অর্থনীতি কাকে বলে? অর্থনীতির সংজ্ঞা, পরিধি বা বিষয়বস্তু কী?
- প্রকাশ: ০৬:৩৪:৩২ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৯ অগাস্ট ২০২১
- / ৯২২১২ বার পড়া হয়েছে
অর্থনীতির ইংরেজি হলো ‘ইকোনোমিকস’ (Economics); এই ইকোনোমিকস শব্দটি গ্রিক শব্দ ‘ওইকোনোমিয়া’ (Oikonomia) থেকে উৎপত্তিলাভ করেছে। ‘ওইকোনোমিয়া’ অর্থ ‘গৃহ পরিচালনা’ (Household Management)।
গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটল বলেছেন, গৃহ পরিচালনা করার বিজ্ঞান হলো অর্থনীতি। তবে সময়ের ব্যবধানে ‘অর্থনীতি’ আর অ্যারিস্টটলের ‘গৃহ পরিচালনা করার বিজ্ঞান’র মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি।
আবার বিখ্যাত পণ্ডিত কৌটিল্যের ‘অর্থশাস্ত্র’ নামক গ্রন্থের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে; কৌটিল্য সেখানে প্রাচীনকাল হতে অর্থনীতি চর্চার কথা বলে থাকলেও আধুনিক যুগের পণ্ডিত কিংবা গবেষকগণ মনে করেন- অর্থনীতি সম্পূর্ণভাবে আধুনিক শাস্ত্র।
অর্থনীতির সংজ্ঞা (Definition of Economics)
বিভিন্ন অর্থনীতিবিদ অর্থনীতির সংজ্ঞা বিভিন্নভাবে দিয়েছেন । এই সংজ্ঞাগুলোকে তিন শ্রেণিতে ভাগ করা যায় বলে পণ্ডিতগণ মত দিয়েছেন।
অর্থনীতির সংজ্ঞার এই তিনটি ভাগ হলো-
- ১. সম্পদের বিজ্ঞান (Science of Wealth)
- ২. কল্যাণের বিজ্ঞান (Science of Welfare)
- ৩. অপ্রাচুর্যের বিজ্ঞান (Science of Scarcity)
এখানে সম্পদের বিজ্ঞান (Science of Wealth) হিসেবে যারা অর্থনীতিকে অভিহিত করেছেন তাঁরা হলেন অ্যাডাম স্মিথ, ডেভিড রিকার্ডো, জন স্টুয়ার্ট মিল প্রমুখ। এই ক্ল্যাসিক্যাল অর্থনীতিবিদগণ ছিলেন অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষের দিকের।
অর্থনীতিকে কল্যানের বিজ্ঞান বলে যারা মত দিয়েছেন তাঁদের মধ্যে প্রধান প্রধান হলেন আলফ্রেড মার্শাল। আলফ্রেড মার্শালকে আধুনিক অর্থনীতির জনক বলা হয়। এছাড়াও ফিশার, পিগু, ডেভেনপোর্ট, ক্যানন, অ্যারো প্রমুখ অর্থনীতিবিদরা অর্থনীতিকে কল্যাণের বিজ্ঞান (Science of Welfare) বলে অভিহিত করেছেন। এই শ্রেণির অর্থনীতিবিদগণকে বলা হয় নিউ ক্ল্যাসিক্যাল অর্থনীতিবিদ।
লিয়োনেল রবিন্স হলেন তৃতীয় প্রকারের সংজ্ঞার প্রধান প্রবক্তা। লিয়োনেল রবিন্স প্রদত্ত সংজ্ঞাটি সবচেয়ে বিজ্ঞানসম্মত মনে করেন অনেকে। এটি ত্রুটিমুক্ত না হলেও, এর গ্রহণযোগ্যতা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রফেসর লিয়োনেল রবিন্স, ক্রেয়ারন্ক্রস প্রমুখ অর্থনীতিবিদগণ অর্থনীতিকে ‘অপ্রাচুর্যের বিজ্ঞান’ (Science of Scarcity) বলে অভিহিত করেছেন।
অ্যাডাম স্মিথের সংজ্ঞা
ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ অ্যাডাম স্মিথকে আধুনিক অর্থশাস্ত্রের জনক বলা হয়। তিনি ১৭৭৬ সালে ‘An Inquiry into the Nature and Causes of the Wealth of Nations’ নামক গ্রন্থ লিখে অর্থনীতির মূল বিষয়গুলি সম্পর্কে ধারণা দেন৷ অ্যাডাম স্মিথ বলেন, ‘অর্থনীতি হচ্ছে এমন এক বিজ্ঞান যা জাতিসমূহের সম্পদের প্রকৃতি এবং তার কারণ অনুসন্ধান করে’।
সম্পদ কীভাবে উৎপাদিত হয় এবং তা কীভাবে মানুষের উপকারে লাগে তাই ছিল তার আলোচ্য বিষয়। অ্যাডাম স্মিথ সম্পদের ওপর অধিক গুরুত্ব দিয়েছেন।
