০২:১৫ অপরাহ্ন, শনিবার, ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
                       

আবেগ: শৈশবে আবেগিক বিকাশ কীভাবে হয় এবং এর ধাপ কী?

বিশ্লেষণ সংকলন টিম
  • প্রকাশ: ০১:২৫:২৭ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ১৭ ডিসেম্বর ২০২১
  • / ৩৩৭৩ বার পড়া হয়েছে

অনেক মনোবিজ্ঞানী বিশ্বাস করেন যে, জন্মের সময় থেকেই শিশুর মধ্যে আবেগ থাকে। নবজাতক শিশুর আবেগ নিয়ে অনেক মতবিরোধ তবে নবজাতকের আবেগিক আচরণ যে সাধারণধর্মী এতে কোনো মতভেদ নেই।


Google News
বিশ্লেষণ-এর সর্বশেষ নিবন্ধ পড়তে গুগল নিউজে যোগ দিন

বিশেষ শর্তসাপেক্ষে এবং স্বল্পমূল্যে এই ওয়েবসাইটটি সামাজিক কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ কিংবা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের নিকট বিক্রি করা হবে।

শৈশবে আবেগিক বিকাশ কীভাবে হয় তা নিচে উল্লেখ করা হলো:

নবজাতকের আবেগিক বিকাশ 

মনোবিজ্ঞানীরা আবেগের বিকাশের পর্যায় সম্পর্কে এক মত নন। ব্লেয়ার (Blair)-এর মতে শিশুর জন্ম সময় থেকেই আবেগিক বিকাশের উপাদান তার মধ্যে থাকে এবং জন্ম মুহূর্তে থেকে এমনকি জন্ম পূর্ব থেকেই শিশু বিভিন্ন বিক্ষিপ্ত আবেগিক আচরণ শুরু করে। অসুবেল (Ausubel) তার ‘Theory of Problems of Child Development’ বইয়ে উল্লেখ করেছেন শিশুর জন্মের আগে যে সব মায়েরা খুব উদ্বিঘ্ন আবেগিক অবস্থায় থাকেন তাদের শিশুরা কাঁদে বেশি। এটাও বিশ্বাস করা হয় যে মায়ের এড্রিনাল গ্রন্থির ক্ষরণ শিশুর জন্মের পূর্বেই শিশুর মধ্যে আবেগের উপাদান (Emotional Equipment) সঞ্চালন করে থাকে। 

প্রাণীদের উপর চালিত গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে আবেগ বংশগতি ভিত্তিক। স্টোন (Stone) গবেষণায় প্রমান করেছেন শান্ত প্রকৃতির সাদা ইঁদুর এবং হিংস্র প্রকৃতির ধূসর ইঁদুরের সংমিশ্রণে এদের বংশধরেরা কেউ শান্ত এবং কেউ উগ্র মেজাজের হয়ে থাকে। হারলক উল্লেখ করেন নবজাতক শিশুর তিন সপ্তাহের মধ্যে প্রধান আবেগ হল পরিতৃপ্তি আর ক্লেশ। দৈহিক উত্তেজনা, ব্যাথা, ঠান্ডা বা গরম যে-কো অতৃপ্তিকর পরিবেশ শিশুকে ভীত করে। তাকে কাঁদতে শরীর মুচড়াতে দেখা যায। আবার মুখে খাবারের স্বাদ, চোষার জিনিস তার পরিতৃপ্তি আনে। 

নবজাতক শিশুর আবেগ নিয়ে অনেক মনোবিজ্ঞানী অনেক গবেষণা করেছেন। ডেকটি (Descarte) ছয়টি মৌলিক আবেগ- বিস্ময় ভালোবাসা, ঘৃনা, কামনা, আনন্দ ও দুঃখের কথা বলেছেন। ওয়াটসনের মতে শিশুর মধ্যে তিনটি আবেগ থাকে। ভয় রাগ, ভালোবাসা। ভয় জাগে জোরে আওয়াজ হলে বা উপর থেকে নিচে পড়ে গেলে। অঙ্গ সঞ্চালনে বাধা দিলে শিশুর রাগ হয় আর ভালোবাসা বা আনন্দ জাগে শিশুকে আদর করলে। শারমান (Sherman) ও ব্রিজেন, ওয়াটসনের মতের বিরোধীতা করেছেন। শারমান কয়েকটি পরীক্ষণের দ্বারা প্রমান করেন শিশুর আচরণ এতই সাধারণ ধর্মী যে, কোন আবেগের জন্য কোন আচরণটি করে তা বাইরে থেকে কখনই বোঝা যায় না।

