পাঠ পরিকল্পনার ধারণা, পাঠ পরিকল্পনা প্রণয়নের কৌশল ও উদ্দেশ্য বা প্রয়োজনীয়তা
- প্রকাশ: ১১:১৬:৪৮ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২১
- / ৩৫১৯৫ বার পড়া হয়েছে
পাঠ পরিকল্পনা লিখিত হওয়া উচিৎ | Photo by Nils Stahl on Unsplash
শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হচ্ছে পরিকল্পিত শিখন-শেখানো কার্যক্রম পরিচালনা করা। এই শিখন-শেখানো কার্যক্রমটি পরিচালনার অন্যতম হাতিয়ার হচ্ছে কার্যকর পাঠ পরিকল্পনা। পাঠ পরিকল্পনা সুষ্ঠুভাবে শ্রেণিকার্যক্রম সম্পাদনের সুচিন্তিত ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। এই ধারাবাহিক প্রক্রিয়ায় গুরুত্ব দেওয়া হয় নির্দিষ্ট শিখনফল নির্বাচন ও তা অর্জনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীর আচরণের ইতিবাচক পরিবর্তন সাধনের উপর।
পাঠ পরিকল্পনা কী?
একটি বিশেষ পাঠ উপস্থাপনের উদ্দেশ্যে প্রস্ততকৃত, সুচিন্তিত, পদ্ধতিগত ধারাবাহিক প্রক্রিয়ার লিখিত রূপটি হলো পাঠ পরিকল্পনা (Lesson Plan)। দৈনন্দিন পাঠে এই পরিকল্পনাটি করতে হয় বলে একে দৈনন্দিন পাঠ পরিকল্পনাও বলা যেতে পারে। পাঠ পরিকল্পনার মাধ্যমে শিক্ষক পাঠের প্রতিটি ধাপ মানসপটে দেখতে পান। ফলে তাঁর পাঠদান যথার্থ হয়; অর্জিত হয় শিখনফল অনুসারে শিক্ষার্থীর শিখন। এমনকি শিক্ষক তাঁর পাঠের সবল-দুর্বল দিক সম্পর্কে আত্মবিশ্লেষণের মাধ্যমে দক্ষ হয়ে ওঠেন এবং পরবর্তী পাঠে তার সফলতার পরিমাণ বাড়াতে পারেন।
এন. এ. বর্সিং বলেছেন- “শ্রেণিকক্ষে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে, কাজের মাধ্যমে, উদ্দেশ্যে পৌঁছানোর জন্যে বিভিন্ন করণীয় বিষয়ের বিবরণই হলো পাঠ পরিকল্পনা।”
শিক্ষাবিদ মনরোর (Monroe) মতে, “পাঠ পরিকল্পনা হলো একটি পূর্বপরিকল্পিত বিষয়ভিত্তিক লিখিত রূপ যার মাধ্যমে শিক্ষক তাঁর শ্রেণিতে পাঠদান করেন।” [Lesson plan is the name of a statement of the things a teacher proposes to do during the period he spends with his class.]
