১০:৫৯ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
                       

সুন্দরবন ভ্রমণে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রোমোসোম-৪৬

জেসমিন পমি
  • প্রকাশ: ১১:৪৮:৩১ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৪ মার্চ ২০২১
  • / ১১৭১ বার পড়া হয়েছে


Google News
বিশ্লেষণ-এর সর্বশেষ নিবন্ধ পড়তে গুগল নিউজে যোগ দিন

বিশেষ শর্তসাপেক্ষে এবং স্বল্পমূল্যে এই ওয়েবসাইটটি সামাজিক কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ কিংবা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের নিকট বিক্রি করা হবে।

সুন্দরবন ভ্রমণে আমাদের চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের ৪৬তম ব্যাচের শিক্ষার্থীদের (ক্রোমোসোম-৪৬) টানা তিনদিন নদীতে ভেসে কাটানোর অভিজ্ঞতা যেমন ছিল তা ধীরেধীরে বর্ণনা করা হচ্ছে বিশ্লেষণ‘র পাতায়। এটি আমার প্রথম ভ্রমণকাহিনি।

  • ১.

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে (চবি) ১৯৭৩ সালে প্রতিষ্ঠিত প্রাণিবিদ্যা বিভাগের ৪৬তম ব্যাচের শিক্ষার্থী আমরা৷ হোমো সেপিয়েন্সের ক্রোমোসোমের সংখ্যাও ৪৬ যা আমাদের ব্যাচের ক্রমের সাথে মিলে যায়। এ কারণে ভালোবেসে আমরা আমাদের এই ব্যাচের নাম দিয়েছি ক্রমোসোম-৪৬ (Chromosome-46) ।

প্রথম বর্ষে পূরণ না হওয়া স্বপ্নগুলোকে পেছনে রেখে দ্বিতীয় বর্ষের প্রাণবন্ত চপলতায় অধীর হয়ে আমরা ছুটে চলার প্রত্যয় করেছি প্রকৃতি মাতার দেওয়া অপার সৌন্দর্যের লীলাভূমি, প্রকৃতির আদরের দুলালী, ছেয়ে থাকা সুন্দরীদের জন্মভূমি সুন্দরবনে৷ প্রাণিবিদ্যা পরিবারের (চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিজ্ঞান বিভাগ) ৪৬তম ব্যাচের ৭৩ জন শিক্ষার্থীর (মেয়ে-৪৩, ছেলে-৩০) সুন্দরবন যাত্রায় অবিভাবকের  দায়িত্বে স্নেহের পরশ নিয়ে যুক্ত ছিলেন আমাদের খুবই প্রিয় দুইজন শিক্ষক। তাঁরা নিজেরা যেমন স্মার্ট তেমনই আমাদের সবসময়ই স্মার্ট নির্দেশনা দেন। আমাদের এই দুইজন পরম শ্রদ্ধেয় শিক্ষক হলে ড. ফরিদ আহসান স্যার এবং ড. মনজুরুল কিবরিয়া স্যার।

চট্টগ্রাম থেকে খুলনায় বাসযোগে যাত্রা করার জন্য ঠিক করা হলো ‘ঈগল পরিবহন’ এর দুটি বাস।

বাস-১ চট্টগ্রাম শপিং কমপ্লেক্স থেকে এবং বাস-২ চবি ক্যাম্পাসের শহীদ মিনার প্রাঙ্গন থেকে ছাড়ার জন্য সমস্ত প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হলো।

২০১৯ সালের ২রা নভেম্বর দুপুর ১টায় সেই মাহেন্দ্রক্ষণটি উপস্থিত হলো যখন আমরা খুলনার উদ্দেশ্যে রওনা করতে যাচ্ছি। অধীর আগ্রহে হুড়োহুড়ি করে বাসে উঠার জন্য আমরা অপেক্ষা করছি। আমাদের ব্যাচের চবি ক্যাম্পাসে বসবাসকারীদের অপেক্ষার উন্মাদনায় তখন মুখর হয়ে উঠেছে শহিদ মিনার প্রাঙ্গন। আগের দিন রাতে আমরা অনেকেই ঘুমোতে পারিনি কিন্তু তাও এই উন্মাদনার স্রোতে কারোরই ক্লান্তি আসছে না। বাস ছাড়ার সময় হলো দুপুর ২টা। এই ১ঘন্টা সময়ের মধ্যেই একজন একজন করে আসছিলো আর আমরা তাকে এমনভাবে অভিবাদন জানাচ্ছিলাম যেন সবাই মিলে রাজ্য জয় করতে যাচ্ছি।

আমরা যাচ্ছি বিশ্বের সবচেয়ে বড় Mangrove Forest, ১৯৯৭ সালে UNESCO ঘোষিত World Heritage Site, রামসার জলাভূমি এবং Bengal Tiger (পূর্ব নাম Royal Bengal Tiger) এর বিচরণভূমি সুন্দরবনে।

একটি সূত্র থেকে জানা যায় Heritiera fomes (সুন্দরী গাছ) নামক একটি উদ্ভিদ এই বনে প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায় বলে এই বনের নাম সুন্দরবন। সুন্দরী গাছ থেকে পাওয়া যায় শক্ত, মজবুত কাঠ যা নৌকা এবং বিভিন্ন আসবাবপত্র তৈরির কাজে লাগে৷

