রিভিউ: চিলেকোঠার সেপাই— বিক্ষুব্ধ কালের এক মহাকাব্যিক আখ্যান
- প্রকাশ: ১২:৩৩:৩৩ অপরাহ্ন, সোমবার, ১০ জানুয়ারি ২০২২
- / ৫০০৬ বার পড়া হয়েছে
বাংলা সাহিত্যে বিরলপ্রজ ঔপন্যাসিক আখতারুজ্জামান ইলিয়াস। ‘চিলেকোঠার সেপাই’ এবং ‘খোয়াবনামা’ এই দুটি উপন্যাস, একটি প্রবন্ধ গ্রন্থ আর হাতেগোনা কয়েকটি ছোটোগল্প লিখেই বাংলা সাহিত্য জগতে নিজেকে এক অনন্য আসনে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছেন। বহুলপঠিত ‘চিলেকোঠার সেপাই’ আখতারুজ্জামান ইলিয়াস রচিত প্রথম উপন্যাস। ‘চিলেকোঠার সেপাই’ ১৯৮৬ সালে প্রথম পুস্তক আকারে প্রকাশিত হয়।
‘চিলেকোঠার সেপাই’ ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপটে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস রচিত একটি মহাকাব্যিক উপন্যাস। কোনো বাড়ির চিলেকোঠায় বাস করেও স্বাধীনতার লক্ষ্যে গড়ে ওঠা বৃহত্তর আন্দোলনের জোয়ারে একজন সাধারণ মানুষের মিলতে সক্ষম হওয়ার গল্প এটি। একটি বিশেষ সময়ে জনজীবনের সমগ্রতাকে, বিশেষ করে গ্রাম ও শহরের প্রতিটি কোণের মানুষকে লেখক এই উপন্যাসে অত্যন্ত সুচারুভাবে উপস্থাপন করতে সক্ষম হয়েছেন। এই উপন্যাসের অন্যতম বৈশিষ্ট্য এর মনোবিশ্লেষণ।
উপন্যাসটির অভিনব কাঠামো এবং নতুন ভাষাভঙ্গি পরবর্তী প্রজন্মের নতুন লেখকদের বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত ও প্রভাবান্বিত করে। ঊনসত্তর সালের প্রবল গণঅভ্যুত্থানের যারা প্রধান শক্তি ছিল, সেই শ্রমজীবী জনসাধারণ কীভাবে আন্দোলন-পরবর্তী সময়টিতে প্রতারিত এবং বঞ্চিত হল, বামপন্থীদের দোদুল্যমানতা আর ভাঙনের ফলে, জাতীয় মুক্তির আকাঙ্ক্ষাকে যথাযথভাবে ধারণ করতে না পারার ফলে অজস্র রক্তপাতের পরও রাজনীতির ময়দান থেকে তাদের পশ্চাদপসরণ ঘটলো, আওয়ামী লিগ প্রধান শক্তি হয়ে উঠলো, উপন্যাসটির উপজীব্য সেই ঐতিহাসিক সময়টুকুই।
আপাতদৃষ্টিতে ওসমান ‘চিলেকোঠার সেপাই’ উপন্যাসের প্রধান চরিত্র, যে একজন ছোটোখাট সরকারি চাকুরে। অন্যদিক থেকে চিন্তা করলে এই ‘চিলেকোঠার সেপাই’ উপন্যাসের প্রধান চরিত্র বলা যায় হাডডি খিজির, যে কিনা ওসমানের বাড়িওয়ালার ভাগনের গ্যারেজ দেখাশোনা করে। এই দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন মাত্রা ও স্তরের চরিত্রই উপন্যাসটিকে টেনে নিয়ে গেছে ঊনসত্তরের উত্তাল সময়ের ভেতর দিয়ে।
