তত্ত্বাবধান: শিক্ষায় তত্ত্বাবধায়কের দায়িত্ব ও তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে প্রধান শিক্ষক
- প্রকাশ: ১২:০৭:১২ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৬ জুন ২০২১
- / ১৩০৪৭ বার পড়া হয়েছে
তত্ত্বাবধান শব্দটি ইংরেজি Supervision শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। Supervision কোনো মৌলিক শব্দ নয়, যৌগিক শব্দ। এখানে Super শব্দের বাংলা অর্থ হল অধিক আর Vision শব্দটির অর্থ দেখা। তাৎপর্যগতভাবে বিবেচনা করলে Supervision শব্দটির অর্থ ‘অধিদর্শন’। এখানে একজন ব্যক্তির সার্বক্ষণিক উপস্থিতি ছাড়াও নির্দেশনা ও নিয়ন্ত্রণ বুঝায়।
তত্ত্বাবধান হলো কোনো কিছু দেখা, তদারকি করা, রক্ষণাবেক্ষণ করা; অর্থাৎ কোনো কাজ শুরু করার পর তা পরিকল্পনামাফিক, সুষ্ঠু নিয়মমাফিক উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য অর্জনের জন্য সঠিকভাবে সম্পাদিত হচ্ছে কি না তা যত্নসহকারে পর্যবেক্ষণ করা। আবার এভাবেও বলা যায়- তত্ত্বাবধান হলো নিবিড় পর্যবেক্ষণ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্দেশনা প্রদানপূর্বক কাজের সার্বিক দিকের প্রতি দৃষ্টিদান। আর এটি যখন শিক্ষাক্ষেত্রে হয়ে থাকে তখন তা শিক্ষা তত্ত্বাবধান নামে পরিচিতি লাভ করে। শিক্ষায় তত্ত্বাবধান হলো শিক্ষার উন্নয়নে পরিকল্পনামাফিক লক্ষ্য অর্জনের জন্য সঠিকভাবে সম্পাদিত হচ্ছে কি না তা পর্যবেক্ষণ করা।
কোনো কাজ পরিকল্পনামাফিক সম্পাদিত হচ্ছে কি না তদারকি বা নিবিড় পর্যবেক্ষণের দায়িত্বে নিয়োজিত ব্যক্তিকে বলা হয় তত্ত্বাবধায়ক। তত্ত্বাবধায়কের ইংরেজি প্রতিশব্দ supervisor।
শিক্ষায় তত্ত্বাবধায়ক
বর্তমান পৃথিবীর সকল দেশে শিক্ষার উপর নানা গবেষণা চালানো হচ্ছে। কিসে শিক্ষার্থীরা উপকৃত হবে বা কীভাবে শিক্ষকের পেশাগত দক্ষতার উন্নয়ন ঘটানো যায়, এ লক্ষ্যে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন থেকে শুরু করে শিক্ষক তত্ত্বাবধায়কের মূল্যায়ন করার প্রক্রিয়া অব্যাহত গতিতে চলছে। দিনদিন শিক্ষার চাহিদা যেমন বৃদ্ধি পাচ্ছে তেমনি নতুন নতুন সমস্যারও সৃষ্টি হচ্ছে শিক্ষা ক্ষেত্রে। তাই শিক্ষা ক্ষেত্রে তদারকি করার জন্য অত্যাধিক জোর দেওয়া হচ্ছে।
তত্ত্বাবধায়ক শুধু তদারকিই করবেন না তাঁকে দিক নির্দেশনাও দিতে হয়, তাই এক্ষেত্রে তত্ত্বাবধায়ককে তাঁর দায়িত্ব সম্পর্কে অত্যন্ত সচেতন থাকতে হয়। শিক্ষায় বিস্তৃতি ঘটার সাথে সাথে তত্ত্বাবধায়কের দায় দায়িত্ব বেড়ে যাচ্ছে। ফলে সব সময় তাঁকে ব্যস্ত থাকতে হয়। উন্নত বিশ্বে এই অবস্থা অধিক লক্ষ্যনীয়।
