পাঠ পরিকল্পনা: পাঠ পরিকল্পনার সংজ্ঞা এবং হার্বার্টের পঞ্চসোপান ও আধুনিক ত্রিসোপান
- প্রকাশ: ০১:২৯:৫৬ অপরাহ্ন, বুধবার, ৭ জুলাই ২০২১
- / ৬১৪৭৪ বার পড়া হয়েছে
পাঠ পরিকল্পনা লিখিত হওয়া উচিৎ | Photo by Nils Stahl on Unsplash
আধুনিকযুগের আধুনিক শিক্ষাদান পদ্ধতির অন্যতম একটি উপাদান হলো পাঠ পরিকল্পনা। সনাতন পদ্ধতিতে শিক্ষাদানের যুগের সাথে আধুনিক যুগের শিক্ষাদান পদ্ধতির যেসব পার্থক্য রয়েছে সেসবের মধ্যে পাঠ পরিকল্পনার ধারণা ও এর ব্যবহার উপরের দিকেই থাকবে।
কেউ কেউ এখানে বলতেই পারেন যে, কোনো কালেই কোনো শিক্ষক পরিকল্পনা ব্যতিত শিক্ষার্থীদের পাঠদান করেননি। সত্যি কথা হলো, কে পরিকল্পনা করে পাঠদান করেছেন বা কে পরিকল্পনা ছাড়াই পাঠদান করেছেন তা আমাদের পক্ষে জানা সম্ভব নয়। তবে আমরা মোটামুটিভাবে নিশ্চিত, পেশাদার যে কোনো শিক্ষকই শ্রেণিকক্ষে পাঠদানের উদ্দেশে প্রবেশের পূর্বে নিশ্চয়ই কিছু না কিছু ভেবে যান, যাকে আমরা পাঠ পরিকল্পনারই একটি রুপ বলতে পারি।
প্রশ্ন হলো, শিক্ষক শ্রেণিকক্ষে প্রবেশের পূর্বে যা ভাবলেন তা যথার্থ কি না; ওইদিনের পাঠদান কার্যক্রম পরিচালনার জন্য যথেষ্ট কি না; কিংবা ওই শিক্ষকের ভাবনায় যা আছে তা নির্দিষ্ট পাঠের নির্দিষ্ট শিখনফলের জন্য উপযুক্ত কি না। মোটের ওপর প্রশ্ন হলো- নিজের অজান্তেই হোক বা সচেতনভাবেই হোক, শিক্ষক যে পরিকল্পনা করে শ্রেণিকক্ষে প্রবেশ করছেন সে পরিকল্পনাকে আমরা একটি সুপরিকল্পিত পাঠ পরিকল্পনা বলতে পারি কি না?
অনেক শিক্ষাবিদ বলেন, শিক্ষার্থীদের পাঠদানের পূর্বে নির্ধারিত ওই পাঠ ও পাঠদানের কলাকৌশলের লিখিত দলিল হলো পাঠ পরিকল্পনা। তবে পাঠ পরিকল্পনা লিখিত হতে হবে তা নয়, অলিখিতও হতে পারে। কিন্তু ব্যপকভাবে যে পাঠ পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা করা হয় তা লিখিত পাঠ পরিকল্পনা। অলিখিত পাঠ পরিকল্পনার চেয়ে লিখিত পাঠ পরিকল্পনা অনেকগুণ কার্যকরি। পাঠ পরিকল্পনা লিখিত হওয়া উচিৎ।
পাঠ পরিকল্পনা কী?