একটি ডকুমেন্টারিতে দেখা তথ্যমতে সুন্দরবনের আদিনাম বাদাবন। তবে এমন নাম কেন দেওয়া হলো তার কোনো ব্যখ্যা পাওয়া যায়নি। 

নামকরণ নিয়ে বিভিন্ন রকম কথা প্রচলিত থাকলেও সবাই এই ব্যাপারে একমত হবেন যে, প্রকৃতির বর্ণিল-যৌবন আর রূপ-লাবণ্যের পসরা বিলিয়ে বসে আছে এই বন তাই তার নাম সুন্দরবন। সুন্দরবনে উপস্থিত হতেই সবার মনে দোলায়িত হবে রবি ঠাকুরের সেই চরণগুলো

 “আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে কত আপনি

তুমি এই অপরূপ রূপে বাহির হলে জননী-

ওগো মা তোমায় দেখে দেখে আঁখি না ফেরে…”

একটু পেছনে গেলে দেখা যায়, মুঘল আমলে স্থানীয় এক রাজা পুরো সুন্দরবনের ইজারা নিয়েছিলেন। তবে ১৭৫৭ সালে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় আলমগীরের কাছ থেকে এই বনের স্বত্বাধিকার নেন এবং তখনই পুরো সুন্দরবনের মানচিত্র তৈরি করা হয়; আমরা সুন্দরবনের সেই মানচিত্র দেখেছি বহুল জনপ্রিয় স্পট করমজল এবং হিরণপয়েন্টে। (ছবি)

  • ০২.

বাসের জানালা দিয়ে ঘুমুঘুমু চোখে ৩রা নভেম্বরের সূর্যোদয় দেখার সৌভাগ্য আমাদের কারো কারো হয়েছিল। আর বাকিরা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন ছিলো ক্লান্তির কারণে। যাত্রাপথের বিরতিতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে আগেরদিন রাতের খাবার খাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল, এটা ছিল ক্লান্তির অন্যতম কারণ যদিও এটি ছিল আরেক রোমাঞ্চকর অনুভূতি।

খুলনা পৌঁছে কোনো নির্দেশনা না পেয়ে ভুলক্রমে বাস থেমে গেলো খুলনা রেল স্টেশনে। তখনই আমাদের বাস-২ থেকে হুট করে নেমে পড়লো আমাদের ব্যাচের অন্যতম উৎসাহী প্রাণিবিদ এবং একমাত্র লেপিডোপটেরিস্ট জহির, চট্টগ্রাম শহরের দূষিত বাতাস নিতে নিতে সে এতটাই তিক্ত ছিলো যে কোনো নির্দেশনার জন্য সবুর করতে পারছিল না। খুলনার ফুরফুরে বাতাসে নিজের ফুসফুস ভর্তি করার উন্মাদনা তাকে পাগল করে তুললো।

বাস ঘুরিয়ে ৪ নম্বর লঞ্চঘাটে যেতেই আমি যখন ‘জহির নেমেছে’ বলে জোরে হাঁক দিয়ে উঠলাম তখন শ্রদ্ধেয় ফরিদ স্যার আমাকে এই বলে আশ্বস্ত করলেন যে রেল স্টেশন থেকে লঞ্চঘাট বেশি দূরে নয়, বরিশালের ছেলে জহির তা চিনবে। আমরা আমাদের সাথে থাকা প্রধান গাইড হানিফ ভাইয়ের থেকে জানতে পারলাম এই ঘাটের অপর নাম শিকদার ঘাট। সত্যিই খুব বেশি দূর ছিলো না, বাস একটু ঘুরে চলতেই আমরা পৌঁছে গেলাম ৪ নম্বর লঞ্চ ঘাটে৷ আমাদের পরপরই এসে পৌঁছালো বাস-১।

সম্পূর্ণ অপরিচিত, অজানা এক জায়গায় জড়োসড়ো হয়ে আমরা ক্রমোসোম-৪৬ এর সবাই দাঁড়িয়ে আছি। উপভোগ করছি সকালবেলার স্নিগ্ধ পরিবেশ, মৃদু হাওয়া।

রোম্যান্স, থ্রিল, আশঙ্কা সবকিছুই একটু একটু করে উপভোগ করছি আমাদের শিরা-উপশিরার মধ্য দিয়ে। সেখানে আমাদের অভ্যর্থনা জানাতে আগে থেকেই উপস্থিত ছিলেন Royal Vision Tourism এর ৫ জন গাইড। আপাত দৃষ্টিতে দেখতে খাটো, স্বাস্থ্যবান, ফরসা, চেক শার্ট পরিহিত এক যুবক স্পষ্ট কন্ঠে নিজেকে আমাদের কাছে ‘হানিফ ভাই’ বলে পরিচয় দিলেন, যার কথা পূর্বে বলা হয়েছে। তিনি একে একে পরিচয় করিয়ে দিলেন ইয়া লম্বা গোঁফের আল-আমিন, সাব্বির , সুজন এবং আরিফ নামের বাকি ৪জন গাইডের সাথে। তাদের ভাই বলে ডাকার জন্যও নির্দেশনাও দিলেন। এমন অনাড়ম্বর সৌজন্যমূলক নির্দেশনা দেবার সময় আমরা কেউই জানতাম না ওনারা কতটা অমায়িক, বন্ধুবৎসল, বিনয়ী এবং নিয়মানুবর্তী। ওনাদের নির্দেশনা এবং সাহায্য ভ্রমণের প্রতি মূর্হুতে আমাদের জন্য অনেক সহায়ক ছিল।