শিক্ষাক্ষেত্রে তত্ত্বাবধায়কের কিছু গুরুত্বপূর্ণ দায় দায়িত্ব:
শিক্ষাক্ষেত্রে একজন তত্ত্বাবধায়ককে বিভিন্ন রকম দায়িত্ব পালন করতে হয়, নিম্নে বেশ কিছু দায়িত্ব সম্পর্কে উল্লেখ করা হলো-
- তত্ত্বাবধায়কের বিদ্যালয় তত্ত্বাবধানকালে প্রথম কাজই হল বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের যাতে শিক্ষক এবং প্রধান শিক্ষক ভালো ভাবে বুঝতে সক্ষম হন তাতে সহায়তা করা। এক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের নাম-পরিচয় এবং তার পারিবারিক পরিবেশ সম্পর্কে অবগত হতে হয়। এতে শিক্ষক যেমন তাঁর পাঠদানে সফল হবেন তেমনি শিক্ষার্থীরাও ক্রমে ক্রমে শিক্ষকের কাছাকাছি আসার সুযোগ পাবে। এতে উভয়ের মধ্যে যে Rapport বা হ্রিদ্যতাপূর্ন সম্পর্ক গড়ে উঠবে তাতে শিক্ষার্থীদের শিক্ষাক্ষেত্রে বিচরণ আরো মসৃণ হবে।
- শিক্ষকদেরকে তাঁদের কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার ক্ষেত্রে সাহায্য সহযোগিতাদান এবং শিক্ষক ও অন্যান্য স্টাফের মধ্যে সমন্বয় সাধন করা হচ্ছে একজন তত্ত্বাবধায়কের অন্যতম কাজ। কারণ শিক্ষা হচ্ছে যৌথ প্রচেষ্টার এক কর্মপ্রক্রিয়া, তাই সবার সঙ্গে সম্পর্ক, সমন্বয় যত ভাল হবে শিক্ষাদান কাজ তত সহজ হবে।
- শিক্ষার নানাবিধ উপকরণের সঙ্গে শিক্ষকদের পরিচয় করিয়ে দেওয়া এবং শিক্ষাপোকরণকে আরো কার্যকর ব্যবহারের জন্য এবং কার্যকর ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য স্কুল কর্মচারিদের সর্বোত্তমভাবে সাহায্য প্রদান। এমন বহু বিদ্যালয় আছে যেখানে বহু শিক্ষাপোকরণ মজুদ থাকলেও শিক্ষকগণ তা ব্যবহার করেন না, এক্ষেত্রে তত্ত্বাবধায়ক এগুলো ব্যবহারে উদ্বুদ্ধকরণ, ব্যবহারে কৌশল এবং ফলাফল সম্পর্কে শিক্ষকদের অবগত করবেন। উপকরণ বলতে বই, বোর্ড, চক/মার্কার, ডাস্টার, মানচিত্র, বিজ্ঞানাগারের যন্ত্রপাতি ইত্যাদি বোঝানো হয়েছে। প্রয়োজনে তত্ত্বাবধায়ক উপকরণ তৈরিতে সহায়তা করবেন।
- শিক্ষককে তাঁর শিক্ষাদান পদ্ধতির উন্নতির জন্য সকল প্রকার সাহায্য সহযোগিতা প্রদান করবেন। কোন বিষয় কোন পদ্ধতিতে পড়ালে শিক্ষার্থী অধিক উপকৃত হবে সে সম্পর্কে শিক্ষককে পরামর্শ দান করবেন।
