শ্রেণিকক্ষ ব্যবস্থাপনা কী? শ্রেণিকক্ষ ব্যবস্থাপনার ধারণা ও কৌশল কী কী?
- প্রকাশ: ০৯:২৪:২৪ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২১
- / ২৫৭৫২ বার পড়া হয়েছে
শ্রেণিকক্ষ ব্যবস্থাপনা বা ক্লাসরুম ম্যানেজমেন্ট (Classroom Management) পাঠদান কার্যক্রমের গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। সুষ্ঠুভাবে নিয়মিত শ্রেণি কার্যক্রম পরিচালনার জন্য পাঠদান কার্যক্রমের শ্রেণিকক্ষ ব্যবস্থাপনার ভূমিকা অনস্বীকার্য। এ ধরনের ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে শিখন-শেখানো কার্যক্রমের মান উন্নয়ন করা সহজতর হয়।
শ্রেণিকক্ষ কাকে বলে?
শ্রেণিকক্ষ বা ক্লাসরুম (Classroom) হলো যে-কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ক্ষুদ্র একক। শ্রেণিকক্ষ একটি প্রতিষ্ঠানের চার দেয়াল বা বেড়ার ভিতর হতে পারে আবার নির্দিষ্ট কোনো শিক্ষাঙ্গনের বাইরেও হতে পারে। তাত্ত্বিকভাবে বলতে গেলে বলতে হয়, কোনো প্রতিষ্ঠানের যেখানে জ্ঞান চর্চা করা হয় তা হলো ওই প্রতিষ্ঠানের শ্রেণিকক্ষ। বিভিন্ন দার্শনিক ও শিক্ষাবিদের ভাষায়, ‘যেখানে শিক্ষক ও শিক্ষার্থী অবস্থান করে জ্ঞান চর্চা করা হয় তাকেই শ্রেণিকক্ষ বা ক্লাসরুম বলে’।
শ্রেণিকক্ষ ব্যবস্থাপনার সংজ্ঞা ও ধারণা
প্রতিষ্ঠানের শ্রেণিকক্ষে যেহেতু জ্ঞান চর্চা করা হয় বিশেষ করে শিক্ষকদের সহায়তায় শিক্ষার্থীদেরকে শিক্ষাদান করার কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়, সেহেতু সেখানে উপযুক্ত ব্যবস্থাপনার প্রয়োজন রয়েছে। শ্রেণিকক্ষে সুষ্ঠুভাবে শিখন-শেখানো কার্যক্রম পরিচালনার জন্য যে বিশেষ প্রকৃতির ব্যবস্থাপনার প্রয়োজন হয় তাকে শ্রেণিকক্ষ ব্যবস্থাপনা বলা হয়।
আবুল বাশারের সম্পাদনা শিক্ষামন্ত্রনালয় কর্তৃক প্রকাশিত শিখন-শেখানোর পদ্ধতি ও কৌশল বই অনুসারে ‘যে ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে শিক্ষার্থী এবং শিক্ষকের পারস্পরিক সৌহার্দপূর্ণ আচরণের দ্বারা ভৌত ও মানবীয় উপাদানের সার্বিক ব্যবহার করে জ্ঞান চর্চার অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হয় তাকেই শ্রেণিকক্ষ ব্যবস্থাপনা ক্লাসরুম ম্যানেজমেন্ট (Classroom Management) বলে।
শ্রেণিকক্ষ ব্যবস্থাপনাকে তাত্ত্বিক ও ব্যাপক অর্থে ‘শ্রেণি ব্যবস্থাপনা’ নামেও অভিহিত করা হয়। শ্রেণি শিক্ষককে বলা হয় ব্যবস্থাপনার নির্বাহী কর্মকর্তা।