পাঠ পরিকল্পনা প্রণয়ন: বিবেচ্য বিষয়
সুষ্ঠু ও পদ্ধতিগত পাঠ পরিকল্পনা প্রণয়নের উপর নির্ভর করে পাঠের শিখনফল অর্জন। কী শেখাবেন, কীভাবে শেখাবেন, কাকে শেখাবেন, কেন শেখাবেন; এই প্রশ্নগুলো সামনে রেখে শিক্ষক পাঠ পরিকল্পনা করে থাকেন। কার্যকর পাঠ পরিকল্পনার মাধ্যমে সময়ের সঠিক ব্যবহার করে একজন শিক্ষক কাক্সিক্ষত ফলাফল অর্জনে সক্ষম হন। আমরা বর্তমানে শ্রেণিকার্যক্রমে যে পাঠ পরিকল্পনা অনুসরণ করি তা জার্মান শিক্ষাবিদ ও দার্শনিক জোহান ফ্রেইডরিক হার্বার্টের (Johann Freidrich Herbart, 1776-1841) মতবাদভিত্তিক পাঠ পরিকল্পনা। হার্বার্ট দার্শনিক এবং শিক্ষাবিদ ছিলেন বলেই তিনি বিশ্বাস করতেন পাঠদান ও পাঠগ্রহণে শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীর পারস্পরিক সম্পর্ক মানসিক পরিবেশের উপর অনেকাংশে নির্ভরশীল। তাই পাঠ পরিকল্পনা করার সময় শিক্ষকের অবশ্যই শ্রেণির শিক্ষার্থী সম্পর্কিত সার্বিক ধারণা থাকতে হবে। শিক্ষার্থীর মেধা, চাহিদা, বয়স, আগ্রহ, সামর্থ্য, প্রবণতা, রুচি, ঝোঁক ইত্যাদি জানা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর অংশগ্রহণের সুযোগ থাকতে হবে পাঠ পরিকল্পনায়।
পাঠ পরিকল্পনা প্রণয়ের জন্য যে কয়েকটি মূল বিষয় বিবেচনা করতে হবে তা উল্লেখ করা হলো-
পাঠ পরিকল্পনা হবে সক্রিয় ও অংশগ্রহণমূলক শিক্ষাদান সহায়ক
পাঠ পরিকল্পনাটি হতে হবে সক্রিয় অংশগ্রহণমূলক। শিক্ষক পাঠের প্রতিটি পর্বে শিক্ষার্থীর অংশগ্রহণের সুযোগ রাখবেন। তবে সকল বিষয়ের পাঠ পরিকল্পনার মূল কাঠামো একই থাকবে। কিš‧ বিষয় এবং পাঠের বিষয়বস্তর ভিন্নতার কারণে শিখন-শেখানো কার্যাবলি, শিখন অর্জন যাচাই ও উপকরণের ব্যবহার ভিন্ন হতে পারে। শিখন সুদৃঢ় করার লক্ষ্যেঅনুশীলন, কাজ সম্পাদন, শ্রেণির কাজ (একক, জোড়ায় বা দলগত) এবং অনুসন্ধানমূলক প্রজেক্ট শিক্ষার্থীদের দ্বারা সম্পাদনের ব্যবস্থা করতে হবে।
পাঠের উদ্দেশ্য শিক্ষার্থীদের অর্জন করানোর জন্য যেহেতু পাঠ পরিকল্পনাটি করা হয়ে থাকে তাই শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক পাঠ উপস্থাপনের এই যে পরিকল্পনা তা যথাসম্ভব কর্মকেন্দ্রিক (activities oriented) এবং মিথস্ক্রিয়া (interactive) হবে। বিভিন্ন শিখনমূলক শেখানো পদ্ধতি ও কৌ শলের সাহায্যে তা সম্পাদন সম্ভব। প্রশ্নোত্তর, জোড়ায় কাজ, দলগত কাজ, প্রদর্শন, মাইন্ড ম্যাপিং, ওয়াকিং ওয়াল, পোস্ট বক্স, আলোচনা, মার্কেট পেস্নস, এক্সপার্ট জিগসো, হট পটেটো, ভূমিকাভিনয়, মাথা খাটানো ইত্যাদি পদ্ধতি ও কৌশল ব্যবহারের মাধ্যমে পাঠ কর্মকেন্দ্রিক, মিথস্ক্রিয়া ভিত্তিক এবং আনন্দদায়ক হয়ে ওঠে। তাই শিক্ষার্থীর বয়স ও মানসিক সামর্থ্য বিবেচনা করে শিক্ষক সর্বাপেক্ষা উপযোগী পদ্ধতি ও কৌশল অনুসরণ করবেন।
