১১:৪২ অপরাহ্ন, রবিবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
                       

শিক্ষার ইতিহাস: উডের ডেসপ্যাচ এবং উডের ডেসপ্যাচের সুপারিশ ও গুরুত্ব কী কী?

আহমেদ মিন্টো
  • প্রকাশ: ০৫:৩৭:০৪ অপরাহ্ন, রবিবার, ১৬ জানুয়ারি ২০২২
  • / ৪৬৯২০ বার পড়া হয়েছে

স্যার চার্লস উড


Google News
বিশ্লেষণ-এর সর্বশেষ নিবন্ধ পড়তে গুগল নিউজে যোগ দিন

বিশেষ শর্তসাপেক্ষে এবং স্বল্পমূল্যে এই ওয়েবসাইটটি সামাজিক কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ কিংবা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের নিকট বিক্রি করা হবে।

ভারতীয় উপমহাদেশে এখন পর্যন্ত যতগুলো শিক্ষানীতি বা শিক্ষাপ্রস্তাব গ্রহণ করা হয়েছে সেগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো ‘উডের শিক্ষা প্রস্তাব’ বা ‘উডের ডেসপ্যাচ’। এখানে এই ‘উডের ডেসপ্যাচ’ আসলে কী এবং এর সুপারিশমালা সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো।

উডের ডেসপ্যাচ কী (What is Wood’s Despatch)

ভারতীয় উপমহাদেশে ইংরেজি শিক্ষা, ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষা এবং নারীশিক্ষা প্রসার ও উন্নয়নের জন্য ১৮৫৪ সালে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কর্তৃক গঠিত বাের্ড অব কন্ট্রোল-এর স্যার চার্লস উড একটি শিক্ষাপ্রস্তাব প্রণয়ন করেন ও তা সরকারের কাছে উপস্থাপন করেন; চার্লস উডের নাম অনুসারে এই শিক্ষা প্রস্তাবকে বলা হয় ‘উডের শিক্ষাপ্রস্তাব’ বা ‘উডের ডেসপ্যাচ’। উডের ডেসপ্যাচের মূল বক্তব্য ছিল পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার ঘটানো এবং মূল লক্ষ্য ছিল ভারতে ইংরেজি ও নারী শিক্ষার উন্নয়ন। উডের ডেসপ্যাচ রচনায় সদস্য ছিলেন মাত্র ১ জন,অর্থাৎ চার্লস উড নিজেই।

উডের ডেসপ্যাচকে বলা হয় ভারতীয় শিক্ষার ‘ম্যাগনাকার্টা’ বা ‘শিক্ষা অধিকার সনদ’। উডের ডেসপ্যাচ ১৮৫৪ সালে তৎকালীন গভর্নর জেনারেল অব ব্রিটিশ ইন্ডিয়া, লর্ড ডালহৌসির (Lord Dalhousie) কাছে উপস্থাপন করা হয়।

উডের ডেসপ্যাচ গৃহীত হয় ১৮৫৪ সালের ১৯ জুলাই। এই শিক্ষাপ্রস্তাবে চার্লস উড ভারতীয় উপমহাদেশে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষার সুষ্ঠু বিকাশের লক্ষ্যে এক পরিকল্পনা গ্রহণ করেন।

১৮৫৪ সালে প্রণীত ও গৃহীত হওয়া উডের ডেসপ্যাচ (Wood’s despatch) ভারতের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ, এই বিষযে কোনো সন্দেহ নেই; কারণ পরবর্তীকালে ভারতের শিক্ষা ক্ষেত্রে তথা শিক্ষা প্রশাসন ও ব্যবস্থানায় যত পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করা হয়েছে সবকিছুর মূলে উডের ডেসপ্যাচের কিছু না কিছু প্রভাব পরিলক্ষিত হয়।

ভারতীয় উপমহাদেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাপ্রস্তাব বা শিক্ষানীতি বলে অভিহিত উডের ডেসপ্যাচের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো এটি শিক্ষার ‘নিম্নগামী পরিস্রবণ নীতি’ ত্যাগ করে সাধারণ নাগরিকদের মধ্যে শিক্ষা বিস্তারের দায়িত্ব স্বীকার করে নেয়। সুতরাং, এখানে উল্লেখ করা যায় যে, স্বাধীন ভারত, পাকিস্তান আমলের পূর্ব পাকস্তান বা পূর্ব বাংলা এবং বর্তমান স্বাধীন বাংলাদেশে যে শিক্ষা ব্যবস্থা চলে আসছে তার ভিত্তি রচিত হয়েছিল ইতিহাস প্রসিদ্ধ এই শিক্ষা সংক্রান্ত দলিল উডের ডেসপ্যাচে’। 

উডের ডেসপ্যাচ যে সকল সুপারিশ করেছিল সেসবের মধ্যে বেশ কিছু হলো-

  • পৃথক শিক্ষা বিভাগ গঠন
  • বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা
  • মাতৃভাষায় শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা
  • জনশিক্ষা ব্যবস্থা
  • গ্রান্ট-ইন-এইড প্রথার প্রবর্তন
  • শিক্ষক-প্রশিক্ষণ
  • বৃত্তিমূলক শিক্ষা
  • নারী শিক্ষা ইত্যাদি

উডের ডেসপ্যাচ উপর্যুক্ত বিষয়গুলোতে গুরুত্ব প্রদানপূর্বক শিক্ষা প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনার উপর সুপারিশ পেশ করেছিল।

