ম্যালথাসের জনসংখ্যা তত্ত্ব
- প্রকাশ: ০৮:২৭:৩১ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৮ অগাস্ট ২০২১
- / ৩১১১৭ বার পড়া হয়েছে
টমাস রবার্ট ম্যালথাস (Thomas Robert Malthus) ছিলেন ইংল্যান্ডের একজন অর্থনীতিবিদ, জনমিতিবিদ এবং ধর্মযাজক। তিনি তাঁর জনসংখ্যা তত্ত্বের জন্য বিখ্যাত। এই তত্ত্ব ‘ম্যালথাসের জনসংখ্যা তত্ত্ব’ (Malthusian Theory of Population) নামে পরিচিত। এই তত্ত্ব টমাস ম্যালথাস উনিশ শতকে প্রচার করেছেন।
জনসংখ্যা বিষয়ে তাঁর যে মতবাদ প্রকাশিত হয় তা তিনি মোট ছয়বার পরিবর্তন করেন। ম্যালথাসের তত্ত্বের সর্বশেষ পরিমার্জিত সংস্করণ বের হয় তাঁর মৃত্যুর পর ১৯৭২ সালে। ম্যালথাস তাঁর তত্ত্বের জন্য ধর্মতাত্ত্বিক ও মার্কসবাদীদের দ্বারা ঘৃণিত হন। তবে জনসংখ্যা সম্পর্কে তিনি যে মতবাদ ব্যক্ত করেছেন তা এখন পর্যন্ত খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
এখানে যা আছে
ম্যালথাসের তত্ত্ব আসলে কী?
ম্যালথাসের তত্ত্ব (ইংরেজি: Malthusian Theory) একটি জনসংখ্যা বিষয়ক তত্ত্ব যার প্রস্তাব হলো খাদ্যশস্যের উৎপাদন যখন গাণিতিক হারে বৃদ্ধি পায় তখন জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায় জ্যামিতিক হারে। ইংরেজ অর্থনীতিবিদ টমাস রবার্ট ম্যালথাস উনিশ শতকের প্রথমভাগে এই তত্ত্ব প্রচার করেন।
১৭৯৮ সালে ম্যালথাস ‘অ্যান এসে অন দ্য প্রিন্সিপল অব পপুলেশন’ (An Essay on the Principle of Population) নামে একটি বই লিখেছিলেন, সে বইয়ে এই তত্ত্ব উল্লেখ করা হয়েছে। উল্লেখ্য, তিনি বেনামে প্রকাশ করলেও, অল্পদিনের মধ্যেই মানুষ জেনে যায় যে, বইটি টমাস রবার্ট ম্যালথাস লিখেছেন।
ম্যালথাসের এই তত্ত্ব অনুসারে স্বাভাবিক নিয়মে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেলে খাদ্যসংকট এমনকী দুর্ভিক্ষ অবশ্যম্ভাবী। এই কারণে ম্যালথাস মনে করতেন যে, দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধের জন্য জন্ম নিয়ন্ত্রণ অপরিহার্য। জন্ম নিয়ন্ত্রণ করা না-গেলে দুর্ভিক্ষের কারণে মানুষ মারা পড়বে এবং এভাবেই জনসংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পাবে।
জনসংখ্যা বৃদ্ধির জ্যামিতিক হার
ম্যালথাস বলেন, খাদ্যের উৎপাদন অপেক্ষা জনসংখ্যা দ্রুততর হারে বৃদ্ধি পায়। তাঁর মতে, খাদ্য বৃদ্ধি পায় গাণিতিক হারে (Arithmetic rate) এবং নিয়ন্ত্রণ করা না হলে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায় জ্যামিতিক হারে (Geometric rate)।
গাণিতিক এবং জ্যামিতিক হার কী?
