প্রাচীন ভারতের সেরা পাঁচ বিশ্ববিদ্যালয়: নালন্দা, উদান্তপুরি, বিক্রমশীলা, সোমপুর ও জগদ্দল মহাবিহার
- প্রকাশ: ১২:০৭:৪১ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৭ জুন ২০২১
- / ৭৩৮১ বার পড়া হয়েছে
ভারতে বৌদ্ধরা ধর্ম, শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে গুরুত্বপুর্ণ অবদান রেখেছেন। গুপ্ত ও পালযুগে মগধ বা বরেন্দ্রি-মগধ অঞ্চলে (বাংলা ও বিহার) অনেকগুলো বৌদ্ধ বিহার ও মহাবিহার গড়ে উঠেছিল। এসব বিহার ও মহাবিহার ছিল বৌদ্ধ ধর্মের ধর্মীয় শিক্ষাকেন্দ্র। প্রথম দিকে এসব শিক্ষাকেন্দ্র থেকে শুধু ধর্মীয় শিক্ষা প্রদান করা হলেও পরবর্তীতে জীবনমুখী শিক্ষাও চালু হয়। এখানে বৌদ্ধ ভিক্ষু, পণ্ডিত, ধর্মগবেষণা ও ধর্মপ্রচারের সাথে যারা যুক্ত ছিলেন তাঁরা অবস্থান করতেন। বিহারগুলোতে আবাসিক ব্যবস্থার মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা ও গবষকরা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত অবস্থান করতেন। বাংলা ও বিহারে গড়ে ওঠা বিহার-মহাবিহার বা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শুধু বাংলা, বিহার বা ভারতীয় উপমহাদেশ থেকেই পণ্ডিত ও শিক্ষার্থীরা আসতেন না বরং তিব্বত, চীন, ব্রহ্মদেশ (মিয়ানমার), ইন্দোনেশিয়া প্রভৃতি দেশ থেকেও জ্ঞান অন্বেষণের জন্য আসতেন।
বাংলা ও বিহারে গড়ে ওঠা ও পরবর্তিতে ধ্বংসপ্রাপ্ত হওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে সেরা পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয় ছিল নালন্দা মহাবিহার, বিক্রমশীলা মহাবিহার, সোমপুর মহাবিহার, উদান্তপুরি মহাবিহার এবং জগদ্দল মহাবিহার। এই পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রাচীন ভারতের সেরা বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে ধরা হয়। মহাবিহারগুলো একই মডেল অনুসরণ করে গড়ে উঠেছিল। এসব বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই ভারতীয় শিক্ষায় আনুষ্ঠানিক ও জীবন ও কর্মমুখী শিক্ষার প্রচলন ঘটে। ভারতীয় উপমহাদেশের শিক্ষার ইতিহাসে এই পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
নালন্দা মহাবিহার বা নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়
ধারণা করা হচ্ছে খ্রিস্টিয় তৃতীয় শতক থেকে পঞ্চম শতকের কোনো এক সময় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয় নালন্দা মহাবিহার (Nalanda Mahavihara or Nalanda University)। কেউ কেউ বলেন, এই প্রাচীন নিদর্শনটি খ্রিস্টিয় সপ্তম শতক থেকে দ্বাদশ শতকের মধ্যে কোনো এক সময় নির্মিত হয়। তবে হারম্যান কুলকে এবং ডায়েটমার রদারমান্ড তাঁদের যৌথভাবে লিখিত ‘আ হিস্ট্রি অব ইন্ডিয়া’ বইয়ে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাকাল বলা হয় পঞ্চম শতককে। এ বিষয়ে নামিত অরোরা তাঁর রচিত ‘ইন্ডিয়ান: আ ব্রিফ হিস্ট্রি অব আ সিভিলাইজেশান’ বইয়ে লেখেন- নালন্দা মহাবিহার প্রথম কুমারগুপ্ত (Kumaragupta