উডের ডেসপ্যাচের সুপারিশ

চার্লস উডের ডেসপ্যাচ এ দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ এর সুপারিশের জন্য। নিচে উডের ডেসপ্যাচের সুপারিশমালা সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেওয়া হলো—

পৃথক শিক্ষা বিভাগ ও জনশিক্ষা অধিকর্তা

উডের শিক্ষাপ্রস্তাব বা উডের ডেসপ্যাচের গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশগুলোর মধ্যে প্রধান হলো শিক্ষা প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনা সম্পর্কিত সুপারিশটি। উডের ডেসপ্যাচের  পরিকল্পনার প্রথমাংশে ছিল পৃথক শিক্ষা বিভাগের কথা।

তখন ভারতবর্ষে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি অধিকৃত স্থান ৫ টি প্রদেশে বিভক্ত ছিল। এগুলো হলো-

  1. বাংলা
  2. মাদ্রাজ
  3. বোম্বে
  4. উত্তর-পশ্চিম প্রদেশ
  5. পাঞ্জাব

তৎকালীন ভারতবর্ষের এই পাঁচ প্রদেশে ছিল প্রাদেশিক শিক্ষা বোর্ড এবং কাউন্সিল অব এডুকেশন। প্রতিটি প্রদেশে শিক্ষার দায়িত্ব কয়েকজন মনোনীত সদস্য নিয়ে গঠিত পরিষদের (Council) উপর ন্যস্ত ছিল, ফলে দেশের শিক্ষাপ্রশাসনে কোন সংহতি ছিলনা। তাই নতুন পরিকল্পনায় সমস্ত প্রদেশ থেকে শিক্ষা বোর্ড বা কাউন্সিল তুলে দিয়ে প্রত্যেকটি প্রদেশের জন্য পৃথক শিক্ষা বিভাগ (Department of Public Instruction) গঠন করার সুপারিশ করা হয়। উডের ডেসপ্যাচে বলা হয় প্রতিটি বিভাগ পরিচালিত হবে একেকজন জনশিক্ষা অধিকর্তার (Director of Public Instruction) কর্তৃক; এবং জনশিক্ষা অধিকর্তার  অধীনে থাকবে যথেষ্ট সংখ্যক দক্ষ স্কুল ও কলেজ পরিদর্শক (Inspectors of Schools and Colleges)।

পরিদর্শকগণ পতিষ্ঠান পরিচালনা, ব্যবস্থাপনা, শিক্ষাদান সম্পর্কে যথাযথ পরামর্শ দান করবেন এবং শিক্ষার সামগ্রিক উন্নয়ন সম্পর্কে সরকারের কাছে বার্ষিক রিপোর্ট দাখিল করবেন। এই ব্যবস্থায় শিক্ষা প্রশাসনে কেন্দ্রীয়করণের নীতি প্রবর্তিত হয়।

বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা

ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে ভারতে উচ্চ শিক্ষা পরিবেশন ও পরিচালনার জন্য কোনো বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়নি। তাই উডের ডেসপ্যাচের দ্বিতীয় মূল্যবান প্রস্তাব ছিল ভারতে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন। কাউন্সিল অব এডুকেশন (Council of Education) ১৮৪৫ সালে সর্বপ্রথম ভারতে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের প্রস্তাব করেছিল, কিন্তু সেই প্রস্তাব তখন অগ্রাহ্য করা হয়। তাই উডের ডেসপ্যাচে প্রস্তাব করা হয় যে, ভারতবর্ষে কলকাতা, বোম্বে, ও মাদ্রাজের স্থানে যেখানে যেখানে যথেষ্ট সংখ্যক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আছে সেখানে সেখানে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় (University of London)-এর অনুকরণে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হবে।

বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা পর্ষদ ও কার্যাবলি 

সরকার মনোনীত একজন আচার্য, একজন উপাচার্য এবং কয়েকজন ফেলো দিয়ে এই সব বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি সিনেট গঠিত হবে। পরীক্ষা গ্রহণ ও উপাধি প্রদান হবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রধান কাজ। উডের ডেসপ্যাচে অবশ্য আইন-শাস্ত্র, ইঞ্জিনিয়ারিং, সংস্কৃত চর্চা ইত্যাদি প্রয়োজনীয় বিষয়গুলোতে বিশেষ বক্তৃতাবলির বন্দোবস্ত করা এবং প্রয়োজনমত বিশেষ উপাধিদানের কথাও উল্লেখ করা হয়েছিল। কাগজে কলমে পরীক্ষা গ্রহণ ছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অধ্যাপনার আয়োজন করার জন্য পরোক্ষ নির্দেশ উক্ত ডেসপ্যাচে ছিল। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ভারতবর্ষে প্রথম যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো স্থাপিত হয় সেগুলোতে অধ্যাপনার বিশেষ কোনো ব্যবস্থা করা হয়নি। সেগুলো সম্পূর্ণ অনুমোদন ধর্মীই ছিল এবং প্রকৃত অধ্যাপনার দায়িত্ব সরকারি কলেজগুলোর উপর ন্যস্ত করা হয়েছিল।

প্রাথমিক শিক্ষা থেকে উচ্চশিক্ষার বিস্তার

শিক্ষা বিভাগ এবং বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের পরিকল্পনার পর উডের শিক্ষাপ্রস্তাবের তৃতীয় স্তরে ছিল ভারতের সর্বত্র প্রাথমিক থেকে উচ্চ শিক্ষার জাল বিস্তারের পরিকল্পনা। এই শিক্ষা স্তরের উপরে থাকবে বিশ্ববিদ্যালয় স্তরের শিক্ষা। এ শিক্ষা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক অনুমোদিত কলেজগুলোর মাধ্যমে প্রসারিত হবে। উচ্চ শিক্ষা স্তরের নিচের দিকে থাকবে মাধ্যমিক শিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলো। আর সকলে নিচের দিকে থাকবে প্রাথমিক বা দেশজ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। প্রাথমিক থেকে উচ্চ স্তর পর্যন্ত মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষা বিস্তার করা হবে।