আরেকটি গুরুত্ববহ চরিত্র আনোয়ার, যে মূলতঃ একজন বামপন্থী কর্মী। ঊনসত্তরের এই টালমাটাল বিক্ষুব্ধ সময়েই সে ঘটনাক্রমে যায় তার গ্রামের বাড়িতে, যেখানে যে চাক্ষুষ করে জনৈক গ্রাম্য জোতদার খয়বার গাজীর শোষণ ও অত্যাচার এবং সেটিকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট তীব্র জনরোষ। উপন্যাসের কাহিনীকে পূর্ণতা দিতেই উঠে আসে দরিদ্র যুবক চেংটু কিংবা করমালি, যারা খয়বার গাজীর বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়াবার ধৃষ্টতা দেখায়। অন্যদিকে, স্বাভাবিক নিয়মেই গতি পায় ওসমানের অবদমিত কামনা, রেস্তোরাঁর আড্ডায় চায়ের কাপে তুমুল ঝড়, হাডডি খিজির ও তার পারিপার্শ্বিক নিম্নবিত্ত চরিত্রগুলোর চিরাচরিত জীবনযাপন, আর এই সবকিছুই ছাপিয়ে উপন্যাসটি হয়ে ওঠে ওই বিক্ষুব্ধ কালের এক মহাকাব্যিক আখ্যান।
মধ্যবিত্ত শ্রেণির ব্যক্তি-সর্বস্ব আত্মপ্রেম চেতনাপ্রবাহ গণ-আন্দোলনের টানে কিভাবে চিলকোঠার বিচ্ছিন্ন জগৎ থেকে বেরিয়ে আসে, এই উপন্যাসের অন্যতম চরিত্র ওসমান গনি তার দৃষ্টান্ত। এ উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র ওসমান গণি ওরফে রঞ্জু দেশবিভাগের কারণে উদ্বাস্তু হয়ে ঢাকায় আসে। ওসমানের বাবা থেকে যান ভারতে, বাবা বেঁচে আছে কি না তা-ও জানে না সে। পুরাতন ঢাকার এক চিলেকোঠার ভাড়াটে বাসিন্দা। সে রাজনীতিসচেতন হলেও আত্মমগ্ন! পাকিস্তানি শাসকদের শোষণের বিরুদ্ধে ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানে তখন শহর, নগর, বন্দর, গঞ্জ, নিভৃত গ্রাম, এমনকী যমুনার দুর্গম চর এলাকা কেঁপে কেঁপে উঠছে। নিত্যদিন মিটিং, মিছিল, গণআদালত, কার্ফু ভাঙা—ক্ষোভ ও বিদ্রোহে সব স্থানের মানুষ তখন মুক্তির লক্ষ্যে উন্মত্ত। ওসমান গণি সবকিছু দেখে, শোনে, মিছিল-মিটিংয়েও যায়। কিন্তু কোনো কিছুতেই সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করতে পারে না। বিচ্ছিন্নতা ও আত্মপ্রেমের চিলেকোঠার চার দেয়ালে আবদ্ধ থেকে তার দিন কাটে।
লেখক আখতারুজ্জামান ইলিয়াস ‘চিলেকোঠার সেপাই’ উপন্যাসে মূলতঃ একটি বিশেষ সময়ের সব ধরনের মানুষকে এক ফ্রেমে আবদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছেন। লেখকের অসামান্য পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা ও বর্ণনা-নৈপুণ্যে শহরের আধুনিক উচ্চবিত্ত বুদ্ধিজীবীর পাশাপাশি বস্তির খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষের চোখে একটি গণআন্দোলনের প্রকৃত রূপটি পাঠকের সামনে উন্মোচিত হয়েছে। ঊনসত্তর যে স্বাধীনতা আন্দোলনকে চূড়ান্ত রূপ দেয় এবং এই ঊনসত্তরই যে হাজার বছরের বাংলার শোষণ মুক্তির হাতিয়ার, তা লেখক ওসমানের চিন্তায় এবং চোখে দেখিয়েছেন। লেখকের লেখনীতে-
