১২:০০ অপরাহ্ন, রবিবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
                       

নির্বিচারে পাহাড় কাটা, পরিবেশ সংরক্ষণ ও আমাদের করণীয়

আবির হাসান সুজন
  • প্রকাশ: ০৭:৩৩:৩৭ অপরাহ্ন, রবিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২১
  • / ২৮১৮ বার পড়া হয়েছে

নির্বিচারে পাহাড় কাটা


Google News
বিশ্লেষণ-এর সর্বশেষ নিবন্ধ পড়তে গুগল নিউজে যোগ দিন

বিশেষ শর্তসাপেক্ষে এবং স্বল্পমূল্যে এই ওয়েবসাইটটি সামাজিক কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ কিংবা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের নিকট বিক্রি করা হবে।

বর্তমান সময়ে পাহাড় কাটার মহোৎসব লেগেছে। মানুষ কোনো রকম কারণ ছাড়াই পাহার ধ্বংসের লীলায় মেতে উঠেছে। ঘরের যেমন খুঁটি বা পিলার থাকে। তেমনি জমিনেরও খুঁটি থাকে। পাহাড় হলো জমিনের খুঁটি বা পেরেক। চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে ঘনঘন পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটা নিত্যনতুন কিছু নয়। পাহাড়ের গায়ে জন্মানো বন-জঙ্গল ও গাছপালা এর অভ্যন্তরীণ বন্ধন মজবুত রাখে। পাহাড় কাটার কারণে সেই বন্ধন দুর্বল হয়ে পড়ে। এর ফলে পাহাড় ধসের পথ সুগম হয়। পরিণতিতে প্রতিবারই প্রাণ হারায় শত শত মানুষ। বস্তুত কিছু মানুষের অবিবেচনাপ্রসূত কর্মকাণ্ডের ফলে  প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমে পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটছে।

মানা হচ্ছে না পরিবেশ সংরক্ষণ আইন

বাংলাদেশে মোট ভূমির এক পঞ্চমাংশ পাহাড়ি অঞ্চল। বিশেষ করে পূর্বাঞ্চল ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলে  ৮% পাহাড়ি অঞ্চল অবস্থিত। বাকি ১০% অবস্থিত দেশের অন্যান্য অঞ্চলে। চট্টগ্রাম-সিলেট অঞ্চলে বেশ কিছু পাহাড় টিলা রয়েছে। প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যের লীলানিকেতন এই টিলা পাহাড় দেশি বিদেশি পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। অথচ এই টিলা কেটে পাহাড় ধ্বংস ধ্বংসে মেতে উঠেছে অনেকে। মানুষের আগ্রাসী থাবায় শত শত বছরের ঐতিহ্য আজ অস্তিত্ব হীনতার পথে। অথচ বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫ ধারা ৬ এর (খ) স্পষ্ট বলা হয়েছে যে, কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান কতৃর্ক সরকারী বা আধা-সরকারী বা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের মালিকানাধীন বা দখলাধীন বা ব্যক্তিমালিকানাধীন পাহাড় ও টিলা কর্তন বা মোচন করা যাবে না।

কিন্তু তথ্য ভিন্ন কথা বলছে, ২০০৩ থেকে ২০২০ সালের জুলাই পর্যন্ত চট্টগ্রাম মহানগরীতে ১২৩টি পাহাড় কাটা হয়েছে।

পাহাড় কাটার ফলে পরিবেশে বিরূপ প্রভাব

পাহাড় কেটে বন জঙ্গল উজাড় করার ফলে পরিবেশের উপর জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। অতি বৃষ্টি কিংবা খরা, সময়ে বৃষ্টি না হয়ে অসময়ে বৃষ্টিপাত বেড়েই চলেছে। মাত্রাতিরিক্ত উষ্ণতা কিংবা শীত ভয়ানক আকার ধারণ করছে।সাম্প্রতিক বছর গুলোতে পৌষ-মাঘ মাসে হাড় কাঁপানো শীতের পরিবর্তে গরম অনুভূত হওয়া, শীতকালীন সময় কমে গিয়ে গরমকাল বেড়ে যাওয়া, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রায়ঃশই ভূকম্পন অনুভূত হওয়া এসবই পরিবেশের উপর বিরূপ প্রভাবের ফলাফল।