ভৈরব নদীর তীরে আরো কয়েকটি জাহাজের সাথে ৪ নম্বর লঞ্চ টার্মিনাল তথা শিকদার ঘাটে দাঁড়িয়ে আছে তিন তলা বিশিষ্ট ‘এম. ভি. বিলাস ভ্রমণ’ নামক সুদর্শনা জাহাজটি। সময় তখন সকাল ৬ টা বেজে ৩০ মিনিট। জাহাজে উঠার নির্দেশনা পেতেই উৎসাহী বেগে আমরা মেয়েরা ‘লেডিস_ফার্স্ট’ নীতি অনুসরণ করে আগে আগে উঠতে লাগলাম। হানিফ ভাই মেয়েদের বলে দিলেন দ্বিতীয় তলায় উঠে নিজেদের পছন্দের কেবিন বেছে নিয়ে ঢুকে যেতে। তখনও আমরা জানতাম না পরের তিনটি দিন আমরা এই জাহাজেই থাকতে যাচ্ছি; থাকা, খাওয়া, ঘুমানো, প্রকৃতির ডাকে সাড়া প্রদান; সবই এই জাহাজেই হতে যাচ্ছে।

লোহার মজবুত সিড়ি দিয়ে দ্বিতীয় তলায় উঠেই আমি একটা দুজনার কেবিনে ঢুকে পড়লাম, যার নম্বর আমার এখনো মনে আছে; ২১৭। আমার সঙ্গী হয়েছিল আমার খুবই প্রিয় স্বল্পভাষী সহপাঠী তামান্না। আমাদের পাশের কেবিনে তখন জায়গা করে নিয়েছিল তুহিন এবং শিফা। এভাবেই দ্বিতীয় তলার প্রত্যেকটি রুমে মেয়েরা যার যার পছন্দ মত কেবিন এবং রুমমেট বেছে নেয়।

কেবিনের পরিষ্কার শুভ্র চাদরের বেডে শুয়েই যখন আমি সকালবেলার দূষণমুক্ত আসমানী আকাশের সাথে বিস্তৃত নীল জলরাশির মিতালি দেখতে পেলাম তখন আমার মনে দোলা দিয়ে গেল কবিগুরু রবি ঠাকুরের বিখ্যাত একটি কবিতা-

নমোনমো নমঃ সুন্দরী মম জননী বঙ্গভূমি—
গঙ্গার (আমার কাছে ভৈরব) তীর স্নিগ্ধ সমীর, জীবন জুড়ালে তুমি।

বিস্তৃত জলরাশির সৌন্দর্যে আমি এতই বিভোর ছিলাম যে খেয়াল করতে ভুলে গেলাম আমাদের কেবিনটার পাশেই রয়েছে চার-চারটে বাথরুম! (যেটা খুব দরকারি ছিলো এই জলভ্রমণে)

  • ০৩.

‘পেট শান্তি তো দুনিয়া শান্তি’ নীতিতে অন্যান্য জাতি কতটুকু বিশ্বাসী তা আমার জানার কথা নয়; কিন্তু আমরা ভোজনরসিক বাঙালি জাতি কায়মনোবাক্যে এই নীতিতে ভর করেই বেঁচে আছি সেটা আমি হলফ করে বলতে পারি।

সকাল-৮:০০ টা।

মেয়েরা যে যতটুকু পারি ততটুকু গুছিয়ে নিয়ে, মানে সাজ-গোজ করে আর কি, সমবেত হয়েছি জাহাজের নিচ তলার ডাইনিঙে। নারী জাতির অগ্রগামিতাকে আরো এক ধাপ এগিয়ে নিতেই প্রথমে সকালের নাস্তা করার জন্য সব মেয়েকে সুযোগ দেয়া হলো। ডাইনিঙে ছেলে-মেয়ে ৭৩ জন একত্রে বসবার মত জায়গা ছিলো না বলেই এই ব্যবস্থা।

হানিফ ভাই শুরুতেই ঘোষণা দিলেন যে, আগামী তিনদিন জাহাজ কে যেন নিজের বাড়ি মনে করেই উদরপূর্তি করা হয়। কারো কোনো সমস্যা, পছন্দ-অপছন্দ সব ব্যাপারেই যেন ওনার সাহায্য চাওয়া হয়।

পরবর্তীতে এই মানুষটি চমৎকারে ভাবেই ওনার কথা রেখেছিলেন

আমরা সবাই জাহাজে উঠার পরপরই অহেতুক সময় নষ্ট না করেই জাহাজ চলা শুরু করেছিল। ভৈরব ছেড়ে আমরা তখন পশুর নদীতে ভাসছি। সকাল ১০টা বাজতেই সোনা-মাখা রোদ্দুরে ঝলমল করছিলো আকাশ। আকাশের এই অপূর্ব ঔজ্জ্বল্য দেখতে পাচ্ছি জাহাজের ছাদ থেকে যেখানে আমাদের সাথে বসে আছে আমাদের সাথে থাকা শ্রদ্ধেয় শিক্ষক দুজন। কিবরিয়া স্যার তর্জনির ইশারায় আমাদেরকে একটু দূরের রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র দেখিয়ে দিলেন।

রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র বাগেরহাটের রামপালে অবস্থিত। সুন্দরবন থেকে মাত্র ১৪ কিলোমিটার উত্তরে পশুর নদীর তীরে অবস্থিত কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র এটি। এই কেন্দ্রটি নির্মিত হচ্ছে বাংলাদেশ এবং প্রতিবেশী দেশ ভারতের যৌথ উদ্যোগে (BPDB এবং NTPC)। ১৮৩৪ একর জমির সীমানা চিহ্নিত করা হয়েছে এই কেন্দ্রের জন্য। এর পাশ দিয়ে অতিক্রম করতেই কিবরিয়া স্যার বলে উঠলেন- রামসার কনভেনশনে দেওয়া পরিবেশ রক্ষার তথ্য অনুসারে এরকম প্রকল্প বন থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে রাখার নির্দেশ দেওয়া হলেও রামপাল প্রকল্পে তা মানা হচ্ছে না এবং অনেকেই ধারণা করছেন এটি অচিরেই সুন্দরবনকে ধ্বংস করবে’।

নদীপথে এম.ভি.বিলাস ভ্রমণে করে আরো কিছুদূর যেতেই আমরা বাংলাদেশের উপকূল রক্ষক বা বাংলাদেশ কোস্টাল গার্ড (Bangladesh Coastal Guard – BCG) এর বিশাল একটি জাহাজ দেখতে পেলাম। বাংলাদেশের সামুদ্রিক তটরেখার নিরাপত্তা এবং শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ সংস্থাটি ১৯৯৫ সাল থেকে কাজ করে যাচ্ছে। বর্তমানে এই সংস্থার অধীনে ৫৭ টি জাহাজ এবং ৩৩৩৯ জন কর্মী রয়েছে বলে জানতে পারি।

বাগেরহাটের নির্মল হাওয়া, চারদিকে অথৈ জলের ঢেউ, আকাশে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করা Brahmyni kite-এর দল আর জাহাজের ত্রিপল দেওয়া ছাদ জুড়ে বসে আছি আমরা প্রাণিবিদ্যা পরিবার তথা ক্রোমোসোম-৪৬, সাথে আমাদের শিক্ষক। মূহুর্তটির কথা ভাবতেই মন চাইছে আবারো ছুটে যেতে সেখানে।

একটু একটু করে এগিয়ে যেতেই অতিক্রম করলাম মোংলা সমুদ্রবন্দর। বাগেরহাটে অবস্থিত বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সমুদ্র বন্দর হলো মোংলা। ১৯৫০ সালে প্রতিষ্ঠিত বন্দরটি খুলনা শহর থেকে ৪৮ কি.মি দূরে অবস্থিত। পশুর এবং মোংলা নদীর সংযোগস্থলে অবস্থিত এই বন্দরটি শুরুর দিকে ‘চালনা বন্দর’ নামে পরিচিত ছিল। পণ্য পরিবহনের জন্য ২৪ ঘন্টাই খোলা থাকে বাংলাদেশের এ গুরুত্বপুর্ণ সমুদ্রবন্দর।

সকাল-১১:০০ টা।

আমরা চলে এসেছি আমাদের প্রথম স্পট করমজলের কাছাকাছি। সকাল থেকে এখন অবধি আমরা তখন পর্যন্ত কেউই খেয়াল করলাম না যে, আমাদের জাহাজের সাথে একটা বিশাল ট্রলার বাঁধা রযেছে যেটাতে অনায়াসেই ৮০ জন সংকুলান হবার মত জায়গা আছে। এই ট্রলারটাতে বসেই আমরা আজীবন গ্যালারিতে রাখার মতো কিছু ছবি তুলেছি কিবরিয়া স্যারের ক্লিকে!

ট্রলার চালানোর দায়িত্বে আছেন গায়ে সাদা পাঞ্জাবি আর মাথায় সাদা টুপি পরা একজন ভদ্রলোক। বয়স ৩০-৩৫ এর মত। হালকা-পাতলা গড়নের। মুখে মিষ্টি হাসি। ওনার কথা বলার টোন টা একটু অন্য রকম থাকলেও বেশ আকর্ষণীয় ছিলো৷ চলার পথে সুযোগ পেলেই ওনি আমাদের অনেক ছোটো-খাটো গল্প শুনিয়েছিলেন।

করমজল ইকো ট্যুরিজম সেন্টার বাগেরহাট জেলার চাঁদপাই রেঞ্জ এ অবস্থিত। সুন্দরবনে আমাদের পরিদর্শন করা একমাত্র স্পট এটি যেটাতে আমরা প্রাণিবিদ্যা পরিবার ছাড়াও আরো অনেক দর্শনার্থী উপস্থিত ছিলেন। করমজল নামকরণ এর কারণ আমি জানতে চেয়েছিলাম কিন্তু কোনো তথ্য পাইনি।