জনশিক্ষা পরিকল্পনা

ভারতে ব্রিটিশ সরকারের নিম্নগামী পরিস্রবন নীতির ফলে শিক্ষার খাতে বরাদ্দ টাকার অধিকাংশই কলেজ স্থাপনার জন্য ব্যয় করা হতো; যে মারণে মাধ্যমিক শিক্ষা ভীষণভাবে অবহেলিত হয়েছিল। প্রচুর সরকারি অর্থ ব্যয় করে এতদিন কলেজ শিক্ষার মাধ্যমে যে উচ্চশিক্ষা দিয়ে আসা হয়েছে তাতে সমাজের উচ্চস্তর থেকে আগত মুষ্টিমেয় ছাত্র উপকৃত হয়েছে। তাই উডের ডেসপ্যাচে সুপারিশ করা হয় যে, মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বৃদ্ধি করা হোক যাতে সমাজের সকল স্তরের ছেলেমেয়োরা শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ পায়। 

উডের ডেসপ্যাচে ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদানের কথা বলা হলেও মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের স্বপক্ষেও সুস্পষ্ট নির্দেশনা দেওয়া হয়। 

উডের ডেসপ্যাচের জনশিক্ষা পরিকল্পনার তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, এগুলো হলো—

  1. নিম্নগামী পরিস্রাবণ মতবাদের বর্জন
  2. মাধ্যমিক স্তরে ভারতীয় ভাষাকে শিক্ষার মাধ্যমরূপে গ্রহণ
  3. ভারতের জাতীয় শিক্ষা পরিকল্পনায় দেশীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিকে স্বীকৃতি দান। 

সরকারি অনুদান শিক্ষা ব্যবস্থার পুনর্গঠনের উপর্যুক্ত পরিকল্পনাকে বাস্তবায়িত করতে প্রচুর অর্থের প্রয়োজন 

থাকলেও ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সরকার এককভাবে ভারতের শিক্ষার সম্পূর্ণ দায়িত্ব পালন করার পক্ষপাতি ছিল না। তাই চার্লস উড তাঁর ডেসপ্যাচে ‘ভারতীয় জনসাধারণের উপরই শিক্ষার অধিকাংশ দায়িত্ব অর্পণ করে সরকার নিজে কিছু অনুদান প্রদানপূর্বক আংশিক দায়িত্ব পালন করবে’ এমন সুপারিশ করেন। এই নীতি গ্রহণের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল যাতে দেশের জনসাধারণ শিক্ষা বিস্তারে উদ্যোগী হয়ে অধিক গ্রহণের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল যাতে দেশের জনসাধারণ শিক্ষা বিস্তারে উদ্যোগী হয়ে অধিক সংখ্যায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করে শিক্ষার দ্রুত প্রসারে সহযোগিতা করতে পারে।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহের আর্থিক সমস্যার সমাধানকল্পে উডের ডেসপ্যাচ অনুদান প্রদানের সুপারিশ করে, তবে সরকারি অনুদান পাবার জন্য সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যোগ্য হবে না।

সরকারি অনুদান পাওয়ার জন্য কিছু শর্ত জুড়ে দেওয়া হয় উডের ডেসপ্যাচে। যেসব শর্ত পূরণ করলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অনুদানের যোগ্য বলে বিবেচিত হবে যেসব হলো

  • ধর্মনিরপেক্ষভাবে সুষ্ঠু শিক্ষাব্যবস্থা পরিচালনা করবে, অবশ্য যদি কোথাও ধর্মীয় শিক্ষা দেওয়া হয় তা উপেক্ষা করা হবে;
  • স্থানীয় পরিচালনার ব্যবস্থা থাকবে;
  • সরকারি পরিদর্শনের অধিকার স্বীকার করবে ও পরিদর্শকের নির্দেশ মেনে চলবে;
  • শিক্ষার্থীদের (অভিভাবকদের) কাছ থেকে সামান্য বেতন নিবে।

সরকারি অনুদান বা গ্রান্ট ইন এইড (Grant in Aid) প্রথায় দেশের সকল শ্রেণির শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কম-বেশি উপকৃত হয়েছিল। তবে মিশনারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোই সবচেয়ে বেশি উপকৃত হয়েছিল।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সরকারের অনুদান মোটামুটি তিন শ্রেণিতে বিভক্ত ছিল: 

  1. শিক্ষকরা যাতে বেতন পান সেজন্য তার কিছু অংশ সাহায্যরূপে দান (Salary Grant)
  2. নির্দিষ্টকালের জন্য নির্দিষ্ট হারে সাহায্য দান (Fixed period Grant)
  3. পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে দান (Payment by Result)

শিক্ষক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা

সার্থক শিক্ষাদানের জন্য যথেষ্ট যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষকের একান্ত অভাব সম্বন্ধেও চার্লস উডের ডেসপ্যাচে গুরুত্বের সাথে উল্লেখ করা হয়। সার্থক শিক্ষাদানের উপযোগী শিক্ষক প্রস্তুত করার জন্য উডের ডেসপ্যাচে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের জন্য একটি নতুন পরিকল্পনা দেওয়া হয়েছিল।