নবজাতকের আবেগিক আচরণ যে নিতান্তই সাধারণ ধর্মী থাকে এ সিদ্ধান্ত আজকাল সকল মনোবিজ্ঞানী সমর্থন করেন। নবজাতক শিশুর মধ্যে অবিমিশ্র উত্তেজনা হল তার প্রথম আবেগ। মনোবিজ্ঞানীদের গবেষণায় দেখা গেছে শিশুর মধ্যে কেবল সার্বিক উত্তেজনার ভাব দেখা যায় যাকে Undifferentiated excitement বলে। অনির্দিষ্ট সাধারণ এই উত্তেজনা হচ্ছে শিশুর মৌল আবেগ প্রথম দুমাস শিশু কোনো উদ্দিপক সম্পর্কে কোনো রকম উৎসাহ দেখায় না, তার ইন্দ্রিয় থাকে অপরিপক্ক। 

প্রারম্ভিক শৈশবের আবেগিক বিকাশ 

মনোবিজ্ঞানী ক্যথারিন ব্রিজেস সদ্যেজাত থেকে দুবৎসর বয়সের শিশুদের পর্যবেক্ষন করেন। তার মতানুযায়ী প্রথম মাস পর্যন্ত শিশুর আবেগের কোনো নির্দিষ্ট রূপ থাকে না শুধু অনির্দিষ্ট একটা উত্তেজনা থাকে। দুমাস থেকে তিন মাসের মধ্যে আবেগের পৃথকীকরণ প্রক্রিয়া শুরু হয়। প্রথমে দুধরনের প্রাথমিক আবেগিক প্রকাশ স্পষ্ট লক্ষ্য করা যায়। আনন্দ (delight) আর অস্বাচ্ছদ্য (distress) প্রকাশ ঘটে পৃথকীকরণের মাধ্যমে। প্রায় ছয় মাস বয়সে আনন্দ থেকে হর্ষ আবেগের সৃিষ্ট, নয় দশ মাসে বড়দের প্রতি ভালোবাসা এবং পনের মাস বয়স থেকে সমবয়সীদের প্রতি ভালোবাসা দেখা যায়। অন্যদিকে অস্বাচ্ছন্দ্য আবেগ পরিণতি লাভ করে রাগে তিন চার মাস বয়সে। পাঁচ মাসে বিরক্তির এবং ছয় মাসের ভয়ের বিকাশ ঘটে। পনের মাস বয়সের পর শিশুর মধ্যে হিংসা দেখা দেয়। এমনি ভাবে পৃথকীকরণের মাধ্যমে আবেগের বিকাশ ঘটতে থাকে শিশুর মধ্যে। 

শিশুর প্রাথমিক আবেগিক আচরণ তার মা যিনি তাকে সারাক্ষন দেখা শোনা করে তাকে কেন্দ্র করেই বিকাশ লাভ করে থাকে। কারো মতে শিশুর প্রথম নির্দিষ্ট আবেগিক আচরণ হল পরিচিত মানুষের মুখ দেখে হাসা। পরে এই নীরব হাসি উচ্চ হাসির রূপ গ্রহন করে। 

গেনেলের একটি পর্যবেক্ষণ থেকে দেখা যায় যে ১ মাস বয়স থেকেই শিশুর ক্ষুধা, রাগ,ব্যাথা জনিত কান্নার মধ্যে পার্থক্য করা যায়।

শেষ শৈশবের আবেগিক বিকাশ 

দুবছরের পরে শিশুর আবেগের বিকাশ আরও বিশেষিত হয়। পরিবারকে ছাড়িয়ে তার স্নেহ ভালোবাস বিস্তৃত পরিবেশে ছড়িয়ে পড়ে। সঙ্গী সাথীদের প্রতি ভালোবাসা লক্ষ্য করা যায় তাছাড়া লজ্জা, ঘৃনা, ঈর্ষা ইত্যাদিরও বিকাশ ঘটে। শৈশবে শিশুর আবেগিক আচরণে দ্রুত পরিবর্তন ঘটে। একটুতেই রেগে যায়। আবার পর মুহুর্তে ভুলেও যায়। শৈশবেই প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার বস্তুকে কেন্দ্র করে শিশুর সেন্টিমেন্টের বিকাশ শুরু হয়।