নির্দিষ্ট শিক্ষাক্রম অনুসারে একজন শিক্ষক বিভিন্ন পদ্ধতি ও কৌশল ব্যবহার করে শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদেরকে শিক্ষা গ্রহণে সহায়তা করেন। শিক্ষার্থীদের শিক্ষার্জনের ক্ষেত্রে শিক্ষক কর্তৃক শ্রেণিকক্ষে যেসব পদ্ধতি ও কৌশল অবলম্বন করা হয় এবং যে সব আনুষঙ্গিক কার্যক্রম সম্পাদন করতে হয় সে সবের সমষ্টি হলো শ্রেণিকক্ষ ব্যবস্থাপনা। এই আধুনিক যুগের শিক্ষাব্যবস্থায় শ্রেণিকক্ষ ব্যবস্থাপনাকে খুবই গুরুত্বের সাথে দেখা হচ্ছে। শিক্ষা গবেষকগণের মতে শিক্ষা ব্যবস্থায় ইতিবাচক ও প্রত্যাশিত পরিবর্তন হলে তা প্রতিফলনের একমাত্র স্থান হচ্ছে শ্রেণিকক্ষ কারণ শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন ধরনের পদ্ধতির সূচনা ঘটছে। শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষক প্রশিক্ষণ ও শিক্ষানীতিতে যত সংস্কার করা হোক না কেন এর প্রতিফলন শ্রেণিকক্ষে পাঠদান প্রক্রিয়ায় প্রতিফলিত না হলে এর কোনো মূল্য থাকবে না।
শ্রেণিকক্ষ ব্যবস্থাপনার প্রকারভেদ
শ্রেণি ব্যবস্থাপনাকে প্রধানত দুই ভাগে ভাগ করা হয়, যেমন-
১. ভৌত ব্যবস্থাপনা
২. মানবীয় ব্যবস্থাপনা
এখানে ভৌত ব্যবস্থাপনার অন্তর্ভুক্ত হলো সকল ভৌত সুবিধাদি; এবং শিক্ষার্থীর পাঠ ধারণ উপযোগী সুবিধাদি মানবীয় ব্যবস্থাপনার অন্তর্ভুক্ত।
শ্রেণিকক্ষ ব্যবস্থাপনার কৌশল
শ্রেণিকক্ষ হলো শিক্ষক-শিক্ষার্থীর পাঠদান ও পাঠ গ্রহণের অন্যতম স্থান, যেখানে শিক্ষার লক্ষ্যের বাস্তবরূপ দিতে শিক্ষককে বেশ জটিল প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। এই জটিল প্রক্রিয়াকে সহজতর করার জন্য প্রয়োজন উপযুক্ত শ্রেণিকক্ষ ব্যবস্থাপনা।
কার্যকরী শ্রেণিকক্ষ ব্যবস্থাপনার জন্য আমেরিকান সাইকোলজিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন (American Psychological Association – APA) শিক্ষকদের ৮ টি পরামর্শ দিয়েছে। এই পরামর্শগুলো হলো-
- শ্রেণিকক্ষে পাঠদানে অস্পষ্ট নিয়ম ব্যবহার করা যাবে না
- পাঠদানের জন্য যে সকল নিয়ম নিয়ম ব্যবহারে শিক্ষক ইচ্ছুক নন, সেসব নিয়ম ব্যবহার করা যাবে না (অনিচ্ছা স্বত্তেও)
- শিক্ষার্থীদের যে সকল আচরণ শ্রেণিকক্ষে বিশৃঙ্খলার সৃষ্ট করে সে সকল আচরণ এড়িয়ে না যাওয়া
- শ্রেণিকক্ষে অসঙ্গতিপূর্ণ আচরণ করা যাবে না
- শিক্ষার্থীদের সাথে অতিরিক্ত কঠোর হওয়া যাবে না বা শিক্ষার্থীদেরকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে এমন কোনো শাস্তি প্রদান করা যাবে না
- শারীরিক শাস্তি প্রদান করা যাবে না
- ‘আউট-অব-স্কুল সাসপেনশন’ যথাসম্ভব এড়িয়ে যেতে হবে
- শিক্ষার্থীদের মারাত্মক কোনো সমস্যা শিক্ষকের একা সমাধান করা যাবে না, এক্ষেত্রে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ, অভিভাবক অথবা পেশাদার মনোবিশারদ বা পেশাদার শিক্ষা পরামর্শকের পরামর্শ নিতে হবে।
