উন্নয়ন কী? উন্নয়নের সংজ্ঞা এবং উন্নত, উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশের বৈশিষ্ট্য
- প্রকাশ: ১২:৪৮:০০ অপরাহ্ন, বুধবার, ৩০ জুন ২০২১
- / ৫২০২৫ বার পড়া হয়েছে
সিয়োল, উন্নত দেশ দক্ষিণ কোরিয়ার একটি শহর | Photo by Sugarman Joe on Unsplash
আমরা যখন কোনো দেশ বা অঞ্চলের প্রতি তাকাই তখন আমরা আমরা আপাতদৃষ্টিতে বলে দিতে পারি- কোন দেশটিতে উন্নয়নের অবস্থা কেমন। আমরা খুব সহজেই বলে দেই যে, কোন দেশ বা অঞ্চল উন্নত অনুন্নত। এই ভাসাভাসা ধারণা থেকে আমরা উন্নয়নকে সাধারণভাবে বুঝতে পারলেও সেই উন্নত বা অনুন্নত সমাজ, দেশ বা অঞ্চলে সম্পদ কীভাবে বন্টিত হচ্ছে তা জানা বা বোঝা সম্ভব হয় না। সমাজে বিভিন্ন শ্রেণিতে উপার্জন, উপার্জনের ন্যায়সঙ্গত বণ্টন, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে সম্পদের বরাদ্দ ও ব্যবহারের পরিমাণ, মোট উৎপাদনের পরিমাণ ও মোট উৎপাদনের কত অংশ জনগণ ভোগ করছে, জীবনমান কেমন ইত্যাদি সম্পর্কে জানতে হলে উন্নয়ন সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা থাকা প্রয়োজন।
গড় আয়ের দিক থেকে যে সব রাষ্ট্র সমান অবস্থানে রয়েছে, সে সব রাষ্ট্রের জীবন যাত্রার মানে উল্লেখযোগ্য পার্থক্য বিদ্যমান। এছাড়াও শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্ম, সুযোগ, বিশুদ্ধ পরিবেশ, নিরাপদ বায়ু ও পানি, অপরাধ-অরাজকতা ইত্যাদি দিক থেকেও আমরা এক দেশের সাথে অন্য দেশের পার্থক্য সনাক্ত করতে পারি, সে সব দেশের গড় আয় সমান হবার পরেও। আর আয়ের সাথে উল্লেখিত বিষয়গুলোকে বিশ্লেষণ ও বিচার করে একেকটি দেশের উন্নয়নের চিত্র তুলে ধরা যায় এবং অন্য একটি দেশের উন্নয়নের সাথে তুলনা করা যায়। আমরা এর মাধ্যমে বুঝতে পারি কোন রাষ্ট্র কম উন্নত এবং কোন রাষ্ট্র বেশি উন্নত।
সনাতন প্রথায় উন্নত ও অনুন্নত অবস্থা প্রকাশ করার জন্য উপার্জনের উপর গুরুত্বারোপ করা হতো। কিন্তু আধুনিক ধারণা অনুযায়ী শুধু উপার্জনের ওপর দারিদ্র্য ও জীবনযাত্রার মান নির্ভর করে না। উন্নত জীবনমানের ক্ষেত্রে উপার্জন ছাড়াও উপার্জন বা আয় ছাড়াও বেশ কিছু বিষয় যুক্ত রয়েছে। এর জন্যই সকলের উন্নয়নের প্রকৃত ধারণা থাকা উচিৎ।
উন্নয়নের অর্থ, সংজ্ঞা ও ধারণা এবং উন্নত, উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশের বৈশিষ্ট্য
উন্নয়ন, দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধ এবং তৃতীয় বিশ্ব