শৈশবেই প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার বস্তুকে কেন্দ্র করে শিশুর সেন্টিমেন্টের বিকাশ শুরু হয়।

শৈশবে যৌন আবেগের বিকাশ 

শিশুর যৌন জীবনের বিকাশও শুরু হয়। এই যৌন বিকাশের স্তরকে ফ্রয়েড আত্নরতির স্তর বলেছেন। মায়ের দুধ খাওয়া, মলমূত্র ত্যাগ করার মধ্যে শিশু যৌন পরিতৃপ্তি লাভ করে। শৈশবের মধ্যবর্তী সময় থেকে শিশুর যৌন আকাংখা বাইরের ব্যক্তিতে স্থানান্তরিত হয়। ছেলেরা মায়ের প্রতি ও মেয়েরা বাবাদের প্রতি আকৃষ্ট হয়।

শৈশবে আবেগিক উদ্দীপকের বিকাশ ও আবেগিক আচরণের বিকাশ

জন্মের পরে প্রথম দুবছরে শিশুর প্রাথমিক চাহিদা আবেগকে নিয়ন্ত্রন করে। অর্থাৎ যে সব উদ্দীপক শিশুর চাহিদা মেটায় বা তার বাঁধা সৃষ্টি করে সেগুলো তার আবেগ সৃষ্টি করে। বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে পরিণমনের ফলে শিশুর অভিজ্ঞতা বাড়ে। এই অভিজ্ঞতা আবেগ সৃষ্টিতে সাহায্য করে। বয়স বাড়ার ফলে দৈহিক ও মানসিক ক্ষমতার বিকাশ ঘটে। তখন দৈহিক সক্রিয়তায় বাধা দিলে বা মানসিক চাহিদা পরিতৃপ্ত না হলে তার মধ্যে নানা ধরনের আবেগের সঞ্চার হয়। 

পরিণমন ও ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে ধারণা অতীত অভিজ্ঞতার স্মৃতি, কল্পনা ইত্যাদি মানসিক শক্তির বিকাশের সাথে আবেগের বিকাশ ঘটে। প্রত্যক্ষ বিষয় বস্তু থেকে আবেগ কল্পনাকে কেন্দ্র করেও সৃষ্টি হয়। পড়া না শিখে স্কুলে আসলে শিক্ষক শাস্তি দেবেন এই আশংকায় (anticipation) শিশু ভয় পায়। 

আবার দেখা যায় কিছু কিছু উদ্দীপক যা আগে আবেগ সৃষ্টি করতো এখন আর তা আবেগ সৃষ্টি করে না। যেমন শিশু অবস্থায় জোরে শব্দ শুনলেই ভয় পায় কিন্তু পরবর্তীতে দেখা যায় উচ্চ শব্দ আর ভয় জাগায় না। আবেগের বিকাশের ফলে নতুন নতুন উদ্দীপক আবেগ সৃষ্টি করে আবার কিছু কিছু পুরোনো উদ্দীপক আবেগ জাগানোর ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। আবেগমূলক আচরনের বিকাশ অনেক সময় সাপেক্ষীকরণের জন্য হয়ে থাকে। এ প্রসঙ্গে আমরা ওয়াটসনের পরীক্ষণের কথা উল্লেখ করতে পারি। ১১ মাসের শিশু আর্থারের হাতে সাদা লোমওয়ালা খেলনা কুকুরটি দিলে সে একটুও ভয় পায় না। এবার আর্থারকে সাদা লোমওয়ালা কুকুরটি দেওয়ার সময় খুব জোরে পেছন থেকে শব্দ করা হল। আর্থার কুকুরটি ধরেই ভয়ে ফেলে দিল। আর্থার যতবার কুকুরটি নিতে হাত বাড়ায় ততবারই জোরে শব্দ করা হয়। আর সেই শব্দ শুনে সে ভয় পেয়ে কেঁদে উঠে। শেষ কালে দেখা গেল শব্দ না করা হলেও শুধু কুকুরটি দেখে আর্থার ভয় পেয়ে কেদে উঠে।এমনকি সাদা দাড়িওয়ালা কাউকে দেখলেও সে কেঁদে উঠে। সাপেক্ষীকরণের সাহায্যে শব্দ থেকে ভয় কুকুরে সঞ্চালিত হয়েছে। আর সাধারীকরণের মাধ্যমে ভয় সাদা লোমওয়ালা কুকুর থেকে সাদা দাড়িওয়ালা লোকে সঞ্চালিত হয়েছে।