শ্রেণিকক্ষ ব্যবস্থাপনার বিভিন্ন ধাপ বা কৌশল সম্পর্কে বিভিন্ন জনে বিভিন্নভাবে লিখেছেন, বিভিন্নভাবে বলেছেন। তবে শ্রেণিকক্ষ ব্যবস্থাপনায় কোন কৌশল অবলম্বন করবেন বা কোন কোন ধাপ অনুসরণ করবেন তা শুধু নির্দিষ্ট শিক্ষকই নির্ধারণ করবেন। এখানে বেশ কিছু সাধারণ কৌশল সম্পর্কে লেখা হলো যা বাস্তব জীবন, শিক্ষাবিজ্ঞান সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন তত্ত্ব ও নিবন্ধ থেকে অনুপ্রাণিত।
১. নিজের প্রতি মনোযোগী হওয়া
শিক্ষকে প্রথমে নিজের প্রতি মনোযোগ দিতে হবে, নির্দিষ্ট বিষয় বা বিষয়বস্তুর ওপর শিক্ষাদানের জন্য নিজেকে যোগ্য শতভাগ যোগ্য করে গড়ে তোলার চেষ্টা করতে হবে। এছাড়া শিক্ষক হিসেবে নিজের আচরণের উন্নতির জন্য নিয়মিত চেষ্টা করে যেতে হবে।
২. সম্পর্ক উন্নয়ন
শিক্ষার্থীদের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের প্রতি পূর্ণমনোযোগ দিতে হবে। শিখন-শেখানো কার্যক্রমে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মধ্যে সুসম্পর্ক থাকা খুবই জরুরি। যে শ্রেণিকক্ষে কোনো শিক্ষকের সাথে শিক্ষার্থীর দূরত্ব পরিলক্ষিত হয় সে শ্রেণিকক্ষে সফলভাবে শিখন কার্যক্রম পরিচালনা করা সম্ভব নয়।
৩. নিয়ম-নীতি ও নিষেধাজ্ঞা
শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের জন্য কিছু নিয়ম ও সীমা নির্ধারণ করে দিতে হবে। যেমন- শিক্ষক যখন বলবেন তখন শিক্ষার্থীরা বলবে না, তাৎক্ষণিকভাবে কোনো প্রশ্ন করতে চাইলে মুখে না বলে হাত উঁচু করবে, আশেপাশে তাকাবে না, অন্যকে বিব্রত করবে না, একেক দিন একেক জায়গায় বসবে, বাড়ির কাজ বাবা-মাকে দেখাবে ইত্যাদি। যদি কেউ শ্রেণিকক্ষে নিয়ম-নীতি ও নিষেধাজ্ঞা বা অন্যান্য নির্দেশনা মানতে ব্যর্থ হয় তাহলে ছোটো ছোটো শাস্তির ব্যবস্থা রাখা, যেমন- ১ম বার ব্যর্থ হলে সতর্কসংকেত, দ্বিতীয়বার ব্যর্থ হলে ৫ মিনিট দাঁড়িয়ে থাকতে হব, তৃতীয়বারে ১০ মিনিট দাঁড়িয়ে থাকতে হবে, চতুর্থবারে প্রধান শিক্ষকের কক্ষে গিয়ে পুনরায় ব্যর্থ না হওয়ার প্রতিজ্ঞা করে আসতে হবে অথবা পরের দিন অভিভাবক নিয়ে আসতে হবে (বিদ্যালয়ের নিয়মকানুন অনুসারে)।
৪. শিক্ষাদান পদ্ধতি নির্বাচন
শিখন শেখানোর ক্ষেত্রে শিক্ষক সেই পদ্ধতি বাছাই করবেন যে পদ্ধতিতে তিনি সবথেকে বেশি দক্ষ। ভালো করে না জেনে বা উপযুক্ত প্রস্তুতি না নিয়ে বা আত্মবিশ্বাসী না হলে হুট করে শ্রেণিকক্ষে কোনো বিষয়ে পাঠদান থেকে বিরত থাকা। তবে যে পদ্ধতি বা কৌশল নির্বাচন করা হবে তা যেন শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক হয় এবং প্রতিটি শিক্ষার্থীদেকে শ্রেণিকার্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা যায়।
৫. অপ্রাসঙ্গিক বিষয়ে কথা না বলা