পাহাড়ের গাছ-পালা অবাধে কেটে ধ্বংস করে ফেলায় অনেক বন্য পশু-পাখি আজ বিলুপ্তির পথে। গাছ-পালা কাটার ফলে প্রাণী জগতের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। অতীতে গ্রামাঞ্চলে যেসব বন্য পশু-পাখি দেখা যেতো পরিবেশের বিরূপ প্রভাবে তাদের অধিকাংশ এখন আর দেখা যায় না।

পাহাড় কাটার ফলে ঝুঁকির মুখে পাহাড়ি জনগোষ্ঠী

দীর্ঘকাল ধরে পাহাড় কাটা এবং পাহাড়ের গায়ে বেড়ে ওঠা গাছপালা উজাড়ের ফলে পাহাড়ের অবশিষ্ট মাটি আগলা হয়ে যায়। বৃষ্টি হলে পাহাড়ের গা বেয়ে তীব্র বেগে নেমে আসা ঢল আগলা মাটি ধুয়ে নিয়ে নিচে নামার ফলে পাহাড় হয়ে পড়ে দুর্বল, জীর্ণশীর্ণ। পাহাড় কাটার ফলে ভুমি ধ্বস  ছাড়াও মাটির অণুজীব বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই জন্য পাহাড়ের গায়ে অবৈধ বস্তি নির্মাণ করে অর্থ উপার্জন করা, পাহাড়ে বাসকারী আশ্রয়হীন মানুষকে মৃত্যুঝুঁকির মুখে ঠেলে দেয়া বন্ধ করতে আমাদের দ্রুত কাজ করতে হবে। প্রভাবশালী মহলের পাহাড় কাটার বিরুদ্ধে নিতে হবে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা, যাতে তারা কোনো দিনও ভুল করেও পাহাড় কাটার কথা মুখে আনতে না পারে।

পাহাড় কাটার নতুন কৌশল

এখন নতুন কৌশলে পাহাড় কাটা হচ্ছে। পাহাড়ের নিচে কিছুটা মাটি কাটা হয় বর্ষার শুরুতে, যাতে প্রবল বৃষ্টি হলে পাহাড় ধসে পড়ে। ফলে পুরো দোষটি প্রকৃতির উপর দিয়ে যায়। আবার খরচও বেঁচে যায়।

অভ্যন্তরীণ বন্ধনের ক্ষতি হচ্ছে

পাহাড়ের গায়ে জন্মানো বন-জঙ্গল ও গাছপালা এর অভ্যন্তরীণ বন্ধন মজবুত রাখে। পাহাড় কাটার কারণে সেই বন্ধন দুর্বল হয়ে পড়ে। এর ফলে পাহাড় ধসের পথ সুগম হয়। পরিণতিতে প্রতিবারই প্রাণ হারায় মানুষ। বস্তুত কিছু মানুষের অবিবেচনাপ্রসূত কর্মকাণ্ডের দরুন প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমে পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটছে।

পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে

নির্বিচারে পাহাড় কাটার কারণে শুধু পাহাড় ধস নয়, এর ফলে একদিকে পাহাড়ি অঞ্চল দিন দিন শ্রীহীন হয়ে পড়ছে, অন্যদিকে পাহাড় থেকে নেমে আসা বালিতে নগরীর নালা-নর্দমা ভরাট হওয়ায় সৃষ্টি হচ্ছে জলাবদ্ধ। পাহাড় কাটার ফলে পরিবেশের ভারসাম্য ধংস হচ্ছে, বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব ত্বরান্বিত হচ্ছে। তাছাড়া, পাহাড় পর্বত ধ্বংসের ফলে নদীর গতিপথ পরিবর্তিত হচ্ছে, জীববৈচিত্র্য বিনষ্ট হচ্ছে, পরিবেশে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে।

পাহাড় কাটা প্রতিরোধে কী করণীয়? 