চলবে…

শেয়ার করুন

মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার তথ্য সংরক্ষিত রাখুন

লেখকতথ্য

জেসমিন পমি

শিক্ষার্থী, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

বিশেষ শর্তসাপেক্ষে এই ওয়েবসাইটটি সামাজিক কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ কিংবা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের নিকট বিক্রি করা হবে।

সুন্দরবন ভ্রমণে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রোমোসোম-৪৬

প্রকাশ: ১১:৪৮:৩১ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৪ মার্চ ২০২১

সুন্দরবন ভ্রমণে আমাদের চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের ৪৬তম ব্যাচের শিক্ষার্থীদের (ক্রোমোসোম-৪৬) টানা তিনদিন নদীতে ভেসে কাটানোর অভিজ্ঞতা যেমন ছিল তা ধীরেধীরে বর্ণনা করা হচ্ছে বিশ্লেষণ‘র পাতায়। এটি আমার প্রথম ভ্রমণকাহিনি।

  • ১.

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে (চবি) ১৯৭৩ সালে প্রতিষ্ঠিত প্রাণিবিদ্যা বিভাগের ৪৬তম ব্যাচের শিক্ষার্থী আমরা৷ হোমো সেপিয়েন্সের ক্রোমোসোমের সংখ্যাও ৪৬ যা আমাদের ব্যাচের ক্রমের সাথে মিলে যায়। এ কারণে ভালোবেসে আমরা আমাদের এই ব্যাচের নাম দিয়েছি ক্রমোসোম-৪৬ (Chromosome-46) ।

প্রথম বর্ষে পূরণ না হওয়া স্বপ্নগুলোকে পেছনে রেখে দ্বিতীয় বর্ষের প্রাণবন্ত চপলতায় অধীর হয়ে আমরা ছুটে চলার প্রত্যয় করেছি প্রকৃতি মাতার দেওয়া অপার সৌন্দর্যের লীলাভূমি, প্রকৃতির আদরের দুলালী, ছেয়ে থাকা সুন্দরীদের জন্মভূমি সুন্দরবনে৷ প্রাণিবিদ্যা পরিবারের (চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিজ্ঞান বিভাগ) ৪৬তম ব্যাচের ৭৩ জন শিক্ষার্থীর (মেয়ে-৪৩, ছেলে-৩০) সুন্দরবন যাত্রায় অবিভাবকের  দায়িত্বে স্নেহের পরশ নিয়ে যুক্ত ছিলেন আমাদের খুবই প্রিয় দুইজন শিক্ষক। তাঁরা নিজেরা যেমন স্মার্ট তেমনই আমাদের সবসময়ই স্মার্ট নির্দেশনা দেন। আমাদের এই দুইজন পরম শ্রদ্ধেয় শিক্ষক হলে ড. ফরিদ আহসান স্যার এবং ড. মনজুরুল কিবরিয়া স্যার।

চট্টগ্রাম থেকে খুলনায় বাসযোগে যাত্রা করার জন্য ঠিক করা হলো ‘ঈগল পরিবহন’ এর দুটি বাস।

বাস-১ চট্টগ্রাম শপিং কমপ্লেক্স থেকে এবং বাস-২ চবি ক্যাম্পাসের শহীদ মিনার প্রাঙ্গন থেকে ছাড়ার জন্য সমস্ত প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হলো।

২০১৯ সালের ২রা নভেম্বর দুপুর ১টায় সেই মাহেন্দ্রক্ষণটি উপস্থিত হলো যখন আমরা খুলনার উদ্দেশ্যে রওনা করতে যাচ্ছি। অধীর আগ্রহে হুড়োহুড়ি করে বাসে উঠার জন্য আমরা অপেক্ষা করছি। আমাদের ব্যাচের চবি ক্যাম্পাসে বসবাসকারীদের অপেক্ষার উন্মাদনায় তখন মুখর হয়ে উঠেছে শহিদ মিনার প্রাঙ্গন। আগের দিন রাতে আমরা অনেকেই ঘুমোতে পারিনি কিন্তু তাও এই উন্মাদনার স্রোতে কারোরই ক্লান্তি আসছে না। বাস ছাড়ার সময় হলো দুপুর ২টা। এই ১ঘন্টা সময়ের মধ্যেই একজন একজন করে আসছিলো আর আমরা তাকে এমনভাবে অভিবাদন জানাচ্ছিলাম যেন সবাই মিলে রাজ্য জয় করতে যাচ্ছি।

আমরা যাচ্ছি বিশ্বের সবচেয়ে বড় Mangrove Forest, ১৯৯৭ সালে UNESCO ঘোষিত World Heritage Site, রামসার জলাভূমি এবং Bengal Tiger (পূর্ব নাম Royal Bengal Tiger) এর বিচরণভূমি সুন্দরবনে।

একটি সূত্র থেকে জানা যায় Heritiera fomes (সুন্দরী গাছ) নামক একটি উদ্ভিদ এই বনে প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায় বলে এই বনের নাম সুন্দরবন। সুন্দরী গাছ থেকে পাওয়া যায় শক্ত, মজবুত কাঠ যা নৌকা এবং বিভিন্ন আসবাবপত্র তৈরির কাজে লাগে৷

