ইরানের নতুন প্রেসিডেন্ট এব্রাহিম রাইসি সম্পর্কে জানুন
- প্রকাশ: ০১:১১:২৮ অপরাহ্ন, শনিবার, ৭ অগাস্ট ২০২১
- / ৪৮৭ বার পড়া হয়েছে
২০২১ সালের জুন মাসে এব্রাহিম রাইসি ইরানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। দেশের মানুষের কাছে এব্রাহিম রাইসি এক জন কট্টরপন্থী ধর্মীয় নেতা হিসেবে পরিচিত। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতোল্লাহ আলী খামেনির খুবই কাছের একজন ব্যক্তি এই এব্রাহিম রাইসি। ষাট বছর বয়সী এই নেতা ৫ আগস্ট, ২০২১ তারিখ বৃহস্পতিবার ইরানের নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন।
নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট রাইসির অন্যতম ইশতেহার ছিল দুর্নীতি প্রতিরোধ করা, বিশেষ করে বিদায়ী প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানির সময়ে ইরানে যে ব্যাপক দুর্নীতি হয়েছে এবং অর্থনৈতিক সঙ্কট দেখা দিয়েছে, তিনি সেসব মোকাবেলা করবেন।
পূর্বে এব্রাহিম রাইসি ইরানের বিচার বিভাগের প্রধান ছিলেন এবং দেশটির অনেকেই মনে করেন আশির দশকে সালে রাজনৈতিক বন্দীদের যে ভাবে গণহারে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল তাতে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল।
এব্রাহিম রাইসির জন্ম
ইরানের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর মাশহাদে এব্রাহিম রাইসির জন্ম ১৯৬০ সালে। তাঁর বাবসও একজন ধর্মীয় নেতা ছিলেন। রাইসির বয়স যখন মাত্র পাঁচ বছর তখন তার বাবাকে হারান।
শিক্ষাজীবনের শুরু ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পডা
১৫ বছর বয়সে বাবার আদর্শ অনুসরণ করে পবিত্র শহর বলে পরিচিত কওমের একটি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা শুরু করেন। ছাত্রাবস্থায়ই তিনি নানান রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সাথে যুক্ত হয়ে পড়েন। আয়াতোল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনির নেতৃত্বাধীন যে ইসলামিক বিপ্লবে ১৯৭৯ সালে পশ্চিমা সমর্থনপুষ্ট শাহের পতন ঘটে, সে বিপ্লবে রাইসিও যুক্ত ছিলেন।
বিচার বিভাগে যোগদান এবং আয়াতোল্লা খামেনির নৈকট্যলাভ
বিপ্লবের মধ্য দিয়ে শাহ আমলের পতন ঘটলে এব্রাহিম রাইসি বিচার বিভাগে নিয়োগ দেওয়া হয় এবং তিনি বিভিন্ন শহরে সরকারি কৌঁসুলি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সরকারি দায়িত্ব পালনকালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আয়াতোল্লাহ খামেনির কাছ থেকে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। উল্লেখ্য, আয়াতোল্লাহ খামেনি ১৯৮১ সালে ইরানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। বলাই বাহুল্য, এ সময় তৎকালীন প্রেসিডেন্টের খুব কাছে চলে গিয়েছিলেন।
ডেথ কমিটিতে রাইসি
এব্রাহিম রাইসিকে ২৫ বছর বয়সে রাজধানী তেহরানের ডেপুটি প্রসিকিউটর হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। ওই দায়িত্ব পালনকালে তিনি ইরানের বিতর্কিত একটি গোপন ট্রাইব্যুনালের চারজন বিচারকের একজন ছিলেন। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের কারণে যে হাজার হাজার মানুষ বিচারের মাধ্যম ইতোমধ্যেই শাস্তিস্বরূপ কারাভোগ করছিলেন তাদেরকে পুনর্বিচারের ব্যবস্থা করা হয় এই ট্রাইব্যুনালে। পুনর্বিচারের মাধ্যমে ওই সকল রাজনৈতিক বন্দিদের বেশিরভাগেরই মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়, এই কারণে ১৯৮৮ সালে গঠিত গোপন এই ট্রাইব্যুনালটি ‘ডেথ কমিটি’ হিসেবে পরিচিতি পায়। গোপন এই ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে পাঁচ হাজারের মতো নারী ও পুরুষের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছিল এবং গণহারে কবর দেওয়া হয় যা মানবতা-বিরোধী অপরাধ হিসেবে বিবেচিত। রাইসি এসব মৃত্যুদণ্ডের পেছনে তাঁর ভূমিকার কথা