সুমেরীয় সভ্যতা: সুমেরীয় সভ্যতার রাষ্ট্র, সমাজ, আইন, কাঠামো, ধর্ম, সাহিত্য, লিখন পদ্ধতি এবং স্থাপত্য ও শিল্প
- প্রকাশ: ১১:৪০:১১ অপরাহ্ন, শনিবার, ৮ জানুয়ারি ২০২২
- / ৯৫৮৭ বার পড়া হয়েছে
আধুনিক ইরাকের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিস নদী। টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিস যথাক্রমে দজলা ও ফোরাত নামেও পরিচিত। এই টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিস নদীর অববাহিকায় প্রাচীনকালে কয়েকটি সভ্যতার বিকাশ ঘটেছিল; সভ্যতাগুলো একত্রে ‘মেসোপটেমীয় সভ্যতা’ নামে পরিচিত। ‘সুমেরীয় সভ্যতা’ এই মেসোপোটেমীয় সভ্যতারই অংশ। ‘মেসোপটেমিয়া’ একটি গ্রিক শব্দ-যার অর্থই হলো দুই নদীর মধ্যবর্তী দেশ। আর দুই নদী বলতে ইউফ্রেটিস ও টাইগ্রিসকেই ইঙ্গিত করা হয়েছে। মেসোপটেমীয় সভ্যতার অগ্রদূত ছিল সুমেরীয় জাতি।
এখানে যা আছে
সুমেরীয় সভ্যতা
৫০০০ খ্রিস্টপূর্বে সুমেরীয় জাতি মেসোপটেমিয়ার দক্ষিণাংশে এবং পারস্য উপকূল অঞ্চলে বসবাস শুরু করে। এরা অ-সেমিটিক জাতিগোষ্ঠি এবং মধ্য এশিয়া থেকে স্থানান্তরিত হয়ে মেসোপটেমিয়া অঞ্চলে বসতি স্থাপন করে। লিখন পদ্ধতি, জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা, আইন কানুন প্রণয়ন, ধর্মীয় অনুশাসন ইত্যাদি সুমেরীয়রাই প্রথম শুরু করে।
সুমেরীয় সভ্যতাকে ‘Fertile Crescent’ বা ‘অর্ধচন্দ্রাকৃতি উর্বর ভূমি’ বলা হয়ে থাকে। ৪০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে মিসরীয় সভ্যতার সমসাময়িক মেসোপটেমীয় সভ্যতা অনেকগুলো জাতির অবদানে গড়ে ওঠে। এ সকল জাতি গোষ্ঠীর মধ্যে সুমেরীয়, ব্যবিলনীয়, কাসাইট, অ্যাসিরীয় এবং ক্যালডীয়রা অন্যতম।
সুমেরীয় রাষ্ট্র
কয়েকটি নগরকে কেন্দ্র করে সুমেরীয়রা সভ্যতার বিকাশ ঘটিয়েছিল। সুমেরীয়রা কতকগুলি নগরের গোড়াপত্তন করেছিল। এগুলোর মধ্যে তাদের রাজধানী উর ছাড়াও সভ্যতার প্রাণ কেন্দ্র ছিল লাগাস, কিস, ইরিদু এবং উরুক অন্যতম। সুমেরীয় সভ্যতায় ধর্মীয় ও রাষ্ট্রীয় নেতাদের পদবী ছিল ‘পাতেজী’। সুমেরীয়রা প্রথম মেসোপটেমিয়া অঞ্চলে খাল খনন, জলাশয় ও বাঁধ নির্মাণ করে সেচ ব্যবস্থা গড়ে তোলে এবং নিজেদের উন্নতি ঘটিয়ে নগর সভ্যতার উদ্ভব ঘটায়। ৩৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যে প্রায় ১৮টি নগর রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়। এসব নগর রাষ্ট্রের প্রশাসকরা ‘এনসি’ নামে পরিচিত ছিলেন। বিখ্যাত শাসক সারগন সুমেরের নগর রাষ্ট্রগুলিকে একত্রিত করে সভ্যতার বিকাশ ঘটান। সুমেরিয়ায় সারগনের প্রতিষ্ঠিত আক্কাদীয় রাজ্য দুশো বছর স্থায়ী ছিল। সুমেরীয়দের পরবর্তী বিখ্যাত শাসক ছিলেন সম্রাট ‘ডুঙি’। সম্রাট ডুঙির নেতৃত্বে সুমেরীয়গণ খ্রিস্টপূর্ব ২১০০ অব্দে একটি ঐক্যবদ্ধ সাম্রাজ্য গড়ে তুলেন। ডুঙি সুমের জাতির জন্য সর্বপ্রথম একটি বিধিবদ্ধ আইন (Code) প্রচলন করেন। সুমেরীয় সমাজে শিল্প ও ব্যবসা পরিচালনায় নারীদের অধিকার দেওয়া হয়েছিল।
