শিক্ষাক্রম কাকে বলে? শিক্ষাক্রমের সংজ্ঞা, উপাদান ও ধারণা কী?
- প্রকাশ: ০৬:২৮:০৬ অপরাহ্ন, বুধবার, ৬ অক্টোবর ২০২১
- / ৫৬৮১৫ বার পড়া হয়েছে
বলা হয়ে থাকে যে, শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড এবং এই শিক্ষাই হলো একটি দেশ ও জাতির উন্নয়নের চাবিকাঠি। উন্নত জীবনযাপন ও সমাজের অগ্রগতি আনয়নে শিক্ষার বিকল্প নেই। শিক্ষাকে সঠিকভাবে রূপদানের জন্য প্রয়োজন শিক্ষাক্রম। এই শিক্ষাক্রম কী? এখানে শিক্ষাক্রমের সংজ্ঞা এবং ধারণা নিয়ে আলোচনা করা হলো।
এখানে যা আছে
শিক্ষাক্রম পদের উৎপত্তি
শিক্ষাক্রমের ইংরেজি পরিভাষা হলো কারিকুলাম (curriculum)। Curriculum শব্দের উৎপত্তি হয়েছে ল্যাটিন শব্দ ‘currere’ থেকে। ল্যাটিন শব্দ ‘currere’ অর্থ ‘পাঠ্যসূচি’ বা ‘course of study’। কেউ কেউ মনে করেন এটি ল্যাটিন শব্দ ‘currer’ থেকে এসেছে, যার অর্থ ‘ঘোড় দৌড়ের মাঠ’।
শিক্ষাক্রমের সংজ্ঞা
শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার সুবিন্যস্ত পরিকল্পনাকে বলা হয় শিক্ষাক্রম। কোনো একটি শিক্ষা কার্যক্রম কী উদ্দেশ্যে পরিচালিত হবে, কী বিষয়বস্তুর মাধ্যমে উদ্দেশ্য অর্জিত হবে; কখন, কীভাবে, কার সহায়তায় এবং কী উপকরণের সাহায্যে তা বাস্তবায়িত হবে, শিক্ষার্থীর শিখন অগ্রগতি কীভাবে মূল্যায়ন করা হবে এসবের যাবতীয় পরিকল্পনার রূপরেখাকে শিক্ষাক্রম বলে।
রাফ টাইলারকে বলা হয় শিক্ষাক্রমের জনক।
শিক্ষাক্রম সম্পর্কে বিভিন্ন মনীষীদের সংজ্ঞা
নিচে কয়েকজন মনীষীর ধারণা উল্লেখ করা হলো যা শিক্ষাক্রমের ধারণা বুঝতে সহায়ক হবে।
- রাফ টাইলার (Ralf Tyler) ১৯৫৬ সালে বলেছেন যে, শিক্ষাক্রম হলো শিক্ষার লক্ষ্য অর্জনের জন্য স্কুল কর্তৃক পরিকল্পিত ও পরিচালিত শিক্ষার্থীর সকল শিখন অভিজ্ঞতা। (All of the learning of students which is planned by and directed by school to attain its educational goals)
- হিলডা তাবা (Hilda Taba) ১৯৬২ সালে বলেছেন, “যুগের চিন্তাভাবনার অবয়বহীন ফসলই হলো শিক্ষাক্রম”।
- হিলডা তাবা আরও বলেছেন, “শিখনের পরিকল্পনা হলো শিক্ষাক্রম”।
- ডেইম অলিভ অ্যানি হুইলার (Dame Olive Annie Wheeler) ১৯৬৭ সালে বলেছেন, “শিক্ষাক্রম বলতে শিক্ষার উদ্দেশ্য, শিখন অভিজ্ঞতা নির্বাচন, বিষয়বস্তু শনাক্তকরণ, বিষয়বস্তু সংগঠন, মূল্যায়ন ইত্যাদির একটি বৃত্তাকার গতিশীল কার্যক্রমকে বুঝিয়েছেন”
- কার (১৯৬৮) এর মতে, “বিদ্যালয় কর্তৃক পরিকল্পিত ও পরিচালিত যাবতীয় শিখন যা বিদ্যালয় এবং বিদ্যালয়ের বাইরে দলগত বা ব্যক্তিগতভাবে সম্পন্ন করা হয় তাই শিক্ষাক্রম”।