অস্বীকার করলেও তিনি বলেছেন যে, সাবেক সর্বোচ্চ নেতা আয়াতোল্লাহ খোমেনির এক ফতোয়ার কারণে ওই সকল মৃত্যুদণ্ড যৌক্তিক ছিল। তবে ও রকম গণহারে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া ছিল ইরানের ইতিহাসে সবচেয়ে বড়ো অপরাধ বলে বিশ্বাস করতেন তৎকালীন দ্বিতীয় সর্বোচ্চ নেতা আয়াতোল্লাহ হোসেইন আলী মনতাজেরি, যা একটি অডিয়ো টেপ ফাঁস হলে জানা যায়। এর ঠিক এক বছর পরেই মনতাজেরিকে তার পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয় এবং খোমেনির মৃত্যুর পর আয়াতোল্লাহ খামেনি ইরানের সর্বোচ্চ নেতা বনে যান।
প্রসিকিউটর জেনারেল রাইসি
আয়াতোল্লা খামেনি সর্বোচ্চ নেতার দায়িত্ব নিলেও ততদিনে রাইসি তেহরানে সরকারি কৌঁসুলি হিসেবেই কাজ করছিলেন। পরবর্তীতে তাকে স্টেট ইন্সপেক্টোরেট অর্গানাইজেশনের প্রধান করা হয়। এর পরে তাকে বিচার বিভাগের উপ-প্রধানের দায়িত্ব দেওয়া হয় এবং ২০১৪ সালে এব্রাহিম রাইসিকে ‘প্রসিকিউটর জেনারেল’ পদে নিয়োগ দেওয়া হয়।
আস্তান-ই-কুদস-ই রাজাভির কাস্টোডিয়ান
২০১৬ সালে আয়াতোল্লাহ খামেনি এব্রাহিম রাইসিকে ইরানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং সমৃদ্ধ ধর্মীয় ফাউন্ডেশন আস্তান-ই-কুদস-ই রাজাভির কাস্টোডিয়ান পদে নিয়োগ দেন।
২০১৭ সালের নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী
এব্রাহিম রাইসি ২০১৭ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে নিজেকে যখন একজন প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করেন যাতে অনেকেই বিস্মিত হয়েছিল। ওই নির্বাচনে হাসান রুহানি বিপুল ভোটেবিজয়ী হয়ে দ্বিতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট পদে নিযুক্ত হন। হেরে যাওয়া রাইসি বলে আসছিলেন তিনি দুর্নীতিবিরোধী যোদ্ধা। কিন্তু হাসান রুহানি দাবি করতেন, বিচার বিভাগের উপ-প্রধান পদে নিযুক্ত থাকলেও তিনি দুর্নীতির বিরুদ্ধে কিছুই করেননি।
নির্বাচনে হেরে বিচার বিভাগের প্রধান
২০১৭ সালের নির্বাচনে এব্রাহিম রাইসি হেরে গেলেও তাঁর ভাবমূর্তির ওপর ওপর প্রভাব পড়েনি বরং ২০১৯ সালে আয়াতোল্লাহ খামেনি তাকে ইরানের বিচার বিভাগের প্রধানের মতো প্রভাবশালী পদে নিয়োগ দেন।
অ্যাসেম্বলি অফ এক্সপার্টস কমিটির ডেপুটি চেয়ারম্যান
এব্রাহিম রাইসিকে বিচার বিভাগের প্রধান পদে নিয়োগ দেওয়ার এক সপ্তাহ না যেতেই তাকে অ্যাসেম্বলি অফ এক্সপার্টস কমিটির ডেপুটি চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। এই কমিটির মোট সদস্য সংখ্যা ৮৮ জন, যারা দেশের বড়ো মাপের ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব। কমিটির কাজ হলো ইরানের পরবর্তী সর্বোচ্চ নেতা নির্বাচন করা।
২০২১ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থীতা
এব্রাহিম রাইসি ২০২১ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে নিজেকে নিরপেক্ষ প্রার্থী এবং প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে, তিনি দারিদ্র, দুর্নীতি ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে তিনি লড়াই করবেন। এছাড়া দেশ পরিচালনায় যারা যুক্ত তাঁদের মধ্যেও ইতিবাচক পরিবর্তন আনবেন বলে কথা দিয়েছেন। অবশ্য তাঁর কট্টরপন্থী মনোভাবের জন্য অনেকেই তাকে প্রার্থী হবার অযোগ্য বলে ঘোষণা করেন। ভিন্নমতাবলম্বী এবং সংস্কারপন্থী প্রভাবশালীর ব্যক্তিরা ভোটারদের আহবান জানিয়েছিলেন নির্বাচন বয়কট করার জন্য। তাঁদের অভিযোগ ছিল যে, সবকিছু এমনভাবে সাজানো হয়েছে যাতে এব্রাহিম রাইসিকে বলার মতো কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখে না পড়তে হয়।
নির্বাচনে প্রথম দফার ভোটেই তিনি পেয়েছেন ৬২% ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন। অবশ্য এ নির্বাচনে ভোট দিয়েছেন ৪৯% এরও কম ভোটার। ১৯৭৯ সালের বিপ্লবের পর কোনো প্রেসিডেন্ট নির্বাচনেই এতো কম ভোট পড়েনি।