বয়স বাড়ার সাথে সাথে আবেগিক প্রকাশের উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটে। শিশু যত পরিণত হয় ততই তার বাহ্যিক প্রকাশের তীব্রতা কমে এবং আচরণ সংযত ও মার্জিত হয়ে উঠে। যেমন ৪/৫ বছরের শিশু রেগে গেলে চিৎকার করে কাঁদে, হাত পা ছোঁড়ে, লাফায়,৭/৮ বছরে রাগের সময় সে আর চিৎকার করে কাদে না। ঐ ভাবে হাত পা ছোড়ে না আরও বড় হলে একে বারেই কাদেঁনা তার দৈহিক প্রকাশ অনেক মার্জিত ও সংযত হয়ে উঠে।

সারাংশ

অনেক মনোবিজ্ঞানী বিশ্বাস করেন যে, জন্মের সময় থেকেই শিশুর মধ্যে আবেগ থাকে। নবজাতক শিশুর আবেগ নিয়ে অনেক মতবিরোধ তবে নবজাতকের আবেগিক আচরণ যে সাধারণধর্মী এতে কোনো মতভেদ নেই। তিন মাস বয়স থেকে আবেগের পৃথকীকরণ শুরু হয় প্রথম শৈশবে শিশু পরিবারের সদস্যদের প্রতি আবেগিক আচরণ করে। 

শেষ শৈশবে আবেগের পৃথকীকরনের জন্য আবেগের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। আশংকা, লজ্জা, ঘৃণা ইত্যাদি আবেগ দেখা দেয়। পরিবারের বাইরে অন্যান্য ব্যক্তির প্রতি আবেগিক আচরণ করতে পারে।

হক, মু. না., হোসেন, দি., আক্তার, শা. (১৯৯৭). শিশু ও শিক্ষা মনোবিজ্ঞান. বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়.

শেয়ার করুন

মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার তথ্য সংরক্ষিত রাখুন

বিশেষ শর্তসাপেক্ষে এই ওয়েবসাইটটি সামাজিক কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ কিংবা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের নিকট বিক্রি করা হবে।

আবেগ: শৈশবে আবেগিক বিকাশ কীভাবে হয় এবং এর ধাপ কী?

প্রকাশ: ০১:২৫:২৭ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ১৭ ডিসেম্বর ২০২১

শৈশবে আবেগিক বিকাশ কীভাবে হয় তা নিচে উল্লেখ করা হলো:

নবজাতকের আবেগিক বিকাশ 

মনোবিজ্ঞানীরা আবেগের বিকাশের পর্যায় সম্পর্কে এক মত নন। ব্লেয়ার (Blair)-এর মতে শিশুর জন্ম সময় থেকেই আবেগিক বিকাশের উপাদান তার মধ্যে থাকে এবং জন্ম মুহূর্তে থেকে এমনকি জন্ম পূর্ব থেকেই শিশু বিভিন্ন বিক্ষিপ্ত আবেগিক আচরণ শুরু করে। অসুবেল (Ausubel) তার ‘Theory of Problems of Child Development’ বইয়ে উল্লেখ করেছেন শিশুর জন্মের আগে যে সব মায়েরা খুব উদ্বিঘ্ন আবেগিক অবস্থায় থাকেন তাদের শিশুরা কাঁদে বেশি। এটাও বিশ্বাস করা হয় যে মায়ের এড্রিনাল গ্রন্থির ক্ষরণ শিশুর জন্মের পূর্বেই শিশুর মধ্যে আবেগের উপাদান (Emotional Equipment) সঞ্চালন করে থাকে। 