পাঠ পরিকল্পনা হবে কার্যকর, আকর্ষণীয় ও বৈচিত্র্যময় পাঠদান উপযোগী
পাঠকে কার্যকর, আকর্ষণীয় ও বৈচিত্র্যময় করে তোলার জন্যে পাঠ পরিকল্পনা প্রণয়নে প্রাসঙ্গিক সহায়ক উপকরণ নির্বাচন করতে হবে। এ কাজটি শিক্ষককে অত্যন্ত সুচিন্তিতভাবে করতে হবে। পাঠের প্রয়োজন অনুযায়ী যথাসম্ভব সহজলভ্য (স্বল্প মূল্য বা বিনামূল্যের) শিক্ষা উপকরণ এবং প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষা উপকরণ ব্যবহারের সুযোগ রাখা আবশ্যক। শিক্ষা সহায়ক উপকরণের ব্যবহার প্রাসঙ্গিক ও যথাযথ হওয়া সম্পর্কেও শিক্ষকের স্পষ্ট ধারণা রাখতে হবে।
পাঠ পরিকল্পনা হবে শিখনফল কেন্দ্র করে
পাঠ পরিকল্পনার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হচ্ছে শিখনফল। শিক্ষার্থীদের শিখনফল অর্জন করানোই শ্রেণি পাঠদানের অন্যতম উদ্দেশ্য। আচরণের কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তনই শিখনফলের মূল লক্ষ্য। পাঠ পরিকল্পনা প্রণয়নের ক্ষেত্রে বর্তমানে আচরণিক উদ্দেশ্য লেখার পরিবর্তে শিখনফল সংযোজিত হয়েছে। শিখনফলটি সকর্মক ক্রিয়ায় আচরণিক ভাষায় লিখতে হবে। শিক্ষাক্রম বা পাঠ্যপুস্তকে উল্লিখিত শিখনফল প্রয়োজনে বিভাজন করে পাঠ পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে। একটি পাঠে একাধিক শিখনফল থাকতে পারে। তবে প্রতিটি শিখনফলের জন্য শিখন-শেখানো কার্যাবলি, পাঠ উপস্থাপন, শিখন অর্জন যাচাই, শিক্ষা উপকরণ ইত্যাদি আলাদা হতে পারে।
পাঠ পরিকল্পনায় মূল্যানকে গুরত্ব দিতে হবে
শিক্ষক পাঠ পরিকল্পনা প্রণয়নে শিখন-শেখানো কার্যক্রমের বিভিন্ন ধাপের (প্রস্ততি, উপস্থাপন, মূল্যায়ন) সময় উলেস্নখ করবেন এবং পাঠের জন্যে বরাদ্দকৃত সময় প্রয়োজন অনুসারে বিভাজন করবেন। প্রতিটি পাঠ পরিকল্পনায় কমপক্ষে একটি চিন্তনমূলক (Thought provoking) এবং সৃজনশীল প্রশ্ন বা কাজ থাকতে হবে। বাড়ির কাজটিও পাঠ পরিকল্পনায় উল্লেখ করতে হবে।
পাঠ পরিকল্পনা প্রণয়নের উদ্দেশ্য, প্রয়োজনীয়তা বা সুবিধা
পাঠ পরিকল্পনা প্রণয়ন করে পাঠদান করা হলে অনেক রকম সুবিধা পাওয়া যায়। পাঠ পরিকল্পনা প্রণয়ের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য হলো শিক্ষার্থীদেরকে সুচিন্তিতভাবে পাঠদান করে শিখনফল অর্জন সহজতর করা
সমর্থ করে তোলা: পাঠের লক্ষ্যই হলো শিক্ষাক্রম অনুযায়ী শিখনফল অর্জন। শিক্ষক শিখনফল অর্জনের উদ্দেশ্যকে মাথায় রেখে পাঠ পরিকল্পনাটি সুচিন্তিতভাবে প্রণয়ন করলে পাঠের প্রতিটি উদ্দেশ্য কার্যকরভাবে অর্জনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা সমর্থ হয়ে ওঠে।
