পাঠ-পরিকল্পনায় পাঠ্যপুস্তক এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির প্রয়োজনীয়তা ও ব্যবহার
- প্রকাশ: ০১:১৫:৪০ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২১
- / ৬০০৫ বার পড়া হয়েছে
পাঠ পরিকল্পনা বা লেসন প্ল্যান অনুসরণ করে একজন শিক্ষক শ্রেণিকক্ষে পাঠদান করছেন । Photo by National Cancer Institute on Unsplash
একটি নির্দিষ্ট শিক্ষাক্রমের আলোকে বিশেষ কিছু নীতিমালা অনুসরণ করে পাঠ্যপুস্তক লেখা হয়; অর্থাৎ শিক্ষাক্রমের প্রতিফলন ঘটে পাঠ্যপুস্তকে। তাই উদ্দেশ্যমুখী এই শিক্ষাক্রমের আলোকে রচিত বই বা পুস্তককেই পাঠ্যপুস্তক বলা হয়। শিক্ষার্থীর চাহিদা, বয়স, সামর্থ্য, প্রয়োজনীয়তা ইত্যাদি বিবেচনা করে পাঠ্যপুস্তকের বিষয়বস্তু নির্বাচন করা হয়। এর সুদূরপ্রসারি লক্ষ্য থাকে শিক্ষার্থীদের মানবতাবাদী, দেশপ্রেমিক, প্রকৃতিপ্রেমিক, বিজ্ঞানমনস্ক সর্বোপরি মানব সম্পদ হিসেবে তৈরি করা।
পাঠ্যপুস্তক ছাড়া পাঠ-পরিকল্পনা করা সম্ভব নয়। শিক্ষক পাঠ্যপুস্তকে নির্বাচিত বিভিন্ন অধ্যায়, পাঠ বা বিষয়বস্তু শ্রেণিতে কার্যকরভাবে পাঠদানের জন্যে পাঠ-পরিকল্পনা করে থাকেন। এই পরিকল্পনার সাফল্য তথা শিক্ষার্থীদের শিখনফল অর্জন অনেকখানিই নির্ভর করে পাঠ্যপুস্তকটির যথাযথ ব্যবহারের উপর। পাঠ্যপুস্তক হলো শিখন-শেখানো কার্যক্রমে সর্বাধিক ব্যবহৃত শিক্ষা উপকরণ। এখানে পাঠ-পরিকল্পনায় পাঠ্যপুস্তক ও তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ব্যবহার নিয়ে আলোচনায় ‘বাংলা’ বিষয়কে উদাহরণ হিসেবে নেওয়া হয়েছে।
পাঠ-পরিকল্পনায় পাঠ্যপুস্তকের প্রয়োজনীয়তা
শিক্ষক পাঠ্যপুস্তক অনুসরণ করেই মূলত শ্রেণিকক্ষে পাঠদান করে থাকেন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠ্যপুস্তকের ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। পাঠ্যপুস্তক ব্যতীত শিক্ষা ব্যবস্থা অকল্পনীয়। আমাদের দেশে শিক্ষক ও শিক্ষার্থী উভয়েই পাঠ্যপুস্তকের উপর নির্ভরশীল। পাঠ্যপুস্তককে কেন্দ্র করেই শিখন-শেখানো কার্যক্রম পরিচালিত হয়। তাই পাঠ-পরিকল্পনায় পাঠ্যপুস্তকের গুরুত্ব অপরিসীম। যে কোনো শ্রেণিরই হোক না কেন, শিক্ষক পাঠ-পরিকল্পনাটি তৈরি করেন পাঠ্যপুস্তকটি সামনে রেখে। পাঠ পরিকল্পনায় শিখনফল একটি অপরিহার্য অংশ। আর নির্দিষ্ট পাঠের এই শিখনফল নির্বাচন করার জন্যে পাঠ্যপুস্তক প্রয়োজন।
পাঠ-পরিকল্পনার উপস্থাপন ধাপের প্রথমেই কবি/লেখক পরিচিতি থাকে। পাঠ্যপুস্তকেও প্রতিটি গল্প/কবিতায় কবি/লেখক পরিচিতির নির্দিষ্ট অংশ থাকে। কবি বা লেখকের পরিচিতি সম্পর্কে জানার জন্যে এ অংশে পাঠ্যপুস্তকটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন
করে থাকে। গল্প ও কবিতার নির্বাচিত অংশের মর্ম উপলব্ধির জন্যে পাঠ-পরিকল্পনার উপস্থাপন পর্বে শিক্ষক আদর্শরূপে আবৃত্তি বা পাঠ করে থাকেন। প্রমিত উচ্চারণে পঠিত শিক্ষকের আদর্শ পাঠ অনুসরণ করে শিক্ষার্থী সরব পাঠে অংশগ্রহণ করে থাকে।
এই দুটো ধাপে শিক্ষকের পাঠ অনুসরণে শিক্ষার্থী পাঠ্য বিষয়বস্তুর বাক্য গঠনরীতি ও ভাষার রূপ-নির্মিতি অনুধাবন করে থাকে।
কবিতার ভাব, আবেগ ও ছন্দ অনুসরণ করে আবৃত্তির দক্ষতা রপ্ত করে। তাই আদর্শ পাঠ ও সরব পাঠে পাঠ্যপুস্তক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
শিক্ষক পাঠ্যপুস্তকের নির্বাচিত পাঠ্যাংশ পাঠ করার সময় শিক্ষার্থী পাঠ্যপুস্তকের সহায়তায় তাঁকে অনুসরণ করে বলে শিক্ষার্থীর পক্ষে পরবর্তীতে শুদ্ধরূপে, স্পষ্ট উচ্চারণে পাঠ করা সম্ভব হয়। কারো উচ্চারণে জড়তা, অস্পষ্টতা থাকলে শিক্ষক তা ঠিক করে দেন। শিক্ষার্থী শব্দের অল্পপ্রাণ, মহাপ্রাণ ধ্বনি ও নাসিক্য ধ্বনির যথার্থতা বজায় রেখে জড়তামুক্ত উচ্চারণের মাধ্যমে উচ্চারণবিকৃতি পরিহার করতে পারে। পাঠ-পরিকল্পনায় উল্লিখিত উচ্চারণ শেখানোর এ কাজটিতেও পাঠ্যপুস্তকের ব্যবহার গুরুত্বপূর্ণ।
পাঠ-পরিকল্পনার উপস্থাপন ধাপের একটি উপধাপ শব্দার্থ শিক্ষণ। শিক্ষার্থীরা পাঠ্যপুস্তক ব্যবহারের মাধ্যমে শব্দের অর্থ সম্পর্কে একটি ধারণা অনুমান করে নেয়। শব্দের অর্থ অনুধাবনের মাধ্যমে বাক্যের গঠন প্রণালি সফলভাবে আয়ত্ত করতে পারে। শব্দের অর্থ জানা, বাক্য গঠন করা, বানান শুদ্ধভাবে লেখা ইত্যাদি ক্ষেত্রে পাঠ্যপুস্তক প্রয়োজন। পাঠ্যপুস্তকের বিষয়বস্তু অবলম্বনে শিক্ষার্থীরা শুদ্ধ বানান, যুক্তাক্ষর সংবলিত বানানের সাথে পরিচিত হয়।
নির্বাচিত বিষয়বস্তুর মূল বক্তব্য বিশ্লেষণের জন্যে শিক্ষক পাঠ্যপুস্তক ব্যবহার করে থাকেন। শিক্ষার্থীরাও পাঠ্যপুস্তক ব্যবহার করে বিষয়ের মর্ম উপলব্ধি ও রস আহরণ করতে পারে। কবিতার ক্ষেত্রে কবিতার মর্মার্থ অনুধাবন করে কবিতার তাৎপর্য, রস ও কবির অনুভূতিকে হৃদয়ঙ্গম করতে পারে। বিষয়ের বিভিন্ন তত্ত্ব ও তথ্য সম্পর্কে জানতে হলেও পাঠ্যপুস্তক প্রয়োজন। শিক্ষক কী শেখাবেন আর শিক্ষার্থীরাই বা কী শিখবে তা পাঠ্যপুস্তকই নির্ধারণ করে দেয়। মোটকথা শোনা, বলা, পড়া ও লেখা; এ চারটি ভাষাদক্ষতা যথাযথভাবে অর্জিত হয় পাঠ্যপুস্তক ব্যবহারের মাধ্যমে।বর্তমান সৃজনশীল প্রশ্নের উত্তর লেখার কৌশল রপ্তকরণে পাঠ্যপুস্তকের কোনো বিকল্প নেই। পাঠ-পরিকল্পনাতেও তাই পাঠ্যপুস্তক ব্যবহারের ওপর অধিকতর গুরুত্ব দেওয়া হয়। শিক্ষার্থীর ভাষাদক্ষতা উন্নয়ন, শব্দভাণ্ডার বৃদ্ধি, মানসিক উৎকর্ষসাধন, মৌলিক চিন্তার উৎসারণ, বিশ্লেষণী ক্ষমতা বৃদ্ধি, কল্পনাশক্তির প্রসার ও সর্বোপরি পাঠের বিষয়বস্তু যথার্থভাবে উপলব্ধির জন্যে পাঠ-পরিকল্পনায় উল্লিখিত উপায়ে পাঠ্যপুস্তক ব্যবহারের সুফল সুবিদিত।