প্রাণীদের উপর চালিত গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে আবেগ বংশগতি ভিত্তিক। স্টোন (Stone) গবেষণায় প্রমান করেছেন শান্ত প্রকৃতির সাদা ইঁদুর এবং হিংস্র প্রকৃতির ধূসর ইঁদুরের সংমিশ্রণে এদের বংশধরেরা কেউ শান্ত এবং কেউ উগ্র মেজাজের হয়ে থাকে। হারলক উল্লেখ করেন নবজাতক শিশুর তিন সপ্তাহের মধ্যে প্রধান আবেগ হল পরিতৃপ্তি আর ক্লেশ। দৈহিক উত্তেজনা, ব্যাথা, ঠান্ডা বা গরম যে-কো অতৃপ্তিকর পরিবেশ শিশুকে ভীত করে। তাকে কাঁদতে শরীর মুচড়াতে দেখা যায। আবার মুখে খাবারের স্বাদ, চোষার জিনিস তার পরিতৃপ্তি আনে। 

নবজাতক শিশুর আবেগ নিয়ে অনেক মনোবিজ্ঞানী অনেক গবেষণা করেছেন। ডেকটি (Descarte) ছয়টি মৌলিক আবেগ- বিস্ময় ভালোবাসা, ঘৃনা, কামনা, আনন্দ ও দুঃখের কথা বলেছেন। ওয়াটসনের মতে শিশুর মধ্যে তিনটি আবেগ থাকে। ভয় রাগ, ভালোবাসা। ভয় জাগে জোরে আওয়াজ হলে বা উপর থেকে নিচে পড়ে গেলে। অঙ্গ সঞ্চালনে বাধা দিলে শিশুর রাগ হয় আর ভালোবাসা বা আনন্দ জাগে শিশুকে আদর করলে। শারমান (Sherman) ও ব্রিজেন, ওয়াটসনের মতের বিরোধীতা করেছেন। শারমান কয়েকটি পরীক্ষণের দ্বারা প্রমান করেন শিশুর আচরণ এতই সাধারণ ধর্মী যে, কোন আবেগের জন্য কোন আচরণটি করে তা বাইরে থেকে কখনই বোঝা যায় না।

নবজাতকের আবেগিক আচরণ যে নিতান্তই সাধারণ ধর্মী থাকে এ সিদ্ধান্ত আজকাল সকল মনোবিজ্ঞানী সমর্থন করেন। নবজাতক শিশুর মধ্যে অবিমিশ্র উত্তেজনা হল তার প্রথম আবেগ। মনোবিজ্ঞানীদের গবেষণায় দেখা গেছে শিশুর মধ্যে কেবল সার্বিক উত্তেজনার ভাব দেখা যায় যাকে Undifferentiated excitement বলে। অনির্দিষ্ট সাধারণ এই উত্তেজনা হচ্ছে শিশুর মৌল আবেগ প্রথম দুমাস শিশু কোনো উদ্দিপক সম্পর্কে কোনো রকম উৎসাহ দেখায় না, তার ইন্দ্রিয় থাকে অপরিপক্ক। 

প্রারম্ভিক শৈশবের আবেগিক বিকাশ 

মনোবিজ্ঞানী ক্যথারিন ব্রিজেস সদ্যেজাত থেকে দুবৎসর বয়সের শিশুদের পর্যবেক্ষন করেন। তার মতানুযায়ী প্রথম মাস পর্যন্ত শিশুর আবেগের কোনো নির্দিষ্ট রূপ থাকে না শুধু অনির্দিষ্ট একটা উত্তেজনা থাকে। দুমাস থেকে তিন মাসের মধ্যে আবেগের পৃথকীকরণ প্রক্রিয়া শুরু হয়। প্রথমে দুধরনের প্রাথমিক আবেগিক প্রকাশ স্পষ্ট লক্ষ্য করা যায়। আনন্দ (delight) আর অস্বাচ্ছদ্য (distress) প্রকাশ ঘটে পৃথকীকরণের মাধ্যমে। প্রায় ছয় মাস বয়সে আনন্দ থেকে হর্ষ আবেগের সৃিষ্ট, নয় দশ মাসে বড়দের প্রতি ভালোবাসা এবং পনের মাস বয়স থেকে সমবয়সীদের প্রতি ভালোবাসা দেখা যায়। অন্যদিকে অস্বাচ্ছন্দ্য আবেগ পরিণতি লাভ করে রাগে তিন চার মাস বয়সে। পাঁচ মাসে বিরক্তির এবং ছয় মাসের ভয়ের বিকাশ ঘটে। পনের মাস বয়সের পর শিশুর মধ্যে হিংসা দেখা দেয়। এমনি ভাবে পৃথকীকরণের মাধ্যমে আবেগের বিকাশ ঘটতে থাকে শিশুর মধ্যে। 

