িত্ব।
- পরিমাণগত ও গুণগত, দুই পদ্ধতিতেই শিক্ষা গবেষণা পরিচালনা করা যায় এবং ফলাফল প্রকাশ করা যায়।
- যথার্থতা ও নৈর্ব্যক্তিকতা শিক্ষা গবেষণার অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য। সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি বা কৌশল প্রয়োগের মাধ্যমে শিক্ষাগবেষনা পরিচালিত হয় বলে এটি ব্যক্তিপ্রভাব থেকে মুক্ত থাকে এবং গবেষণা নৈর্ব্যাক্তিক ও যথার্থ হয়।
- সঠিকভাবে শিক্ষা গবেষণা পরিচালনা করে যে ফলাফল পাওয়া যায় তার ওপর ভর করে ভবিষ্যতে কী ঘটবে তা সম্পর্কে অনেকাংশে বলে দেওয়া সম্ভব। অর্থাৎ শিক্ষাগবেষনার মাধ্যমে ভবিষ্যৎ ঘটনাপুঞ্জের ভবিষ্যদ্বাণী করা সম্ভব।
শিক্ষকের গবেষক হওয়ার যৌক্তিকতা বা প্রয়োজনীয়তা
শিক্ষক হলেন তিনি যিনি শিক্ষাদানের মতো মহান ব্রত পালন করে যাচ্ছেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদেরকে শিক্ষাদানের কাজে যারা নিয়োজিত থাকেন তাঁরা হলেন শিক্ষক। যে জাতির শিক্ষকগণ যত মানসম্পন্ন সে জাতি তত উন্নত। এই কথাটি প্রত্যেকেই স্বীকার করেন। আমরা অনেকেই বুঝে থাকি যে, শিক্ষক শুধু শ্রেণিকক্ষে প্রবেশ করে একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত সিলেবাস ধরে কিছু পড়িয়ে আসবেন। কিন্তু শিক্ষক হিসেবে এটিই তাঁর একমাত্র কাজ নয়।
একজন শিক্ষককে প্রথমে বোঝার চেষ্টা করতে হয় তাঁর শিক্ষার্থীদেরকে। শিক্ষার্থীরা কী চায়, শিক্ষার্থীদের শিখন চাহিদা কেমন, কোন বিষয়গুলো শিক্ষার্থীদের জন্য গুরুত্বপূর্ন, শিক্ষার্থীদের কোন পদ্ধতিতে শিক্ষাদান করা উচিৎ, শিক্ষাক্রম বা পাঠ্যসুচি ও শিক্ষার্থীদের মাঝে উপযুক্ত সেতুবন্ধন রচনা করা, ইত্যাদিসহ শিখন-শেখানো সম্পর্কিত দক্ষতা অর্জন করা জরুরি।
যে কারণে একজন শিক্ষককে গবেষণা করা প্রয়োজন তা উল্লেখ করা হলো-
- গবেষণার মাধ্যমে একজন শিক্ষক শিখন ও শিখনফল সম্পর্কে উপযুক্ত ধারণা লাভ করতে পারে।
- একজন শিক্ষক গবেষণার মাধ্যমে শিখন শেখানো দক্ষতার উন্নয়ন ঘটাতে পারে।
- গবেষণার মাধ্যমে কজন শিক্ষক শিখন পরিবেশ সম্পর্কে উপযুক্ত ধারণা লাভ করতে পারে।
- শ্রেণি-শিখন বা বিদ্যালয় শিখনে শিক্ষক নিজের সমস্যাগুলো চিহ্নিত করতে পারে এবং তা সমাধানের ব্যবস্থা নিতে পারে গবেষণার মাধ্যমে।
- গবেষণা একজন শিক্ষককে উত্তম পাঠপরিকল্পনা প্রণয়নে সহযোগিতা করে থাকে এবং সে পাঠপরিকল্পনা কীভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে সে সম্পর্কে নির্দেশনা প্রদান করে।
- শিক্ষার্থীদের শিখন মূল্যায়ন যে-কোনো শিক্ষাব্যবস্থারই একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য। শিখন শেখানো কার্যক্রমের পরে কখন, কোন পদ্ধতিতে, কত সময়ে বা কত সময়ের ব্যবধানে শিক্ষার্থীদের শিখন মূল্যায়ন করা উচিৎ সে সম্পর্কে শিক্ষক উপযুক্ত ধারণা লাভ করতে পারে এবং সে অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেওয়ার সক্ষমতা অর্জন করতে পারে গবেষণার মাধ্যমে।
- গবেষণা শিক্ষককে তথ্যের উৎস্য ও পেশাদার নেটওয়ার্কের সাথে যুক্ত করতে সাহায্য করে, যা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
- শিক্ষার্থীদের আচরণ ও প্রকৃতি বুঝতে গবেষণা একজন শিক্ষককে সহযোগিতা করতে পারে।
- শিক্ষক যে পদ্ধতি ও কৌশল প্রয়োগ করে শিক্ষাদানে অভ্যস্ত তা কতটুকু কার্যকর গবেষণা তা বুঝতে সাহায্য করে।
- শিখন শেখানো কার্যক্রমে শিক্ষককে সর্বোত্তম পদ্ধতি ও কৌশল সম্পর্কেও ধারণা প্রদান করতে পারে গবেষণা। শিক্ষার্থীদের জ্ঞানার্জনের পথ সুগম করার জন্য কোন শিক্ষণ পদ্ধতি সবচেয়ে ফলপ্রসূ হবে সে সম্পর্কে বিশদ ধারণা পাওয়া যায়।
- শিক্ষাদানে বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের ভিত্তি তৈরিতে শিক্ষা গবেষণা একজন শিক্ষককে সহযোগিতা করতে পারে।
- গবেষণা একজন শিক্ষককে তাঁর পেশার দায়বদ্ধতা বুঝতে সাহায্য করে করে এবং প্রাতিষ্ঠানিক দায়দায়িত্ব সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা প্রদান করে।
উপসংহার
শিখন শেখানো একটি জটিল প্রক্রিয়া যে প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই যেতে হয় একজন শিক্ষককে। এই জটিল প্রক্রিয়া তখনই সুন্দর ও সাবলীলভাবে সম্পাদন করে শিক্ষার্থীদের পরিপূর্ণভাবে শিখনফল অর্জনে শিক্ষক সহায়তা করতে পারবেন যখন তিনি নিজেকে গবেষক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে পারবেন। শিক্ষা গবেষণার মাধ্যমে শিক্ষক নিজেকে জানা থেকে শুরু করে শ্রেণিশিখন বা বিদ্যালয় শিখন, শিখন-শেখানো কৌশল, মূল্যায়ন, শিক্ষার্থীদের অবস্থা বোঝা, শিক্ষার্থীদের উন্নতিতে পদক্ষেপ গ্রহণ, প্রাতিষ্ঠানিক দায়িত্ব, সহকর্মিদের মনস্তত্ত্বসহ নানা বিষয়ে উপযুক্ত ধারণা পেতে পারেন যা তাঁর ব্যক্তিজীবন ও পেশায় সব সময় নির্দেশক হিসেবে কাজ করবে।
(আরও পড়ুন- গবেষণার সংজ্ঞা, ধারণা ও প্রকারভেদ)
আসাধারন লেখনি৷ ধন্যবার এতো সুন্দর ভাবে তুলে ধরার জন্য 🥰
ধন্যবাদ স্যার