পাঠ-পরিকল্পনায় পাঠ্যপুস্তকের সফল ব্যবহার
শিক্ষককে পাঠ্যপুস্তকের অনুচ্ছেদ বা বিষয়বস্তুর ধারাবাহিকতা বজায় রেখে পাঠ-পরিকল্পনাটি করতে হয়। তাই তিনি পাঠ-পরিকল্পনা প্রণয়নের পূর্বে পাঠ্যপুস্তকের নির্ধারিত বিয়য়বস্তু বা পাঠটি ভালো করে পড়বেন। এরপর পাঠটিকে ৪৫ বা ৫০ মিনিটের ক্লাসে পড়ানোর উপযোগী একাধিক খণ্ডে ভাগ করবেন। খণ্ড ভাগ করার সময় পাঠের বর্ণনা বা ঘটনাপ্রবাহ বিবেচনায় রাখতে হবে। যেমন- অষ্টম শ্রেণিতে পাঠ্য কামরুল হাসানের ‘আমাদের লোকশিল্প’ প্রবন্ধটির দুটি পাঠ-পরিকল্পনা করতে গেলে প্রথম পাঠটি পাঠ্যপুস্তকের প্রথম অনুচ্ছেদ থেকে পঞ্চম অনুচ্ছেদ পর্যন্ত (খাদ্যশস্যের পরেই বাংলাদেশ….ঐতিহ্য অনুযায়ী হয়) আর দ্বিতীয়টি হতে পারে ষষ্ঠ অনুচ্ছেদ থেকে (বাংলাদেশে গ্রামে গ্রামে….সাহায্য করতে পারে) শেষ অনুচ্ছেদ পর্যন্ত। কারণ এখানে প্রথম পাঁচটি অনুচ্ছেদে একটি বক্তব্যবিষয়ের পূর্ণতা এসেছে।
শিক্ষক পাঠের ভাববস্তু, বিভিন্ন তথ্য ও বিষয়বস্তুর সুস্পষ্টরূপ উপস্থাপনে পাঠ-পরিকল্পনায় পাঠ্যপুস্তক ব্যবহার করবেন। উপকরণ নির্বাচনে বিষয়বস্তুর সাথে সামঞ্জস্য রাখার জন্যে নির্দিষ্ট পাঠটি মনোযোগ দিয়ে পড়বেন। পাঠ-পরিকল্পনার বিভিন্ন ধাপের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে পাঠ্যপুস্তক ব্যবহার করবেন।
শিখন-শেখানো কার্যক্রমে পাঠের শিখনফল অর্জনের জন্য বিভিন্ন পদ্ধতি ও কৌশলের ব্যবহার অপরিহার্য। শিক্ষক শিক্ষার্থীদের নির্বাচিত পাঠ্যাংশটির বোধগম্যতা অর্জন করাতে কোন পদ্ধতি ও কৌশলের ব্যবহার কখন, কীভাবে করবেন- সেবিষয়ক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে পাঠ্যপুস্তকের বর্ণিত বিষয়বস্তুর স্বরূপই তাঁকে সঠিক পথ দেখায়। পাঠের শিখনফল নির্বাচন থেকে শুরু করে মূল্যায়ন ও বাড়ির কাজ নির্ধারণ পর্যন্ত সকল সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে পাঠ্যপুস্তকই হচ্ছে শিক্ষকের প্রকৃত পথপ্রদর্শক।
পাঠ-পরিকল্পনায় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ব্যবহার
উপাত্ত বা ডের (data) সাথে সুনির্দিষ্টতা বা প্রেক্ষাপট যুক্ত হলেই উপাত্তটি হয়ে যায় তথ্য। অর্থাৎ উপাত্ত আর প্রেক্ষাপট সংশ্লিষ্ট হয়ে যে নতুন মাত্রা আসে তা-ই তথ্য বা ইনফরমেশান (information)। উপাত্তের সাথে কোনো ঘটনা, প্রেক্ষাপট বা পরিস্থিতির সম্পর্ক থাকে। এই সম্পর্ক উপাত্তকে বুঝতে ও ব্যবহার করতে সহায়তা করে। উপাত্তের এই নতুন রূপায়ণই হচ্ছে তথ্য।