সুমেরীয় সমাজ
বিভিন্ন স্তরে বিভক্ত ছিল সুমেরীয় সমাজ ব্যবস্থা। প্রথমস্তরে ছিল শাসক ও ধর্মযাজক, দ্বিতীয় স্তরে সাধারণ নাগরিক এবং তৃতীয় স্তরে ছিল ক্রীতদাস সম্প্রদায়। শাসকগণ নিজেদেরকে ঈশ্বরের প্রতিনিধি দাবি করে দেশ শাসন করতেন। দাসদাসীরা শাসকদের সেবায় নিয়োজিত থাকতো। স্বাভাবিক ভাবেই দাসদাসী এবং কৃষক ছিল সমাজের সবচেয়ে সুবিধাবঞ্চিত সম্প্রদায়।
সুমেরীয়দের প্রতিশোধমূলক আইন
সাধারণভাবে সুমেরীয়দের আইনকে বলা হয় প্রতিশোধমূলক আইন। অর্থাৎ চোখের বদলে চোখ, হাতের বদলে হাত ইত্যাদি।
সুমেরীয়দের আইনের মূল বিষয় ছিল,
- প্রথমতঃ অপরাধীকে তার কৃত অপরাধের জন্য তদ্রুপ শাস্তি দেওয়া।
- দ্বিতীয়তঃ একধরনের বিচার আদালত বিদ্যমান ছিল, যেখানে বাদী বিবাদী উভয়কেই হাজির করা হতো।
- তৃতীয়তঃ ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক মর্যাদার প্রতি লক্ষ্য রাখা হতো। বিশেষ করে সামরিক বাহিনীর বিচারকার্য কঠোর ছিল। অথচ সামরিক বাহিনীতে একমাত্র অভিজাতদেরই অংশগ্রহণ করার সুযোগ ছিল।
অন্যান্য সমাজের মতো সুমেরীয় আইনও গড়ে ওঠেছিল তাদের সামাজিক বিধি ব্যবস্থার মধ্যদিয়েই। সুমেরীয়দের বিখ্যাত সম্রাট ‘ডুঙি’ প্রথম আইন সংকলন করেন।
সুমেরীদের আইন ব্যবস্থা পরবর্তী সমসাময়িক সভ্যতাগুলির উপর প্রভাব বিস্তার করে ছিল। সুমেরীয় আইনের মূল অধ্যায় ছিল-
- প্রতিশোধমূলক আইন
- আইনে অসমতা
- আকষ্মিক ও ইচ্ছাকৃত হত্যার স্বল্প পার্থক্য।
অর্থনৈতিক কাঠামো
সুমেরীয়দের অর্থনৈতিক কাঠামো ছিল সরল। মিসরের মত এখানে একটি স্বতন্ত্র বাণিজ্য দ্বার উন্মুক্ত হয়েছিল। সুমেরীয় সমাজে ভূমি দাসের অস্তিত্ব ছিল। তবে কারিগরী কাজে নিপুন শ্রমিকরা উচ্চ পারিশ্রমিক লাভ করত। সুমেরীয় অর্থনীতির মূল উৎস ছিল কৃষি। কৃষক হিসেবে এরা ছিল বেশ উঁচু স্তরের। তাদের সেচ ব্যবস্থা ছিল উন্নততর। ফসল উৎপাদনের পরিমানও ছিল বেশী। সুমেরীয়দের সাথে বিভিন্ন অঞ্চলের এক বিস্তৃত বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। সুমেরীয় ‘সীল’ দেখে অনুমান করা হয় সম্ভবত ভারতের সাথেও তাদের বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল। সুমেরীয়রা প্লাবনের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য কৃত্রিম মৃত্রিকাস্তুপের উপর শহর, গ্রাম এবং মন্দির গড়ে তোলে।
সুমেরীয় ধর্ম
অন্যান্য প্রাচীন সভ্যতার ন্যায় সুমেরীয়রা অনেক দেব দেবীতে বিশ্বাসী ছিল। তাদের এক একটি দেবতা এক একটি নামে পরিচিত ছিল। যেমন বিখ্যাত দেবতা ‘শামাশ’ (সূর্যদেবতা), ‘এনলিল’ (বৃষ্টি, বন্যা ও বায়ুর দেবতা), পানির দেবতা ‘এনকি’, প্লেগ রোগের বিশেষ দেবতা ‘নারগাল’ এবং ‘ইস্টারা’ (নারী জাতির দেবতা) নামে পরিচিত ছিলেন। তবে তাদের প্রধান দেবতা ছিল নার্গাল। সুমেরীয় সভ্যতায় মিসরীয় সভ্যতার অনেক প্রভাব থাকলেও পরকালের ধারণা বা পুর্নরুজ্জীবন (স্বর্গ-নরক) ধারণা জন্ম লাভ করেনি মিসরীয়দের মধ্যে। সম্ভবতঃ এই কারণে সুমের অঞ্চলে মৃতদেহকে কেন্দ্র করে কোন প্রকার অট্টালিকা, সমাধি বা মমির প্রবণতা দেখা যায় না। তাই তারা মৃতদেহকে কবর দিতো।
