নৌবিমা কী? নৌবিমা ও নৌবিমাপত্রের শ্রেণিবিভাগ আলোচনা
- প্রকাশ: ০৭:৪৫:০৬ অপরাহ্ন, সোমবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২১
- / ৩৫৩৫ বার পড়া হয়েছে
প্রাচীনকাল থেকেই নৌপথে ব্যবসা-বাণিজ্য হয়ে আসছিল। বর্তমান কালেও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের অধিকাংশই নৌ পথের মাধ্যমে হয়ে থাকে। নৌপথে জাহাজ চলাচলের সময় নানা ধরণের বিপদ ঘটতে পারে। যে সমস্ত কারণে নৌপথে বিপদ ঘটে তন্মধ্যে অন্যতম হলো ঘূর্ণাবর্ত, সাইক্লোন, জলোচ্ছ্বাস ও জলদস্যুর আক্রমণ। এ ধরণের বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য নানা চিন্তাভাবনার ফল হলো বর্তমানের নৌবিমা।
বিমা সম্পর্কে বিস্তারিত পড়ুন এখানে ক্লিক করে।
এই নিবন্ধে যা আছে
নৌবিমার ধারণা
নৌবিমা এক ধরণের সম্পত্তি বিমা। অর্থের মাধ্যমে পরিমাপযোগ্য কোনো সম্পত্তির ক্ষতির জন্য যে বিমা করা হয়, তাকে সম্পত্তি বিমা বলে। বিমাবিষয়ক স্বনামধন্য লেখক অধ্যাপক এম. এন. মিশ্র (M. N. Mishra) বলেন, “নৌবিমা চুক্তি বিমাকারী ও বিমাগ্রহীতার মধ্যে সম্পাদিত এমন এক প্রকার চুক্তি যার মাধ্যমে সমুদ্রগামী জাহাজ এবং এর সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত স্বার্থের কোনো ক্ষতির জন্য বিমাকারী চুক্তি অনুযায়ী ক্ষতিপূরণের দায়িত্ব গ্রহণ করে।”
মূলত, সমুদ্র পথে চলাচলরত পণ্যবাহী জাহাজের ক্ষেত্রে সম্পত্তির ক্ষয়ক্ষতি ও বিপদজনিত ঝুঁকির বিপরীতে বিমাগ্রহীতা কর্তৃক নির্দিষ্ট প্রিমিয়ামের বিনিময়ে বিমাকারী প্রতিষ্ঠান কর্তৃক ক্ষতিপূরণের যে প্রতিশ্রুতি প্রদান করা হয়, তাকে নৌবিমা বলে। নৌবিমা মূলত: সামুদ্রিক বিপদজনিত ক্ষতির জন্য নির্ধারিত হলেও সমুদ্রপথে পরিবহনের উদ্দেশ্যে সমুদ্রপথ পর্যন্ত পৌঁছানোর জন্য অভ্যন্তরীণ নৌপথ বা স্থলপথে পণ্য-দ্রব্য পরিবহন করলে তাও সেই নৌবিমার আওতাভুক্ত। সুতরাং নৌ পথে বিপদ হলেই যে নৌবিমার অন্তর্ভুক্ত হবে এমন নয়। পণ্য পৌঁছানো পর্যন্ত বিষয়বস্তুর ক্ষতি হলেও তা নৌবিমার অন্তর্ভুক্ত হবে।
নৌবিমার শ্রেণিবিভাগ
নৌবিমা প্রধানত চার প্রকার:
১. জাহাজী বিমা
বাণিজ্য জাহাজ এবং তার সাথে সম্পৃক্ত উপকরণের জন্য সম্ভাব্য ক্ষতির যে বিমা গ্রহণ করা হয়, তাকে জাহাজী বিমা বলা হয়।
২. পণ্য বিমা
বাণিজ্যিক জাহাজে বহনকৃত পণ্যের ক্ষতির জন্য যে বিমা গ্রহণ করা হয়, তাকে পণ্য বিমা বলে। ধরুন, জাপান থেকে জাহাজে করে গাড়ি আনা হচ্ছে। গাড়ির জন্য বিমা করা হলে সেটি পণ্য বিমা বলে বিবেচিত হবে।
৩. মাসুল বিমা