একটি ডকুমেন্টারিতে দেখা তথ্যমতে সুন্দরবনের আদিনাম বাদাবন। তবে এমন নাম কেন দেওয়া হলো তার কোনো ব্যখ্যা পাওয়া যায়নি। 

নামকরণ নিয়ে বিভিন্ন রকম কথা প্রচলিত থাকলেও সবাই এই ব্যাপারে একমত হবেন যে, প্রকৃতির বর্ণিল-যৌবন আর রূপ-লাবণ্যের পসরা বিলিয়ে বসে আছে এই বন তাই তার নাম সুন্দরবন। সুন্দরবনে উপস্থিত হতেই সবার মনে দোলায়িত হবে রবি ঠাকুরের সেই চরণগুলো

 “আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে কত আপনি

তুমি এই অপরূপ রূপে বাহির হলে জননী-

ওগো মা তোমায় দেখে দেখে আঁখি না ফেরে…”

একটু পেছনে গেলে দেখা যায়, মুঘল আমলে স্থানীয় এক রাজা পুরো সুন্দরবনের ইজারা নিয়েছিলেন। তবে ১৭৫৭ সালে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় আলমগীরের কাছ থেকে এই বনের স্বত্বাধিকার নেন এবং তখনই পুরো সুন্দরবনের মানচিত্র তৈরি করা হয়; আমরা সুন্দরবনের সেই মানচিত্র দেখেছি বহুল জনপ্রিয় স্পট করমজল এবং হিরণপয়েন্টে। (ছবি)

  • ০২.

বাসের জানালা দিয়ে ঘুমুঘুমু চোখে ৩রা নভেম্বরের সূর্যোদয় দেখার সৌভাগ্য আমাদের কারো কারো হয়েছিল। আর বাকিরা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন ছিলো ক্লান্তির কারণে। যাত্রাপথের বিরতিতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে আগেরদিন রাতের খাবার খাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল, এটা ছিল ক্লান্তির অন্যতম কারণ যদিও এটি ছিল আরেক রোমাঞ্চকর অনুভূতি।

খুলনা পৌঁছে কোনো নির্দেশনা না পেয়ে ভুলক্রমে বাস থেমে গেলো খুলনা রেল স্টেশনে। তখনই আমাদের বাস-২ থেকে হুট করে নেমে পড়লো আমাদের ব্যাচের অন্যতম উৎসাহী প্রাণিবিদ এবং একমাত্র লেপিডোপটেরিস্ট জহির, চট্টগ্রাম শহরের দূষিত বাতাস নিতে নিতে সে এতটাই তিক্ত ছিলো যে কোনো নির্দেশনার জন্য সবুর করতে পারছিল না। খুলনার ফুরফুরে বাতাসে নিজের ফুসফুস ভর্তি করার উন্মাদনা তাকে পাগল করে তুললো।

বাস ঘুরিয়ে ৪ নম্বর লঞ্চঘাটে যেতেই আমি যখন ‘জহির নেমেছে’ বলে জোরে হাঁক দিয়ে উঠলাম তখন শ্রদ্ধেয় ফরিদ স্যার আমাকে এই বলে আশ্বস্ত করলেন যে রেল স্টেশন থেকে লঞ্চঘাট বেশি দূরে নয়, বরিশালের ছেলে জহির তা চিনবে। আমরা আমাদের সাথে থাকা প্রধান গাইড হানিফ ভাইয়ের থেকে জানতে পারলাম এই ঘাটের অপর নাম শিকদার ঘাট। সত্যিই খুব বেশি দূর ছিলো না, বাস একটু ঘুরে চলতেই আমরা পৌঁছে গেলাম ৪ নম্বর লঞ্চ ঘাটে৷ আমাদের পরপরই এসে পৌঁছালো বাস-১।

সম্পূর্ণ অপরিচিত, অজানা এক জায়গায় জড়োসড়ো হয়ে আমরা ক্রমোসোম-৪৬ এর সবাই দাঁড়িয়ে আছি। উপভোগ করছি সকালবেলার স্নিগ্ধ পরিবেশ, মৃদু হাওয়া।

রোম্যান্স, থ্রিল, আশঙ্কা সবকিছুই একটু একটু করে উপভোগ করছি আমাদের শিরা-উপশিরার মধ্য দিয়ে। সেখানে আমাদের অভ্যর্থনা জানাতে আগে থেকেই উপস্থিত ছিলেন Royal Vision Tourism এর ৫ জন গাইড। আপাত দৃষ্টিতে দেখতে খাটো, স্বাস্থ্যবান, ফরসা, চেক শার্ট পরিহিত এক যুবক স্পষ্ট কন্ঠে নিজেকে আমাদের কাছে ‘হানিফ ভাই’ বলে পরিচয় দিলেন, যার কথা পূর্বে বলা হয়েছে। তিনি একে একে পরিচয় করিয়ে দিলেন ইয়া লম্বা গোঁফের আল-আমিন, সাব্বির , সুজন এবং আরিফ নামের বাকি ৪জন গাইডের সাথে। তাদের ভাই বলে ডাকার জন্যও নির্দেশনাও দিলেন। এমন অনাড়ম্বর সৌজন্যমূলক নির্দেশনা দেবার সময় আমরা কেউই জানতাম না ওনারা কতটা অমায়িক, বন্ধুবৎসল, বিনয়ী এবং নিয়মানুবর্তী। ওনাদের নির্দেশনা এবং সাহায্য ভ্রমণের প্রতি মূর্হুতে আমাদের জন্য অনেক সহায়ক ছিল।