সুমেরীয় সাহিত্য
সুমেরীয়রা বিদ্যাশিক্ষায় উৎকর্ষ সাধন করতে সক্ষম হয়েছিল। এমনকি তারা কোন কোন ক্ষেত্রে প্রতিবেশী মিসরীয়দেরকেও অতিক্রম করেছিল। যেমন, সুমেরীয়রা ‘গিল গামেশ’ নামক মহাকাব্য রচনা করেছিল। ইউরুকের কিংবদন্তী রাজা গিলগামেশকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল এই বিখ্যাত ‘গলগামেশ’ নামক মহাকাব্য। ২০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে এই মহাকাব্য রচিত হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়।
সুমেরীয়দের লিখন পদ্ধতি
সুমেরীয় সভ্যতার অন্যতম কীর্তি ছিল একধরনের লিখন পদ্ধতির উদ্ভাবন। এই পদ্ধতি ছিল প্রথমতঃ চিত্রলিপি এবং পরবর্তীতে তা শব্দলিপিতে রূপান্তরিত হয়। এই লিখন পদ্ধতি ‘কিউনিফর্ম’ নামে পরিচিত। কাঁদা মাটিতে চাপ দিয়ে চিত্রাংকন দ্বারা মনের ভাব প্রকাশ করত। যা মেসোপটেমীয় লিপি হিসেবে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করে। এ সুমেরের বিখ্যাত শহর নিপ্পুরে এ কিউনিফর্ম (Cuneiform) চিত্রলিপির প্রায় চার হাজার মাটির চাকতি পাওয়া গেছে। এসকল কিউনিফর্ম বর্ণভিত্তিক নয়, বরং একে বলা যেতে পারে অক্ষরভিত্তিক বর্ণলিপি।
সুমেরীয় স্থাপত্য ও শিল্প
ধারনা করা হয় সুমেরীয়রা নগর সভ্যতায় পোড়া ইটের প্রথম ব্যবহার। তবে মিসরীয়দের মতো সুমেরীয়রা পাথরের ব্যবহার করত না বলে তাদের তৈরী ইমারত দীর্ঘস্থায়ী হতো না।
সম্ভবতঃ সুমের অঞ্চলে পাথর দুস্প্রাপ্য ছিল। তবে তাদের নগর পরিকল্পনা ছিল খুবই নিখুঁত। দালানের দেয়াল ইটের তৈরী হলেও ছাঁদ ছিল কাঠের দ্বারা তৈরী। সুমেরীয় শ্রেষ্ঠ স্থাপত্যকীর্তি ‘জিগগুরাট’ নামক ধর্মমন্দির। প্রায় প্রতি নগরেই এইরূপ জিগগুরাট নামক ধর্মমন্দির বা ইমারত তৈরী হয়েছিল। সুমেরীয়দের অন্যান্য কৃতিত্বের মধ্যে ছিল গণনা পদ্ধতি, গুণভাগ নির্ণয়, চন্দ্র ভিত্তিক বর্ষপঞ্জি তৈরী, পানি দ্বারা চালিত এক ধরনের ঘড়ি। অন্যদিকে কৃষি ছিল সুমেরীদের প্রধান জীবিকা। দ্বিতীয় পেশা হিসেবে তারা ব্যবসা বাণিজ্যের প্রচলন ঘটায়।
অল্পকথায় সুমেরীয় সভ্যতা
পশ্চিম এশিয়ায় অবস্থিত সুমেরীয় সভ্যতার সাথে আফ্রিকার মিসরীয় সভ্যতার অনেক মিল রয়েছে। নতুন পাথরের যুগ পার হয়ে ব্রোঞ্জ (তামা) যুগেই উভয় সভ্যতার সৃষ্টি হয়। এখানে তামা বা ধাতু ব্যবহারের ফলে উৎপাদন ক্ষমতা ও হাতিয়ারের ব্যবহার বৃদ্ধি পায়। মিসরীয়দের মতো সুমের অঞ্চলেও রাজা, পুরোহিত, সামরিককর্তা এরূপ বিভাজন দেখা যায়। মেসোপটেমীয় সভ্যতার বিকাশ এবং নিত্য নতুন আবিষ্কারের মূলে সুমেরীয়দের অবদানই অধিক ছিল। সুমেরীয় শ্রেষ্ঠ স্থাপত্যকীর্তি ‘জিগগুরাট’ নামক ধর্মমন্দির।