শিশুর প্রাথমিক আবেগিক আচরণ তার মা যিনি তাকে সারাক্ষন দেখা শোনা করে তাকে কেন্দ্র করেই বিকাশ লাভ করে থাকে। কারো মতে শিশুর প্রথম নির্দিষ্ট আবেগিক আচরণ হল পরিচিত মানুষের মুখ দেখে হাসা। পরে এই নীরব হাসি উচ্চ হাসির রূপ গ্রহন করে। 

গেনেলের একটি পর্যবেক্ষণ থেকে দেখা যায় যে ১ মাস বয়স থেকেই শিশুর ক্ষুধা, রাগ,ব্যাথা জনিত কান্নার মধ্যে পার্থক্য করা যায়।

শেষ শৈশবের আবেগিক বিকাশ 

দুবছরের পরে শিশুর আবেগের বিকাশ আরও বিশেষিত হয়। পরিবারকে ছাড়িয়ে তার স্নেহ ভালোবাস বিস্তৃত পরিবেশে ছড়িয়ে পড়ে। সঙ্গী সাথীদের প্রতি ভালোবাসা লক্ষ্য করা যায় তাছাড়া লজ্জা, ঘৃনা, ঈর্ষা ইত্যাদিরও বিকাশ ঘটে। শৈশবে শিশুর আবেগিক আচরণে দ্রুত পরিবর্তন ঘটে। একটুতেই রেগে যায়। আবার পর মুহুর্তে ভুলেও যায়। শৈশবেই প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার বস্তুকে কেন্দ্র করে শিশুর সেন্টিমেন্টের বিকাশ শুরু হয়।

শৈশবেই প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার বস্তুকে কেন্দ্র করে শিশুর সেন্টিমেন্টের বিকাশ শুরু হয়।

শৈশবে যৌন আবেগের বিকাশ 

শিশুর যৌন জীবনের বিকাশও শুরু হয়। এই যৌন বিকাশের স্তরকে ফ্রয়েড আত্নরতির স্তর বলেছেন। মায়ের দুধ খাওয়া, মলমূত্র ত্যাগ করার মধ্যে শিশু যৌন পরিতৃপ্তি লাভ করে। শৈশবের মধ্যবর্তী সময় থেকে শিশুর যৌন আকাংখা বাইরের ব্যক্তিতে স্থানান্তরিত হয়। ছেলেরা মায়ের প্রতি ও মেয়েরা বাবাদের প্রতি আকৃষ্ট হয়।

শৈশবে আবেগিক উদ্দীপকের বিকাশ ও আবেগিক আচরণের বিকাশ

জন্মের পরে প্রথম দুবছরে শিশুর প্রাথমিক চাহিদা আবেগকে নিয়ন্ত্রন করে। অর্থাৎ যে সব উদ্দীপক শিশুর চাহিদা মেটায় বা তার বাঁধা সৃষ্টি করে সেগুলো তার আবেগ সৃষ্টি করে। বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে পরিণমনের ফলে শিশুর অভিজ্ঞতা বাড়ে। এই অভিজ্ঞতা আবেগ সৃষ্টিতে সাহায্য করে। বয়স বাড়ার ফলে দৈহিক ও মানসিক ক্ষমতার বিকাশ ঘটে। তখন দৈহিক সক্রিয়তায় বাধা দিলে বা মানসিক চাহিদা পরিতৃপ্ত না হলে তার মধ্যে নানা ধরনের আবেগের সঞ্চার হয়। 