মনে রাখা দরকার, প্রকৃতি তার নিজস্ব নিয়মে চলে। পরিবেশ রক্ষায় আন্তরিক না হলে আমাদের জীবন ও সম্পদ দিয়ে সেই দায় শোধ করতে হয়। বাংলাদেশের  বিভিন্ন অঞ্চলে বেআইনিভাবে পাহাড় কাটা রোধে এবং পাহাড়ে বসবাসকারীদের সুরক্ষায় সরকারকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।

এসব অপকর্ম থেকে আমাদেও বেরিয়ে আসতে হবে। প্রচলিত যেসব আইন আছে সেসব আইনে যে শাস্তির বিধান বর্ণিত আছে তা আরও বৃদ্ধি করে এর সুপ্রয়োগ জোরদার করতে হবে। পাহাড় দখলবারীদের উচ্ছেদ করতে হলে যতটুকু জনবল বন বিভাগের থাকা উচিত সেসব বৃদ্ধিতেও সরকারকে মনোযোগ দিতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তানের বিরূপ প্রভাবের হাত থেকে  ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে পাহাড় ও গাছ কাটা বন্ধে পদক্ষেপ নিতে হবে। বর্ষায় কোনো না কোনো সময় ভারি বর্ষণ হবেই। তবে তার সঙ্গে পাহাড় কাটা, বনের গাছপালা কেটে ফেলার ঘটনা যোগ হলেই এর খেসারত  চরমভাবে দিতে হবে আমাদের।

পাহাড়ে আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ, ঝুঁকিপূর্ণ বসতি স্থাপন নিষিদ্ধ করে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করলে কিছুটা হলেও পাহাড় কাটা রোধ করা যাবে। বিশেষজ্ঞদের মতামত নিয়ে সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা নিতে হবে। পাহাড় ধ্বংসের কুফল সবাইকে বোঝাতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে জনসাধারণকে সচেতন করে গড়ে তুলতে হবে। পাহাড় কাটা এবং পাহাড়ি বন ধ্বংসের ফলে ক্ষতিগ্রস্থ পাহাড়ে পুনরায় প্রকৃত পাহাড়ি বনায়নের (Indigenous Forestry) ব্যবস্থা করতে হবে।

ইউনিভার্সিটি গুলোতে প্রতি মাসে একটি হলেও সভা, সেমিনারের আয়োজন করতে হবে।

পাহাড় কাটা বন্ধে অব্যাহত নজরদারি, কঠোর এনফোর্সমেন্ট অভিযান, পরিবেশ আইনের শতভাগ প্রয়োগ, আদালতে দক্ষতার সঙ্গে মামলা পরিচালনা এবং পাহাড়জুড়ে বৃক্ষায়ন-বনায়ন, পানি নিষ্কাশনের ড্রেনেজ স্থাপন, পাহাড়ের মাটির পতনরোধে সিলট্র্যাপ, গাইডওয়াল নির্মাণের মাধ্যমে নিরাপদ বেষ্টনী গড়ে তোলাই হবে  পাহাড় রক্ষার একমাত্র ঔষধ। 

শেষকথা

পাহাড়ধস, পাহাড় কাটা এবং পাহাড়ি বন ধ্বংস রোধে বাংলাদেশ সরকারকে সংশ্লিষ্ট সকল মন্ত্রণালয় এবং প্রতিষ্ঠানকে সংযুক্ত করে একটি মহাপরিকল্পনা নিতে হবে এবং তা যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে।