পাঠ পরিকল্পনা হলো এমন একধরনের পরিকল্পনার যার মাধ্যমে একজন শিক্ষকের পক্ষে শ্রেণিকক্ষে পাঠদানের পূর্বেই ঠিক করে নেওয়া সম্ভব হয়- একটি নির্দিষ্ট পাঠ বা পাঠের অংশ তার শিখনফল অনুসারে কীভাবে শিক্ষার্থীদেরকে শেখাতে হবে, পাঠের কোন অংশের জন্য কতটুকু সময় ব্যয় করতে হবে, ওই পাঠ বা পাঠ্যাংশের ওপর শ্রেণিকার্যক্রম পরিচালনার সময় শিক্ষক হিসেবে নিজের ও শিক্ষার্থীদের কার কী কী করণীয় থাকবে, পাঠদানে কী কী উপকরণ ব্যবহার করতে হবে এবং যে শিখনফলকে কেন্দ্র করে পাঠদান করা হবে তা কতটুকু অর্জিত হলো তা জানার জন্য মূল্যায়ন কীরূপ হবে।
শিক্ষা বিষয়ক ব্লগার ব্রি স্টফার (Bri Stauffer) Applied Education Systems ওয়েবসাইটে লিখেছেন যে, শিক্ষার্থীরা কী শিখবে, কীভাবে তা শেখানো হবে এবং কীভাবে শিখন মূল্যায়ন করা হবে সে সম্পর্কে শিক্ষকের দৈনন্দিন নির্দেশনা হলো পাঠ পরিকল্পনা।
পাঠ পরিকল্পনা বলতে বোঝায় শিক্ষকের সুবিধার জন্য শিক্ষক কর্তৃক বা প্রতিষ্ঠান কর্তৃক প্রণয়ন করা এমন এক ধরনের পরিকল্পনা যাতে উল্লেখ থাকে নির্ধারিত লক্ষ্য অর্থাৎ শিক্ষার্থীদের কী শিখতে হবে বা শিক্ষার্থীদেরকে কী শেখাতে হবে; নির্ধারিত লক্ষ্য অর্জনের উপায় অর্থাৎ শিক্ষার্থীদেরকে শিক্ষক কোন পন্থা, পদ্ধতি ও কৌশল ব্যবহার করে পাঠদান সফল কবেন; নির্ধারিত লক্ষ্য অর্জন করা হলো কি না তা জানার জন্য উপযুক্ত মূল্যায়ন প্রক্রিয়া; এবং প্রত্যাশিত লক্ষ্য পূরণ না হলে কী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
পাঠ পরিকল্পনার প্রবক্তা
পাঠ পরিকল্পনা (Lesson Plan) নিয়ে সর্বপ্রথম কথা বলেন হার্বার্ট স্পেনসার। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, পাঠ পরিকল্পনা একজন শিক্ষকের পাঠদানের দক্ষতা ও কৌশলজ্ঞান অনেকাংশে বাড়িয়ে দিতে পারে। কেউ কেউ আবার এটাও বলে থাকেন যে, পাঠ পরিকল্পনার সূচনা হয়েছে খৃস্টিয় দ্বিতীয় থেকে চতুর্থ শতকের মধ্যে কোনো সময়ে, তবে এর সত্যতা যাচাই করা সম্ভব হয়নি।
হার্বার্টের পঞ্চসোপান
ফ্রেডরিক হার্বার্ট পাঠদানের ক্ষেত্রে ক্ষেত্রে পাঁচটি ধাপ অনুসরণ করার কথা বলেন যা বাঙালি শিক্ষাবিদ ও শিক্ষক-প্রশিক্ষকদের কাছে পাঠ পরিকল্পনার পঞ্চসোপান বা হার্বার্টের পঞ্চসোপান নামে পরিচিত। হার্বার্টের পঞ্চসোপান ইংরেজিতে ‘Herbert’s Five Steps of Lesson Plan’ নামে পরিচিত। ব্রিটানিকার তুলে ধরা তথ্য অনুসারে হার্বার্টের পঞ্চসোপানে যা আছে তা হলো-
১. প্রস্ততি (preparation)