- বিদ্যালয়ে কর্মরত বিশেষজ্ঞ অভিজ্ঞ ব্যক্তিবর্গ যাতে স্কুল শিক্ষকদের সর্বাধিক সাহায্যে আসতে পারে তার জন্য তত্ত্বাওবধায়ক যথাসাধ্য চেষ্টা করবেন। সহজ করে বলতে গেলে বলতে হয় বিদ্যালয়ে অনেক প্রশিক্ষন প্রাপ্ত শিক্ষক আছেন যাদের সংস্পর্শে, সহায়তার অন্যান্য প্রশিক্ষণ বিহীন শিক্ষকগণ উপকৃত হতে পারে যা শিক্ষকদের বুঝতে হবে। আর এই বিষয়টি তত্ত্বাবধায়ক সকলকে অবগত করবেন যে, বাইরের বিশেষজ্ঞ আনার আগে নিজেদের সম্পদের সদ্ব্যব্যবহার করতে সক্ষম হওয়া দরকার। এখানে সম্পদ বলতে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত ও অভিজ্ঞ শিক্ষকদের বোঝানো হয়েছে।
- কীভাবে শিক্ষার্থীদের বিষয়বস্তু আরও ভালো করে বুঝানো যায় সে সম্পর্কে ধারণা অর্জনের জন্য শিক্ষকদের তত্ত্বাবধায়ক সাহায্য করবেন। পাশাপাশি উত্তম পন্থায় যে সকল উপায়ে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করা যায়, সে সকল পন্থা অবলম্বনের জন্য শিক্ষকদের সহযোগিতা করবেন তত্ত্বাবধায়ক যাতে শিক্ষকগণ সহজেই শিক্ষার্থীদের অগ্রগতি বুঝতে পারেন বা শিক্ষার্থীরা কোনো কিছু বুঝতে পেরেছে কি না বা বুঝলে কতটুকু বুঝেছে সে সম্পর্কে ধারণালাভ করতে পারবেন।
- তত্ত্বাবধায়ক একজন শিক্ষককে তাঁর কাজ, কাজের পরিকল্পনা এবং উন্নতির মূল্যায়নে অনুপ্রাণিত করবেন যাতে সে আরও কাজ করতে আগ্রাহান্বিত হয় ও সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে সক্ষম হয়।
- তত্ত্বাবধায়কের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব হল শিক্ষজকের পাঠ পরিকল্পনা তৈরিতে সাহায্য প্রদান। পাঠ পরিকল্পনা তৈরির অর্থই হলো পাঠদানের বিষয়বস্তুর আগাম প্রস্তুতি। কারণ শিক্ষাদানের কোনো কার্যকর পদ্ধতি জানা না থাকলে শিক্ষক প্রকৃত, ফলপ্রসূ শিক্ষাদান করতে পারেন না। আর এক্ষেত্রে শিক্ষকের কাজ এবং পড়ানোতে উন্নতি আনয়নের জন্য প্রয়োজন পাঠ পরিকল্পনা। বিষয়বস্তুর ধারাববাহিকতা রক্ষা করে যদি তা উপস্থাপনব করা যায় তাহলে শিক্ষার্থীরা যেমন উপকৃত হবে তেমনি শিক্ষকদের মনে আসে প্রশান্তি। আর এ দুয়ের মধ্যে যোগসূত্র স্থাপন করেন তত্ত্বাবধায়ক।
- একজন তত্ত্বাবধায়ক শিক্ষকদের সহযোগিতামূলক ভাবে পাঠ্যক্রম প্রনয়নে অনুপ্রাণিত করার ক্ষেত্রে ও দায়িত্ব পালন করবেন। যুগের সাথে তাল রেখে যুগোপযোগী পাঠ্যক্রম তৈরি, বয়সানুপাতে পাঠ্যসূচি প্রণয়ন হয়েছে কিনা এসব ক্ষেত্রেও তত্ত্বাবধায়ক শিক্ষকদের প্রয়োজনে সহায়তা করবেন।