পরিণমন ও ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে ধারণা অতীত অভিজ্ঞতার স্মৃতি, কল্পনা ইত্যাদি মানসিক শক্তির বিকাশের সাথে আবেগের বিকাশ ঘটে। প্রত্যক্ষ বিষয় বস্তু থেকে আবেগ কল্পনাকে কেন্দ্র করেও সৃষ্টি হয়। পড়া না শিখে স্কুলে আসলে শিক্ষক শাস্তি দেবেন এই আশংকায় (anticipation) শিশু ভয় পায়। 

আবার দেখা যায় কিছু কিছু উদ্দীপক যা আগে আবেগ সৃষ্টি করতো এখন আর তা আবেগ সৃষ্টি করে না। যেমন শিশু অবস্থায় জোরে শব্দ শুনলেই ভয় পায় কিন্তু পরবর্তীতে দেখা যায় উচ্চ শব্দ আর ভয় জাগায় না। আবেগের বিকাশের ফলে নতুন নতুন উদ্দীপক আবেগ সৃষ্টি করে আবার কিছু কিছু পুরোনো উদ্দীপক আবেগ জাগানোর ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। আবেগমূলক আচরনের বিকাশ অনেক সময় সাপেক্ষীকরণের জন্য হয়ে থাকে। এ প্রসঙ্গে আমরা ওয়াটসনের পরীক্ষণের কথা উল্লেখ করতে পারি। ১১ মাসের শিশু আর্থারের হাতে সাদা লোমওয়ালা খেলনা কুকুরটি দিলে সে একটুও ভয় পায় না। এবার আর্থারকে সাদা লোমওয়ালা কুকুরটি দেওয়ার সময় খুব জোরে পেছন থেকে শব্দ করা হল। আর্থার কুকুরটি ধরেই ভয়ে ফেলে দিল। আর্থার যতবার কুকুরটি নিতে হাত বাড়ায় ততবারই জোরে শব্দ করা হয়। আর সেই শব্দ শুনে সে ভয় পেয়ে কেঁদে উঠে। শেষ কালে দেখা গেল শব্দ না করা হলেও শুধু কুকুরটি দেখে আর্থার ভয় পেয়ে কেদে উঠে।এমনকি সাদা দাড়িওয়ালা কাউকে দেখলেও সে কেঁদে উঠে। সাপেক্ষীকরণের সাহায্যে শব্দ থেকে ভয় কুকুরে সঞ্চালিত হয়েছে। আর সাধারীকরণের মাধ্যমে ভয় সাদা লোমওয়ালা কুকুর থেকে সাদা দাড়িওয়ালা লোকে সঞ্চালিত হয়েছে।

বয়স বাড়ার সাথে সাথে আবেগিক প্রকাশের উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটে। শিশু যত পরিণত হয় ততই তার বাহ্যিক প্রকাশের তীব্রতা কমে এবং আচরণ সংযত ও মার্জিত হয়ে উঠে। যেমন ৪/৫ বছরের শিশু রেগে গেলে চিৎকার করে কাঁদে, হাত পা ছোঁড়ে, লাফায়,৭/৮ বছরে রাগের সময় সে আর চিৎকার করে কাদে না। ঐ ভাবে হাত পা ছোড়ে না আরও বড় হলে একে বারেই কাদেঁনা তার দৈহিক প্রকাশ অনেক মার্জিত ও সংযত হয়ে উঠে।

সারাংশ

অনেক মনোবিজ্ঞানী বিশ্বাস করেন যে, জন্মের সময় থেকেই শিশুর মধ্যে আবেগ থাকে। নবজাতক শিশুর আবেগ নিয়ে অনেক মতবিরোধ তবে নবজাতকের আবেগিক আচরণ যে সাধারণধর্মী এতে কোনো মতভেদ নেই। তিন মাস বয়স থেকে আবেগের পৃথকীকরণ শুরু হয় প্রথম শৈশবে শিশু পরিবারের সদস্যদের প্রতি আবেগিক আচরণ করে। 

শেষ শৈশবে আবেগের পৃথকীকরনের জন্য আবেগের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। আশংকা, লজ্জা, ঘৃণা ইত্যাদি আবেগ দেখা দেয়। পরিবারের বাইরে অন্যান্য ব্যক্তির প্রতি আবেগিক আচরণ করতে পারে।

হক, মু. না., হোসেন, দি., আক্তার, শা. (১৯৯৭). শিশু ও শিক্ষা মনোবিজ্ঞান. বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়.