যোগাযোগ হচ্ছে সংযোগ (connection) আর প্রযুক্তি হচ্ছে যোগাযোগের একটি মাধ্যম। বিজ্ঞানের এই যুগে আমাদেরচারপাশে ছড়িয়ে আছে নানা প্রযুক্তি। তাই বিভিন্ন তথ্য আদান-প্রদানের জন্য আমরা কোনো না কোনো প্রযুক্তি ব্যবহার করে থাকি। এই তথ্য আদান-প্রদানের জন্য আমরা যে প্রযুক্তি ব্যবহার করি তা-ই তথ্যপ্রযুক্তি। বিভিন্ন তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির মধ্যে যে প্রযুক্তিটি মানুষকে সবচেয়ে বেশি সাহায্য করছে সেটি হচ্ছে ডিজিটাল ইলেকট্রনিক্স। বলা যায়, পৃথিবী এর মাধ্যমে একেবারে হাতের মুঠোয় চলে এসেছে। মানুষ হাতের লেখা চিঠি উপেক্ষা করে এখন সেকেন্ডের মধ্যেই পাঠাচ্ছে ই-মেইল। পৃথিবীর যে কোনো স্থানেই থাকুক না কেনো মুহূর্তেই ভিডিও ক্যামেরার সাহায্যে দেখতে পারছে আপনজনকে। ব্রডব্যান্ড, বিভিন্ন মডেম, ওয়াইফাই ইত্যাদি ইন্টারনেট কানেকশানের মাধ্যমে মানুষ যোগাযোগ করতে পারছে যখন খুশি তখন। পুরো পৃথিবীটাই যেন একটা বৃহৎ গ্রাম। সেটা বোঝানোর জন্য নতুন একটা শব্দ আবিস্কার হয়েছে যা গ্লোবাল ভিলেজ (global-village) বা বৈশ্বিক গ্রাম নামে পরিচিত। পাশাপাশি না থেকেও কার্যত (virtually) আমরা সবাই পাশাপাশি, যেন এক আত্মিক সম্পর্ক।
এটি সম্ভব হয়েছে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির জন্যেই। বলা যায়, তথ্য দেওয়া নেওয়া, বাঁচিয়ে রাখা বা সংরক্ষণ করা, আবার খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখা, বিশ্লেষণ করা এবং নিজের কাজে ব্যবহার করার প্রযুক্তিই হচ্ছে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি।বর্তমান সময় তথ্য ও প্রযুক্তির উপর নির্ভরশীল। শিক্ষার সার্বিক গুণগত মানোন্নয়নে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ব্যবহার আজ সময়ের দাবি।
মানুষের জীবনধারণের পদ্ধতিকে বদলে দিয়ে জীবনকে সহজ ও আনন্দময় করেছে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি। এটি শিক্ষাক্ষেত্রেও যোগ করেছে এক নতুন মাত্রা। শিখন-শেখানো কার্যক্রমকে করে তুলেছে সহজ, আনন্দদায়ক ও অধিকতর কার্যকর। শ্রেণিকক্ষে পঠিতব্য বিষয়ের পঠনপরিকল্পনায় ও পরিকল্পনার ফলপ্রসূ বাস্তবায়নে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ব্যবহার শিক্ষককে যেমন সহায়তা করছে তেমনি শিক্ষার্থীর কাছে বিমূর্ত বিষয়টি মূর্তকরণ ও আনন্দদায়ক পরিস্থিতির সৃষ্টি করে কার্যকর শিখন নিশ্চিত করছে ।
শ্রেণিতে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির সফল ব্যবহার