I) এর শাসনামলে প্রতিষ্ঠিত হয়, উপমহাদেশে প্রথম চৈনিক পরিব্রাজক ফা হিয়েন (Faxian) এর উপমহাদেশ থেকে প্রস্থানের অল্প সময় পরেই। পঞ্চম শতকের ৪১৪ থেকে ৪৫৫ সাল পর্যন্ত ছিল কুমারগুপ্তের শাসনামল, সুতরাং এ থেকে আমরা বলতে পারি, নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় বা নালন্দা মহাবিহার খ্রিস্টিয় পঞ্চম শতকের নিদর্শন। হর্ষবর্ধনও নালন্দা বিহারের উন্নয়নে পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন।
নালন্দা মহাবিহার স্থাপন করা হয়েছিল প্রাচীন ভারতের মগধে। মগধ আধুনিক ভারতের বিহার রাজ্য বলে পরিচিত। প্রাচীন ভারতের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়কে চিহ্নিত করা হয়েছে। এমন কি বিশ্বের সর্বপ্রথম বিশ্ববিদ্যালয় হলো নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়। এটি এখন স্বীকৃত যে, নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় হলো ভারতের সবথেকে প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়। নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়কে বলা হয় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বৌদ্ধ স্কলারদের মক্কা। চীনের তীর্থযাত্রী হিউয়েন সাং (Xuanzang or Hsiuen-tsang) ৬৩০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ৬৪৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত দীর্ঘ ১৩ বছর ভারতীয় উপমহাদেশে অবস্থান করেন যার মধ্যে টানা দুই বছর তিনি নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিলেন। নালন্দা ছিল বৌদ্ধ মহাযান শিক্ষাধারার কেন্দ্র। নালন্দার বহু আচার্য ও পণ্ডিত বাঙালি ছিলেন। অনেক ইতিহাসবিদ বলেন, নালন্দা বিহার ধ্বংস করেছিলেন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খলজি, ১৯৯৩ সালে।
নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল কমপক্ষে ১২ হেক্টর বা ৩০ একর জমির ওপর, যা ১৯১৫ থেকে ১৯৩৭ সালের প্রথম ধাপের খননকার্যের মধ্য দিয়ে জানা যায়। ২০১৬ সালে নালন্দা মহাবিহারের ধ্বংসাবশেষকে ৪০তম অধিবেশনে ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ তালিকাভুক্ত করেছে, এর রেফারেন্স নম্বর ১৫০২।
উদান্তপুরি মহাবিহার
খ্রিস্টিয় অষ্টম শতাব্দীতে পাল রাজা প্রথম গোপাল (Gopal I) বরেন্দ্র-মগধের রাজধানী পাটলিপুত্রে প্রতিষ্ঠা করেন উদান্তপুরি মহাবিহার বা উদান্তপুরি বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু এলিজাবেথ ইংলিশ এর বই ‘ভাজরায়োগিনি: হার ভিজুয়ালাইজেশন, রিচুয়ালস, অ্যান্ড ফরমস’ বই বলছে যে, এটি দেবপালের সময় নবম শতাব্দীতে গড়ে ওঠে। আধুনিক ভারতের বিহার রাজ্যের নালন্দা জেলায় গড়ে ওঠা মহাবিহারের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে ধর্মপালের নামও নেন কেউ কেউ। উয়াদন্তপুরিকে ওদন্তপুরী, ওদন্তপুর, ওদন্তপুরা, উদ্দন্তপুর, উদন্তপুর বা উদন্তপুরা নামেও ডাকা হয়।