অনেক সময় দেখা যায়, শিক্ষক পাঠদান কার্যক্রম সহজ করার জন্য বিশেষ কিছু উদাহরণ দেন। কিন্তু ওই উদাহরণ প্রদান করতে গিয়ে আর মূলপাঠে ফেরা হয় না বা ফিরলে অনেক সময় নষ্ট হয়। আবার অনেকে অপ্রয়োজনেও হাস্যরসের জন্য কিছু অপ্রাসঙ্গিকতা বিষয়ের অবতারণা ঘটান যা অনুচিৎ। এতে শ্রেণিকক্ষে কোলাহলের সৃষ্টি হয় এবং শিখনফল অর্জন ব্যহত হয়; কখনো কখনো এই কোলাহল পাশাপাশি অবস্থিত অন্য শ্রেণিকক্ষের জন্যও ক্ষতিকর হয়ে ওঠে।
৬. উৎসাহ ও পুরস্কারের ব্যবস্থা
শিক্ষার্থীরা কোনো কিছু অর্জন করলে শিক্ষকের উচিৎ প্রশংসা করা। শিক্ষকের পক্ষ থেকে প্রশংসা পেলে শিক্ষার্থীদের আগ্রহ ও মনোবল দুটিই বৃদ্ধি পায়। প্রশংসা শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়নেও গুরুত্বপূর্ণ। তাই শেখার প্রতি বা পাঠের প্রতি শিক্ষার্থীদের আগ্রহী হতে উৎসাহ প্রদানের প্রয়োজন আছে। এই আগ্রহকে আরও বাড়িয়ে দেওয়া যায় যদি শিক্ষক মাঝেমধ্যেই শিক্ষার্থীদের সাফল্যের স্বীকৃতিস্বরূপ কিছু পুরস্কারের ব্যবস্থা করেন। এই পুরস্কার হতে পারে সাপ্তাহিক, মাসিক বা শিক্ষকের ইচ্ছেমতো ঘোষণা অনুযায়ী। এ ধরনের পুরস্কার আর্থিকভাবে খুব দামি হবে তেমন নয়; ৫ টাকার একটি কলম বা পেন্সিলও হতে পারে। শিক্ষকের হাত থেকে পুরস্কার গ্রহণে শিক্ষার্থীদের অন্যরকম ভালোলাগা কাজ করে, সে পুরস্কার যেমনই হোক বা যত দামেরই হোক। শ্রেণিকক্ষ ব্যবস্থাপনায় ‘উৎসাহ ও পুরস্কার প্রদান’ খুবই সুন্দর একটি কৌশল হতে পারে।
৭. অভিভাবকদের অংশগ্রহণ
শিখন-শেখানো কার্যক্রম বা প্রক্রিয়ায় শিক্ষার্থীদের পিতামাতা বা বৈধ অভিভাবকদের অংশগ্রহণ ঘটাতে পারলে শ্রেণিকক্ষ ব্যবস্থাপনা আরও সহজ হয়ে ওঠে। শিক্ষার্থীদের বাড়ির কাজ, শিখনে অগ্রগতি বা অবনতি কিংবা অন্যান্য উপযুক্ত বিষয়ে অভিভাবকদের নিয়মিত জানানো সম্ভব হলে কিংবা অন্তত দৈনিক বাড়ির কাজ অভিভাবক দেখছেন এমনটা নিশ্চিত করা গেলে একদিকে যেমন শিখনফল অর্জন অনেকটা সহজ হবে তেমনি শ্রেণিকক্ষ ব্যবস্থাপনাপনাও সহজ হবে।
উপর্যুক্ত কৌশলগুলোকে শ্রেণিকক্ষ ব্যবস্থাপনার মূলনীতি হিসেবে বিবেচনা করা যায়। দেখা যাবে, একজন লেখক বা শিক্ষাবিদ বলছেন শ্রেণিকক্ষ ব্যবস্থাপনার নীতি ৫ টি, অন্যকেউ বলছেন ৬ টি, আমি এখানে উল্লেখ করলাম ৭ টি, আবার APA বলছে ৮ টি। আসলে শ্রেণিকক্ষ ব্যবস্থাপনার নীতি এবং নীতির সংখ্যা নির্ভর করবে শ্রেণি শিক্ষকের ওপর যেহেতু প্রত্যেক শিক্ষকই ভিন্ন।
একটি আদর্শ শ্রেণিকক্ষে সর্বোচ্চ কতজন শিক্ষার্থী বসতে পারে এবং কত জন শিক্ষার্থীর উপর কখনোই কোনো শ্রেণিকক্ষ হতে পারে না। বিষয়টি স্পষ্ট করার জন্য অনুরোধ করা হলো।
বাংলাদেশের জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ অনুসারে শ্রেণিকক্ষে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত হওয়া উচিত ১:৩০। একেই আদর্শ ধরুন।