শিক্ষকদেরকে উপযুক্ত প্রশিক্ষণ প্রদান করে দক্ষতা বৃদ্ধির পাঁচ প্রদেশে বিভিন্ন ধরনের ‘নর্মাল স্কুল’ প্রতিষ্ঠার সুপারিশ করা হয়। পাশাপাশি শিক্ষক প্রশিক্ষণার্থীদের বৃত্তির ব্যবস্থার নির্দেশনা দেওয়া হয়। ডেসপ্যাচ অনুযায়ী প্রশিক্ষণ শেষে সনদ প্রদান এবং চাকুরীতে নিয়োগদানের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। উল্লেখ্য, উডের ডেসপ্যাচ বাস্তবায়ন ধারাবাহিকতায় ১৯০৬ সালের ৬ জানুয়ারি প্রতিষ্ঠিত হয় ঢাকা টিচার্স ট্রেনিং কলেজ। (পড়ুন— টিচার্স ট্রেনিং কলেজ, ঢাকা)

বৃত্তিমূলক শিক্ষা ব্যবস্থা

বৃত্তিমূলক শিক্ষার প্রতি উডের ডেসপ্যাচে বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করা হয়। বৃত্তিমূলক শিক্ষার জন্য পৃথক ব্যবস্থার সুপারিশ করা হয় ডেসপ্যাচে। আইন, চিকিৎসা, কারিগরি বিদ্যা প্রভৃতি শিক্ষার জন্য পৃথক পৃথক কলেজ স্থাপনের সুপারিশ করে। বলা হয়েছিল যে, যে কলেজগুলো বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক পরিচালিত হবে। 

নারী শিক্ষা বিস্তারে গুরুত্বারোপ

উপযুক্ত ব্যবস্থার অভাবে ভারতবর্ষের নারী শিক্ষা অনেক পিছিয়ে রয়েছে যা জনশিক্ষার প্রত্যাশিত ফলাফল প্রাপ্তির অন্তরায়। ঠিক রি উপলব্ধি থেকে উডের ডেসপ্যাচ ভারতে অধিকসংখ্যক নারী বিদ্যায়তন প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা নেয় এবং অনুদান প্রথার মাধ্যমে নারী শিক্ষা বিস্তারের ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও বলা হয়।

এক নজরে উডের ডেসপ্যাচের গুরুত্ব

১৮৫৪ সালে প্রকাশিত উডের ডেসপ্যাচ কেন গুরুত্বপূর্ণ তা উপরে উল্লিখিত সুপারিশমালার সংক্ষিপ্ত আলোচনা থেকে বোঝার কথা। তবে পাঠকদের বোঝা সহজতর করার জন্য এখানে বুলেট পয়েন্টে উল্লেখ করা হলো যে, কেন উডের ডেসপ্যাচ গুরুত্বপূর্ণ।

  • সর্বস্তরের মানুষকে শিক্ষা প্রদানের সুপারিশ
  • কলকাতা, বোম্বে ও মাদ্রাজে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা
  • ‘নিম্নগামী পরিস্রাবণ নীতি’ বাতিল
  • মাতৃভাষায় শিক্ষা প্রদান
  • নিম্নস্তরের মানুষদের শিক্ষার্জনের পক্ষে আর্থিক সাহায্য
  • ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষায় গুরুত্বারোপ
  • নারী শিক্ষায় গুরুত্বারোপ
  • বৃত্তিমূলক শিক্ষা চালু
  • মুসলিমদের জন্য আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থা
  • শিক্ষক প্রশিক্ষণ গুরুত্বের সাথে গ্রহণ

উডের ডেসপ্যাচের ত্রুটি

উডের ডেসপ্যাচ পাশ্চাত্য শিক্ষা বাস্তবায়নের জন্য যে সুপারিশগুলো করেছিল তা ছিল প্রধানত শহরকেন্দ্রিক, এই কারণে একে সাফল্যের সাথে শতভাগ বাস্তবায়ন করা যায়নি।

শেষকথা

উডের ডেসপ্যাচ ভারত ও বাংলাদেশের শিক্ষার ইতিহাসে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি ঘটনা। আজ পর্যন্ত এই দেশ বা অঞ্চলে শিক্ষা কাঠামো যেভাবে দাঁড়িয়ে রয়েছে তা মূলত উডের ডেসপ্যাচের নীতিতেই। উডের ডেসপ্যাচের লক্ষণীয় কয়েকটি দিক হলো— ডেসপ্যাচে ভারতীয়দের শিক্ষার ব্যাপারে ইংরেজ সরকারের দায়িত্ব স্বীকার; শিক্ষা প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনার উন্নতিকল্পে প্রাথমিক স্তর থেকে আরম্ভ করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত শিক্ষাদান কিভাবে চলবে এ সম্বন্ধে চিন্তাপ্রসূত সুপারিশ।

তথ্যসূত্র

  • ওহাব, এম. এ., আক্তার, সেলিনা, ও দে, সুনীল কান্তি. (২০০০). বাংলাদেশে শিক্ষা ও প্রশাসন ব্যবস্থাপনা. বাউবি.
  • Ahmad, Z. Wood’s Education Despatch. Banglapedia. https://en.banglapedia.org/index.php/Wood%E2%80%99s_Education_Despatch
  • Byju’s. Wood’s Despatch – Modern Indian History Notes. https://byjus.com/free-ias-prep/woods-despatch/

শেয়ার করুন

One thought on “শিক্ষার ইতিহাস: উডের ডেসপ্যাচ এবং উডের ডেসপ্যাচের সুপারিশ ও গুরুত্ব কী কী?

মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার তথ্য সংরক্ষিত রাখুন

লেখকতথ্য

আহমেদ মিন্টো

মিন্টো একজন ফ্রিল্যান্স লেখক এবং বিশ্লেষণ'র কন্ট্রিবিউটর।

বিশেষ শর্তসাপেক্ষে এই ওয়েবসাইটটি সামাজিক কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ কিংবা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের নিকট বিক্রি করা হবে।

শিক্ষার ইতিহাস: উডের ডেসপ্যাচ এবং উডের ডেসপ্যাচের সুপারিশ ও গুরুত্ব কী কী?

প্রকাশ: ০৫:৩৭:০৪ অপরাহ্ন, রবিবার, ১৬ জানুয়ারি ২০২২

ভারতীয় উপমহাদেশে এখন পর্যন্ত যতগুলো শিক্ষানীতি বা শিক্ষাপ্রস্তাব গ্রহণ করা হয়েছে সেগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো ‘উডের শিক্ষা প্রস্তাব’ বা ‘উডের ডেসপ্যাচ’। এখানে এই ‘উডের ডেসপ্যাচ’ আসলে কী এবং এর সুপারিশমালা সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো।

উডের ডেসপ্যাচ কী (What is Wood’s Despatch)

ভারতীয় উপমহাদেশে ইংরেজি শিক্ষা, ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষা এবং নারীশিক্ষা প্রসার ও উন্নয়নের জন্য ১৮৫৪ সালে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কর্তৃক গঠিত বাের্ড অব কন্ট্রোল-এর স্যার চার্লস উড একটি শিক্ষাপ্রস্তাব প্রণয়ন করেন ও তা সরকারের কাছে উপস্থাপন করেন; চার্লস উডের নাম অনুসারে এই শিক্ষা প্রস্তাবকে বলা হয় ‘উডের শিক্ষাপ্রস্তাব’ বা ‘উডের ডেসপ্যাচ’। উডের ডেসপ্যাচের মূল বক্তব্য ছিল পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার ঘটানো এবং মূল লক্ষ্য ছিল ভারতে ইংরেজি ও নারী শিক্ষার উন্নয়ন। উডের ডেসপ্যাচ রচনায় সদস্য ছিলেন মাত্র ১ জন,অর্থাৎ চার্লস উড নিজেই।

উডের ডেসপ্যাচকে বলা হয় ভারতীয় শিক্ষার ‘ম্যাগনাকার্টা’ বা ‘শিক্ষা অধিকার সনদ’। উডের ডেসপ্যাচ ১৮৫৪ সালে তৎকালীন গভর্নর জেনারেল অব ব্রিটিশ ইন্ডিয়া, লর্ড ডালহৌসির (Lord Dalhousie) কাছে উপস্থাপন করা হয়।

উডের ডেসপ্যাচ গৃহীত হয় ১৮৫৪ সালের ১৯ জুলাই। এই শিক্ষাপ্রস্তাবে চার্লস উড ভারতীয় উপমহাদেশে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষার সুষ্ঠু বিকাশের লক্ষ্যে এক পরিকল্পনা গ্রহণ করেন।

১৮৫৪ সালে প্রণীত ও গৃহীত হওয়া উডের ডেসপ্যাচ (Wood’s despatch) ভারতের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ, এই বিষযে কোনো সন্দেহ নেই; কারণ পরবর্তীকালে ভারতের শিক্ষা ক্ষেত্রে তথা শিক্ষা প্রশাসন ও ব্যবস্থানায় যত পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করা হয়েছে সবকিছুর মূলে উডের ডেসপ্যাচের কিছু না কিছু প্রভাব পরিলক্ষিত হয়।

ভারতীয় উপমহাদেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাপ্রস্তাব বা শিক্ষানীতি বলে অভিহিত উডের ডেসপ্যাচের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো এটি শিক্ষার ‘নিম্নগামী পরিস্রবণ নীতি’ ত্যাগ করে সাধারণ নাগরিকদের মধ্যে শিক্ষা বিস্তারের দায়িত্ব স্বীকার করে নেয়। সুতরাং, এখানে উল্লেখ করা যায় যে, স্বাধীন ভারত, পাকিস্তান আমলের পূর্ব পাকস্তান বা পূর্ব বাংলা এবং বর্তমান স্বাধীন বাংলাদেশে যে শিক্ষা ব্যবস্থা চলে আসছে তার ভিত্তি রচিত হয়েছিল ইতিহাস প্রসিদ্ধ এই শিক্ষা সংক্রান্ত দলিল উডের ডেসপ্যাচে’। 

উডের ডেসপ্যাচ যে সকল সুপারিশ করেছিল সেসবের মধ্যে বেশ কিছু হলো-

  • পৃথক শিক্ষা বিভাগ গঠন
  • বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা
  • মাতৃভাষায় শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা
  • জনশিক্ষা ব্যবস্থা
  • গ্রান্ট-ইন-এইড প্রথার প্রবর্তন
  • শিক্ষক-প্রশিক্ষণ
  • বৃত্তিমূলক শিক্ষা
  • নারী শিক্ষা ইত্যাদি

উডের ডেসপ্যাচ উপর্যুক্ত বিষয়গুলোতে গুরুত্ব প্রদানপূর্বক শিক্ষা প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনার উপর সুপারিশ পেশ করেছিল।