শেয়ার করুন

One thought on “নির্বিচারে পাহাড় কাটা, পরিবেশ সংরক্ষণ ও আমাদের করণীয়

  1. চট্টগ্রামের বায়েজিদ এলাকার, ক্যান্টনমেন্ট সংলগ্ন এলাকা তালতলাতে পাহাড়ি যায়গা কেনা বেচা করে, তাতা পাহাড় কেটে প্লোট বানানো হচ্ছে।

মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার তথ্য সংরক্ষিত রাখুন

লেখকতথ্য

আবির হাসান সুজন

শিক্ষার্থী, ভুমি ব্যবস্থাপনা ও আইন বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা

বিশেষ শর্তসাপেক্ষে এই ওয়েবসাইটটি সামাজিক কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ কিংবা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের নিকট বিক্রি করা হবে।

নির্বিচারে পাহাড় কাটা, পরিবেশ সংরক্ষণ ও আমাদের করণীয়

প্রকাশ: ০৭:৩৩:৩৭ অপরাহ্ন, রবিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২১

বর্তমান সময়ে পাহাড় কাটার মহোৎসব লেগেছে। মানুষ কোনো রকম কারণ ছাড়াই পাহার ধ্বংসের লীলায় মেতে উঠেছে। ঘরের যেমন খুঁটি বা পিলার থাকে। তেমনি জমিনেরও খুঁটি থাকে। পাহাড় হলো জমিনের খুঁটি বা পেরেক। চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে ঘনঘন পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটা নিত্যনতুন কিছু নয়। পাহাড়ের গায়ে জন্মানো বন-জঙ্গল ও গাছপালা এর অভ্যন্তরীণ বন্ধন মজবুত রাখে। পাহাড় কাটার কারণে সেই বন্ধন দুর্বল হয়ে পড়ে। এর ফলে পাহাড় ধসের পথ সুগম হয়। পরিণতিতে প্রতিবারই প্রাণ হারায় শত শত মানুষ। বস্তুত কিছু মানুষের অবিবেচনাপ্রসূত কর্মকাণ্ডের ফলে  প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমে পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটছে।

মানা হচ্ছে না পরিবেশ সংরক্ষণ আইন

বাংলাদেশে মোট ভূমির এক পঞ্চমাংশ পাহাড়ি অঞ্চল। বিশেষ করে পূর্বাঞ্চল ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলে  ৮% পাহাড়ি অঞ্চল অবস্থিত। বাকি ১০% অবস্থিত দেশের অন্যান্য অঞ্চলে। চট্টগ্রাম-সিলেট অঞ্চলে বেশ কিছু পাহাড় টিলা রয়েছে। প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যের লীলানিকেতন এই টিলা পাহাড় দেশি বিদেশি পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। অথচ এই টিলা কেটে পাহাড় ধ্বংস ধ্বংসে মেতে উঠেছে অনেকে। মানুষের আগ্রাসী থাবায় শত শত বছরের ঐতিহ্য আজ অস্তিত্ব হীনতার পথে। অথচ বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫ ধারা ৬ এর (খ) স্পষ্ট বলা হয়েছে যে, কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান কতৃর্ক সরকারী বা আধা-সরকারী বা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের মালিকানাধীন বা দখলাধীন বা ব্যক্তিমালিকানাধীন পাহাড় ও টিলা কর্তন বা মোচন করা যাবে না।

কিন্তু তথ্য ভিন্ন কথা বলছে, ২০০৩ থেকে ২০২০ সালের জুলাই পর্যন্ত চট্টগ্রাম মহানগরীতে ১২৩টি পাহাড় কাটা হয়েছে।