শ্রেণিকক্ষে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হলে শিক্ষকের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি সম্পর্কে ধারণা থাকতে হবে। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির সফল ব্যবহারে শ্রেণি পাঠটি হয়ে ওঠে ক্সবচিত্র্যময়, আকর্ষণীয়, অধিক গ্রহণযোগ্য এবং ফলপ্রসূ। প্রযুক্তি শিখন শেখানো প্রক্রিয়ায় উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে এবং শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অর্জনে সহায়ক হয়।
শ্রেণিকক্ষে শিখন-শেখানো কার্যক্রমের মূল চালিকাশক্তি হচ্ছেন শিক্ষক। তাই শিক্ষককে নির্বাচিত প্রযুক্তি সফলভাবে ব্যবহার করতে হবে। পাঠ-পরিকল্পনায় শিক্ষক তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ব্যবহার এমনভাবে করবেন যেন প্রযুক্তি শিক্ষকের বিকল্প না হয়ে হয় পরিপূরক। পাঠের শিখনফল অর্জনে শ্রেণিতে প্রযুক্তির ব্যবহার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রযুক্তি একটি ইলেকট্রনিক উপকরণ। এর সফল ব্যবহারের মাধ্যমে পাঠদান প্রক্রিয়া সহজরূপ লাভ করেছে। ল্যাপটপ, ডেস্কটপ, ভিডিও ক্যামেরা, ক্যামেরা, মোবাইল, অডিও সাউন্ড সিস্টেম, স্পিকার ইত্যাদি প্রযুক্তি ব্যবহার করে শিক্ষক শ্রেণি পাঠদান কার্যক্রমটি সম্পাদন করতে পারেন। শিক্ষকবিষয়সংশ্লিষ্ট অডিও মোবাইলে শুনিয়ে বা প্রজেক্টরে ভিডিও দেখিয়ে পাঠটি শুরু করতে পারেন। যেমন- ভাষা অন্দোলন বিষয়ক পাঠে ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ অথবা ভাষা আন্দোলন বিষয়ক অন্য কোনো গান বা স্থিরচিত্র প্রদর্শন করে পাঠটি শুরু করা যেতে পারে। পাঠের বিষয়বস্তু উপস্থাপনেও প্রয়োজনে ভিডিও দেখানো যায়।
শিক্ষক বাংলা গদ্য বা কবিতা পাঠদানের ক্ষেত্রে লেখক/কবির বিভিন্ন তথ্য সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের ধারণা লাভ করানোর জন্যে ডিজিটাল কন্টেন্ট ব্যবহার করতে পারেন। পাওয়ার পয়েন্ট প্রোগ্রামে স্মার্ট আর্ট বা এনিমেশনের সাহায্যে লেখক/কবির বিভিন্ন তথ্য কার্যকরভাবে তুলে ধরতে পারেন। প্রয়োজনে ভিডিও প্রদর্শন করেও কবির জীবন ও শিল্প সম্পর্কে ধারণা দিতে পারেন।
শ্রেণিতে পাঠ বিশ্লেষণে বিষয়টি অধিক মূর্ত করার ক্ষেত্রে শিক্ষক চিত্র বা ভিডিও ব্যবহার করবেন। যেমন পাঠের বিষয়বস্তু মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক গল্প বা কবিতা হলে মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন ভিডিও, স্থিরচিত্র প্রদর্শন করে পাঠটি ব্যাখ্যা করবেন। এতে তৎকালীন অবস্থা সম্পর্কে শিক্ষার্থীর ধারণা স্পষ্ট ও দীর্ঘস্থায়ী হবে। শিক্ষার্থীর কাছে পাঠটিও আকর্ষণীয় ও গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠবে।