উন্নয়ন হলো কোনো রাষ্ট্রের সিংহভাগ নাগরিকের মৌলিক চাহিদা মিটিয়ে তাদের সন্তুষ্ট করার জন্য এবং সরকারি চাহিদা অনুসারে তাদের কর্মে নিয়োজিত করার জন্য উচ্চ পর্যায়ের উৎপাদনকে লক্ষ্য করে মানবসম্পদ উন্নয়ন ক্ষমতা। উন্নয়ন সম্পর্কে এই সংজ্ঞাটি অর্থনীতি সম্পৃক্ত। দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের পরবর্তী দশক থেকে পৃথিবীর অধিকাংশ দেশ তাদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের জন্য প্রবলভাবে কাজ করা শুরু করে। আফ্রিকা, এশিয়া, ল্যাটিন আমেরিকা, ক্যারিবিয়ান অঞ্চল এবং দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগর উপকুলীয় দেশগুলোতে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তনের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ উন্নয়নের প্রয়োজন লক্ষ্য করা যায়। এ সকল দেশের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বিভিন্ন উপাদান ও বৈশিষ্ট্য অনেকটা একই রকম। উন্নত দেশগুলোকে থেকে পিছিয়ে পড়া উল্লেখিত অঞ্চলের দেশগুলোকে যথাক্রমে অনুন্নত, নিম্ন-উন্নয়নশীল এবং উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। নিম্ন-উন্নয়নশীল ও উন্নয়নশীল দেশুলোকে বলা হয় তৃতীয় বিশ্বের দেশ (Third World Country)।
বিশ্বের বহু অর্থনিতিবিদ ও বিশিষ্ট পন্ডিত ব্যাক্তিরা মনে করেন তৃতীয় বিশ্বের এইসব দেশ উন্নয়নের জন্য পাশ্চাত্যের মুখাপেক্ষী হয়ে পড়েছে। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো বিভিন্ন ধরনের অনুদান সংগ্রহের জন্য তাদের আগ্রহ প্রকাশ করে। পাশাপাশি তৃতীয় বিশ্বের নেতৃত্বস্থানীয় ব্যক্তিরা নিজ নিজ দেশের উন্নয়নের জন্য নাগরিকদের উদ্ভুদ্ধ করেন এবং সে অনুযায়ী নানা রকম নীতিমালা, কর্মসুচি ও প্রকল্প হাতে নিয়ে থাকেন।
উন্নয়ন অর্থ, উন্নয়নের সংজ্ঞা বা উন্নয়ন কাকে বলে
প্রকৃতপক্ষে ‘উন্নয়ন’ হলো এমন একটি তাৎপর্যপূর্ণ শব্দ, যার কোনো সুনির্দিষ্ট অর্থ নেই। ‘উন্নয়ন’ শব্দটির সমার্থক শব্দসমূহের মধ্যে আছে বিস্তৃতি, প্রসারণ, বিবর্তন, বৃদ্ধি, প্রগতি, অগ্রগতি, উত্তরণ, বিকাশ ইত্যাদি। আবার ‘উন্নয়ন’ শব্দের বিপরিতার্থক শব্দগুলোর মধ্যে যা আছে তা হলো- প্রত্যাবৃত্তি, পশ্চাদগমন করা, প্রত্যাবর্তন করা ইত্যাদি।
সাধারণভাবে বলা যায় – উন্নয়ন হলো অগ্রগতি, বৃদ্ধি অথবা ব্যপকতার ফল স্বরূপ প্রাপ্ত হয়েছে এমন কিছু। অভিধানে উন্নয়নকে সংক্ষেপে বলা হয়েছে, “A process of unfolding, maturing and evolving.”। উন্নয়নের এই অর্থ ও ধারণা মানব সমাজের ক্ষেত্রেও একইভাবে প্রযোজ্য। উন্নয়ন হলো কোনো কিছুর কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন বা উত্তরণ।
বিশেষজ্ঞদের মতে উন্নয়ন অর্থ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঘটিয়ে দেশ তথা জাতিকে আধুানকায়নের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া ও দেশের সঞ্চয়, বিনিয়োগ, উৎপাদন এবং জাতীয় আয় বৃদ্ধি এসব নিশ্চিত করা। অ্যাডাম স্মিথ জাতীয় উন্নয়ন বলতে সামগ্রিকভাবে পুঁজি সঞ্চয়নকে বুঝিয়েছেন। সেসময় অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রবক্তারা মাথাপিছু আয়ের প্রবৃদ্ধিকে জাতীয় উন্নয়ন মনে করতেন।