ঝড়ের কবল থেকে জাহাজ রক্ষার্থে পণ্য সমুদ্রে ফেলে দিলে তার মাসুল পাওয়া যায় না। এ মাসুল ক্ষতির জন্য যে বিমাগ্রহণ করা হয়, তাকে মাসুল বিমা বলে। এটি আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে খুবই প্রচলিত একটি নৌবিমা।
৪. দায় বিমা
সমুদ্রে অনিচ্ছাকৃতভাবে কিছু নিয়মকানুন অমান্য করার ফলে আর্থিক ক্ষতি হতে পারে। এ ধরণের ক্ষতির জন্য যে বিমা করা হয়, তাকে দায় বিমা বলে। এছাড়া দুটি জাহাজে সংঘর্ষ, ডুবে যাওয়া ইত্যাদি সংঘটিত হতে পারে। এ ধরণের ক্ষতির জন্য দায় বিমা করা যায়।
নৌবিমাপত্র
নৌবিমা পত্র ১৭৭১ সাল থেকে লন্ডনের কর্পোরেশন অব লয়েডস নামক বিমা সংঘ নানা ধরণের নৌবিমা প্রবর্তন করে। নিচে এগুলোর বিবরণ দেওয়া হলো :
১. সমুদ্রে যাত্রা
এ ধরণের বিমাপত্রে এক বন্দর থেকে অন্য বন্দরে অথবা এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নির্দিষ্ট পথের উল্লেখ থাকে। উল্লিখিত চলাচল পথে জাহাজ বা পণ্যের ক্ষতি হলে বিমা কোম্পানি সে ক্ষতি বহন করতে বাধ্য থাকে।নির্ধারিত নৌ পথের বাইরে কোনো ক্ষতি হলে বিমা কোম্পানি তা পূরণ করবে না। বিমা চুক্তির মধ্যে যা নির্দিষ্ট করা থাকবে, তার বাইরে কোনো ক্ষতিপূরণ দেওয়ার বিধান নেই।
২. সময় বিমাপত্র
এ ধরণের নৌবিমাপত্র একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য গ্রহণ করা হয়। এ সময়ের মধ্যে বিমাকৃত বিষয়ের ক্ষতি হলে বিমাগ্রহীতাকে ক্ষতিপূরণ দেয়া হয়। কিন্তু চুক্তিতে উল্লিখিত সময়ের পর কোনো ক্ষতি হলে তা পূরণ করা হবে না।
৩. মিশ্র বিমাপত্র
এ নৌবিমা পত্রে সমুদ্রপথের নাম ও সুনির্দিষ্ট সময়ের উল্লেখ থাকে। এটিতে সমুদ্রপথ ও সময় উল্লেখ করায় উভয়ের সংমিশ্রণ থাকে বলে তা মিশ্র নৌ বিমাপত্র নামে পরিচিত। বাস্তবে এ ধরণের মিশ্র বিমাপত্রের ব্যবহার সবচেয়ে বেশি।
৪. মূল্যায়িত বিমাপত্র
মূল্যায়িত ধরণের বিমাপত্রে আগেই বিষয়বস্তুর মূল্য নির্ধারণ করা হয়। পূর্ব-নির্ধারিত মূল্যকে বিমাকৃত
মূল্য বলা হয়। পরে ক্ষতি হলে বিমাকৃত মূল্যের সমপরিমাণ ক্ষতি পুষিয়ে দেওয়া হয়।
৫. অমূল্যায়িত বিমাপত্র
এ ধরণের নৌ বিমাপত্রে বিমাকৃত মূল্য পূর্ব থেকে নির্ধারণ করা হয় না। সমীকরণটি হলো, বিমাকৃত মূল্য = পণ্য দ্রব্যাদির মূল্য + ভাড়া + জাহাজ মাসুল + বিমা খরচ। তবে পূর্ব-নির্ধারিত মুনাফা এতে যোগ করা থাকে না। এ ধরণের বিমাপত্র এখন আর চলে না।
৬. ভাসমান বিমাপত্র