মার্শালের সংজ্ঞা
আলফ্রেড মার্শাল (Alfred Marshall) ছিলেন একজন ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ। অর্থনীতি নিয়ে মার্শালের সংজ্ঞার মূল আলোচ্য বিষয় হলো অভাব মোচনসংক্রান্ত মানুষের দৈনন্দিন কার্যাবলি।
১৮৯২ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত ‘Economics of Industry’ গ্রন্থে মার্শাল বলেছেন, ‘অর্থনীতি মানুষের জীবনের দৈনন্দিন সাধারণ কার্যাবলি আলোচনা করে’।
এখানে ‘মানুষের সাধারণ কার্যাবলি’ বলতে বোঝানো হয়েছে যে, মানুষ কীভাবে অর্থ উপার্জন করে ও কীভাবে সেই উপার্জিত অর্থ তার বিভিন্ন অভাব মেটানোর জন্য ব্যয় করে।
ক্যানন, অ্যারো, পিগু এবং অন্য অর্থনীতিবিদরা মার্শালের এ বক্তব্যের সাথে একমত প্রকাশ করেন।
লিয়োনেল রবিন্সের সংজ্ঞা
বিশ্বের অন্যতম সেরা সামাজিক বিজ্ঞান বিশ্ববিদ্যালয় London School of Economics and Political Science (LSE) এর এক সময়ের প্রফেসর লিয়োনেল চার্লস রবিন্স (Lionel Charles Robbins, Baron Robbins) তাঁর ‘Nature and Significance of Economic Science’ নামক গ্রন্থে বলেছেন, “অর্থনীতি মানুষের অসীম অভাব এবং বিকল্প ব্যবহারযোগ্য সসীম সম্পদের সম্পর্ক বিষয়ক মানব আচরণ সম্বন্ধে আলোচনা করে।”
গবেষকগণ প্রফেসর লিয়োনেল রবিন্সের সংজ্ঞায় ৩ টি বৈশিষ্ট্য খুঁজে পেয়েছেন। এগুলো হলো:
- ১. অসীম অভাব
- ২. সীমিত সম্পদ
- ৩. সম্পদের বিকল্প ব্যবহার
১. অসীম অভাব
প্রতিটি মানুষের অভাব অসীম বা সীমাহীন। মানুষের একটি অভাব মিটলে সাথে সাথে অন্য অভাব দেখা দেয়। মানুষের এই অভাব থেকে সমস্যার সৃষ্টি হয় এবং সে এসব সমস্যার মোকাবেলা করার জন্য নিরন্তর অর্থনৈতিক প্রচেষ্টা চালিয়ে যায়। এ বোধ থেকেই মানুষের অর্থনৈতিক কর্ম প্রচেষ্টার উদ্ভব হয়।
২. সীমিত সম্পদ
অর্থনীতিতে সম্পদের একটি বিশেষ অর্থ আছে। যেসব দ্রব্যের উপযোগ আছে, বিনিময় মূল্য আছে; অর্থাৎ যোগান সীমিত, হস্তান্তরযোগ্য এবং বাহ্যিকতা আছে, তাকে সম্পদ বলে। অসীম অভাবের তুলনায় মানুষের সম্পদ খুব সীমিত। সম্পদের অপ্রতুলতার জন্য মানুষকে অর্থনৈতিক সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। আবার, সম্পদ সীমিত বলে বিভিন্ন অভাবের মধ্যে কোন্টি অত্যাবশ্যকীয় তা বাছাই করতে হয়।
৩. সম্পদের বিকল্প ব্যবহার
লিয়োনেল রবিন্সের সংজ্ঞায় দুষ্প্রাপ্য সম্পদের বিকল্প ব্যবহারের উপর জোর দেয়া হয়েছে। উৎপাদনের উপকরণগুলো বিকল্প ব্যবহারযোগ্য। মানুষের অভাব অসীম; কিন্তু উৎপাদনের উপকরণ বা সম্পদ সীমিত। তাই সসীম সম্পদের সাহায্যে কিভাবে অসীম অভাব পূরণ করা যায়, তাই অর্থনীতির আলোচনার অন্যতম মূল বিষয়।
একই উৎপাদনের উপকরণ বা সম্পদ একাধিক অভাব মেটানোর জন্য ব্যবহৃত হতে পারে। যেমন- এক টুকরো জমিতে ধান ও পাট উভয়ই চাষ করা যায়, কিন্তু একসাথে চাষ করা যায় না। ধান চাষ করলে পাট চাষ করা যায় না। অর্থাৎ সীমিত সম্পদ দিয়ে একই সময়ে একাধিক অভাব মেটানো সম্ভব নয়। তাই সম্পদের বিকল্প ব্যবহার জরুরি হয়ে পড়ে। এজন্য মানুষকে তার সীমাহীন অভাবসমূহের মধ্যে কোনটি আবশ্যকীয় তা বাছাই করতে হয় এবং বাছাইকৃত অভাব বিকল্প ব্যবহারযোগ্য সম্পদ দ্বারা মেটাতে হয়।