ষাটের দশকে বলা হতো জাতীয় আয় বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তা দেশের দেশের উন্নয়ন হয়। কিন্তু জাতীয় আয় উন্নয়নের প্রকৃত বহন করে না। কারণ জাতীয় আয়কে দেশের মোট জনসংখ্যা দিয়ে ভাগ করে মাথাপিছু আয় দেখালেও জনসাধারণ তার সুফল থেকে বঞ্চিত থেকে যায়।
সত্তরের দশকে জনগণের প্রকৃত কল্যাণ সামনে রেখে প্রবৃদ্ধির পুনর্বন্টনের দৃষ্টিকোণ থেকে অর্থনৈতিক উন্নয়নের ব্যাখ্যা দেয়া হয়, এর পাশাপাশি সামাজিক উন্নয়ন, রাজনৈতিক উন্নয়ন, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার প্রসঙ্গও জুড়ে দেওয়া হয়। তবে সত্তরের দশকে প্রচলিত উন্নয়নের সংজ্ঞায় মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণের প্রসঙ্গ বাদ থেকে যায়।
জাতীয় আয় যদি মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে সক্ষম হয় তবে তাকেই প্রকৃত উন্নয়ন বলা যাবে।
বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মতে উন্নয়নের সংজ্ঞা
- নাটা বলেছেন, “উন্নয়ন হলো প্রচ্ছন্ন উৎপাদনের একটি প্রসারণ”।
- শুমপিটার বলেছেন, “উন্নয়ন হলো বাহ্যিক উদ্দীপনার ফলশ্রুতি”।
- কিল্ডালবার্গার ও হেগেলে বলেছেন, “উন্নয়ন হলো কাঠামোগত পরিবর্তনের সাথে উৎপাদন বৃদ্ধি”।
- বয়ার ও ইয়াম বলেছেন, “উন্নয়ন হলো জীবনযাত্রার সুযোগ-সুবিধাদির পছন্দগত সম্প্রসারণ”।
- হার্বিসন ও মায়ার্স বলেছেন “অর্থনৈতিক উন্নয়ন হলো একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে দীর্ঘ সময় একটি দেশের মানুষের প্রকৃত মাথাপিছু জাতীয় আয় বৃদ্ধি পায়”।
- Mahbubul Haq, Paul Stitin, James Grants and others (1970) বলেন, “সকল মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণই হলো অর্থনৈতিক উন্নয়ন”।
- ILO বলেছে, “মানুষের জন্যে খাদ্য ও পুষ্টি, মৌলিক শিক্ষা, স্বাস্থ্য পরিচর্যা, স্যানিটেশন, বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ, গৃহায়ন ইত্যাদি সুবিধা সৃষ্টি করাই উন্নয়ন”।
- প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, “উন্নয়ন অর্থ হলো দেশের নিচের অর্ধেকাংশ (আয় বিন্যাসে যারা মধ্যম আয়ের নিচে অবস্থান করে) মানুষের জীবনে অর্থনৈতিক উন্নতি”। তাঁর মতে, যে কর্মসূচি বা কর্মোদ্যোগ দেশের নিচের অর্ধেকাংশ মানুষের মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি করতে সহায়ক হবে সেটাকেই শুধু উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বলা যাবে।
- অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন বলেছেন্ম “উন্নয়ন হলো মানুষের স্বাধীনতাকে সম্প্রসারিত করার প্রক্রিয়া”। তিনি মনে করেন, উন্নয়ন মানে স্বাধীনতা। নোবেল বিজয়ী অমর্ত্য সেন প্রমাণ করেছেন যে, শুধু নিম্ন আয়ই নয়; স্বাস্থ্য, শিক্ষা, খাদ্য ইত্যাদি মৌলিক চাহিদার পশ্চাদমুখীতাই দারিদ্রের অন্যতম কারণ।