নতুন কোনো কিছু শিক্ষাদানের আগে ওই বিষয় সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের শেখানো হয়েছে এমন অথবা শিক্ষার্থীরা জানে এমন কোনো কিছুর সাথে সম্পর্ক স্থাপনের নাম হলো প্রস্ততি। প্রস্ততি পর্বের কার্যক্রমের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদেরকে পাঠের প্রতি আগ্রহী করার প্রচেষ্টা করা হয়।
২. উপস্থাপন (presentation)
প্রস্ততি পর্ব সাফল্যের সাথে শেষ করার পর পাঠের বিষয়বস্তু প্রকৃত অভিজ্ঞতার আলোকে শ্রেণিকক্ষে উপস্থাপন করা করতে হয়। উপস্থাপন যদি প্রকৃত অভিজ্ঞতার আলোকে না হয় তাহলে শিখন কার্যকর হয় না।
৩. সংযোগ (association)
হার্বার্টের শিক্ষণ প্রক্রিয়ায় সংযোগ হলো শিক্ষার্থীদের পুর্ব ধারণার সাথে শ্রেণিকক্ষে উপস্থাপিত পাঠের সাথে সংযোগ ঘটিয়ে তুলনাকরণের মাধ্যমে মিল এবং অমিল বা পার্থক্যগুলো বিবেচনার মাধ্যমে নতুন ধারণার সৃষ্টি।
৪. সাধারণীকরণ (generalizing)
পাঠদানে সাধারণীকরণ হলো কোনো একক শিখন অভিজ্ঞতা, যা শ্রেণিকক্ষে শেখানো হয়েছে তা বাস্তবজীবনের একাধিক অভিজ্ঞতার সাথে এক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার প্রক্রিয়া।
৫. প্রয়োগ (application)
শিক্ষাদান বা জ্ঞানদান পর্যন্ত সীমাবদ্ধ না রেখে বরং শিখনকে শিক্ষার্থীদের জীবনে কার্যকরী করতে এর তাৎক্ষণিক প্রয়োগ প্রক্রিয়া অনুসরণ করা প্রয়োজন। শিক্ষক যা কিছু শেখান, তা যদি তাৎক্ষনিকভাবে শিক্ষার্থীদের মাধ্যমে প্রয়োগ করাতে পারেন তাহলে ওই শিখন অপেক্ষাকৃতভাবে বেশি স্থায়ী হয়।
বলা হয়ে থাকে হার্বার্টের পঞ্চসোপান আধুনিক পাঠ পরিকল্পনার কাঠামোর কাছে গুরুত্ব হারিয়েছে। কিন্তু সত্যি কথা হলো যখন কোনো শিক্ষক পাঠ পরিকল্পনা প্রণয়ন করেন বা কোনো শিক্ষক প্রশিক্ষক পাঠ পরিকল্পনা প্রণয়ন সম্পর্কে প্রশিক্ষণনার্থীদের উদ্দেশে লেকচার দেন, তখন এই পঞ্চসোপানকে এড়িয়ে যেতে পারেন না। আমার দেখা প্রত্যেকেই স্বীকার করেছেন, আধুনিক পাঠ পরিকল্পনা মূলত হার্বার্টের পাঠদান ধাপেরই সংক্ষিপ্ত রুপ। হার্বার্টের পঞ্চসোপানকে সংক্ষিপ্ত করার পেছনে জন ডিউইর বক্তব্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে বলে মত দিয়েছেন শিক্ষাক্ষেত্রের বিভিন্ন পণ্ডিত।
আধুনিক পাঠ পরিকল্পনার ত্রিসোপান
ফ্রেডরিক হার্বার্টের পঞ্চসোপানকে সংক্ষিপ্ত করে তিনধাপ বিশিষ্ট পাঠ পরিকল্পনার নকশা প্রবর্তন করা হয় যা বর্তমানে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এই আধুনিক পাঠ পরিকল্পনাকে ত্রিসোপানিক পাঠ পরিকিলপনা বলে।
আধুনিক পাঠ পরিকল্পনার এই তিনটি ধাপ হলো- ১. প্রস্ততি, ২. উপস্থাপন এবং ৩. মূল্যায়ন।
১. প্রস্ততি (preparation)