গাণিতিক ও জ্যামিতিক প্রবৃদ্ধির ধারা নিম্নে দেখানো হলো:
- গাণিতিক হার: ১, ২, ৩, ৪, ৫, ৬, ৭, ৮…
- জ্যামিতিক হার: ১, ২, ৪, ৮, ১৬, ৩২…
গাণিতিক হারের চেয়ে জ্যামিতিক হার দ্রুত বৃদ্ধি পায়। জ্যামিতিক হার চক্রবৃদ্ধি সুদ ব্যবস্থার মতো। মূলধনের সুদ যেমন একটা নির্দিষ্ট সময়ের পরে মূলধনে পরিণত হয় এবং সেটার সুদও অ্যাকাউন্টে হয় জমা। ঠিক তেমনি আজকের শিশুরাও আগামীতে বাবা-মা হবে এবং তাদের ঘরে আসবে আরো শিশু। নিয়ন্ত্রণ করা না হলে হয়তো জন্ম নেবে আরো অধিক সংখ্যায়।
ঠিক এভাবেই ম্যালথাস বলতে চেয়েছিলেন যে, জ্যামিতিক হার গাণিতিক হারকে অতিক্রম করে চলে। অর্থাৎ বার্ষিক জন্মহার বার্ষিক খাদ্য উৎপাদনকে অতিক্রম করে চলবে।
জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের প্রাকৃতিক নিরোধ
পরবর্তী পর্যায়ের জন্য তিনি তিনটি সম্ভাব্য অবস্থা সৃষ্টির কথা বলেন, যে অবস্থাগুলোর প্রতিটি অবস্থাই মৃত্যুহারকে দেবে বাড়িয়ে। এগুলো হলো- ক্ষুধা, ব্যাধি এবং যুদ্ধ।
ম্যালথাসের মতে এগুলোই হলো জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের প্রাকৃতিক নিরোধ (positive checks) ব্যবস্থা।
এই প্রাকৃতিক নিরোধ ব্যবস্থাগুলো জনসংখ্যাকে এমন একটা সংখ্যায় কমিয়ে আনবে যে, জনসংখ্যা উৎপাদিত খাদ্যের পরিমাণের সঙ্গে হবে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
ম্যালথাস মনে করেন, মানুষ যৌন চাহিদা দ্বারা এমন ভাবে চালিত হয় যে, সে প্রজনন ক্ষমতানুযায়ী সন্তান জন্ম দেবার প্রবণতা দেখায়। অর্থাৎ, মানুষ অধিক সন্তান জন্ম দিতে পারাকে গৌরবের চোখে দেখে।
তিনি প্রথম দিকে যুক্তি দেখাতেন যে, সব অবস্থাতেই মানুষের জন্মহার একই থাকবে এবং কেবল মৃত্যুর হারই জন্মহার প্রবৃদ্ধিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে। তিনি তখন মনে করেছিলেন যে মানুষ হয়তো স্বেচ্ছায় সন্তান জন্মদান করবে না বা জনসংখ্যা সীমিত করবে না।
তিনি আরো বলেন যে, যদি খাদ্যের যোগান বৃদ্ধি পায়, তা হলে তা বরং আরো অধিক সন্তানের জীবনধারণে করবে সহায়তা। ফলে জনসংখ্যা আরো বৃদ্ধি পাবে। এতে আবার পুনরায় খাদ্যের উপর চাপ পড়বে। পুনরায় দেখা দেবে খাদ্যের অভাব।
পরিমার্জিত তত্ত্বে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা
পরবর্তীতে ম্যালথাস পরিবর্তীত ও পরিমার্জিত তত্ত্বে আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন যে, জন্মহার সীমিত করে মানুষ ইচ্ছা করলে ক্ষুধা, ব্যাধি এবং যুদ্ধ থেকে পরিত্রাণ পেতে পারে। এজন্য তিনি প্রাকৃতিক নিরোধের পরিবর্তে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা (preventive checks) গ্রহণের পরামর্শ দেন। তিনি অবশ্য জন্মনিয়ন্ত্রণ বা জনসংখ্যাকে সীমিত করে এমন কোন পন্থাকে অনৈতিক বলে উল্লেখ করেন এবং এর পরিবর্তে জন্মহার হ্রাস করার ক্ষেত্রে বিলম্ব বিবাহ (late marriage) উৎকৃষ্ট পন্থা বলে মনে করেন।