উডের ডেসপ্যাচের সুপারিশ

চার্লস উডের ডেসপ্যাচ এ দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ এর সুপারিশের জন্য। নিচে উডের ডেসপ্যাচের সুপারিশমালা সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেওয়া হলো—

পৃথক শিক্ষা বিভাগ ও জনশিক্ষা অধিকর্তা

উডের শিক্ষাপ্রস্তাব বা উডের ডেসপ্যাচের গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশগুলোর মধ্যে প্রধান হলো শিক্ষা প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনা সম্পর্কিত সুপারিশটি। উডের ডেসপ্যাচের  পরিকল্পনার প্রথমাংশে ছিল পৃথক শিক্ষা বিভাগের কথা।

তখন ভারতবর্ষে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি অধিকৃত স্থান ৫ টি প্রদেশে বিভক্ত ছিল। এগুলো হলো-

  1. বাংলা
  2. মাদ্রাজ
  3. বোম্বে
  4. উত্তর-পশ্চিম প্রদেশ
  5. পাঞ্জাব

তৎকালীন ভারতবর্ষের এই পাঁচ প্রদেশে ছিল প্রাদেশিক শিক্ষা বোর্ড এবং কাউন্সিল অব এডুকেশন। প্রতিটি প্রদেশে শিক্ষার দায়িত্ব কয়েকজন মনোনীত সদস্য নিয়ে গঠিত পরিষদের (Council) উপর ন্যস্ত ছিল, ফলে দেশের শিক্ষাপ্রশাসনে কোন সংহতি ছিলনা। তাই নতুন পরিকল্পনায় সমস্ত প্রদেশ থেকে শিক্ষা বোর্ড বা কাউন্সিল তুলে দিয়ে প্রত্যেকটি প্রদেশের জন্য পৃথক শিক্ষা বিভাগ (Department of Public Instruction) গঠন করার সুপারিশ করা হয়। উডের ডেসপ্যাচে বলা হয় প্রতিটি বিভাগ পরিচালিত হবে একেকজন জনশিক্ষা অধিকর্তার (Director of Public Instruction) কর্তৃক; এবং জনশিক্ষা অধিকর্তার  অধীনে থাকবে যথেষ্ট সংখ্যক দক্ষ স্কুল ও কলেজ পরিদর্শক (Inspectors of Schools and Colleges)।

পরিদর্শকগণ পতিষ্ঠান পরিচালনা, ব্যবস্থাপনা, শিক্ষাদান সম্পর্কে যথাযথ পরামর্শ দান করবেন এবং শিক্ষার সামগ্রিক উন্নয়ন সম্পর্কে সরকারের কাছে বার্ষিক রিপোর্ট দাখিল করবেন। এই ব্যবস্থায় শিক্ষা প্রশাসনে কেন্দ্রীয়করণের নীতি প্রবর্তিত হয়।

বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা

ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে ভারতে উচ্চ শিক্ষা পরিবেশন ও পরিচালনার জন্য কোনো বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়নি। তাই উডের ডেসপ্যাচের দ্বিতীয় মূল্যবান প্রস্তাব ছিল ভারতে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন। কাউন্সিল অব এডুকেশন (Council of Education) ১৮৪৫ সালে সর্বপ্রথম ভারতে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের প্রস্তাব করেছিল, কিন্তু সেই প্রস্তাব তখন অগ্রাহ্য করা হয়। তাই উডের ডেসপ্যাচে প্রস্তাব করা হয় যে, ভারতবর্ষে কলকাতা, বোম্বে, ও মাদ্রাজের স্থানে যেখানে যেখানে যথেষ্ট সংখ্যক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আছে সেখানে সেখানে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় (University of London)-এর অনুকরণে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হবে।

বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা পর্ষদ ও কার্যাবলি 

সরকার মনোনীত একজন আচার্য, একজন উপাচার্য এবং কয়েকজন ফেলো দিয়ে এই সব বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি সিনেট গঠিত হবে। পরীক্ষা গ্রহণ ও উপাধি প্রদান হবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রধান কাজ। উডের ডেসপ্যাচে অবশ্য আইন-শাস্ত্র, ইঞ্জিনিয়ারিং, সংস্কৃত চর্চা ইত্যাদি প্রয়োজনীয় বিষয়গুলোতে বিশেষ বক্তৃতাবলির বন্দোবস্ত করা এবং প্রয়োজনমত বিশেষ উপাধিদানের কথাও উল্লেখ করা হয়েছিল। কাগজে কলমে পরীক্ষা গ্রহণ ছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অধ্যাপনার আয়োজন করার জন্য পরোক্ষ নির্দেশ উক্ত ডেসপ্যাচে ছিল। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ভারতবর্ষে প্রথম যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো স্থাপিত হয় সেগুলোতে অধ্যাপনার বিশেষ কোনো ব্যবস্থা করা হয়নি। সেগুলো সম্পূর্ণ অনুমোদন ধর্মীই ছিল এবং প্রকৃত অধ্যাপনার দায়িত্ব সরকারি কলেজগুলোর উপর ন্যস্ত করা হয়েছিল।