উদান্তপুরি মহাবিহার বা বিশ্ববিদ্যালয়কে নালন্দা বিশবিদ্যালয়ের পর দ্বিতীয় প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে ধরা হয়। উদান্তপুরি মহাবিহারের মাধ্যমে বঙ্গের বৌদ্ধদের খ্যাতি নানাদিকে ছড়িয়ে পড়ে।
প্রচলতি ধারণা অনুযায়ী ১১৯৩ সালে মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খলজির আক্রমণে উদান্তপুরি মহাবিহার পুরোপুরি ধ্বংস হয়।
বিক্রমশীলা মহাবিহার
ধর্মপাল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বিক্রমশীলা মহাবিহার বা বিক্রমশীলা মহাবিহার (Vikramashila Mahavihara)। তিব্বতীয় বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের জন্য খুবই আকর্ষণীয় একটি বিহার ছিল বিক্রমশীলা মহাবিহার। এখানে অবস্থান করে তাঁরা ভারতীয় ভাষায় লেখা বিভিন্ন গ্রন্থ/পাঠ্য তিব্বতীয় ভাষায় অনুবাদ করতেন।
ধারণা করা হয় গুপ্ত সাম্রাজ্যের সময়ে প্রতিষ্ঠিত নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার মান কমে যাওয়ায় এর কাছাকাছি পাল সাম্রাজ্যের রাজা ধর্মপাল (প্রায় ৭৭০ থেকে ৮২১ খ্রি.) শ্রীজ্ঞান অতীশ দীপঙ্করসহ প্রভাবশালী পণ্ডিততের নিয়ে বিক্রমশীলা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। তবে বিক্রমশীলা যখন শ্রেষ্ঠ সময় পার করছিল, তখনও নালন্দার গৌরব একটুও কমেনি বলেই কুলকে ও রদারমান্ডের বইয়ে পাওয়া যায়। ধর্মপালের শাসনযুগ ছিল প্রায় ৭৯০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ৮২১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। যেহেতু পাল বংশের শেষ্ঠ রাজা ধর্মপাল বিক্রমশীলা মহাবিহার প্রতিষ্ঠা করেছেন, সেহেতু নিশ্চিতভাবে বলা যায়- এই বিক্রমশীলা মহাবিহার অষ্টম শতকের শেষে অথবা নবম শতকের শুরুতে প্রতিষ্ঠিত হয়। এ বিশ্ববিদ্যালয়টি বর্তমান বিহার রাজ্যের ভাগলপুর জেলার অস্তিচক গ্রামে অবস্থিত। নালন্দা ও উদান্তপুরি মহাবিহারের মতোই ১১৯৩ সালে মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খলজি বিক্রমশীলা মহাবিহার ধ্বংস করেন।
সোমপুর মহাবিহার বা পাহারপুর মহাবিহার
ইউনেস্কোর মতে পালবংশের দ্বিতীয় ও শ্রেষ্ঠ রাজা ধর্মপাল সোমপুর মহাবিহার (Somapura Mahavihara) প্রতিষ্ঠা করেন। তবে এলিজাবেথ ইংলিশ রচিত ‘ভাজরায়োগিনি: হার ভিজুয়ালাইজেশন, রিচুয়ালস, অ্যান্ড ফরমস’ বইয়ে পাওয়া যায়, সোমপুর মহাবিহার দেবপাল (Devapala) নবম শতাব্দীতে (৮১০-৮৫৯ খ্রি.) প্রতিষ্ঠা করেন। বর্তমানে ধ্বংসপ্রাপ্ত অষ্টম অথবা নবম শতাব্দীর একটি নিদর্শন। সোমপুর মহাবিহার একাধারে সোমপুরী মহাবিহার, পাহাড়পুর মহাবিহার, পাহাড়পুর বিহার, পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার, সোমপুর বিহার নামেও পরিচিত। এই সোমপুর মহাবিহার দক্ষিণ-হিমালয়ের দ্বিতীয় বৃহত্তম মহাবিহার। সোমপুর বিহার বা সোমপুর বিশ্ববিদ্যালয় আয়তনের দিক থেকে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় সমান। সোমপুর বিহার গড়ে উঠেছিল পুন্ড্রবর্ধনের রাজধানী পুন্ড্রনগর এবং কোটিবর্ষ এলাকার মাঝামাঝি স্থানে। এর দুইপাশে হলুদ বিহার ও সীতাকোট বিহার নামে ছিল আরও দুইটি শিক্ষাকেন্দ্র। সোমপুর মহাবিহারটি বর্তমান বাংলাদেশের নওগাঁ জেলার পাহাড়পুরে অবস্থিত।