- তত্ত্বাবধায়কের দায়িত্ব হল বিদ্যালয়ের সার্বিক কর্মসুচি এবং সকল প্রকার উন্নতি সম্পর্কে ছাত্র, শিক্ষক, অভিভাবক এবং জনসাধারণকে তথা সমাজকে অবহিত করার ক্ষেত্রে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে সাহায্য করা। কারণ এতে সাধারণ লোকের মাঝে বোধ জাগ্রত হবে যে, বিদ্যালয় সামাজিক প্রতিষ্ঠান হলেও এতে আমাদের সম্পৃক্তি এবং অবগবতি মানেই একসঙ্গে একাত্ম হওয়া, যা বিদ্যালয়ের প্রতি তাঁদের আগ্রহ উৎসাহ বাড়িয়ে তুলবে।
তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব
বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের দুই ধরণের দায়িত্ব পালন করতে হয়। একটি হচ্ছে প্রশাসনিক ভূমিকা আরেকটি তত্ত্বাবধায়নি ভূমিকা। তবে এখানে উল্লেখ্য যে, প্রধান শিক্ষকের প্রশাসনিক ভূমিকার আওতায়ই তত্ত্বাবধায়নিক ভূমিকা বা দায়িত্ব নিহীত। নিচে প্রধান শিক্ষকের তত্ত্বাবধায়নিক দায়িত্ব সমূহ তুলে ধরা হল‑
- বিদ্যালয়ের পরিবেশ উন্নত করা
- বিধি মোতাবেক ম্যানেজিং কমিটি গঠন করা
- শিক্ষার মান উন্নয়নে প্রধান শিক্ষক হবেন একজন গঠনমূলক সমালোচক
- বিদ্যালয়ে শৃঙ্খলা আনয়নপূররবক শিক্ষা প্রক্রিয়ার উন্নতি বিধানের চেষ্টা
- শিক্ষকদের সকল প্রত্যাশিত কাজে অনুপ্রেরণার উৎস
- শিক্ষকদের শিখন প্রক্রিয়া তত্ত্বাবধান
- শ্রেণিকক্ষে নতুন শিক্ষকের পাঠদান পর্যবেক্ষণ ও প্রয়োজনে সাহায্য প্রদান
- শিক্ষকদের পেশাগত দক্ষতা উন্নয়নে ব্যবস্থা করা
- পাঠ পরিকল্পনা প্রণয়নে সাহায্যদান
- পাঠদানের জন্য উপকরণের ব্যবস্থা করা
- শিক্ষার যুগোপযোগী ভাবধারার সাথে শিক্ষকদের পরিচয় করিয়ে দেওয়া
- বিদ্যালয়ের উন্নতমানের পাঠাগার ও ল্যাবের ব্যবস্থা করা
- বিদ্যালয়ে শিক্ষকদের নিয়মত উপস্থিতি ও শ্রেণিকক্ষে গমন পর্যবেক্ষণ
- পরীক্ষার প্রশ্নপত্র প্রনয়নে ও তৈরিতে সাহায্য করা
- বিদ্যালয়ের মূল্যায়ন কর্মসুচি তদারকি ইত্যাদি
উপর্যুক্ত দায়িত্বগুলো পালন করার ক্ষেত্রে একজন প্রধান শিক্ষককে অত্যন্ত উদার ও গনতান্ত্রিকমনা হতে হবে, তা না হলে শিক্ষার উন্নতিকল্পে যে ভূমিকা পালন তা প্রধান শিক্ষকের অপূর্ণ থেকে যাবে।
শেষকথা
তত্ত্বাবধান কাজ যেহেতু যৌথ প্রচেষ্টা বা উদ্যোগের সেহেতু শিক্ষক এবং তত্ত্বাবধায়ক উভয়কেই এক্ষেত্রে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে সহমর্মিতার সঙ্গে কাজ করে যেতে হবে। তাহলেই কেবল সম্ভব শিক্ষার সার্বিক মানোন্নয়ন তথা গোটা জাতির ও দেশের উন্নয়ন।
*গ্রন্থসূত্র: শিক্ষা প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনা, হোসনে আরা বেগম এবং জাকির হোসেন