শিক্ষক মোবাইল ব্যবহার করেও নির্দিষ্ট কবিতাটির আবৃত্তি বা পাঠ শুনাবেন। প্রয়োজনে আবৃত্তিটির ভিডিও দেখাবেন। এতে শিক্ষার্থীর উচ্চারণ-দুর্বলতা কাটবে ও কবিতাটির মূল বক্তব্য সহজেই অনুধাবন করতে পারবে। অর্থাৎ বিমূর্ত বিষয়গুলো শিক্ষার্থীর কাছে মূর্ত হয়ে উঠবে। শিক্ষক পাঠের বিষয়বস্তুর অজানা শব্দগুলো অর্থসহ প্রজেক্টরের সাহায্যে চিত্রে প্রদর্শন করবেন। ছবিসহ দেখলে শিক্ষার্থীরা অজানা শব্দগুলো সহজেই চিনতে এবং মনে রাখতে পারবে। ফলে শিখন দীর্ঘস্থায়ী হবে।
I hear and I forget. I see and I remember. I do and I understand. (Lao Tsu, Chinese Philosopher, 6th century BC)
চাইনিজ দার্শনিকের এই উক্তিটি কার্যকর করে তোলা সম্ভব শ্রেণিতে ডিজিটাল কন্টেন্ট ব্যবহারের মাধ্যমে। শিক্ষক তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির সাহায্যে ডিজিটাল কন্টেন্ট তৈরি করে শ্রেণি কার্যক্রম পরিচালনা করলে বিমূর্ত বিষয়গুলো শিক্ষার্থীর কাছে মূর্ত হয়ে উঠবে। শিক্ষার্থী দেখবে, মনে রাখবে এবং একক কাজ/জোড়ায় কাজ/দলীয় কাজের মাধ্যমে পাঠের বিষয়বস্তু অনুধাবনে সক্ষম হবে। এতে শিখন সহজ ও দীর্ঘস্থায়ী হবে। শিক্ষার্থীরা পাঠের শিখনফল অর্জনে সক্ষম হবে।
শিক্ষক মাঝে মাঝে শিক্ষার্থীদের ধারাবাহিক মূল্যায়নের ক্ষেত্রেও বিভিন্ন ছবি/ভিডিও দেখিয়ে কুইজ প্রতিযোগিতার আয়োজন করতে পারেন এবং তাদের মেধা মূল্যায়নের মাধ্যমে অগ্রগতিও যাচাই করতে পারেন। এ লক্ষ্যে শ্রেণি পাঠের মূল্যায়নেও শিক্ষক বিভিন্ন প্রশ্ন/চিত্র/ভিডিও দেখিয়ে শিক্ষার্থীর পাঠের অগ্রগতি যাচাই করবেন। অগ্রগতি সন্তোষজনক না হলে ডিজিটাল কন্টেন্টটি পরের দিন আরও কার্যকর করে তৈরি করবেন। তিনি বাড়ির কাজ প্রদানেও প্রযুক্তি ব্যবহার করতে পারেন। পাওয়ার পয়েন্টের স্লাইডে ভিডিও দেখিয়ে বা চিত্র প্রদর্শন করে বা প্রশ্নমালা তৈরি করে শিক্ষার্থীদের বাড়ির কাজ দেওয়া যেতে পারে।
মোটকথা, শিক্ষক পাঠ-পরিকল্পনা করার সময় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি ব্যবহারের সুযোগ রেখে এমনভাবে পাঠ-পরিকল্পনাটি করবেন যেন শ্রেণিতে শিখনফল অর্জন সম্ভব হয়। কারণ পাঠ-পরিকল্পনা ও পাঠদান প্রক্রিয়ায় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির সফল ব্যবহার শিক্ষার অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনে ফলপ্রসূ ভূমিকা রাখে এবং শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে সহায়ক হয়।