উন্নয়ন সম্পর্কিত ধারণা
সরকার যদি কৃষিকাজের জন্য জনসাধারণকে পানির পাম্প বিতরণ করে, তাহলে যতদিন এই বিতরণ কার্যক্রম চলবে ততদিন কৃষিক্ষেত্রে পানির অভাব হবে না বরং জীবনযাত্রার মান ভালো থাকবে, কিন্তু এই পাম্প বিতরণ বন্ধ হয়ে গেলে যদি পুনরায় পানির অভাবে কৃষিকাজ বন্ধ থাকে এবং মানুষের দুরবস্থা ফিরে আসে তাহলে পাম্প বিতরণকে উন্নয়নের সূচক বলা যাবে না। যদি বিতরণ করা পাম্পের কার্যকারিতা ও যৌক্তিক ব্যবহার টেঁকসই হয় এবং তা জনকল্যাণে ভূমিকা রাখে তাহলে তাকে উন্নয়ন বলা যাবে।
প্রফেসর ড. অমর্ত্য সেন মনে করেন যে, কোনো জাতি যদি কোনো সময়ের জন্য উন্নত জীবনযাপন করে তবে তাকে উন্নয়ন বলা যাবে না; উন্নয়নের গূঢ় অর্থ হলো ইতিবাচক উন্নত পরিবর্তনের স্থায়ীত্ব। ড. সেন বলছেন, অবস্থার স্থায়ীত্বই মুখ্য বিষয়; যা জনসাধারণের জীবনে শুধু অথনৈতিক ক্ষেত্রেই না, রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ইত্যাদি ক্ষেত্রেও একটি টেকসই, দীর্ঘমেয়াদী ও সুদূর প্রভাব বিস্তার করে।
প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস মনে করেন, অর্থনৈতিক দিক থেকে সমাজের সর্বনিম্ন অবস্থানে যারা জীবনযাপন করে তাদের অবস্থার উন্নতি না হলে দেশের সার্বিক উন্নয়ন হয়েছে বলে মানা যায় না। অর্থনৈতিকভাবে নিম্ন অবস্থানে আছে, তাদেরকে লক্ষ্য করে পরিকল্পনা করতে হবে হবে বলে ড. ইউনূস মত দেন। ড. ইউনূস বলেছেন যে, উন্নয়ন পরিকল্পনা করতে হবে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে অর্থনীতির সবচেয়ে নিম্নস্তরে অবস্থানকারী জনগণের জন্য।
জাতিসঙ্ঘ উন্নয়ন কর্মসুচির (UNDP) মতে, উন্নয়ন বলতে এমন একটি প্রক্রিয়াকে বোঝায় যা মানুষকে তার পছন্দমতো জীবনযাত্রার সুবিধা ও মান বেছে নেয়ার সুযোগ দেয়।
উপর্যুক্ত আলোচনা থেকে বলা যায়, উন্নয়ন হলো একটি অব্যাহত পরিবর্তন প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে কোনো দেশের জাতীয় আয়ের প্রবৃদ্ধি ঘটবে, সঞ্চয় বৃদ্ধি পাবে, সম্পদের সুষম বণ্টন সম্পন্ন হবে এবং বৃহত্তর জনগোষ্ঠির মৌলিক চাহিদা অপেক্ষাকৃত স্থায়ীভাবে পূরণ করা সম্ভব হয়।
উন্নত, অনুন্নত ও উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের সংজ্ঞা, প্রকৃতি বা বৈশিষ্ট্য
আধুনিক বিশ্বের সাধারণ মানুষ স্বাধীনচেতা এবং গণতন্ত্রমনা, রাজনীতিবিদরা চায় রাজনীতি প্রাতিষ্ঠানিক রূপলাভ করুক, শিল্পপতি ও কৃষিবিদরা চায় উৎপাদন বৃদ্ধি লাভ করুক; সর্বোপরি প্রত্যেকেই চায় নিরাপদ সমাজ, শান্তিময় সহাবস্থান। এখানে একেকজনের ইচ্ছে, প্রক্রিয়া, মাধ্যম এবং কৌশল ভিন্ন ভিন্ন হলেও সবার লক্ষ্য উন্নয়ন। তাই জাতীয় উন্নয়ন বলতে ব্যাপক অর্থে একটি জাতির সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক অগ্রগতিকে বোঝায়।