বড় ধরণের জাহাজ কোম্পানির অনেক জাহাজ থাকে এবং সেগুলো সর্বদাই বিভিন্ন গতিপথে পণ্য-দ্রব্য নিয়ে চলাচল করে। এরূপ জাহাজ কোম্পানি একবারে বড় অংকের বিমাপত্র ক্রয় করে এবং পরে ঝুুঁকি বুঝে টাকার অংক নির্দিষ্ট করে। এতে প্রত্যেক জাহাজের জন্য আলাদা আলাদা করে বিমাপত্র গ্রহণ করতে হয়। ছোটো জাহাজ কোম্পানির জন্য এটি উপযোগী নয়।
৭. স্বার্থ বিমাপত্র
বিষয়বস্তুতে বিমাগ্রহীতার স্বার্থ জড়িত থাকলে তাকে স্বার্থ বিমাপত্র বলা হয়। নৌবিমার শর্তানুযায়ী বিষয়বস্তুতে বিমাযোগ্য স্বার্থ অবশ্যই থাকতে হবে।
৮. যৌগিক ঝুঁকির বিমাপত্র
একাধিক নৌবিমা কোম্পানী একত্রে খুব বড় অংকের ঝুঁকির ক্ষেত্রে মিলিতভাবে এ ধরণের বিমাপত্রের দায়িত্ব গ্রহণ করে।
৯. যুগ্ম বিমাপত্র
বিষয়বস্তুর উপর একাধিক বিমা কোম্পানির সাথে ভিন্ন ভিন্ন প্রিমিয়াম প্রদান করে যে বিমাপত্র গ্রহণ
করা হয়, তাকে যুগ্ম বিমাপত্র বলে। ক্ষতি হলে আনুপাতিক হারে টাকা পেয়ে থাকে। পুরো টাকা আলাদা আলাদা ভাবে আদায় করতে পারে না।
১০. মুদ্রা বিমাপত্র
বৈদেশিক মুদ্রা উঠানামা করার কারণে আমদানি-রফতানি করতে গিয়ে ক্ষতি হতে পারে। যে বিমাপত্রের মূল্য বৈদেশিক মুদ্রায় পরিশোধ করতে হয় তাকে মুদ্রা বিমাপত্র বলে। যেমন- ২৫,০০,০০০০ টাকার বিমার জন্য সম পরিমাণ ডলার প্রদান করা।
১১. ছাউনি বিমাপত্র
এ ধরণের বিমাপত্র কোনো নির্দিষ্ট সময় ও এলাকার মধ্যে ক্ষয়ক্ষতি পূরণের জন্য করা হয়। এ বিমার
প্রিমিয়াম একত্রে বিমা করার সময় প্রদান করে থাকে। যদি বিমাকৃত মূল্য পণ্যের মূল্য থেকে বেশি হয়, তাহলে
আনুপাতিক হারে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়।
১২. বন্দর ঝুঁকি বিমাপত্র
এ বিমাপত্রের দ্বারা সুনির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে অবস্থানকালে জাহাজ কিংবা পণ্যের কোনোরূপ ক্ষতি
হলে সে দায় বিমাকারী গ্রহণ করে থাকে। তবে এ ধরণের বিমাপত্র দ্বারা সমুদ্রপথে চলাচলের সময় কোনো ক্ষতি হলে তার দায়িত্ব বিমাকারী গ্রহণ করে না।
এক নজরে নৌবিমা
নৌবিমা চুক্তি বিমাকারী ও বিমাগ্রহীতার মধ্যে সম্পাদিত এমন এক প্রকার চুক্তি যেখানে সমুদ্রগামী জাহাজ এবং এর সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত স্বার্থের কোনো ক্ষতির জন্য বিমাকারী চুক্তি অনুযায়ী ক্ষতি পূরণের দায়িত্ব গ্রহণ করে। সমুদ্র পথে চলাচলরত টাকায় পরিমাপযোগ্য সম্পত্তির ক্ষয়ক্ষতি ও বিপদজনিত ঝুঁকির বিপরীতে বিমা গ্রহীতা কর্তৃক নির্দিষ্ট প্রিমিয়ামের বিনিময়ে বিমাকারী প্রতিষ্ঠান ক্ষতিপূরণের যে প্রতিশ্রুতি প্রদান করে, তাকে নৌবিমা বলা হয়।