অর্থনীতির পরিধি বিষয়বস্তু (Scope or Subject Matters of Economics)
অর্থনীতির পরিধি বা বিষয়বস্তু নিয়ে অর্থনীতিবিদদের মধ্যে নানা মতভেদ আছে। অর্থনীতির পরিধি বা বিষয়বস্তু সম্পর্কে নিচে আলোচনা করা হলো।
১. অর্থনীতি একটি সামাজিক বিজ্ঞান
অর্থনীতি সমাজবদ্ধ মানুষের আচরণ ও কার্যাবলি আলোচনা করে; এখানে সেই ধরনের কার্যাবলি আলোচনা বা বিশ্লেষণ করে, যে-সব কার্যাবলি অর্থ-আয় ও অর্থ-ব্যয়ের সাথে জড়িত, কেবল সেসব কার্যাবলি নিয়ে অর্থনীতি আলোচনা করে। সমাজবহির্ভূত মানুষের আচরণ ও কার্যাবলি অর্থনীতির আলোচ্য বিষয় নয়।
২. অন্যান্য বিজ্ঞানের কিছু বিষয়বস্তু অর্থনীতিতে অন্তর্ভুক্ত
অর্থনীতিকে অনেক সময় অন্যান্য বিষয়ের সাহায্য নিতে হয়। এমন অনেক অর্থনৈতিক বিষয়বস্তু আছে, যে-গুলোর ক্ষেত্রে কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছার জন্য রাষ্ট্রবিজ্ঞান, মনস্তাত্ত্বিক বিজ্ঞান, নীতিবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান প্রভৃতির সাহায্যের প্রয়োজন হয়।
যেমন: আয়কর প্রগতিশীল হলে কর দাতাদের মানসিকতা কীরূপ হবে তা মনস্তাত্ত্বিক বিজ্ঞানের সাহায্যে জানা যাবে।
৩. অর্থনীতির মূল লক্ষ্য অভাব মোচন
মানুষ কীভাবে তাদের অভাব মোচন করে তা-ই অর্থনীতির আলোচ্য বিষয়। সমাজবদ্ধ মানুষ তার সামাজিক জীবনে অসীম অভাবের সম্মুখীন হয়। কিন্তু অসীম অভাবের তুলনায় সম্পদ অত্যন্ত সীমিত।
স্টোনিয়াম এবং হেগ বলেছেন যে, অর্থনীতি হলো স্বল্পতা এবং স্বল্পতাজনিত সমস্যাদি আলোচনার শাস্ত্র।
মানুষ সীমিত সম্পদ দিয়ে কীভাবে হক সম্পদ উৎপন্ন করে এবং কীভাবে এ সম্পদের সুষ্ঠু বণ্টনের মাধ্যমে তার অভাব মোচন ও সার্বিক কল্যাণ অর্জন করে তা-ই অর্থনীতির মূল আলোচ্য বিষয়।
উপরোক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে এটা স্পষ্টই প্রতীয়মান হয় যে, অর্থনীতির বিষয়বস্তু বা পরিধি অত্যন্ত ব্যাপক। অর্থনীতিবিদদের মধ্যে কেউ কেউ ব্যাপক অর্থে এবং কেউ কেউ সংকীর্ণ অর্থে এর পরিধি নির্ধারণ করেছেন। অ্যাডাম স্মিথের মতে, জাতিসমূহের সম্পদের প্রকৃতি ও কারণ সম্পর্কে দান করা অর্থনীতির কাজ। আলফ্রেড মার্শাল যুক্তি দেন যে অর্থনীতির বিষয়বস্তু হলো- মানুষের দৈনন্দিন কার্যাবলি। অন্যদিকে অধ্যাপক লিয়োনেল রবিন্সের মতে, অপ্রাচুর্যজনিত সমস্যাবলীর অনুশীলন অর্থনীতির মূল বিষয়বস্তু।
অর্থনৈতিক বিধিসমূহ বাস্তবক্ষেত্রে প্রয়োগ করে অনেক অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান বের করা যায়। অর্থনৈতিক তত্ত্বজ্ঞান প্রয়োগ করে উৎপাদন, ভোগ, বণ্টন, সরকারি অর্থব্যবস্থা, ব্যাংক ও মুদ্রা ব্যবস্থা, বাজার ব্যবস্থা, দ্রব্যমূল্য নির্ধারণ, জনসংখ্যা, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য প্রভৃতি সংক্রান্ত সকল সমাধান বের করা সম্ভব। অতএব অর্থনীতির পরিধিও ব্যাপক।
মাশাআল্লাহ
আপনার উত্তর টি খুব ভালো হয়েছে
অসাধারণ লিখনী মাশাআল্লাহ
Valuable information
খুব ভালো লাগলো
অনেক ভালো লাগলো। আলহামদুলিল্লাহ, বুঝলাম অনেক কিছু।
আরও সুন্দর সুন্দর প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার অনুরোধ রইলো। ধন্যবাদ।