পাহাড় কাটার ফলে পরিবেশে বিরূপ প্রভাব

পাহাড় কেটে বন জঙ্গল উজাড় করার ফলে পরিবেশের উপর জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। অতি বৃষ্টি কিংবা খরা, সময়ে বৃষ্টি না হয়ে অসময়ে বৃষ্টিপাত বেড়েই চলেছে। মাত্রাতিরিক্ত উষ্ণতা কিংবা শীত ভয়ানক আকার ধারণ করছে।সাম্প্রতিক বছর গুলোতে পৌষ-মাঘ মাসে হাড় কাঁপানো শীতের পরিবর্তে গরম অনুভূত হওয়া, শীতকালীন সময় কমে গিয়ে গরমকাল বেড়ে যাওয়া, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রায়ঃশই ভূকম্পন অনুভূত হওয়া এসবই পরিবেশের উপর বিরূপ প্রভাবের ফলাফল।

পাহাড়ের গাছ-পালা অবাধে কেটে ধ্বংস করে ফেলায় অনেক বন্য পশু-পাখি আজ বিলুপ্তির পথে। গাছ-পালা কাটার ফলে প্রাণী জগতের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। অতীতে গ্রামাঞ্চলে যেসব বন্য পশু-পাখি দেখা যেতো পরিবেশের বিরূপ প্রভাবে তাদের অধিকাংশ এখন আর দেখা যায় না।

পাহাড় কাটার ফলে ঝুঁকির মুখে পাহাড়ি জনগোষ্ঠী

দীর্ঘকাল ধরে পাহাড় কাটা এবং পাহাড়ের গায়ে বেড়ে ওঠা গাছপালা উজাড়ের ফলে পাহাড়ের অবশিষ্ট মাটি আগলা হয়ে যায়। বৃষ্টি হলে পাহাড়ের গা বেয়ে তীব্র বেগে নেমে আসা ঢল আগলা মাটি ধুয়ে নিয়ে নিচে নামার ফলে পাহাড় হয়ে পড়ে দুর্বল, জীর্ণশীর্ণ। পাহাড় কাটার ফলে ভুমি ধ্বস  ছাড়াও মাটির অণুজীব বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই জন্য পাহাড়ের গায়ে অবৈধ বস্তি নির্মাণ করে অর্থ উপার্জন করা, পাহাড়ে বাসকারী আশ্রয়হীন মানুষকে মৃত্যুঝুঁকির মুখে ঠেলে দেয়া বন্ধ করতে আমাদের দ্রুত কাজ করতে হবে। প্রভাবশালী মহলের পাহাড় কাটার বিরুদ্ধে নিতে হবে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা, যাতে তারা কোনো দিনও ভুল করেও পাহাড় কাটার কথা মুখে আনতে না পারে।

পাহাড় কাটার নতুন কৌশল

এখন নতুন কৌশলে পাহাড় কাটা হচ্ছে। পাহাড়ের নিচে কিছুটা মাটি কাটা হয় বর্ষার শুরুতে, যাতে প্রবল বৃষ্টি হলে পাহাড় ধসে পড়ে। ফলে পুরো দোষটি প্রকৃতির উপর দিয়ে যায়। আবার খরচও বেঁচে যায়।

অভ্যন্তরীণ বন্ধনের ক্ষতি হচ্ছে

পাহাড়ের গায়ে জন্মানো বন-জঙ্গল ও গাছপালা এর অভ্যন্তরীণ বন্ধন মজবুত রাখে। পাহাড় কাটার কারণে সেই বন্ধন দুর্বল হয়ে পড়ে। এর ফলে পাহাড় ধসের পথ সুগম হয়। পরিণতিতে প্রতিবারই প্রাণ হারায় মানুষ। বস্তুত কিছু মানুষের অবিবেচনাপ্রসূত কর্মকাণ্ডের দরুন প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমে পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটছে।

পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে

নির্বিচারে পাহাড় কাটার কারণে শুধু পাহাড় ধস নয়, এর ফলে একদিকে পাহাড়ি অঞ্চল দিন দিন শ্রীহীন হয়ে পড়ছে, অন্যদিকে পাহাড় থেকে নেমে আসা বালিতে নগরীর নালা-নর্দমা ভরাট হওয়ায় সৃষ্টি হচ্ছে জলাবদ্ধ। পাহাড় কাটার ফলে পরিবেশের ভারসাম্য ধংস হচ্ছে, বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব ত্বরান্বিত হচ্ছে। তাছাড়া, পাহাড় পর্বত ধ্বংসের ফলে নদীর গতিপথ পরিবর্তিত হচ্ছে, জীববৈচিত্র্য বিনষ্ট হচ্ছে, পরিবেশে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে।

পাহাড় কাটা প্রতিরোধে কী করণীয়? 