- পোফাম ও বেকার (১৯৭০) যৌথভাবে বলেছেন, “শিক্ষাক্রম স্কুলের সেই সকল পরিকল্পিত কার্যক্রম যা অর্জনের দায়দায়িত্ব স্কুলের ওপর বর্তায়”।
- জনসন (১৯৭০) বলেছেন, “শিক্ষাক্রম হলো শিক্ষার্থীর পারদর্শিতা বা ফলাফল”।
- ব্রিটিশ শিক্ষাবিদ লটন (১৯৭৩) বলেছেন, “শিক্ষাক্রমের উপাদান অত্যাবশ্যকীয়ভাবে সামাজিক কৃষ্টি থেকে নির্বাচিত করতে হবে”।
- মার্শ এবং স্ট্যাফোর্ড (১৯৮৮) এর মতে, “শিক্ষাক্রম হলো ‘পরিকল্পনা’ ও ‘অভিজ্ঞতার’ পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত একটি সেট যা শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয়ের দৈনন্দিন কার্যক্রমের মাধ্যমে সম্পন্ন করে”।
শিক্ষাক্রমের কার্যকর সংজ্ঞা
শিক্ষাক্রমের বিবর্তন এবং উপরিল্লিখিত ধারণাগুলো বিশ্লেষণে দেখা যায় শিক্ষাক্রমের ধারণা যুগ যুগ ধরে নিম্নোক্তভাবে বিবর্তিত হয়েছে। যেমন: শিক্ষাক্রম হলো
- বংশানুক্রমিক সুসংবদ্ধ জ্ঞান
- মানসিক শৃঙ্খলা
- স্কুল নিয়ন্ত্রিত অভিজ্ঞতা
- পরিকল্পিত শিখন অভিজ্ঞতা
- শিক্ষাদান পরিকল্পনা
- আচরণিক উদ্দেশ্য/শিখনফল
- জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা
- শিখন প্রক্রিয়া
- পারদর্শিতা ও কৃতিত্ব মূল্যায়ন
এ সকল দিক ব্যাখ্যা করে ড্যানিয়েল ট্যানার ও লরেল ট্যানার (Daniel Tanner and Laurel N. Tanner) ১৯৮০ সালে শিক্ষাক্রমের একটি কার্যকর সংজ্ঞা প্রদানের চেষ্টা করেন: “Curriculum is that reconstruction of knowledge and experience, systematically developed under the auspices of the school (or university) to enable the learner to increase his or her control of knowledge and experience”
শিক্ষাক্রমের উপাদান
বিভিন্ন সংজ্ঞাকে বিশ্লেষণ করলে শিক্ষাক্রমের চারটি মূল উপাদান খুঁজে পাওয়া যায়:
- ১. উদ্দেশ্য
- ২. বিষয়বস্তু
- ৩. শিখন-শেখানো পদ্ধতি ও কৌশল
- ৪. মূল্যায়ন
শিক্ষাক্রমের এই চার উপাদানের অর্থ হলো- শিক্ষা কার্যক্রম কী উদ্দেশ্যে পরিচালিত হবে, কোন বিষয়বস্তু পাঠদানের মাধ্যমে উদ্দেশ্যসমূহ অর্জিত হবে, কোন পদ্ধতি এবং প্রক্রিয়ায় শিক্ষার্থীরা তা শিখবে এবং শিক্ষার্থীর পারদর্শিতা কীভাবে মূল্যায়ন করা হবে- এ সম্পর্কিত সকল নির্দেশনার সমষ্টিই হল শিক্ষাক্রম। এগুলো পরস্পর সম্পর্কযুক্ত, নির্ভরশীল এবং পরিপূরক। শিক্ষাক্রম প্রণয়ন ও উন্নয়নকালে এর প্রত্যেকটি উপাদান সম্পর্কে গভীর মনোযোগ দিয়ে বিচার বিশ্লেষণ করতে হয়।
শিক্ষাক্রমের ধারণা
শিক্ষাক্রম ধারণার উৎপত্তির শুরুতে শিক্ষাক্রম সংকীর্ণ অর্থে ব্যবহার করা হতো। সময়ের ব্যবধান এটি শিক্ষা ও শিক্ষাদান কর্মকাণ্ড পরিচালনার সামগ্রিক পরিকল্পনা হিসেবে লাভ করেছে। শিক্ষাক্রম নিয়ে গবেষণা থেমে নেই বা নির্দিষ্ট কোনো গণ্ডীর মধ্যে আটকে নেই। শিক্ষাক্রম নিয়ে নতুন নতুন গবেষণার ফলে এ সংক্রান্ত আরও নতুন নতুন ধারণা সৃষ্টি হচ্ছে। শিক্ষা বাস্তবায়নের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের অবশ্যই শিক্ষাক্রমের ধারণা সম্পর্কে জ্ঞান থাকা প্রয়োজন।
শিক্ষাক্রমের প্রাচীন ধারণা
শিক্ষাক্রম শব্দটি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে এবং যুগের পরিবর্তনের ধারাবাহিকতায় শিক্ষাক্রমের ধারণা ক্রমাগত বিবর্তিত হচ্ছে। তাই শিক্ষাক্রমের সর্বজনস্বীকৃত কোনও একক ও নির্দিষ্ট সংজ্ঞা বা ধারণার উদ্ভব হয়নি।
প্রাচীনকালে মানুষের বেঁচে থাকার দক্ষতা অর্জনই ছিল শিক্ষার প্রতিপাদ্য বিষয়। ফলে তখনকার অনানুষ্ঠানিক শিক্ষায় এ দিকটি গুরুত্ব পেয়েছে। পরবর্তীতে ক্রমাগত শিক্ষা সম্পর্কিত মানুষের চিন্তার ফসল হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে শিক্ষাক্রমের ধারণা বাস্তব রূপ পেতে থাকে।
শিক্ষাক্রমের প্রাচীন ধারণামতে কোনো শ্রেণি বা স্তর বা কোর্সের অন্তর্ভুক্ত বেশ কয়েকটি পাঠ্যবিষয়ের সমষ্টি হলো শিক্ষাক্রম।
আমেরিকায় শিক্ষাক্রমের ব্যাপক ব্যবহার লক্ষ করা যায় ১৮২০ সাল থেকে। সে সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শিক্ষাক্রম বলতে কোনো একটি কোর্সের অন্তর্ভুক্ত পাঠ্যবিষয়কে বুঝাত, যা অনুসরণ করে শিক্ষক শ্রেণিতে পাঠদান করা হতো।
সে সময় আমেরিকার শিক্ষাক্রমের মূল লক্ষ্য ছিল শিশুর মানসিক এবং জ্ঞানের বিকাশ। এজন্য শিক্ষাক্রমে বংশানুক্রমিক সুসংবদ্ধ জ্ঞান ও মানসিক শৃঙ্খলা অর্জনের উপর গুরুত্ব দেওয়া হত। প্রাচীনপন্থী শিক্ষাবিদদের ধারণা ছিল যে, শিশুর সুষ্ঠু মানসিক বিকাশ ঘটাতে হলে বিদ্যালয়ের শিক্ষাক্রমে কতগুলো অপরিহার্য বিষয় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। এগুলো হলো মাতৃভাষা, গণিত, বিজ্ঞান, ইতিহাস, দর্শন ও পশ্চিমা দেশের ভাবধারা। ফলে সে সময় শিক্ষাক্রমে এ বিষয়গুলো গুরুত্বের সাথে অন্তর্ভুক্ত করা হতো।
শিক্ষাক্রম আধুনিক ধারণা
মোটামুটিভাবে, ১৯৩০ সালের পর থেকে শিক্ষাক্রমের প্রাচীন ও সংকীর্ণ ধারণার পরিবর্তন হয়। বেশিরভাগ শিক্ষাবদই মনে করেন যে, শিক্ষাক্রমের ধারণার ব্যাপক বিস্তৃতি ঘটে ১৯৩০ সালের পরে। তখন শিক্ষাক্রম বলতে স্কুল কর্তৃক পরিচালিত সকল শিখন অভিজ্ঞতার সমষ্টিকে বুঝানো হতো।
১৯৩৫ সালে ক্যাসওয়েল ও কম্পবেল শিক্ষাক্রমের পুরাতন ধারণার অবসান ঘটিয়ে একটি নতুন সংজ্ঞা প্রস্তাব করেন, “শিক্ষাক্রম হল শিক্ষকের পরিচালনায় শিক্ষার্থীর অর্জিত সকল অভিজ্ঞতা”।
শিক্ষাক্রম তার সংকীর্ণ ধারণার গণ্ডি পার হয়ে ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত হতে শুরু করে এবং শিক্ষাক্রম কেবলমাত্র পাঠ্যবিষয়ের পরিবর্তে স্কুলের নিয়ন্ত্রিত সকল শিখন-অভিজ্ঞতার সমষ্টিরূপে পরিগণিত হতে থাকে। কিন্তু শিক্ষাক্রম বিশেষজ্ঞগণ শিক্ষাক্রমের আরও সুস্পষ্ট ও গ্রহণযোগ্য ধারণার অনুসন্ধান করতে থাকেন।
১৯৪৯ সালে শিক্ষাক্রম বিশেষজ্ঞ রাফ টাইলার কর্তৃক প্রদত্ত ধারণায় শিক্ষাক্রম সম্পর্কিত এ সমস্যার কিছুটা সমাধান পাওয়া যায়। রাফ টাইলার সর্বপ্রথম বলেন- “শিক্ষাক্রম হলো শিক্ষার লক্ষ্য অর্জনের জন্য স্কুল কর্তৃক পরিকল্পিত ও পরিচালিত এবং শিক্ষার্থীর অর্জিত সকল শিখন অভিজ্ঞতা”।
রাফ টাইলারের সংজ্ঞায় দেখা যায় যে, রাফ টাইলার শিক্ষাক্রমকে স্কুল পরিচালিত সকল কর্মকাণ্ডের উদ্দেশ্যভিত্তিক ও পরিকল্পিত শিখন অভিজ্ঞতা নির্ভর করার উপর জোর দিয়েছেন।
১৯৫০ সালের মাঝামাঝি শিক্ষার্থীর জীবনে স্কুলের প্রভাব প্রকটরূপে দেখা যায়। তখন শিক্ষাক্রমের ধারণা পরিমার্জন ও পরিবর্তনের ব্যাপারে আমেরিকায় বেশ কিছু শিক্ষামূলক প্রকল্প (Educational Projects) গ্রহণ করা হয়। আমেরিকার শিক্ষামূলক প্রকল্পে যেসব শিক্ষাবিদ কাজ করতেন তারা শিক্ষাক্রমকে পাঠদানের নির্দেশনামূলক পরিকল্পনা (Instructional Plan) হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেন।
ষাটের দশকের শেষে এবং সত্তরের দশকের প্রথমে অনেকে স্কুলের কাজকে শিল্প কারখানার উৎপাদন ব্যবস্থার সঙ্গে তুলনা করেন। শিল্প কারখানায় যেমন কাঁচামাল প্রক্রিয়াজাত করে নানারকম দ্রব্যসামগ্রী উৎপাদন করা হয়, তেমনি স্কুলের কাজ হবে নিরক্ষর ও অনভিজ্ঞ শিক্ষার্থীদের দক্ষ, অভিজ্ঞ ও অক্ষরজ্ঞান সম্পন্ন মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা। এর ফলে শিক্ষাক্রম প্রণয়নে শিক্ষার্থীর পারদর্শিতা ও কৃতিত্ব মূল্যায়ন এবং স্কুলের জবাবদিহিতার প্রশ্ন গুরুত্ব পেতে থাকে। শিক্ষাক্রমের বিষয়বস্তু নির্বাচন ও মূল্যায়ন ব্যবস্থাকে বিজ্ঞানসম্মত করার লক্ষ্যে এ সময় শিক্ষাক্রমে আচরণিক উদ্দেশ্য লেখার ওপর ব্যাপক গুরুত্ব আরোপ করা হয়। এ সময় থেকে শুরু করে পরবর্তীতে বিভিন্ন মনীষী কর্তৃক প্রদত্ত শিক্ষাক্রমের ধারণায় শিক্ষাক্রমের এই পরিবর্তিত ও সুনির্দিষ্ট রূপ গুরুত্ব পেতে থাকে। এভাবে সময়ের পরিক্রমায় শিক্ষাক্রমের ধারণায় নতুন নতুন মাত্রা সংযোজিত হয় ও পুরাতন ধারণার পরিবর্তন ঘটতে থাকে।
শেষকথা
প্রকৃতপক্ষে শিক্ষাক্রম হলো একটি ব্যাপক ধারণা যার মধ্যে রয়েছে জাতীয় ঐতিহ্য, কৃষ্টি থেকে শুরু করে বর্তমান ও ভবিষ্যত মানবসম্পদ গড়া ও শিক্ষার্থীদেরকে কর্মে নিয়োজিতকরণের একটি সুদূরপ্রসারী কর্মপরিকল্পনার দিকনির্দেশনা।
ধন্যবাদ খুব সুন্দর হয়েছে।
ধন্যবাদ