‘‘…সব রাস্তায় আগুন জ্বলছিল, নবাবপুরে আগুন, নিমতলীতেও আগুন। ফায়ার ব্রিগেডের বড় বড় গাড়ি থেকে বড়ো পাইপ দিয়ে জলধারা পড়ে রাস্তাঘাট ভেসে যাচ্ছে, আগুনের শিখা নিচে নামে না। দেখতে দেখতে সেই জলধারা পরিণত হয় নদীতে।
সদরঘাট থেকে জনসন রোড, নবাবপুর থেকে নিমতলী পেরিয়ে মেডিকেল কলেজের সামনে দিয়ে স্যাভেজ রোড দিয়ে বুড়িগঙ্গা ছুটে চলেছে শাহবাগ অ্যাভিন্যুতে। সেখান থেকে নদী ছোটোে এয়ারপোর্টের দিকে। তার শাখা-প্রশাখা ছড়িয়ে যায় নীলখেতে, নিউ মার্কেটের সামনে দিয়ে মিরপুর রোডে। নদীর ঢেউ এসে লাগে ধানমণ্ডির এ-রাস্তায় সে-রাস্তায়। তবে আগুনকে এতটুকু দমাতে পারে না।
…ওসমান ঠিকই টের পায় নদী এসেছে আগুনকে উস্কে দেবার জন্য। আগুনকে কদমবুশি করতে করতে নদী এগিয়ে যায়। একসময় সংগ্রাম মিছিল রক্তপাত পুলিশের গুলিতে মৃত্যুতে শিহরিত হয়ে প্রবল আকর্ষণে মনোজগৎ থেকে বাস্তবতায় ফিরে আসে। একসময় রাজনীতি তার কাছে মনে হতো বুদ্ধিবিলাস। কিন্তু এক অস্ফুট চেতনা বীজ থেকে তার ভেতরে জন্ম নেয় সংগ্রামী ভাবনা!
ওসমান ভাবতে থাকে…… বাংলা বাজার, তাঁতি বাজারের মানুষ লুপ্ত-খালের হিম হৃদপিণ্ড থেকে উঠে এসেছে? ঐ তো ইব্রাহীম খাঁর আমলে শাহজাদা খসরুর সঙ্গে সংঘর্ষে নিহত পাগড়ি পরা সেপাইরা। শায়েস্তা খাঁর টাকায় আট মণ চালের আমলে না খেয়ে মরা মানুষ দেখে ওসমান আঁতকে ওঠে। ৩০০ বছর ধরে তাদের খাওয়া নাই, কেউ চুলের তরঙ্গ উড়িয়ে তারা এগিয়ে চলে পায়ে পায়ে।
মোগলের হাতে মার খাওয়া, মগের হাতে মার খাওয়া, কোম্পানির বেনেদের হাতে মার খাওয়া- সব মানুষ না এলে মিছিল কি এত বড় হয়?’’
চিলেকোঠার চার দেয়াল থেকে মুক্তির প্রচেষ্টা অবশেষে ওসমানকে উন্মত্ত করে তোলে। পরিচিতরা বদ্ধ পাগল হিসেবে চিহ্নিত করে তাকে আটকে রাখে তার নিজের ঘরে। মুক্তি আকাঙ্ক্ষী ওসমানের কাছে মনে হয়,
… মহল্লার গলি, উপগলি, শাখাগলি থেকে আরো সব লোক এসে জুটেছে খিজিরের সঙ্গে। এত লোক কোত্থেকে আসে? পাড়ায় কি এত মানুষ আছে?
হ্যাঁ, এবার ওসমান ঠিক ধরতে পেরেছে। মহল্লার জ্যান্ত মানুষের সঙ্গে যোগ দিচ্ছে ১০০ বছর আগে সায়েবদের হাতে নিহত, সায়েবদের পোষা কুকুর নবাবদের হাতে নিহত মিরাটের সেপাই, বেরিলির সেপাই, লক্ষ্ণৌ-এর মানুষ, ঘোড়া ঘাটের মানুষ, লালবাগের মানুষ। গা একটু ছম ছম করলেও ওসমান সামলে নেয়। না, তার ভয় কী?