একজন শিক্ষক শ্রেণিকক্ষে কীভাবে উত্তম পন্থায় শিক্ষার্থীদেরকে নির্ধারিত পাঠের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে চান, পাঠের সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য শিক্ষক কীভাবে শিক্ষার্থীদের সাথে সংযোগ স্থাপন করবেন, নতুন পাঠ সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের কীভাবে উৎসাহী করে তুলবেন ইত্যাদি হলো পাঠ পরিকল্পনার প্রস্ততি অংশের অন্তর্ভুক্ত।
কুশল বিনিময়, পূর্বজ্ঞান যাচাই, মজার কৌতুক বলা, ধাঁধা ছুড়ে দেওয়া, ছোট্ট গল্প বলা, কার্টুন দেখানো ইত্যাদি প্রস্ততি পর্বের একেকটি কৌশল।
২. উপস্থাপন (presentation)
উপস্থাপন হলো শ্রেণিকক্ষে নির্ধারিত পাঠের বিষয়বস্তু শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে তুলে ধরা এবং প্রয়োজনীয় আলোচনা ও বিভিন্ন পদ্ধতি/কৌশল অবলম্বন করে শিক্ষার্থিদেরকে শিখনফল অর্জনে সহায়তা করা।
বক্তৃতা, আলোচনা, ফোকাসড গ্রুপ ডিসকাশন, একক কাজ, জোড়ায় কাজ, দলীয় কাজ, ভূমিকাভিনয়, মাইন্ড ম্যাপিং ইত্যাদি পাঠ উপস্থাপনের একেকটি কৌশল হিসেবে চিহ্নিত করা যায়।
৩. মূল্যায়ন (assessment)
মূল্যায়ন হলো এমন একটি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা নির্ধারিত শিখনফল অর্জন করতে সক্ষম হলো কি না তা যাচাই করা হয়। মূল্যায়নকে প্রয়োগ বা অ্যাপলিকেশন (application) বলা হয়ে থাকে কখনো কখনো।
ম্যাক্রো ও মাইক্রো লেসন প্ল্যান সম্পর্কে পড়তে এখানে ক্লিক করুন
পাঠ পরিকল্পনা সম্পর্কে সকল পোস্ট পড়ুন এখানে ক্লিক করে
(পাঠ পরিকল্পনা সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন থাকলে তা মন্তব্যের ঘরে লিখুন, অবশ্যই উত্তর দেওয়া হবে)
জনাব,
আসসালামু আলাইকুম। প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির পাঠ পরিকল্পনা সম্পর্কে আমাকে একটু মেইল করতে পারবেন কি? আপনার লেখা পড়ে ভালো লেগেছে তবে যদি আমাকে একটু উপকার করতেন এ বিষয়ে মেইল করে খুশি হতাম।
পাঠ পরিকল্পনার প্রণেতা কে?
Patporikolponar sirtaboli biboron .
Atar ans ta diben.
পাঠ পরিকল্পনা উন্নতির ক্ষেত্রে নীতি গুলি লেখ
প্রথম শ্রেণী পাঠ থেকে অষ্টম শ্রেণী পাঠ পর্যন্ত পাঁচটি পাঠ পরিকল্পনা রচনা করো।
এই প্রশ্নের জবাব দয়া করে দিবেন 2-3 দিনের মধ্যে।
আমার খুব দরকার। 🙏
জনাব মু. মিজানুর রহমান মিজান
ধন্যবাদ,
অসাধারণ লেখনী
সব গুলো অংশ লাগবে শুরু থেকে শেষ
নির্দিষ্ট করে বললে সুবিধা হবে। চেষ্টা করব আপনার বা আপনাদের চাহিদা মেটানোর।
অনুপাঠটীকা ও বৃহৎ পাঠটীকার মধ্যে পার্থক্য ai question ar answer pIZ daban amar khub i dorker 2/3 din are modha Amar gmail patiya diban PLz
আপনাকে ইমেইল করা হয়েছে।