ভৈরব নদীর তীরে আরো কয়েকটি জাহাজের সাথে ৪ নম্বর লঞ্চ টার্মিনাল তথা শিকদার ঘাটে দাঁড়িয়ে আছে তিন তলা বিশিষ্ট ‘এম. ভি. বিলাস ভ্রমণ’ নামক সুদর্শনা জাহাজটি। সময় তখন সকাল ৬ টা বেজে ৩০ মিনিট। জাহাজে উঠার নির্দেশনা পেতেই উৎসাহী বেগে আমরা মেয়েরা ‘লেডিস_ফার্স্ট’ নীতি অনুসরণ করে আগে আগে উঠতে লাগলাম। হানিফ ভাই মেয়েদের বলে দিলেন দ্বিতীয় তলায় উঠে নিজেদের পছন্দের কেবিন বেছে নিয়ে ঢুকে যেতে। তখনও আমরা জানতাম না পরের তিনটি দিন আমরা এই জাহাজেই থাকতে যাচ্ছি; থাকা, খাওয়া, ঘুমানো, প্রকৃতির ডাকে সাড়া প্রদান; সবই এই জাহাজেই হতে যাচ্ছে।

লোহার মজবুত সিড়ি দিয়ে দ্বিতীয় তলায় উঠেই আমি একটা দুজনার কেবিনে ঢুকে পড়লাম, যার নম্বর আমার এখনো মনে আছে; ২১৭। আমার সঙ্গী হয়েছিল আমার খুবই প্রিয় স্বল্পভাষী সহপাঠী তামান্না। আমাদের পাশের কেবিনে তখন জায়গা করে নিয়েছিল তুহিন এবং শিফা। এভাবেই দ্বিতীয় তলার প্রত্যেকটি রুমে মেয়েরা যার যার পছন্দ মত কেবিন এবং রুমমেট বেছে নেয়।

কেবিনের পরিষ্কার শুভ্র চাদরের বেডে শুয়েই যখন আমি সকালবেলার দূষণমুক্ত আসমানী আকাশের সাথে বিস্তৃত নীল জলরাশির মিতালি দেখতে পেলাম তখন আমার মনে দোলা দিয়ে গেল কবিগুরু রবি ঠাকুরের বিখ্যাত একটি কবিতা-

নমোনমো নমঃ সুন্দরী মম জননী বঙ্গভূমি—
গঙ্গার (আমার কাছে ভৈরব) তীর স্নিগ্ধ সমীর, জীবন জুড়ালে তুমি।

বিস্তৃত জলরাশির সৌন্দর্যে আমি এতই বিভোর ছিলাম যে খেয়াল করতে ভুলে গেলাম আমাদের কেবিনটার পাশেই রয়েছে চার-চারটে বাথরুম! (যেটা খুব দরকারি ছিলো এই জলভ্রমণে)

  • ০৩.

‘পেট শান্তি তো দুনিয়া শান্তি’ নীতিতে অন্যান্য জাতি কতটুকু বিশ্বাসী তা আমার জানার কথা নয়; কিন্তু আমরা ভোজনরসিক বাঙালি জাতি কায়মনোবাক্যে এই নীতিতে ভর করেই বেঁচে আছি সেটা আমি হলফ করে বলতে পারি।

সকাল-৮:০০ টা।

মেয়েরা যে যতটুকু পারি ততটুকু গুছিয়ে নিয়ে, মানে সাজ-গোজ করে আর কি, সমবেত হয়েছি জাহাজের নিচ তলার ডাইনিঙে। নারী জাতির অগ্রগামিতাকে আরো এক ধাপ এগিয়ে নিতেই প্রথমে সকালের নাস্তা করার জন্য সব মেয়েকে সুযোগ দেয়া হলো। ডাইনিঙে ছেলে-মেয়ে ৭৩ জন একত্রে বসবার মত জায়গা ছিলো না বলেই এই ব্যবস্থা।

হানিফ ভাই শুরুতেই ঘোষণা দিলেন যে, আগামী তিনদিন জাহাজ কে যেন নিজের বাড়ি মনে করেই উদরপূর্তি করা হয়। কারো কোনো সমস্যা, পছন্দ-অপছন্দ সব ব্যাপারেই যেন ওনার সাহায্য চাওয়া হয়।

পরবর্তীতে এই মানুষটি চমৎকারে ভাবেই ওনার কথা রেখেছিলেন

আমরা সবাই জাহাজে উঠার পরপরই অহেতুক সময় নষ্ট না করেই জাহাজ চলা শুরু করেছিল। ভৈরব ছেড়ে আমরা তখন পশুর নদীতে ভাসছি। সকাল ১০টা বাজতেই সোনা-মাখা রোদ্দুরে ঝলমল করছিলো আকাশ। আকাশের এই অপূর্ব ঔজ্জ্বল্য দেখতে পাচ্ছি জাহাজের ছাদ থেকে যেখানে আমাদের সাথে বসে আছে আমাদের সাথে থাকা শ্রদ্ধেয় শিক্ষক দুজন। কিবরিয়া স্যার তর্জনির ইশারায় আমাদেরকে একটু দূরের রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র দেখিয়ে দিলেন।

রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র বাগেরহাটের রামপালে অবস্থিত। সুন্দরবন থেকে মাত্র ১৪ কিলোমিটার উত্তরে পশুর নদীর তীরে অবস্থিত কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র এটি। এই কেন্দ্রটি নির্মিত হচ্ছে বাংলাদেশ এবং প্রতিবেশী দেশ ভারতের যৌথ উদ্যোগে (BPDB এবং NTPC)। ১৮৩৪ একর জমির সীমানা চিহ্নিত করা হয়েছে এই কেন্দ্রের জন্য। এর পাশ দিয়ে অতিক্রম করতেই কিবরিয়া স্যার বলে উঠলেন- রামসার কনভেনশনে দেওয়া পরিবেশ রক্ষার তথ্য অনুসারে এরকম প্রকল্প বন থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে রাখার নির্দেশ দেওয়া হলেও রামপাল প্রকল্পে তা মানা হচ্ছে না এবং অনেকেই ধারণা করছেন এটি অচিরেই সুন্দরবনকে ধ্বংস করবে’।

নদীপথে এম.ভি.বিলাস ভ্রমণে করে আরো কিছুদূর যেতেই আমরা বাংলাদেশের উপকূল রক্ষক বা বাংলাদেশ কোস্টাল গার্ড (Bangladesh Coastal Guard – BCG) এর বিশাল একটি জাহাজ দেখতে পেলাম। বাংলাদেশের সামুদ্রিক তটরেখার নিরাপত্তা এবং শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ সংস্থাটি ১৯৯৫ সাল থেকে কাজ করে যাচ্ছে। বর্তমানে এই সংস্থার অধীনে ৫৭ টি জাহাজ এবং ৩৩৩৯ জন কর্মী রয়েছে বলে জানতে পারি।

বাগেরহাটের নির্মল হাওয়া, চারদিকে অথৈ জলের ঢেউ, আকাশে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করা Brahmyni kite-এর দল আর জাহাজের ত্রিপল দেওয়া ছাদ জুড়ে বসে আছি আমরা প্রাণিবিদ্যা পরিবার তথা ক্রোমোসোম-৪৬, সাথে আমাদের শিক্ষক। মূহুর্তটির কথা ভাবতেই মন চাইছে আবারো ছুটে যেতে সেখানে।

একটু একটু করে এগিয়ে যেতেই অতিক্রম করলাম মোংলা সমুদ্রবন্দর। বাগেরহাটে অবস্থিত বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সমুদ্র বন্দর হলো মোংলা। ১৯৫০ সালে প্রতিষ্ঠিত বন্দরটি খুলনা শহর থেকে ৪৮ কি.মি দূরে অবস্থিত। পশুর এবং মোংলা নদীর সংযোগস্থলে অবস্থিত এই বন্দরটি শুরুর দিকে ‘চালনা বন্দর’ নামে পরিচিত ছিল। পণ্য পরিবহনের জন্য ২৪ ঘন্টাই খোলা থাকে বাংলাদেশের এ গুরুত্বপুর্ণ সমুদ্রবন্দর।

সকাল-১১:০০ টা।

আমরা চলে এসেছি আমাদের প্রথম স্পট করমজলের কাছাকাছি। সকাল থেকে এখন অবধি আমরা তখন পর্যন্ত কেউই খেয়াল করলাম না যে, আমাদের জাহাজের সাথে একটা বিশাল ট্রলার বাঁধা রযেছে যেটাতে অনায়াসেই ৮০ জন সংকুলান হবার মত জায়গা আছে। এই ট্রলারটাতে বসেই আমরা আজীবন গ্যালারিতে রাখার মতো কিছু ছবি তুলেছি কিবরিয়া স্যারের ক্লিকে!

ট্রলার চালানোর দায়িত্বে আছেন গায়ে সাদা পাঞ্জাবি আর মাথায় সাদা টুপি পরা একজন ভদ্রলোক। বয়স ৩০-৩৫ এর মত। হালকা-পাতলা গড়নের। মুখে মিষ্টি হাসি। ওনার কথা বলার টোন টা একটু অন্য রকম থাকলেও বেশ আকর্ষণীয় ছিলো৷ চলার পথে সুযোগ পেলেই ওনি আমাদের অনেক ছোটো-খাটো গল্প শুনিয়েছিলেন।

করমজল ইকো ট্যুরিজম সেন্টার বাগেরহাট জেলার চাঁদপাই রেঞ্জ এ অবস্থিত। সুন্দরবনে আমাদের পরিদর্শন করা একমাত্র স্পট এটি যেটাতে আমরা প্রাণিবিদ্যা পরিবার ছাড়াও আরো অনেক দর্শনার্থী উপস্থিত ছিলেন। করমজল নামকরণ এর কারণ আমি জানতে চেয়েছিলাম কিন্তু কোনো তথ্য পাইনি।

চলবে…