প্রাথমিক শিক্ষা থেকে উচ্চশিক্ষার বিস্তার

শিক্ষা বিভাগ এবং বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের পরিকল্পনার পর উডের শিক্ষাপ্রস্তাবের তৃতীয় স্তরে ছিল ভারতের সর্বত্র প্রাথমিক থেকে উচ্চ শিক্ষার জাল বিস্তারের পরিকল্পনা। এই শিক্ষা স্তরের উপরে থাকবে বিশ্ববিদ্যালয় স্তরের শিক্ষা। এ শিক্ষা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক অনুমোদিত কলেজগুলোর মাধ্যমে প্রসারিত হবে। উচ্চ শিক্ষা স্তরের নিচের দিকে থাকবে মাধ্যমিক শিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলো। আর সকলে নিচের দিকে থাকবে প্রাথমিক বা দেশজ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। প্রাথমিক থেকে উচ্চ স্তর পর্যন্ত মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষা বিস্তার করা হবে।

জনশিক্ষা পরিকল্পনা

ভারতে ব্রিটিশ সরকারের নিম্নগামী পরিস্রবন নীতির ফলে শিক্ষার খাতে বরাদ্দ টাকার অধিকাংশই কলেজ স্থাপনার জন্য ব্যয় করা হতো; যে মারণে মাধ্যমিক শিক্ষা ভীষণভাবে অবহেলিত হয়েছিল। প্রচুর সরকারি অর্থ ব্যয় করে এতদিন কলেজ শিক্ষার মাধ্যমে যে উচ্চশিক্ষা দিয়ে আসা হয়েছে তাতে সমাজের উচ্চস্তর থেকে আগত মুষ্টিমেয় ছাত্র উপকৃত হয়েছে। তাই উডের ডেসপ্যাচে সুপারিশ করা হয় যে, মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বৃদ্ধি করা হোক যাতে সমাজের সকল স্তরের ছেলেমেয়োরা শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ পায়। 

উডের ডেসপ্যাচে ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদানের কথা বলা হলেও মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের স্বপক্ষেও সুস্পষ্ট নির্দেশনা দেওয়া হয়। 

উডের ডেসপ্যাচের জনশিক্ষা পরিকল্পনার তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, এগুলো হলো—

  1. নিম্নগামী পরিস্রাবণ মতবাদের বর্জন
  2. মাধ্যমিক স্তরে ভারতীয় ভাষাকে শিক্ষার মাধ্যমরূপে গ্রহণ
  3. ভারতের জাতীয় শিক্ষা পরিকল্পনায় দেশীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিকে স্বীকৃতি দান। 

সরকারি অনুদান শিক্ষা ব্যবস্থার পুনর্গঠনের উপর্যুক্ত পরিকল্পনাকে বাস্তবায়িত করতে প্রচুর অর্থের প্রয়োজন 

থাকলেও ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সরকার এককভাবে ভারতের শিক্ষার সম্পূর্ণ দায়িত্ব পালন করার পক্ষপাতি ছিল না। তাই চার্লস উড তাঁর ডেসপ্যাচে ‘ভারতীয় জনসাধারণের উপরই শিক্ষার অধিকাংশ দায়িত্ব অর্পণ করে সরকার নিজে কিছু অনুদান প্রদানপূর্বক আংশিক দায়িত্ব পালন করবে’ এমন সুপারিশ করেন। এই নীতি গ্রহণের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল যাতে দেশের জনসাধারণ শিক্ষা বিস্তারে উদ্যোগী হয়ে অধিক গ্রহণের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল যাতে দেশের জনসাধারণ শিক্ষা বিস্তারে উদ্যোগী হয়ে অধিক সংখ্যায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করে শিক্ষার দ্রুত প্রসারে সহযোগিতা করতে পারে।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহের আর্থিক সমস্যার সমাধানকল্পে উডের ডেসপ্যাচ অনুদান প্রদানের সুপারিশ করে, তবে সরকারি অনুদান পাবার জন্য সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যোগ্য হবে না।

সরকারি অনুদান পাওয়ার জন্য কিছু শর্ত জুড়ে দেওয়া হয় উডের ডেসপ্যাচে। যেসব শর্ত পূরণ করলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অনুদানের যোগ্য বলে বিবেচিত হবে যেসব হলো

  • ধর্মনিরপেক্ষভাবে সুষ্ঠু শিক্ষাব্যবস্থা পরিচালনা করবে, অবশ্য যদি কোথাও ধর্মীয় শিক্ষা দেওয়া হয় তা উপেক্ষা করা হবে;
  • স্থানীয় পরিচালনার ব্যবস্থা থাকবে;
  • সরকারি পরিদর্শনের অধিকার স্বীকার করবে ও পরিদর্শকের নির্দেশ মেনে চলবে;
  • শিক্ষার্থীদের (অভিভাবকদের) কাছ থেকে সামান্য বেতন নিবে।

সরকারি অনুদান বা গ্রান্ট ইন এইড (Grant in Aid) প্রথায় দেশের সকল শ্রেণির শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কম-বেশি উপকৃত হয়েছিল। তবে মিশনারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোই সবচেয়ে বেশি উপকৃত হয়েছিল।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সরকারের অনুদান মোটামুটি তিন শ্রেণিতে বিভক্ত ছিল: 

  1. শিক্ষকরা যাতে বেতন পান সেজন্য তার কিছু অংশ সাহায্যরূপে দান (Salary Grant)
  2. নির্দিষ্টকালের জন্য নির্দিষ্ট হারে সাহায্য দান (Fixed period Grant)
  3. পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে দান (Payment by Result)

শিক্ষক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা

সার্থক শিক্ষাদানের জন্য যথেষ্ট যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষকের একান্ত অভাব সম্বন্ধেও চার্লস উডের ডেসপ্যাচে গুরুত্বের সাথে উল্লেখ করা হয়। সার্থক শিক্ষাদানের উপযোগী শিক্ষক প্রস্তুত করার জন্য উডের ডেসপ্যাচে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের জন্য একটি নতুন পরিকল্পনা দেওয়া হয়েছিল।