মনে রাখা দরকার, প্রকৃতি তার নিজস্ব নিয়মে চলে। পরিবেশ রক্ষায় আন্তরিক না হলে আমাদের জীবন ও সম্পদ দিয়ে সেই দায় শোধ করতে হয়। বাংলাদেশের  বিভিন্ন অঞ্চলে বেআইনিভাবে পাহাড় কাটা রোধে এবং পাহাড়ে বসবাসকারীদের সুরক্ষায় সরকারকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।

এসব অপকর্ম থেকে আমাদেও বেরিয়ে আসতে হবে। প্রচলিত যেসব আইন আছে সেসব আইনে যে শাস্তির বিধান বর্ণিত আছে তা আরও বৃদ্ধি করে এর সুপ্রয়োগ জোরদার করতে হবে। পাহাড় দখলবারীদের উচ্ছেদ করতে হলে যতটুকু জনবল বন বিভাগের থাকা উচিত সেসব বৃদ্ধিতেও সরকারকে মনোযোগ দিতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তানের বিরূপ প্রভাবের হাত থেকে  ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে পাহাড় ও গাছ কাটা বন্ধে পদক্ষেপ নিতে হবে। বর্ষায় কোনো না কোনো সময় ভারি বর্ষণ হবেই। তবে তার সঙ্গে পাহাড় কাটা, বনের গাছপালা কেটে ফেলার ঘটনা যোগ হলেই এর খেসারত  চরমভাবে দিতে হবে আমাদের।

পাহাড়ে আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ, ঝুঁকিপূর্ণ বসতি স্থাপন নিষিদ্ধ করে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করলে কিছুটা হলেও পাহাড় কাটা রোধ করা যাবে। বিশেষজ্ঞদের মতামত নিয়ে সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা নিতে হবে। পাহাড় ধ্বংসের কুফল সবাইকে বোঝাতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে জনসাধারণকে সচেতন করে গড়ে তুলতে হবে। পাহাড় কাটা এবং পাহাড়ি বন ধ্বংসের ফলে ক্ষতিগ্রস্থ পাহাড়ে পুনরায় প্রকৃত পাহাড়ি বনায়নের (Indigenous Forestry) ব্যবস্থা করতে হবে।

ইউনিভার্সিটি গুলোতে প্রতি মাসে একটি হলেও সভা, সেমিনারের আয়োজন করতে হবে।

পাহাড় কাটা বন্ধে অব্যাহত নজরদারি, কঠোর এনফোর্সমেন্ট অভিযান, পরিবেশ আইনের শতভাগ প্রয়োগ, আদালতে দক্ষতার সঙ্গে মামলা পরিচালনা এবং পাহাড়জুড়ে বৃক্ষায়ন-বনায়ন, পানি নিষ্কাশনের ড্রেনেজ স্থাপন, পাহাড়ের মাটির পতনরোধে সিলট্র্যাপ, গাইডওয়াল নির্মাণের মাধ্যমে নিরাপদ বেষ্টনী গড়ে তোলাই হবে  পাহাড় রক্ষার একমাত্র ঔষধ। 

শেষকথা

পাহাড়ধস, পাহাড় কাটা এবং পাহাড়ি বন ধ্বংস রোধে বাংলাদেশ সরকারকে সংশ্লিষ্ট সকল মন্ত্রণালয় এবং প্রতিষ্ঠানকে সংযুক্ত করে একটি মহাপরিকল্পনা নিতে হবে এবং তা যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে।