০৪:৫৫ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
                       

নিয়ন্ত্রণ কাকে বলে? নিয়ন্ত্রণের প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্য, আবশ্যকীয় উপাদান এবং গুরুত্ব কী?

প্রফেসর এম এ মাননান
  • প্রকাশ: ০৬:৪৬:৫৪ অপরাহ্ন, বুধবার, ১৫ ডিসেম্বর ২০২১
  • / ২৬৯৩৭ বার পড়া হয়েছে

কী কী বৈশিষ্ট্য থাকলে আমরা একটি নিয়ন্ত্রণ প্রক্রিয়াকে যথাযথ বলব সে সম্পর্কে জানা প্রয়োজন।


Google News
বিশ্লেষণ-এর সর্বশেষ নিবন্ধ পড়তে গুগল নিউজে যোগ দিন

বিশেষ শর্তসাপেক্ষে এবং স্বল্পমূল্যে এই ওয়েবসাইটটি সামাজিক কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ কিংবা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের নিকট বিক্রি করা হবে।

ব্যবস্থাপনার সর্বশেষ গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক কাজ হলো নিয়ন্ত্রণ। প্রাতিষ্ঠানিক জগতে নিয়ন্ত্রণ বলতে প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য ও পরিকল্পনা অনুযায়ী কার্যাবলি সম্পাদিত হচ্ছে কিনা তা নিশ্চিত করার জন্য কার্যফল পরিমাপ করা এবং কোনো বিচ্যুতি হলে তা সংশোধনের ব্যবস্থা গ্রহণ করাকে বুঝানো হয়। পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ হচ্ছে কিনা কিংবা নির্ধারিত মান অনুসারে কাজকর্ম চলছে কিনা তা দেখাই নিয়ন্ত্রণের কাজ। কার্যক্ষেত্রে কোনো রকম ত্রুটি-বিচ্যুতি ধরা পড়লে তার কারণ চিহ্নিত করার পর যথাযথ সংশোধনী এনে নিয়ন্ত্রণ প্রক্রিয়ায় তা দূর করা হয়। সে কারণে নিয়ন্ত্রণকে নিয়াময়মূলক ব্যবস্থাও বলা হয়। 

পরিকল্পনা ও নিয়ন্ত্রণ ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। পরিকল্পনা না থাকলে নিয়ন্ত্রণ মূল্যহীন। কেননা পূর্ব-পরিকল্পনা বা নির্ধারিত মান অনুযায়ী নিয়ন্ত্রণ কার্য পরিচালিত হয়ে থাকে। এখানে নিয়ন্ত্রণ কাকে বলে বা নিয়ন্ত্রণের সংজ্ঞা, প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্য, আবশ্যকীয় উপাদান এবং গুরুত্ব উল্লেখ করা হলো।

নিয়ন্ত্রণ কী?

উইরিখ ও কুঞ্জ (H. Weihrich & H. Koontz)-এর মতে “পরিকল্পনা অনুযায়ী যাতে কার্য সম্পাদিত হয় তা নিশ্চিত করার জন্য সম্পাদিত ব্যক্তিক ও প্রাতিষ্ঠানিক কাজ পরিমাপ ও সংশোধন করাকেই নিয়ন্ত্রণ বলে” (Controlling is measuring and correcting individual and organisational performance to ensure that events conform to plants)।

হেনরি ফেয়ল (Henry Fayol)-এর মতে, “নিয়ন্ত্রণ হলো গৃহীত পরিকল্পনা, জারিকৃত নির্দেশনা ও প্রতিষ্ঠিত নীতি অনুযায়ী কার্য পরিচালিত হচ্ছে কিনা তা পরীক্ষা করা” (Control involves whether anything occurs in conformity of the plan, the instructions issued and principles established)।

অধ্যাপক দূর্গাদাস ভট্টাচার্য্য-এর ভাষায়, “পরিকল্পনা অনুসারে কার্য সম্পাদন হচ্ছে কি-না তা নিরীক্ষণ করা, প্রকৃত কার্য ও বিনির্দিষ্ট কার্যের মধ্যে বিচ্যুতি নিরূপণ করা এবং সংশোধনমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ প্রক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণ বলে।”

পরিশেষে বলা যায়, প্রাতিষ্ঠানিক লক্ষ্য অর্জনের জন্য পরিকল্পনা বা পূর্ব নির্ধারিত মান অনুযায়ী কার্যাবলি সম্পাদিত হচ্ছে কি-না তা যাচাই করা এবং কোনরূপ বিচ্যুতি পরিলক্ষিত হলে তার কারণ নির্ধারণপূর্বক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ প্রক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণ বলে। একটি প্রতিষ্ঠানে নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা দুর্বল হলে তা চলমান রাখা কঠিন হয়ে পড়বে।

নিয়ন্ত্রণের প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্য (Nature and Characteristics of Controlling)

ব্যবস্থাপনা প্রক্রিয়ার সর্বশেষ ও চূড়ান্ত কার্য হচ্ছে নিয়ন্ত্রণ। পরিকল্পনা অনুযায়ী কার্যাবলি ঠিকমত পরিচালিত হচ্ছে কি-না তা যাচাই করা এবং কোনো রকম ত্রুটি বিচ্যুতি হয়ে থাকলে প্রয়োজনীয় সংশোধনমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করাই নিয়ন্ত্রণের মূখ্য কাজ। কী কী বৈশিষ্ট্য থাকলে আমরা একটি নিয়ন্ত্রণ প্রক্রিয়াকে যথাযথ বলব সে সম্পর্কে জানা প্রয়োজন। নিচে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো:

পরিকল্পনার অনুসরণ (Follow-up of planning):  ব্যবস্থাপনার যে সব কার্যাবলি রয়েছে তা পরিকল্পনার মাধ্যমে শুরু হয় এবং নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে শেষ হয়। অর্থাৎ নিয়ন্ত্রণ পরিকল্পনাকে অনুসরণ করে। পরিকল্পনায় কাজের যে মান নির্ধারণ করা হয়, সেটি বিবেচনা করেই নিয়ন্ত্রণ কাজ করা হয়ে থাকে। দৈনন্দিন কাঁচা বাজারের কথাই ধরুন। বাজারে যাওয়ার আগে কী কী জিনিস ক্রয় করবেন এবং তার জন্য কী পরিমাণ অর্থ ব্যয় হবে সে সম্পর্কে আপনার একটি পরিকল্পনা থাকে। বাজারে গিয়ে সে অনুযায়ী জিনিসপত্র ক্রয় করেন। কোনো জিনিসের দাম হেরফের হলে পরিকল্পনার সাথে সমন্বয় করেন এবং বাজারের বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করেন।

কার্য পরিমাপ করা (Measurement of performance): পরিকল্পনায় নির্ধারিত মান (standard) অনুযায়ী বিভিন্ন বিভাগের ও ব্যক্তির কর্মকাণ্ড পরিমাপ করার জন্য নিয়ন্ত্রণ কৌশলের দরকার হয়। তাই কার্য সম্পাদন পরিমাপ নিয়ন্ত্রণের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য। 

ত্রুটি-বিচ্যুতি দেখা (Investigation of defects/variances): সম্পাদিত কার্য পরিমাপ করার সময় পূর্ব-নির্ধারিত মানের সাথে সম্পাদিত কাজের মিল আছে কি-না তা অনুসন্ধান করে দেখা হয়। বিচ্যুতি বা পার্থক্য ধরা পড়লে তা রেকর্ড করা হয়। 

বিচ্যুতির কারণ নির্ণয় (Diagnosis of the causes of defects/variances):  অনুসন্ধানের ফলে ত্রুটি-বিচ্যুতি ধরা পড়লে তার কারণ নির্ধারণ করা হয়। কারণ জানা না থাকলে সমস্যা সমাধান করা অসম্ভব হয়। 

সংশোধনমূলক ব্যবস্থা (Taking corrective action):  নিয়ন্ত্রণের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সংশোধনমূলক ব্যবস্থা। অর্থাৎ নিয়ন্ত্রণের ফলে যেসব ত্রুটি-বিচ্যুতি ধরা পড়ে সেগুলো সংশোধনের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা। সংশোধনের ব্যবস্থা না থাকলে নিয়ন্ত্রণ কাজ সম্পূর্ণ হয় না। 

অব্যাহত কার্য (Continuous activity): নিয়ন্ত্রণ একটি সার্বক্ষণিক কার্য। প্রতিষ্ঠানের সকল কাজের সাথে এটি জড়িত। পরিকল্পনা মোতাবেক বিভিন্ন কাযর্, যেমন সংগঠন, কর্মীসংস্থান, নির্দেশনা, প্রেষণা ইত্যাদি যতক্ষণ চলতে থাকে নিয়ন্ত্রণও অবিরাম গতিতে ততক্ষণ চলতে থাকে। কোনো কারণে পরিকল্পনায় সংশোধনী আনা হলে সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্যও নিয়ন্ত্রণ অব্যাহত থাকে। 

সাংগঠনিক ব্যাপ্তি (Organisational pervasiveness):  প্রতিষ্ঠানের ভেতরে যতগুলো বিভাগ বা সেকশন থাকে সবগুলোতেই পরিকল্পনার সাথে সঙ্গতি রেখে নিয়ন্ত্রণ কার্য করা হয়। তাই নিয়ন্ত্রণের ব্যাপ্তি পুরো সংগঠনেই ছড়িয়ে থাকে। 

পরিবর্তনশীল (Flexible): ব্যবসায়িক পরিবেশ সবসময়ই পরিবর্তন হচ্ছে। এসব পরিবর্তনের সাথে তাল রেখে নিয়ন্ত্রণ কৌশলেও পরিবর্তন আনা হয়ে থাকে। 

বাস্তবতার প্রতিফলন (Reflection of reality): প্রতিষ্ঠানের বাস্তব অবস্থা বিবেচনা করেই নিয়ন্ত্রণ কার্য সম্পাদন করা হয়। বাস্তব তথ্যের ভিত্তিতে পরিকল্পনার সাথে মিল রেখেই কার্য সম্পাদন নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। 

ব্যবস্থাপনার সর্বশেষ গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক কাজ হলো নিয়ন্ত্রণ।

কার্যকরী নিয়ন্ত্রণের আবশ্যকীয় উপাদান (Elements of Effective Controlling)

একটি কার্যকরী নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থায় কতকগুলো আবশ্যকীয় উপাদান রয়েছে। নিয়ন্ত্রণকে কার্যকরী করতে হলে এ উপাদানগুলোকে গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করতে হয়। এগুলো নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার প্রয়োজনীয় শর্ত হিসেবেও বিবেচিত হয়ে থাকে। এসব উপাদান নিচে আলোচনা করা হলো:

নিয়ন্ত্রণ পরিকল্পনা ও কর্মীর পদের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হবে (Control should be tailored to plans and positions): নিয়ন্ত্রণ সর্বদাই পরিকল্পনার সাথে এবং প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন পদের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হবে। অর্থাৎ নিয়ন্ত্রণ একদিকে যেমন পরিকল্পনা অনুযায়ী হবে, অন্যদিকে তা কোন পদে কোন ধরনের কাজের দায়িত্ব রয়েছে তার সাথে মিল রেখে করতে হবে।

নিয়ন্ত্রণ বোধগম্য হবে (Controls should be understandable):  প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত ব্যবস্থাপকদের নিকট নিয়ন্ত্রণ গ্রহণযোগ্য বা বোধগম্য হতে হবে। নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি সহজ-সরল ও বোধগম্য হলে ব্যবস্থাকগণ তা ব্যবহারে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। 

নিয়ন্ত্রণ বিচ্যুতির দ্রুত সনাক্তকরণে সাহায্য করবে (Control should help quick detection of deviations): নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি এমনভাবে সাজাতে হবে যাতে বিচ্যুতি বা সমস্যা দ্রুত চিহ্নিত করা যায়। সমস্যা বা ত্রুটি সনাক্ত করতে পারলে ব্যবস্থাপকগণ সেদিকে বেশি মনোযোগী হতে পারেন এবং এতে নিয়ন্ত্রণ কার্য সহজতর হয়। 

নিয়ন্ত্রণ নমনীয় হবে (Controls should be flexible): আদর্শ নিয়ন্ত্রণ নমনীয় হবে। অর্থাৎ প্রয়োজনে কোনো রকম পরিবর্তন সাধিত হলে নিয়ন্ত্রণে যাতে পরিবর্তন আনা যায় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।

নিয়ন্ত্রণ উদ্দেশ্যমুখী হবে (Controls should be objective): আদর্শ নিয়ন্ত্রণের আরো একটি উপাদান হলো উদ্দেশ্যকেন্ত্রিকতা। অর্থাৎ ব্যবস্থাপনার উদ্দেশ্যসমূহ অর্জনের জন্যই নিয়ন্ত্রণ কাজ পরিচালিত হতে হবে। এ উদ্দেশ্যের মান সংখ্যায় প্রকাশ করা যেতে পারে। যেমন- ১০০ টাকা খরচ, ১০ ঘন্টা শ্রম ইত্যাদি। 

নিয়ন্ত্রণ সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে (Controls should be consistent): নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি সাংগঠনিক পরিবেশের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, যেখানে কঠোর নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি থাকে সেখানে কর্মীদের অধিক স্বাধীনতা দেয়া হলে তা সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে পারে না। এতে নিয়ন্ত্রণ ব্যর্থ হতে বাধ্য।

নিয়ন্ত্রণ হবে স্বল্প ব্যয়সাধ্য (Controls should be economical): আদর্শ নিয়ন্ত্রণের আরেকটি উপাদান হলো এটি স্বল্প ব্যয়সাধ্য হবে। যে পদ্ধতিতে নিয়ন্ত্রণ করা হবে তার যে ব্যয় হবে তা এর থেকে প্রাপ্ত সুবিধার চেয়ে কম হতে হবে। নিয়ন্ত্রণ ব্যয়বহুল হলে নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্য সফল হয় না। 

নিয়ন্ত্রণ হবে বাস্তবভিত্তিক (Controls should be pragmatic):  নিয়ন্ত্রণ হবে বাস্তবভিত্তিক অর্থাৎ অবাস্তব কল্পনা বা অনুমানের উপর নির্ভর করে নিয়ন্ত্রণ করা হলে তা কার্যকরী হয় না। 

নিয়ন্ত্রণে ভবিষ্যৎ দর্শন থাকবে (Controls should have future vision): কার্যকর নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা এমন হতে হয় যাতে ভবিষ্যতে কি ধরনের সমস্যা বা ত্রুটি-বিচ্যুতি হতে পারে সে সম্পর্কে ধারণা দিতে পারে এবং এগুলো কিভাবে সমাধান করা যায় তারও ইঙ্গিত দিতে পারে। এতে ভবিষ্যতে সম্ভাব্য সমস্যার সমাধান সহজসাধ্য হয়। 

নিয়ন্ত্রণ সংশোধনীমূলক হবে (Controls should lead to corrective action): নিয়ন্ত্রণের আর একটি পূর্বশর্ত হলো এতে সংশোধনমূলক ব্যবস্থা রাখা। নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে আদর্শমান ও পরিকল্পনার সাথে প্রকৃত কার্যের তুলনা করে ত্রুটি-বিচ্যুতি সনাক্ত করা হয়। নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতিতে ঐসব ত্রুটি-বিচ্যুতি বা দুর্বলতা সংশোধনের ব্যবস্থাও থাকতে হবে।

নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা প্রবর্তন ও অনুশীলন করার সময় উপরিউক্ত উপাদান বা বৈশিষ্ট্যসমূহ বিবেচনা করতে হয়। একটি নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থায় এ উপাদানগুলো বিবেচিত না হলে নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। মনে রাখতে হবে, নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠানের উচ্চপর্যায়ের লোকজন দ্বারা পরিকল্পিত হয়। নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে উর্ধ্বতন ও অধস্তনের মধ্যে এক যোগসূত্র তৈরি হয়। তাই সুষ্ঠু নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা একটি প্রতিষ্ঠানের পুরো সংস্কৃতি পরিবর্তন করে দিতে পারে। আর এই পরিবর্তন ইতিবাচক হলে প্রতিষ্ঠানের জন্য অবশ্যই মঙ্গল বয়ে আনবে। এর জন্য কাজের প্রকৃতি অনুযায়ী নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নির্ধারণ করা প্রয়োজন। 

ব্যবস্থাপনায় নিয়ন্ত্রণের গুরুত্ব বা প্রয়োজনীয়তা (Importance of Controlling in Management)

একটি প্রতিষ্ঠানের সকল কার্য সুষ্ঠুভাবে সম্পাদনের জন্য নিয়ন্ত্রণের গুরুত্ব বা প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। নিয়ন্ত্রণ পরিবর্তনশীল পরিবেশে প্রতিষ্ঠানকে সঠিক পদক্ষেপ নিতে সহায়তা করে। বড় ধরনের ভুল থেকে প্রতিষ্ঠানকে রক্ষা করার জন্য ছোট ভুল বড় ভুুলে পরিণত হবার আগেই তা সনাক্ত করতে সাহায্য করে। তা ছাড়াও, নিয়ন্ত্রণ পরিকল্পনার বাস্তবায়ন নিশ্চিত করে, লোকসানের ঝুঁকি হ্রাস করে এবং ত্রুটি-বিচ্যুতি সংশোধনকল্পে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি করে। ব্যবস্থাপনায় নিয়ন্ত্রণের এসব গুরুত্ব নিচে আলোচনা করা হলো: 

পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সহায়তা (Help in the implementation of plan): পরিকল্পনার সাথে নিয়ন্ত্রণের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বিদ্যমান। সঠিক নিয়ন্ত্রণ কৌশলের মাধ্যমে পরিকল্পনার বাস্তবায়নের অগ্রগতি পরিমাপ করা যায়। ফলে পরিকল্পনার বাস্তবায়ন সহজতর হয়।

কর্তৃত্ব অর্পন (Delegation of authority):  প্রতিষ্ঠানের সকল বিভাগে নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হলে ব্যবস্থাপক নিশ্চিন্তে অধস্তনের নিকট কর্তৃত্ব অর্পণ করতে পারেন।

লোকসানের ঝুঁকি হ্রাস (Minimization of the risk of losses):  সঠিক ও কার্যকর নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার কারণে সব রকমের কার্যাবলি নিয়ন্ত্রিত হয় বলে প্রতিষ্ঠানের উৎপাদনশীলতা বাড়ে। এতে প্রতিষ্ঠানে লোকসানের ঝুঁকি কমে যায়।

সমস্যার কারণ চিহ্নিতকরণ (Identification of the causes of problems): পরিকল্পনা অনুযায়ী বাস্তব কাজ পরিচালিত না হলে বুঝতে হবে কাজের ক্ষেত্রে কোথাও সমস্যা রয়েছে। কার্যকর নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার মাধ্যমে ব্যবস্থাপকগণ সমস্যার কারণ চিহ্নিত করতে পারেন এবং যথাসম্ভব তা সংশোধনও করতে পারেন।

ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ (Decentralisation of power): উত্তম নিয়ন্ত্রণ-কৌশল প্রতিষ্ঠিত হলে প্রতিষ্ঠানের উপরের স্তরে সকল ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করে রাখার প্রয়োজন হয় না। এর মাধ্যমে ক্ষমতার অপব্যবহার কিংবা অযোগ্য ব্যবহার কমানো যায় বিধায় ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ সম্ভব হয়।

সমন্বয়সাধনে সহায়তা (Aid in coordination): কার্যকর নিয়ন্ত্রণ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন বিভাগ ও কর্মীর কাজের মধ্যে সমন্বয় সাধনে সহায়তা করে। সমন্বয়সাধনের কারণে প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হয়।

পরিবর্তিত অবস্থার সাথে খাপ খাওয়াতে সহায়তা (Help in keeping pace with changing circumstances): প্রতিষ্ঠানে কিংবা এর পরিবেশে কোনো পরিবর্তন সাধিত হতে পারে। কার্যকর নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি এ পরিবর্তনশীল অবস্থা সম্পর্কে পূর্বাভাস দিতে পারে এবং পরিবর্তিত পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়াতে সহায়তা করে।

অপচয় হ্রাস (Reduction of wastage): সুষ্ঠু নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা থাকলে প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত প্রত্যেক ব্যক্তি তার দায়িত্ব ঠিক পরিকল্পনা মোতাবেক পালন করতে সচেষ্ট হয়। ফলে প্রতিষ্ঠানের অপচয় হ্রাস পায়।

ব্যবস্থাপকের সময় ও শ্রম সাশ্রয় (Saving of time and energy of the manager): প্রতিষ্ঠানে সুষ্ঠু নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা থাকলে ব্যবস্থাপককে প্রতিষ্ঠানের কাজ দেখাশুনা করতে অধিক সময় দিতে হয় না। বরং অন্যান্য কাজে তিনি অধিক মনোনিবেশ করতে পারেন। ফলে তার সময় ও শ্রম বাঁচে।

ভুল-ত্রুটি থেকে অব্যাহতি (Getting relief from errors): অনেক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভুল দিনের পর দিন ঘটতে থাকলে তা প্রতিষ্ঠানের জন্য ক্ষতিকর হয়ে উঠতে পারে। নিয়ন্ত্রণ এ ধরনের ভুল পূর্ব থেকে সনাক্ত করতে সাহায্য করে। ফলে প্রতিষ্ঠান অনিবার্য ক্ষতির হাত থেকে বেঁচে যায়।

দ্রুত সংশোধনমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ (Undertaking quick corrective action): শুধু ভুল-ভ্রান্তি বা বিচ্যুতি সনাক্তকরণই নয়, নিয়ন্ত্রণ-ব্যবস্থা সেগুলোর কারণ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় সংশোধনমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে সহায়তা করে। এতে প্রতিষ্ঠানের পরিকল্পার সঠিক বাস্তবায়ন সম্ভব হয়।

ব্যবস্থাপনায় গতিশীলতা আনয়ন (Dynamism in management): নিয়ন্ত্রণহীনতা প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের সীমা লঙ্ঘন করতে প্ররোচিত করে। এছাড়া সুষ্ঠু নিয়ন্ত্রণ ব্যতীত ব্যবস্থাপনার অধিকাংশ কাজই বেপরোয়াভাবে পরিচালিত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এ কারণে ব্যবস্থাপনাকে গতিশীল ও সুশৃঙ্খল করতে সুষ্ঠু নিয়ন্ত্রণ অত্যাবশ্যক।

ব্যবস্থাপনার সামগ্রিক কার্যাবলি সুষ্ঠু ও সঠিকভাবে সম্পাদনের ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণের গুরুত্ব অপরিসীম। এ কারণে কোনো কোনো লেখক নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে এরূপ মন্তব্য করেছেন: ‘Management itself is controlling’ অর্থাৎ ব্যবস্থাপনাই নিয়ন্ত্রণ।

শেয়ার করুন

2 thoughts on “নিয়ন্ত্রণ কাকে বলে? নিয়ন্ত্রণের প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্য, আবশ্যকীয় উপাদান এবং গুরুত্ব কী?

মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার তথ্য সংরক্ষিত রাখুন

বিশেষ শর্তসাপেক্ষে এই ওয়েবসাইটটি সামাজিক কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ কিংবা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের নিকট বিক্রি করা হবে।

নিয়ন্ত্রণ কাকে বলে? নিয়ন্ত্রণের প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্য, আবশ্যকীয় উপাদান এবং গুরুত্ব কী?

প্রকাশ: ০৬:৪৬:৫৪ অপরাহ্ন, বুধবার, ১৫ ডিসেম্বর ২০২১

ব্যবস্থাপনার সর্বশেষ গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক কাজ হলো নিয়ন্ত্রণ। প্রাতিষ্ঠানিক জগতে নিয়ন্ত্রণ বলতে প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য ও পরিকল্পনা অনুযায়ী কার্যাবলি সম্পাদিত হচ্ছে কিনা তা নিশ্চিত করার জন্য কার্যফল পরিমাপ করা এবং কোনো বিচ্যুতি হলে তা সংশোধনের ব্যবস্থা গ্রহণ করাকে বুঝানো হয়। পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ হচ্ছে কিনা কিংবা নির্ধারিত মান অনুসারে কাজকর্ম চলছে কিনা তা দেখাই নিয়ন্ত্রণের কাজ। কার্যক্ষেত্রে কোনো রকম ত্রুটি-বিচ্যুতি ধরা পড়লে তার কারণ চিহ্নিত করার পর যথাযথ সংশোধনী এনে নিয়ন্ত্রণ প্রক্রিয়ায় তা দূর করা হয়। সে কারণে নিয়ন্ত্রণকে নিয়াময়মূলক ব্যবস্থাও বলা হয়। 

পরিকল্পনা ও নিয়ন্ত্রণ ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। পরিকল্পনা না থাকলে নিয়ন্ত্রণ মূল্যহীন। কেননা পূর্ব-পরিকল্পনা বা নির্ধারিত মান অনুযায়ী নিয়ন্ত্রণ কার্য পরিচালিত হয়ে থাকে। এখানে নিয়ন্ত্রণ কাকে বলে বা নিয়ন্ত্রণের সংজ্ঞা, প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্য, আবশ্যকীয় উপাদান এবং গুরুত্ব উল্লেখ করা হলো।

নিয়ন্ত্রণ কী?

উইরিখ ও কুঞ্জ (H. Weihrich & H. Koontz)-এর মতে “পরিকল্পনা অনুযায়ী যাতে কার্য সম্পাদিত হয় তা নিশ্চিত করার জন্য সম্পাদিত ব্যক্তিক ও প্রাতিষ্ঠানিক কাজ পরিমাপ ও সংশোধন করাকেই নিয়ন্ত্রণ বলে” (Controlling is measuring and correcting individual and organisational performance to ensure that events conform to plants)।

হেনরি ফেয়ল (Henry Fayol)-এর মতে, “নিয়ন্ত্রণ হলো গৃহীত পরিকল্পনা, জারিকৃত নির্দেশনা ও প্রতিষ্ঠিত নীতি অনুযায়ী কার্য পরিচালিত হচ্ছে কিনা তা পরীক্ষা করা” (Control involves whether anything occurs in conformity of the plan, the instructions issued and principles established)।

অধ্যাপক দূর্গাদাস ভট্টাচার্য্য-এর ভাষায়, “পরিকল্পনা অনুসারে কার্য সম্পাদন হচ্ছে কি-না তা নিরীক্ষণ করা, প্রকৃত কার্য ও বিনির্দিষ্ট কার্যের মধ্যে বিচ্যুতি নিরূপণ করা এবং সংশোধনমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ প্রক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণ বলে।”

পরিশেষে বলা যায়, প্রাতিষ্ঠানিক লক্ষ্য অর্জনের জন্য পরিকল্পনা বা পূর্ব নির্ধারিত মান অনুযায়ী কার্যাবলি সম্পাদিত হচ্ছে কি-না তা যাচাই করা এবং কোনরূপ বিচ্যুতি পরিলক্ষিত হলে তার কারণ নির্ধারণপূর্বক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ প্রক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণ বলে। একটি প্রতিষ্ঠানে নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা দুর্বল হলে তা চলমান রাখা কঠিন হয়ে পড়বে।

নিয়ন্ত্রণের প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্য (Nature and Characteristics of Controlling)

ব্যবস্থাপনা প্রক্রিয়ার সর্বশেষ ও চূড়ান্ত কার্য হচ্ছে নিয়ন্ত্রণ। পরিকল্পনা অনুযায়ী কার্যাবলি ঠিকমত পরিচালিত হচ্ছে কি-না তা যাচাই করা এবং কোনো রকম ত্রুটি বিচ্যুতি হয়ে থাকলে প্রয়োজনীয় সংশোধনমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করাই নিয়ন্ত্রণের মূখ্য কাজ। কী কী বৈশিষ্ট্য থাকলে আমরা একটি নিয়ন্ত্রণ প্রক্রিয়াকে যথাযথ বলব সে সম্পর্কে জানা প্রয়োজন। নিচে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো:

পরিকল্পনার অনুসরণ (Follow-up of planning):  ব্যবস্থাপনার যে সব কার্যাবলি রয়েছে তা পরিকল্পনার মাধ্যমে শুরু হয় এবং নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে শেষ হয়। অর্থাৎ নিয়ন্ত্রণ পরিকল্পনাকে অনুসরণ করে। পরিকল্পনায় কাজের যে মান নির্ধারণ করা হয়, সেটি বিবেচনা করেই নিয়ন্ত্রণ কাজ করা হয়ে থাকে। দৈনন্দিন কাঁচা বাজারের কথাই ধরুন। বাজারে যাওয়ার আগে কী কী জিনিস ক্রয় করবেন এবং তার জন্য কী পরিমাণ অর্থ ব্যয় হবে সে সম্পর্কে আপনার একটি পরিকল্পনা থাকে। বাজারে গিয়ে সে অনুযায়ী জিনিসপত্র ক্রয় করেন। কোনো জিনিসের দাম হেরফের হলে পরিকল্পনার সাথে সমন্বয় করেন এবং বাজারের বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করেন।

কার্য পরিমাপ করা (Measurement of performance): পরিকল্পনায় নির্ধারিত মান (standard) অনুযায়ী বিভিন্ন বিভাগের ও ব্যক্তির কর্মকাণ্ড পরিমাপ করার জন্য নিয়ন্ত্রণ কৌশলের দরকার হয়। তাই কার্য সম্পাদন পরিমাপ নিয়ন্ত্রণের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য। 

ত্রুটি-বিচ্যুতি দেখা (Investigation of defects/variances): সম্পাদিত কার্য পরিমাপ করার সময় পূর্ব-নির্ধারিত মানের সাথে সম্পাদিত কাজের মিল আছে কি-না তা অনুসন্ধান করে দেখা হয়। বিচ্যুতি বা পার্থক্য ধরা পড়লে তা রেকর্ড করা হয়। 

বিচ্যুতির কারণ নির্ণয় (Diagnosis of the causes of defects/variances):  অনুসন্ধানের ফলে ত্রুটি-বিচ্যুতি ধরা পড়লে তার কারণ নির্ধারণ করা হয়। কারণ জানা না থাকলে সমস্যা সমাধান করা অসম্ভব হয়। 

সংশোধনমূলক ব্যবস্থা (Taking corrective action):  নিয়ন্ত্রণের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সংশোধনমূলক ব্যবস্থা। অর্থাৎ নিয়ন্ত্রণের ফলে যেসব ত্রুটি-বিচ্যুতি ধরা পড়ে সেগুলো সংশোধনের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা। সংশোধনের ব্যবস্থা না থাকলে নিয়ন্ত্রণ কাজ সম্পূর্ণ হয় না। 

অব্যাহত কার্য (Continuous activity): নিয়ন্ত্রণ একটি সার্বক্ষণিক কার্য। প্রতিষ্ঠানের সকল কাজের সাথে এটি জড়িত। পরিকল্পনা মোতাবেক বিভিন্ন কাযর্, যেমন সংগঠন, কর্মীসংস্থান, নির্দেশনা, প্রেষণা ইত্যাদি যতক্ষণ চলতে থাকে নিয়ন্ত্রণও অবিরাম গতিতে ততক্ষণ চলতে থাকে। কোনো কারণে পরিকল্পনায় সংশোধনী আনা হলে সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্যও নিয়ন্ত্রণ অব্যাহত থাকে। 

সাংগঠনিক ব্যাপ্তি (Organisational pervasiveness):  প্রতিষ্ঠানের ভেতরে যতগুলো বিভাগ বা সেকশন থাকে সবগুলোতেই পরিকল্পনার সাথে সঙ্গতি রেখে নিয়ন্ত্রণ কার্য করা হয়। তাই নিয়ন্ত্রণের ব্যাপ্তি পুরো সংগঠনেই ছড়িয়ে থাকে। 

পরিবর্তনশীল (Flexible): ব্যবসায়িক পরিবেশ সবসময়ই পরিবর্তন হচ্ছে। এসব পরিবর্তনের সাথে তাল রেখে নিয়ন্ত্রণ কৌশলেও পরিবর্তন আনা হয়ে থাকে। 

বাস্তবতার প্রতিফলন (Reflection of reality): প্রতিষ্ঠানের বাস্তব অবস্থা বিবেচনা করেই নিয়ন্ত্রণ কার্য সম্পাদন করা হয়। বাস্তব তথ্যের ভিত্তিতে পরিকল্পনার সাথে মিল রেখেই কার্য সম্পাদন নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। 

ব্যবস্থাপনার সর্বশেষ গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক কাজ হলো নিয়ন্ত্রণ।

কার্যকরী নিয়ন্ত্রণের আবশ্যকীয় উপাদান (Elements of Effective Controlling)

একটি কার্যকরী নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থায় কতকগুলো আবশ্যকীয় উপাদান রয়েছে। নিয়ন্ত্রণকে কার্যকরী করতে হলে এ উপাদানগুলোকে গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করতে হয়। এগুলো নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার প্রয়োজনীয় শর্ত হিসেবেও বিবেচিত হয়ে থাকে। এসব উপাদান নিচে আলোচনা করা হলো:

নিয়ন্ত্রণ পরিকল্পনা ও কর্মীর পদের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হবে (Control should be tailored to plans and positions): নিয়ন্ত্রণ সর্বদাই পরিকল্পনার সাথে এবং প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন পদের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হবে। অর্থাৎ নিয়ন্ত্রণ একদিকে যেমন পরিকল্পনা অনুযায়ী হবে, অন্যদিকে তা কোন পদে কোন ধরনের কাজের দায়িত্ব রয়েছে তার সাথে মিল রেখে করতে হবে।

নিয়ন্ত্রণ বোধগম্য হবে (Controls should be understandable):  প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত ব্যবস্থাপকদের নিকট নিয়ন্ত্রণ গ্রহণযোগ্য বা বোধগম্য হতে হবে। নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি সহজ-সরল ও বোধগম্য হলে ব্যবস্থাকগণ তা ব্যবহারে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। 

নিয়ন্ত্রণ বিচ্যুতির দ্রুত সনাক্তকরণে সাহায্য করবে (Control should help quick detection of deviations): নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি এমনভাবে সাজাতে হবে যাতে বিচ্যুতি বা সমস্যা দ্রুত চিহ্নিত করা যায়। সমস্যা বা ত্রুটি সনাক্ত করতে পারলে ব্যবস্থাপকগণ সেদিকে বেশি মনোযোগী হতে পারেন এবং এতে নিয়ন্ত্রণ কার্য সহজতর হয়। 

নিয়ন্ত্রণ নমনীয় হবে (Controls should be flexible): আদর্শ নিয়ন্ত্রণ নমনীয় হবে। অর্থাৎ প্রয়োজনে কোনো রকম পরিবর্তন সাধিত হলে নিয়ন্ত্রণে যাতে পরিবর্তন আনা যায় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।

নিয়ন্ত্রণ উদ্দেশ্যমুখী হবে (Controls should be objective): আদর্শ নিয়ন্ত্রণের আরো একটি উপাদান হলো উদ্দেশ্যকেন্ত্রিকতা। অর্থাৎ ব্যবস্থাপনার উদ্দেশ্যসমূহ অর্জনের জন্যই নিয়ন্ত্রণ কাজ পরিচালিত হতে হবে। এ উদ্দেশ্যের মান সংখ্যায় প্রকাশ করা যেতে পারে। যেমন- ১০০ টাকা খরচ, ১০ ঘন্টা শ্রম ইত্যাদি। 

নিয়ন্ত্রণ সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে (Controls should be consistent): নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি সাংগঠনিক পরিবেশের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, যেখানে কঠোর নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি থাকে সেখানে কর্মীদের অধিক স্বাধীনতা দেয়া হলে তা সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে পারে না। এতে নিয়ন্ত্রণ ব্যর্থ হতে বাধ্য।

নিয়ন্ত্রণ হবে স্বল্প ব্যয়সাধ্য (Controls should be economical): আদর্শ নিয়ন্ত্রণের আরেকটি উপাদান হলো এটি স্বল্প ব্যয়সাধ্য হবে। যে পদ্ধতিতে নিয়ন্ত্রণ করা হবে তার যে ব্যয় হবে তা এর থেকে প্রাপ্ত সুবিধার চেয়ে কম হতে হবে। নিয়ন্ত্রণ ব্যয়বহুল হলে নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্য সফল হয় না। 

নিয়ন্ত্রণ হবে বাস্তবভিত্তিক (Controls should be pragmatic):  নিয়ন্ত্রণ হবে বাস্তবভিত্তিক অর্থাৎ অবাস্তব কল্পনা বা অনুমানের উপর নির্ভর করে নিয়ন্ত্রণ করা হলে তা কার্যকরী হয় না। 

নিয়ন্ত্রণে ভবিষ্যৎ দর্শন থাকবে (Controls should have future vision): কার্যকর নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা এমন হতে হয় যাতে ভবিষ্যতে কি ধরনের সমস্যা বা ত্রুটি-বিচ্যুতি হতে পারে সে সম্পর্কে ধারণা দিতে পারে এবং এগুলো কিভাবে সমাধান করা যায় তারও ইঙ্গিত দিতে পারে। এতে ভবিষ্যতে সম্ভাব্য সমস্যার সমাধান সহজসাধ্য হয়। 

নিয়ন্ত্রণ সংশোধনীমূলক হবে (Controls should lead to corrective action): নিয়ন্ত্রণের আর একটি পূর্বশর্ত হলো এতে সংশোধনমূলক ব্যবস্থা রাখা। নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে আদর্শমান ও পরিকল্পনার সাথে প্রকৃত কার্যের তুলনা করে ত্রুটি-বিচ্যুতি সনাক্ত করা হয়। নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতিতে ঐসব ত্রুটি-বিচ্যুতি বা দুর্বলতা সংশোধনের ব্যবস্থাও থাকতে হবে।

নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা প্রবর্তন ও অনুশীলন করার সময় উপরিউক্ত উপাদান বা বৈশিষ্ট্যসমূহ বিবেচনা করতে হয়। একটি নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থায় এ উপাদানগুলো বিবেচিত না হলে নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। মনে রাখতে হবে, নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠানের উচ্চপর্যায়ের লোকজন দ্বারা পরিকল্পিত হয়। নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে উর্ধ্বতন ও অধস্তনের মধ্যে এক যোগসূত্র তৈরি হয়। তাই সুষ্ঠু নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা একটি প্রতিষ্ঠানের পুরো সংস্কৃতি পরিবর্তন করে দিতে পারে। আর এই পরিবর্তন ইতিবাচক হলে প্রতিষ্ঠানের জন্য অবশ্যই মঙ্গল বয়ে আনবে। এর জন্য কাজের প্রকৃতি অনুযায়ী নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নির্ধারণ করা প্রয়োজন। 

ব্যবস্থাপনায় নিয়ন্ত্রণের গুরুত্ব বা প্রয়োজনীয়তা (Importance of Controlling in Management)

একটি প্রতিষ্ঠানের সকল কার্য সুষ্ঠুভাবে সম্পাদনের জন্য নিয়ন্ত্রণের গুরুত্ব বা প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। নিয়ন্ত্রণ পরিবর্তনশীল পরিবেশে প্রতিষ্ঠানকে সঠিক পদক্ষেপ নিতে সহায়তা করে। বড় ধরনের ভুল থেকে প্রতিষ্ঠানকে রক্ষা করার জন্য ছোট ভুল বড় ভুুলে পরিণত হবার আগেই তা সনাক্ত করতে সাহায্য করে। তা ছাড়াও, নিয়ন্ত্রণ পরিকল্পনার বাস্তবায়ন নিশ্চিত করে, লোকসানের ঝুঁকি হ্রাস করে এবং ত্রুটি-বিচ্যুতি সংশোধনকল্পে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি করে। ব্যবস্থাপনায় নিয়ন্ত্রণের এসব গুরুত্ব নিচে আলোচনা করা হলো: 

পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সহায়তা (Help in the implementation of plan): পরিকল্পনার সাথে নিয়ন্ত্রণের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বিদ্যমান। সঠিক নিয়ন্ত্রণ কৌশলের মাধ্যমে পরিকল্পনার বাস্তবায়নের অগ্রগতি পরিমাপ করা যায়। ফলে পরিকল্পনার বাস্তবায়ন সহজতর হয়।

কর্তৃত্ব অর্পন (Delegation of authority):  প্রতিষ্ঠানের সকল বিভাগে নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হলে ব্যবস্থাপক নিশ্চিন্তে অধস্তনের নিকট কর্তৃত্ব অর্পণ করতে পারেন।

লোকসানের ঝুঁকি হ্রাস (Minimization of the risk of losses):  সঠিক ও কার্যকর নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার কারণে সব রকমের কার্যাবলি নিয়ন্ত্রিত হয় বলে প্রতিষ্ঠানের উৎপাদনশীলতা বাড়ে। এতে প্রতিষ্ঠানে লোকসানের ঝুঁকি কমে যায়।

সমস্যার কারণ চিহ্নিতকরণ (Identification of the causes of problems): পরিকল্পনা অনুযায়ী বাস্তব কাজ পরিচালিত না হলে বুঝতে হবে কাজের ক্ষেত্রে কোথাও সমস্যা রয়েছে। কার্যকর নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার মাধ্যমে ব্যবস্থাপকগণ সমস্যার কারণ চিহ্নিত করতে পারেন এবং যথাসম্ভব তা সংশোধনও করতে পারেন।

ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ (Decentralisation of power): উত্তম নিয়ন্ত্রণ-কৌশল প্রতিষ্ঠিত হলে প্রতিষ্ঠানের উপরের স্তরে সকল ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করে রাখার প্রয়োজন হয় না। এর মাধ্যমে ক্ষমতার অপব্যবহার কিংবা অযোগ্য ব্যবহার কমানো যায় বিধায় ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ সম্ভব হয়।

সমন্বয়সাধনে সহায়তা (Aid in coordination): কার্যকর নিয়ন্ত্রণ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন বিভাগ ও কর্মীর কাজের মধ্যে সমন্বয় সাধনে সহায়তা করে। সমন্বয়সাধনের কারণে প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হয়।

পরিবর্তিত অবস্থার সাথে খাপ খাওয়াতে সহায়তা (Help in keeping pace with changing circumstances): প্রতিষ্ঠানে কিংবা এর পরিবেশে কোনো পরিবর্তন সাধিত হতে পারে। কার্যকর নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি এ পরিবর্তনশীল অবস্থা সম্পর্কে পূর্বাভাস দিতে পারে এবং পরিবর্তিত পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়াতে সহায়তা করে।

অপচয় হ্রাস (Reduction of wastage): সুষ্ঠু নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা থাকলে প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত প্রত্যেক ব্যক্তি তার দায়িত্ব ঠিক পরিকল্পনা মোতাবেক পালন করতে সচেষ্ট হয়। ফলে প্রতিষ্ঠানের অপচয় হ্রাস পায়।

ব্যবস্থাপকের সময় ও শ্রম সাশ্রয় (Saving of time and energy of the manager): প্রতিষ্ঠানে সুষ্ঠু নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা থাকলে ব্যবস্থাপককে প্রতিষ্ঠানের কাজ দেখাশুনা করতে অধিক সময় দিতে হয় না। বরং অন্যান্য কাজে তিনি অধিক মনোনিবেশ করতে পারেন। ফলে তার সময় ও শ্রম বাঁচে।

ভুল-ত্রুটি থেকে অব্যাহতি (Getting relief from errors): অনেক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভুল দিনের পর দিন ঘটতে থাকলে তা প্রতিষ্ঠানের জন্য ক্ষতিকর হয়ে উঠতে পারে। নিয়ন্ত্রণ এ ধরনের ভুল পূর্ব থেকে সনাক্ত করতে সাহায্য করে। ফলে প্রতিষ্ঠান অনিবার্য ক্ষতির হাত থেকে বেঁচে যায়।

দ্রুত সংশোধনমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ (Undertaking quick corrective action): শুধু ভুল-ভ্রান্তি বা বিচ্যুতি সনাক্তকরণই নয়, নিয়ন্ত্রণ-ব্যবস্থা সেগুলোর কারণ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় সংশোধনমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে সহায়তা করে। এতে প্রতিষ্ঠানের পরিকল্পার সঠিক বাস্তবায়ন সম্ভব হয়।

ব্যবস্থাপনায় গতিশীলতা আনয়ন (Dynamism in management): নিয়ন্ত্রণহীনতা প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের সীমা লঙ্ঘন করতে প্ররোচিত করে। এছাড়া সুষ্ঠু নিয়ন্ত্রণ ব্যতীত ব্যবস্থাপনার অধিকাংশ কাজই বেপরোয়াভাবে পরিচালিত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এ কারণে ব্যবস্থাপনাকে গতিশীল ও সুশৃঙ্খল করতে সুষ্ঠু নিয়ন্ত্রণ অত্যাবশ্যক।

ব্যবস্থাপনার সামগ্রিক কার্যাবলি সুষ্ঠু ও সঠিকভাবে সম্পাদনের ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণের গুরুত্ব অপরিসীম। এ কারণে কোনো কোনো লেখক নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে এরূপ মন্তব্য করেছেন: ‘Management itself is controlling’ অর্থাৎ ব্যবস্থাপনাই নিয়ন্ত্রণ।