উন্নত দেশ
যে সকল সার্বভৌম দেশ শিক্ষার পরিপূর্ণ সুযোগ গ্রহণ করে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও উচ্চতর প্রযুক্তি তথা আধুনিক যন্ত্রপাতি ও উপকরণ ব্যবহার করে এবং উপযুক্ততম কৌশল ব্যবহার করে উল্লেখযোগ্যভাবে অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের মাধ্যমে জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন করতে সক্ষম হয়েছে সে সকল দেশকে উন্নত দেশ বলা হয়। উন্নত দেশ বা উন্নত জাতিকে বলা হয় প্রথম বিশ্ব। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জাপান প্রভৃতি দেশ হলো উন্নত দেশ।
উন্নত দেশগুলোও পূর্বে মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে নানাবিধ কর্মতৎপরতার উদ্যোগ গ্রহণ করত যার কারণে মানুষের কর্মসংস্থানের উদ্দেশ্যে শিল্প-কারখানা ও নানা ধরনের প্রকল্প স্থাপনের দিকেই ছিল তাদের প্রচেষ্টা। কিন্তু অধ্যাপক অমর্ত্য সেনের মানব উন্নয়ন সূচক ধারণা প্রবর্তনের পর থেকে তারা মানুষের মৌলিক চাহিদার স্থায়ী পূরণের দিকে নজর দিয়েছে এবং নিশ্চিত করেছে। রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে উন্নত দেশের জনগণ শান্তি ও স্বস্তি লাভ করেছে। উন্নত দেশগুলো মানুষের স্বাস্থ্য নিরাপত্তা প্রদান, শিক্ষার হার বৃদ্ধি, দ্রব্যমূল্যের স্থিতিশীলতা, মানুষের গড় আয়ু বৃদ্ধি, বেকার সমস্যার সমাধান (নিম্ন পর্যায়ে নামিয়ে আনা), বাসস্থান সমস্যার সমাধান, বাকস্বাধীনতার উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করা, মানুষকে নিরাপদ জীবনযাপনে সক্ষম করে তোলার ব্যবস্থা করেছে। এসব দেশ কর্মমুখি শিক্ষায় গুরত্বারোপ করেছে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, রাশিয়া, ফ্রান্স, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ইত্যাদি হলো উন্নত দেশ।
উন্নত দেশের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য
- উচ্চ মাথাপিছু আয়
- নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়েছে
- বেকারত্বের হার স্বল্প
- শিল্পোন্নত
- আমদানির তুলনায় রফতানি বেশি
- উচ্চতর প্রযুক্তির সর্বোত্তম ব্যবহার
- উচ্চতর কৌশলগত দক্ষতা
- মৌলিক চাহিদা নিশ্চিত করা হয়েছে
- বিভিন্ন দেশকে আর্থিক, প্রযুক্তিগত, কৌশলগত ও সামরিক সহায়তা প্রদান করে
উন্নয়নশীল দেশ
বোঝায় যে সব দেশে প্রত্যাশিত অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে কার্যকর টেঁকসই উন্নয়নের ভিত্তি রচিত হয়েছে এবং স্থবিরতা কাটিয়ে ক্রমান্বয়ে উন্নয়নের দিকে অগ্রসর হচ্ছে।, সে সব দেশকে উন্নয়নশীল দেশ বলা হয়। আবার এভাবেও বলা যায়, অনুন্নত দেশের বৈশিষ্ট্যসমূহ থেকে মুক্তি পেতে যে সব দেশ প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখছে, সে সকল দেশকে উন্নয়নশীল দেশ বলে।