সোমপুর মহাবিহার ৩০০ বছর ধরে বৌদ্ধদের বিখ্যাত ধর্ম শিক্ষাদান কেন্দ্র হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছিল। এটি ছিল মহাযান শিক্ষাধারার প্রধানতম কেন্দ্র। চীন, তিব্বত, ব্রহ্মদেশ (মিয়ানমার), ইন্দোনেশিয়া ইত্যাদি দেশের বৌদ্ধরা এখানে ধর্মজ্ঞান অর্জন করতে আসতেন। বিক্রমশীলা মহাবিহারের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা শ্রীজ্ঞান অতীশ দীপঙ্কর সোমপুর বিহেরর আচার্যের দায়িত্বও পালন করেছিলেন। প্রাচীন বাংলা তথা বাংলাদেশের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় ছিল সোমপুর বিশ্ববিদ্যালয়।
এই বিশ্বিবিদ্যালয়টি ধ্বংস করেন ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মাদ বিন বখতিয়ার খলজি। এটি ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ তালিকাভুক্ত। ১৯৮৫ সালে ইউনেস্কো এটিকে বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে যার রেফারেন্স নম্বর ৩২২।
জগদ্দল মহাবিহার
বরেন্দ্র অঞ্চল অর্থাৎ উত্তরবঙ্গে রামপাল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন জগদ্দল মহাবিহার (Jagaddala Mahavihara)। জগদ্দল মহাবিহার গড়ে উঠেছিল ১০৭৭ থেকে ১১২০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে কোনো এক সময়ে। একাদশ অথবা দ্বাদশ শতাব্দীতে প্রতিষ্ঠিত এই জগদ্দল মহাবিহার বা জাগাদ্দালা মহাবিহার ছিল ভারতীয় উপমহাদেশের সেরা পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি। জগদ্দল মহাবিহারটি বর্তমান বাংলাদেশের নওগাঁ জেলার ধামইরহাট উপজেলায় অবস্থিত। জগদ্দল বিশ্ববিদ্যালয়ের সেরা শিক্ষক ও আচার্যদের মধ্যে ছিলেন বিভূতিচন্দ্র, মোক্ষকরগুপ্ত ও শুভাকরগুপ্ত। পাল যুগের পতন হলে এখানের বৌদ্ধ পণ্ডিত ও ভিক্ষুরা তিব্বত বা তাঁদের জন্য নিরাপদ এমনসব জায়গায় চলে যান। ধীরেধীরে ধ্বংস হতে থাকে জগদ্দল মহাবিহার। ধারণা করা হয় মুসলমান শাসকদের মধ্যে কেউ একজনের নির্দেশে এটি পুরোপুরি ধ্বংস করা হয়। জগদ্দল মহাবিহারের ধ্বংসাবশেষ ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের তালিকাভুক্ত হবার অপেক্ষায় আছে।
শেষকথা
নালন্দা, বিক্রমশীলা, উদান্তপুরি, সোমপুর এবং জগদ্দল মহাবিহারগুলো একই মডেল অনুসরণ করে গড়ে উঠেছিল। এই পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয় যেমন একই মডেলে গড়ে উঠেছিল, তেমনই এগুলো মধ্যে আন্তঃযোগাযোগও ভালো ছিল। ধারণা করা হয় নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার মান কমে যাওয়ায় বিক্রমশীলা বা উদান্তপুরির মতো বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠেছিল কিন্তু নালন্দার জৌলুষ কখনোই কমেনি। প্রাচীন বাংলা ও বিহারের প্রতিটি বিশবিদ্যালয়েরই বহু আচার্য ও পণ্ডিত বাঙালি ছিলেন।
ভালো সংযোজন।