নিয়ন্ত্রিত ও সংগঠিত করা: পাঠ কার্যক্রমকে নিয়ন্ত্রিত ও সংগঠিত করা পাঠ পরিকল্পনার একটি অন্যতম উদ্দেশ্য। পাঠের বিভিন্ন পদ্ধতি ও কৌশল ব্যবহারের মাধ্যমে পাঠকে নিয়ন্ত্রিত ও সংগঠিত করা যায়। পাঠটি নিয়ন্ত্রিত ও সংগঠিত হলে শিক্ষার্থীরা সহজেই পাঠের উদ্দেশ্য অর্জনে সক্ষম হবে। এটিও শিক্ষকের জন্য অনেক বড়ো একটি সুবিধা।
আকর্ষণীয় করা: বিভিন্ন পদ্ধতি ও কৌশল ব্যবহার করে এবং উদাহরণের মাধ্যমে শিক্ষক শিখন-শেখানো কার্যক্রমকে আকর্ষণীয় করে তোলা সম্ভব। পাঠদান আর্কষণীয় হলে শিক্ষার্থীরা পাঠে আনন্দ পাবে এবং শিখনফল অর্জন অনেক বেশি কার্যকর ও স্থায়ী হবে।
ধারাবাহিকতা রক্ষা করা: পাঠদান কার্যক্রমে ধারাবাহিকতা না থাকলে শিখন উদ্দেশ্যের যথার্থতা ব্যাহত হবে। শিক্ষক পূর্ববর্তী ও পরবর্তী পাঠের ধারাবাহিকতা রক্ষা করে পাঠ পরিকল্পনাটি করবেন। তাহলে পাঠের পুনরাবৃত্তি ঘটবে না।
কাজ সুনির্দিষ্ট করা: অংশগ্রহণমূলক শিখনে শ্রেণি কার্যক্রমে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর কাজ সুনির্দিষ্ট থাকতে হবে। পাঠের শিখনফল অর্জনে এটি অত্যন্ত জরুরি। পাঠ পরিকল্পনা তৈরির সময় এই বিষয়টিতে খেয়াল রাখা উচিৎ, এতে শিক্ষকের কাজ আরও সহজ হয়।
ত্রুটি-বিচ্যুতি চিহ্নিত ও দূরীকরণ: শিখনফল অর্জনে ক্ষেত্রে ত্রুটি-বিচুতি চিহ্নিত করে তা দূর করার ব্যবস্থা করতে হবে। আর এটি একটি সুচিন্তিত পাঠ পরিকল্পনায় মাধ্যমে সহজেই করা যায়।
সময় নির্ধারণ: পাঠ পরিকল্পনায় প্রতিটি ধাপ, উপধাপ ও কাজের জন্যে ব্যয়িত সময়ের উল্লেখ করা থাকে। ফলে কাজের ব্যাপ্তি অনুযায়ী শিক্ষক নির্দিষ্ট বা নির্ধারিত সময়ে শিক্ষার্থীদেরকে পাঠদান করতে সক্ষম হন।
পাঠ পরিকল্পনার সোপান বা ধাপ
পাঠ পরিকল্পনার উদ্ভাবক জার্মান শিক্ষাবিদ ও দার্শনিক জন ফ্রেইডরিক হার্বার্ট। হার্বার্ট পাঠ পরিকল্পনার পাঁচটি সোপানের কথা বলেন যা হার্বার্টের পঞ্চসোপান নামে পরিচিত। এই পঞ্চসোপানের উপর ভিত্তি করে পাঠ পরিকল্পনা করা হয়। সোপানগুলো নিম্নরুপ-
১. প্রস্ততি (Preparation)
২. উপস্থাপন (Presentation)
৩. তুলনাকরণ (Comparison)/অনুষঙ্গ স্থাপন (Association)
৪. সূত্রগঠন /সামান্যীকরণ (Generalisation)
৫. প্রয়োগ/ অভিযোজন (Application)
বর্তমানে হার্বার্টের পঞ্চসোপানকে সংক্ষপ্তি করে তিনটি সোপানে রূপ দেওয়া হয়েছে, যা হার্বার্টের ত্রিসোপান নামে পরিচিত। এই ত্রিসোপানকে ভিত্তি করে পাঠ পরিকল্পনা তৈরি করা হয়। সোপান তিনটি হচ্ছে-
১. প্রস্ততি (Preparation)
২. উপস্থাপন (Presentation)
৩. মূল্যায়ন (Evaluation)
(বাংলাদেশ শিক্ষা শিক্ষামন্ত্রনালয় কর্তৃক ‘টিকিউ-২’ প্রজেক্টের এর আওতায় শিক্ষকদের জন্য প্রকাশিত ম্যানুয়াল থেকে পুর্নলিখিত)
আরও পড়তে পারেন–
পাঠ পরিকল্পনা: পাঠ পরিকল্পনার সংজ্ঞা এবং হার্বার্টের পঞ্চসোপান ও আধুনিক ত্রিসোপান
ম্যাক্রো ও মাইক্রো পাঠ পরিকল্পনা
পাঠটীকা কী? পাঠটীকা প্রণয়নের পূর্বশর্ত এবং পাঠটীকার প্রয়োজনীতা কী?