উন্নয়নশীল দেশের মানুষ বা উন্নয়নশীল জাতি নিজেদের আয়, দক্ষতা, কৌশলগত ও প্রযুক্তিগত জ্ঞান বৃদ্ধির মাধ্যমে সম্পদ বৃদ্ধিম ও টেঁকসই উন্নয়নের অভিপ্রায়ে প্রয়োজনীয় শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ গ্রহণ করছে, যার ফলে তাদের জীবনযাত্রার মান ক্রমশ উন্নতির দিকে এগিয়ে চলছে। উনয়নশীল দেশসমূহের একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো, এরা উন্নত দেশের উন্নয়ন মডেল অনুসরণ করে নিজেদের উন্নয়নের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে; কিন্তু সম্পূর্ণভাবে উন্নত জাতির উপর নির্ভরশীলতা কাটিয়ে উঠতে এখনো সক্ষম হয়নি।
উন্নয়নশীল দেশের উন্নয়নের পথে উপর্যুপরি রাজনৈতিক ক্ষেত্রে স্বার্থপরতা, একনায়কতন্ত্র, পারস্পারিক রেষারেষি, শোষণ ও নানাবিধ অনৈতিক কর্মকাণ্ড প্রধান কিছু বাধা। এগুলো অধিকাংশ মানুষকে সার্বিকভাবে দুরাবস্থার নিচের সীমায় অবস্থান করতে বাধ্য করছে যা নানা চেষ্টা ও উদ্যোগ গ্রহণের পরেও উন্নয়নের সর্বচ্চো শিখরে পৌঁছতে পারে না।
উন্নত দেশের তুলনায় উন্নয়নশীল বহুলাংশে পিছিয়ে থাকলেও, অনুন্নত দেশের তুলনায় অনেকটা ভালো অবস্থায় অবস্থান করে। উন্নয়নশীল দেশে উন্নতির জন্য সম্পদ বৃদ্ধি ও ব্যবহার করে জাতীয় উন্নয়নের দিকে নজর রাখা হয়। এসব দেশে মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণের দিকে বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখা হয়। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে উন্নয়নের পথে কেন্দ্রিয় ব্যাংক শক্তিশালী ভূমিকা পালন করে এবং বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো দেশের মুদ্রামান স্থিতিশীল রাখতে চেষ্টা করে।
উন্নয়নশীল দেশগুলোতে দৈনন্দিন জীবনে দ্রব্য ক্রয়-বিক্রয়ে মানুষ অনেকাংশে স্বস্তি লাভ করলেও উন্নত দেশের অনুদান ও উন্নয়নমূলক প্রকল্প গ্রহণ করতে বাধ্য হয়। মানুষের দূনীতিপরায়নতা, আমলাতান্ত্রিকতা ইত্যাদি জটিল ব্যবস্থা উন্নয়শীল দেশের উন্নয়নের যাত্রাপথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। উন্নয়নশীল দেশের উদাহরণ- বাংলাদেশ, নেপাল, ইন্দোনেশিয়া ইত্যাদি।
উন্নয়নশীল দেশের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য
- নিম্ন মাথাপিছু আয়
- সম্পদের অসম বণ্টন
- নিরাপত্তাহীনতা
- বেকারত্বের হার উচ্চ
- লাজুক স্বাস্থ্যখাত
- কম উপযুক্ত শিক্ষা ব্যবস্থা
- বৈদেশিক সাহায্য নির্ভর অর্থনীতি
- প্রয়োজনীয় মূলধনের অভাব
- বিশাল জনসংখ্যা ও জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার উচ্চ
- প্রযুক্তি ও কৌশলগত দিকে পিছিয়ে থাকা
- কৃষিপ্রধান অর্থনীতি
- উন্নয়নশীল শিল্পখাত
- রফতানির চেয়ে আমদানি বেশি