ম্যালথাসের জনসংখ্যা তত্ত্বের সমালোচনা
ম্যালথাসের এই জনসংখ্যা তত্ত্বটি নানানভাবে সমালোচিত হয়েছে। নিম্নে তা তুলে ধরা হলো:
১. ম্যালথাস ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে প্রাকৃতিক নিরোধ অর্থাৎ ক্ষুধা, ব্যাধি এবং যুদ্ধ বৃদ্ধি পাবে। কিন্তু ম্যালথাসের সময় থেকে এখন পর্যন্ত এই তিনটি প্রাকৃতিক নিরোধ বাড়েনি। বরং ক্ষুধা ও ব্যাধি নিবারণে অগ্রগতি সাধিত হয়েছে।
২. ম্যালথাসের সময়ে খাদ্যের অভাবে যে মৃত্যুহার ছিল তা আজ অনেক হ্রাস পেয়েছে। ম্যালথাস ভাবতেও পারেনি খাদ্যের উৎপাদন এতটা বৃদ্ধি পাবে। কেননা কৃষি উৎপাদন বিগত একশত বছরে ২/৩ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। কৃষি পদ্ধতিতে উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার এবং খাদ্যের উৎপাদন বৃদ্ধির বর্তমান হার সম্পর্কে ম্যালথাস ভাবতেও পারেননি।
৩. আধুনিক যুগে জন্ম নিয়ন্ত্রণের এমন অনেক ব্যবস্থা আবিষ্কার হয়েছে, যা ম্যালথাসের জানা ছিলনা। অথচ প্রতিরোধমূলক এবং প্রতিকারমূলক জন্মনিয়ন্ত্রণের অনেক ব্যবস্থা আবিষ্কার করা সম্ভব হয়েছে।
৪. ম্যালথাস কেবল জনসংখ্যার সঙ্গে খাদ্য উৎপাদনের সম্পর্ক নিয়েই বেশী চিন্তা-ভাবনা করেছেন। অথচ, তিনি প্রাকৃতিক সম্পদের নানাবিধ ব্যবহার সম্পর্কে তেমনি চিন্তা-ভাবনা করেননি। এটা চিন্তা করলে তিনি হয়তো বলতেন প্রাকৃতিক সম্পদকে কাজে লাগাতে বরং আরো জনশক্তি বা শ্রমের প্রয়োজন হবে এবং উৎপাদন বৃদ্ধিতে তা হবে সহায়ক।
ম্যালথাসের তত্ত্বের মূল বিষয়বস্তু
ম্যালথাসের তত্ত্বটি হলো একটি জনসংখ্যা বিকাশের তত্ত্ব। কোনো একটি নির্দিষ্ট সময় মেয়াদে জনসংখ্যা কীভাবে বাড়ে এবং এই বৃদ্ধি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন কিভাবে প্রভাবিত করে তাই ম্যালথাসের জনসংখ্যা তত্ত্বের মূল বিষয়বস্তু।
এ তত্ত্বে দেশের খাদ্য যোগানের পরিপ্রেক্ষিতে জনসংখ্যার সমস্যাটি আলোচিত হয়েছে বলে দেশে খাদ্য ঘাটতির পরিস্থিতি হলো জনাধিক্যের প্রধান লক্ষণ। সর্বোপরি এ তত্ত্বের মধ্য দিয়ে আমরা ম্যালথাসকে একজন হতাশবাদী হিসেবে দেখতে পাই। কারণ তাঁর তাছে অধিক জনসংখ্যা মাত্রই মানবজাতির জন্য একদিকে ত্রাস এবং নৈরাশ্য সৃষ্টি করে। কিন্তু তারপরও বর্তমানে বিশ্বে দারিদ্রতা বৃদ্ধি পাওয়ায় কিছুটা হলেও অনেকেই ম্যালথাসের তত্ত্বটি বিশ্বাস করছেন।
(বিভিন্ন অনলাইন আর্কাইভ ও বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যবই অবলম্বনে লিখিত)
ভালো লাগলো