শিক্ষকদেরকে উপযুক্ত প্রশিক্ষণ প্রদান করে দক্ষতা বৃদ্ধির পাঁচ প্রদেশে বিভিন্ন ধরনের ‘নর্মাল স্কুল’ প্রতিষ্ঠার সুপারিশ করা হয়। পাশাপাশি শিক্ষক প্রশিক্ষণার্থীদের বৃত্তির ব্যবস্থার নির্দেশনা দেওয়া হয়। ডেসপ্যাচ অনুযায়ী প্রশিক্ষণ শেষে সনদ প্রদান এবং চাকুরীতে নিয়োগদানের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। উল্লেখ্য, উডের ডেসপ্যাচ বাস্তবায়ন ধারাবাহিকতায় ১৯০৬ সালের ৬ জানুয়ারি প্রতিষ্ঠিত হয় ঢাকা টিচার্স ট্রেনিং কলেজ। (পড়ুন— টিচার্স ট্রেনিং কলেজ, ঢাকা)

বৃত্তিমূলক শিক্ষা ব্যবস্থা

বৃত্তিমূলক শিক্ষার প্রতি উডের ডেসপ্যাচে বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করা হয়। বৃত্তিমূলক শিক্ষার জন্য পৃথক ব্যবস্থার সুপারিশ করা হয় ডেসপ্যাচে। আইন, চিকিৎসা, কারিগরি বিদ্যা প্রভৃতি শিক্ষার জন্য পৃথক পৃথক কলেজ স্থাপনের সুপারিশ করে। বলা হয়েছিল যে, যে কলেজগুলো বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক পরিচালিত হবে। 

নারী শিক্ষা বিস্তারে গুরুত্বারোপ

উপযুক্ত ব্যবস্থার অভাবে ভারতবর্ষের নারী শিক্ষা অনেক পিছিয়ে রয়েছে যা জনশিক্ষার প্রত্যাশিত ফলাফল প্রাপ্তির অন্তরায়। ঠিক রি উপলব্ধি থেকে উডের ডেসপ্যাচ ভারতে অধিকসংখ্যক নারী বিদ্যায়তন প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা নেয় এবং অনুদান প্রথার মাধ্যমে নারী শিক্ষা বিস্তারের ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও বলা হয়।

এক নজরে উডের ডেসপ্যাচের গুরুত্ব

১৮৫৪ সালে প্রকাশিত উডের ডেসপ্যাচ কেন গুরুত্বপূর্ণ তা উপরে উল্লিখিত সুপারিশমালার সংক্ষিপ্ত আলোচনা থেকে বোঝার কথা। তবে পাঠকদের বোঝা সহজতর করার জন্য এখানে বুলেট পয়েন্টে উল্লেখ করা হলো যে, কেন উডের ডেসপ্যাচ গুরুত্বপূর্ণ।

  • সর্বস্তরের মানুষকে শিক্ষা প্রদানের সুপারিশ
  • কলকাতা, বোম্বে ও মাদ্রাজে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা
  • ‘নিম্নগামী পরিস্রাবণ নীতি’ বাতিল
  • মাতৃভাষায় শিক্ষা প্রদান
  • নিম্নস্তরের মানুষদের শিক্ষার্জনের পক্ষে আর্থিক সাহায্য
  • ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষায় গুরুত্বারোপ
  • নারী শিক্ষায় গুরুত্বারোপ
  • বৃত্তিমূলক শিক্ষা চালু
  • মুসলিমদের জন্য আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থা
  • শিক্ষক প্রশিক্ষণ গুরুত্বের সাথে গ্রহণ

উডের ডেসপ্যাচের ত্রুটি

উডের ডেসপ্যাচ পাশ্চাত্য শিক্ষা বাস্তবায়নের জন্য যে সুপারিশগুলো করেছিল তা ছিল প্রধানত শহরকেন্দ্রিক, এই কারণে একে সাফল্যের সাথে শতভাগ বাস্তবায়ন করা যায়নি।

শেষকথা

উডের ডেসপ্যাচ ভারত ও বাংলাদেশের শিক্ষার ইতিহাসে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি ঘটনা। আজ পর্যন্ত এই দেশ বা অঞ্চলে শিক্ষা কাঠামো যেভাবে দাঁড়িয়ে রয়েছে তা মূলত উডের ডেসপ্যাচের নীতিতেই। উডের ডেসপ্যাচের লক্ষণীয় কয়েকটি দিক হলো— ডেসপ্যাচে ভারতীয়দের শিক্ষার ব্যাপারে ইংরেজ সরকারের দায়িত্ব স্বীকার; শিক্ষা প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনার উন্নতিকল্পে প্রাথমিক স্তর থেকে আরম্ভ করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত শিক্ষাদান কিভাবে চলবে এ সম্বন্ধে চিন্তাপ্রসূত সুপারিশ।

তথ্যসূত্র

  • ওহাব, এম. এ., আক্তার, সেলিনা, ও দে, সুনীল কান্তি. (২০০০). বাংলাদেশে শিক্ষা ও প্রশাসন ব্যবস্থাপনা. বাউবি.
  • Ahmad, Z. Wood’s Education Despatch. Banglapedia. https://en.banglapedia.org/index.php/Wood%E2%80%99s_Education_Despatch
  • Byju’s. Wood’s Despatch – Modern Indian History Notes. https://byjus.com/free-ias-prep/woods-despatch/