- অনেকাংশে খাদ্যে স্বয়ংসপূর্ণ
- দুর্নীতিপরায়ণতা
- রাজনৈতিক অস্থিরতা
অনুন্নত দেশ
যে সব দেশে উপযুক্ত শিক্ষা, কৌশলগত জ্ঞান ও উচ্চতর প্রযুক্তির অভাবে উৎপাদন স্বল্প এবং জনগণের মান নিম্ন, সে সব দেশকে অনুন্নত দেশ বলে। অনুন্নত দেশগুলো অনেকাংশে বৈদেশিক সাহায্যের উপর নির্ভরশীল।
শিক্ষার পর্যাপ্ত সুযোগ থেকে বঞ্চিত হওয়ার কারণে অনুন্নত দেশের জনসাধারণের বা অনুন্নত জাতির যথোপযুক্ত জ্ঞান ও দক্ষতার অভাব থাকে, ফলে তাদের উৎপাদনের পরিমাণ ও মাথাপিছু আয় প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম হয়ে থাকে যে কারণে সেখানে মানবেতর জীবনযাপন করতে দেখা যায়।
অনুন্নত জাতির প্রধান বৈশিষ্ট্যের মধ্যে রয়েছে নিরক্ষতা, অদক্ষতা, কৃষি ও শিল্পের অনগ্রসরতা, ক্ষুধা, দারিদ্র, অবকাঠামোগত ত্রুটি, স্বাস্থ্যহীনতা ও অপুষ্টি, ধর্মান্ধতা, জনসংখ্যা, দুর্নীতি পরায়ণতা, কুসংস্কারাচ্ছন্নতা ইত্যাদি। এসবের কারণে এরা জাতীয় জীবনের সকল ক্ষেত্রে পরনির্ভরশীল হয়ে রয়েছে। শিক্ষার অভাব ও দারিদ্র্যের কারণে অনুন্নত দেশের মানুষের জীবন স্থবির হয়ে পড়ছে।
অবকাঠামোগত ত্রুটি হলো অনুন্নত দেশগুলোর অন্যতম সমস্যা। অনুন্নত দেশগুলো এসব ত্রুটি খুঁজে বের করে অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং জনসাধারণের কর্মসংস্থান সৃষ্টির চেষ্টা করে চলছে, এতে সাফল্যও পাচ্ছে। কিন্তু জনগণের অশিক্ষা, প্রয়োজনীয় দক্ষতার অভাব বেশি দূর এগুতে দিচ্ছে না। অনুন্নত দেশ বৈদেশিক অনুদানের উপর নির্ভরশীল হলেও দুর্নীতি পরায়ণতার কারণে ঐ বৈদেশিক অনুদানের সিংহভাগ প্রশাসনিক আত্মসাতের ভোগে চলে যায়, বঞ্চিত হয় সাধারণ মানুষ। যার ফলে সাধারণ মানুষ দারিদ্র্য থেকে বেরিয়ে আসতে পারে না। কয়েকটি অনুন্নত দেশের নাম হলো- জিম্বাবুয়ে, কেনিয়া, কঙ্গো ইত্যাদি।
অনুন্নত দেশের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য
- নিম্ন আয়
- গণনিরক্ষরতা
- গণদারিদ্র্য
- চরম অনিরাপত্তা
- ক্ষুধা
- অপুষ্টি
- মূলধন গঠনের অভাব
- উচ্চ জনসংখ্যার চাপ
- কৃষিখাতে পেছানো
- বেকারত্ব
- প্রযুক্তির স্বল্প ব্যবহার
- শিল্পায়নের অভাব
- লাজুক আর্থসামাজিক অবস্থা
- দুর্নীতিপরায়ণতা
- রাজনৈতিক অস্থিরতা
- অবকাঠামোগত উন্নয়নের অভাব
বিশেষ দ্রষ্টব্য: অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশে যেমন দুর্নীতি হয়, তেমনই উন্নত দেশেও দুর্নীতি হয়। তবে উন্নত দেশের দুর্নীতি সে সব দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থাকে খুব বেশি প্রভাবিত করতে পারে না, কিন্তু আন্তর্জাতিক মহলে বিশেষ গুরুত্ব পায়। অনুন্নত দেশ ঊন্নয়নশীল দেশের দুর্নীতি আন্তর্জাতিক মহলে গুরুত্ব পায় না বললেই চলে, তবে দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে ভীষণভাবে বাধাপ্রাপ্ত হয়।