অবশেষে সেই বিচ্ছিন্ন ঘর থেকে তাকে বেরিয়ে পড়তে প্ররোচনা দেয় গণঅভ্যুত্থানের সদস্য হওয়ার অপরাধে মধ্যরাতে কার্ফু চাপা রাস্তায় মিলিটারির হাতে প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত হাড্ডি খিজির। সমাজের তথাকথিত নিম্নস্তরের সামান্য একজন শ্রমিকই ওসমানের মুক্তি আকাঙ্ক্ষী সত্তাকে জাগিয়ে তোলে।
ওসমানকে আটকে রাখার জন্য বন্ধুদের সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যায়। নিহত খিজিরের আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে সে ঘরের তালা ভেঙে সবার অগোচরে রাস্তায় বেরিয়ে আসে। চিলেকোঠার বন্ধন থেকে মুক্তি পেয়ে ওসমানের সামনে অজস্র পথ খুলে যায়। নিজের সামনে-পেছনে-ডানে-বাঁয়ে সব পথকেই তখন তার আপন মনে হয়। মূলত, চিলেকোঠার চার দেয়ালের বন্ধন থেকে মুক্ত হওয়ার সাথে সাথে বিচ্ছিন্নতা ও আত্মপ্রেমের বন্ধন থেকেও তার মুক্তি ঘটে। বৃহত্তর গণআন্দোলনের জোয়ারে অবশেষে ওসমান একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে মিশে যেতে সক্ষম হয়।
‘চিলেকোঠার সেপাই’ উপন্যাসের রহমত উল্লাহ ও খয়বর গাজী চরিত্রগুলি পাকিস্তানি শাসক-চক্রের সেবায় অনুগত দাস। তারা বর্গাচাষীদের নির্মমভাবে শোষণ করে। তাদের নির্দেশে গ্রামাঞ্চলে বর্গাচাষীদের গরু চুরি করে জমা করা হয় চরের এক গোপন আস্তানায়। গ্রামের মানুষ একসময় আলী বক্সের নেতৃত্বে পুড়িয়ে দেয় খয়বর গাজীর-স্ট্যান্ডল হোসেন আলীর আস্তানা। বিপ্লবী কর্মী আলী বক্সের শিষ্য হলো চেংটু। গ্রামের মানুষ সবাই একত্র হয়ে খয়বর গাজীকে শাস্তি দেওয়ার জন্য বৈরাগীর ভিটা পরিষ্কার করে। খয়বর গাজী নামায পড়ার জন্য সময় চায়। এক সময় আওয়ামী লিগের মিছিলে এসে সব এলোমেলো করে দেয়। খয়বর গাজী পালিয়ে এক নেতার আশ্রয়ে চলে যায়। শহুরে রাজনীতির হাওয়া লেগে পাল্টে যায় গ্রামীণ আবহ।
আখতারুজ্জামান ইলিয়াস মহাকবির মতো ছোটো ছোটো কাহিনিপর্বকে সুন্দর সম্মিলনের মাধ্যমে এ উপন্যাসে একটি মহাকাব্যিক রূপ দিয়েছেন। শহরের বস্তি থেকে শুরু করে যমুনার দুর্গম চর এলাকা পর্যন্ত উপন্যাসটি বিসতৃ হয়েছে। লেখকের অতি সূক্ষ্ম এবং নিবিড় পর্যবেক্ষণ শক্তিতে উপন্যাসের শব্দে শব্দে একটি আলাদা দ্যোতনা সৃষ্টি হয়েছে। লেখকের অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন লেখায় একেকটি চরিত্রের বাস্তবতা, পরাবাস্তবতা, ঘটনার সাথে চরিত্রের বাস্তবতা, কল্পনা, চেতনা অন্তঃচেতনার মিশ্রণে প্রতিটি পৃষ্ঠায় পাঠক নতুন দৃষ্টিতে জীবনকে আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছে। ‘চিলেকোঠার সেপাই’ উপন্যাসের কাহিনিবিন্যাসই পাঠককে শেষ পর্যন্ত টেনে নিয়ে যায়।
ঊনসত্তরের প্রবল গণআন্দোলনের প্রভাবে জাতীয় মুক্তির সম্ভাবনার পথ উন্মুক্ত হলেও সাধারণ মানুষের জীবনযাপনের মানের কোন পরিবর্তন হয়নি। ক্রান্তদর্শী ঔপন্যাসিক আখতারুজ্জামান ইলিয়াস নিরাসক্ত দৃষ্টিতে রাজনীতির যে অন্তঃস্বরূপ তুলে ধরেছিলেন, বর্তমান সময় কালের রাজনীতির ক্ষেত্রেও যে সেই দৃষ্টিভঙ্গির খুব বেশি পরিবর্তন ঘটেনি, তা বলাই বাহুল্য।